ভালোবাসি তারে পর্ব-৩৩

0
5163

ভালোবাসি তারে

৩৩.
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। চারপাশের পরিবেশ শীতলতায় ভরপুর। বৃষ্টির তীব্র শব্দ শুনতে পাচ্ছে ঝুম। জমিদার বাড়ির ড্রইংরুমে বসে সেই শব্দ এক মনে শুনছে সে। ঝুমের আশেপাশে মনোয়ারা শেখ নেই। হয়তো তার রুমে আছেন। সানজিদা শেখ রান্নাঘরে সবার জন্য পিঁয়াজু আর চা বানাতে ব্যস্ত।

স্নিগ্ধ, স্নিধা আর স্নেহা ঘিরে ধরেছে ঝুমকে। স্নিগ্ধ দাঁত বের করে হাসছে। ভ্রু নাঁচিয়ে ঝুমকে বলল সে,
— “নিঝুমের সঙ্গে দিনকাল কেমন কাটছে ঝুম? এনজয় করছো তো?”

লজ্জায় ঝুমের নত মাথা আরো নত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ভারী হতে শুরু করে গাল। রক্তিম আভা ফুটে উঠে। স্নিধা হেসে বলল,
— “বাহ্! বাহ্! ভাইয়ের কথা শুনতেই দেখি লাল,নীল হয়ে যাচ্ছো ঝুম আপু। এত লজ্জা কই রাখো বলো তো!”
স্নেহা বলল,
— “তা কোথায়, কোথায় ঘুরলে? নিঝুম তোমার ঠিকঠাক খেয়াল রাখছে তো ভাবী?”

সঙ্গে সঙ্গে চমকে তাকাল ঝুম। ‘ভাবী’ শব্দটা একধরণের শিহরণ বইয়ে দিলো তার ভেতরটা জুড়ে। একরাশ লজ্জায় আবারো মিইয়ে গেল সে। আস্তে বলল,
— “এ-এমন কিছুই না।”
— “তাই….?”
সবাই এক সঙ্গে মৃদু চেঁচিয়ে উঠল।

ঝুম উত্তর দিলো না। সানজিদা শেখ রান্নাঘর থেকে পিঁয়াজু আর চা ট্রে-তে করে আনতে আনতে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,
— “কি হয়েছে? চেঁচাচ্ছিস কেন তোরা?”
স্নিগ্ধ দাঁত কেলিয়ে বলল,
— “নিঝুমের বিয়ের কথা বলছিলাম মামী। নিঝুম যে কবে বিয়ে করবে!”

শেষের বাক্যটা অনেকটা আফসোসের সঙ্গে বলল স্নিগ্ধ। সানজিদা শেখ কিছু একটা ভাবলেন। ট্রে-টা টেবিলে রেখে ঝুমের পাশে বসলেন। হতাশা নিয়ে বললেন,
— “ঠিক বলেছিস। ছেলেটাকে এত বলি তবুও বিয়ে করছে না। আগে বলতো ডাক্তার হওয়ার পর বিয়ে করবে। ডাক্তার তো হলো। তবুও বিয়ের কথা এড়িয়ে যায়। কেন বলতো? এ ব্যাপারে তুই কিছু জানিস স্নিগ্ধ?”

স্নিগ্ধ মাথা নাড়ায়। না জানার ভান করে বলে,
— “না তো মামী।”
সানজিদা শেখ এবার ঝুমকে বললেন,
— “ঝুম? তোর নজরে কোনো ভালো মেয়ে আছে? ভাবছি নিঝুমের বিয়েটা এবার করিয়েই দেবো। যতই মানা করুক! শুনবো না।”
ঝুম কি বলবে ভেবে পায় না। অজানা এক আশঙ্কায় ভয় পেতে শুরু করে। কিছু বলতে পারে না। গলায় কথা আটকে আসে। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। নিঝুম এসেছে। ঝুমকে দিয়েই আবার হাসপাতালে গিয়েছিল সে। এখন ফিরল।

বৃষ্টির পানিতে পুরো শরীর ভিঁজে গেছে নিঝুমের। মাথার চুল এক হাতে ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসছে নিঝুম। ঝুমকে দেখে মুচকি হাসে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নামিয়ে ফেলে ঝুম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সানজিদা শেখকে বলে উঠে সে,
— “আম্মু? কফি উপরে পাঠিয়ে দাও। ওখানেই খাবো।”
সানজিদা শেখ জিজ্ঞেস করলেন,
— “নাস্তা করবি না?”
নিঝুম একপলক তাকালো ঝুমের দিকে। বলল,
— “রুমে পাঠিয়ে দিও।”

এতটুকু বলেই নিঝুম চলে যায় তার রুমে। ঝুমের এখন অস্বস্তি লাগছে এখানে বসে থাকতে। স্নিগ্ধরা তার দিকে তাকিয়ে কেমন মুচকি মুচকি হাসছে! তাছাড়া ঝুমেরও মন বসছে না। নিঝুমের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। নিঝুমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘ নির্লজ্জ ডাক্তার! আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। ‘
অথচ, সামনা সামনি কথাটা কখনোই বলতে পারবে না ঝুম। একদমই না।

মেঘলা কফি বানিয়ে নিঝুমের রুমে নিয়ে যাচ্ছিল। তখনই সানজিদা শেখ ধমকে উঠলেন,
— “কাল এই মেয়ের বিয়ে। অথচ দেখো এই মেয়েকে! এই মেঘলা! তোকে কাজ করতে কে বলেছে রে? এদিকে আয় আমাদের সঙ্গে গল্প কর।”
— “মাগার, কফি ক্যাডা দিবো নিঝুম ভাইজান রে?”

সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধর উত্তর প্রস্তুত।
— “ঝুম, ঝুম দিবে।”
সানজিদা শেখ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই স্নিগ্ধ আগের মতোই দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
— “ঝুমের মায়ের ব্যাপারে ঝুমের সাথে নিঝুমের কিছু কথা ছিল। তাই ভাবলাম, ঝুম কফিও দিয়ে আসুক আর নিঝুমের সাথেও দেখা করে আসুক। ঠিক ভেবেছি না মামী?”
সানজিদা শেখ বিশ্বাস করলেন না যেন। তবুও কিছু বললেন না। ঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মাত্র।

দরজা ঠেলে নিঝুমের রুমে ধীর পায়ে ঢুকলো ঝুম। পুরো রুমে একবার চোখ বোলালো। রুম একেবারে ফাঁকা। ওইদিনের মতো টেবিলে রঙ-তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিছু ইংরেজী উপন্যাসের বই পড়ে আছে টেবিলের মাঝখানটায়। ঝুম চোখ ফিরিয়ে নিলো সেখান থেকে। টেবিলে নাস্তার ট্রে রাখলো। পরপরই গুঁছিয়ে রাখতে লাগল বই এবং রঙ-তুলি। হঠাৎ পেছন থেকে নিঝুমের কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
— “ঝুমময় পিচ্চি? পাক্কা গিন্নি, গিন্নি ভাব এসে গেছে দেখছি। বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো নাকি?”

ঝুম ভড়কে গেল। তৎক্ষণাত পেছনে ফিরে চাইলো। বারান্দার দরজার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঝুম। থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত রেখে সঠান হয়ে। গলায় আকাশী রঙের তোয়ালে ঝোলানো। ঝুম চেয়েই রইল সেদিকে। জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি এতক্ষণ বারান্দায় ছিলেন?”

নিঝুম নিরুত্তর। মুখের তৃপ্ত হাসি মজায় রেখে এগিয়ে এলো সে। ঝুমের সামনা-সামনি দাঁড়ালো। প্রশ্ন করল,
— “কি করছিলে করো! আমি দেখছিলাম।”
ঝুম আবারো ভড়কালো। আর্তনাদ করে উঠলো,
— “আপনি পাগল হয়ে গেছেন ডাক্তার।”
নিঝুমের থমথমে গলা। অথচ শীতল চাহনি।
— “এদিকে আসো। চুল মুছে দিবে।”
ঝুম বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলে,
— “কি বলছেন এসব?”

নিঝুম জবাব দিলো না। চুপচাপ বসে পরল বিছানায়। অপেক্ষায় রইল ঝুমের। ঝুম খেয়াল করে নিঝুমের চুল ভেঁজা। বিন্দু বিন্দু পানি কণা একাধারে চুল থেকে গড়িয়ে তোয়ালে ও পরনের টি-শার্ট ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে করে চুল মুছে নি নিঝুম। যেন সে জানতো ঝুম আসবে। ঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ডাক্তার দিন দিন উম্মাদ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনে মনে ভালোই লাগছে ঝুমের।

নিঝুমের কাঁধ থেকে তোয়ালে হাতে নিলো ঝুম। ধীরে ধীরে চুল মুছে দিতে লাগল। নিঝুম চোখ বন্ধ করে আছে। ঝুমের স্পর্শ অনুভব করছে সে। এক-দুই সেকেন্ড পর নিঝুম হঠাৎ বলে উঠে,
— “আমার উত্তরটা এখনো দাও নি তুমি ঝুম।”

ঝুম হকচকিয়ে যায়। প্রশ্ন করে,
— “জ্বী?”
— “আমার উত্তর চাই ঝুম। এখনই।”
ঝুম চুপ রয় কিছুক্ষণ। ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বলে,
— “আব্বা-আম্মাকে ভীষণ ভালোবাসি আমি ডাক্তার। তাদের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করা অসম্ভব আমার পক্ষে।”

নিঝুম অনেক্ষণ কিছু বলল না। ঝুম চুল মোছা শেষে তোয়ালে মেলে দেয় বারান্দায়। ফিরে এসে বসে নিঝুমের পাশে। অপেক্ষা করে নিঝুমের কিছু বলার। কিন্তু না। নিঝুম কিছু বলছে না। চুপ সে। হঠাৎ কি যেন হলো। ঝুম জড়িয়ে ধরল নিঝুমকে। বুকের বা’পাশটায় মাথা রেখে ফুঁফিয়ে উঠল,
— “আপনি কি রাগ করেছেন ডাক্তার? প্লীজ রাগ করবেন না। আমি মনে-প্রাণে আপনাকে চাই। কিন্তু আব্বা-আম্মার সম্মতিতে।”

নিঝুম চাইলে ঝুমের বাবা-মাকে রাজী করাতে পারত তাদের বিয়ের জন্য। কিন্তু… কিন্তু দেড়ি করে ফেলেছে সে। আলম খানকে নিঝুম যতটুকু জানে, আলম খান কথা দিয়ে কথা ভাঙ্গার মানুষ নন। তারওপর বিয়ের কথা এতদূত এগিয়ে আসার পর পিছ পা কখনোই হবেন না তিনি। বরং এগিয়ে যেতে উদ্যোগী হবেন। নিঝুম চায় না ব্যর্থ চেষ্টা করতে। সে চায় দাবার আসল গুটি হস্তক্ষেপ করতে!

নিঝুমের উত্তর না পেয়ে ঝুম সরে যেতে চাইলো। নিঝুম দিল না। আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
— “আরো কিছুক্ষণ থাকো। ভালো লাগছে।”
এবার আর নড়ে না ঝুম। চোখ দু’টো বুজে লেপ্টে রয় নিঝুমের সঙ্গে!

___________________

সকাল পৌনে ৮টা। এতক্ষণে ঘুম ভেঙ্গেছে ঝুমের। আড়মোড়া ভেঙ্গে আস্তে আস্তে চোখ খুললো ঝুম। তার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে নিধা। সেদিকে একপলক তাকালো সে। পরক্ষণে ঘড়িতে তাকাতেই চট করে উঠে বসল। এত বেলা করে উঠেছে সে। নিঝুম কি এতক্ষণে হাসপাতালে চলে গেছে?

দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল ঝুম। মনে মনে শান্তনা দিলো নিজেকে। নিঝুম যায় নি। হয়তো নিচে গিয়েই দেখবে টেবিলে বসে নাস্তা করছে সে। কিন্তু আফসোস! বাড়ির সবাই অনেক আগেই নাস্তা করে ফেলেছে। নিঝুমও নাস্তা করে চলে গেছে হাসপাতালে। খানিকটা অভিমান জমলো ঝুমের মনে। তাকে কি একটু বলে যাওয়া যেত না? মন খারাপ করে সোফায় বসে পরল ঝুম। আশেপাশে সবাই কাজে ব্যস্ত। মেঘলা বিয়ের ছোটখাটো অনুষ্ঠান হবে। তারা, তারাই শুধু! তাই বিশেষ সাজানো হচ্ছে না। কাঁচের টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভি অন করে একে একে চ্যানেল পাল্টাতে লাগল ঝুম।

হঠাৎ! ঝুমের সামনে সময় টিভি চ্যানেলে রুপকের ছবি ভেসে উঠলো। ঝুম বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এ লোককে টিভিতে দেখাচ্ছে কেন? সেলেব্রিটি-ফেলিব্রিটি হয়ে গেল নাকি আবার? কৌতুহল দমাতে না পেরে হেড লাইন পড়ল ঝুম। যেখানে স্পষ্ট লেখা,

— ‘ ড্রাক ও মাদক সেবন ও ব্যবসা এবং প্রতিনিয়ত ঘুঁষ দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার অপরাধে গ্রেফতার যুবক জারিফ রুপক এবং পুলিশ আজমান সরকার।’

__________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia