ভ্যাম্পেয়ার রাজ্য পর্ব-০৩

0
325

#ভ্যাম্পেয়ার_রাজ্য
#লেখিকাঃ_মার্জিয়া_রহমান_হিমা
#পর্বঃ ০৩

মাঝরাতে হঠাৎ দমকা হাওয়া শুরু হয়। ব্যালকনির দরজা খুলে হুরহুর করে রুমে বাতাস প্রবেশ করতে থাকে। বাতাসের সঙ্গে কেউ একজন ঝড়ের গতিতে প্রিশার রুমের ভেতরে ঢুকলো। প্রিশার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দেখলেই কেউ ধরে ফেলতে পারবে এই চোখে কিছু পাওয়ার জন্য কতোটা আশা, আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।

প্রিশা ঠাণ্ডা বাতাসের টের পেয়ে চোখ খুলে বিরক্তিতে ব্যালকনির দরজার দিকে তাকায়। পাশে কেউ রয়েছে এমন অনুভূতি হয় প্রিশার। প্রিশা চট করে পাশে তাকাতেই লাল চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে দেখতে পেলো। প্রিশার বুক ঢক করে উঠে। বাইরের আবছা আলোতেই তার মুখমণ্ডল দেখে প্রিশা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে। অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সেই মুখ আর তার হাসি যেনো তাকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। তাকে দেখে প্রিশার ভয়ে হাত পা কাঁপা শুরু হয়।
প্রিশার চিৎকার শুনতেই পুরো বাড়িতে আলো জ্বলে উঠে। ঝড়ের বেগে হঠাৎ কেউ দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লো প্রিশার রুমে। প্রিশা দরজা ভাঙার শব্দে আরো ভয় পেয়ে আবারও চিৎকার দিয়ে বসলো।
শুভ্র প্রিশার চিৎকার শুনে রুমের লাইট অন করে।
প্রিশা আলোর সুভাষ পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দরজার দিকে তাকিয়ে শুভ্রকে দেখে জান ফিরে পায়। প্রিশা বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো পায়ে দৌঁড়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে ঢুকড়ে কাঁদতে থাকে।
শুভ্র চমকে গেলো প্রিশার হঠাৎ এমন আক্রমণের শিকার হয়ে। শুভ্র প্রিশাকে বললো
” কি হয়েছে চিৎকার করেছিলে কেনো তুমি ?”
প্রিশা হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললো
” ককেউ ছিল লো এখানেহ।” শুভ্র ভ্রু কুঁচকে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে পর্যবেক্ষণ করেও কাউকে পেলো না।
বাড়ির সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে একে একে। দিদার হেল্ড এসে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই প্রিশা শুভ্রকে ছেড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে ভয়ে। দিদার হেল্ড অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো
” কি হয়েছে নানুমনি ? কাঁদছো কেনো তুমি ?”
সবাই অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে প্রিশাকে কিন্তু প্রিশা এখনও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। প্রিশা অস্পষ্টভাবে উত্তর দেয় কেউ ঠিক মতো বুঝতে পারছে না।
শুভ্র ব্যালকনিতে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা দেখার জন্য চোখ বন্ধ করে নেয়। সব কিছু দেখে চোখ খুলে ফেলে। সোডাল্ট এসেছি ? তাও তার ভয়ঙ্কর রূপ নেই। শুভ্র দ্রুত পায়ে রুমে আসলো। প্রিশার দিকে তাকায়। দিদার হেল্ডকে উদ্দেশ্য করে শুভ্র গম্ভীর গলায় বললো
” এই রুমে এসেছিলো দিদুন। প্রিশা তাকে দেখেই ভয় পেয়েছে।” সবাই অবাক হয় শুভ্রর কথায়। রিমা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো
” এই রুমে কে আসবে তাও এতো রাতে ? প্রিশা কাকে দেখেছো তুমি?” প্রিশা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ভেজা গলায় বললো
” জানি না কে সে। কিন্তু অনেক ভয়ঙ্কর দেখতে।
চোখ দুটো লাল। কেমন ভয়ঙ্কর হাসি দিয়ে তাকিয়ে ছিলো।” প্রিশা আবারও কেঁদে দেয় ভয়ে। দিদার হেল্ড বুকে জড়িয়ে নেয় প্রিশাকে। শুভ্র প্রিশার অবস্থা বুঝতে পেরে দিদার হেল্ডকে বললো
” তুমি প্রিশার সঙ্গে থাকো। প্রিশা ভয় পাচ্ছে বেশি।” পাখি আর রিমা সাইরাকেও প্রিশার সাথে থাকতে বললো। দিদার হেল্ড আর সাইরা প্রিশাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। সবাই একে একে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
শুভ্র প্রিশাকে দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখনও। প্রিশা কান্না করায় নাক মুখ লাল হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে চোখ থেকে মুক্ত ঝরছে প্রিশার। শায়ান শুভ্রকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ফিসফিস করে বললো
” এভাবে দেখছিস কেনো তুই ? প্রিশা কিন্তু আমার বউ হবে। ওর দিকে এভাবে তাকাবি না। আমার ডার্লিং ভয় পাচ্ছে। ওকে ঘুমাতে দে চল।”
শুভ্র এক ভ্রু উঁচু করে শান্ত দৃষ্টিতে শায়ানের দিকে তাকায়। শায়ানও গম্ভীর হয়ে তাকালো।
শুভ্র নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

প্রিশা দিদার হেল্ডকে জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে। সাইরা প্রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” পিচ্চি কেউ আসবে না এখন। আমরা আছি তোমার সাথে। তুমি ঘুমাও একটু !” প্রিশা দুজনের মাঝখানে গুটি মেরে শুয়ে থাকে। দুজনের হাত শক্ত করে ধরে নিজের উপর রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
শুভ্র সিদ্ধার্থ হেল্ড এর রুমে ঢুকেই বলে উঠে
” প্রিশার রুমে সোডাল্ট এসেছিলো দাদাই।”
সৈকত হেল্ড বসতে বসতে বললো
” জানি আমরা। কিন্তু প্রিশা এসেছে এসব খবর এতো দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছে গেলো কি করে ? ও যে শ্রেয়ার মেয়ে এটা তো পরিবারের লোক ছাড়া কেউ জানে না।” সিদার হেল্ড ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকালো। বিরক্তের সঙ্গে বললো
” ভাইয়া তুমি বোকার মতো কথা বলছো না ? এটা তো একটা খবর মাত্র। কতো বড় বড় মূল্যবান! জিনিস তারা হাতিয়ে নিতে পারে সেখানে এসব খবর পাওয়া কি খুব কঠিন কাজ বলে তোমার মনে হয়?”

সিদ্ধার্থ হেল্ড চিন্তিত হয়ে বললো
” তোমার মাথায় কি অযৌক্তিক কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু নেই ? এটা ভাবো সোডাল্ট আজ প্রিশার রুমে এসেছে শুধুমাত্র। এটা দিয়ে যে আমাদের হুমকি স্বরূপ সাবধানতা থাকার সংকেত দিয়ে গিয়েছে বুঝতে পারছো ? প্রিশার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে সোডাল্ট। সোডাল্ট যদি কোনোভাবে প্রিশাকে কাছে পায় তাহলে কি হবে সেটা জানোই তোমরা।”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে
” কি হবে দাদাই ?” সিদ্ধার্থ হেল্ড উওর দিলো না। ধ্যানে মগ্ন হয়ে যায়। শুভ্র ভ্যাম্পেয়ার এর শক্তির উপর রাগ ঝারলো। মানুষের মস্তিষ্ক পড়া যায় কিন্তু ভ্যাম্পেয়ারের মস্তিষ্ক পড়া যায় না। এ কেমন শক্তি ?
শুভ্র রেগে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই সিদ্ধার্থ হেল্ড তাকে পিছু ডাকলো। শুভ্র রাগ নিয়েই এসে তার সামনে দাঁড়ায়। সিদ্ধার্থ হেল্ড শান্ত গলায় বললো
” আপাতত প্রিশাকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছো তুমি। প্রিশার ১৮ বছর পূর্ণতা না পাওয়া পর্যন্ত সোডাল্টের হাজারও আক্রমণ চলতে থাকে প্রিশার উপর। প্রিশাকে নিজের করে নিতে চাইবে আর না সেটা অসম্ভব মনে হলে সে প্রিশার ক্ষতি করতে পারে। বর্তমানে তুমি ভ্যাম্পেয়ার রাজ্যের সবচেয়ে ক্তিশালী। তোমার ক্ষমতার সাথে সোডাল্ট পেরে উঠবে না। তুমিই প্রিশাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়।” শুভ্র শান্ত হয়ে সব শুনলো। সিদ্ধার্থ হেল্ড এর বংশধর হওয়ার ভ্যাম্পেয়ার রাজ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারি সে। অনেকেই যা পারবে না তা শুভ্র পারবে তেমন ক্ষমতা। শুভ্র শান্ত গলায় বললো
” কি করতে হবে আমায় ?” সিদ্ধার্থ হেল্ড উত্তরে বললো
” সময় আর পরিস্থিতি দেখে নিজের বুঝতে পারবে কখন কি কি করতে হবে। সবাই আসতে পারো এখন।” তিনজনই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

সকালে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে প্রিশা। প্রিশা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিজের চারপাশে তাকাচ্ছে বারবার। রাতের ভয় এখনও কাটেনি তার। বুক ধড়ফড় করে বারবার।
শুভ্র উপর থেকে সব দেখে মনে মনে হাসছে। শুভ্র এবার পা চালিয়ে প্রিশার পেছনে পেছন হাটতে থাকে। প্রিশা মনে মনে বিরবির করছে। শুভ্র বলে উঠলো
” ভুত কে বকে লাভ আছে ? বেচারা ভুত তো কিছুই করেনি। কাল তো অন্য কেউ এসেছিলো।” শুভ্রর গলা শুনে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায় প্রিশা। প্রিশা ফ্যালফ্যাল করে তাকালো শুভ্রর পানে। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
” কে এসেছিলো ?” শুভ্র শান্ত গলায় বললো
” খুবই খারাপ একটা জিনিস। যাভে তার কাছে ? চলো নিয়ে যাই তোমাকে !” শুভ্র প্রিশার হাত ধরে টানতেই প্রিশা চেঁচিয়ে বলে উঠলো
” না না যাবো না আমি। ছাড়ুন আমাকে !”
প্রিশা হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করতে থাকে কিন্তু শুভ্র ছাড়ার মানুষ নয়। টেনে নিয়ে নামিয়ে নিচ্ছে প্রিশাকে আর প্রিশার চেঁচামেচি শুনে মনে মনে হাসছে। প্রিশার চিৎকার শুনে সবাই হাজির হয়। প্রিশা দিদার হেল্ড এর হাত শক্ত করে ধরে চেঁচিয়ে ভেজা গলায় বললো
” নানু দেখো উনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আমি যাবো না কোথাও। ওও নানু আমাকে যেতে দিও না।” সবাই হাসতে থাকে প্রিশা আর শুভ্রকে দেখে।

বিকেল সাইরাকে বললো প্রিশাকে নিয়ে ঘুরে আসতে। শুভ্র আর শায়ানও তাদের সাথে বের হলো। চারজন হাটতে হাটতে হঠাৎ শুভ্র দাঁড়িয়ে গেলো একজন মানুষকে দেখে। হঠাৎ করে শুভ্রর ব্লাড খাওয়ার জন্য তার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। শুভ্রর মনে হলো রক্ত না খেলে সে এবার মারা যাবে। শুভ্র নিজের চারপাশে তাকালো। এখানে প্রচুর মানুষ রয়েছে। শুভ্রর চোখ জোড়া নীল হয়ে যায়। শায়ানের শুভ্রর দিকে খেয়াল করতেই শায়ান চমকে শুভ্রর দিকে তাকায়। শায়ান চাপা স্বরে শুভ্রকে বললো
” কি হয়েছে তোর ? তোর ভ্যাম্পেয়ার রূপ বাইরে বেরিয়ে আসছে কেনো ? তুই নিজেকে আড়াল কর নাহলে কেউ দেখে ফেলবে।” শুভ্র রুমাল বের করে নিজের মুখ ঢেকে নেয় আর চোখে সানগ্লাস পড়ে নিলো। শুভ্রর রক্ত পিপাসাও বাড়তে থাকে।
শুভ্রর খুবই রাগ হলো। আগে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি সে। না চাইতেও এখন তার ভ্যাম্পেয়ার রূপ বেড়িয়ে আসছে। শুভ্রর মনে হলো এখনই তাকে এখান থেকে প্রস্থান করতে হবে। শুভ্র শায়ানকে ইশারা করে সেখান থেকে চলে গেলো দৌঁড়ে।
প্রিশা সাইরার সাথে গল্প করতে এতো ব্যস্ত যে আশেপাশে কোথাও তাকাচ্ছে না সে।
হঠাৎ প্রিশার মুখের সামনে একটি ফুলের তোরা ধরলো কেউ। প্রিশা সহ শায়ান আর সাইরাও চমকে যায় এমন কাজে। প্রিশা সাইরার দিকে তাকিয়ে আবারও ফুলের দিকে তাকায়। ডেইজি আর রোজের তোরাটা। প্রিশা ফুলের তোরা না নিয়ে সেটা সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। একজন সুদর্শন যুবককে দেখতে পেলো। সাইরা ভ্রু কুঁচকে বলবো
” hey ! Who are you ?” ছেলেটির হাবভাব দেখে মনে হলো সে সাইরার প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয় সে। ছেলেটি মুখে হাসি নিয়ে প্রিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো
” Hello ! Beautiful pretty girl. Myself sid. What’s your name ?” প্রিশা আলতো হেসে বললো
” প্রিশা।” সিড নামের ছেলেটি ফ্লাওয়া বুক টা এগিয়ে দিয়ে বললো
” This is for you. Take it please !”
প্রিশা সাইরার দিকে তাকায় কিন্তু সাইরার সেদিকে খেয়াল নেই। সাইরা তো সিডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অগ্নিমূর্তির মতো। পারলে এখনই খেয়ে ফেলে তাকে। শায়ান এগিয়ে এসে সিডের হাত থেকে ফ্লাওয়ার বুক নিয়ে হাসি মুখে বললো
” Thanks for that.” সিড থমথমে চেহারায় প্রিশা আর সাইরার দিকে তাকায়। শায়ানকে এক প্রকার ইগনোর করে সিড বললো
” আমরা কি ফ্রেন্ডসিপ করতে পারি ?” শায়ান সিডের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো
” No chance bro ! She is my friend. Now, you can go from here.”
সিড তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শায়ানের দিকে। প্রিশার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলো সে। সিডের হাতে একটা ট্যাটুর উপর নজর পড়ে শায়ানের। শায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। কোথাও দেখেছে বলে ধারণা করলো।
ফ্লাওয়ার বুক টা ছুড়ে ফেলে দিতেই প্রিশা বলে উঠে
” আরে ফেললে কেনো ভাইয়া ?”
শায়ান মুখ কুঁচকে বলে
” অপরিচিতদের জিনিস নিতে নেই বুঝেছো? তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে। তোমাকে শুধু ফুল কেনো দেবে ? চকলেট বা অন্যকিছু দেওয়ার দরকার ছিলো তো নাকি ?”
প্রিশা আর সাইরা একে অপরের দিকে তাকালো। প্রিশা মিটমিট করে হাসে।

চলবে………