#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ২০
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
সাঈফ অতি মনোযোগের সহিত হাতের কড় গুনছে।এক হাতে সে তার একপেশে লম্বা চুল ধরে রেখেছে।হ্যাঁ,ঠিকই ধরেছে সে!গুনে গুনে ৪৯ ঘন্টা ৩৪ মিনিট পার হয়েছে।অর্থাৎ দুইদিনেরও বেশি সময় ধরে সে ঘরে বন্দি!ধ্যাত,কি একটা জঘন্য অবস্থা।বিয়ের লায়েক হয়ে গেছে সে,এখন কি বড় বোনের এমন শাসন মেনে নেওয়া যায়?হসপিটাল থেকে আসার পর এক সেকেন্ডের জন্য নামিরা তাকে একা ছাড়ে নি।ইভেন ঘুমিয়ে গেলেও বারবার তার রুমে এসে চেক করেছে।সাঈফের প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসছে।যে করেই হোক এই মূহুর্তে তাকে বেরুতে হবে।কিন্তু কি করে?দারোয়ানকে আগেই বলা হয়েছে,তাকে যাতে কোনোভাবে গেইট ক্রস করতে না দেওয়া হয়।সে বেচারা চাকরি খোয়ানোর রিক্স নিবে না।সাঈফ দাঁত দিয়ে নখ কাটলো।দরজার বাহিরে উঁকি দিলো।ওই তো মনু মিয়া।এদিকেই আসছেন।হেলেদুলে হাঁটছেন,অতিশয় ভুঁড়ি নিয়ে।মাঝে মাঝে লম্বা দাঁড়িতে হাত বুলাচ্ছেন।কাছে আসতেই সাঈফ তার কাঁধ আঁকড়ে ধরে রুমের ভেতর টেনে আনলো।মনু মিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে মেঝেতে বসে পড়লো।করুণ স্বরে বলতে লাগলো,
—“চাচা বুকে বড় ব্যাথা,আপনি আমাকে বাহিরে বের হতে সাহায্য করেন।”
মনু মিয়া হতবাক।সাঈফের কথা বুঝতে তার কিছুটা সময় লাগলো।যখন বুঝতে পারলো স্যারের ছেলে অসুস্থ! মূহুর্তে তার পেট কামড়ে উঠলো।জুলফি বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো।হাসফাস গলায় বলেন,
—“কি হইছে আব্বাজান?গ্যাসের সমস্যা?বড়ি খাইবেন।সকালে ঠিকঠাক বাথরুম হইছিলো নি?আপনি খাড়ান,আমি সবাইরে ডাইকা নিয়া আহি।”
সাঈফ বিরক্ত হলো। অধৈর্য গলায় জবাব দিলো।
—“না না,চাচা। কাউকে ডাকা লাগবে না।এ ব্যথা যে
প্রেমের ব্যথা, চাচা।এ ব্যথা আপনি ছাড়া কেউ বুঝবে না।দুদিন ধরে যে তাকে দেখি না।”
মনু মিয়া এতোক্ষণে আসল কাহিনি ধরতে পারলেন।কিছুটা আমতাআমতা করে বললেন,
—“ম্যাডাম আর বড় আম্মাজানের কানে গেলে,আমারে তারা আস্ত রাখবো না।”
সাঈফ আহত গলায় করে বলল,
—” আমার জন্য এতোটুকুও করতে পারবেন না?চাচা?”
মনু মিয়ায় বরাবরই নরম মন!দ্বিধাগ্রস্ত মনে
রাজি হয়ে গেলেন।আজ যে করেই হোক দারোয়ানকে ম্যানেজ করবেন,দরকার হলে যুদ্ধ করবেন।সাঈফকে বাহিরে বের করেই ছাড়বেন।
—————–
–“বিয়ে হতে না হতে মেয়েটা কেমন পর হয়ে গেছে।২ দিন হয়ে গেলো কোন খবর নেই।জামাই তো ঠিকিই নিয়ম করে ফোন দিয়েছে!”
নাদিরা বেগম গাল ফুলিয়ে বলে উঠলেন।তাইজুল ইসলাম মনোযোগ দিয়ে ফাইলপত্র ঘাঁটছেন। স্ত্রীর কথায় তেমন পরোয়া করলেন না।নিজ কাজে তিনি মত্ত।নাদিরা বেগম পুনরায় বললেন,
—“আমিও কোনো খবর নিবো না,দেখি কতো দিন আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে। ”
—“তোমার সাথে কথা না বললে,আমার মেয়ের তেমন কোনো ক্ষতি হবে।বরং তুমি আর তোমার মা মিলে সবসময় মানসিকভাবে যে একটা চাপ দিয়েছো সেটা থেকে সাময়িকের জন্য মেয়েটা বেঁচে যাবে।”
তাইজুল ইসলামের গম্ভীর গলায় বলা প্রতিটি শব্দ নাদিরা বেগমের কানে বেশ কর্কশ ঠেকলো।মূহুর্তেই
তার চোখজোড়া নোনতা পানিতে ছলছল করে উঠলো।তিনি স্তম্ভিত।মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না!ফ্যালেফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইলেন কর্মরত স্বামীর দিকে।স্ত্রীর এরূপ নির্লিপ্ততায় তাইজুল ইসলামের মনে কিছুটা খারাপ লাগা তৈরি হলো।নিজের ওপর কিছুটা রাগ হলো তার।হাতের ফাইল বিছানার ওপরে ছুঁড়ে ফেললেন।পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নামিরা বেগমের সামনাসামনি বসলেন।চামড়া কুঁচকানো পেলব হাত নিজের খসখসে হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন।মিনতির স্বরে বললেন,
–“আজ সত্যি সত্যি,একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে নাদিরা?”
নাদিরা বেগম অশ্রুসজল চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন।বুকের মাঝে তার অস্থিরতা।
–“সায়ানের মৃত্যুর জন্য সামিরাকে তুমি দোষী মনে করতে না?সেজন্যই ছোট থেকেই মেয়েটাকে অবহেলায় রেখেছিলে না?”
–“আপনি কি বলতে চাইছেন,আমি কি মা হিসেবে কোনো দায়িত্ব পালন করি নি?সামু এভাবেই বড় হয়ে গেছে।”
নামিরা বেগম এতোক্ষণে মুখ খুললেন।তার কন্ঠে আহাজারি!হয়ত বেদনা কিংবা অনুশোচনা।
—“আমি আমার উত্তর পাই নি।”
তাইজুল ইসলাম চোয়াল শক্ত করে কাট কাট গলায় বললেন। হাতের বন্ধন কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছে।নাদিরা বেগম আহত চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন।চাইনিতে কিছু একটা ছিলো।তাইজুল ইসলাম হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।রুম ত্যাগ করার পূর্বে বললেন,
—“মা হিসেবে তুমি আর্দশ।কিন্তু সেটা সাঈফ আর নামিরার বেলায়।সামিরার বেলায় সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছ ঠিকিই কিন্তু সেটা অনেকটা দায়সারাভাবে!মেয়ের ভেতরটা কখনো স্পর্শ করতে পারো নি।”
তাইজুল ইসলাম বেরিয়ে যেতেই নাদিরা বেগম ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। এক হাতে বুকের বা’পাশ খামচে ধরলেন।জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন।দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়!এতো বছরের সংসারে এই প্রথম তার স্বামী আঙুল তুলে তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছেন।যে ভুল শুধরানোর কোনো উপায় নেই।সব কষ্ট ভাগীদার তাকেই কেন হতে হবে?বিয়ের আগে মেয়েদের এক ধরনের জটিলতা।বিয়ের পর অন্য ধরনের।দুই পরিবারের মন রক্ষার জন্য নিজের অনুভূতিকে পাথরতুল্য করতে হয়।একদিকে মা,অন্যদিকে তার নিজের মেয়ে।তিনি নিজেও জানেন,ভুলটা তার।ভেবেছিলেন স্বামীর এতোদিকে খেয়াল নেই।হয়ত পার পেয়ে যাবেন।কিন্তু অপরাধ করে কেউ কখনো পার পেয়েছে?তিন সন্তানের মাঝে একজনকে বাঁকা চোখে দেখা তো,অপরাধেরই সামিল!তিনি শুধু দায়িত্ব পালন করেছেন,ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে পারেন নি।মায়ের কথাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মেয়েকে তিনি কতোই না অযত্নে রেখেছিলেন!অথচ মেয়েটা এককালে তার নেওটা ছিলো।একসময় নিজেরটা বুঝতে পেরে,অনুভূতি আড়াল করে,একা একাই বড় হয়ে গেল।নাদিরা বেগম কয়েকবছর আগের কথা মনে করে ডুকরে উঠলেন।চোখ বুঝে পড়ে রইলেন বিছানায়।
————
পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় নীলচে জ্বলজ্বলে সাগরের তরঙ্গমালারা আজ বাঁধনহারা।এ কেমন এক অনন্য রূপবৈচিত্র্য?উর্মিমালার সুমধুর মূর্ছনা প্রাণবন্ত করে তুলে দেহের প্রতিটি অঙ্গ।অব্যক্ত আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় ধমনী জুড়ে।ফ্লোটি স্টাইল বোহেমিয়ান ড্রেসটি এক হাতে সামলিয়ে চোখ বুজে গোড়ালি অবদি পানি দাঁড়িয়ে আছে সামিরা।দূর থেকে দেখলে মনে হবে হয়তকোনো প্রকৃতি কন্যা উত্তাল হওয়ার ছন্দ গুণছে।অথচ কন্যার চোখে ভাসছে দুদিন আগের সেই মায়াবী রাত!কানে বাজছে গাম্ভীর্য ঘেরা কিছু সুরম্য বাণী।
—“পৃথিবীতে আমরা কেউ নিখুঁত নই,মিরা।নো ওয়ান!কম-বেশি সবাই জীবনে ভুল করেছি।করছিও!এ সব ভুলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে অতীত আঁকড়ে ধরে জীবনে এগিয়ে যাওয়া।দা এক্সিডেন্ট দ্যাট হ্যাপেন্ড,ওয়াজ ডিসাইডেড বাই দা সুপিরিয়র।ইউ আর ইনোসেন্ট,মাই লেডি।পিউর লাইক এ ফ্লাওয়ার।সো বি পটেনশিয়াল,এন্ড মেইক মি ইউর পটেনশিয়ালটি।আ’ম অলওয়েজ উইথ ইউ।”
আবির তার বলিষ্ঠ হাতজোড়া এগিয়ে দিয়েছিলো তার দিকে।চিরকালের জন্য আঁকড়ে ধরার আহ্বান জানিয়েছিলো।সামিরা নিজেও সেই আহ্বান সাড়া দিয়েছিল।সে রাতটা সেই দ্বীপেই কাটিয়ে দিয়েছিলো তারা।এরপর দেখতে দেখতে সুখস্বপ্নের ন্যায় কেটে গেছে দুটো দিন।উন্মোচন করেছে মানুষটার ভিতরে লুকিয়ে থাকা,চঞ্চলমনা এক অন্য পুরুষকে।যে পুরুষের পৌরুষ্য হলো ভিন্ন।চাওয়া-পাওয়া বাহিরে!উদ্দেশ্যে তার সহধর্মিণীকে খুশির জোয়ারের ভাসিয়ে দেওয়া।সামিরা নিজেও জানে না,এই দুদিন সে কতোটা আনন্দে বাহিত করেছে।আবির সকল অদ্ভুত কর্ম কান্ডে মিনিটে মিনিটে হেঁসেছে।সমস্ত জড়তা কাটিয়ে,সাবলীলভাবে মিশেছে মানুষটার সাথে।এইতো বিকালে বাহিরে যাওয়া আগে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো,
—-“কোথায় হারিয়ে যেও না প্লিজ।”
তারপর খানিকটা থেমে বলল,
–“আসলে হয়েছে কি,পানিতে প্যারট ফিশ গুলো দেখেছো না?আমারও ইচ্ছে এদের মতো একগাদা বাচ্চা নেওয়া।তারপর তোমাকে নিয়ে আমাদের ফিউচার বেবিদের সাথে জলকেলি খেলা।”
আবিরের কথাশুনে সামিরা মিটমিট করে হাসছিলো।তারপর নিজেই বলল,
—“ব্যস!মাত্র এতোটুকু ইচ্ছে?’
—“না আরো আছে।গভীর সমুদ্রের যেয়ে মৎস্য মানব, মৎস্য মানবীদের সংসার দেখা।তারপর নেপাল যেয়ে নেপালী কলা খাওয়া।এ ইচ্ছে আমার বহুদিনের!তুমি হারিয়ে গেলে কি করে হবে বলো?তখন ভবঘুরের ন্যায় মাক্স আর ফিন লাগিয়ে আমার সমুদ্র ঘুরে বেড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।”
আবিরের এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে সামিরা অট্টহাসিতে মেতে উঠেছিলো।হাসির দমকে সে আর কিছুই বলতে পারে নি।আবির তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সেই মূহুর্তে বেরিয়ে গিয়েছিল।সামিরার বুঝে আসে না,ঘুরতে এসেও একটা মানুষের এতো কি কাজ?ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন তো আছেই।বলতে শোনা যায়।”ওকে,স্যার।ইয়েস স্যার।ফাইন।ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি।”
সেই বিকেলে বেরিয়েছে মানুষটা রাত বারোটা বাজতে চলেছে,অথচ কোনো খবর নেই।একবার ফোনও করলো না।হঠাৎ সামিরার মন ভার হয়ে গেল।চোখ মেলে নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় নিস্তব্ধ রইল।দরজা ধাক্কানোর শব্দে হুঁশে আসলো সে।ঠোঁটের কোণায় হাল্কা হাসির রেশ ধরা দিলো।কোনোরকম তড়িঘড়ি করলো না।ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলো।চুলগুলো হাতের সাহায্যে কিছুটা পরিপাটি করে নিলো।নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো।দরজা খুলতেই,মুখের হাসি মিইয়ে গেল।শার্টের বোতাম খোলা,চুলের অবস্থা বেহাল।ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে।কপালের রগ ভেসে আছে।চোখে ক্লান্তি।হাতের কনুই বেয়ে রক্ত ঝরছে।সামিরা হতবিহ্বল!বিধস্ত মানুষটাকে দেখে তার অন্তর কেঁপে উঠলো।হৃৎপিন্ডের গতিবেগ বেড়ে গেল।গলা শুকিয়ে চৌচির।সে অস্ফুট শব্দে চিৎকার করে উঠলো।
–“কি হয়েছে আপনার?এমন দেখাচ্ছে কেন?হাত কাটলো কি করে?রক্ত বেরুচ্ছে যে?”
আবির কোনো উত্তর দিলো না।তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতর ঢুকলো।সামিরার দিকে তাকালোও না।গায়ের শার্ট খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো।উদাম শরীর নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।সামিরা দরজা লাগিয়ে ছুটে এলো।আবিরের নিশ্চুপতা তাকে পোড়াচ্ছে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হলো,কিছু বলছেন না কেন?দেখুন,আবির আমার কিন্তু এবার চিন্তা হচ্ছে।কোথায় লেগেছে,আমাকে দেখতে দিন।”
সামিরা তার হাত এগিয়ে দিলো।আবির তার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।দু’হাতে মাথার চুল চেপে ধরে একবার পায়চারি করলো।অতঃপর মাথা নাড়িয়ে ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলল,
—“তোমাকে এখানে আনা আমার উচিত হয় নি।একদম ঠিক হয় নি।”
সামিরা আবিরের আচরণে প্রথমে কষ্ট পেলেও এবার ঘাবড়ে গেল।এগিয়ে এসে দু’হাতে আবিরের গাল আঁকড়ে ধরলো।অনুরোধের স্বরে বলল,
—“বলুন না, কি হয়েছে?এমন করছেন কেন?আমার যে ভীষণ অস্থির লাগছে।”
—“আমি ঠিক আছি।প্লিজ!আমাকে কিছু সময় একা থাকতে দেও।”
আবির শান্ত গলায় স্বাভাবিকভাবে বলল।সামিরাকে সরিয়ে রেস্টরুমে প্রবেশ করলো।যেন এক প্রকার পালিয়ে গেল!তিন তিনবার রিজেকশনে অপরদিকের মানুষটার কেমন লাগলো একবারও ভাবলো না।এদিকে কষ্টার্জিত সামিরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।তার মনের ভেতর ঝড় চলছে।নয়ন জোড়ায় শুষ্কতা!সেখানে জলের ছিটেফোঁটাও নেই।সেই শুষ্কতা ভেতরের দুর্ভিক্ষকে বিশ্লেষিত করছে।সে সন্তপর্ণে বিছানা ঘেঁষে জমিনে বসে পড়লো।
চলবে
#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ২১
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
চিন্তন ঊর্ধ্বে জীবন।অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ সবটাই যে স্পষ্টত।এই তিনটি সোপানের সংমিশ্রণেই মানুষের জীবনযাত্রা !সামনের মানুষের মার্জিত ও ভালোবাসাময় ব্যবহার আপনার জীবনের ধাপগুলোকে বিশেষত প্রভাবিত করে!বিপরীতের মানুষটার আচরণে কখনো আমরা খুশি হয়,তো কখনো দুঃখ পাই;বা রাগান্বিত হই!আর ক্রোধের বশীভূত হয়ে সবচেয়ে লেম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি।স্বীয় ক্ষতি হবে জেনেও দ্বিধাবোধ করি না!সামিরার এই মূহুর্তে খুব ইচ্ছে করে আবিরকে একটা চরম শিক্ষা দিতে।দু’দিনের জন্য একদম উধাও হয়ে যেতে পারলে,খুব শান্তি হতো তার!কোনো অপরিত্যক্ত দ্বীপ খুঁজে সেখানে না হয় থাকলো।কিন্তু সে তো স্বার্থপরের কাতারে নয়!ভেতরকার যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য দুটো পরিবাকে সে আর যাইহোক,হয়রান করতে পারে না।সে হারিয়ে গেলে সবচেয়ে কষ্ট পাবে তার বাবা।এরপর একে একে সবাই!বাবার সিদ্ধান্তে সে তার নতুন জীবনের পথে অগ্রসর হয়েছে।পেছনে ফিরবে কি করে?সামিরা কল্পনা করলো সে লুকিয়ে রয়েছে।ঘুটঘুটে আধারে ঘেরা রাত।আবির তার চিন্তায় অস্থির!খাওয়া, নাওয়া,ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজছে।উদোম শরীরে মিরা!মিরা! বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।গা থেকে তার অঝোরে ঘাম ঝরছে।পরিবারের মানুষের কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে ফোন ভেঙে ফেলেছে।তাকে না পেয়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো।জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।আবার হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে লাগলো।একসময় খুঁজে পেল।প্রশস্ত বক্ষে চেপে ধরলো তাকে।আবিরের নিঃশ্বাসের তোড়ে তার ভীষণ ওম লাগলো।আচমকা সামিরা হুঁশে আসলো।অনুভব করলো তার শরীরে,বিশেষ করে পেট আলাদা উত্তাপে ছেয়ে গেছে।সে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে ছিলো।ফট করে নিচে তাকাল।আবির তার উরুতে মাথা রেখে,পেটে মুখ গুঁজে দিয়েছে।সাওয়ার নেওয়ায় সমস্ত দেহ শীতল। ঠান্ডা শক্ত হাত জোড়া তার মেদহীন কোমরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।এরূপ
গভীর পরশে সামিরার মাথা থেকে পা অবদি সমস্ত দেহ শিরশিরে উঠল।পশম দাঁড়িয়ে গেল।সে
এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল।ধীরে ধীরে
আবিরের মাথায় হাত রাখলো,উদ্দেশ্য সরিয়ে দেওয়া।সামিরার ছোঁয়া পেতে আবির বিরবির করে বলে উঠলো,
—-“এভাবে থাকতে দেও না!ভীষণ শান্তি লাগছে।পারলে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেও।”
কতো সহজ আবদার!সামিরা তাচ্ছিল্য হাসলো।
তার ভেতর দগ্ধ হচ্ছে,হোক!আবির শান্তিই তো আসল।তার নিয়তিতে হয়ত সকলের অবহেলা লেখা ছিলো।সামিরা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলল,
—-“পারবো না।আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।”
—“হোক।আমি এভাবেই থাকবো।”
—“না।আপনাকে উঠতে হবে।”
—“উফফ! বড্ড কথা বলো তুমি।”
হঠাৎ আবির জামার উপর দিয়ে সামিরা পেটে চুমু খেলো।থরথরিয়ে কেঁপে উঠল সামিরা।এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ছোয়ায় তার হাঁটু কাঁপতে লাগলো।
—“আর একটাও কথা বললে,স্পর্শ আরো গাঢ় হবে।”
হিমশীতল গলায় থ্রেট দিলো আবির।একগুঁয়েমি কাছ হেরে গেল সামিরা।স্বাভাবিক হতেই,মানুষটার সিল্কি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।খেয়াল করলো চুল ভেজা।বিছানার কোণায় তোয়ালে পড়ে আছে।সামিহা বিছানা ঘেঁষে মেঝে বসে ছিলো।হাত বাড়িয়ে তোয়ালে নিয়ে নিলো।আস্তে আস্তে আবিরের চুলের গোড়া গোড়া মুছতে লাগলো।খানিক বাদে আবির আবার বলল,,
—“তুমি একদম তুলোর মতো,মিরা।আমার তুলোনি।”
এমন অদ্ভুত নাম শুনে সামিরা কপাল কুঁচকালো।অন্য সময় হলে হয়ত তার হাঁসি পেত।কিন্তু সিচুয়েশন এখন ভিন্ন!সামিরাকে চুপ থাকতে দেখে আবির চট করে উঠে পড়লো।দুই পা ভাজ করে সামিরার মুখোমুখি বসলো।গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সামিরা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সে চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে।আবিরের রোমশ বুকে বিন্দু বিন্দু পানি আঁটকে আছে।সেখানে সামিরার চোখ আটকালো।আচমকাই তার তৃষ্ণা বেড়ে গেল। মানুষটা যেমন সুদর্শন,তেমনি নির্লজ্জ! কেবল শর্টস পরে তার সামনে বসে আছে।সামিরার
ফর্সা গাল সেকেন্ডে লাল হয়ে গেল।মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হলেও,সে নজর ঘুরাতে পারলো না।তার নজর গেঁথে রইলো আবিরের বলিষ্ঠ বুকপটে।তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে আবির মুচকি হাসলো।সামিরার একটা হাত নিয়ে তার বুকের মাঝে চেপে ধরলো।শীতল দেহ।
সামিরা সাথে সাথে চোখ বুঝে নিলো।অনুভব করলো আবিরের অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন। আচমকা আবিরের হেঁচকা টানে সে তার বুকে মুখ থুবড়ে পড়লো।নাকে ব্যথা পেলেও কোনো শব্দ করলো না।কেবল চোখ বুজে পড়ে রইলো।আবির তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে বলল,
—“খুব বাজে ভাবে ফেঁসেছি আমি।কিন্তু তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।তুমি ছাড়া আমি যে নিঃশেষ।দরকার হলে সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ আমি নিবো।তোমাকে না হয় দূরে….”
আবিরের মনে হলো কেউ তার গলা চেপে ধরেছে।সে থেমে গেল।আর কোনো শব্দই তার মুখ থেকে বেরুলো না। সামিরা আবছা আবছা আবিরের সব কথাই শুনছিলো।আবিরের থেমে যাওয়ায় অস্থির হয়ে উঠলো সে।বুক থেকে মাথা তুলে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো।তার ফোন আসায় কথা অপূর্ণ রয়ে গেল। আবিরকে ছেড়ে ফোন হাতে নিলো।সেলিনা খাতুন কল দিয়েছেন।ফোন রিসিভ করতে মোখলেস মিয়ার কন্ঠ শোনা গেল।তিনি খুশিতে গদগদ।
—“কেমন আছো,মা!”
—“জি ভালো আছি,বাবা!আপনার কি খবর?”
সামিরা হাসি মুখে উত্তর দিলো।মোখলেস মিয়া আফসোস মাখা কন্ঠে জবাব দিলেন,
—“আমার আর খবর!বুড়ো হয়ছি তো,সবার কাছে চক্ষুশূল আমি।কেউ ভালো করে কথা বলে না রে মা!”
—“কেন বাবা,কি হয়েছে?”
—“আজ দুপুরে তোমার শাশুড়ী বাজার থেকে স্টেরিলাইজড ছুরি আনিয়েছে।জিজ্ঞেস করলাম,এটা দিয়ে কি করবে।জবাব দিলো,এটা দিয়ে নাকি আমার যেকোনো একটা হাত কেটে ফেলবে।তারপর আমিও তার মতো হাত কাটা হয়ে যাবো।এরপর দুজনে মিলে নাকি বিজয় সরণী সিগন্যালে বসে ভিক্ষা করবো।”
সামিরা হতবাক। শশুরের কথার বিপরীতে কি উত্তর দিবে বুঝে পেল না।ফোন স্পিকারে ছিলো।সে আবিরের দিকে তাকাল।মানুষটার মুখে মৃদু হাসি।পুরোপুরি ভ্রুক্ষেপহীন!সামিহা আমতা আমতা করে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো।এর মাঝে সেলিনা খাতুনের গলার আওয়াজ শোনা গেল।
—-“উফফ,থামো তো।ছেলের মেয়ের খবর না নিয়ে,কখন থেকে আজাইরা পেচাল পারছো।ফোনটা আমার কাছে দেও!
—“আমার কথা শেষ হয় নি।”
—-“বহুত বলেছো!এখন টেবিলে যেয়ে বসো,আদিবা আছে। খাবার বেড়ে দিবে।খেয়ে নেও।
যাও!”
মোখলেস মিয়া ফোন কানে নিয়ে কাচুমাচু গলায় সামিরার উদ্দেশ্যে বললেন,
—“যাই মা।তোমার শাশুড়ী আবার কোন সময় খাওয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ঠিক নেই।
সাবধানে থেকো,ভালো থেকো।”
—“ঠিক আছে,বাবা।আপনিও ভালো থাকবেন।নিজের যত্ন নিবেন।”
শশুর যেতেই সামিরা শাশুড়ির সাথে কথা বলতে লাগলো।দুইজনের মাপা মাপা কথা!সবটাই আবিরের কানে যাচ্ছে।দুজনের কথোপকথনে
মনে হচ্ছে শিক্ষিকা তার ছাত্রীকে প্রশ্ন করছে, ভীতসন্ত্রস্ত ছাত্রী উত্তর দিচ্ছে।সে নিঃশব্দে হাসলো।
এটা বুঝতে পারলো খুব শীঘ্রই তার মা মিরার মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবো।আবির সামিরার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো।খোলা দরজা দিয়ে উড়নচন্ডী বাতাস ঘরে ঢুকছে।ঠান্ডা হাওয়া বারেবারে সামিরার মুখ ছুঁইয়ে দিচ্ছে। সে বার বার চোখ বুঝে নিছে।খানিকবাদে তিরতির করে চোখ খুলছে।ঠোঁটে হাল্কা হাসির ছোঁয়া।আবিরের বুকে কাঁপন ধরে গেল।এতো এতো স্নিগ্ধতা!সারাদিনের ধকল নিমিষেই মিইয়ে গেল।ভুলে গেল আগমনী বিপদের কথা!সামিরার নিষ্পাপতায় সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেল।সে আলতো ভাবে সামিরার চোখে তার শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া বুলিয়ে দিলো।ফোন তখনও সামিরার কানে,সেলিনা খাতুনের পরবর্তী কথা তার কানে গেল না। কেবল ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইল আবিরের দিকে।মানুষটার আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে।একেক বারের ভিন্ন ভিন্ন আচরণ!সে বুঝতে পারলো,কোনো একটা অশান্তিতে আছে আবির।তার থেকে লুকিয়ে যাচ্ছে।আসল সমস্যা কোথায় জানতে হবে তাকে।হঠাৎ চিৎকারের শব্দে সামিরার ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো।
—-“ও ভাবী,ভাবী গো?কথা বলেন না কেনে?শাউড়ীর লগে তো ভালাই কথা কইলেন।আমি ফোন নিসি বইলা কথা কইবেন না?”
—-“হে বল,চমকি।আমি শুনছি।তোমার সব কথাই শুনবো।”
—-“যাওয়ার সময় আমনের লগে ঠিক মতো কথা কইলাম না।যাক গা,আপনে আইলে একসাথে বইসা গপ্প করবো।এখন আমার জন্য আপনার একখান কাম করা লাইগবে।”
—-“কি কাজ?”
ফোনের অপরপাশ থেকে সামিহা জিজ্ঞেস করলো।
—“আমার জন্য ভালা দেইখা একখান লিবিস্টিক আনবেন।ল্যাংন্টা কালারের মইধ্যে।”
সামিরা ভীষণভাবে চমকালো।এমন কোনো কালারের কথা সে আগে কখনো শুনে নি।সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো।
—“কি কালার?”
চমকি কিছু বলার আগে আদিবা ফোন কেঁড়ে নিলো।তারপর হাঁসতে হাঁসতে বলল,
—“ন্যুড কালার,ভাবী।চমকির ভাষ্যমতে ল্যাংন্টা কালার।”
এবার সামিরাও হেঁসে দিলো।
—“ওকে নিয়ে আসবো।”
টুকটাক কথা বলে ফোন রাখতেই দেখলো আবির ঘুমিয়ে পড়েছে।বন্ধ চোখে সারাদিনের ধকলের ছাপ!সামিরা দরজা জানালা বন্ধ করে এসি অন করলো। রিসোর্টের রিসিপশনে কল করে ফাস্ট এইড কিট আনালো।বিছানার পাশে বসে আলতোভাবে কাটা জায়গায় হাত বুলালো।কনুই থেকে নিচের দিকে বেশ গভীরভাবেই কেটেছে। সামিরার খুব মায়া হলো!সে অতি যত্নে আবিরের হাতে মেডিসিন লাগিয়ে দিলো।কাজ শেষ হতেই আবির বুকে মাথা রেখে শুইয়ে পড়লো।এদিকে ঘুমন্ত আবির অভ্যাস বশত সামিরা নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।
———
—“হ্যালো!কোথায় তুই?
—” এইতো আপা, আছি।”
—“তুই আছিস,এটা আমিও জানি। কিন্তু কোথায়?”
নামিরার গম্ভীর গলার স্বর। সাঈফ আমতাআমতা করে বলল,
—“স্টুডিওতে। ”
—“ভালো।কিন্তু খবরদার!মিরপুরের দিকে যাবি না।”
—“কি যে বলিস না আপা!ওখানে কেন যাবো?জ্বরের ঘোরে একদিন ভুল হয়ে গিয়েছিলো বলে কি, বারবার একই ভুল করবো নাকি।”
—“এতোকিছু জানতে চাই না।তুই এই মূহুর্তে বাসায় এসে ব্রেকফাস্ট করবি।”
—কিন্তু,আপা।
চলবে
#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ২২
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
সাঈফ এক নাগাড়ে এটা ওটা বলছে।রাতুলকে পিসিতে কিছু একটা দেখাচ্ছে।আজকে তার মনটা বেশ চনমনে!গতকাল বাসা থেকে বের হয়ে সরাসরি স্টুডিওতে চলে এসেছে।আসার পর পর বিক্ষিপ্ত মনটা শান্তিতে ভরে গেছে।শরীরও এখন পুরোপুরি ঠিক।রাত জেগে নতুন একটা গান লিখেছে!এই প্রথম সাঈফ নিজে গান কম্পোজ করেছে।গানের নাম “মলিন মায়াবতী” কন্ঠ,আবেগ,উচ্ছ্বাসের সাথে সবটা ঢেলে দিয়েছে।খুব শীঘ্রই তাদের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করবে।প্রেমে পড়ার পর তার বেশ উপকার হয়েছে বলা চলে।কিন্তু সমস্যা হলো গানের টেম্পো তার ভীষণ স্লো মনে হচ্ছে।সেই সাথে রাতুলের ব্যবহার করা সাউণ্ড কোয়ালিটি তার মনে ধরে নি!এদিকে রাতুলের কোনো খেয়াল নেই।আনমনে কি যেন ভাবছে!আচমকাই প্রশ্ন করলো।
—“আদিবার কাছে থাকলে কেমন লাগে?আর দূরে গেলে কেমন অনুভব হয়?”
সাঈফ সেকেন্ড খানেক থমকালো।রাতুলের প্রশ্নকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গানের বিট রিডিউস করায় মন দিলো।সাঈফের নিরুত্তরতা রাতুলের ওপর কোনো প্রভাব ফেললো না।সে পুনরায় বলল,
—“দোস্ত!কালকে ভার্সিটিতে একটা মেয়ে ডেট অফার দিয়েছে।কিন্তু আমার মধ্যে কোনো ইন্টারেস্ট কাজ করছে না।”
—“করবে কি করে?তুই তো গে।”
সাঈফ টিটকারির সহিত বলে উঠলো। গম্ভীর মুখে
তীর্যক হাসির রেশ।রাতুল কিঞ্চিত বিরক্ত হলো।পরক্ষণে মিচকে হাসলো।সাঈফের কাছাকাছি এসে চোখ মেরে বলল,
—“চল! তাহলে তোকে আজ খুশি করে দেই।”
—“মাদার**র্ড!সর সামনে থেকে।আমি কি তোর মতো নাকি!”
বন্ধুকে ভড়কাতে পেরে রাতুল বেজায় খুশি। সে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।সাঈফ তার কাঁধে হাত রেখে ঠান্ডা গলায় বলল,
—“একবার চাইল্ডহুড পিরিয়ডে স্কুল ব্রেকের পর বাসায় এসে দেখি,মা,বড়পা,আপা কেউ নেই।সাথে সাথে কলিজা কামড়ে ধরে ছিলো।নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না!চোখ থেকে অঝোরে নৈশব্দ জল পড়ছিলো।নিজের জন্য নয়!চিন্তা হচ্ছিলো তাদের জন্য!কোনো বিপদে পড়েছে কি না সেই চিন্তা!আদিবার থেকে দূরে থাকলে আমার ঠিক একই চিন্তা হয়।”
রাতুলের হাসি থেমে গেছে।বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।সাঈফ এবার মৃদু হাঁসলো।
—“জানিস!সেদিন আমাকে বার্থডে সারপ্রাইজ দিতে সবাই লুকিয়ে ছিলো।আচানাক যখন সামনে এলো।আমার মনে হয়েছিলো,এই তো আমার দুনিয়া!পেয়ে গেছি সবকিছু।আর কিছু চাই না।আদিবাকে চোখের সামনে পেলে আমি ঠিক সেই আগের অনুভূতিতে ভেসে যাই।বেশ প্রখর অনুভব আমার।”
রাতুল ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।কি বলবে বুঝতে পারলো না।সেদিন সাঈফের প্রেমটা ধরতে না পারলেও,আজকে ভালোবাসার গভীরতা সে অনুভব করেছে।সাঈফকে জড়িয়ে ধরলে কাঁধে চাপড় মারলো। ফিসফিস করে বললো,
—“স্বাগত বন্ধু!খুবই জলদি তোমার বিনাশ হচ্ছে।”
সাঈফ শুনলেও প্রতি উত্তর করলো না।
——–
মালদ্বীপের সবচেয়ে উপভোগ্য বস্তু হচ্ছে স্নোকেলিং আর সার্ফিং।এর মধ্যে স্নোকেলিং হলো রঙিন মাছের দুনিয়া ঘুরার সবচেয়ে মনোরম পন্থা!মালদ্বীপে আসা প্রতিটি কাপলই স্নোকেলিং এর আনন্দ উপভোগ করে থাকে।জায়গাটা মাঝ সমুদ্রের স্বাভাবিক থেকে কিছুটা গভীরে। অন্তরের সবটা উচ্ছ্বাস নিয়ে,একে অপরের হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে একজোড়া কপোত-কপোতী।মৎস্য রাজ্যে রূপবৈচিত্র্যে তারা মন্ত্রমুগ্ধ।তাদের পায়ে ফিন,মুখে মাক্স।সামনে ওয়েল ট্রেইনড ইনসট্রাক্টর!আঙ্গুলের ইশারায় নির্দেশনা দিচ্ছেন। তরঙ্গের তালে তালে ভেসে যাচ্ছে উভয়ে।মিনিট বিশেক পর উঠে এলো তারা।দেহ-মন যেন নতুন করে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে!চেহারা জুড়ে পরিতৃপ্তি স্পষ্ট।
—-“কেমন লেগেছে?”
—“সত্যি বলতে,লাইফের সবচেয়ে আনন্দদায়ক এডভেঞ্চার ছিলো।প্রথমে নার্ভাস লাগছিল।কিন্তু
আপনি হাত ধরার সাথে সাথে, সেটা পুরোপুরি কেটে গেছে।”
—“আর একবার ট্রাই করবে?”
—“কাল করি,না হয়!আজ ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
—-“এজ ইউর উইশ,ম্যাম।”
আবির মাথা নাড়িয়ে কুর্নিশ করলো।সামিরা হাসলো।সকাল সকাল আবির তাকে এতো সুন্দর সারপ্রাইজ দিবে, সে কল্পনাতে আনে নি!আড়চোখে আবিরকে দেখলো।ভেজা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কাপড় আঁটকে,মাংসবহুল পেশী ফুটে উঠেছে।স্নোকেলিং শেষে,সে আবার কিছু সনয় সুইমিং করেছে।সামিরা অহেতুক লজ্জা পেল।মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।
তীরের কাছাকাছি আসতে দেখলো পর্যটকরা যার যার মতো এনজয় করছে।কেউ কেউ দ্বীপের ভেজা বালিতে গড়াগড়ি করছে,কেউ আবার রৌদ্রস্নাতে ব্যস্ত।কয়েকজন বাচ্চা মিলে আপন মনে স্যান্ড ক্যাসেল বানাচ্ছে। সামিরা চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারপাশ দেখছে।আবির দেখছে সামিরার উচ্ছ্বাসিত নতুন রূপকে!এতো এতো রূপের, আলাদা আলাদা আর্কষণই যে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।সে এখন ছাড়া পেতে চায় না।এভাবেই সামিরার পাশে পাশে থাকতে চায়!
সবকিছু দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে সামিহার চোখ থমকালো।কোনো কিছু না ভেবে পায়ের একটা জুতা খুলে হাতে নিয়ে,সে এক ছুটে সেদিকে চলে গেল।আবির কিছুটা অবাক হলো।কাহিনি বোঝার জন্য সেও সামিরার পিছু পিছু গেলো।দেখলো হ্যাংলা মতো একটা ছেলেকে,সামিরা তার হাতের জুতো দিয়ে এলোমেলো ভাবে আঘাত করছে।আর চিৎকার করে বলছে,
—“ইউ বাস্টার্ড!মায়ের রোগের দোহাই দিয়ে,তুই এখানে বসে ফুর্তি করছিস?আমার সাথে চিট করেছিস ভালো কথা, আমার বাবাকেও ধোঁকা দিলি?টুডে আ’ম গনা কিল ইউ।”
আচমকা ছেলেটা ক্ষেপে গেল।নিজেকে প্রোটেক্ট করতে সমস্ত শক্তি দিয়ে সামিরাকে ধাক্কা মারলো।মোক্ষম সময়ে আবির তাকে আগলে নিলো।পর পরই তার কপালের রগ ফুলে উঠলো।দ্বিতীয় কিছু না ভেবে বাম হাত মুঠ করে নিলো।সামনের ফুঁসতে থাকা ছেলেটার কলার চেপে ধরে,নাক বরাবর এক ঘুষি বসিয়ে দিলো।একটাতে ক্ষান্ত হলো না।বরং গুনে গুনে তিনটা ঘুষি দিলো।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—“ওয়ান ফর হার্টিং,মাই লেডি।টুই ফর টাচিং হার!! এন্ড থ্রি ফর ক্রায়িং হার।”
সামনের ছেলেটা ততোক্ষণে বেহুঁশ।বালিতে পড়ে আছে।নাক থেকে তার গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে।সামিরা আবিরের হাত আলতোভাবে চেপে ধরলো।জ্বল জ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল চেতনাহীন মাহিদের দিকে।তার মায়া হলো না বরং ভেতরটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
———-
দ্বিপ্রহরের জ্বলজ্বলে রোদ্দুরে মস্তিষ্কের এলোমেলো অবস্থা।হাসিব ভার্সিটিতে থাকায় রাতুলকে গানের বিট আর ট্র্যাক বুঝিয়ে দিয়ে সাঈফ বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।গাড়ি কথা বেমালুম ভুলে গেছে সে!কিছু দূর হেঁটে লোকাল বাসে চড়ে বসলো।
প্রায় আধঘন্টা পর লক্ষ্য করলো,সে মিরপুর-১ এ সনি সিনেমা হলের সামনেে দাঁড়িয়ে আছে।যেন এতো সময় ঘোরে আটকে ছিলো!তাৎক্ষণাৎ কপাল চাপড়ালো!শূন্যে লাথি মারলো।কিছু সময় ফুটপাতে পায়চারি করলো। আশেপাশের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কোমড়ে হাত রেখে চোখ বুঝে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।চোখ খুলতে না খুলতে চমকে উঠলো।আদিবা দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক তার মুখোমুখি!অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে।যেন কোনো এলিয়েন দেখছে।সাঈফ নিজের গালে আলতোভাবে চড় মারলো।বিড়বিড় করে বলল,
–“হ্যালুসিনেশন!সব স্বপ্ন।”
–“আপনি দিন-দুপুরে স্বপ্ন দেখলেও,এই আমি সত্যি।”
সাঈফের বড় করে তাকাল।কালো চুড়িদার সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা তরুণীর,সুরম্য কন্ঠ বেজে উঠতেই তার হৃদয় ধকধক করতে লাগলো।এর মানে আদিবা সত্যি!সে শিউর হতে আদিবার গাল টেনে দিল।হ্যাঁ!রক্ত মাংসে গড়া আস্ত মানুষটাই তার সামনে।সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“তুমি এখানে?”
—“জামার ভেতরের ইনার-অয়ার কিনতে এসেছিলাম।চয়েস করতে পারি নি, তাই বাসায় চলে যাচ্ছি।”
জড়তাহীন সোজাসাপটা উত্তর!সাঈফের কান সাথে সাথে রক্তিম হয়ে উঠলো।তামাটে বর্ণে ততোটা ফুটে না উঠলেও,আদিবা বুঝতে পারলো। তাকে আর একটু বাজাতে সে বলল,
—“ওমা!লজ্জা পাচ্ছেন কেন?আপনাকে তো আর চয়েস করতে বলি নি?”
সাঈফ শুকনো বিষম খেলো।আদিবা সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে,তার দিকে এগিয়ে দিলো।বোতল হাতে নিলেও সাঈফ পানি খেলো।স্বাভাবিক হতেই বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল,
—“আমি এদিকে একটা ইমপোর্টেন্ট কাজে এসেছিলাম।”
—“জানতে চাই নি তো!”
আদিবা কড়া জবাব।সাঈফের মনে হলো তার গালে কেউ সপাটে চড় মেরেছে।সে এই মূহুর্তে চুপচাপ থাকাই শ্রেয় মনে করলো।হঠাৎ আদিবা তার বাহু আঁকড়ে ধরলো।
—“চলুন,আমার সাথে।”
হতভম্ব সাঈফ প্রশ্ন করার সুযোগ পেলো না।আদিবা ততোক্ষণে রিকশা ডেকে উঠে পড়েছে।সাঈফ প্রথমে কিছুটা ইতস্ততবোধ করলেও,আদিবার কটমটে চাহনির সামনে হার মেনে উঠে বসলো।রিকশা চলতে শুরু করলে সে প্রশ্ন করলো,
—“কোথায় যাচ্ছি,আমরা?”
—“পার্সেল আনতে।”
—“কার পার্সেল?”
সাঈফ হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। আদিবা এবার সমস্ত শক্তি দিয়ে সাঈফের বাহু শক্ত চেপে ধরলো।বড় বড় নখগুলো গেঁথে দিলো।ব্যথায় সাঈফের মুখ কুঁচকে গেল। মুখ থেকে শব্দ বেরুলো না।
—“কার আবার?অবশ্যই আপনার।ভাবি মালদ্বীপ থেকে পার্সেল পাঠিয়েছে।জানেন কি আছে ওতে?”
সাঈফ না সূচক মাথা নাড়ালো।সে জানে না।
—“আপনার জন্য বউ পাঠিয়েছে।আবার একটা না!দুটো বউ।সেদিন এয়ারপোর্টে যেভাবে কাকুতি মিনতি করলেন।আমার ভীষণ মায়া হলো।পরে ফোন দিয়ে ভাবির কাছে, আপনার নামে সুপারিশ করলাম।ব্যস!আজকেই আপনার বউ পার্সেল হাজির।”
আদিবার রাগান্বিত গলার আওয়াজ।সাঈফ কিছু বলার সাহস পেল না।মলিন মুখে বসে রইলো।কতোদিন আগের সেই কথাটাও আদিবা মনে রেখেছে।সে তো মজা করে বলেছিলো।সবার মন ভালো করা ছিলো,তার উদ্দেশ্য!আদিবা আবার তাকে ভুল বুঝলো।সাঈফের মনে মনে বেশ রাগ হলো্।এর মধ্যে এসআরকে এর মতো পার্ট নিতে, চুলগুলো আজ সে ঝুঁটি করে এসেছে।মনটা শান্ত করতে না হয় কয়টা,টেনে কয়টা ছিঁড়ে পারতো।
চলবে।