ভুলিনি তোমায় পর্ব-১১

0
3916

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :১১

ঘুম খুবই অদ্ভুদ জিনিস।মাঝে মাঝে দেখা যায় অকারনেই ঘুম আসে আর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করলেও আসে না।
বর্তমানে আমি ইচ্ছা করে ঘুমানোর চেষ্টায় আছি,কিন্তুু আমার ভেতর ঘুম নামক অদ্ভুদ জিনিসের ছিটেফোটাও নেই।এপাশ ওপাশ করে ছটফট করতেছি তাও ঘুম আসছে না।
মনের ভেতর অস্থিরতা বিরাজ করছে,একফোটা শান্তিও পাচ্ছি না।চোখের সামনে মায়ের চেহারা ভেসে উঠছে,মনে হচ্ছে আমার সামনে মা।
কিন্তুু আমি ছুঁতে গেলেই হাওয়া হয়ে যায়।যতবার মায়ের মুখটা ভেসে উঠছে ততবারই এক অদ্ভুদ সুখ্যানুভূতি অনুভব হচ্ছে।

নিস্তব্ধ পরিবেশ,চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক,,,একটু পর পর গাড়ির হর্নের শব্দ আসছে।আর এদিকে আমি,
ঘুমের সাথে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ করতেছি।অবশেষে দীর্ঘ তিন ঘন্টার যুদ্ধে ঘুম ননামক অদ্ভুদ জিনিসের জয় হলো আর আমি হেরে গেলাম।

কী করবো?কী করলে মনের ভেতরের অস্থিরতা যাবে?এসব ভাবতে ভাবতে রুমের ভেতর হাটতে লাগলাম।
অনেক্ষণ পায়চারী করার পর ভাবলাম বাবা এখন কী করছে?একবার বাবাকে দেখে আসি।

যে ভাবা সেই কাজ, বিছানা থেকে ওড়না টা নিয়ে সুন্দর করে মাথায় দিয়ে বাবার রুমের দিকে ছুট দিলাম।
বাবার রুমের সামনে দাড়িয়ে রয়েছি ২ মিনিট থেকে,ভেতরে যাবো কী যাবো না?
সেটাই ভাবতেছি। অবশেষে দ্বিধাকে পাত্তা না দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

ভেতরে ঢুকার পর আমার মনে হলো আমার নক করে ঢুকা উচিত ছিলো।
পুরো রুমে মায়ের জিনিস পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে,,,বাবা বিছানার নিচে ফ্লোরে
গুটিসুটি মেরে বসে মায়ের
শাড়ী বুকে জড়িয়ে ফুফিয়ে কান্না করছে।
এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আমার ভেতরের অস্থিরতা বেড়ে গেলো।
এসেছিলাম অস্থিরতা কমাতে কিন্তুু এখন উল্টো বেড়ে গিয়েছে। শব্দবিহীন বড় বড় পা
ফেলে বাবার পিছনে গিয়ে দাড়ালাম,,,বাবার কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট আমার কানে আসছে।
আমি আস্তে করে পিছন থেকে বাবার কাঁধে হাত রাখলাম।
আমার স্পর্শে যে বাবা চমকে উঠলেন তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
বাবা তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছতে লাগলেন।

আমি কান্না কন্ঠে বললাম,,”চোখের পানি মুছার দরকার নেই।আমি দেখেছি,তুমি নিজেকে যতই স্ট্রং দেখাও ভেতরে ভেতরে যে তুমি একদম ভেঙ্গে রয়েছো তা আমি ভালোই জানি।সবসময়ই তো আমাকে বুঝাও যে, যে চলে গিয়েছে তার কথা যেনো ভেবে নিজেকে কষ্ট না দেই।আর আজ তুমি নিজেই কষ্ট পাচ্ছো। অদ্ভুদ না,যারা অন্যদের বুঝায়,অন্যদের সাপোর্ট করে,দিনশেষে তারা কিন্তুু কারো সাপোর্ট পায় না,কেউ থাকে না তাদের বুঝানোর।”

বাবা চোখের পানি মুছে আমার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিলেন।
বাবার দিকে তাকাতেই আমার চোখ গোলগোল হয়ে গেলো।
বাবার চোখগুলো অতিরিক্ত লাল, দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক্ষন কেঁদেছে।

বাবা আমার গালে হাত দিয়ে বললেন,,”বাহ্ আমার মেয়ে তো অনেক বড় হয়ে গিয়েছে, আমাকেই বুঝাচ্ছে।তা হঠাৎ এ সময় বাবার রুমে কেনো?”

বাবাকে এমন দেখে আমার ভেতর ধক করে উঠলো,,হু হু করে কেঁদে দিলাম।

—“এই পাগলী মেয়ে, কান্না করছিস কেনো?দেখ আমি কী কান্না করছি?”

—“বাবা তুমি মায়ের জন্যই কেঁদেছো, তাই না?সত্যি,, বাবা মায়ের ব্যবহারে আমার একটুও খারাপ লাগেনি।আমি সত্যি বলতেছি,,উনার কী দোষ, উনি কী জানতেন নাকী যে আমি উনার মেয়ে।জানলে নিশ্চই বলতো না।”

বাবা কিছু বললেন না,কিছুক্ষন চুপ থেকে হুট করে বলে উঠলেন,,”আমি তোর বাবা হতে পারি নি তাই না?আমি মায়ের অভাব পূরন করতে পারি নি, তাই না?”

আমি কান্নারত অবস্থায় বললাম,,,”কে বলেছো তুমি বাবা হতে পারো নি?তুমি দুনিয়ার বেস্ট বাবা।তোমার মতো বাবা দুনিয়াতে খুজলেও পাওয়া যাবে না।
তোমার কারনেই তো আমি বেঁচে আছি,,আজ যদি তুমি না থাকতে তাহলে কী আমি এ পৃথিবীতে থাকতাম বলো?
তুমি জানো প্রত্যেক টা বাচ্চার যদি তোমার মতো বাবা থাকতো তাহলে তারা দুনিয়ার বেস্ট বাচ্চা হতো।
কেউই মৃত্যু বেচে নিতো না,কারন তাদের কাছে তাদের বাবা নামক মনি ছিলো।তুমি আমার বেস্ট বাবা।”

বাবা অদ্ভুদভাবে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।আমি চোখের পানি মুছে বাবার হাত ধরে বললাম,,”বাবা আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবে?জানো কেউ না কখনও আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় নি। তুমি দিবে?”

বাবার চোখের কোনে জল চিকচিক করতে লাগলো।উনি কিছু বলবে তার আগেই আমি বললাম কিছু না বলতে।
বাবা চুপ করে আমাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে একটা কাঁথা গায়ের উপর মেলে দিলেন।অতঃপর বাবা একপাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
বাবার কষ্ট টা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।কারন এ যন্ত্রনাটা আমি অনুভব করেছি।মাথায় নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে একটা সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়লাম।

!
!
!

চারদিকে অন্ধকার নেমেছে,একটু আগেই সন্ধ্যা মিলিয়েছে।আকাশে এখনও আলো আছে।হালকা এই আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আমাকে আর এহসানকে।

আমরা এমনভাবে আছি যে যে কেউ এখন দেখলে মনে করবে চুরি করতে এসেছি।
বিষয়টা প্রায় এমনই,, চুপি চুপি দুজনই দাড়িয়ে আছি।
চোখে মুখে ভয় আর বিরক্তি দুটোই স্পষ্ট ফুটে উঠছে।
গত আধ ঘন্টা যাবৎ রেস্টুরেন্টের কোনে চুপচাপ লুকিয়ে অপেক্ষা করতেছি।

এহসান ভাইয়া অধৈর্য্য গলায় বলে উঠলেন,,,”আর কত সময়,, এরা বাহির হচ্ছে না কেনো?মনে হয় পুরো রেস্টুরেন্ট খেতে এসেছে..!!”

আমি দ্রুত হাত দিয়ে উনার মুখ চেপে ধরলাম,,,”শিশশ,,চুপ..!ধীরে বলুন..!! ”

এহসান ভাইয়া ফ্রিজ হয়ে গেলেন।
উনি একবার আমার দিকে তো আরেকবার উনার মুখে রাখা আমার হাতের দিকে তাকাচ্ছেন।
বিষয়টা বুঝতেই আমি হাত সরিয়ে নিলাম।

উনি এখনও ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছেন,,আমার অসস্তি হতে লাগলো।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,,”আপনাকে আসতে বলেছে কে?”

উনি অন্যদিকে ফিরে বললেন,,”আমি কী জানতাম নাকী তুমি এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছো।”

আমি চোখমুখ কুচকে বললাম,,”তো কী মনে করেছেন??

আচ্ছা,,একটা মেয়ে যদি একা কোথাও দুই তিন দিন যাওয়া আসা করে তাহলেই কী সে ফস্টি নস্টি করতে যাচ্ছে?
কেনো মেয়েরা কী অন্য কোনো কাজে একা যেতে পারে না?
আপনাদের সমস্যা টা কী জানেন,,সমস্যা হলো এটা যে, কে কী করলো না করলো,এইসব খুজে তাদের পঁচানো।মানুষের পিছনে পরে থাকা।”

আমার কথা শুনে এহসান অবাক হয়ে গেলো।উনি আহত কন্ঠে বলে উঠলো,,”নায়লা,তুমি ভুল ভাবছো,,,এমন কিছুই নয়।
আমি জাস্ট কৌতুহল বশত তোমার পিছন পিছন এসেছিলাম।
তুমি কখনো কোথাও যাও না,আর সেখানে গত দুইদিন থেকে একই টাইমে একা একা কোথাও যাচ্ছো।
তাই আমি কৌতুহল বশত তোমার পিছন পিছন এসেছিলাম।
আই সোয়ার(swear-কসম) আমার এমন কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।”

আমি কিছু বললাম না।
সেদিন আম্মুকে দেখার পর গত দুই দিন থেকে কলেজে না গিয়ে ওই রেস্টুরেন্টে আসতেছি।কিন্তুু আম্মুর দেখা পেলাম না হতাশ হয়ে ফিরে গেলাম।
আজ আবার যখন আসতেছিলাম তখনই দেখলাম এহসান আমার পিছু নিয়েছে।
আমি উনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিতে চেয়েছিলাম,,
কিন্তুু তার আগেই দেখি আম্মু রেস্টুরেন্টের ভেতরে যাচ্ছেন।
তাই আর উনার দিকে কনসেন্টট্রেইট না করে এখানে লুকিয়ে পড়লাম।
কিন্তুু একটুপর দেখি উনিও আমার পিছন দাড়িয়ে আছেন।
উনি হয়তো ভেবেছেন আমি চমকে যাবো কিন্তুু আমি মোটেও এমন রিয়েক্ট করি নি।
আমি এমনভাব করলাম যেনো আমি জানতাম উনি এখানে আসবেন।
উনা আমাকে প্রশ্ন করতেই ফটফট করে একটা কাহিনী বানিয়ে বললাম,,, আমি এখানে আমার ফ্রেন্ডের আম্মুর পিছনে এসেছি, উনি ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিছু করবেন,আর সেটা ও গেস করতে পারলে ওকে ফোন কিনে দিবে, তাই আমি জানতে এসেছি উনি কী করেন?
এরপর আমি উনাকে পাল্টা প্রশ্ন করতেই,, উনি বললেন উনি কেনো এসেছেন।
অতঃপর আমরা লুকিয়ে অপেক্ষা করতেছি আম্মু বের হয়ে আসার জন্য।
অথচ আম্মুর বের হওয়ার নাম নেই।
এবার আমি নিজেও অধৈর্য হয়ে গেলাম কারন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। বাবা মনে হয় টেনশন করতেছে।
দাত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছিলাম তখনই এহসান ভাইয়া মৃদু আওয়াজ করে বলে উঠলেন,,”ওই দেখো বের হয়েছে।”
আচমকা এমন হওয়ায় আমি গাবড়ে গেলাম,সাথে সাথে আঙ্গুলে কামড় দিয়ে দিলাম।
আমি আহ বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
উনি,,” কী হয়েছে? কী হয়েছে?” বলে আমার হাত দেখতে লাগলেন,
আর আমি উনাকে হাত দেখতে না দিয়ে আম্মুদের পিছন পিছন যেতে লাগলাম।
আজকে আম্মুর সাথে একজন পুরুষ রয়েছে,,হয়তো উনার স্বামী।
উনারা হাত ধরাধারি করে হাসতে হাসতে হাটতেছেন।বুড়ি হয়ে গিয়েছেন এখনও রাস্তায় এভাবে হাটতেছেন,,হয়তো এটাকেই বলে শহরের পরিবেশ।
দুজনেই একটা গাড়ীতে উঠে পড়লেন আর আমি দৌড়ে দৌড়ে উনাদের পিছন একটা সি এন জি তে উঠলাম,আমার সাথে এহসান ও উঠেছে।দুজনেই হাপাচ্ছি,ড্রাইবারকে শুধু বলেছি গাড়ীটার পিছনে যেতে।

গাড়ীর গতিবেগের সাথে সাথে আমার চুল উড়ার গতিবেগও বেড়ে গেলো।বারবার মুখে এসে পড়তেছে।বিষয়টাতে আমার থেকে এহসান বেশি বিরক্ত কারন চুলগুলো বারবার উনার মুখে যাচ্ছে।উনি বারবার সরিয়ে দিচ্ছেন আর চুলগুলো বারবার উনার মুখে যাচ্ছে।উনি আমার দিকে বিরক্তিকর চাহনী নিয়ে তাকাতেই আমি অসহায় ফেস করলাম।উনি কিছু বলে চেয়েও বলেনি।শুধু মুচকি হাসলেন।এবার উনার হাসি দেখে আমার বিরক্তি লাগলো।

দীর্ঘ সময় পর দেখলাম সামনের গাড়ীটা একটা মোড়ে ঢুকে একটা বাড়ীর সামনে থামলো।ড্রাইবারকে বললাম উনাদের থেকে একটু স্পেস রেখে দাড় করাতে।

আমাদের গাড়ীটা উনাদের গাড়ী থেকে অনেক দূরেই ছিলো,,উনাদের গাড়ীর পিছন আরো একটা গাড়ী রয়েছে।গাড়ীটাও ঠিক আমাদের মতো একটু দূরেই উনাদের থেকে।

উনারা গাড়ী থেকে নেমেই, বাড়ীটাতে ডুকতে লাগলেন। উনারা ডুকতেই আমি ভাবলাম একটু নেমে দেখে আসবো কিন্তুু তার আগেই দেখলাম ওই গাড়ী থেকে কেউ একজন নামছে।

আমি একটু এগিয়ে যেতেই ব্যক্তিটিকে দেখলাম।সাথে সাথে আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।আমি একটু আওয়াজ করেই বলে উঠলাম,,,”বাবাআ..!!”

আমার আওয়াজ পেয়ে বাবা চমকে উঠলেন, সাথে সাথে পিছনে ফিরে আমাকে দেখে,,,,,

চলবে,,,