ভয়ংকর সে পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
659

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৪০_শেষ_পর্ব
#M_Sonali

“আমার এই চেহারাটাই সবাই দেখছিল। তোমার বাবা দাদী সবাই। শুধু তুমি ঐ চেহারাটা দেখছো যেটা আমি দেখাতে চেয়েছি। বলতে পারো তোমার চোখে আমার শক্তি দিয়ে পর্দা ফেলে দিয়েছিলাম। শুধুমাত্র আমায় কতটা ভালবাসো তা বোঝার জন্য।”

ওর এমন কথা শুনে বেশ অভিমান হল চাঁদনীর। সে ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল,

“আমি এতটা পাগলের মত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আপনি বুঝতে পারেননি আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি? যে আবার এভাবে পরীক্ষা করতে হলো? আপনি জানেন আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সুই-সাইড করে ম-রে যাব। তবু অন্য কারো হবো না। আর আপনি কিনা আমার সাথে এমন টা করতে পারলেন? যান আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।”

কথাটা বলেই দূরে সরে যেতে নিল চাঁদনী। শ্রাবণ তখনই ওকে হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। কপালে চুমু দিয়ে বলল,

“তুমি কি জানো চাঁদপাখি। রাগলে তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে। ইচ্ছে করে আস্তো চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।”

ওর কথা শুনে চাঁদনী অভিমানের সুরে অন্যদিকে তাকিয়ে রাগ করে বললো,

“তো খান না, মানা করেছে কে? খেয়ে ফেলুন আমায়।”

ওর কথায় শ্রাবণ হেসে উত্তর দিলো,

“খাবো তো অবশ্যই। তবে এখন না সঠিক সময় এলে। বুঝেছো চাঁদ পাখি রেডি থেকো সেই সময়ের জন্য।”

চাঁদনী ওর কথার কোন উত্তর দিল না। কারণ সে ভাল করেই জানে শ্রাবন তার সাথে মজা করছে। তাই ওর বুকে কিল ঘুষি মারতে লাগল। শ্রাবণ আর দেড়ি না করে ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর নিজের ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে লাগলো ওকে।
,
,
,
১৫ দিন পর,
“আমার কলিজার টুকরা মেয়েটাকে আমি তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি বাবা। ওকে তুমি ভালো রেখো। ওর সকল দায়িত্ব এখন থেকে তোমার। ওকে কখনো আমাদের অভাব বুঝতে দিওনা। এতোটুকুই চাই তোমার কাছে।”

শ্রাবণের হাত ধরে কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলেন রতন মিয়া। ওনার কান্না দেখে দেরি না করে ওনার হাতটি নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে ওনাকে আশ্বাস দিয়ে শ্রাবন বললো,

“আপনি চিন্তা করবেন না বাবা। আপনারা ওকে যতটা ভালবেসে বড় করেছেন আমি তার চাইতেও সুখী করবো ওকে। এখন থেকে ওর সকল দায়িত্ব আমার। ওর যেন কোন দিকে কোন অসুবিধা না হয় সেটা আমি দেখব। ওকে কখনোই আপনাদের অভাব বুঝতে দিব না। আর তাছাড়া এত টেনশন করছেন কেন। আমরা তো তিন বছর পর আবার ফিরে আসবো। জাস্ট তিন বছরের ব্যাপার।”

ওর কথার উত্তরে রতন মিয়া কিছু বলার আগেই পাশ থেকে রত্না বেগম বলে উঠলেন,

“তোমার কাছে তিন বছর অনেক কম সময় হতে পারে জামাই। কিন্তু আমাদের কাছে তিনটি বছর অনেক সময়। এতটা সময় চাঁদনী বুড়িকে দেখতে পাবো না ভেবেই আমাদের কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ির একমাত্র সুখ পাখি সে। তাকে আজ তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। ওকে তুমি দেখে রেখো। আর প্রতিদিন একবার করে অন্তত আমাদের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিও। এখন যাও, তোমরা আর দেরি করো না বেরিয়ে পড়ো।”

ওনার কথা শুনে শ্রাবণ ওনাকেও বেশ কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে কথা বললো। তারপর ওনাদের থেকে বিদায় নিয়ে চাঁদনী কে নিয়ে রওনা হলো। বিদায়ের সময় অবশ্য চাঁদনী রতন মিয়া এবং রত্না বেগম অনেক কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু শ্রাবণ অনেক বুঝিয়ে তাকে নিয়ে রওনা দিয়েছে। সে আসার সময় বলে এসেছে আজ বিকেলের ফ্লাইটে ওকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। তিন বছর পর বিদেশ থেকে ফিরবে। অফিস থেকে একটি কাজের জন্য বিদেশে যাবে সে। তাই চাঁদনী কে নিয়ে সেখানে যাবে। তারা যদিও প্রথমে রাজি ছিলেন না ওকে পাঠাতে। কিন্তু পরে শ্রাবণের জড়াজড়িতে বাধ্য হয়েছেন।
,
,
গাড়ি ছুটে চলেছে আপন গতিতে। অনেক বেশি স্পিডে ছুটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তা ধরে। চাঁদনী জানালার বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে অঝোরে কান্না করছে। কেন জানে না আজকে বাবা এবং দাদিকে ছেড়ে আসতে বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছিল তার। কেমন যেন বারে বারে মনে হচ্ছিল এটাই তাদের সাথে ওর শেষ দেখা। আর কখনো হয়তো তাদেরকে দেখতে পারবেনা সে।

ওকে চুপচাপ বসে কান্না করতে দেখে শ্রাবণ ওর হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। তারপর শান্ত গলায় বলে উঠলো,

“এভাবে কাদছো কেনো চাঁদ পাখি? আমি আছি তো তোমার পাশে।”

ওর কথার উত্তরে চাঁদনী ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। চোখের জল ফেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“এভাবে উনাদের মিথ্যে কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল শ্রাবণ। আমরা তিন বছর এখানে আসতে পারবো না সেটা খোলাখুলি ভাবে বললেই হতো। এভাবে বিদেশের কথা বলে যাওয়াটা আমার মোটেও ভালো ঠেকছেনা। কেন যেনো বারবার মনে হচ্ছে ওনাদের সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না। আমার কিছু ভালো লাগছেনা শ্রাবণ। আপনি এমন মিথ্যে কথা কেন বলালেন আমাকে দিয়ে।”

কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো সে। ওকে কান্না করতে দেখে শ্রাবণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আমি যেটা করেছি আমাদের ভালোর জন্য করেছি চাঁদপাখি। তুমি এসব নিয়ে এত ভেবনা। আর তুমি ভালো করেই জানো তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যাচ্ছি। সেখান থেকে আগামী তিন বছরের মধ্যে কোন ভাবেই এখানে আসতে পারবে না। তাই এত বড় নাটক সাজাতে হয়েছে আমায়।”

চাঁদনী আর ওর কথার উত্তরে কোন কিছু বলল না। চুপচাপ আবারো জানলার বাইরে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। শ্রাবণ তাকে অনেক আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে নিয়ে ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে চলে যাবে। আর আগামী তিন বছরের মধ্যে সেখান থেকে ফিরতে পারবে না কোনোভাবেই। এ তিন বছরের মধ্যে যদি সে কোনভাবে ওখান থেকে বাইরে বের হয়। তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে শ্রাবনের। তাই সে রাজি হয়েছে।

বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে কান্না করতে করতে কখন যে চোখটা লেগে এসেছে নিজেও জানেনা চাঁদনী। শ্রাবণের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ওকে ঘুমাতে দেখেই শ্রাবণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে উঠল। মনে মনে কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে টাকা পরিশোধ করে চলে যেতে বললো। আশে পাশে তাকালো, দেখলো আশেপাশে কেউ নেই। চাঁদনীকে নিয়েই নিজের ভ্যাম্পায়ার রূপ ধারণ করে উড়াল দিলো আকাশ পানে।

ঘুম ভাঙতেই সারাশরীরে অসম্ভব ঠান্ডা অনুভব করলো চাঁদনী। সে চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সে যেখানে শুয়ে আছে তার চারপাশটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাঁদনী বেশ ভয় পেয়ে গেল। সে উঠে বসার চেষ্টা করতেই খেয়াল করলো, সে যেন কোনো কিছুর সাথে শক্ত করে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। তার সারা শরীর জরিয়ে আছে ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে কিছু। যার আগুনের মত উত্তপ্ত গরম নিশ্বাস আছড়ে পরছে ওর মুখে।

ভয়ে মুহূর্তে যেন ঘেমে একাকার হয়ে গেল চাঁদনী। শরীরে এতটা ঠান্ডা জরিয়ে থাকা সত্বেও ঘাম ঝরে পড়তে লাগল তার কপাল বেয়ে। সে এবার ভয়ে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। সে কোনভাবেই চিৎকার করতে বা নড়াচড়া করতে পারছে না। তখনই চাঁদনীর অনুভব হতে লাগল যেন তার গলার কাছে কিছু একটা নিজের ধারালো দাঁত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করতেই দেখল, তার চোখের সামনে অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে দুটি ভয়ানক চোখ। যেন দুটি আগুনের গোলার মতো। মুহূর্তে সেই চোখ দুটো এগিয়ে গেল তার গলার কাছে। এবং গলায় শুই ফোটার মত আঘাত লাগলো।
সাথে সাথে ভয়ে চিৎকার করে উঠল চাঁদনী। উঠে বসে হাপাতে লাগল সে। সারা শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা তার। বেশ কিছুক্ষণ হাঁপাতে হাঁপাতে চারি দিকে খেয়াল করতেই দেখল, সে একটি বিশাল রুমের মাঝে শুয়ে আছে। রুমটা তার অচেনা নয়। এখানে সে এর আগেও একবার এসেছে। তার আর বুঝতে বাকি রইল না। সে এখন ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে রয়েছে, শ্রাবণের রুমে। কিন্তু রুমটা একবারে ফাঁকা। সেখানে ও ছাড়া আর কেউ নেই। আশেপাশে শ্রাবণকেও কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।

বিছানা ছেড়ে নিচে থেমে দাঁড়ালো চাঁদনী। সারা শরীর যেন থর থর করে কাঁপছে তার। ভীষণ রকম ভয় লাগছে মনে। পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পুরো রুমটা খালি। কোন দিকে কোনো জানালা নেই। যে একটু বাইরে দেখতে পারবে। ধিরু পায় এগিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে। দরজাটা লাগিয়ে রাখা। সে বুঝতে পারছে না আদৌ দরজা দিয়ে বাইরে বের হতে পারবে কিনা। তবুও মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দরজার কাছে।

দরজার সামনে গিয়ে আলতো হাতে দরজায় ধাক্কা দেয় সে। সাথে সাথে খটখট শব্দে খুলে যায় দরজাটা। চাঁদনী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দেরি না করে দ্রুত রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু বাইরে বের হতেই যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে এমন একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যার চারিপাশে হাজার টা দরজা এবং হাজারটা রাস্তা। কোন দিক দিয়ে যাবে বা কোন রাস্তায় যাবে কিছুই যেন বুঝতে পারছেনা। যেন কোন এক গোলকধাঁধায় আটকে গেছে সে। এর আগেও তো শ্রাবণ এর সাথে এখানে এসেছিল। তখন তো এমন ছিল না। তাহলে আজ কেন এমন দেখাচ্ছে? কথাগুলো ভেবে যেন ভয়ে চোখে অশ্রু ঝরে পড়ে চাঁদনীর। সে কি করবে বুঝতে পারে না। একবার ভাবে আবার রুমে ফিরে যাবে। পরক্ষণেই চিন্তা করে না সামনে এগিয়ে দেখবে।

এভাবে কিছুক্ষণ দুটানা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় সে। সামনে এগিয়ে দেখবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে হাটা শুরু করে সে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে চোখ খুলে হাঁটতে থাকে। তার চারপাশে অসংখ্য রাস্তা এবং দরজা রয়েছে। চাঁদনী কোন দিকে যায় না। একটানা সামনের দিকে হেঁটে চলতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আধ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। তবুও যেন রাস্তা শেষ হয়না। সে যেন এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে এবার বেশ হাপিয়ে ওঠে। এদিক ওদিক ফিরে তাকিয়ে একটি দরজার দিকে নজর পড়ে। দরজাটা অন্য সব দরজার চাইতে একটু আলাদা। অন্যসব দরজায় ভ্যাম্পায়ারদের ভয়ংকর মুখের চেহারা ছবি আঁকা। কিন্তু এই দরজাটা একদম স্বাভাবিক।

সে কিছু না ভেবে সেই দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেয়। কিন্তু দরজা টা লাগানো। কোনভাবেই খুলতে পারে না। তাই দরজায় ঠকঠক করে শব্দ করতে থাকে। আর শ্রাবন বলে ডাকতে থাকে। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়। কিন্তু কোথাও থেকে কেউ কোনো সাড়া দেয় না। বা দরজা খুলে না। চাঁদনী এবার বেশ বিরক্ত হয়। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না শ্রাবণ তাকে এখানে রেখে কোথায় গেছে। আর এটাইবা কোন জায়গা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ওর মনে হয় যেন কোন এক ঠান্ডা বাতাস ওকে ছুয়ে উড়ে চলে গেল। মূহূর্তে ভীষণ রকম ভয় পেয়ে যায় চাঁদনী। সে শুকনো ঢোক গিয়ে নিজের চারিপাশে ভালো করে দেখে নেয়। কিন্তু না কোথাও কেউ নেই। সব কিছুই স্বাভাবিক আছে। কথাটা ভাবতেই আবারো তার চোখের সামনে দিয়ে যেন হাওয়ার বেগে কিছু একটা ছুটে চলে যায়। এবার যেন প্রচন্ড রকম ভয় পেয়ে যায় সে। ভয়ে শ্রাবণ বলে চিৎকার দিয়ে নিজের চোখ দুটো দুহাতে ঢেকে নেয়।

তখনই মাথায় কারো হাতের স্পর্শে ধ্যান ভাঙ্গে তার। সে কোনো কিছু না ভেবেই সামনে থাকা মানুষটিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে। হু হু করে কান্না করতে থাকে। মানুষটিও তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“সরি চাঁদ পাখি আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু তুমি এখানে কি করছ। ঐ রুম থেকে বাইরে বের হয়েছ কেন?”

চাঁদনী কিছু বলেনা। আরো জোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে ওঠে। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শ্রাবণকে। শ্রাবণ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর আবার বলে,

“এভাবে কান্না করো না চাঁদপাখি। এখন তো আমি চলে এসেছি। আর কোন ভয় নেই। আর তাছাড়া ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের কেউ তোমার কোন ক্ষতি করবে না। কারো সাহস হবে না তোমার ধারে কাছেও আসার। তাই ভয়ের কিছুই নেই চাঁদ পাখি। চলো আমার সাথে।”

কথাটা বলেই ওকে কোলে তুলে নেয় শ্রাবন। তারপর হাওয়ার বেগে কোথাও একটা ছুটে চলে যায়। চাঁদনী আর এর মাঝে চোখ তুলে তাকানোর সাহস দেখায় না। মুহূর্তেই কোথাও একটা গিয়ে থমকে যায় তারা। চাঁদনী এবার চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে ফিরে তাকায়। দেখে বিশাল বড় একটি সিংহাসনের সামনে হাজার হাজার ভ্যাম্পায়ার এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

প্রতিটা ভ্যাম্পায়ার এর চেহারা একদম বিশ্রী ও ভয়ানক দেখতে। চাঁদনীর যেন গা শিউরে উঠছে তাদের চেহারা দেখে। সবাই কেমন অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন শিকারের অপেক্ষা করে আছে তারা। হুকুম পেতেই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে চাঁদনীর ওপর। আর মুহূর্তের মাঝে তাকে খুবলে খুবলে খেয়ে ফেলবে।

কেন জানে না ভীষণ রকম ভয় লাগছে চাঁদনীর। শ্রাবণের সাথে থেকেও যেন তার নিজেকে একদম একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হাজারটা রাক্ষসের মাঝখানে সে একাই দাঁড়িয়ে আছে। যেন সবাই মুহূর্তের মাঝে তাকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্যাপারটা ভাবতেই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল চাঁদনীর। ভয়ে যেন নড়াচড়া করার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে সে। তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ বাঁকা হাসল। গম্ভীর গলায় ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আমার সাথে আসো।”

কথাটি বলেই ওকে কিছু বলতে না দিয়ে হাত ধরে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর চাঁদনীকে পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে সিংহাসনে বসে পরলো। সকলের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলো,

“তোমরা সকলেই জানো আজকে আমাদের সবার জন্য কতটা বিশেষ একটা দিন। এই দিনটার জন্য আমরা শত শত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি। সব অপেক্ষার অবসান ঘটবে আজ। তোমাদের সামনে তোমাদের সকলের শিকার দাঁড়িয়ে আছে। যাকে স্বীকার করতে পারলেই তোমরা সবাই লাভ করবে এক বিশেষ শক্তি। যে শক্তির উৎস শুধুমাত্র এই একজনের মাঝেই রয়েছে। যাকে অনেক কষ্টে ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি আমি। যার বিশ্বাস অর্জন করা ছিল আমার কাছে বিশাল বড় একটি চ্যালেঞ্জ।”

এতটুকু বলে থামল শ্রাবণ। তারপর বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে ফিরে তাকাল চাঁদনীর দিকে। চাঁদনী যেন আকাশ থেকে পড়েছে। তার মাথা যেন কোন কাজ করছে না। শ্রাবনের বলা প্রতিটি কথা যেন তীরের মত বিধছে তার কানে। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না শ্রাবণ এসব কেন বলছে। আর কাকে শিকার বলছে সে। তবে কি চাঁদনী সেই স্বীকার? যাকে অনেক কষ্টে ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু শ্রাবণ তো তাকে ভালোবাসে। অনেক বেশি ভালোবাসে। সে ওকে কেন মারবে? সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু শ্রাবণ সেদিকে তোয়াক্কা করেনা। আবারও বাঁকা হেসে সকলের দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

“তোমাদের শিকার রেডি। আমার কাজ এখানেই শেষ। এখন থেকে তোমাদের কাজ তোমরাই করতে পারবে। যাও ওকে নিয়ে গিয়ে বলির জন্য রেডি করো। সময় কিন্তু আর বেশি নেই।”

ওর হুকুম পেতেই ভ্যাম্পায়ার গুলো যেন মুহুর্তের মাঝে ছুটে আসে চাঁদনীর কাছে। ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ওকে ধরে নিয়ে যায় অদ্ভুত একটি জায়গায়। জায়গাটা পুরো অন্ধকারছন্ন। এবং ভয়ঙ্কর একটি জায়গা। জায়গাটার ঠিক মাঝখানে রয়েছে বিশাল বড় একটি কালো রঙের পাথর। পাথরের ওপর চাঁদনীকে চিৎ করে শুইয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার হাত-পা পাথড়ের সাথে আপনাআপনি আটকে যায়। যেন খুব কঠিন কোন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে তাকে। চাঁদনীর ঠিক নাক বরাবর ওপরে রয়েছে বিশাল বড় একটি থালার মত চাঁদ। তবে এই চাঁদটা যেন অদ্ভুত রকম দেখতে। এটা পৃথিবীতে থাকা সাধারণ কোনো চাঁদের মত নয়। বরং র-ক্তের মত লাল রঙের চাঁদ।

চাঁদনী শত চেষ্টা করেও যেন গলা দিয়ে একটি শব্দ বের করতে পারছে না। যেন বোবা হয়ে গিয়েছে সে। শুধু দু চোখ দিয়ে অঝোর-ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। সে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করল। দেখল ডান পাস থেকে শ্রাবণ এগিয়ে আসছে। তার মুখে বিশ্রী হাসি। আশেপাশের প্রতিটা ভ্যাম্পায়ার তার দিকেই তাকিয়ে আছে ভয়ংকর দৃষ্টিতে। সে এবার চোখ বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহর নাম নিল। তার বাবা এবং দাদির কাছে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিল। সে বুঝতে পেরে গেছে সে বিশাল বড় একটি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। আর এই ষড়যন্ত্র কোন মানুষ করেনি। বরং একজন ভয়ংকর ভ্যাম্পায়ার পিচাশ করেছে। যার নাম শ্রাবণ। যে তাকে ভালবাসার ফাঁদে ফেলে এতো বড় ধোঁ-কা দিতে সক্ষম হয়েছে। চাঁদনী মনে মনে ঠিক করে নেয় সে মা-রা যাবে। এমন জীবন তার দরকার নেই। সব সময় এত আত-ঙ্ক তার ভালো লাগে না। সে চোখ বন্ধ করে বলি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

তখনই বুকের ঠিক মাঝখানে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয় তার। সে না চাওয়া সত্যেও চোখ মেলে তাকায়। দেখে তার নাক বরাবর থাকা র-ক্তা-ক্ত চাঁদের মতো দেখতে জিনিসটা থেকে, আগুনের মত দেখতে কিছু একটা বেরিয়ে তার ঠিক বুকের মাঝখানে লাগছে। আর সেটা যেন ক্রমশই তার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। চাঁদনী এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। চিৎকার করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে। ওর চিৎকারে সকল ভ্যাম্পায়ার এর মুখে ফুটে ওঠে নরখাদক ময় হাসি। এখানেই শেষ হয় #ভয়ংকর_সে এর গল্প কাহিনি।

🔥🔥🔥🔥সমাপ্ত🔥🔥🔥🔥