ভুলিনি তোমায় পর্ব-১২

0
3625

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :১২

—“নিজের চোখের সামনে কখনও নিজের বাবাকে মারা যেতে দেখেছেন?”

হুটহাট এমন প্রশ্ন শুনলে যে কেউ ভড়কে যাবে,ঠিক তেমনই আমার সামনের ব্যক্তিটিও ভড়কে গেলো।
চোখ বড় বড় করে উনি আমার দিকে তাকালেন,,,”যার অর্থ এ কেমন প্রশ্ন?”

আমি মৃদু হাসলাম,,আমাকে এভাবে হাসতে দেখে সামনের ব্যক্তিটি ভ্রু কুচকে তাকালো।নিশ্চয় মনে মনে ভাবছে আমি পাগল।
এটা ভাবতেই আবারো হেসে দিলাম।
উনি এবার আগের থেকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

আমার সামনে থাকা ব্যক্তিটি অনেকটা কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন,,”আপনার কী কোনো সমস্যা আছে?
না মানে,নিজে নিজে প্রশ্ন করছেন আবার নিজে নিজেই হাসছেন।এভাবে হাসলে তো মানুষ পাগল বলবে।”

আমি কিছু না বলে পুনরায় হাসলাম।
সামনের ব্যক্তিটির কপালে কিঞ্চিৎ বাজ পড়লো।
মনে মনে নিশ্চয় ধরে নিয়েছেন যে আমি পাগল।
এতে আমার কিছু যায় আসে না গত কয়েকমাস থেকে সবাই বলতেছে যে আমি নাকি পাগল।
আরে পাগল তো ওরা, আমি বুঝি পাগল?ওরা সবাই পাগল।হি হি,,ওরা পাগল..!!বলেই আবারো হেসে দিলাম।

আমাকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখে সামনে থাকা ব্যক্তিটি কিছুক্ষন তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো,, যে হয়েছে টা কী?
উনি কী বুঝলো জানি না..!!একটুপর উনি চেয়ার থেকে দাড়িয়ে গেলেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে হাটা দিলেন।

আমাদের জীবনে কিছু চরম সত্য রয়েছে, যা কখনো বদলানো যায় না।যেমন,,মৃত্যু।
মৃত্যু এক চরম সত্য,,সবাইকে একদিন হলেও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে।
এটা কঠিন সত্য যা কেউ কোনোদিন ও বদলাতে পারে নি আর পারবেও না।
এখনও পর্যন্ত কম চেষ্টা হয় নি এ সত্য বদলানোর। কত বড় বড় বিজ্ঞানীরা এর ঔষদ আবিষ্কার করার জন্য এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তবুও কেউ পারে নি।

এতকিছুর পরেও কিছু মৃত্যু মেনে নেওয়া কষ্টকর।বলতে গেলেই মানাই
যায় না।ঠিক তেমন আমিও মানতে
পারতেছি না।

কেনো মানবো?ওরা সবাই মিথ্যা বলছে আমি মানি না..!! আমি জানি আমার বাবা বেঁচে আছেন,,,ওরা মিথ্যা বলছে।

যদি মরেই যায় তাহলে আমি কেনো দেখলাম না বাবার লাশ।
হুদাই কার না কার কবর দেখিয়ে
বলতেছে আমার বাবা।কী মিথ্যুক দেখছো?বলে কী,,,
“আমার বাবা বলে মারা গেছে?”

আমার বাবা কী কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাবে???বাবা তো আমাকে প্রমিস
করেছিলো যে সবসময় আমার সাথে থাকবে,
আমি যেনো উনাকে ছেড়ে না যাই।কিন্তুু দেখো আজ উনি চলে গিয়েছে।

“জীবনে কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না,সবসময় তোমার পাশে থাকবো..!!”বলা মানুষগুলোই একসময় কাঁদিয়ে একা করে চলে যায়।
ঠিক যেমন সৌরভ চলে গিয়েছে আর এখন বাবা। মানুষ এমন কেনো হয়?
কথা দিয়ে কতা রাখে না..ওরা কী বুঝে না ওদের ওই মিথ্যা আশার উপরেই যে আমাদের জীবন চলতো।

সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার পর আজ ২ মাস ঘর বন্ধী জীবনযাপন করছি.. খুব অদ্ভুদভাবেই বাস করতেছি। কারন আমার জীবনের শেষ
সম্বল টুকুও যে আর নেই
আমার সাথে,তাই তো এভাবে বাস করতেছি।আশেপাশের সবাই বলাবলি করছে,,আমি নাকী পাগল হয়ে গিয়েছি। আমি জানি
একটু আগে যে ব্যক্তি এসেছে উনি নিশ্চয় পাগলের ডাক্তার ছিলেন।

বাহিরে কী হচ্ছে জানি না,তবে এটুকু জানি উনাকে ফুফি নিয়ে এসেছেন।কারন এই দুইমাসে আমার কাছে শুধু ফুফি আর কেয়া আপু এসেছিলেন।
ওহ্, দুই একবার এহসানও এসেছিলেন। ফুফি কালকেও এসেছিলেন,,আর এসেই আমার সাথে বকবক করেছিলেন,,
ফুফির কথাগুলো ছিলো এমন,,,

–“নায়লা মা,,এভাবে আর কতদিন?”

আমি কিছু বললাম না।ফুফি এক লোকমা ভাত আমার মুখে দিয়ে বললেন,,

“– দেখ সবাইকে একদিন না একদিন মরতেই হবে।তাই বলে কী আমরা এভাবে থাকবো?তুই এমন করছিস বলে সবাই তোকে পাগল বলছে..!!
সবার একটা জীবন আছে,সবার সংসার আছে।তোর এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে,,নিজেকে একটু সামলা।তুই যদি এভাবে চলিস তাহলে আমি আমার সংসার কীভাবে চালাবো,,বল?”

ফুফির শেষের কথা শুনে আমার ভ্রু কুচকে এলো,,আমার জন্য উনার সংসারের কী সমস্যা?

ফুফি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলেন,,

—“আমাদের সবাইকে কিছু সমস্যার জন্য আমার শশুরবাড়ী যেতে হবে।আসলে কেয়ার দাদী সম্পত্তি ভাগ করবেন।তাই আমাদের যেতে হবে।কিন্তুু আমি চলে গেলে তুই?সমস্যা টা হচ্ছে তোর এমন অদ্ভুদ আচরনের জন্য সবাই ভয়ে আছে।উনারা বলতেছেন আমরা যদি যাই তাহলে তোকেও নিয়ে যেতে না হলে তারা অন্য পথ ধরবে।আর তোকে নিয়ে তো আর যেতে পারবো না,তাই..!!”

ফুফি আরো অনেক কিছুই বলেছে,,
আমি নিরবে সব শুনলাম।কোনো রিয়েক্ট করলাম না।কথায় আছে না,,
মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়,ঠিক তেমন আমিও হয়ে গিয়েছি।
প্রথম কয়েকদিন কারো সাথে দেখা করতাম না,,কেউ আসলে চিল্লাচিল্লি করতাম।
হুটহাট জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠতাম।কয়েকদিন পর কান্না বন্ধ হয়ে যায়,,একদমই কান্নাকাটি করি না আর না চিল্লাচিল্লি করি।
একদম চুপ হয়ে গিয়েছি,, এখন শুধু হাসি আসে।অকারনেই হেসে দেই,,,হাসতে খুব
ভালো লাগে।এ যে এখন হাসতেছি,, হি হি হি।

নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর,,, যারে দেয় তাকে একসাথে সবই দেয়,,আর যার নেয় তার একদম
সবই ছিনিয়ে নিয়ে নেয়।
এই যে আমার থেকে এক এক করে সব নিয়ে নিয়েছে,,প্রথমে মা,তারপর শৈশব,তারপর ভালোবাসা আর এখন বাবা।শুধু বাবা না
সব সুখও নিয়ে গিয়েছে।কারন আমার সব
সুখ তো বাবা ছিলো যে এখন আর নেই আমার পাশে।আচ্ছা আমার সাথেই কেনো এমন হয়?আমাকে কী কাঁদতে দেখলে আল্লাহর খুব
ভালো লাগে?সবসময় কী কপালে দুঃখই থাকবে?মাঝে মাঝে মনে হয়, আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখতে ভুলে গিয়েছে।না না না,,মনে হয় তখন আমি
ঘুরতে চলে গিয়েছিলাম,,হি হি হি,,!!

সকালের সোনালী সূর্যের আলো জানালা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করলো,,সাথে সাথে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো।মেঝেতে সোজা হয়ে
বসে হাত দিয়ে চোখে কচলাতে লাগলাম।কাল রাতেও নিচেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফ্লোরে রাখতেই হাতে কিছু লাগলো।
হাতের দিকে তাকাতেই দেখলাম বাবার ছবি।মুহূর্তেই মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো।গত কয়েকদিনে একটা বাজে অভ্যাস হয়েছে, বাবার জিনিসপত্র নিয়ে ঘুমানোর।মনে হয় যেনো বাবা আমার পাশে আছেন।

এর মধ্যেই হঠাৎ কেউ রুমে ঢুকে রুমের লাইট
জ্বলিয়ে দিলো,,চোখে লাইটের আলো
পড়তেই চোখগুলো আপনাআপনি
কুচকাতে লাগলো।ডান হাত টা চোখের সামনে এনে চোখ ছোট ছোট করে সামনে
থাকা ব্যক্তির দিকে তাকালাম।ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পেলাম আমার সামনে
কয়েকজন সাদা কাপড় পড়া মহিলা
দাড়িয়ে আছেন।উনাদের দেখে
হসপিটালের নার্স মনে হলো,,,উনারা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,,,

—“এই মেয়ে উঠ..!!”

আমার হেলদোল না দেখে দুজনে মিলে আমাকে ধরলেন দাড় করানোর জন্য।
কিন্তুু আমি শক্ত ধরে বসে রইলাম।
এবার উনারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ইশারা করলেন।তারপর
দুজনে মিলে আমাকে টানতে টানতে নিতে লাগলেন।আমি যখন উনাদের
সাথে পেরে উঠছিলাম না তখন চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম,,,

—–“না,আমি যাবো না।আমি কোথাও যাবো না।আমার বাবা একা একা কান্না করবেন,,আমাকে
ছেড়ে দেও।আমি আমার বাবাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।বাবাআআআআ..”

চলবে???