মজিলো_প্রেম_সখার_সনে পর্ব-০৪

0
213

#মজিলো_প্রেম_সখার_সনে _ ০৪

খান বাড়িতে নীরব পরিবেশ। কারো মুখে কোনো কথা নাই। নতুন কেউ এই বাড়িতে আসলে অবাক হয়ে বলবে, বাড়ির কেউ মারা গেছে নাকি? ফিহা বাড়িটার বাইরের পরিবেশ দেখে যতটা খুশি হয়েছিলো ভিতরে ঢুকেই ততটাও স্তব্ধ। কারণ কারো মুখে কোনো কথা নাই। সবার চোখে পানি। শয্যাশয়ী রোগী পিটপিট চোখে দেখতেছে। ফিহা খানিকটা অবাক হয়ে তার বাবা ফুয়াদ খানকে জিজ্ঞেস করে বাবা আমরা এখানে আসলাম কেনো?

ফুয়াদ সাহেব হাতের দুই তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে বলে, ফিহা এইটা তোমার দাদুর বাড়ি। তোমার দাদু খুবই অসুস্থ আমরা তাকে দেখতে এসেছি। ইনি হলো তোমার দাদু ফাহমিদুল খান। পাশে বসা থাকা ইনি হলো হলো তোমার দাদি জাদেজা খান। আমরা তাদের দেখতে এসেছি।

ফিহার বেশ খানিকটা অবাক লাগলো বাবার কথায়। এতদিন জানতো তার আপন বলতে কেউ নাই বাংলাদেশে। তাহলে আজকে এসব কথার মানে কি? এগুলোর রহস্য কি? ভরা সমাজে তো আর বাবাকে বলতে পারবেনা তাই নিশ্চুপ রয়ে গেলো। ভাবলো বাড়িতে ফিরলে বাবার কাছ থেকে সব জানবে। চোখজোড়া বাবার কাছ সরাতেই চোখ পড়ে শাফখাতের দিকে? শাফখাত ও চুপচাপ দাড়িয়ে রয়েছে।

ফিহার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার কেউ নাই। আম্মাকে দেখলো সবার জন্য চা করে নিয়ে আসছে। ফিহা তো আর শকড খায় । ফিহা মনে মনে বলে আমার আম্মা যদি এই বাড়ির অতিথি হতো তাহলে নিশ্চয়ই কিচেন যেয়ে চা করতো না । ফাতেমা ওইখানে বসে থাকা প্রত্যকের হাতে চা সার্ভ করলো।

এমন সময় ফাহিম খান মানে এলাকার এমপি বলে উঠলো ডিলনাসিন, পারিজাত তোমরা রুমে চলে যাও। তোমরা ছোট মানুষ বড়দের কথাবার্তায় তোমাদের থাকতে নেই। এই লিভিং রুমে শুধু বড়রা থাকবে।

এমপির কাঠ কাঠ কথা শুনে ডিলনাসিন, পারিজাত দ্রুত লিভিং রুম ত্যাগ করে উপরে চলে যায়।

ফাহিম খান ফাতেমার তৈরি করা চায়ের কাপে চুমুক দেয়। এরপরে ফিহাকে বলে তুমি দাড়িয়ে আছো কেনো? তোমার বড় আম্মুর পাশে বসো।

ফাহিম খানের এই কথা শুনে মনে মনে বলে এইখানে তো দুজন মহিলাকে দেখছি। কে আমার বড় আম্মু। দ্বিধাদন্ধে ভূগতে থাকতে ফিহা। তখন মায়া খান ফিহাকে ডাক দেয় এইখানে বসো ফিহা। সমস্যা নাই আমরা তোমার আপন লোক। ফিহা কিচ্ছুটি না বলে মায়া খানের পাশে বসে।

বিছানা থেকে ফাহমিদুল খানকে টেনে তুলে সিয়াম খান। ফাহমিদুল খান বিছানা থেকে উঠে বলে, ফুয়াদ এইভাবে দাড়িয়ে থাকবি আমার কাছে বসবি না। বাবার নরম গলা শুনে ফুয়াদ দৌড়ে যেয়ে বাবার কাছে বসে। কেমন আছিস ফুয়াদ? জ্বি বাবা ভালো। এতোটা অভিমান জমেছে তোর? আমিতো তোর বাবা। বাবা হয়ে নাহয় সেই সময়ে দুইটা কথা বলেছিলাম। সেই অভিমান ভাঙ্গতে ২২ টা বছর কাঁটালি একা নীরবে। একটিবারো আমার কাছে এসে বললি না বাবা আমাকে ক্ষমা করো। আমাদের মেনে নাও এতো জেদ তোর?

ফুয়াদ খান কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে রইলো। সেইসময় জাদেজা খান বললো ফাহমিদুল ও তোমার ছেলে। জেদটা তো তোমার কাছ থেকে পাওয়া। তুমি ওকে তেজ্যপুত্র করেছিলে, কোনমুখে তোমার কাছে এসে বলবে বাবা আমাদের ক্ষমা করো। কোনো মুখ রেখেছিলে। তোমার একটি কথা আমার ছোট ছেলেকে ২২ বছর দূরে রাখছে। আমি চাইনা শেষ বয়সে ছেলে অন্য জায়গায় যাক। আমরা আজ আছি কাল নেই। শেষ বয়সটা নাতি, নাতনি, ছেলেদের একসঙ্গে থাকতে চাই।

দেখো জাদেজা ওইটা কি আমার মনের কথা ছিলো? রাগে ক্ষোভে বলেছিলাম। কেনো বলেছিলাম তার পিছনের কারণ নিশ্চয়ই জানা আছে। তোমার ছেলে কি তখন মেনে নেওয়ার মতো কাজ করেছে?

ফুয়াদ খান এই কথা শোনার পর মুখ খোলে। বাবা তুমি শয্যাশায়ী এমন কিছু বলোনা যারজন্য আবার তোমাকে ঘৃনা করি।

ফুয়াদের এই কথা শোনামাত্রই রেগে যায় ফাহিম। চোখ জোড়া বড় বড় করে বলে ফুয়াদ এতো কিসের তাড়াহুড়ো তোর? আজ তোর রাগের কারণে ফিহা আমাদের থেকে দূরে যেয়ে মানুষ হয়েছে। তোকে সবসময় বলি ভাই একটু শান্ত হও। কিন্তু তুইতো সবসময় জোড়ে আর জেদে কথা বলিস? তোর নাহয় বাবা, মা, ভাই, ভাতিজা _ ভাতিজি লাগেনা। কিন্তু আমাদের তো লাগে? আমরা চাইনা আমাদের রক্ত অন্য জায়গায় ইতিমের মতো থাকুক।

ফাহমিদুল হাত দিয়ে ইশারা করে ফাহিমকে চুপ থাকতে বলতে। ফাহিম খান চুপ করে যায়। ফাহমিদুল ফুয়াদকে বলে, বাবা আজ থেকে তোকে এই বাড়িতে থাকতে হবে। আমি বউমাকে মেনে নিলাম। তোর কোনো আপত্তি আছে?

এই কথা শোনামাত্রই ফাতেমা দ্রুত যেয়ে ফাহমিদুল কে সালাম করে। ফাহমিদুল খান হাত দুটি ধরে বলে ফাতেমা আমাকে ক্ষমা করো? ছি! ছি! বাবা এসব আপনি কি বলছেন? আপনি আমার বাবা। বাবারা কি সন্তানের কাছে ক্ষমা চায়? আমারতো পাপ লাগবে। আমিতো এই সুযোগের জন্যই ছিলাম একদিন আপনি আমাকে ছেলে বউয়ের স্বীকৃতি দিবেন। স্বীকৃতি যেহেতু দিয়েছেন, এবার কিন্তু আমি অন্য কোথাও যাবোনা । আমায় আর আমার মেয়েকে এই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

বউয়ের এমন কথায় ফুয়াদ হকচকিয়ে যায়। এরপরে বলে বউ তুমি এসব কি বলছো? তোমার মনে নাই পাকিস্তান থেকে তোমাকে নিয়ে আসার পর কত অপবাদ দিয়েছিলো আমার বাবা। সবকিছু নিমিষে ভূলে গেলে। তোমাকে রাজাকারের বংশ বলেছিলো? এরপরেও তুমি কোন মুখে এই বাড়িতে থাকতে চাইছো? তোমার মান সম্মান কোথায়?

ওগো স্বামী তুমি আমাকে শশুড় বাড়ি থেকে আলাদা করোনা। আমি তোমার এই কথা রাখতে পারবো না। কয়েকবছর আগে বাবা যেই কাজ করেছে তুমি এইরকম কিছু করিয়ো না। এখন সবার সঙ্গে থেকে একাকীত্ব ভূলতে চাই। বাবা মায়ের সেবা করতে চাই।

ফুয়াদ খান মূহর্তেই চোখ নিচু করে ফেলে। জাদেজা খান ফাহমিদুল কে বলে দেখো আমাদের ছেলে পাকিস্তান থেকে খাঁটি হিরে এনেছিলো। কিন্তু আমরা তাকে চিনতে কত সময় লাগালাম। তার পৈতৃক ভূলের কারণে তাকে দোষারোপ করে দূরে ঢেললাম। একবারো ভেবে দেখলাম না সে ভরসা করেই বাংলাদেশে বিয়ে করে এসেছিলো। সবকিছু হয়েছে তোমার জেদের কারণে। ফাতেমা যেয়ে তার শাশুড়িকে সালাম করে করে। জাদেজা বুকে টেনে নেয় ফাতেমাকে।

ফিহা বুঝতে পারলো এইটা তার দাদার বাড়ি। কিন্তু এইটা বুঝতে পারলো না তার দাদা কেনো তার বাবা মায়ের বিয়ে মেনে নেয় নাই। বাবা বোধহয় সেই ক্ষোভ থেকে আমাকে বলেছিলো আমাদের কেউ নাই। ফিহার আজকে খুশিতে মন গদগদ হয়ে গেলো। কতবড় পরিবার থাকতেও তার একা থাকতো এক জায়গায়। কিছুক্ষণ পর ধলাবিলাই এর দিকে নজর যায়। মনে মনে বলে এই ধলাবিলাই টা আমার ভাই ছি! এখন যদি সে বলে দেয় আমি তাকে চুমু দিয়েছি। তাহলে আমার কি হবে?

ফিহাকে সবাই চুপ থাকতে দেখে জাদেজা ডাক দেয়। ফিহা দাদির কাছে যায়। একরাশ অভিমান নিয়ে বলে, তুই কি জানতিস না আমরা তোর আত্মীয়। একবারো আসিস নাই কেনো? তুই যদি একবার আমাদের কাছে এসে বলতি দাদি তোমরা কেমন আছো? তখনি তো আমাদের রাগ কমে যেতো। তুইয়ো পারলি না বাবার মতো ব্যর্থ হলি।

ফিহা দাদির এই কথা শুনে মনে মনে বলে আমি কি জানতাম তোমরা বেঁচে আছে। তোমার ছেলে আর ছেলের বউতো বলেছিলো বাংলাদেশে আপন বলতে কেউ নাই। কিন্তু এখনতো তোমাদের এই কথা বলে মন খারাপ করতে পারিনা। অতএব চুপচাপ থাকা ভালো।

এরপরে ফিহাকে ফাহমিদুল ডাক দেয়। ফিহা দাদুর কাছে যেয়ে বসে। এরপরে ফাহমিদুল বলে আমি জানি বাবা_ মা কখনো তোমাকে বলে নাই আমাদের কথা। যদি বলতো তুমি আসতে আমি সব জানি ফিহা। দাদুকে ক্ষমা করিয়ো। ফিহা দাদুর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে কোনো ক্ষমা করবো না আমি। আমি জানতে চাই কেনো তুমি এতদিন ছেলের বউকে মেনে নাও নি? যদি কারণ না বলো তাহলে ক্ষমা করবো না।

ফিহার কথায় ফাহমিদুল চোখ বন্ধ করে ফেলে মায়া খান ফিহাকে ডাক দিয়ে বলে বড় হইছিস না। কোথায় কি বলতে হয় তাও জানিস না। এসব কথা বলার জন্য তোর দুইটা বড় আম্মু আছে। যদি কখনো জানার আগ্রহ থাকে আমার কাছে আসিস। কথাগুলো ফিহার কানে কানে বলে মায়া।

ফাহিম খান এসে বলে সবাইতো আমাকে চিনে ফিহা। নিশ্চয়ই তুমিয়ো চিনো? নামতো শুনেছো আমি তোমার বড়আব্বু। তোমার ফিরোজ ভাইয়ের বাবা, আর এ তোমার বড়আম্মু মায়া খান। এইটা হলো তোমার ছোটআব্বু সিয়াম খান। আর ওনি হলো জেবা খান তোমার ছোটআম্মু। আর শাফখাত হলো তোমার ছোটআব্বুর ছেলে। এরা দুইজন তোমার বড় ভাই। তোমার দুইটা বোন রয়েছে মায়া ওদের নিয়ে আসো পরিচয় করিয়ে দিই। মায়া ডিলনাসিন, পারিজাতকে লিভিং রুমে নিয়ে আসে। ফাহিম খান তাদের কাছে ডেকে বলে। এ হলো তোমাদের ফুয়াদ চাচ্চুর মেয়ে ফিহা খান। তোমাদের বড়আপু। কখনো যাতে শুনিনা বড়আপুকে অসম্মান করছো? ঠিক আছে। ডিলনাসিন, পারিজাত মাথা দিয়ে হ্যা সূচক সম্মতি দেয়।

মায়া, জেবা ফুয়াদের রুমটা পরিষ্কার আছে? জ্বি আছে। আচ্ছা তোমরা ফুয়াদ আর ফাতেমাকে রুমে দিয়ে আসো। ডিলনাসিন ফিহা আপুকে তোমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাও।

ডিলনাসিন ফিহার হাত ধরে বলে আজ থেকে আমরা তিনজন। ভাইয়ারা দুজন দেখি আমাদের এবার থেকে হারায় কে? চলে আপু ছাঁদে যাবো।

চলবে,,

®️রিয়া জান্নাত।