ভুলিনি_তোমায়? পর্ব-০৬

0
3640

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :৬

মানুষ মাত্রই ভুল,জীবনে সবাই একবার হলেও ভুল করে থাকে,শুধু ধরন টা ভিন্ন থাকে।এ ভুল থেকেই সবাই শিক্ষা নেয়। আমরা ভুল না করলে কখনই ভালো খারাপ চিনতাম না।আমিও ভুল করেছি,তাই আজ বুঝতে পেরেছি কে কেমন?আমার করা এ ভুলের কারনে আমি জীবনে খুব বড় একটা শিক্ষা পেয়েছি।আমি নিশ্চিত এখন আমি প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত নিতে অন্তত দুইবার হলেও ভাববো।

ছোটবেলায় বাবা একবার বলেছিলো,,”নায়লা বলো তো ছোটবেলায় পেন্সিল আর বড় হলে কলম দিয়ে কেনো লিখি?”

তখন আমি বাবাকে উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলাম,,”কারন পেন্সিল অনেক ফুল,ফল, চিত্র আঁকা থাকে তাই ছোটরা পেন্সিল ব্যবহার করে।কলমে কোনো ডিজাইন থাকে না দেখতে পঁচা তাই ওটা বড়রা ব্যবহার করে।”

বাবা আমার কথায় মৃদু হাসলেন।আমাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,,”বাহ্ আমার মেয়ে তো খুব বুদ্ধিমান।তবে মা তোমার কথা পুরো ঠিক নয়।আমরা ছোটবেলায় পেন্সিল এজন্য ব্যবহার করি যাতে ভুল করলে রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে পারি।কারন ভুল করার বয়স টাই ছোটবেলা। বুঝেছো?”

বাবার কথায় আমি গোলগোল চোখ করে বাবার দিকে তাকালাম।কিন্তুু ব্যর্থ হলাম কিছুই বুঝলাম না। বাবা বিষয়টা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন,,”যদি কোনোদিন তোমার মনে হয় তুমি ভুল করেছো তাহলে এ কথা মনে করো তাহলে এর অর্থ বুঝবে।”

আজ আবার বাবার সেই কথাটা মনে পড়লো। বাবা আজ আমি বুঝেছি তোমার কথার মানে, আমি শুধরে নিবো আমার ভুল।আমার জন্য তোমার পুরো জীবন শেষ করে দিয়েছো তুমি,আমিও তোমাকে সবচেয়ে ভালো মেয়ে হয়ে দেখাবো।আমি বাঁচবো,হ্যা আমি বাঁচবো তোমার জন্য বাঁচবো।আমিও সবাইকে দেখিয়ে দিবো যে আমার জন্য তোমার জীবনের নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো না। তোমার মত বাবা যেনো সব মেয়ের কপালে থাকে।আজ থেকে আমি নতুন করে জীবন শুরু করবো।তোমার মুখের হাসির জন্য হলেও বেঁচে থাকবো। আমি চাই তুমি একদিন সবাইকে গর্ব করে বলো, আমি নায়লা বখত আশরাফীর বাবা আশরাফ হোসেন।

কিন্তুু আমি কী পারবো?সৌরভকে কী কোনোদিন ভুলতে পারবো?ও ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা,আমার প্রথম ভরসা,আমার প্রথম বিশ্বাস।কিন্তুু ও এক নিমিষেই সব শেষ করে দিয়েছে।ভালোবাসায় কেনো এত কষ্ট?আমি কেনো তোমাকে ভুলতে পারতেছি না?সৌরভ তুমি কী জানো তোমার স্মৃতি আমাকে খুব কাঁদায়? “”আপনমনে এসব ভেবেই ফুফিয়ে কেঁদে উঠলাম।


আপুদের খাবার টেবিলে বসে আছি আমি সাথে আপুদের পুরো পরিবার , আবার নিচের ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে ছেলেটিও আছে।আশ্চর্যের বিষয় ছেলেটা এখানে একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।আমি বললে ভুল হবে, কারো দিকেই তাকাচ্ছে না।নিজের মত খাচ্ছে, অথচ পাশ থেকে যে কেয়া আপু ওকে গিলছে তার কোনো খবরও নেই।আমি আড়চোখে ছেলেটিকে একটু ভালো করে দেখতেই আমার কলিজা টা ধক করে উঠলো। ওর চেহারা প্রায় সৌরভের মত।সেই চোখ,সেই ঠোঁট,চেহারার প্রায় ৭০ অংশ ওর মত।দেখতে সৌরভের মত সুন্দর।হোয়াইট টিশার্ট ব্লাক টাউজার, ঘন কালো চুল, হাতে অ্যাপেলের ঘড়ি, সাথে সৌরভের মত কিউট বাচ্চা ফেস দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।আমি এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম।আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, গাড়ী থেকে নামার সময় ছেলেটাকে দেখে বাড়ীর কেয়ার টেকারের মত লেগেছিলো,কিন্তুু এখন তো সেটা মনে হচ্ছে না।তাছাড়া তখন লুচু লুচু লেগেছিলো আর এখন ভদ্র লাগতেছে।হাহ্ ছেলেরা এমনই হয়,উপরে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে ভেতরে শয়তান হয়ে থাকে। এদের একশ রং থাকে একটুও চেনা যায় না।যেমন আমি সৌরভকে চিনতে পারি নি।দুইবছরেও কেনো তোমাকে চিনতে পারলাম না? এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো।

এমন সময় বাবা আমাকে বলে উঠলো,,,”কী হয়েছে মা? কান্না কেনো করছিস?শরীর খারাপ লাগছে?ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে?”

বাবার কথা শুনে সবাই খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো।বাবার এমন অস্থিরতা দেখে আমি তড়িৎগতিতে বলে উঠলাম,,”না,না, বাবা।আসলে খেতে পারতেছি না যে তাই চোখ দিয়ে পানি পড়তেছে।”

বাবা আগের থেকে বেশি অস্থির হয়ে বললেন,,”সে কী মা, কেনো খেতে পারছিস না।এদিকে আয় আমি খাইয়ে দেই।”

এতগুলো মানুষের সামনে বাবার হাতে খাবার খাবো,বিষয়টা কেমন দেখাচ্ছে না?তাই আমি বাবাকে না বলে নিজে খেতে লাগলাম।সবাই নিজের খাবারে মন দিয়ে খেতে লাগলেন।একটুপর দেখলাম ছেলেটা অর্ধেক খাবার রেখে উঠে যাচ্ছে,ঠিক তখনই কেয়া আপু বলে উঠলেন,,,”আরে এহসান ভাইয়া, আপনি খাবার অর্ধেক রেখেই চলে যাচ্ছেন কেনো?আর খাবেন না?”

কেয়া আপুর কথা শুনে ছেলেটা বিরক্তমাখা কন্ঠে বলে উঠলো, “দেখতেই তো পাচ্ছো উঠে গিয়েছি।তার মানে আর খাবো না তাই না?”

কেয়া আপুর হাসিমাখা মুখটা চুপসে গেলো,তাও মাথা নাড়িয়ে বললো হুম।এবার ফুফি ছেলেটাকে বলে উঠলো,”কী হলো বাবা,তুমি পুরো খাবার খেলে না কেনো?আন্টির রান্না কী আজ মজা হয়নি?”

এবার ছেলেটা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,,”কী যে বলেন না আন্টি,আপনার রান্না মজা না হয়ে কই যাবে?আসলে সকাল থেকে গ্যাস্টিকের প্রবলেম করছে তাই খেতে পারতেছি না।”

ফুফি অস্থির হয়ে বলে উঠলো,,”সে কী?গ্যাস্টিকের ঔষদ খাও নি?কীরে রেদোয়ান তুই এহসানকে ঔষদ দিস নি কেনো?”

রেদোয়ান ভাইয়া ফুফির দিকে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন,,,”উফফ মা,তুমি কী বলো?আমার কাছে ঔষদ থাকলে বুঝি আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে দিবো না?আসলে ঔষদ শেষ হয়ে গিয়েছে।”

ফুফি ছোট করে বলে উঠলো,,”ওহ্।”

পাশ থেকে বাবা বলে উঠলেন,,”নায়লার আছে তো।ডাক্তার ওকে সেকলো ২০ এমজি এটা দিয়েছে,তুমি আমাদের বললেই তো পারতে। নায়লার ঔষদ খাওয়ার সময় ওর কাছ থেকে নিয়ে নিও।”

ছেলেটি কিছু বলবে তার আগেই ফুফি বলে উঠলো,,,হ্যা,হ্যা। নায়লার কাছ থেকেই নিয়ে নিও।তাছাড়া সকালে তুমি অনেক সাহায্য করেছো । ”

ছেলেটি আর কিছু বললো না, সোজা গিয়ে সোফায় বসে পড়লো।আমিও চুপচাপ টুকটাক খাবার খেলাম।ঔষদ নিয়ে খেতেই কেয়া আপু আমার কাছে এসে বললেন উনাকে ঔষদ দিতে,উনি এহসান নামের ছেলেটাকে দিবেন।আমি কিছু না বলে উনাকে ঔষদ দিয়ে দিলাম।আপু ঔষদ নিয়ে ছেলেটার কাছে যেতেই ছেলেটার মুখে হাজার বিরক্তি দেখতে পেলাম।কিন্তু কেয়া আপুকে খুব খুশি দেখলাম।যতটুকু বুঝলাম কেয়া আপু ছেলেটার প্রতি দূর্বল।আমি নিজেও এমন অনুভূতি ফিল করেছি তাই খুব ভালো করেই বিষয়টা বুঝলাম।

বিকালের দিকে আমরা আমাদের নতুন বাসায় শিফট হয়ে গেলাম।ফুফু অনেক বলেছে উনাদের বাসায় থাকতে কিন্তুু আমি বাবাকে বলে দিয়েছি না বলে দিতে। তাই বাবাও না করে দিয়েছে।ফ্ল্যাটে সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে ওই ছেলেটা আর রেদোয়ান ভাইয়া।আমি পুরো বাসা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম,সবকিছু সুন্দর করেই সাজিয়েছে।বাসায় আমি একা, বাবা বাজারে গিয়েছে।তাই আমি ভাবলাম ছাদ টা একটু ঘুরে আসি।অনেকদিন তো বন্দী ছিলাম একটু প্রকৃতি অনুভব করি।

আমাদের উপরের তলায় ছাদ,তাই উঠতে বেশি সময় লাগে নি। ছাদে আসতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো,কী সুন্দর। ছাদের মধ্যে নানারকম ফুলের গাছ,আবার ঔষদি গাছও রয়েছে।সূর্যের আলোতে নটোরলতা ফুলগুলো অসাধারন লাগছিলো। এত ফুলের ভীড়ে জবা ফুল দেখে আমি থমকে গেলাম।শরীর কাপতে লাগলো।কাপা কাপা হাতে একটা জবা ফুল ছিড়ে নিলাম।জবা ফুলটা নিয়ে কানের এক পাশে দিয়ে দিলাম এবং চুলগুলো ছেড়ে দিলাম।প্রিয় মানুষটার মুখে শুনেছিলাম,, “”আমাকে এভাবে দেখতে না কী মোহনীয় লাগে।”” ভাবতেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।কত মিথ্যা আশা, কত মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছে।প্রথম যেদিন আমার কানের পাশে জবা ফুল লাগিয়েছিলো সেদিন বলেছিলো,,,”তোমার এ মুখ দেখলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।কী মায়াবী লাগে তোমায়,তোমাকে এভাবে দেখলে আরো ভালোবাসতে মন চায়।খুব বেশী ভালোবাসি তোমায়,যা বলে বোঝাতে পারবো না।তোমার জন্য আমি সব করতে পারি,কখনও আমাকে ছেড়ে দিও না।””

হাহ্, আমার জন্য সব করতে পারবে বলেছিলো,আমি যেনো তোমাকে ছেড়ে না যাই,দেখো আজ তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছো।ছেড়েই যদি চলে যাবে তাহলে কেনো এত ভালোবাসার অভিনয় করেছো?কেনো আমার আবেগ বাড়িয়েছো?”ভালোবাসায় কেনো এতো কষ্ট??”

না, আমি আর কাঁদবো না। তুমি কী ভেবেছো আমি তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে নিজেকে কষ্ট দিবো?নিজেকে শেষ করে দিবো?তাহলে তুমি ভুল,আমিও তোমাকে দেখিয়ে দিবো তুমি ছেড়ে দেওয়ার পরেও আমি ভালো ছিলাম।এসব ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ছাদের কিনারায় গিয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,,”আপনি নায়লা না?আই মিন আপনার নাম নায়লা তাই না?”

চলবে,,,,