ভালোবাসি তারে পর্ব-৩৬

0
5080

ভালোবাসি তারে

৩৬.
রাতে ঝড়ো হাওয়ার তান্ডব শুরু হয়ে গেল প্রবল বেগে। কালবৈশাখী হয়তো। নিঝুম ঠিক জানে না। নদীর কাছের পিচঢালা আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি থামায় সে। বন্ধ জানালা গলিয়ে চেয়ে থাকে প্রকৃতির অশান্ত তোলপাড়ের দিক। মৃদু বৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পানিগুলো বাতাসের তালে, তালে দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে। গাছের সতেজ ডাল, পাতা ঝড়ের বেগ সামলাতে না পেরে ঝোড়ে যাচ্ছে নিমিষেই। কিছু পাতা বন্ধ জালানার গ্লাসে এসে আটকে যায়। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ সরিয়ে নেয় বাহির থেকে। সীটে হেলান দিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রয় অনেক্ষণ।

ফোনের রিংটোনের শব্দে চোখ মেলে তাকায় নিঝুম। স্ক্রীনে গুটিগুটি অক্ষরে স্নিগ্ধর নাম ভেসে উঠছে। নিঝুম ফোনটা হাতে নিলো। আবারো চোখ বন্ধ করে সীটে মাথা ঠেকে বসল। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে স্নিগ্ধর রাগী কণ্ঠ,
— “কোথায় তুই? দিন দুনিয়ার খেয়াল আছে? মামী কত চিন্তা করছে তোর জন্য! কারো ফোনও ধরছিস না। কেন?”

নিঝুমের নির্লিপ্ত ভাব। যেন কিছুই হয় নি। শান্ত গলায় সে বলল,
— “আমার আসতে দেড়ি হবে। আম্মুকে চিন্তা করতে মানা কর। আমি ঠিক আছি।”
— “আমি বলতে পারবো না। তুই এখনই আসবি বাসায়।”
নিঝুম উত্তর দিলো না। স্নিগ্ধ আশা ছেড়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। বলল,
— “আমরা চলে যাবো একটু পর। আম্মু এখানে থাকতে চাইছে না। তুই তাড়াতাড়ি আয় বাসায়। মামী না খেয়ে বসে আছে।”

তপ্ত নিশ্বাসগুলো যেন ঘিরে ধরল নিঝুমকে। চোখ মেলে গাড়ির আয়নায় নিজের রক্তলাল চোখের দিকে একবার তাকায় নিঝুম। বলে,
— “আসছি।”

কলটা কেটে আবার ফোনের মেসেঞ্জারে ঢোকে সে। মেসেজের সারিতে সর্বপ্রথম ঝুমের নামটা ভেসে উঠে। ‘লজ্জাবতী পিচ্চি’ নামে সেভ করা ঝুমের সঙ্গে খুব অল্পই মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছে তার। শেষ মেসেজটা ছিল ঝুমের। লিখেছিল,

— ‘নাস্তা করেছেন ডাক্তার? আমি জানি করেন নি। নাস্তা খাওয়ার সময় আমাকে মেসেজ দিবেন কিন্তু। আপনি আর আমি একসাথে নাস্তা করব।’

বিড়বিড় করে পড়ল নিঝুম। বেশ কয়েকবার পড়তেই থাকল। মেসেজটা আজকের। নিঝুমের বুকটা কেমন করে উঠল যেন। পাথরের মতো শক্ত লাগতে লাগল ভেতরটা। খানিকটা তাচ্ছিল্য করে হাসার চেষ্টা করল নিঝুম। আজ সকাল অব্দিও সব ঠিক ছিল। অথচ এখন…

ফোনের স্ক্রিনে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলতো হাতে টাইপ করল নিঝুম, ‘ভালোবাসি লজ্জাবতী।’
তারপর আরো কিছুক্ষণ প্রকৃতির উথাল-পাতাল দেখল। পরপরই গাড়ি স্টার্ট দিলো জমিদার বাড়ির পথে।

১১

রাত ১২টায় বাসায় ফিরে নিঝুম। সানজিদা শেখ সোফায় বসে ছিলেন। নিঝুমকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ক্ষীপ্ত গলায় তৎক্ষণাত বললেন,
— “এখন ফেরার সময় হলো তোর? এত বেপরোয়া কেন তুই? আমি কত চিন্তা করছিলাম জানিস?”

নিঝুম শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খুলে, আস্তে ধীরে শার্টের হাতা বটে,বটে হাফ হাতা করতে লাগল। সানজিদা শেখ ছেলের বিষণ্ণ মুখ দেখে শান্ত হলেন একটু। নিঝুমের পাশে বসলেন। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি হইছে বাপ? ঝুমের বাবার রাগ কি কমে নাই?”
— “না।”
ছোট্ট করে উত্তর দিলো নিঝুম।

সানজিদা শেখ আবার বললেন,
— “তোরে কিছুই বলে নাই? ঝুমকে কি তোর সাথে বিয়ে দিবে না?”
নিঝুম হতাশা নিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “জানি না আম্মু। উনি স্পষ্ট ভাবে কিছু বলছেন না।”

সানজিদা শেখেরও মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ করে বললেন,
— “আমি দেখি, তোর আব্বুর সাথে কথা বলব।”
নিঝুম প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। সানজিদা শেখ বললেন,
— “তোর ফুফি তো চলে গেছে।”
— “জানি। স্নিগ্ধ বলেছে।”
— “কিছু খেয়েছিস?”
— “না।”
— “ফ্রেস হয়ে আয়। খাবার বাড়ছি।”

নিঝুম বিনা বাক্যে মেনে নিলো। মৌন থেকে সম্মতি দিলো। সম্মতি পেয়ে সানজিদা শেখ দ্রুত চলে গেলেন খাবার বাড়তে। নিঝুম তখন সিঁড়ির বেয়ে উপরে উঠছিল। কয়েক সিঁড়ি উঠতেই হঠাৎ সানজিদা শেখ অভিযোগ করে উঠলেন,
— “নিঝুম? তুই আমাকে ঝুমের কথা আগে বলিস নি কেন? আমি কিন্তু রাগ করেছি।”

নিঝুম হালকা হেসে দিল। কিছু না বলেই চলে গেল উপরে।

____________________

দু’দিন হলো ঝুমকে বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছেন না মিসেস শ্রেয়া। ফোনও নিয়ে রেখেছেন। এ দুদিন নিঝুমের সঙ্গে কথা, দেখা কিছুই হয় নি তার। ঝুমের কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। প্রতিনিয়িত কান্না পাচ্ছে। আজ বহু কষ্টে মিসেস শ্রেয়াকে কলেজ যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয়েছে ঝুম। কলেজ গিয়েই সর্বপ্রথম নিজের প্রিয় বান্ধবীর ফোন দিয়ে নিঝুমকে মেসেজ করেছে। নিঝুমকে আসতে বলেছে কলেজে।

কলেজ ছুটি হয়েছে মাত্র। ঝুম আস্তে আস্তে কলেজের পেছনের দিকে এগোচ্ছে। কলেজের পেছনে রয়েছে একটা পিচঢালা রাস্তা। সেই রাস্তার কাছাকাছি আসতেই ঝুম কিছু দূরে নিঝুমের গাড়ি দেখতে পায়। গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম। বিষণ্ণ মুখ, উষ্কখুষ্ক চুল! সর্বদা নিজেকে গুছিয়ে রাখা মানুষটা আজ বড্ড অগোছালো। ঝুমকে দেকে নিঝুম দূর্বল হাসলো। কিছু না বলে গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে পরল সে। নিঝুমের স্পষ্ট ইঙ্গিত ঝুমকে গাড়িতে বসতে বলছে। ঝুমও বিনা বাক্যে বসে পড়ে গাড়িতে। এবং সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দেয় নিঝুম।

গাড়ি থামলো শহরের একটা নির্জন স্থানে। আশপাশটা বেশ সুন্দর। সবুজে ঘেরা! গাছপালায় ভরা! এতটুকু সময়ে নিঝুম, ঝুম কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে নি। মৌনতা ভেঙ্গে ঝুম এবার জিজ্ঞেস করল,
— “এটা কোন জায়গা ডাক্তার?”
— “এয়ারপোর্টের পেছনের সাইট।”

ভরাট গলা নিঝুমের। ঝুমেরর কৌতুহল বেড়ে যায়। এ বিষয়ে আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে, তার পূর্বেই ফোন বেজে ওঠে নিঝুমের। নিঝুম বিরক্ত হয় যেন। তবুও কল রিসিভ করে বিরক্ত সহিত বলে উঠে,
— “হ্যাঁ, বলো ডক্টর মাইসা।”

‘মাইসা’ নামটা শুনতেই ঝুমের ভ্রু কুঁচকে যায়। ছোট্ট মনটা আরো ছোট্ট হয়ে যায় যেন। কোথায় ভেবেছিল নিঝুমের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটাবে, নানা গল্পে মেতে উঠে বর্তমান কঠিন সময়ের কথা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়ে উপভোগ করবে মুহুর্তটা। অথচ নিঝুম কি করছে? ঝুমের মনে অভিমান জমলো। জানালার কাছ ঘেঁষে বসে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো সে।

প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর নিঝুম কথা শেষ করে কল কেটে দেয়। ঝুমের দিকে তাকাতেই চোখ ছোট ছোট হয়ে যায় তার। প্রশ্ন করে,
— “কি হয়েছে? ওভাবে বসে আছ কেন? কাছে আসো।”
ঝুমের স্পষ্ট উত্তর,
— “আসবো না কাছে। আপনি যার সাথে কথা বলছিলেন বলেন গিয়ে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আছে নাকি আপনার?”
নিঝুম অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
— “ও আমার বোনের সমান ঝুম। ভাইয়া ডাকে আমাকে। জেলাস হচ্ছো কেন?”

ঝুম জবাব দেয় না। এক,দু সেকেন্ড পর ঝুমের কান্নার শব্দ শুনতে পায় নিঝুম। এবার সত্যি সত্যি অবাক হয় সে। এই সামান্য ব্যাপারে কান্নার কি আছে? এক ঝটকায় ঝুমকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে নিঝুম। নিঝুমের বুকে লেপ্টে এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে ঝুম। নিঝুম অস্থির হয়ে উঠে। শান্ত থাকার চেষ্টা করে। শান্ত গলায় বলে,
— “কি হয়েছে পিচ্চি? কাঁদছো কেন?”
সামান্য তোতলিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে ঝুম বলল,
— “আমাকে আপনার কাছে কখন নিয়ে যাবেন ডাক্তার? আমার আর ভালো লাগছে না। আব্বাকে প্রতিদিন আমার জন্য মানুষের কাছে কথা শুনতে হয়। আব্বার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না ডাক্তার। খুব কষ্ট হয় আমার। ভীষণ কষ্ট হয়!”

নিঝুম নির্বাক শুনে শুধু। মনে মনে শান্তনা দিয়ে কিছু বলার জন্য কথা সাজানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে ব্যর্থ। নিঝুম নিজেই যে দূর্বল, ভেঙ্গে যাওয়া এক টুকরো কাঁচ মাত্র! মানুষের মুখ কিভাবে বন্ধ করতে হয় নিঝুম জানে না। যতই তুমি তাদের ভালো করো না কেন, তারা তোমার পেছনে দূর্নাম করবেই! এটাই যে সমাজ! এটাই নিকৃষ্ট সমাজের নিকৃষ্ট মানুষ! যারা কারো ভালো চায় না। স্বার্থপর হয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর ঝুমের কান্না থামে। তবে ফুঁফানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখনো। ঝুমের কপালে চুমু দিয়ে সরে আসে নিঝুম। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
— “তোমাকে কেউ কিছু বলেছে ঝুম?”
ঝুম মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানালো। বলল,
— “হিজাব পড়ে মুখ ঢেকে এসেছি। কেউ চিনে নি আমাকে।”

নিঝুম আলতো হাতে ঝুমের দু’চোখের পানি মুছে নাক বরাবর অধর ছোঁয়ায়। আদুরে গলায় বলে,
— “সব ঠিক হয়ে যাবে ঝুম। ইনশাল্লাহ!”

ঝুম নাক টানলো। নিঝুমের হাতে হাত রেখে বলল,
— “খেয়েছেন?”
— “না।”

সঙ্গে সঙ্গে ঝুম সরে বসল। জানালার গলিয়ে হাত বের করে, পানি দিয়ে হাত ধুলো। নিজের ব্যাগ থেকে একটা টিভিন বক্স বের করল সে। অদৃশ্য এক অধিকার বোধে আদেশ করল,

— “আম্মা খাবার দিয়েছিল। আমি অর্ধেক খেয়েছি, বাকিটা আপনার। এবার ‘আ’- করুন।”

নিঝুম ঘন ঘন পলক ফেলে ঠোঁট হালকা ফাঁক করে। ঝুম খাইয়ে দিতে শুরু করে এবার। নিঝুমও বাধ্য ছেলের মতো খাচ্ছে। আলাদা তৃপ্তি লাগছে তার। হাজারো যন্ত্রণার মাঝে একটু শান্তি মন ভরিয়ে দিচ্ছে। ভেতরে কষ্টে চূর্ণবিচূর্ণ হলেও বাহ্যিক দিকে দিয়ে নিঝুম স্বাভাবিক। বাকি আট-দশটা প্রেমিকের মতো উত্তেজনায় অস্থির হতে সে পারে না। কিংবা পারতে চাইছে না। খেতে খেতে হঠাৎ নিঝুম ডাকলো,
— “ঝুম।”
— “হু?”
— “একটা গান গাও তো।”

ঝুম নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুম ইশারায় বলে গাইতে। ঝুম চোখ নামিয়ে ফেলে। খানিক বাদ পর সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠে,

‘ একটা ছেলে মনের আঙিনাতে
ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে
বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে
বৃষ্টি জলে একলা ভিজে

একটা ছেলে মনের আঙিনাতে
ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে
বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে
বৃষ্টি জলে একলা ভিজে
সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে
সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে

আমি তো বেশ ছিলাম চুপিসারে
ছোট্ট মেয়ে সেজে একটা কোণে
সবুজ বনে নীলচে আলো জ্বেলে
স্বপ্ন ভেজা মাটিতে পা ফেলে

আমি তো বেশ ছিলাম চুপিসারে
ছোট্ট মেয়ে সেজে একটা কোণে
সবুজ বনে নীলচে আলো জ্বেলে
স্বপ্ন ভেজা মাটিতে পা ফেলে
সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে
সেই ছেলেটা হঠাৎ এলো মনে

ছোট্ট আমি দুষ্টু আমি সেজে
কেমন যেন হলাম জড়সড়
আকাশ ভরা তারার আলো দেখে
বৃষ্টি ভেজা মাটিতে পা রেখে
বুক ভরা আবেগটুকু ঢেকে
হঠাৎ করে হয়ে গেলাম বড়
বন পাহাড়ি ঝর্ণা বৃষ্টি ফেলে
আমায় বাসলো ভালো সেই ছেলে
বন পাহাড়ি ঝর্ণা বৃষ্টি ফেলে…
আমায় বাসলো ভালো সেই ছেলে ‘

__________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia