ভালোবাসি তারে পর্ব-৩৭

0
5516

ভালোবাসি তারে

৩৭.
শাখাওয়াত শেখের সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছেন আলম খান। তাদের সামনেই টেবিলে রয়েছে নানা ধরণের ফলমূল, বিস্কুট, কেক এবং চা। ভদ্রতা দেখিয়ে আলম খান বললেন,
— “শাখাওয়াত সাহেব, আপনারা তো কিছুই খাচ্ছেন না। আমার স্ত্রী কেক খুব ভালো বানায়। একটু খেয়ে দেখুন।”

শাখাওয়াত শেখ নম্র হেসে বললেন,
— “আমরা এখানে খেতে আসি নি আলম সাহেব। নিঝুম আর ঝুমের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

এতক্ষণে যেটুকু হাসি বজায় রেখেছিলেন আলম খান, সেটিও মিইয়ে গেল এবার। প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না তিনি। চুপ রইলেন। শাখাওয়াত শেখ আবার বললেন,
— “আমার ছেলে আপনার মেয়েকে ভালোবাসে। এটা যেমন সত্য, তেমনি ওরা যে একে অপর ছাড়া সুখে থাকবে না, এটাও সত্য। আপনি আমার ছেলেকে চিনেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমার ছেলের খারাপ কোনো কিছুর প্রতি নেশা নেই। স্বভাব, আচরণও আপনাদের জানা। আমি চাই, পুরোনো কিছু বাজে স্মৃতি ভুলে আপনি ঝুম আর নিঝুমের সম্পর্কটা মেনে নিন। আমি আপনার কাছে অনেক আশা নিয়ে ঝুমের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এখন শুধু আপনার উত্তরের অপেক্ষা।”

আলম খান বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। কি ভেবে মলিন হাসলেন তিনি। বললেন,
— “নিঝুম যথেষ্ট ভালো ছেলে আমি জানি। ওর সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু… আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত বলে কেউ আমার মেয়েকে অসম্মান করুক সেটাও আমি চাই না।”

নিঝুম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল সব। এপর্যায়ে শীতল গলায় বলল,
— “আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন মাস্টার আঙ্কেল। আমি তখন ছিলাম না। থাকলে হয়তো এমন কিছুই হতো না। ঝুমের সম্মানই আমার সম্মান। ঝুমের সম্মানহানি হয় এমন কিছু দ্বিতীয় বার হবে না, সেটা আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”

আলম খান স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকালেন নিঝুমের দিকে। নিঝুমের হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত কণ্ঠে বললেন,
— “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি নিঝুম।”

__________________________

ঝুম উদাসীন হয়ে বসে আছে বিছানায়। ড্রইংরুম থেকে মৃদু কথার আওয়াজ পাচ্ছে সে। ভয় লাগছে। আলম খান কি তাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন? তারা কি এক হতে পারবে নাকি অপূর্ণই থেকে যাবে? প্রচন্ড চিন্তায় দূর্বল হয়ে উঠছে ঝুম। চোখ জলে টলমল করছে।

হঠাৎ-ই দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে কেউ। ঝুম চমকে যায়। এলোমেলো অবস্থায় সে! দ্রুত পরনের জামা ঠিক করে, পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। বিছানা ছেড়ে উঠতেই নিঝুম চাপা গলায় বলে উঠে,
— “আমি ঝুম। তোমার ডাক্তার। শান্ত হও!”

তৎক্ষণাত পাশ ফিরে তাকায় ঝুম। নিঝুমকে দেখে শান্ত হয়। নিঝুম এগিয়ে আসে ঝুমের দিকে। মুখ মলিন তার। অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে ঝুম। জিজ্ঞেস করে,
— “স-সব ঠিক আছে তো ডাক্তার? সবাই মেনে নিয়েছে তো আমাদের?”

মলিন মুখটা আরো মলিন করে ফেলে নিঝুম। বিষণ্ণতা, কষ্ট আর যন্ত্রণা সবই এঁটে নেয় চেহারায়। ম্লান কণ্ঠে বলে,
— “সব শেষ ঝুম। তুমি আর আমার প্রেমিকা রইলে না।”

ঝুম মাত্রাধিক কেঁপে উঠে দু’কদম পিছিয়ে যায়। বড় বড় চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে। বুকের ধুকধুক শব্দ তীব্র বেগে ছুটছে। শরীর কাঁপছে। ঠোঁটটাও তরতর করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ! কাঁপা কাঁপা স্বরে ঝুম বলল,
— “ক-কি কি বল-ছেন এগুলো ডা-ডাক্তার?”
— “যা সত্যি তাই।”
খুবই শান্ত স্বরে বলল নিঝুম। নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইল ঝুমের দিকে।

ঝুম যেন থমকে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। অনুভূতি শূণ্য হয়ে গেল। সব কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে তার। এর পরমুহুর্তেই শরীর ভাড়ি হতে শুরু করে। শরীরের ভাড় বহন করতে না পেরে, খাট ঘেঁষে বসে পরল ঝুম। হঠাৎ-ই জোড়ে জোড়ে কান্না শুরু করে দিলো। বার বার বলতে লাগল,
— “আমি মরে যাবো! আমিহ্ মরে যাবো! আমাকে কিছু করে মেরে ফেলুন না ডাক্তার।”

নিঝুম ভড়কে গেল। ঝুমের অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে উঠল। সে তো শুধু একটু মজা করতে চেয়েছিল। কে জানতো, ঝুম এতটা সিরিয়াসলি নেবে সব! নিঝুম দ্রুত ঝুমের কাছে গিয়ে বসল। ঝুমের দু’গালে দু’হাত রেখে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে নিলো একটু। বলল,
— “শান্ত হও ঝুম। কান্না বন্ধ করো। সবাই শুনবে তো!”

ঝুম ঠোঁট কামড়ে মৃদু শব্দ করে কেঁদে উঠল। কান্না বন্ধ করল না। নিঝুম আবার বলল,
— “ঝুম, পিচ্চি আমার! কাঁদে না। দেখো, সবাই আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেছে।”

ঝুম বিস্মিত হলো। বিস্ময়ের দরুণ কান্না খানিকটা কমে গেল তার। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে, নাক টেনে প্রশ্ন করল,
— “আপনি যে তখন বললেন?”
নিঝুম হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
— “আ-আমি তো বলতে চেয়েছিলাম, সব ঝামেলা শেষ। আর তুমি আমার প্রেমিকা থেকে বউ হতে চলেছ। তুমিই বুঝতে পারো নি।”
বলেই আরেকটু হাসলো নিঝুম।

ঝুমের এবার রাগে শরীর কেঁপে উঠল। একটু আগে কি নরক যন্ত্রণাই-না পেয়েছিল সে। তীব্র ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠেছিল। অথচ নিঝুমকে দেখো! এমন একটা বাজে মজা করে সে এখনো দিব্যি হাসছে। ঝুম ফুঁসে উঠল। এক ঝটকায় গাল থেকে নিঝুমের হাত সরিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল নিঝুমের বুকে। আর বলতে লাগল,
— “বেয়াদব! অসভ্য! আপনি খুব খারাপ। আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না আমি। কখনো যাবো না আপনার কাছে।”

ঝুমের পাগলামো দেখে মুচকি হাসলো নিঝুম। কৌশলে ঝুমকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। বুকে আঘাত করতে না পেরে নিঝুমের পিঠে এলোপাথাড়ি মারছে ঝুম। নিঝুম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। নিঝুম বেশ আদুরে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে তুমি ঝুম?”

প্রশ্ন শুনে একদম শান্ত হয়ে গেল ঝুম। দূর্বলতায় নেতিয়ে গেল। নিঝুমের বুক ঘেঁষে লেপ্টে রইল একদম। ঢোক গিলে মৃদু স্বরে, কাঁপা গলায় বলল,
— “এমন বাজে মজা কেন করেন ডাক্তার? আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানেন? মনে হচ্ছিল আমার দুনিয়া বুঝি থমকে গেল? আমি এখনো বেঁচে আছি কিভাবে?”

বলতে বলতেই ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল ঝুম। নিঝুম আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ঝুমকে। একহাতে ঝুমকে ধরে, অন্যহাতে ঝুমের চুলে হাত বুলাতে লাগল। মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “বেয়াদব আর বেয়াদবি করবে না। প্রমিস!”

কান্নার মাঝেও খানিকটা হেসে উঠল ঝুম। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগল নিঝুমকে। মনে মনে আওড়ালো,

— ‘আপনি আমার অন্ধকারের ছায়া। আপনি আমার আগলে রাখা বুকের ভিতর শুদ্ধতম মায়া!’
~সালমান হাবীব।

_____________________

নিঝুম দুইটি শাড়ি দিয়েছিল ঝুমকে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি এবং বেগুনি রঙ্গা একটি শাড়ি। ঝুম আজকে বেগুনি শাড়িটা পড়েছে। হালকা সেজে, মাথায় ঘোমটা এঁটে নিয়েছে সে। নিঝুমের সামনে বসে থাকতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার। নিঝুম কেমন নির্লজ্জের মতো কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে। ঝুম মাথা নিচু করে রইল। আর একবারের জন্যও তাকাল না নিঝুমের পানে। সানজিদা শেখ বেশ কঠোর রুপ ধারণ করে বললেন,
— “আলম সাহেব, মেয়ে দেখতে এসে এমন অপমান হবো আমরা কখনো কল্পনাও করি নি। মেয়ে তো দেখি গুরুজনদের সালামও দিচ্ছে না।”

ঝুম ভড়কে গেল। মাথা তুলে তাকাল। আলম খানও তাজ্জব বনে গেছেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সানজিদা শেখ আবারো বললেন,
— “তাও সালাম দিচ্ছো না কেন?”

ঝুম হকচকিয়ে যায়। দ্রুত বলে,
— “আসসালামু আলাইকুম।”
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
একটু থেমে আবার বললেন,
— “তা তোমার নাম কি মেয়ে?”

এবার যেন অবাকের সীমা ছাড়িয়ে গেছে ঝুমের। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সানজিদা শেখ এমন ব্যবহার করছেন কেন? তিনি তো ঝুমের নাম জানেন! ঝুম নিঝুমের দিকে তাকাল। নিঝুম ঠোঁট চেপে হাসছে। নিঝুম থেকে চোখ সরিয়ে সবার দিকে তাকাল এবার। সবাই-ই হাসছে। শুধু সানজিদা শেখ বাদে। ঝুম খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “জ্বী, আমার নাম মালিহা তাবাস্সুম ঝুম।”
— “কি পড়ালেখা করছ?”
— “জ্বী, আন্টি আমি…”

কথা শেষ হবার আগেই সানজিদা শেখ হালকা ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “আন্টি কি হ্যাঁ? আম্মু বল।”
ঝুম মাথা দুলিয়ে সামান্য তোতলিয়ে বলল,
— “আ-আম্মু।”
— “দেখ ঝুম। আমি দজ্জাল শাশুড়ী হওয়ার চেষ্টা করছি। এখনকার যুগের বউদের এভাবেই হাতে রাখতে হয়। আমাকে বেশি বেশি ভয় পাবি বুঝলি? ভয় না পেলেও ভয় পাওয়ার এক্টিং করবি।”
সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললেন সানজিদা শেখ।

ঝুমের হাসি পেয়ে গেল হঠাৎ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে দিল। বাকি সবাইও তাই। নিঝুমের দিকে তাকাতেই দেখল, নিঝুম মুচকি হেসে ঠোঁট নাঁড়িয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করছে,
— “কেমন লাগল দজ্জাল শাশুড়ী?”

বলা শেষে দু’ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল আবার। ঝুম মুখ বাঁকালো শুধু। উত্তর দিল না। এতে মাথা নিচু করে আবারো হেসে দিল নিঝুম।

______________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia