ভালোবাসি প্রেয়সী পর্ব-০২

0
354

#ভালোবাসি_প্রেয়সী [০২]
#জান্নাতুল_বিথী

দুই বিষয় ক্লাস করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পড়ি আমি। আয়েশা আজ ভার্সিটিতে আসেনি বলে আনমনে একা একা হাটা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিলো না। আজ দুজনেরই একসাথে পুরো ভার্সিটি ঘুরার কথা ছিলো, কিন্তু হঠাৎ আয়েশা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর আসতে পারেনি। নিজে তো আসেই নি বরং আমাকে জোর করে পাঠালো। তার উপর এতো ঝামেলা হলো, ভেবেই বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভার্সিটি থেকে বের হতে নিলেই সামনে এসে দাড়ায় তখনকার সিনিয়র আপু ভাইয়ারা। তাদের সাথে বাড়তি একজন আছে, আর সে হলো স্বয়ং ইমাদ ভাই। তাদের দেখে বিরক্তিতে নাক মুখ কুচকে ফেলি আমি। কোনো কথা না বলে চুপ করে অপেক্ষা করি তাদের কিছু বলার। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ করে ইমাদ ভাই বললো,

‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে মিস উপমা?’

তার প্রশ্নে নাক মুখ কুচকে বললাম,

‘আমি যেখানেই যাই না কেনো আপনাকে নিশ্চয় কৈফিয়ত দিবো না তাই না সিনিয়র ভাইয়া?’

শেষের কথাটা অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলায় সে কপাল কুচকে বললো,

‘ভার্সিটি ছুটি না হতেই তুমি চলে যাচ্ছো আর বলছো আমাদের কৈফিয়ত দিবে না?’

‘আরো অনেকেই তো আছে কই তাদের কে তো গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন না কেনো চলে যাচ্ছে? আমার পেছনে পড়ে আছেন কেনো?’

‘তোমার কি মনে হয় আবরার ইমাদ তোমার পেছনে পেছনে ঘুরবে? দিবা স্বপ্ন দেখো নাকি?’

তার কথা শেষ হতে না হতেই হাসির রোল পড়ে যায় তাদের মাঝে। আমি বুকে দুই হাত গুজে বললাম,

‘পেছন পেছন না ঘুরলে সামনে থেকে সরুন, আমি বাড়ি যাবো।’

‘তুমি না একটু আগে প্রোপোজ করছো আমাকে? ধরো এখন তোমার প্রোপোজাল আমি এক্সেপ্ট করলাম। তাহলে এজ আ গার্লফ্রেন্ড হিসেবে তোমার উচিত আমার সাথে ডেটে যাওয়া!’

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাই আমি। উনি আমাকে নাচানোর জন্য প্রোপোজালএক্সেপ্ট করছে এতোটুকু বুঝতে পারছি। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘আমার তো খেয়ে দেয়ে আর কোনো কাজ নেই তাই না? আমি কি না ডেটে যাবো আপনার মতো একজন মানুষের সাথে? ব্যাপারটা হাস্যকর!’

চারদিক থেকে অনেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কেউ কিছু বলার হয়তো সাহস পাচ্ছে না। ফ্রি তে বিনোদন নিচ্ছে সবাই। ইমাদ ভাইয়া বুকে দুই হাত গুজে আমার দিকে হালকা ঝুকে বললো,

‘তুমি আমাকে প্রোপোজ করছো এটা ভার্সিটির সবাইই দেখেছে। এখন সবাইকে সাক্ষী রেখে আমি তোমার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করলাম। নাও এখন চুপচাপ সামলাবে নাকি চেঁচিয়ে বাংলা সিনেমার মতো নাটক করবে?’

একটু থেমে ইমাদ ভাইয়া সবার দিকে তাকিয়ে আমার হাতের কব্জি ধরে বললো,

‘আজ থেকে উপমা আমার গার্লফ্রেন্ড। তার সাথে কথা বলার আগে প্রতিটা ছেলে দশ বার ভাববে। কেউ খারাপ ন’জ’রে তাকালে তার চোখ উপড়ে ফেলবো। আমাকে সবাই যতোটুকু সম্মান করো আজ থেকে উপমাকেও ঠিক ততোটাই সম্মান করবে। মনে থাকে যেনো সবার, মনে রাখবে সে আবরাব ইমাদের গার্লফ্রেন্ড!’

ইমাদ ভাইয়ার কথায় ভীষন অবাক হই আমি, সাথে মনে মনে ফুসে উঠি। নিজের উপরেই এখন রা’গ লাগছে কেনো এই মেয়ে গুলোর খপ্পরে পড়ে এই ছেলেকে প্রোপোজ করতে গেলাম। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, ইমাদ ভাই কথা টা শেষ করেই আমার হাত সেভাবে চেপে রেখেই গেটের বাহিরে আসে। বাহিরে এসে উনি আমার হাত ছেড়ে দিলে আমি সেখানে একহাতে চেপে ধরে বললাম,

‘কি নাটক শুরু করছেন আপনি এসব?’

‘নাটক কে শুরু করছে আমি নাকি তুমি?’

‘আমি মোটেও কিছু শুরু করিনি, বরং আপনি এসবকে টেনে হিচড়ে বড় করছেন।’

‘আমি টেনে হিচড়ে বড় করছি না বলতে পারো তুমি নাটক শুরু করছো এখন আমি নাটকের উপসংহার লিখবো।’

‘কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘কিছু না, আপাতত এতোটুকু মনে রাখো তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড।’

‘আপনি কিন্তু বেশি বেশি করছেন, আমি আপনাকে ইচ্ছে করে প্রোপোজ করিনি।’

‘আই নো সুইটি, এখন আমরা ডেটে যাবো।’

‘আমি কোথাও যাবো না।’

বলে এক প্রকার দৌড়ে ওইখান থেকে পালিয়ে আসি। একটু দূরে এসে একটা রিকসা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হই।
.
বাড়িতে পৌছেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি আমি। পাশেই শুয়ে মোবাইল ঘাটছিলো আয়েশা, আমাকে এভাবে শুয়ে পড়তে দেখে বললো,

‘কিরে উপু কি হইছে তোর?’

আমি নিশ্চুপ থেকে বুঝিয়ে দিলাম এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার। মেয়েটা আমাকে খুব বুঝে, তাইতো আমার উত্তর না পেয়ে চুপটি করে বসে পড়ে আবারো মোবাইল ঘাটতে। সে জানে যখন আমার কথা বলার হবে কখন সে জিজ্ঞেস করা লাগবে না এমনিই আমি তার সাথে সব কিছু শেয়ার করবো। মিনিট দশেক পরে আমি নিজে থেকেই উঠে তাকে ভার্সিটিতে ঘটা সব ঘটনা একে একে বলতে শুরু করি। আমার থেকে সব কিছু শুনে সে বললো,

‘যে ছেলেটাকে প্রোপোজ করছিলি সেই ছেলেটার নাম কি?

আমি বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে বললাম,

‘আবরার ইমাদ না কি জানি নাম সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে বলে আবরার ইমাদ আবরার ইমাদ।’

আমার কথায় ফিক করে হেসে দেয় আয়েশা। হাসতে হাসতে বললো,

‘ইমাদ ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ, তোর সাথে এমন ব্যবহার কেনো করছে তার নিশ্চয় কারন আছে।’

‘কচুর কারন আছে, তুই বুঝিস নি আমি তাকে প্রোপোজ করছি কারনে তার ডিমান্ড বেড়ে… এই এক মিনিট তুই ওই খ’চ্চ’র টাকে চিনিস কিভাবে তুই তো এখনো একদিনও ভার্সিটি যাসনি, কাউকে ছেনার কথাও না তোর তাহলে?’

‘তুই ভুলে গেলি নাকি কার সাথে প্রেম করি আমি?’

তার কথায় কপাল কুচকে আমি বললাম,

‘ইমন ভাইয়া তোকে কিছু বলছে আমার ব্যাপারে?’

‘আরে না না, ইমন কেনো তোর ব্যাপারে আমাকে কিছু বলতে যাবে। তাছাড়া ইমন এখনো জানেই না তুই ও আমার সাথে একই ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছিস।’

‘তাহলে জানিস কিভাবে ওই ধা’ন্দা’বা’জ ছেলেটা ভালো?’

‘ইমন সারাক্ষণ ই ইমাদ ভাইকে নিয়ে গল্প করে। তাই তাকে না দেখেও সে কেমন চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি। তাছাড়া তুই তার ফ্রেন্ড সার্কেলের যেভাবে বর্ননা দিয়েছিস তাতেই বুঝলাম কে হতে পারে।’

তার সব কথা বোধ গম্য হতেই আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘সব ছেলেরাই তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে বন্ধুদের সুনাম করে!’

আয়েশা ফের কিছু বলতে গেলে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

‘বেশি জ্ঞান দিতে আসিস না আশু। মাইর খাবি কিন্তু!’
.
মাঝ রাস্তায় একটা ৮ বছরের বাচ্ছাকে রাস্তায় ফেলে খুব মা’র’ছে দুইটা ছেলে। মেয়েটা তাদের মাইর থেকে বাচার জন্য ছটফট করতে থাকে! চিৎকার করে কান্না করে বলছে সে ব্যাথা পাচ্ছে তাকে যেনো আর না মারা হয়। তখন একটা ১৩ বছরের ছেলে ছুটে আসে, সেখান দিয়েই সে তার বাবা মায়ের সাথে হয়তো বাড়ি ফিরছিলো সে! মাঝ রাস্তায় একটা মেয়েকে এভাবে মারতে দেখে ছুটে আসে সে, তাকে ছুটে আসতে দেখে তার বাবা মা ও তার পেছন পেছন ছুটে আসে। যে ছেলে গুলো মেয়েটাকে মারছিলো তারা মানুষ দেখে মেয়েটাকে সেখানে পেলেই চলে যায়। মেয়েটা তখনো চিৎকার করে কাঁদছিলো, ছেলেটা তাড়াহুড়ো করে এসে মেয়েটার ছোট্ট মাথা নিজের কোলের উপর নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

‘এই পিচ্চু তুমি ঠিক আছো? কিছু হবে না তোমার!’

ততক্ষনে ছেলেটার মা বাবাও সেখানে এসে দাড়ায়। মেয়েটার মাথা ফেটে র’ক্ত বের হচ্ছিলো দেখে তারা ভ’য় পেয়ে যায়। ছেলেটার বাবা তার কোল থেকে মেয়েটাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ১৩ বছরের ছেলেটি মেয়েটাকে এ অবস্থায় রেখে কিছুতেই বাড়ি ফিরবেনা। অগত্যই তার বাবা মা তাকে সহ হাসপাতালে থাকতে হলো। এক পর্যায়ে ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠলে নিজেকে নিজের বাড়ির বেড রুমে আবিষ্কার করে। তড়িগড়ি করে উঠে বের হয়ে বাবা মা কে মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় মেয়েটাকে নাকি তার বাবা মা এসে নিয়ে যায়। এতে ছেলেটা অকারনেই অনেক কষ্ট পায়। বাবা মায়ের উপর জমা হয় অদৃশ্য এক অভিমান।

রাত তখন আড়াইটা বাজে। বারান্দায় বসে হাবাজাবি ভাবছিলো ইমাদ। দেখতে দেখতে সেই ঘটনার আজ ১২ বছর পূর্ণ হলো। আজও সেই মেয়েটাকে মনে মনে খুজে চলেছে সে, বাবা মায়ের সাথে সত্যিই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। ওই দূর আকাশের পানে তাকিয়ে ইমাদ বিরবির করে বললো,

‘আমরা তো একই আকাশের ছায়ায় আছি পিচ্চু, একই বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি! তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছো পিচ্চু? তোমার কয়েক মিনিটের আগমন আমার জীবন টা এলো মেলো করে দেয়। আব্বু, মায়ের সাথে সৃষ্টি হয় দূরত্ব। যে দূরত্ব আমি চেয়েও ঘুছিয়ে নিতে পারি নি। এর জন্য কি তুমি দায়ী নয়? কেনো এসেছিলে ক্ষনিকের জন্য আমার জীবনে? তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।’

চলবে,,,,,,