ভালোবাসি তারে পর্ব-১৩

0
6008

ভালোবাসি তারে

১৩.
রোদের তাপটা আজকে কম। শীতল আবহাওয়া চারদিকে। অনেকটা খুশি-মনে জমিদার বাড়ি পৌঁছায় ঝুম। উঠানের বাগানে নিঝুম দাঁড়িয়ে ছিল। তিনটি গোলাপ গাছের ঠিক সামনে গম্ভীর ভাবে! হয়তো কিছু ভাবছে। ঝুমকে দেখতে পেয়ে গাম্ভীর্য যেন আরো বেড়ে গেল নিঝুমের। নিঝুম ঝুমের দিকে তাকানোতে ঝুম হালকা হাসলো। নিঝুম হাসলো না। বরং কাঠিন্য গলায় বলল,
— “এদিকে আসো ঝুম।”

ঝুম ভড়কে গেল। নিঝুম এভাবে কথা বলছে কেন? ধীর পায়ে নিঝুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ঝুম। নিঝুম কোনো কথা বলছে না। মনোযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্যে কয়েকবার কাঁশি দিলো ঝুম। তবুও প্রায় অনেক্ষণ নিশ্চুপ নিঝুম। ঝুম অধৈর্য হয়ে উঠে। বলে,
— “কেন ডেকেছেন নিঝুম ভাইয়া?”

নিঝুম মনে মনে চমকে যায়। নিঝুম ভাইয়া? ঝুম তাকে নিঝুম ভাইয়া ডেকেছে? মুহুর্তেই মনের মাঝে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল নিঝুমের। অশান্ত লাগছে ভেতরটা। ঝুম আবার বলল,
— “কিছু কি বলবেন না ডাক্তার?”

‘ডাক্তার’ শব্দটা শুনতেই একটু শান্ত হলো নিঝুম। ঝুমের দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “কিছু না। যাও!”
কপাল কুঁচকে গেল ঝুমের। জিজ্ঞেস করল,
— “মানে?”
— “ভুলে গেছি কি বলব। তাই, এখন যাও।”
ঝুম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিছু বলতে চাইলো যেন। কিন্তু বলল না। নিঝুমের দিকে একপলক তাকিয়ে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।

________________

ছোটবেলা থেকেই মিসেস সানজিদা ঝুমকে প্রচুর ভালোবাসেন। বলা যায়, নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। যার দরুণ, পারিবারিক প্রায় সব অনুষ্ঠানে ঝুম উপস্থিত থাকে। এবারো তার ব্যতীক্রম হয়নি।

নিধাকে পড়ানো শেষে ঝুম যখন বাসায় যাওয়ার জন্য বেড়োচ্ছিল তখন মিসেস সানজিদা তাকে ডেকে নিজের পাশে বসালেন। সোফার অপর প্রান্তে থাকা একটি প্যাকেট ঝুমকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
— “এটা ধর! মেঘলার হলুদে সাদা শাড়ি আর বিয়েতে বেগুনি শাড়িটি পড়বি, বুঝলি?”

ঝুম সাথে সাথেই কিছু বলল না। প্যাকেটের ভেতরের শাড়িগুলো একবার দেখে নিলো। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। শপিংমলে ঝুম যে শাড়িগুলো দেখেছিল, ঠিক সেগুলোই প্যাকেটে সুন্দরভাবে ভাঁজ করা আছে। ঝুম চিন্তায় পড়ে গেল। এগুলো কে কিনেছে? নিঝুম? মিসেস সানজিদার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে ঝুম বলল,
— “এগুলো আমার প্রয়োজন নেই আন্টি। এখন আর শাড়ি পড়তে ভালো লাগে না আমার। আপনার কাছেই রেখে দিন।”
মিসেস সানজিদা কিছু বলতে নিচ্ছিলেন। এরমধ্যেই কারো আসার শব্দ শোনা গেল। ঝুম সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, নিঝুম শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। ভ্রু কুঁচকানো তার। এসেই প্রশ্ন করল,
— “কিছু হয়েছে মা?”

মিসেস সানজিদা অভিযোগের সুরে বললেন,
— “দেখ না আব্বা, মেয়েটাকে শাড়ি গুলো দিচ্ছি, আর এই মেয়ে নিচ্ছেই না। ঝুম নাকি শাড়ি পড়া বাদ দিয়ে দিয়েছে।”

নিঝুম শীতল চাহনী নিয়ে ঝুমের দিকে তাকালো। পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। ছোট্ট করে বলল,
— “ওহ্!”

ঝুম মাথা নিচু করে চুপ রইলো। মিসেস সানজিদাও আর কিছু বললেন না। নিঝুম আবার বলল,
— “ঝুম? চলো! তোমায় তোমার বাসায় দিয়ে আসি।”
ঝুম অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। নিঝুম তাকে দিয়ে আসবে? কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ভাবার সময় পেলো না ঝুম। নিঝুম চলে যাচ্ছে। বিদায় নিয়ে ঝুমও পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।

গাড়িতে ড্রাইভিং সীটের পাশে বসল ঝুম। নিঝুম গাড়ির ডিকিতে কিছু একটা রেখে তারপর বসল ড্রাইভিং সীটে। গাড়ি চলতে শুরু করল। অথচ নিঝুম, ঝুম দুজনেই চুপ। প্রায় অর্ধেক রাস্তায় এসে নিঝুম প্রশ্ন করল,
— “মন খারাপ?”
ঝুম চমকে উঠে। নিঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।
— “না। ঠিক আছি আমি।”
— “তাহলে চুপ করে আছো কেন?”
— “এমনি। ভালো লাগছে না।”
— “তুমি না বললে তুমি ঠিক আছো?”

ঝুম বিস্মিত হয়। নিঝুম আজকে এত প্রশ্ন করছে কেন? কথায় কথায় প্যাঁচ ধরছে! ঝুম আমতা আমতা করতে লাগলো। হঠাৎ বলে উঠল,
— “আপনি এত কথা বলেন ডাক্তার?”
নিঝুম আর কিছু বলে না। মুচকি হাসে। কিছুক্ষণ পরই ঝুমের বাসায় পৌঁছে যায় তারা। ঝুম একবার নিঝুমের দিকে তাকায়। হালকা সবুজ চোখের চোখাচোখি হতেই বিনা শব্দে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। কিন্তু চলে যায় না। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে নিঝুমের কিছু বলার। নিঝুম ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
— “দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
ঝুম হকচকিয়ে যায়। মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। চলে যেতে নিলে নিঝুম আবার ডাকে,
— “ঝুম?”
ঝুমের হালকা কণ্ঠ,
— “হু?”
— “গাড়ির ডিকিতে একটা প্যাকেট রেখেছি আমি। দাও তো।”
ঝুম অবাক হয়। নিঝুম তো নিজেও পারতো কাজটা। তাকেই বলছে কেন? তবে প্রশ্ন করে না। চুপচাপ গাড়ির ডিকি থেকে প্যাকেট-টা নিলো। জানালার কাছে এসে প্যাকেট-টা এগিয়ে দিয়ে বলল,
— “নিন।”
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে। বলে,
— “লাগবে না। তুমি রেখে দাও।”

বলেই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যায় নিঝুম। ঝুম বোকা বনে যায়। কিছু একটা মনে পড়তেই তড়িৎ গতিতে প্যাকেট-টা খুলে দেখলো ঝুম। প্যাকেটের ভেতর আরেকটা প্যাকেট দেখে ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষণেই আরেকটা প্যাকেটের ভেতর সাদা আর বেগুনি রঙের শাড়ি চোখে ভেসে উঠল তার। বুঝতে বাকি রইলো না, নিঝুম কৌশলে তাকে শাড়ি দু’টো দিয়ে গেছে। নিঝুমের প্রতি ঝুমের রাগ হলো প্রচুর। ক্রুদ্ধ চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

_________________

পরেরদিন ছিল মেঘলার গায়ে হলুদ। মেঘলা যেহেতু অনাথ, শুধু করিম চাচার পরিবারের কিছু সদস্য নিয়ে একদম ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে গায়ে হলুদটি। জমিদার বাড়ির উঠানেই।

ঝুম ভেবেছিল সে লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা পরেই যাবে হলুদের অনুষ্ঠানে। কি মনে করে আর পড়েনি। হলদে রঙের একটা থ্রিপিস পড়েছে সে। জমিদার বাড়ি আসতে আসতে অনেক দেড়ি হয়ে যায় ঝুমের। উঠানে গিয়ে দেখতে পায় অনুষ্ঠান তখন প্রায় শুরুর দিকে। ঝুম সময় নষ্ট না করে মিসেস সানজিদার কাছে যায়। ঝুমকে দেখে মিসেস সানজিদা যেন মনঃক্ষুণ্ণ হন। বলেন,
— “তুই শাড়ি পড়িস নি কেন? নিঝুম তো বলল তোকে শাড়ি দিয়েছে ও!”

ঝুম কি বলবে ভেবে পায় না। আমতা আমতা করে বলে,
— “এত গরমে শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করে নি আন্টি।”
অথচ আবহাওয়া তেমন গরম নেই আজকে। মিসেস সানজিদা কিছু বলতে নিলে ঝুম আবার বলে উঠে,
— “আন্টি? আমার হাতটা ভীষণ ময়লা হয়ে আছে। আমি হাতটা ধুয়ে আসি?”

বলতে বলতেই সেখান থেকে চলে এলো ঝুম। জমিদার বাড়ির নিচ তলায় বেসিন বলতে শুধু রান্নাঘরেই আছে। আর সব উপরতলায়। সুতরাং, রান্নাঘরের দিকেই গেলো ঝুম। যাওয়ার আগে নিঝুমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। কেমন চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ঝুম উপেক্ষা করেছে সেই দৃষ্টি। তবে নিঝুমকে একবার পূর্ণদৃষ্টিতে দেখতেও ভুলে নি। সবসময়ের মতো নিঝুমকে অসাধারণ লাগছে। বিশেষ করে নিঝুমের তীক্ষ্ণ চোখজোড়া!

ঝুমের হাতে কোনো ময়লা লেগে নেই। কথাটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যে অথবা অজুহাত। কিছুক্ষণ এমনিই রান্নাঘরে অতিবাহিত করে যাওয়ার জন্য পেছনে ফিরতেই ঝুম চমকে উঠে। ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায়। নিঝুম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সারামুখ লাল হয়ে আছে তার। পাঞ্চাবীর বুকের দিকটা একটু ঘেমে আছে। হালকা সবুজ চোখজোড়া লাল আভা পেয়ে এক অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু নিঝুমের চেহারায় কাঠিন্য ভাব দেখে ঝুম মাথা নত করে ফেলে। ভীতু গলায় প্রশ্ন করে,
— “কিছু বলবেন?”

নিঝুম উত্তর দেয় না। ঝুমের উপর অদ্ভুদ ভাবে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। ঝুম তার কথা অমান্য করে শাড়ি পড়ে নি। নিঝুমের ইগোতে লাগে ব্যাপারটা। ঝুম আরেকবার ‘কি হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতেই প্রচন্ড রাগে পাশে থাকা ফুলের ঝুড়ি ছুঁড়ে মারলো নিঝুম। কিছু ফুল ছিঁটকে পড়ল ফ্লোরে। আর কিছু ফুল, ঝুড়ি সহ আঘাত হানলো দেওয়ালে। ঝুম ভড়কে গেল। তবে প্রকাশ করল না। আড়চোখে নিঝুমের দিকে তাকালো মাত্র। মনে মনে আওড়ালো,
— “তার রাগে আমি ভীতু,
তাকে দেখে আমি লজ্জায় রাঙা।
অথচ তাকে ভয় পাওয়া, তাকে দেখে লজ্জা পাওয়া, আমার ভীষণ প্রিয় অভ্যাস।”

_______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা