ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-০৩

0
4849

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-০৩
রোকসানা আক্তার

নাতাশা বালিশটি সোফার হাতলের সঙ্গে ঠেসে দেয়।আর উল্টোদিক ঘুরে আধশোয়া হয়ে শরীরটা এলিয়ে দু’হাত কানের নিচে গুঁজে নেয়।চোখ জোড়ার পাতা এক করতে আপ্রাণ চেষ্টায় নাতাশা।ঘুম আজ অভিমান করে নাতাশাকে ধরা দিচ্ছে না,সে তার রাজ্যে অবাধ বিচরণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।গড়গড়িয়ে অশ্রু বেয়ে পড়তে থাকে নাতাশার চোখ থেকে।তার কান্নায় কেন জানি তার আজ কোনো কোনোরকম আক্ষেপ হচ্ছে না। কারণ,পুড়ে যাওয়া দগ্ধ হৃদয় বুকে জমা যন্ত্রণাকে
মানিয়ে নিতে শিখেছে সেই দু’বছর আগে।

তাহলে ভালোবাসাটা কি নীরের জন্যে তার একটুখানি বেশিই ছিল? এবং এখনো আছে?তবে নীরতো নাতাশাকে দু’চোখেও দেখতে পারেনা।কি হবে নাতাশার অনিশ্চিত জীবনে?কীভাবে কাটবে সামনের দিনগুলো?এরকম হাজারো ভাবনা নাতাশার মনে ছুঁয়ে যায়!
নাতাশার সবথেকে বর আফসোস এখানেই—আজ নিজের প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেয়েও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো।

বাসর রাত!প্রতিটি বাঙ্গালী মেয়েদের জীবনে এক অন্যতম রাত।এ রাতকে নিয়ে তাদের মনে হাজারো জল্পনা-কল্পনার রেখা আঁকে।এই রাতটির ভাবনায়
তাদের চোখে-মুখে একটা রক্তিম আভা ভেসে ওঠে।
ভালোবাসার নিষ্ঠুর পরিহাস নাতাশাকে আজ এই রাতটিই বিষন্ন করে তুললো।

নীর বেলকনিতে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সিগারেট টানে। আর নিমজ্জে চোখদুটো বন্ধ করে ধোঁয়া ছাড়ে।এখন সে একটু স্বস্তি পেলো।মুখে একটা তাচ্ছিল্যের আভা এনে নিজমনে বলতে থাকে,
——যাক!অবশেষে ডিভোর্স যেহেতু মেনে নিয়েছিস তাহলে বিনে কারণে এখন বাড়ি থেকে পালানোর কোনো দরকার নেই।এমনিতেই ক্লান্ত!এখন শুধু একটা লম্বা ঘুম চাই।
সিগারেটের পোঁচ টা বাহিরে পেলে দিয়ে বিছানার কাছে আসে।আর ঘাড় ঘুরিয়ে নাতাশার দিকে একনজর তাকায়।নাতাশা উল্টো শোয়ার কারণে তার কোমরের অর্ধেক অংশ অনাবৃত!নাতাশার ধবধবে সাদা কোমরটায় একটা কালো তিল থাকায় শরীররে সর্বাঙ্গে রূপ ছড়িয়ে পড়ছে।নীর তা দেখে কপালের ভাঁজ কুঁচকে আনে।গলাটা হালকা ঝেড়ে নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
——ওভাবে কোমর না ছড়িয়ে ঠিকঠাক ভাবে শোও! নীর চৌধুরীকে রূপের ফাঁদে ফেলে কখনো মন চুরী করতে পারবে না!বুঝলে?
কথা শেষ করেই নীর বিছানার উপর ধপ্পাস করে তার শরীরটা এলিয়ে দেয়।
নীরের কথায় নাতাশার টনক নড়ে উঠে।বামহাত দিয়ে তাড়াতাড়ি কোমরে কাপড় টেনে নেয়।আর নীর বিছানায় শোয়া মাএই ঘুমের দেশে বিচরণ করে।

নীর যে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তা নাতাশার খেয়ালে আসতেই সে এদিক ফিরে। আর টানটান চোখে নীরের দিকে তাকায়।চোখের পানি গড়গড়ি দিয়ে উঠে নাতাশার।লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে চোখদুটোর পাতাকে আবার এক করে।হয়তো ঘুমিয়েছে,হয়তোবা আবার ঘুমায়নি।বলতে গেলে তন্দ্রাঘুম কেটেছে নাতাশার।

চারদিকে ফজরের আযান পড়ে।নাতাশা চোখের পাতাখুলে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ায়।মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে বাথরুম থেকে নামাজের ওযুটা করে নেয়।বাথরুম থেকে বের হয়ে ওয়াড্রবের কাছে যায়।ড্রয়ার খুলে জায়নামাজ খুঁজতে থাকে।কিন্তু কোথায়ও জায়নামাজ দেখতে পায়নি।পরে উপায়ন্তর না পেয়ে সোফার উপর দাড়িয়েই নামাজ সেরে নেয়।

আঁবছা অন্ধকার কেটে জানলার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো উঁকি মারে।নাতাশা হাতের করে তফসি পড়া শেষ করে জানলার দিকে এগিয়ে যায়।পর্দা গুলো সরিয়ে দেয়। জানলা দুটো খুলে দিতেই নীরের ঘুম ভেঙ্গে যায়।নীর ধমকে উঠে নাতাশাকে ঝাঁটি দিতে থাকে।
——আমার ঘুম সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত পর্দা এবং জানলা দুটোয় হাত দেওয়া নিষেধ।আর এগুলো খুলে দিতে কাউকে এখানে আমি চাকরানি রাখিনি।

নাতাশা নীরের কথা অগ্রাহ্য করে অন্য জানলাগুলোও খুলে দেয়।।নাতাশার এধরনের কার্বার দেখে
নীর বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়।আর রাগান্ধিত হয়ে নাতাশার দিকে তেড়ে আসে।নাতাশার গায়ে হাত তুলতে গেলেই নাতাশা বলে উঠে,
——মারুন?যত খুশি মারুন!কেউ আপনাকে বাঁধা দিবে না।তবে আমি যেটা করবো সেটায় কেউ বাঁধা দিতে পারবে না।ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড?

নাতাশার এমন স্পর্ধা দেখে নীর অবাকের চরম পর্যায়ে।আগুনে ঘি ঢালার মতো নীরের এখন অবস্থা!সে ঝাঁঝাঁলো একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।হিংস্র মুখে বলে,
—–তোমার সাহস তো কম না!তুমি আমার রুমে দাড়িয়ে আমাকে বাঁকা আঙ্গুল দেখাচ্ছ?তোমার এই বাঁকা আঙ্গুল আমি সোঁজা করে দিবো দাড়ায়….!

নীর এসব বলে দাঁতগুলো কটমটিয়ে নাতাশার আঙ্গুল চেপে ধরে।নাতাশা কড়া গলায় বলে উঠে।
——কোন অধিকারে আপনি আমায় ছুঁতে আসছেন!বউয়ের অধিকারে?আমাকে ছোঁয়ার আপনার কোনো অধিকার নেই।আমার হাত ছাড়ুন বলছি!নাহলে আমি চিৎকার দিতে বাধ্য হবো!হাত ছাড়ুন?

নাতাশা হাতটা ঝাড়া দিতেই নীর তার হাত সরিয়ে ফেলে।তারপর নাতাশা কাপড়ের ভাঁজ ঠিকঠাক করে দরজা খুলে রুমের বাহিরে চলে আসে।নাতাশা
নিচে এসে দেখে কোহিনুর বেগম কিচেনে রান্নাবান্না ছড়িয়ে দিয়েছেন।কোহিনুর বেগম নাতাশাকে দেখামাএই মুঁচকি হেসে উঠেন।আর বলেন,
——শুভ সকাল, নাতাশা মা?ঘুম কেমন হলো?
——শুভ সকাল, মা।আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো হয়েছে।
——নীর কি ঘুমচ্ছে?
——-জ্বী,মা।
——-একটু খেয়াল রেখো ওর প্রতি মা।
——-আচ্ছা মা।মা চা’টা আজ আমি বানাবো।চায়ের পাতা,পানি কোথায় যদি একটু বলতেন…
——সে কেমন কথা!তুমি চা বানাতে যাবে কেন?বাসায় আমি আছি এবং অন্যান্য কাজের লোক আছে।তাছাড়া নতুন বউকে কাজ করতে দেখলে সবাই মন্দ ভাববে।
——মা এসব কেমন কথা?আরেহ আমার ইচ্ছে হয়েছে আজ সবাইকে আমার হাতের বানানো চা খাওয়াবো।এটাতো মন্দ নয়,ভালোবাসা।এছাড়া যারা মন্দ মনের তারাই মন্দ ভাববে।

নাতাশার কথা শুনে কোহিনুর বেগম খিলখিল হেসে উঠেন।মাথা নেড়ে বলেন,
——আচ্ছা দিচ্ছি।দাড়াও।
তারপর তিনি চিনি,দুধ,চায়ের পাতার বৈয়াম নাতাশার হাতে দেন।নাতাশা একটা পাতিলে সাদাপানি নিয়ে চুলায় বসিয়ে দেয়।
চা বানানো শেষ হলে নাতাশা বাড়ির সকল মেম্বারদের জন্যে কাপে কাপে চা ঢালতে থাকে,আর এ ‘বাড়ির কাজের লোক রহিমা খাতুন ধপাস ধপাস সব ড্রাইনিং-এ নিয়ে জড়ো করছে।
তাছাড়া বৌভাত ডেটটা আগামীকাল,সেকারণে আজ এত ঝামেলা নেই।
সবাই ঘুম থেকে উঠে ড্রাইনিং-এ এক এক করে আসতে থাকে।শিরিন শাহ কিচেনে এসে বলে,
——-মা,ফাহাদ পায়েস খেতে বায়না করেছে।এখন…..
কথা শেষ না করে নাতাশার দিকে তাকায়।ফাহাদ হলো শিরিন শাহের ছেলে।আর শিরিন শাহের একটাই ছেলে।
কোহিনুর বেগম কড়া গলায় বলেন,
——-তো পায়েস রান্না করে নাও?এত্ত অভিনয়ের কি আছে!
——-মা আসলে আপনার ছেলের জন্যে রুমে চা নিয়ে যেতে হবে।নিহান নাকি আজ নিচে খাবে না।
——-ওর রুমে চা টা দিয়ে এসেই পায়েসটা বানিয়ে নিও।আমার এমনিতেই অনেক কাজ!তা’তো স্বচোখে দেখতে পাচ্ছো!

একথা বলেই কোহিনুর বেগম আবার নিজকাজে মন দেন।শিরিন শাহ সামান্য ক্রুদ্ধ হয়ে নাতাশার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার চলে যায়।শিরিন শাহ চলে যাওয়ার পর নাতাশা বলে উঠে,
——-মা পায়েসটা আমিই দিই? যেহেতু ভাবি ব্যস্ত!তাছাড়া ফাহাদেরও খেতে ইচ্ছে হয়েছে।
——-দরকার নেই উটকো ঝামেলা করার।যারটা সে নিজেই বানিয়ে নেবে।অন্যকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেওয়া একটা বদভ্যাস।তুমি নীরকে গিয়ে এককাপ চা দিয়ে আসো।

নাতাশা কোহিনুর বেগমের কথায় মাথা নেড়ে ড্রাইনিং-যায়।সে কিছুটা হদিস করতে পারে কোহিনুর বেগমের সাথে বড়ভাবির তেমন মিল নেইই।

চলবে….