ভেতরে বাহিরে পর্ব-০১

0
1635

#ভেতরে_বাহিরে
সূচনা পর্ব
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি

‘ আমায় স্পর্শ করবেন না,আবেশ ভাইয়া৷আমার থেকে দূরে যান৷ আমার পুরো শরীরে ব্যথা৷ একটু রহম করুন৷ ‘ সদ্য বিবাহিত নতুন বউয়ের উক্ত কথা শুনেই মেজাজ বিগড়ে গেলো আবেশের৷ নিজেকে সংযত করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্ধেক ঘোমটা টানা মেয়েটির দিকে৷ মেয়েটি অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে৷ আর বারবার এক কথা আওড়াচ্ছে,’আমায় স্পর্শ করবেন না,প্লীজ!’

আবেশ কিছুটা আগাতেই মেয়েটা আবার ভয়ে সংকুচিত হয়ে অনুনয়ের সুরে বলল,

‘ দূরে যান!আমার থেকে দূরে যান৷ সত্যি বলছি,আমার পুরো শরীরে ব্যথা৷ ‘

বিগড়ানো মেজাজ মুহূর্তেই আরো বিগড়ে গেলো আবেশের৷ যেখানে সে এই বিয়েটা’ই মানে নি এবং এই মেয়ের মুখ দেখার কোনো ইচ্ছে তার নেই৷ সে কী’না সেখানে এই মেয়েকে ছুঁয়ে দেখবে?

‘ এই মেয়ে কী সমস্যা তোমার? বারবার এক কথা বলছো,কেন?’

‘ আমি জানি আজ এই মুহূর্তে আমার সাথে কী হবে৷ আপনার দোহাই লাগে আমায় ছেড়ে দিন৷ ‘

ভেজা গলায় একরাশ ভয় নিয়ে বলল সে৷ আবেশ নিজের রাগ সংযত করার জন্য বাসর ঘরে লাগানো ফুলের মালা গুলো টেনে ছিড়তে লাগলো৷ সবাই কী পেয়েছে তাকে? যে যা ইচ্ছা বলবে আর সে শুনে যাবে?
আবেশের ভাংচুরের শব্দে মাধুর্য ভয়ে আরো সিটিয়ে গেলো৷ সব পুরুষ এক ধরণের কেন হয়? মাধুর্যের মনে ভয়ের বীজ আরো সূক্ষ্ম ভাবে রোপণ হলো৷ সেই সাথে শরীরের ব্যথায় মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে৷

‘ হেই ইউ৷ নিজেকে কী ভাবো তুমি? আমি ইচ্ছে করে তোমায় বিয়ে করেছি? না জোর করে তুলে এনেছি?’

আবেশের রাগে বলা প্রত্যেকটা কথায় খানিকটা অবাক হলো মাধুর্য।মিনমিনে গলায় বলল,

‘ আমি কিচ্ছু জানি না আবেশ ভাইয়া কিচ্ছু জানি না৷’

মাথার চড়ে থাকা রাগটা দপদপ করে বাড়তে লাগলো আবেশের৷ ইচ্ছা হচ্ছে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে মেয়েটার গাল লাল করে দিতে৷

‘ আমাকে নিয়ে তোমার ধারণা,কী?’ দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করলো আবেশ৷ মাধুর্য কাঁদছে৷ ফুঁপিয়ে কেঁদে উত্তর দিলো,

‘ আপনাকে নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই৷ আমি শুধু দয়া চাচ্ছি৷ প্লীজ আমার সাথে কিছু করবেন না৷ বিশ্বাস করুন,আমার শরীরের ব্যথায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে৷’

আবেশ রাগ ধরে রাখতে না পেরে পাশে থাকা ফুলদানিতে লাথি দিতেই পুরো ঘর ঝনঝন আওয়াজে ছেয়ে যায়৷ মাধুর্য বিছানার চাদর খামচে ধরে ভয়ে আরো চুপসে গেলো৷ তার অনুনয়ের জন্য’ই কী এতো রাগ আবেশের? দুনিয়া এতো নিষ্ঠুর কেন? নরক সম যন্ত্রণা শরীরে নিয়ে বিয়ের আসরে বসে ছিলো৷ আবারো আরেক নরক যন্ত্রনা বুঝি বাসর ঘরে ভোগ করতে হবে,তাকে?

‘ আমাকে তুমি তোমার মতো থার্ডক্লাশ ভাবো? শুনে রাখো,তুমি এবং তোমরা আমাকে যেমন ঠকিয়েছো আমি তোমার প্রত্যেকটা মূহুর্ত জাহান্নাম করে তুলবো৷ ‘

‘ আমার জীবন তো জাহান্নামের চেয়েও ভয়ংকর আবেশ ভাইয়া৷ যদি পারেন আমাকে মেরে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন৷’

মাধুর্যের কথা শুনে অবাক চোখে তাকালো আবেশ৷ যতবার খাটের দিকে তাকাচ্ছে রাগটা যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে৷ ঘরে রঙিন বাতি আর মোমের আলোয় লাল বেনারসি পরে বসে থাকা নববধূর দিকে তাকালে কামনা না পেয়ে তার ইচ্ছা হচ্ছে, মেয়েটাকে মেরে দিতে৷। মেয়েটার কান্নার আওয়াজ আরো বিরক্ত লাগছে তার৷ ঝাঁজালো কন্ঠে ধমকে উঠে বলল,

‘ এই মেয়ে কান্না থামাও৷ আর একবার তোমার কান্নার সাউন্ড আমার কানে আসলে..’

‘ কী করবেন?মারবেন! না আর পাঁচটা স্বামীর মতো অধিকার খাটাবেন?’

মাধুর্যের তীক্ষ্ণ আওয়াজে বলা কথায় সত্যি সত্যি এগিয়ে গেলো আবেশ৷ শক্ত করে চেপে ধরলো তার হাতের বাহু৷ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো মাধুর্য।

‘ তোমায় নরক যন্ত্রণা দিবো৷ যে যন্ত্রণায় কাতর হবে তুমি আর তোমায় বারবার মনে কারাবে আমাকে বিয়ে করার দিনটা৷’

আবেশের কথা শুনে মাধুর্য চমকে উঠলো৷ সব যন্ত্রণা তাকে কেন সহ্য করতে হয়? নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কেঁপে উঠা কন্ঠে বলল,

‘ আ..মা..কে ছাড়ুন৷ ছেড়ে দিন৷ আমি ব্যথা পাচ্ছি৷’

আবেশ শুনেও যেন শুনলো না৷ আরো শক্ত করলো হাতের বাঁধন৷ হিতাহিত জ্ঞান তার লোপ পাচ্ছে৷ সেই সাথে মনের কোঠায় পুষে থাকা রাগ অভিমানের মিশ্রিত অনুভূতি তাকে বিষিয়ে তুলছে৷

‘ তোমাকে ছুঁয়ে দেখার কোনো রুচি এই আবেশের নেই৷’

‘ দয়া করে আমার হাত ছেড়ে দিন,আবেশ ভাইয়া৷’ মাধুর্য আবারো কাতর কন্ঠে বলল৷ আবেশ রাগ মিশ্রিত পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো৷ একদম গাঢ় লাল বেনারসি জড়ানো মেয়েটা অর্ধেক ঢেকে রাখা ঘোমটার আড়াল থেকে তার হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে৷ তার জীবন কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো কিছু মুহূর্তে ৷ গোছালো জীবনে অগোছালো হাওয়া বইছে৷

‘ আ..বেশ ভাইয়া.. ‘ করুন কন্ঠের ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়ে আবেশের৷

‘ আমার উপর একটু দয়া করুন৷ আপনার হাতের ছোঁয়া আমার শরীরে বিষের মতো লাগছে৷’ মাধুর্য থেমে থেমে বলতেই
আবেশ হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে শাসিয়ে বলল,

‘ বিয়ের আসরে বসার সময় এই কথা মাথায় আসে নি?’

‘ আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই নি৷’

‘ করলে কেন! পালিয়ে যেতে পারলে না?’ আবেশ মাধুর্যের হাত ছেড়ে চিল্লিয়ে বলল৷ মাধুর্য হাতের বাঁধন আলগা পেয়েই পিছিয়ে গিয়ে বলল,

‘ পালিয়ে যেতে পারলে আমি বহু আগেই চলে যেতাম,আবেশ ভাইয়া।সমস্ত যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে যেতাম।আমার কাউকে সহ্য হচ্ছে না।প্লীজ আমাকে একা ছেড়ে দিন। আমার আপনাকে ভয় লাগছে।’

আবেশ রাগ সংযত করতে না পেরে মাধুর্যের কথা একটানে ঘোমটা টেনে সরিয়ে দেয়।মিটমিটে আলোয় আবেশকে অতিরিক্ত ভয় লাগছে মাধুর্যের।আবেশ একটানে মাধুর্যকে টেনে নামায় খাটে থেকে।হাতের টানে মাধুর্য ব্যথায় ককিয়ে উঠে।

‘ আমাকে ভয় লাগছে,তাই না?’

আবেশ মাধুর্যের হাত ঝাঁকিয়ে বলতেই মাধুর্য দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকায়।হাতের পুড়ে যাওয়া জায়গা টুকুর মাঝেই আবেশ চেপে ধরে আছে।জ্বলে উঠছে সমস্ত শরীর। বারবার হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য বললেও আবেশ ছাড়ছে না। লাইটের টিমটিমে আলোয় হ্ঠাৎ করেই আবেশের চোখ গেলো কান্নায় লাল হয়ে উঠা মেয়েটার দিকে।টানা টানা চোখ সাথে জোড়া ভ্রু অত্যাধিক মায়াবী মুখমণ্ডল। ল্যাপ্টে আছে কাজল,আইলাইনার।কাঁদার ফলে নাক চোখ ফুলে উঠেছে। আবেশের রাগে একটু ভাঁটা পড়লো।

মাধুর্য ছটফট করছে। চামড়া ছিলে যাচ্ছে হাতের।বিয়ের একটু আগেই হাতে পুড়েছে। সেই কথা মনে পড়তেই ব্যথা দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।কাঁপা কন্ঠে বলল,

‘ আ..আমি….আমি চলে যাবো। সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো। তবুও আমার হাত ছেড়ে দিন।’

আবেশ হাত ছেড়ে দিলো সাথে সাথেই। মাধুর্য ব্যথায় মেঝেতে বসে পড়লো।মৃদু চিৎকার করে কাঁদতেই আবেশ ফিরে তাকালো। সে তো এমন কিছু করে নি যাতে মেয়েটা এইভাবে কাঁদবে?

‘ কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?’ আবেশ কিছুটা মোলায়েম কন্ঠে বলতেই মাধুর্য শব্দ করে কেঁদে উঠলো।মাধুর্য আবেশের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই বুঝতে পারলো চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে।

‘ আমাকে মেরে ফেলবেন?প্লীজ আমাকে মেরে ফেলুন।একটুকরো কাগজ দিন আমি নোট লেখে দিয়ে যাবো,আপনার কোনো দোষ নেই।’

আবেশ ঘাবড়ে গেলো মাধুর্যের ভেজা কন্ঠের কথায়।মাধুর্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও পারলো না। পেছনে থাকা সোফায় হেলান দিতে চেষ্টা করে ব্যথা্য ককিয়ে উঠলো আবার। আবেশ তড়িঘড়ি করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলো। মাধুর্য চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। আবেশ এগিয়ে গেলো। লাইটের আলোতে মাধুর্যের গলার খোলা অংশটুকুতে মারের দাগ দেখতে পেলো। ফর্সা গালের নীচের অংশেও কালো দাগ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ লাঠি বা বেল্ট দিয়ে মেরেছে। আবেশ মাধুর্যের সামনে হাটু ভাজ করে বসতেই চোখ গেলো হাতের দিকে ঘা হয়ে আছে জায়গাটুকু।কাছে এগিয়ে গিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ তোমার শরীরে এইগুলা কী? আর হাতে…এই মেয়ে..’ আবেশের বাকি কথাটুকু শেষ হওয়ার আগেই….

চলবে…