ভালোবাসি তারে
৩৪.
ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘলা, মেঘলা চারপাশ। হয়তো আবারো বৃষ্টি হবে। নীল রঙা শাড়ি পড়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ঝুম। একমনে বাহিরের অশান্ত পরিবেশটা দেখছে সে। ইতোমধ্যে বৃষ্টির পূর্বের তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে আকাশে। ঝুমের ভেতরটাও ভীষণ উত্তেজনায় চূর্ণবিচূর্ণ! তোলপাড় চলছে বুকের বা’পাশটায়। বার বার ঠোঁট কামড়ে লম্বা, লম্বা নিশ্বাস নিচ্ছে সে। এমন সময় বেশ কয়েকবার মৃদু ভাবে দরজার কারাঘাত শোনা গেল। ঝুম চমকে উঠল। পেছনে ফিরে উঁচু গলায় বলল,
— “দরজা খোলা আছে।”
দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করল নিঝুম। হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবী পড়েছে সে। গালে চাপ দাঁড়ি, ঠোঁটে হাসি। তার নীলচে চোখ জোড়াও জ্বলজ্বল করছে। দারুণ লাগছে দেখতে! ঝুম চেয়েই রইল সেদিকে। নিঝুম মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। বলল,
— “নীল শাড়ি পড়েছ যে? হিমুর রুপা সেজেছো নাকি?”
ঝুম অবাক হয়ে বলল,
— “আমি কেন হিমুর রুপা সাজতে যাবো? আমি তো আপনার জন্য সেজেছি।”
মুখ ফসকে কথাটা তরতর করে বলে ফেলে ঝুম। পরক্ষণেই কি বলেছে বুঝতে পেরে লজ্জায় দ্রুত চোখ,মুখ খিঁচে মাথা নত করে রয়। নিঝুমের হাসি তীব্র হয় এতে। নীলচে চোখে ফুটে উঠে দুষ্টুমীর আভা। ঝুমের নাক টেনে প্রশ্ন করে,
— “কেন রুপা? আমাকে কি তোমার হিমুর মতো লাগছে না?”
লজ্জায় ঝুমের গাল ভারী হতে শুরু করে। লজ্জা ঢাকতে মিনমিনিয়ে অভিযোগ করে উঠে,
— “আপনি অনেক খারাপ ডাক্তার। সবসময় এমন করেন কেন?”
নিঝুম শব্দ করে হেসে উঠে। ঝুমের কানের কাছে ঝুঁকে বলে,
— “ঝুমময় পিচ্চি, উহু! আমার লজ্জাবতী।”
নিঝুমের কণ্ঠে যেন হাজারো নেশার ভীড়। ঝুম কেঁপে কেঁপে উঠে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিছু বলতে পারে না। নিঝুম সরে দাঁড়ায়। ঝুমের কাঁপাকাঁপি দেখে কিছুক্ষণ। ‘ঝুম’ – নিঝুমের জন্য তার বুকে সৃষ্ট তীব্র ব্যথার নাম। যে ব্যথা ঝুমকে কাঁপতে দেখে আরো ভয়ংকর হচ্ছে। নিঝুম আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চুপচাপ চেয়ে রয় ঝুমের মুখপানে।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঝুম শান্ত হয়। তবুও কাঁপাকাঁপির রেশ কাটছে না। কাঁপা গলায় সে বলল,
— “একটু আগে আব্বা ফোন দিয়েছিল ডাক্তার।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকালো।
— “কেন?”
— “কেন মানে? আপনি জানেন না কেন?”
— “আমি কিভাবে জানবো?”
ঝুম চোখ ছোট ছোট করে তাকালো এবার। তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “রুপককে কে জেলে পাঠিয়েছে ডাক্তার?”
নিঝুম ভারী অবাক হয় যেন। অবাকের আভা ফুটিয়ে তুলে সম্পূর্ণ চেহারায়। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলে,
— “রুপক কে যেন? তোমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে না? আচ্ছা। ও জেলেও চলে গেছে?”
নিমিষেই ঝুমের কাঁপাকাঁপি থেমে যায়। ফুঁসে উঠে সে। ভ্রু দু’টো কুঞ্চিত করে মৃদু ধমক দিয়ে উঠে,
— “একদম না চেনার ভান করবেন না। সত্যি করে বলুন! আপনি রুপককে জেলে পাঠিয়েছেন, তাই না?”
ধরা পড়ে যাওয়ায় হাসলো নিঝুম। ঝুম আবারো বলল,
— “আপনি রুপকে জেলে পাঠালেন কিভাবে?”
নিঝুম উত্তর দিলো না। ঝুমের কোমড় জড়িয়ে ধরল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ছোঁয়ালো। আদুরে গলায় বলল,
— “কিছু জিনিস গোপন থাকা ভালো ঝুম।”
ঝুম পাল্টা প্রশ্ন করে না। চোখ বন্ধ করে নেয়। নিঝুমের স্পর্শে ঝুম শক্ত হয়ে আছে। বুকের তোলপাড় ক্রমে ক্রমে তীব্র হচ্ছে। হাত,পা মাত্রারিক্ত কাঁপছে। আগের চেয়েও বেশি! ঝুমের ডাক্তার যেন ঝুমকে কাঁপাতে কাঁপাতেই মেরে ফেলবে। তবুও ঝুম রাজী। শত বার রাজী!
বাহিরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। সেই ঝড়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে ঝুম,নিঝুম দু’জনেই। অথচ চোখ বন্ধ করে আগের মতোই দাঁড়িয়ে তারা। ঝুম সাহস জোগালো মনে। আস্তে আস্তে নিঝুমের বুকে মাথা রাখলো। কণ্ঠে একরাশ আবেগ মিশিয়ে বলল,
— “ভালোবাসি ডাক্তার।”
মুহুর্তেই নিঝুম ‘থ’ হয়ে যায়। তার বুকে মাথা রেখে দাঁড়ানো, ঝুমের আদো আদো দেখতে পাওয়া চেহারার দিকে দ্রুত তাকায়। ঝুম পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে আছে। নিঝুমের মনে হলো, সে স্বার্থক। নিজের সারাটাজীবন ঝুমকে দেখে পার করে দিতে পারবে সে। এক উম্মাদ প্রেমিক হবে। আগলে রাখবে তার প্রিয়তমাকে। ঝুমের দিকে চেয়েই নিঝুম ফিসফিসিয়ে বলল,
— “ভালোবাসি।”
৯
সামান্য দুরত্বে মেঘলা আর আকাশের কাবিন পড়াচ্ছে। কাজি কবুল বলতে বলছে তাদের। ঝুম সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মনোয়ারা শেখের দিকে নজর গেল তার। মুখ কুঁচকে রেখেছেন তিনি। হয়তো ঝুমের উপস্থিতি তার পছন্দ হচ্ছে না। কিংবা বাড়ির কাজের লোকের বিয়ে এত ধুমধাম করে করছে বিধায় উনার ভালো লাগছে না। মেঘলার বিয়ে ছোটখাট করে হওয়ার কথা হলেও বিনা দাওয়াতেই গ্রামের অনেকেই এসে হাজির হয়েছেন অনুষ্ঠানে। তাই বাড়ির প্রত্যকেই ব্যস্ত। খাবার সর্ট পরতে পারে। বাবুর্চি দিয়ে আরো রান্না করাচ্ছেন তারা। সবার এত আগ্রহ আর ব্যস্ততাই হয়তো মনোয়ারা শেখের বিরক্তির কারণ।
আচমকা ঠান্ডা কিছু ঝুমের আঙুলে লাগতেই ভয় পেয়ে গেল ঝুম। পাশ ফিরে দেখল নিঝুম দাঁড়িয়ে। ঠান্ডা, ঠান্ডা কোল্ডড্রিংক পান করছে সে। ঝুম তাকাতেই নিঝুম বলল,
— “খাবে?”
ঝুম মাথা নাড়ালো। সে খাবে না। নিঝুমও কিছু বলল না। খাওয়া শেষে চুপচাপ অন্যদিকে চলে গেল। কি মনে করে গ্লাস রেখে আবারো ঝুমের পাশে এসে দাঁড়ালো নিঝুম। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “ইমার্জেন্সি পরেছে। হাসপাতালে যেতে হবে। নিজের খেয়াল রাখবে। আসি।”
ঝুম কিছু বলল না। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল নিঝুমের দিক।
__________________
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। ঝুম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঘলা আর আকাশকে দেখছে। কত হাসি খুশি লাগছে তাদের। একদিন তার আর নিঝুমেরও বিয়ে হবে। তারাও একদিন এক হয়ে যাবে। ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল ঝুমের। হাজারো স্বপ্নের বেরা জালে আটকে পরল নিমিষেই।
হঠাৎ নিজের গালে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল ঝুম। হাত চলে গেল গালে। ঝুম ছিটকে উঠল। যখন মস্তিষ্ক জানান দিলো তাকে কেউ চড় মেরেছে, সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে তাকাল সে। মিসেস শ্রেয়াকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো অবাক হলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই মিসেস শ্রেয়া চেঁচিয়ে বললেন,
— “চুপ! একদম চুপ! কোনো কথা বলবি না তুই। একটুও লজ্জা করল না তোর? আমাদের সম্মানের কথা একটা বারও ভাবলি না?”
সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ঝুমের। কিছু বুঝতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে মিসেস শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। আলম খানের উপর চোখ যেতেই দেখল তিনি মাথা নত করে আছেন। অত্যন্ত লজ্জিত গলায় তিনি বললেন,
— “মাফ করবেন, ভাই। আমি বুঝতে পারি নি আমার মেয়ের এমন করবে। আমার মেয়েকে বাচ্চা মনে করে মাফ করে দিন।”
সাথে সাথে ঝুমের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। আলম খানের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায় সে। ঝুম বুঝতে পারছে না, তার অপরাধটা কোথায়? শাখাওয়াত শেখ নম্র গলায় বললেন,
— “একা নিজেকে দোষারোপ করবেন না। দোষ কিছুটা আমার ছেলেরও আছে।”
মনোয়ারা শেখ প্রতিবাদ করে উঠলেন,
— “একদম নিঝুমের দোষ দিবে না ভাইয়া। এই মেয়েই নিঝুমকে ফাঁসিয়েছে। যেই দেখেছে ছেলে ভালো, টাকাওয়ালা ওমনি ঝাঁপিয়ে পরেছে। আর কি কি করেছে কে জানে! নিঝুমকে তো একেবারে বশ করে ফেলেছে। ভাগ্যিস উনি (একজন মহিলা) এই লোভী মেয়েকে নিঝুমের সাথে এক রুমে নষ্টামী করতে দেখে ফেলেছিল। নাহলে যে কি হতো! হয়তো এই মেয়ে নিঝুমকে নিজের জালে ফাঁসিয়ে বিয়েও করে ফেলতো। বেয়াদপ বলে কথা!”
আলম খান চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “ভুলেও এমন কথা দ্বিতীয় বার বলবেন না। আমার মেয়ে কেমন আমরা জানি। আর শাখাওয়াত সাহেব, মাফ করবেন। এত অপমান সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। আমি নিঝুমকে চিনি। আপনিও আমার মেয়েকে চিনেন, জানেন। ঝুম কেমন তা আপনাদের অজানা নেই। তাই দয়া করে এমন বাজে কথা বলবেন না আমার মেয়ের নামে।”
মুহুর্তেই বিয়ের হাসোজ্জ্বল পরিবেশ আড়াল হয়ে এক আলাদা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল চারপাশে। সবার আলোচনা ঝুম আর নিঝুমকে নিয়েই। কেউ কেউ মনোয়ারা শেখের পক্ষে কথা বলছে তো, কেউ কেউ ঝুমের পক্ষে। আবার কেউ বলছে,
— “মাস্টারের মেয়ে এমন হবে কে জানতো? আমিও অনেকবার দেখেছি এই মেয়েকে জমিদারের ছেলের সাথে। একবার তো কোলেও নিতে দেখেছি। আল্লাহ্ জানে, হয়তো আরো পাপ কাজ করছে।”
সব শুনে ঝুম স্তব্ধ হয়ে গেছে। হজম করতে পারছে না। যন্ত্রণায় চোখ থেকে পানি গরিয়ে পড়ছে অনবরত। গুঞ্জন শুনে স্নিগ্ধ চিৎকার করে উঠল,
— “সবাই চুপ থাকুন দয়া করে। প্লীজ!”
কিছুটা হলেও শান্ত হলো চারপাশ। স্নিগ্ধ এবার নরম সুরে শাখাওয়ায় শেখকে বলল,
— “মামা, ঝুম আর নিঝুম একে অপরকে ভালোবাসে। হয়তো কয়েকদিন পর নিঝুম নিজেই এ কথা বলতো তোমাদের। যেহেতু সব জেনেই গেছ… ওদের বিয়ে দিয়ে দাও। এটাই ওদের জন্য ভালো হবে।”
মনোয়ারা শেখ স্নিগ্ধর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালেন। স্নিগ্ধ তবুও থামলো না। স্নিগ্ধর কথায় সায় দিলেন সানজিদা শেখও। যদিও এসব জানতেন না তিনি। শাখাওয়াত শেখ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
— “আমি নিঝুমের বিয়ে ঝুমের সাথে দিতে রাজী আছি। আলম সাহেব, আপনার মতামত কি?”
আলম খান কিছু বলতে চাইলেন। পারলেন না। তার আগেই মনোয়ারা শেখ বিরোধিতা করে উঠলেন,
— “এমন করবে না ভাইয়া। এ নষ্টা মেয়েকে আমি কখনোই নিঝুমের বউ হিসেবে মানবো না। দেখা যাবে আরেকটা বড়লোক ছেলে পেলেই নিঝুমকে ছেড়ে ঐ ছেলেকে ধরবে। মাঝখান দিয়ে নিঝুম ভুক্তভুগী হবে। আর এটা আমি কিছুতেই মানবো না।”
আলম খান রেগে গেলেন এবার। গম্ভীর গলায় বললেন,
— “আমি আপনার প্রস্তাবে রাজী হতে পারছি না শাখাওয়াত সাহেব। যেখানে আমার মেয়েকে এত অসম্মানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সেখানে আমি কখনোই আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না।”
এতটুকু বলেই ঝুমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন আলম খান। ঝুম চুপচাপ জড়বস্তুর মতো হাঁটতে লাগলো। ‘টু’ শব্দটিও করল।
কিন্তু যখন বাসায় আসলো! ড্রইংরুমের ফ্লোরে বসে আহাজারি করে উঠলো ঝুম। চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মিসেস শ্রেয়া চড়, থাপ্পড়, গালাগাল, যা পারছেন করছেন। তবুও থামার নাম নেই ঝুমের। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলছে সে,
— “আমি নিঝুমকে ছাঁড়া বাঁচবো না আব্বা। বাঁচবো না!”
‘ভালোবাসা কোনো উপন্যাস বা কবিতার লাইনের মতো সুন্দর না, ভালোবাসা বিশ্বাসী ভাইরাস, খুব ছোঁয়াচে।’
-স্বপ্নীল চক্রবর্ত্তী
__________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা