ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৩৭+৩৮

0
504

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩৭
©জারিন তামান্না .

কিছুদিন পর,

গা ম্যাজম্যাজ করছে পলকের। কোমড়টাও ভার হয়ে আছে। নড়তেচড়তেও বড্ড কাহিল লাগছে তার। রাতেও খায়নি কিছু।সিফাত দুই তিনবার বলেছিল কিন্তু পলক বারবার না করায় জোর করেনি আর। ঘরে এসে শুয়ে আছে সোজা হয়ে।পেটের উপর বালিশ দিয়ে ভার দিয়ে রেখেছে সে। শুরুর দুই তিনটা দিন যেন জাহান্নাম সমান যায় তার।

সিফাত ঘরে এসে শোয়ার প্রস্তুতি নিতেই পলককে ঠিক হয়ে শুতে বললো। কিন্তু,পলক তার জায়গা থেকে নড়লো না। তাকে তাড়া দিয়ে আবারও বললো সিফাত,
_কি হলো আসুন?
_আজ এখানেই থাকবো আমি। প্লিজ!
পলকের এহেন কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেল সিফাতের। কারণ,পলক নিজে থেকে সিফাতের কাছে না গেলেও, সিফাতের এহেন কাজেও বাঁধা দেয় না কখনো। একদিন রাতে অবশ্য সে আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল,
_আপনি রোজ রোজ এভাবে বালিশ রাখেন কেন শুনি?
পলকের প্রশ্নে কিছুসময় চুপ করে তাকিয়েছিল সিফাত তার দিকে। তারপর বলেছিল, যেদিন এখানকার বালিশটা আপনি নিজেই সরিয়ে রাখবেন সেদিন উত্তর পেয়ে যাবে।তখন আমিও আর এভাবে বালিশ রাখবো না। রাখার প্রয়োজনই হবে না একচুয়ালি !

সিফাতের এহেন কথায় আর কিছু বলার মত খুঁজে পেল না পলক। চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল রোজকার মতই। আর তারপর থেকে কখনোই সে আর কিছুই বলেনি এই নিয়ে। কিন্তু, আজ পলকের এমন অনুরোধের কারণটা ঠিক বুঝলো না সিফাত। হঠাৎ খেয়াল করলো পলকের পেটের উপর বালিশ চেপে রেখেছে সে। সেটা দেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সিফাত। পলক বুঝলো না সামান্য দূরে শুতে চেয়েছে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কি হলো!

কিন্তু,সিফাতের পিছু পিছু যেতেও পারলো না সে। প্রচন্ড ব্যাথা করছে তার পেটে। তাই চুপচাপ শুয়ে সিফাতের অপেক্ষা করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর ঘরে ফিরে এলো সিফাত। একহাতে হট ওয়াটার ব্যাগ আর অন্য হাতে একগ্লাস শরবত নিয়ে। ঘরে এসে দেখলো পলক জড়সড় হয়ে পেট চেপে একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। ঘরের লাইট অন করতেই তার আলোয় চোখ মেলে তাকালো পলক। সিফাতকে দেখে অবাক হলো বেশ। জিজ্ঞেস করলো,
_কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? একরাত আপনার কাছ ঘেঁষে শুবো না বলে কি এভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়?!
পলকের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শরবতটা সাইড টেবিলের উপর রেখে, ব্যাগটা বিছানার এক কোণায় রাখলো সিফাত। তারপর, পলককে বললো,
_দেখি…উঠে বসুন তো একটু।
_কেন?
_দরকার আছে। বলে নিজেই পলকের পিঠে হাত রেখে তাকে উঠিয়ে বসালো। তারপর, শরবতের গ্লাসটা পলকের হাতে দিয়ে বললো খান এটা।
_এটা কি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।
_লেবুর শরবত। কড়া করে চিনি দিয়েছি। এটা খেলে ব্যাথা অনেকটা কমে যাবে। তারপর,,গরম পানির ছ্যাক দিলে আরাম লাগবে আপনার।
সিফাতের এহেন কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেল পলকের। তা দেখে সিফাত বললো,
_Its a natural process of woman’s body. লুকানো বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। নিন, শেষ করুন এটা।
পলক পুরো থতমত খেয়ে গেল সিফাতের কথায়। লজ্জায় গুটিয়ে গেল একেবারে। সিফাত যে এভাবে বুঝে যাবে ব্যাপারটা সেটা মোটেও আশা করেনি পলক। তার ওপর কেমন সেবা করছে তার। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা হলো পলকের। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বসে রইলো সে,,মুখে আর দিতে পারছে না। লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। পলকের এমন অবস্থা দেখে সিফাত বুঝলো লজ্জা পাচ্ছে সে। তাই তার পাশে বসে নিজেই মুখে তুলে দিলো শরবতের গ্লাসটা। বললো, খেয়ে নিন। পলকও চুপচাপ চুমুক দিল তাতে। শরবত খেতে খেতেই সিফাত তাকে বললো,
_কখন হয়েছে এটা? খুব বেশি খারাপ লাগছে কি?
পলক লজ্জায় শেষ। মুখ ফুঁটে কিছু বলবে তো দূর।
_কিছু জিজ্ঞেস করেছি আপনাকে।
_ সন্ধ্যা থেকে।বেশ কাঁচুমাচু করে বললো পলক।
_ আপনার হাজবেন্ড হই আমি মৃন্ময়ী। আমার কাছে কোন কিছু নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই আপনার। যে কোন সমস্যা, যে কোন অসুবিধা সব নির্দ্বিধায় বলবেন আপনি আমাকে। আপনার বিষয়ে খুঁটিনাটি সব জানার অধিকার কিন্তু আছে আমার।
_জ্বী। শরবতটা শেষ করে বললো পলক। পলকের হাত থেকে খালি গ্লাসটা নিয়ে সাইড টেবিলের উপর রাখলো সিফাত। তারপর,পলকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে গরম পানির ব্যাগটা তার তলপেটের উপর দিয়ে দিল। গা’য়ে চাদর টেনে দিয়ে উঠে গেল বিছানা থেকে। ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় এলো শোয়ার জন্য। আজ আর পলককে জোর করলো না রোজকার মত শোয়ার জন্য। বরং সে নিজেই এগিয়ে এসে পলকের কাছ ঘেঁষে শুলো। সেটা টের পেয়ে অবাক কন্ঠে পলক বললো,
_আপনি এখানে শোবেন?
_হ্যাঁ! নাকি আজ পুরো বিছানাটাই চাই আপনার?
_না..মানে, আমি তো সুস্থ নই,,এমন অবস্থায় আমার কাছেই শোবেন আপনি?
_আপনি অসুস্থও নন মৃন্ময়ী। আর এটা খুবই ন্যাচারাল একটা ব্যাপার। এটা নিয়ে এত কিসের সংকোচ হচ্ছে আপনার সত্যিই বুঝতে পারছিনা আমি!
_না..আসলে আমি বলছিলাম কি..
_কি?
_আপনার অস্বস্তি লাগবে না আমার কাছ ঘেঁষে শুতে?
_নাহ। বলেই সাইড টেবিলের ল্যাম্পটা সুইচ অফ করে দিল সিফাত। একপাশ হয়ে পলকের মুখোমুখি হয়ে শুয়ে আলতো করে হাত রাখলো পলকের পেটে। মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
_আপনাকে একটা গল্প বলি মৃন্ময়ী! পলক কৌতুহলী হয়ে ঘাড় কাত করে সিফাতের মুখোমুখি হলো সিফাতের কথা শোনার জন্য।তার চোখে কৌতুল দেখে মুচকি হাসলো সিফাত।তারপর বলতে শুরু করলো,
_ আমার তখন ১১/১২ বছর বয়স। সেবার বছর রোজার সময় একরাতে খেয়াল করলাম সবাই সেহরি খেতে এলেও রুকু আপা এলো না। আমি আপাকে ডাকতে যেতে চাইলে মা বাঁধা দিয়ে বললো, আপা রোজা থাকবে না। আমি বুঝলাম না কিছু,,কিন্তু কিছু বললামও না। সকালে আপার রুমে গিয়ে দেখি মা আপাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে আপা বেশ লজ্জা পেলেও মা কিছু বললেন না আমায়। আমি আপাকে জিজ্ঞেস করলাম,আপা তোর কি শরীর খারাপ? বাবা কে বলি ডাক্তারকে খবর দিতে? মা বললেন, আপার একটু শরীরটা খারাপ সিফাত। কিন্তু, এর জন্য ডাক্তার লাগবে না। ৪/৫ দিন পরে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপর, খাওয়া শেষ হলে আমাকে বললো তার সাথে নীচে যেতে। নীচে যাওয়ার পর মাকে দেখলাম একটা ব্যাগে গরম পানি ভরতে। পানি ভরতে ভরতেই মা বললো,
_তোমার আপা অসুস্থ নয় বাবা। এত চিন্তা করো না।
_তাহলে আপা রোজা কেন রাখলো না, মা?
_কারণ আল্লাহ তাকে কিছুদিনের ছুটি দিয়েছেন। নামায রোজার মত সব ইবাদত থেকে। প্রতিটা মেয়েকেই একটা সময়ের পরে এমন ছুটি দেয় আল্লাহ প্রতি মাসেই। এই ছুটিতে তারা নিজেদের প্রস্তুত করে একটা বিশেষ আর পৃথিবীর সুন্দরতম একটা কাজের জন্য। তুমি তো এখন ছোট বুঝবে না সবটা। যখন আরেকটু বড় হবে তখন বুঝবে সব। কিন্তু,,সব সময় মনে রাখবা এইটা কোন অসুখ না। মেয়েদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে বরাদ্দ করা একটা প্রক্রিয়া। এটা ভালো দৃষ্টিতে দেখবে সবসময়। একটা মেয়েকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় এই সময়টা। তাই এই সময়টা খুব যত্নের প্রয়োজন মেয়েদের। বুঝলে?
_হ্যাঁ, মা।
_যাও,,এটা তোমার আপাকে দিয়ে আসো। মুচকি হেসে বললেন মিসেস. রেহনুমা।
তারপর যখন আপার কাছে গেলাম,,আপাকে বললাম,
_তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে আপা? মা বলেছে এটা কোন অসুখ না।কিন্তু, খুব যত্ন লাগবে এখন তোর। তুই আমাকে বলিশ কখন কি লাগবে, আমি এনে দিবো তোকে। তুই বেশি বেশি রেস্ট নিবি, ওকে?

আমার কথা শুনে সেদিন হেসেছিল আপা। কিন্তু,তারপর থেকে প্রতিবারই মায়ের সাথে সাথে আমিও আপার যত্ন নিতাম এই সময়টায়। তারপর, যখন বড় হলাম। ক্লাস নাইনে উঠি বায়োলজি বইতে পড়ে জেনেছি এটা নিয়ে। নিজের মা বোনের প্রতি কনসার্ন থেকে পরিবর্তে আরও জেনেছি ইন্টারনেট ঘেঁটে। তাই, আমি বুঝি কতটা ইম্পর্ট্যান্ট আর সেনসেটিভ ইস্যু এটা। সারার বেলায় তো আমিই ওকে যাবতীয় সব এনে দিতাম প্রায় সময়।খেয়াল রাখতাম ওর। আর আপনি তো আমার স্ত্রী,মৃন্ময়ী! আমার অস্তিত্বে অংশীদার। ভবিষৎতে আমার সন্তানের মাও আপনিই হবেন ইন শাহ আল্লাহ।আর একটা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য এটা কতটা ইম্পর্টেন্ট একটা প্রসেস এটা নিশ্চয় অজানা নয় আপনার! আপনারা মেয়েরা কত কত সেক্রিফাইস করেন এই সন্তান জন্মদানের জন্য। এত এত বছর পিরিয়ডের মত একটা ব্যাপারকে সহ্য করে নিজেদের শরীরকে প্রস্তুত করেন। একটা ভ্রুণকে নিজের গর্ভে ধারণ করার জন্য এত এত বছর এত শারীরিক কষ্ট সহ্য করেও স্বাভাবিক জীবন মেইন্টেইন করেন।তাই এই সময়টায় এইসব যত্ন আপনাদের প্রাপ্য মৃন্ময়ী। আর সব কিছুর উর্ধ্বে আপনার ভালো খারাপ সব অবস্থাতেই আপনি একই থাকবেন আমার কাছে। আমার স্ত্রী হিসেবে, আমার একান্ত ব্যক্তিগত নারী হয়ে। তাই আপনার যে কোন প্রয়োজন, সমস্যা,অসুবিধা নিঃসংকোচে বলবেন আপনি আমাকে। আমি আমার সাধ্য মত চেষ্টা করবো সেটার সাথে ডিল করার। বুঝেছেন আপনি?
পলক কিছু বললো না, কেবল শক্ত করে তাকে জড়িয়ে রাখা সিফাতের হাতটা ধরলো শক্ত করে। আর পলকের এই কাজটাই সিফাতকে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিল তাকে তার মৃন্ময়ীর মনের কথাটা।

পলকের কপালে চুমু দিয়ে সিফাত বললো, রাতে কিছু প্রয়োজন হলে ডেকে দিবেন আমাকে। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুম হলেই অনেকটা বেটার ফিল করবেন আপনি।

শরবতটা খাওয়ার পরে ব্যাথা কিছুটা কমেছে পলকের। গরম ছ্যাক দেওয়ায় অনেকটাই আরাম লাগছে তার। আর সিফাতও পাশে আছে, তাই নিশ্চিন্তে চোখ বুঝলো সে ঘুমানোর জন্য।

____________________________________

৩ মাস পর,

দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।বেশ সুখেই যাচ্ছে সিফাত পলকের বিবাহিত জীবন। অন্তরার ডেলিভারি হয়েছে গত মাসে। ছেলে সন্তানের মা হয়েছে সে। ছেলেটা দেখতে নিলয়ের মতই হয়েছে। তাকে প্রথম দেখে খুব কেঁদেছিল অন্তরা। নিলয় না থাকলেও তার অংশকে পৃথিবীর বুকে সুস্থভাবে আনতে পারেছে সে। আর এর জন্য সিফাত আর পলকের কাছে কৃতজ্ঞ অন্তরা। এই পরিবারটা তাকে ফিরিয়ে না দিলে একা একা খুব বেশিই কঠিন হয়ে যেত তার পক্ষে এই সন্তানকে এভাবে পৃথিবীর আলো দেখানো। তাই অন্তরা বলেছিল বাচ্চাটা যেন প্রথমে পলক নয় তো সিফাতের কোলেই দেওয়া হয়। বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার পর সিফাতের মুখটা দেখেছিল পলক। কি আদুরে উচ্ছ্বাসিত একটা মুখ হয়েছিল সিফাতের। বাচ্চার প্রতি কতটা দূর্বল.. কতটা স্নেহশীল একজন মানুষ সিফাত..খুব করে বুঝেছিল পলক। বাচ্চাটার ডাকনাম সিফাতই রেখেছে। নিলয়ের সাথে মিলিয়ে নাম দিয়েছে নিয়ন। নিয়নকে আদর করতে করতে একসময় পলককেও সে বলে বসেছিল, মৃন্ময়ী.. আমি না ঠিক ডিসাইড করতে পারিনা যে ছেলে বেবি বেশি সুন্দর নাকি মেয়ে বেবি। তাই আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আমাদের বেবি হলে ছেলে মেয়ে দুটোই যেন হয়। পলক চোখ বড় বড় করে বলেছিল, টুইন?! সিফাতও দাঁত ক্যালিয়ে হেসে বলেছিল তার টুইন বেবিই চাই। কিন্তু,বাচ্চার কথা শুনে পলকের মনে হয়েছিল সিফাত খুব করে চায় তারও একটা বেবি আসুক এবার। কিন্তু,বিয়ের সবে ২ মাস।আর সিফাত আর পলকের সম্পর্কও এখনো আগায়নি। তাই তখন এই ভাবনাটাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল পলক। কিন্তু,বিপত্তি বাঁধলো যখন সিফাতের দাদী এলেন তাদের বাড়িতে।
___________________________________

রুকুর দ্বিতীয় সন্তান আসতে চলেছে পৃথিবীতে। ২’৫ মাসের প্রেগন্যান্ট সে। সবাই খুব খুশি। রুকুর কথা শুনে তার সাথে দেখা করতে আলম ম্যানশনে এসেছেন সিফাতের দাদী। মূলত গ্রামের বাড়িতেই থাকেন তিনি। মাঝে মধ্যে এসে থেকে যান ছেলের কাছে।সিফাতের বিয়ের সময় উমরা হজ্বে গিয়েছিলেন। একবার বিয়ে পিছিয়েছে, তার জন্য আবার বিয়ে পিছাবে এমনটা তিনি চাননি।তাই তাকে ছাড়াই ফিক্সড ডেটেই পলক আর সিফাতের বিয়েটা হয়েছে। হজ্ব থেকে ফেরার পর তিনি এখানেই এসেছিলেন। পলক আর সিফাতদের সাথে দেখা করে গেছেন। কিন্তু,পলকের গা’য়ের রঙ নিয়ে বেশ আপত্তি করেছেন তিনি। যদিও সিফাত বুঝিয়েছিল, তারপরেও তিনি খুব একটা পছন্দ করেননি পলককে। ইশতিয়াক আলম খুব একটা কথা বলেন না পলকের সাথে। খারাপ ব্যাবহার না করলেও একটা দূরত্ব রেখেই চলেন। সারাও তাই করে। ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলে না পলকের সাথে। কিন্তু,রেহনুমা, রুকু খুব আদর করে পলককে। আর সিফাত তো আছেই সব সময়। আদরে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে তাকে।

সিফাতের দাদীর নাম সুরাইয়া আলম। ৬৭ বছর বয়সী এই মহিলা এখনো বেশ শক্তপোক্ত। কথাও বার্তাও বেশ স্পষ্ট। রুকু আলম ম্যানশন এসেছিল বিকালে। তাকে নিয়ে হল রুমে বসে কথা বলছিলেন তিনি। পলক চা নাস্তা নিয়ে এসেছে সবার জন্য। রুকুর পছন্দের পাস্তাও নিজ হাতে রান্না করেছে। ইয়ানার পছন্দের চিকেন রোলও নিজ হাতেই বানিয়েছে পলক। হলরুমের একটা সোফায় বসিয়ে নিজ হাতেই তাকে খাইয়ে দিচ্ছিল পলক। তখনই বাচ্চা নিয়ে কথা বলতে বলতে সুরাইয়া আলম বললেন,
_তোর তো তাও এইটা দ্বিতীয় বাচ্চা রে রুকু। আমার সিফাতের যে কবে একটা বাচ্চা হবে। কবে যে আল্লাহ আমারে বড় দাদী হওয়ার ভাগ্য দিবো কে জানে।
_আল্লাহ যখন দিবে ইন শাহ আল্লাহ সব হবে দাদী। -রুকু বললো।
_আর কবে হইবো! সিফাতের তো আর বয়স কম হইলো না। আর চাকরি বাকরি করা বউ আনছে সিফাত। সেই কি এত সহজে বাচ্চা লইবো! তোর বাপের এই বয়সেই দুই বাচ্চার বাপ হইয়া গেছিল। আর সিফাতের একটাও হইলো না।
_আমার আর সিফাতের মধ্যে তো খুব একটা বয়সের ফারাক নাই দাদী। পিঠাপিঠিই আমরা প্রায়। তাই বাবা ওই অল্প বয়সেই দুইজনের বাবা হয়ে গিয়েছিল।
_তুই চুপ থাক রুকু। আমার ছেলে আমি জানি না কিছু?
সিফাত তো বউ কইতেই পাগল।নিজেই পছন্দ কইরা বিয়া করলো। সে না কইলো কিন্তু বউয়ের তো উচিৎ এইবার একখান বাচ্চা নেওন। শেষের কথাগুলো একপ্রকার পলককে শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন তিনি। পলক সেসব শুনেও কিছু বললো না।চুপচাপ ইয়ানাকে খাইয়ে দিতে থাকলো।
_আহ! দাদী…সবে মাত্র বিয়ে হলো ওদের। এখন পর্যন্ত হানিমুনেও যেতে পারেনি ওরা। বছর দুই এক বছর অন্তত যাক। পরে না হয়..
_আরে থাম তুই। সিফাতের বয়স কি পইড়া থাকবো নাকি। কবে বাচ্চা কাচ্চা হইবো আর কবে মানুষ করবো। একমাত্র নাতি আমার। তার ঘরে বংশের বাতি না দেইখা গেলে মইরাও তো শান্তি পামু না আমি।
_আল্লাহ যেটা দেয় সেটাই তো অনেক আম্মা। ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান। -রেহনুমা বললেন।
_তুমি তো কইবাই। তোমার তো ছেলে মেয়ে সবই আছে। যদি সিফাত না থাকতো তাইলে ঠিকই আফসোস করতা। তারপর তিনি সরাসরি পলককে উদ্দেশ্য করে বললেন,
_শোনো,নয়া বউ…..বাচ্চা কাচ্চা হইলো স্বামীর আদর সোহাগের ফল। যার ঘরে যত বাচ্চা আল্লাহ কইছেন তার ঘরে আল্লাহর রহমত বেশি। তয়, আজ কাইল তো কেউ দুই একটার বেশি নিবারই চায় না। আর সিফাত তো বাচ্চা কাচ্চার লাইগা অস্থির এক্কেরে।আমগোর ইনুরে কত্ত আদর করে দেখছো? ওরও তো ইচ্ছা করে নিজের একখান বাচ্চাও ওরও হইক।কিন্তু তোমার লাইগা মনোয় ওই মুখ ফুইটা কইতেও পারেনা যে ওর একখান বাচ্চা লাগবো। তয়, তুমি তো বউ, বুঝো না? নাকি তুমিই বাচ্চা নিবার চাও না? আজকাইল তো কত পদ্ধতিই বাইরোইছে মাইয়া মানুষের বাচ্চা না হওনের লাইগ্গা। যত তাড়াতাড়ি পারো আমারে সুখবর শোনাও। বুঝলা?
_জ্বী দাদী। খুব শান্তস্বরে বললো পলক।

____________________________________

কয়েকদিন পর,

রাত ১১ ‘০০ মিনিট।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছিল সিফাত। হাতমুখ ধুতে গিয়ে ভিজে গেছে খানিকটা। আয়নায় খেয়াল করলো আজও বিছানার সাইড দিয়ে পায়চারী করছে পলক। সিফাত বুঝলো কোন একটা কিছু চলছে পলকের মথায়। চুল মুছতে মুছতেই জিজ্ঞেস করলো,
_কি সমস্যা মৃন্ময়ী?
পলকের গতি থেমে গেল সিফাতের এহেন প্রশ্নে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চোরাচোরা গলায় বললো, কিছুনা।
_কিছু তো অবশ্যই। না হলে এভাবে ইঁদুরের মতো পায়চারি করতেন না আপনি।
_আচ্ছা, আপনার কি আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে না? লজ্জা সংকোচ সব ছাপিয়ে খুব দ্রুত বেগে বললো কথাটা পলক। তার কথা শুনে বেশ অবাক হলো সিফাত। বললো,
_কাছে পেতে ইচ্ছে করবে না কেন? আর আপনি তো কাছেই থাকেন আমার।
_না..ওভাবে না।আসলে.. পুরো কথাটা বলতে পারছে না পলক। ভয়, লজ্জা, সংকোচ সব এসে খুব জোর ঘিরে ধরেছে তাকে। বেশ ইতস্তত করছে সে।
_তো কিভাবে? অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো সিফাত।
_স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যেমন হয় সেভাবে। বেশ ইতস্তত করে বললো পলক। আসলে সিফাত পলকের সম্পর্কটা খুব ভালো হলেও পূর্ণতা পায়নি এখনো। সিফাত নিজে থেকেই চায়নি এসব। পলককে সময় দিতে চায় সে। কিন্তু, সিফাতের দাদী ইদানীং খুব মানসিক চাপ দিচ্ছে পলককে বাচ্চা নেওয়ার জন্য।রোজ দিন কথা শোনায় তাকে। তাই না পারতে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব লজ্জা ভয় ভেঙে সিফাতের কাছাকাছি যাওয়ার। নিজেকে সমর্পণ করার।কিন্তু,লজ্জা সংকোচে সরাসরি বলতে পারছে না তাকে কিছু।

পলকের কথায় সিফাত বুঝলো পলক কি বলতে চাইছে। আচমকা এমন একটা ব্যাপারে পলকের নিজে থেকেই কথা বলায় বেশ খটকা লাগলো তার। তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে চিরুনিটা হাতে নিতে নিতে বললো,
_এখনো এসবের সময় হয়নি মৃন্ময়ী!
_সময় হয়নি মানে? স্ত্রী আমি আপনার। আমাকে কাছে টানার জন্য সময় অসময়ের কি আছে। আপনি যখন ইচ্ছা চাইতে পারেন। অধিকার এটা আপনার।আর যাই হোক, আপনার তো একটা চাহিদা আছে। হাজার হোক পুরুষ মানুষ আপনি!

পলকের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবিহ্বল সিফাত। শান্ত শিষ্ট, ধীর স্বভাবের তার মৃন্ময়ী যে এভাবেও কথা বলতে পারে সেটা তার ভাবনাতীত ছিল। আর শেষের কথা দুটোয় বেশ মেজাজ খারাপ হলো সিফাতের। তাও নিজেকে সংযত করে শান্ত স্বরেই বললো,
_হ্যাঁ,,পুরুষ আমি। বিবাহিত পুরুষ।আপনাকে ভালোবাসার পরে প্রেমিক পুরুষও বটে। তাই স্ত্রী বা প্রেমিকার প্রতি এসবের চাহিদা থাকাটাও স্বাভাবিক আমার এবং সেটা আছেও । এটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্তই। কিন্তু,স্বামী বা প্রেমিক পুরুষ হলেও আমি কামুক পুরুষ নই। নইলে জীবনের ৩৩ বছর এভাবে একা কাটানোর পরেও বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে আপনাকে ঘরে আনার কোন প্রয়োজন আমার ছিল না।আর তাছাড়া,বিয়ে ছাড়াও সাফওয়ান সিফাতের মত পুরুষের জন্য নারী সঙ্গের অভাব হবে না নিশ্চয় ?

পলকের চোখ টলমল করছে। শেষের কথাগুলোই সিফাত ঠিক কি মিন করেছে সেটা পলক বেশ বুঝতে পেরেছে।একজন স্ত্রী হয়ে স্বামীর কাছে এমন কথা শোনাও ভীষণ কষ্টকর।পলকের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। তারপরেও, নিজেকে শক্ত রেখে বললো,
_স্ত্রীই যখন বলছেন আর চাহিদাও আছে বলছেন তাহলে কেন বুঝে নিচ্ছেন না নিজের অধিকার?

পলকের কন্ঠ ভার হয়ে আসছে। তার শুনে সিফাতও বুঝলো যে কষ্ট পেয়েছে পলক তার কথায়। কিন্তু,এখন সে নরম হবে না পলকের প্রতি। শক্তভাবে তাকে সামলাতে হবে সবটা। তাই, কিছুটা কঠিন গলায়ই বললো,
_আপনি এখনো প্রস্তুত নন মৃন্ময়ী!
_ক্যা..কেএএএ..বলেছে আমি প্রস্তুত নই? আমি প্রস্তুত। আপনি করুন আপনার যা করার। -ভার ভার গলায় বললো পলক।

পলকের এহেন গোঁ ধরা কথায় এবার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো সিফাতের। সে বুঝতে পারছে না কেন আজ এমন করে কথা বলছে পলক। এটা তো তার স্বভাব নয়। কিন্তু,,পলককে যে কথায় বোঝানো যাবে না সেটাও বেশ বুঝতে পারলো সিফাত। তাই তাকে বোঝানোর অন্য ফন্দি আটলো সে। বললো,
_আচ্ছাহ?!
_হ্যাঁ! খুব কষ্টে বললো পলক। কান্নার দমকে গলা ভার হয়ে এসেছে তার। কিন্তু,সে কিছুতেই কাঁদতে চাইছেনা এই মূহুর্তে। সিফাতের সামনে আর প্রকাশ করতে চাইছে না নিজের কষ্টটা। সে যদি বুঝতে পারে পলকের এহেন কথার পেছনে কি কারণ,,তাহলে খুব রাগ করবে সে। পলককে কিছু বলুক আর না বলুক দাদীকে ঠিক শুনিয়ে দিবে কিছু না কিছু। সিনক্রিয়েট হবে অহেতুক। তাই সে শক্তপোক্ত থাকার জোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

_ok, fine. Then let’s try it.. বলেই সে এগিয়ে গেল পলকের দিকে।
পলক ভয় পাচ্ছে। কিন্তু, নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথা সম্ভব চেষ্টা করছে সে।একটাসময় সিফাত তার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো।মুগ্ধ নয়নে দেখলো পলকের ভয়ার্তক মুখটা। মুচকি হাসলো সে। তারপর, এক হাতে পলকের গালে স্লাইড করতেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। তা দেখে আবারও জিজ্ঞেস করলো সিফাত,
_Are you sure, Mrinmoyi? should I go ahead?
_হ্য..এ..এ..হ্যাঁ। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো পলক।
তার এহেন একগুঁয়েমি দেখে মেজাজ খারাপ হলেও বেশ হাসিও পেল সিফাতের।পলক ভাংবে তবুও মচকাবে না।পলককের এই স্বভাবটাও বেশ মুগ্ধ করে সিফাতকে।

নিরবে আবারও হাসলো সে।তারপর,দু হাতে পলকের মুখখানি আঁজলায় তুলে নিল আলতো করে। পলকও তাকিয়ে আছে তার মুখপানেই। টলমল করছে তার শান্ত নিবিড় চোখজোড়া । সেই সাথে চোখ মুখে ছেয়ে আছে ভয়,লজ্জা,সংকোচ। তবুও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে,নিজেকে সিফাতের কাছে সমার্পণ করবে বলে। সিফাত এর সবটাই দেখলো, বুঝলোও। তারপরেও, আরও খানিকটা এগিয়ে গেল পলকের দিকে।সিফাতের উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে পলকের চোখে মুখে।সিফাত পলকের খুব কাছে গিয়ে পলকের ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো পলক। দু’ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো তার পদ্মপাতার জলের মতো টলটলে গাল বেয়ে।সেই উষ্ণতা ছুঁয়ে দিল সিফাতকেও।খুব যত্ন করে তবে ছোট করেই চুমুটা দিল সে পলকের ঠোঁটে। সিফাতের এমন আলতো স্পর্শে আরও কাঠ হয়ে গেল পলক। ভেতর ভেতর কাঁপছে সে। ঠোঁট ছেড়ে পলকের মুখপানে চাইতেই মিটমিটেয়ে হাসতে লাগলো সিফাত,পলকের ওই বন্ধ চোখের ভয়ার্তক মুখটা দেখে। ভীষণ রকম আদুরে গলায় বললো,
_বলেছিলাম তো আগেই! প্রস্তুত নন আপনি। আর আপনি তো ভালোও বাসেন না আমাকে। তাই আমার স্পর্শগুলোতে ভালোবাসা থাকলেও সেটা গ্রহণ করতে পারছেন না আপনি। কিন্তু, তাপরেও যদি আমি এগিয়ে নিয়ে যাই এই মূহুর্ত, এই সম্পর্কটাকে, আমার স্পর্শে ভালোবাসা থাকলেও.. আপনার স্পর্শে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা খুঁজে পাবো না আমি।যেটা মোটেও তৃপ্তিদায়ক হবে না।না আমার জন্য আর না আপনার জন্য। তো অযথা কি দরকার…সংকোচ, ভয়, জড়তা নিয়ে ভালোবাসাহীন এমন একটা সম্পর্কে জড়ানোর! শুধু শরীরের টানে এক হয়ে কি লাভ মৃন্ময়ী যদি মনেই অতৃপ্তি থেকে যায়?

পলক চুপ।সিফাতের প্রশ্নের পিঠে দেবার মত কোন উত্তর নেই তার কাছে। নিজের এহেন নির্বোধ আচরণের কারণে ভীষণভাবে লজ্জিতও সে সিফাতের কাছে। বড্ড ছোট লাগছে তার নিজের কাছে নিজেকেই। সিফাত যে কতটা বোঝদার, সহানুভূতিশীল,পরিপক্ক স্বভাবের মানুষ সেটা এতদিনে বেশ বুঝে গেছে পলক। তারপরেও,তার সাথে এই ব্যাপারে খোলামেলা আলাপ আলোচনা না করে এমন নির্বোধের মত আচরণ করাটা ঠিক হয়নি তার,সেটা এখন খুব করে বুঝতে পারছে সে। তাই ভীষণ রকম লজ্জা লাগছে তার সিফাতের মুখোমুখি দাঁড়াতেও। কিছু বলা তো অনেক দূরের কথা।

পলককে এভাবে চুপ থাকতে দেখে সিফাত বুঝলো, ডোজ কাজে দিয়েছে। তাই, পরিস্থিতি সামলে নিতেই সে বললো,

_বেশ রাত হয়েছে মৃন্ময়ী। এবার আসুন..ঘুমাবেন। বলেই পলককে ছেড়ে বিছানার দিকে পা বাড়ালো সে। বিছানা বালিশ সব ঠিকঠাক করে পলককে তাড়া দিল শুতে আসার জন্য।

এতক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে নিরবেই অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল পলক। এবারেও সে পরাস্ত হলো সিফাতের কাছে। সে তো নিজের সব ভয়, লজ্জা, সংকোচের সাথে একরকম যুদ্ধ করেই সিফাতের কাছাকাছি যেতে চেয়েছিল। সিফাতকে তার অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে দাদীর কথা রাখতে চেয়েছিল।তাই তো এমন নির্লজ্জের মত সিফাতকে এসব বলেছে সে।কিন্তু,,সিফাত তো ঠিকই বুঝে গেছে সব। ফিরে গেছে নিজ থেকেই।
_কি হলো আসুন?
সিফাতের তাড়া পেয়ে চোখ মুখে বিছানায় গেল। জায়গা মত শুতেই রোজকার নিয়মে খানিক ভঙ্গ দিয়ে একটা অন্যরকম কাজ করলো সিফাত আজ। পলককে জড়িয়ে না ধরেই তার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বললো,

_আমার অধিকার আমৃত্যু আমারই থাকবে মৃন্ময়ী। তাই সময়,সুযোগ মত সেই অধিকারের ব্যাবহার আর প্রয়োগও আমিই করবো। আপনাকে সেটা বলার বা বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।আমাদের মাঝে মানসিক সম্পর্কটা ভালোভাবে তৈরী হোক আগে, তারপর নিজেদের সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দিবো আমরা। আর আজ আপনি ঠিক কি কারণে এমন করলেন জানি না তবে এটুকু আমি ঠিক বুঝেছি এসব আপনার চাওয়া ছিল না। আর আপনাকে পুরোপুরিভাবে নিজের করে পাওয়ার জন্য আমার কেবল আপনার সম্মতি আপনার চাওয়াটাই চাই। সেটা যত সময়ই লাগুক।এটাই আমার ইচ্ছে। আর অন্যকারও ইচ্ছেতে কিছু করার মানুষ যে আমি নই এটা নিশ্চয় ভালো করেই জানেন আপনি?
_হু।
_তাহলে এমন স্টুপিডিটি করবেন আর কখনো?
_না।
_এই তো গুডগার্ল। বলেই পলকের কপালে গভীরভাবে এঁকে দিল তার প্রেমময় স্পর্শ। তারপর, পলকের কামিজের কাটা অংশের ফাঁক গেলিয়ে সরাসরি ওর পেটে হাত রাখলো আজ। এই প্রথম নিজের শরীরে এভাবে সিফাতের স্পর্শ পেতেই ঝংকার দিয়ে উঠলো পলকের শরীর। সিফাতের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে ছিল সে। সিফাতের মুখোমুখি হতেও যে লজ্জা লাগছে তার আজ। কিন্তু, সিফাতের এমন স্পর্শে চকিতেই ঘাঁড় ঘুরিয়ে চোখ বড় বড় করে সিফাতের দিকে চাইলো সে। তা দেখে সিফাত মিটমিটে হেসে বললো,

_সময় দিচ্ছি ঠিক আছে, তবে ব্যাপারটা আপনার জন্য সহজ করে দিতেও কিন্তু কোন কমতি রাখবো না আমি। বলেই দুষ্টু হেসে চোখ মারলো সিফাত। তারপর, হাত বাড়িয়ে সুইচ অফ করে দিল টেবিল ল্যাম্পটাও। চোখ বুঝলো ঘুমানোর জন্য।

পলক পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সিফাতের এহেন কথা আর কাজে। মনে মনে বললো, কি মানুষ রে বাবা! এই রাগ,এই সোহাগ তো মূহুর্তেই দুষ্টুমূর্তির রূপ তার। ক্ষণে ক্ষণে মুড সুয়িং করে এর। পেঙ্গুইন একটা। বলেই মনে মনেই একটা ভেংচি কাটলো সিফাতকে সে।

_এভাবে আমাকে নিয়ে না ভেবে ঘুমোন মৃন্ময়ী। স্কুল আছে তো সকালে। ঘুম ঠিকঠাক না হলে খারাপ লাগবে। বলেই এ পলককে ওভাবে চেপে ধরেই একটানে আরও খানিকটা কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল একপ্রকার। তারপর, চোখ খুলে পলকের দিকে ঝুঁকে ছোট্ট করে আবারও একটা চুমু খেলো পলকের ঠোঁটে । বললো, এখন ট্রায়াল সেমিস্টেরে শুধু চুমু খেয়েই কাজ চালাচ্ছি, তবে সময় হলে পুরোটাই খেয়ে নিবো আপনাকে। বলেই দুষ্টু হেসে পলকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো সে।

পলক থতমত খেয়ে গেছে সিফাতের কথার এহেন ছিড়ি দেখে। এই সিফাতকে সে চেনে না। সিফাতের মত ভদ্রসভ্য মানুষও যে এই ধাঁচের রোমান্টিক পার্সোন হতে পারে সেটা পলকের ধারণা বাইরে ছিল পুরোপুরি।

একটা ফাঁকা ঢোক গিললো পলক। তারপর,মনে মনে বললো, ট্রায়ালের এর কি ছিড়ি রে বাবা! এরপর, জানলাভেদ করে আসা বাইরের অবাছা আলোতেই সিফাতের ঘুমন্ত মুখটা দেখলো একবার। মুচকি হেসে বললো, captain of my life. তার দিকে তাকিয়ে চোখ বুঝলো সেও।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩৮
©জারিন তামান্না

আচ্ছা,এভাবে কান্না কাটি করলে কিভাবে কি চলবে বলুন তো মৃন্ময়ী? এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট, সামান্য ইনজোর্ড হয়েছি জাস্ট, মরে তো যাইনি আমি।
_এই চুপ! কি সব আজে বাজে কথা বলতেছেন আপনি হ্যাঁ? ভাল্লাগে না আপনার? খুব ভাল্লাগে আমাকে কষ্ট দিতে। এই জন্য এভাবে বলেন আপনি। সিফাতের কপাল থেকে ঝট করে উঠে সোজা হয়ে বসলো পলক।ধমকের সুরে এভাবে বলতে বলতেই কান্নার বেগ আরও একচোট বেড়ে গেল তার।সেটা দেখে মুচকি হাসলো সিফাত। স্যালাইন পুশ করা হাতেই পলকের হাতটা ধরলো আলতো করে। আস্তে করে বললো,

_মৃন্ময়ী..
_কিইই? অভিমানে ভরপুর পলকের গলা।
_ভালোবাসি তো।
_হুহ!

পলকের এমন অভিমান দেখে হাসলো সিফাত। তার হাতের মুঠোয় থাকা পলকের হাতটায় দূর্বল শরীরের হালকা জোর নিয়েই খানিক শক্ত করে চাপ দিতেই আরও বেশি বেশি কেঁদে দিল পলক।এতদিনের জমানো কান্না বোধয় আজ সিফাতের সংস্পর্শে এসে বাঁধ ভেঙে উপচে পড়ছে একেবারে। সিফাত আর কিছুই বললো না। মুগ্ধ হয়ে দেখলো তার মৃন্ময়ীর অশ্রুময়ী ভালোবাসা!
__________________________________

৪ দিন আগে,

রশিদ ছুটিতে গেছে গ্রামের বাড়িতে। তাই আজ সিফাত নিজেই ড্রাইভ করে গিয়েছিল একটা অফিসিয়াল মিটিং এ্যাটেন করতে। ফেরার পথে হাইওয়েতে একটা ট্রাক বেসামাল হয়ে খুব জোরে ধাক্কা দিয়েছে সিফাতের গাড়িটাকে। বেশ ভালো রকম ড্যামেজ হয়েছে গাড়িটা। সিফাতেরও বেশ আঘাত লেগেছে। বিশেষ করে মাথায়। হাতে পায়েও খুব জোর লেগেছে। ৯ ঘন্টা লেগেছে সার্জারি করতে। বলতে গেলে মরতে মরতে বেঁচেছে সে। আইসিইউতে রাখা হয়েছিল তাকে।আজ ৪ দিন পরে জ্ঞান ফিরেছে তার। ডাক্তার বলেছে পায়ে বেশ ভালো রকম আঘাত পেয়েছে। ২/৩ মাসের আগে হাঁটতে চলতে পারবে না । আর ব্রেনেও ইন্টারনাল ব্লিডিং হওয়ায় পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে তার।

সিফাতের এক্সিডেন্টের খবর পাওয়ার পর থেকে পলক একদম শান্ত ছিল। সবাই খুব অবাক হয়েছিল পলকের এমন শান্ত ব্যবহারে। কেউ কেউ বলেছে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা নেই,,টান নেই বলেই একটুও কাঁদেনি পলক। সিফাতের দাদী কত কি শুনিয়েছে পলককে এই নিয়ে।, রেহনুমাও অবাক হয়েছিল পলকের এমন আচরণে। সারাও অনেক কটু কথা শুনিয়েছে।এই চারদিনে তাকে হাসপাতাল থেকে টলানো যায়নি একটুও। প্রথম যেদিন জেদ করেছিল সে হাসপাতালেই থাকবে, সেদিন বাধ্য হয়ে রিহান একটা কেবিন বুক করেছিল সিফাতের নামে। এই চারদিন ধরে পলক সেই কেবিনেই আছে। প্রতিবেলায় সে আইসিইউর সামনে এসে সিফাতকে দেখে যায় আইসিইউ এর বাইরে থেকে। রুকু, রেহনুমা খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু, সে খায় না ঠিকমত। কেবিনে এলেই বেশিরভাগ সময় তাকে জায়নামাযেই পড়ে থাকতে দেখে তারা। পলকের সামনে রেহনুমা প্রতিবারই কেঁদে কেটে অস্থির হলেও পলকের চোখ থেকে এক ফোঁটাও পানি পড়ে না। কিন্তু,,তার চোখগুলো থাকে ভীষণ ফোলা। সিফাতের জন্য সেও কাঁদে। তবে তা কেবল তার রবের দরবারে। জায়নামাযে…সিজদায়। নিশাত খুব অবাক হয়েছিল পলকের এমন আচরণে।কয়েকমাস আগে তাদের বাবার সময় পলক কি কান্না কাটিই না করেছিল। আর এই পলক কি শক্ত হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। সবাইকে সিফাতের জন্য দো’য়া করতে বলছে বারবার। নিশাত একবার কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল,
_তুই এত শান্ত আছিস কি করে রে বুবু? ভাইয়ার জন্য কষ্ট লাগতেছে না তো একটুও?
জবাবে পলক বলেছিল, সব কষ্ট বাইরে প্রকাশ করতে নাই নিশু। বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখেই বিপদমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। আমিও তাই করতেছি। এটাই শিখিয়েছে ওই মানুষটা আমাকে।
পলকের এহেন কথায় সেদিন নিশাত খুব করে বুঝেছিল সিফাত কতটা বদলে দিয়েছে তার এই বোনটাকে। ঠিক কতটা ভালোবাসা দিলে কেউ কাউকে নিজের মত গড়ে নিতে পারে,,বদলে দিতে পারে সেটা সিফাতের কাছে থাকা তার বোনকে দেখেই বুঝেছিল নিশাত।

আজ সিফাতের জ্ঞান ফিরার পরে তাকে কেবিনে শিফট করা হয়।একে একে সবাই দেখা করে গেছে। সবাই রুম থেকে যাওয়ার পরেও পলক রয়ে গেল ওখানেই। নার্স বলেছিল সিফাতের রেস্ট লাগবে।কিন্তু,,সিফাত জেদ করে পলককে এখানেই রেখেছে। তার বিছানাতেই বসিয়েছে তাকে। পলককে একা পেয়ে প্রথমেই সিফাত বলেছিল,
_ কেমন আছেন মৃন্ময়ী?
(পলক চুপ।)
_আমি ভালো আছি মৃন্ময়ী।
নিরবে কাঁদছে পলক। বলছেনা কিছুই।
_আচ্ছা,আমার ঘুমিয়ে থাকাটা কি আপনি জেগে পুষিয়ে দিয়েছেন মৃন্ময়ী?
(পলক চুপ। কাঁদছে নিরবে)
_দাদী বললো আপনি নাকি একটুও কাঁদেননি আমার জন্য! একদম শান্ত স্বাভাবিক ছিলেন।কষ্ট হয়নি আপনার তাহলে। আমি মরে গেলেও বোধয় কাঁদবেন না আপনি। সেটা অবশ্য ভালোই হবে। এমনিতেও মৃত মানুষের জন্য কান্না কাটি কিছু করতে নেই।

এতক্ষণ নিরবে কাঁদলেও এখন তার কান্না ফোঁপানোতে পরিণত হলো। কিন্তু, সিফাত থেমে নেই। সে নিজের মত বলেই যাচ্ছে।
_জানেন মৃন্ময়ী, এক্সিডেন্ট হওয়ার পরে আমি তো কলেমাও পড়ে ফেলেছিলাম। ভেবে ছিলাম এই যাত্রায় বোধয় ওপারেই ঠাঁই হবে সরাসরি। আফসোসও হচ্ছিল,,আপনাদের কাউকে শেষবারের জন্য না দেখেই যেতে হবে ভেবে। আপনার কপালে শেষবার আমার ভালোবাসা না ছুঁইয়েই বোধয় চোখ বুজতে হবে আমাকে চির..

এতক্ষণ সিফাতের পাশে বসে চুপচাপ শুনছিল সব পলক। একের পর এক সিফাতের এমন কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেও ওটুকু বলার সাথে সাথে হামলে পড়লো সে একপ্রকার সিফাতের কপালে।প্রথমবারের মত খুব গভীরভাবে এঁকে দিল তার প্রেমময় স্পর্শ। সিফাত পুরো থতমত খেয়ে গেল আচমকা পলকের এমন আদুরে আক্রমণে। কয়েকসেকেন্ড সময় লাগলো তার ব্যাপারটায় ধাতস্ত হতে। ব্যাপরটা বুঝতেই মনে প্রাণে খুশির জোয়ার বয়ে গেল তার।শরীরে এত এত আঘাত আর ব্যান্ডেজ নিয়েও পরম সুখে আবিষ্ট হলো সিফাত। এক হাতে ব্যান্ডেজ করা। অন্যহাতে স্যালাইন পুশ করা। সেই হাতেই আলতো করে পলকের পিঠে হাত রাখলো সিফাত। পলক ওভাবেই লেপ্টে আছে সিফাতের সাথে। কাঁদছে প্রচুর। সিফাতের চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে সুখজল। পলক মুখে কিছু না বললেও আজ তার এই কান্না,,এই স্পর্শ খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিল, পলক তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।

____________________________________

কিছুদিন পরে,

হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনা হয়েছে সিফাতকে । পলক দিন রাত তার সেবা করে। তাকে গোসল করানো থেকে শুরু করে নিজ হাতে খাওয়ানো, মেডিসিন দেওয়া সবটা পলক নিজেই করে। বিভিন্ন কথা বলে, গল্প করে তাকে সঙ্গ দেয়। সিফাত বেশ কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করছে পলক স্কুলে যাচ্ছে না। প্রথমে একবার জিজ্ঞেস করেছিল সে, কেন যাচ্ছে না স্কুলে। তখন পলক বলেছিল ইমার্জেন্সি লিভ নিয়েছে কয়েকদিনের। কিন্তু,বাড়ি ফিরে আসার ২ সপ্তাহ পরেও তাকে স্কুলে যেতে না দেখায় বেশ খটকা লাগলো সিফাতের। একদিন সকালে সিফাতকে খাইয়ে দিচ্ছিল পলক। খেতে খেতেই সিফাত জিজ্ঞেস করলো,
_মৃন্ময়ী?
_হুম।
_স্কুলে কেন যাচ্ছেন না আপনি? ইমার্জেন্সি লিভ তো এতদিন হয় না কখনো কারো।
সিফাতের এহেন প্রশ্নে কিছুসময় তার মুখের দিকে শান্তচোখে তাকিয়ে রইলো পলক। তারপর, খুব স্বাবাবিক স্বরেই বললো,
_চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি আমি।
_কিহ? বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো সিফাত।
_হ্যাঁ। বলেই আরেক চামুচ স্যুপ মুখে তুলে দিল সে সিফাতের। কিন্তু সিফাত সেটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
_এটা কেন করেছেন আপনি? আপনাকে তো আমি চাকরি ছাড়তে মানা করেছিলাম বিয়ের আগেই। এটা আপনার নিজস্ব পরিচয় মৃন্ময়ী।
_আমার পরিচয় আপনি। বিয়ের পর আপনার পরিচয়ই যথেষ্ট আমার জন্য।
_What rubbish! এইসব টিপিক্যাল উমেন টাইপ কথা কবে থেকে বলেন আপনি মৃন্ময়ী? উত্তেজিত স্বরে বললো সিফাত।
_এখানে টিপিক্যাল উমেন হওয়ার কি আছে ক্যাপ্টেন! আপনার স্ত্রী আমি। আপনার এমন ক্রিটিকাল অস্থায় আপনাকে একা ফেলে চাকরি করতে নিশ্চয় যাবো না আমি!
_ও..তারমানে আমি অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছি বলেই আপনি আমার সেবা করার জন্য চাকরিটা ছেড়েছেন!
আমার সেবা কে করতে বলছে আপনাকে? ডক্টর তো বলেছিল নার্স এপয়েন্ট করতে।তাহলে তখন কেন মানা করেছিলেন আপনি?

ঠিক তখনই সিফাতের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সিফাতের দাদী বললেন,
_অয় মানা করে নাই। আমিই না করতে কইছি। ঘরে তোর বিয়া করা বউ থাকতে বাইরের মাইয়া মানুষ আইয়া সেবা ক্যান করবো তোর?
দাদীর কথায় হতভম্ব হয়ে গেল সিফাত। তারমানে এই চাকরিটা পলক স্বেচ্ছায় ছাড়েনি।তাকে বাধ্য করা হয়েছে।

ভীষণ রকম রাগ উঠে গেল সিফাতের পলকের উপর। পলককে সে বারবার বলেছিল বিয়ের পরেও সে চাইলে চাকরিটা কন্টিনিউ করতে পারে। তাকে চাকরি ছাড়ার প্রয়োজন নেই। পলকও চেয়েছিল চাকরিটা করতে। এমনকি বিয়ের পরে সিফাতই তাকে বলেছিল যেন তার বেতনটা আগের মতই তার বাবার বাড়িতে দেয়। অন্তরা যেহেতু এখন কিছু করছে না,,এই টাকাটা তার কাজে লাগবে। যদিও পলাশ এতে খুব আপত্তি করেছিল, কারণ তার বেতনই যথেষ্ট এই পরিবারকে স্বচ্ছলভাবে চালিয়ে নিতে। তারপরেও সিফাত বলেছিল, পলক এই পরিবারের মেয়ে। তাকে শিক্ষা দিক্ষা দিয়ে এতখানি যোগ্য এই পরিবার করেছে। তাই এটা তার কর্তব্য যে সে তার আয় থেকে এই পরিবারে কন্ট্রিবিউট করবে। সিফাতের এমন কথায় পলাশ বা ওই পরিবারের কেউই আর আপত্তি করতে পারেনি। বরং, অভিভূত হয়েছিল সিফাতের এহেন চিন্তা ভাবনা দেখে। কিন্তু, সেই চাকরিটাই পলক ছেড়ে দিল। রাগে দুঃখে পলককে সে বললো,
_এসব নিয়ে যাও মৃন্ময়ী। খাবো না আমি আর।
_ক্যান,খাবি না ক্যান?
_খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি এখন যাও দাদী। আমি রেস্ট নিবো।
সিফাতের এমন কাঠকাঠ গলায় বলা কথা শুনে দাদী চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কিন্তু,পলক নড়লো না। তা দেখে রাগী স্বরে সিফাত বললো,
_বসে আছো কেন,যাও। রেখে আসো এগুলা।
_আমি চাকরিটা দাদীর কথায় ছাড়িনি কিন্তু। নিজে থেকেই ছেড়েছি। আপনি হাসপাতালে থাকাকালীন সময়েই।
_কেন?
_কারণ, আপনার চাইতে, আমার পরিবারের চাইতে আমার চাকরি করাটা জরুরি না আমার কাছে। আল্লাহ তো আমাকে এমন কোন পরিস্থিতিতে ফেলেননি যে চাকরিটা আমাকে করতেই হতো। তাছাড়া সময়ের দাবীতে আমাদেরকে অনেক সময় অনেক কিছু ছাড়তে, নতুন করে গড়ে নিতে হয় জীবনে। আমার মনে হয়েছে এখন স্কুলে সময় দেওয়ার চাইতে আমার মানুষটাকে সময় দেওয়া বেশি জরুরি। কিন্তু, স্কুল তো আর আমাকে এতদিনের ছুটি দিবে না। তাই ছেড়ে দিয়েছি চাকরিটা।
_খারাপ লাগছে না আপনার?
_হুউউ,,খারাপ লেগেছিল।, ২ বছর ধরে করছিলাম চাকরিটা। কিন্তু, আফসোস হয়নি বিন্দুমাত্র। আজ একটা ছেড়েছি, অন্যটা খুঁজে নিবো পরে।
_এই দেশে চাকরি সোনার হরিণ মৃন্ময়ী।
সিফাতের এহেন কথায় মুচকি হাসলো পলক। তারপর,আবার একচামচ স্যুপ চামচে নিয়ে পলক বললো,
_আমি কেবল একটা চাকরি ছেড়েছি। নিজের পরিচয় নয়। আমি এখন assistant director of Alam Group of industry. I’m working behalf on Mr. Safwan Shifat.
_What? চমকে প্রশ্ন করলো সিফাত।
_হ্যাঁ। বাবা নিজেও চাননি আমি নিজের এই পরিচয়টা এভাবে ছেড়ে দেই। তাই উনিই আমাকে অফার করেছিলেন আপনার জায়গায় কাজ করার জন্য। আমি তো এখনো পারিনা আপনার মতো এত সুন্দর করে সবটা হ্যান্ডেল করতে, কিন্তু তারপরেও বাসায় বসে যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি আপনার কাজটুকু সামাল দেওয়ার। আর তাছাড়া আপনিই তো বলেন, আমি মিসেস. সাফওয়ান সিফাত। তো তার জন্য তার হয়েই তো থাকবো আমি, তার সব ভালো খারাপ সময়ে, সব পরিস্থিতিতে…তাই না?

সিফাত পুরো অবাক। পলকের মুখে এমন কনফিডেন্ট আর ডেডিকেটেড কথাবার্তা শুনে। তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে এই শুনে যে ইশতিয়াক আলম যে কিনা পলককে পছন্দই করে না খুব একটা সে নিজেই পলককে তাদের ব্যবসায়, কোম্পানিতে জয়েন করতে বলেছে। পলককে Working woman হিসেবে নিজের পরিচয়টা ধরে রাখতে সাহায্য করছে।

_আপনি সুস্থ হওয়ার পরেও কিন্তু আমি এই জবটা কন্টিনিউ করবো। আপনি আপত্তি করবেন না নিশ্চয়? পলক বললো।
_ আপনাকে আমি ছাড়তে দিলে তো! বলেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সে পলককে। ভীষণ খুশি সে। সত্যিই আল্লাহ কারো সাথে অবিচার করে না। বান্দার কাজ আর নিয়তের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তার বিপরীতে বান্দার জন্য তার রহমত সরূপ একটা না একটা ব্যবস্থা করেই দেয়। পলকের ধৈর্য্য, ভালো ব্যবহার, সিফাতের প্রতি, এই পরিবারের প্রতি ভালোবাসা এই সব কিছু ইশতিয়াক আলমের মনেও ঠিক জায়গা করে দিয়েছে পলকের জন্য। তাই তো তিনি নিক থেকেই পলকের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাকে সাপোর্ট করেছে এভাবে! সত্যিই মানুষ তার কর্মের ফল ঠিকই পায়। সিফাত পেয়েছে পলকের ভালোবাসা, পলক পেয়েছে তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকার আর জায়গাটা।

________________________________

২ মাস পরে,

সিফাত এখন পুরোপুরি সুস্থ। পলকের সেবা, ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট,মেডিসিন সব কিছুতে খুব দ্রুত রেস্পন্স করেছে সিফাতের শরীর। তাই এতটা ক্রিটিকাল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২ মাসেই সুস্থ হয়ে উঠেছে সিফাত। দেখতে দেখতে সিফাত আর পলকের বিয়েরও ৫ মাস হয়ে গেছে। আজকাল সিফাত আর পলক দুজনেই একসাথে অফিসে যায়। সিফাত অসুস্থ থাকাকালীন সিফাতের সাহায্য নিয়ে বেশ ভালোভাবেই সবটা সামলেছে পলক। পরিবারের সবাই বেশ খুশি পলকের অফিস জয়েন করায়।ইশতিয়াক আলমও বেশ সন্তুষ্ট আজকাল পলকের প্রতি। একসাথে কাজ করার সুবাদে পলকের সাথে বেশ ভালো বন্ডিং হয়ে গেছে তার। এখন আর আগের মত দূরত্ব রেখে চলেন না তিনি। বেশ স্নেহ করেন পলককে তিনি।
_______________________________

আজ সিফাতের জন্মদিন।, এতবড় এক্সিডেন্টের পরে অনেক কঠিন সময় পাড় করেছে সবাই। বিশেষ করে পলক আর সিফাত। তাই সবার মন রিফ্রেশ করার জন্য রুকুর আইডিয়াতে সিফাতের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে একটা ছোটখাটো সেলিব্রেশনের আয়োজন করা হয়েছিল আজ। আইডিয়াটা অবশ্য রুকুই দিয়েছে। সিফাত হৈ হট্টগোল করে জন্মদিন পালন করাটা পছন্দ করেনা একদম। তাই রাতে রুকু,সারার শশুড়বাড়ির পরিবার, পলকের পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটা ফ্যামিলি ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল একটা রেস্টুরেন্টে। সিফাতের জন্মদিন উপলক্ষে ইয়ানাকে দিয়ে এই ট্রিটের ব্যবস্থা করেছে সবাই বুদ্ধি করে। কারণ, কারও কথা রাখুক না রাখুক ইয়ানার আবদার সে কখনোই ফেলতে পারে না। হলোও তাই। রাতে সবাই মিলে ডিনারে গিয়েছিলো।

বাড়ি ফেরার পর একটা প্রজেক্টের কাজের জন্য সিফাতকে এতক্ষণ স্টাডিরুমেই আটকে রেখেছিল রিহান। তাই কাজ শেষ করে ঘরে আসতে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে সিফাতের।

রাত ১১:২৭ মিনিট।

ঘরে এসে সিফাত দেখলো ঘরে ড্রিম লাইট জ্বালানো কেবল। ঘরও খালি। পলক নেই ঘরে। সিফাত ভাবলো হয় তো বেলকনিতে আছে। ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘরের আলোটাও জ্বালিয়ে দিল সে। গলার টাই খুলতে খুলতেই এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। কিন্তু আলমারির কাছে যাওয়ার আগেই নিভে গেল ঘরের আলোটা। দাঁড়িয়ে গেল সে। লোড শেডিং হয়েছে। কিন্তু আই পি এস চালু হচ্ছে না। অবাক হলো সিফাত। ফ্ল্যাশ লাইট অন করার জন্য পকেট থেকে ফোনটা বের করতে যেতেই ঘরে হলুদ আভার রেশ দেখতে পেল সে। আলোর উৎস খুঁজে পেছনে তাকাতেই একরকম ঝটকা খেলো সিফাত। হাতে মোম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পলক। পড়নে তার সিফাতের দেওয়া সেই কালো জর্জেট শাড়িটা। গোল গলার হাফ হাতার ব্লাউজ। ব্লাউজটা কোমড়ের উপর থেকে দুই ইঞ্চি উপরে হওয়ায় শাড়ির ফাঁক গেলে বিছাটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পলকের শরীরে,পাতলা শাড়ির ভেতর একদম ফুঁটে উঠেছে ওটা। মোমের আলোয় যেন আরও বেশি ঝলমল করছে সেটা। চুলগুলো সামনে থেকে টেনে পেছনে খোপা করেছে পলক। খোপায় ধবধবে সাদা বেলিফুলের গাজরা।
হাতে রূপার একজোড়া বালা। নাকে সবসময়কার পড়া ডায়মন্ডের নাকফুলটা। মোমের আলোয় চিকচিক করছে সেটা।ব্যাস! আর তেমন কোন গয়না নেই পলকের গায়ে। মোমটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সিফাতের সামনে এসে দাঁড়ালো পলক। সিফাতের মুখপানে চাইলো পলক। তার চোখ মুখে ছেঁয়ে আছে অন্য রকম এক আভা।সিফাত অবাক হয়ে দেখছে পলককে। কাছ থেকে আরও খেয়াল করে দেখলো সিফাত। চোখে মোটা করে কাজল টানা। পলককের শান্ত নিবিড় ওই চোখজোড়ায় এই কাজল যেন গোটা এক অর্ধচন্দ্র অমাবস্যার রাত নামিয়ে এনেছে। এতটাই মনোমুগ্ধকর লাগছে তাকে। ঠোঁটে কেবল ওয়াটার কালারের লিপগ্লস দেওয়া।জ্বলজ্বল করছে তার ঠোঁট জোড়া। মুখে আর কোন প্রসাধনী নেই। সিফাতকে এমন অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে পলক মৃদু হাসলো। সিফাতের কাছে একদম অন্যরকম লাগলো এই হাসিটা।এই হাসি, কাজল কালো চোখের ভাষা এই সব কিছুই পলককে আজ এক অদ্ভুত মোহনীয় রূপে সাজিয়ে তুলেছে।

_শুভ জন্মদিন, ক্যাপ্টেন! -পলকের কন্ঠস্বরও বড্ড গভীর শোনালো এই মূহুর্তে।
_মৃন্ময়ী! – ঘোর লাগানো কন্ঠে ডাকলো সিফাত।
সিফাতের এহেন ডাকে তার আরও খানিকটা কাছে এগিয়ে গেল পলক। একহাতে আলতো করে হাত রাখলো সিফাতের গালে। তার খুব কাছে গিয়ে পরম যত্নে আর ভীষণ গভীরভাবে সিফাতের অন্যগালে এঁকে দিলো নিজের প্রেমময় স্পর্শ। তারপর, সিফাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে অদ্ভুত ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো,
_ ভালোবাসি প্রিয়!

সিফাতের চোখে মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। ভেতরকার খুশি আনন্দ সব উপচে পড়ছে তার ভুবন ভুলানো হাসিতে। একহাতে তার গালে রাখা পলকের হাতটা ধরলো সে। অন্যহাতে পলকের কোমড় জড়িয়ে ধরে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। পলকের মুখপানে চেয়ে নেশা ধরে কন্ঠে বললো,
_আজ যদি অবাধ্য হই,
হই কোন বেপরোয়া প্রেমিক,
সব নিয়ম……সব অধিকারের গন্ডি পেরিয়ে
হই যদি কোন অশান্ত ঝড়,
তছনছ করে দেই প্রেমিকার
এতকালের সযত্নে রাখা প্রেমমহল,
যদি প্রেয়সীর কপালে বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে
তার সর্বস্ব আমার করে নেই,
যদি প্রেমপিপাসী হয়ে ঠোঁটের পেয়ালায়
শুষে নেই তার সবটুকু প্রেম
যদি উপড়ে ফেলি সব দূরত্ব
সংকোচ, আর আঁড়াল
যদি পূর্ণতার চাদরে জড়িয়ে
আজ এক করি ভালোবাসা,
অনুমতি দেবেন কি আমায়,
আমার মৃন্ময়ী…প্রিয়তমা?!

এতক্ষণ মন্ত্রমগ্ধের মত শুনছিল পলক সিফাতের বলা প্রতিটা শব্দ,প্রতিটি কথা।মুগ্ধ নয়নে সিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মাতাল চোখে পলকের মুখপানে চেয়ে আছে সিফাতও। অপেক্ষার অবসান খুঁজছে সে, তার মৃন্ময়ীর সম্মতিতে। কিন্তু,পলক কিছু বললো না। সিফাতের বুকের বা পাশটায় হাত রেখে লাজুক হাসলো কেবল। সিফাতও মুচকি হেসে পলকের আঙুলের ফাঁক গেলে নিজের আঙুল জড়িয়ে শক্ত করে মুঠো বন্দি করে নিল তার মৃন্ময়ীকে। অগ্রসর হলো ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়ে।

____________________________________

ভোর ৫:১৯ মিনিট।

বেলকোনির রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে পলক।তার কোমড় ছাপানো ঘন চুলগুলো থেকে বৃষ্টি ফোঁটার মত টপটপ করে পানি ঝরছে এখনো। এক অপার স্নিগ্ধতা বিজার করছে পলকের শরীরজুড়ে।পূর্ণতার স্বাদে পরিতৃপ্ত সমস্ত মন-প্রাণ। গতরাতে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছে সে সিফাতকে। নিজের মাঝে ধারণ করেছে তার স্পর্শ, গন্ধ, অস্তিত্ব। নতুন করে জেনেছে ভালোবাসার অন্য এক রূপকে।

এখনো পৃথিবীর বুকে আলো ফোঁটেনি ঠিকভাবে। পরিপূর্ণতার রাত শেষে প্রথম ভোর দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে। আচমকা পেছন থেকে এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল সিফাত।পলকের চুলে নাক ডুবিয়ে, শাড়ির ফাঁক গেলিয়ে হাত রাখলো পলকের পেটের উপর।অন্যহাতে পলকের সামনে এগিয়ে দিলো কফির মগটা। সিফাতের এহেন উপস্থিতি টের পেয়ে মুচকি হাসলো পকল।হাত বাড়িয়ে নিল কফির মগটা। একটা চুমুক দিয়েই ওটা আবার বাড়িয়ে দিল সিফাতের কাছে।ঘাঁড় কাত করে মাথাটা এলিয়ে দিল সিফাতের বুকে। ধীরে ধীরে সূর্য উঁকি দিচ্ছে।তার ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর কোণায় কোণায়। খানিকটা উষ্ণ আলো এসে জুড়ে বসলো সিফাত আর পলকের ছোট্ট বেলকনিতেও। কফিতে চুমুক দিতে দিতে পলককে নিয়েই এই নতুন ভোরের সূচনা দেখলো সিফাত। মনে মনে বললো, আলহামদুলিল্লাহ!

____________________________________

সকাল ৫ :৪০ মিনিট।

বিছানা বালিশ সব উল্টেপাল্টে দেখছে পলক। বাদ যায়নি বিছানার চাদরটাও। বিছানার নিচে, সাইড টেবিলের আশে পাশেও খোঁজা শেষ। একসময় ক্লান্ত হয়ে কোমড়ে দু হাত দিয়ে দাঁড়ালো সে। মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো জিনিসটা ঠিক কোথায়! কিন্তু মনে পড়ছে না তার কিছুতেই। সোফায় বসে মোবাইলে কিছু একটা করছিল সিফাত। সেই সাথে দেখছিল পলকের এমন তোলপাড় করা তল্লাশি। মিটিমিটি হাসছে সে,পললের এমন হয়রানি দেখে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে পলক আরও একবার বিছানার চাদরে হাত দিতেই সিফাত বললো,
_কিছু কি খুঁজছেন মৃন্ময়ী?
_আ..আব…হ্যাঁ।
_কি সেটা?
_ওই তো কোমড়ের বিছাটা। রাতে আপনি খুলে…একটুকু বলতেই পলক খেয়াল করলো সিফাত মিটমিটিয়ে হাসছে। তা দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে পলক বললো,
_আপনি হাসছেন কেন বলুন তো?
_আমি??! আমি কোথায় হাসছি! আমি চুপচাপ বসে আছি। অপেক্ষা করছি আপনি কখন বেডসীট চেঞ্জ করে বিছানা গোছাবেন আর আমি ঘুমাবো। সারারাত তো ঘুমানোর সুযোগই পেলাম একটুও…বলেই পলককে দেখিয়ে মিথ্যামিথ্যি হাই তুললো সিফাত।
পলক পুরো অবাক সিফাতের মিথ্যাচার দেখে। একটু আগে এমন স্ট্রং করে খাওয়া কফির পরে তো কারও এমন ঘুম পাওয়ার কথাই না! আর সিফাত কি সুন্দর ঘুম পাওয়ার ভান করছে!! তা দেখে ভেংচি কাটলো পলক সিফাতকে। তারপর আবার পেছন ঘুরে আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। সিফাত আবারও হাসলো তা দেখে। সোফা ছেড়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো পলককে। তার গালে চুমু দিয়ে বললো,
_আমার অধিকার ওটা।শুধুই আমার। তারপর, পলককে সামানে ফিরিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো সিফাত তার সামনে। হাতের মুঠোয় থাকা বিছাটা বের করে আজ নিজেই শাড়ির আঁচল সরিয়ে জড়িয়ে দিল ওটা পলকের কোমড়ে। পলকের কোমড়ে একদম ঝলমল করছে বিছাটা। তা দেখে মুচকি হাসলো সিফাত। উঠে দাঁড়িয়ে পলককে তাড়া দিল বিছানা রেডি করার জন্য। ঘন্টা ২ ঘুমিয়ে নেবে ওরা। তারপর ৯ টায় অফিসে যাবে।

বিছানায় গিয়ে সিফাত বালিশ ঠিকঠিক করে শুতে শুতে পলককে বললো ঘুমাতে আসার জন্য। পলক বিছানায় উঠেই আজ ঝট করে তার জন্য রাখা বালিশটা সরিয়ে দিল। তা দেখে অবাক হয়ে সিফাত বললো,
_বালিশ সরালেন কেন?
_কারণ আপনি থাকতে আজ থেকে ওটার আর কোন দরকার হবে না। বলেই চুলগুলো ঠিক করতে করতে সিফাতের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো পলক। সিফাত কিছু বললো না আর। মুচকি হাসলো কেবল। তার মৃন্ময়ী বুঝে গেছে বুকে ঠাই নেওয়ার পরে বুকের কাছে বালিশ রেখে শোয়ার প্রয়োজন নেই আর তার। পলকের কপালে গভীরভাবে চুমু দিয়ে রোজকার মতই জড়িয়ে ধরলো তাকে। চুলে বিলি কাটতে কাটতেই চোখ বুজলো সে। কিন্তু, একটু পরেই বুকের উপর উষ্ণ কিছুর অনুভূতি হতেই ঝট করে চোখ খুললো সিফাত। পলক কাঁদছে! কিন্তু কেন? চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো পলককে,
_মৃন্ময়ী!! কি হয়েছে? কাঁদছেন কেন আপনি?
পলল কিছু বলছে না।
_এইইই মৃন্ময়ী? পলকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকছে তাকে সিফাত। কিন্তু পলক চুপ। এভাবে কিছুই বুজতে পারছে না সিফাত কি হয়েছে। তাই আবারও প্রশ্ন করলো পলককে,
_আপনার কি ব্যাথা করছে মৃন্ময়ী? কষ্ট হচ্ছে বেশি? উঠুন,,ডাক্তারের কাছে যাই চলুন। বলেই পলককে বুকে নিয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল সিফাত। তখনই পলক মুখ খুললো। বললো,
_যদি কখনো জানতে পারেন আমি আপনার থেকে আমার কোন অতীত লুকিয়েছি, যেটা বিয়ের আগেই জেনে নেওয়াটা আপনার অধিকার ছিল,আর আমি সেই অধিকারটা ক্ষুণ্ণ করেছি..তখন কি করবেন আপনি?সিফাতের বুকে মাথা রেখে এক হাতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো পলক।

সিফাত ঠিক বুঝলো না পলক তার কোন অতীতের কথা বলছে। তবে আন্দাজ করে নিল কিছুটা। পলকের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বললো,
_ভেবে দেখবো আগে…আপনার না বলার কারণ কি ছিল। লুকিয়ে যাওয়াটাই বা কতটা যুক্তি সংগত ছিল। যদি মেনে নেওয়ার মত হয় মেনে নেবো, নয় তো কষ্ট পাবো একাই। তবে,, পরবর্তীতে আপনাকে কাছে টানতে না পারলেও ছাড়তেও পারবো না কোনমতেই। কিন্তু, আজ এসব কথা কেন বলছেন আপনি আমাকে?

কতক্ষণ চুপ করেই শুয়ে রইলো পলক। তারপর খুব অপরাধী কন্ঠে বললো, তিয়ানের সাথে রিলেশনশিপে ছিলাম আমি ২ বছর। কিন্তু, সেসময় তিয়ান জাপানে ছিল।গ্রেজুয়েশনের জন্য।ওই বিয়েটার জন্য আমরা ব্রেকআপ করি। বিয়ের আগেই বলতে চেয়েছিলাম আমি কিন্তু,বলতে পারিনি। কষ্ট দিতে চাইনি আপনাকে। কিন্তু,আজ জীবনের এমন একটা পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে এত এত ভালোবাসার যোগ্য হয় তো নই আমি একজন প্রতারক আমি।

_জানি আমি । – বলতেই ঝট করে উঠে বসলো পলক সিফাতের বুকের উপর থেকে। তার চোখে ঠিকড়ে পড়ছে রাজ্যের বিস্ময়। সিফাত সব জানে এটা তার কল্পনাতীত ছিল। পলকের চোখে এহেন বিস্ময় হতভম্বিতা দেখে মুচকি হাসলো সিফাত। তারপর পলকের কুনুই ধরে টান দিয়ে তাকে আবার নিজের বুকের উপর এনে ফেললো সে। আচমকা টানে বেশ কিছু চুল এসে ঝাপটে পড়লো পলকের মুখের উপর। আলতো হাতে সযত্নে সেগুলো সরিয়ে তার কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বললো সিফাত,

_আমি সবটা জেনেই আপনাকে ভালোবেসেছি মৃন্ময়ী। তিন কবুল বলে বিয়ে করে আপনাকে নিজের স্ত্রী…নিজের অস্তিত্বের অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করেছি। তাই, অতীত যা ছিল, ছিলই। বর্তমান আর ভবিষ্যৎটা হবে আমাদের। শুধুমাত্র আমাদের।
_আপনি এসব জানতেন তবুও কেন কিছু বললেননি আমাকে? আর কে বলেছে এসব আপনাকে?
_বিথি বলেছে।
_বিথু! অবাক হয়ে বললো পলক।
_হ্যাঁ। আমিই জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন কথায় কথায়। তিয়ানের চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছি আপনার জন্য। এবং সেটা অবশ্যই বন্ধুত্বের চাইতেও বেশি। কিন্তু, প্রথম আমার খটকাটা সেদিনই লেগেছিল যেদিন শপিংমলে তিয়ানকে দেখার পরে আপনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ভেতর ভেতর। প্রথমে তেমন পাত্তা না দিলেও আপনাদের পহেলা ফাল্গুণের ছবিগুলো দেখেই বুঝে গেছিলাম তিয়ান ভালোবাসে আপনাকে। তিয়ানের চোখে আপনার জন্য যে মুগ্ধতা ছিল তা একজন প্রেমিকের মুগ্ধতা তার প্রেয়সীর জন্য। ভালো তো আমিও বেসেছি আপনাকে। এটা বুঝতে পারাটা খুব একটা কঠিন কিছু ছিল না আমার জন্য। আর বিথির পার্টিতে আপনার সাথে ডান্স করার সময় তিয়ানের চোখে যে রুক্ষতা আমি দেখেছিলাম সেটা ছিল জেলাসি।আপনাকে পাওয়ার জেদ,নেশা। পরে তো সে নিজেই স্বীকার করেছিল সে আপনাকে ভালোবসে। সবার কাছে সেই ভালোবাসার নাম বন্ধুত্ব হলেও তিয়ানের চোখে সেই ভালোবাসার নাম ছিল প্রেম। এরপর বিথিকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।সে আমায় ভরসা করে সত্যিটাই বলেছিল।
_আপনি সব জেনে বুঝেও বিয়ে করলেন আমাকে? একটুও ঘৃণা হলো না আপনার আমাকে? এভাবে ঠকানোর পরেও কেউ কাউকে এতটা ভালো কি করে বাসতে পারে ক্যাপ্টেন?
বলতে বলতে সিফাতকে আঁকড়ে ধরেই ঝরঝর করে কেঁদে দিল পলক।কিন্তু সিফাত তাকে থামালো না। কাঁদতে দিল। বরং আরও পরম যত্নে বিলি কাটতে লাগলো তার মাথায়। বললো,
_আপনি তো আমাকে ঠকাননি মৃন্ময়ী। তিয়ান আপনাকে প্রেমিকের মত ভালোবাসলেও আপনার চোখে আমি তার জন্য সেই ভালোবাসা দেখিনি। বরং সেখানে আমি প্রতিবারই আমাকে খুঁজে পেতাম। আপনি না বুঝলেও আপনার অনুভূতির শহরে আমার প্রবেশ কিন্তু ঠিকই ঘটে গিয়েছিল মৃন্ময়ী। আর তিয়ান আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে মৃন্ময়ী। তাই আপনার চাওয়াটাকে সম্মান করেই আপনাকে আমার হতে দিয়েছে।আমি নিজেও রেসপেক্ট করি তিয়ানের এই ভালোবাসাকে। আর, আপনি যখন সব ভুলে কেবল আমার হতে প্রস্তুত হয়েছিলেন তাহলে কেন আমি আপনাকে গ্রহণ করতাম না বলুন তো? তাছাড়া কথায় বলে, “প্রেমের মরা জলে ডোবে না। ” তাই নিজেকে ছাড়লেও আপনাকে ছাড়তে পারবো না আমি। আমার আপনাকেই চাই,,,শুধুমাত্র আমার মৃন্ময়ীকেই চাই আমার।

_আপনি এত ভালো কেন? কাঁদতে কাঁদতেই আজ আবারও এই প্রশ্নটা করলো পলক। তা শুনে এবার সজোরেই হেসে দিল সিফাত। তারপর পলককে তুলে চোখ মুছিয়ে দিল তার। আবার বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
_ভালোবাসি যে, মৃন্ময়ী!

চলবে…