মধু পিঁপড়া পর্ব-১৮+১৯

0
90

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৮
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
আত্মার শক্তিশালী বন্ধন হলো বন্ধুত্ব।বন্ধু কখনোই তার বন্ধুকে ছেড়ে যায় না। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে সব সময়ই ছায়ার মতো পাশে থাকে।হাসিব আর রাতুলের জীবনের সেই ছায়া হলো সাঈফ।কলেজ লাইফ থেকে তারা একসাথে।নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ায় প্রায় সময় মাসের শেষ দিকে তাদের হাতে টাকা থাকতো না।কখনো একবেলা খেয়ে সারাদিন পার করতে হতো।মেসে অতিবাহিত দিনগুলো ছিলো দুঃসহনীয় কষ্টের!!কেবল মাত্র সাঈফের বদৌলতে,আজকে তারা দু’বন্ধু একটা স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে।অথচ সাঈফ ভেতরে ভেতর অভাবনীয় কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে তারা টেরই পায় নি!মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানালো।ইসপিটাল থেকে সাঈফের সাথে সরাসরি তারা বাসায় এসেছে।সারা রাস্তায় তেমন কোনো কথা হয় নি।এ মূহুর্তে ঢুকতে গিয়েও ভীষণ ইতস্তত বোধ করছে তারা।এর মধ্যে কক্ষের ভেতর থেকে সাঈফের রুগ্ন কন্ঠ ভেসে আসলো।

—‘ভিতরে আয়।বাহিরে কি করছিস?গিটার বাজানো ছেড়ে কি দারোয়ান হওয়ার ইচ্ছে জেগেছে?”

রাতুল চট করে ভিতরে ঢুকে পড়লো।ধুপধাপ শব্দ করে হেঁটে সাঈফের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো।সাইফ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো।রাতুল তার বাহুতে সজোরে আঘাত করলো।অতপর রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল,

—“সালা,মাদারবো**।দেবদাস সেজেছিস!মরে যাবি একটা মেয়ের জন্য? আমরা তোর কিছুই হই না তাই তো?”

রাতুল পুনরায় আঘাত করতে যাবে তার পূর্বেই হাসিব পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো।টেনেটুনে সোফায় বসিয়ে দিলো।কর্ণার টেবিল থেকে পানি নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলো।নিজেও সেখানে বসে পড়লো।
অতঃপর সাঈফের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,

—“মেয়েটাকে লাগবে তাই তো?বললেই হতো!!তুলে নিয়ে আসতাম।”

সাঈফ মলিন হাসলো।সেই হাসির রেশ ধরে বলে উঠলো,

–“মেয়েটাকে না হয় তুলে আনলি,কিন্তু তার মনের মাঝে কি আমার জায়গা করে দিতে পারবি?”

–“আহা!আমরা থাকতে তুই এতো কেন ভাবছিস?”

হাসিব বিরক্ত হলো।রাগ পড়তেই রাতুল বলল,

—-“জায়গার সাথে সাথে বাড়িও তুলে দিবো না হয়… এক কাজ কর কালকে তুলে এনে বিয়ে করে নে।সরাসরি বাসরে ঢুকে যা,দেখবি পরদিন সব ঠিক।আর মেয়ের পরিবারকে না হয় নামিরা আপা সামলিয়ে নিবো।”

রাতুলের কথার বিপরীতে সাঈফ হামি তুলতে তুলতে কিছু বলতেই নিচ্ছিলো,আচমকা নামিরা হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে প্রবেশ করলো।টি-টেবিলে ট্রে রাখতে রাখতে নরমাল গলায় বলল,

–“তোরা আসলেই গাধা।প্রেম আর পায়খানা কখনো জোর করে হয় না।”

নামিরার কথার শুনে হাসিব রাতুল একে অপরের দিকে তাকাল।তার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।নামিরার সামনে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলো।অন্যদিকে সাঈফ মিটমিট করে হাসছে।
নামিরা দুইকাপ কফি তাদের দিকে হাতে ধরিয়ে দিলো। অতঃপর নিজের জন্য আনা গ্রীন-টি হাতে নিয়ে বিপরীত পাশের সোফায় বসে পড়লো।
রাতুল হাসিবকে নিশ্চিুপ থাকতে দেখে বলে উঠলো,

—“শোন,অল্প বসয়ী মেয়েদের মন অনেক সেনসিটিভ হয়।আদিবার মতো মেয়েরা পরিবার ও প্রেম দুটো নিয়ে বেশ দ্বিধায় ভুগে।হয়ত,জোরজবরদস্তি করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।আমি চাই না আমার ভাই কোনো মেয়ের ওপর নিজের ভালোবাসাটা চাপিয়ে দিক।বরং আমি বলবো নিজের চেষ্টায় ও একাগ্রতা দিয়ে মেয়েটার মন অর্জন করে নিতে।”

নামিরার কথায় রাতুল আর হাসিবের মনে কোনো পজিটিভ প্রভাব ফেলেছে কি না বোঝা গেল না।কিন্তু
সাঈফ বেশ খুশি হলো।সে তার বোনের দিকে কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে তাকালো।নামিরা তোয়াক্কা করলো না।সে নিজের মতো কাপে ঠোঁট ভেজালো।তাদের সম্পূর্ণ বিকাল কেটে গেলো প্রেমালোচনার মধ্য দিয়ে।

————

সামিরা চোখ-মুখ খিঁচে রেখেছে।বেশ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে।সাথে অবসন্নও!পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নারীদের অনেক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়।তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছুই ঘটে নি।সারা সকাল ভালোই ছিলো,সমস্যা হলো আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্টে প্রবেশের পর পর!বেশ অস্বস্তি অনুভব হচ্ছিলো তার।খাওয়ার সময়ই ওয়াশরুমে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলো সে।তবুও ঠাঁই বসেছিলো।বাপ,ভাইয়ের সামনে এসব নিয়ে যতোটুকুই কমফোর্টেবল।আবিরের সামনে ঠিক ততোটাই আনকমফোর্টেবল!আবির টেবিল ছাড়তেই সে যেন স্পেস পেল! তাই তাড়াহুড়ো করে মোবাইল ফেলেই ওয়াশরুমে ছুটে গিয়েছিলো।হ্যান্ড ব্যাগে ব্যাকআপ থাকায় তেমন সমস্যা নয় নি।ভেবেছিলো আবির আসার আগেই সে ফিরে আসবে।কিন্তু সবটা গুছিয়ে নিতে বেশ সময় চলে গিয়েছিলো।আবিরের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সে সবটাই বুঝতে পেরেছিলো।মানুষটা তাকে যখন জড়িয়ে ধরেছিলো তার ভীষণ ভালো লাগছিলো।ঝিমঝিমে ভাবটা নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু সমস্যা হলো তাকে ধমক দেওয়ায়।আচমকাই তার মেজাজ বিগড়ে গেল।আর অজান্তেই উল্টোপাল্টা কথা শুনিয়ে দিলো।সামিরা এখন মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত। কিন্তু সরি শব্দটা মুখ থেকে বের হচ্ছে না!!এ কেমন বিগ্নতা?যেন গলা কেউ চেপে ধরে রেখেছে।
মাসের এই বিশেষ সময়টা মেয়েদের জন্য ভয়াবহ পীড়াদায়ক।পিরিয়ডের সময় যন্ত্রণা, মুড সুইং, খিদে না পাওয়া মোটামুটি সব মেয়েরাই এ ধরনের সমস্যা ফেস করে থাকে।ছোট ছোট ব্যাপারেই হঠাৎ রেগে যাওয়া, স্বাভাবিক একটা ব্যাপার মেনে নিতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া মুড সুইংয়ের অন্যতম একটি লক্ষণ।সেই সাথে পেটের চিনচিনে ব্যাথা!সবটা মিলিয়ে সামিরা এখন রোবটের ন্যায় শক্ত পায়ে হাঁটছে।নতুন জায়গার নতুনত্ব তাকে আজ আর আর্কষিত করছে না।
নীল পানির দেশ খ্যাত মালদ্বীপ!পানির নিচের সাদা চিকচিকে বালির রাজ্য।মালদ্বীপের মূল আকর্ষণ হলো এর সরল, শান্ত ও মনোরম পরিবেশ, আদিম সমুদ্র সৈকত ও ক্রান্তীয় প্রবাল প্রাচীর।ছোট ছোট দ্বীপগুলো যেন নানান রঙের মাছের অ্যাকুরিয়াম। পর্যটনদের জন্য অপার বিস্ময়!জলরাশির দিগন্তজোড়া সমুদ্রবক্ষ, সমুদ্র গর্জন, বায়ুপ্রবাহ যেন তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন করে। পর্যটকদের অশান্ত মনকে শান্ত করে। হতাশা দূর করে উচ্ছলতা ফিরিয়ে দেয় আর মুগ্ধতায় ভাসিয়ে দেয় মনপ্রাণ।এই নীল-সাদার মাঝে চির-হরিৎ বৃক্ষের সমাহারে আবৃত সুলতান পার্ক।মালে ইসলামিক সেন্টারের বিপরীতে অবস্থিত মালদ্বীপের একটি বিখ্যাত পাবলিক পার্ক।যা রসরানি বাগিচা নামেও পরিচিত।সুন্দর সবুজ… ….এই কমপ্যাক্ট পার্কে বৃহৎ ছায়াযুক্ত গাছের পাশাপাশি লনের একপাশ ঘেঁষে কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে।এখানে একটি ঝর্ণা রয়েছে যা জায়গাটিকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। এছাড়া রয়েছে রাউন্ড শেপের সাদা রঙের কিছু সুইং!!

হ্রদের পানিতে ছোট ছোট রঙিন প্রজাতির মাছের অবাধ বিচরণ।সামিরা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে।তার ক্লান্ত চোখজোড়ায় অদ্ভুত বিষন্নতা!তার থেকে কয়েক কদম পিছনে আবির।সে এতোসময় নির্লিপ্ত থাকলেও,শেষমেশ বেহায়া মনকে সামলাতে পারলো না।কাছে এসে সামিরার পাশাপাশি দাঁড়ালো!!বার বার আঁড়চোখে দেখতে লাগলো।তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সামিরার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছিলো।আচমকা কি হয়েছে মেয়েটির? তার আচরণে কি খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে?অবশ্য ভুল তো তারই,অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার আগে সে একজন নারী।নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে তাকে অপমান করা।আবির তার মিরাকে এবং তার অনুভূতিকে অসম্মান করেছে। চিন্তায় তার ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে।
সে কি একবার জিজ্ঞেস করবে?কথা বলছে না কেন?
মিরার এই নিশ্চুপতা যে তাকে মারাত্মক আঘাত করছে।পর মূহুর্তে ভাবলো কি দরকার অযাচিত কর্তৃত্ব ফলানোর।আগের মতোই অপমান সূচক বাক্য কর্ণগোচর হবে!!কিন্তু এই বিষাদমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা যে বারবার মুঁচড়ে উঠছে।পার্কের শান্ত পরিবেশের মাঝে
নিবরতা ভেঙে সামিরা প্রথম কথা বলে উঠলো।তার কম্পিত গলার স্বর,

—“আমি খুব খারাপ তাই না?সবাইকে কষ্ট দেই।এরপর সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়।প্রথমে মামা,এরপর মাহিদ।কিছুদিন পর আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন তাই না?”

আবির বিহ্বল নয়নে সামিরার মুখ পানে তাকিয়ে রইল।সে কিছুই বুঝতে পারলো।লক্ষ্য করল সামিরার চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনতা পানি গড়িয়ে পড়ছে।আবিরের হৃদপিন্ডের বেগ যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল।সে ঘামতে লাগলো।ভেতরতে বেশ অস্থির বোধ করলো।চারপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষ যে যার যার মতো ঘুরছে।তাদের দিকে কারোই তেমন নজর নেই।সামিরার দৃষ্টি তখনও পরিষ্কার পানিতে নিবদ্ধ।সে কম্পমান গলায় বলল,

—তখন আমার মাত্র পাঁচ বছর।আমার…..

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৯ (প্রথমাংশ)
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

—“তখন আমার মাত্র পাঁচ বছর।সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন আমার একমাত্র মামা,সায়ান রেদোয়ান।তিনি সে-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট ছিলেন।পড়াশোনার খাতিরে নানীকে সাথে নিয়ে আমাদের সাথেই থাকেন।মা-বাবা আর আপার পর তিনিই ছিলেন আমার সব থেকে কাছের।খেলার সঙ্গী।আনন্দ সঙ্গী।অলসো মাই ক্রাইম পার্টনার।”

সামিরা থামলো।এক ধ্যানে সামনে তাকিয়ে থেকে হালকা হাসলো।হয়ত শৈশবের কিছু খুনসুটিময় মূহুর্ত মনে নাড়া দিয়েছে।খানিকবাদেই তার নিষ্পাপ মুখটি চুপসে গেল। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো।পরবর্তী শব্দগুলো ভেতরে ভেতরে গুছিয়ে নিলো।এদিকে আবিরের দৃষ্টি প্রিয়তমার ভেজা চোখে নিবদ্ধ।সে নিশ্চুপ!শুধুই অবলোকন করছে।

—“আপা,সাঈফ আর আমার মধ্যে মামা আমাকেই বেশি ভালোবাসতেন।আমার সব আবদার ছিলো তাকে ঘিরেই!তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন,যার কাছে মুখ ফুটে কিছু চাওয়া হলে কখনোই অপূর্ণ রাখতেন না।বাবার আমার আবদার পূরণ না করলেও,মামা সেই আবদার অনায়াসে পূরণ করে দিতেন। সবকিছু ভালোই চলছিলো।এই সবটা ভালো মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম আমি নিজে।আমি ধীরে ধীরে জেদি হয়ে উঠলাম।এক সময় এমন হলো না শব্দটা শুনতে পারতাম না।ইচ্ছের বাহিরে কিছু হলেই সামনের মানুষটাকে আঘাত করতে বসতাম।সেই সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি ছিলো আমার জন্য দুধভাত।সেদিনটি ছিলো বিভৎসময়…”

হুট করেই সামিরা থেমে গেল।দু’হাতে চোখ মুছলো।তারপর আবিরের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলল,

—“সন্ধ্যা হতে বেশি সময় বাকি নেই।আমাদের ফিরতে হবে।”

যেন তার ঘোর কেটেছে।কথা শেষ হতেই সে নিজের মতো হাঁটা ধরলো।আবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।কিসের এতো সংকোচ?সম্পূর্ণ কথা না শোনা অবদি যে,সে শান্তি পাবে না!সামিরার মুখনিঃসৃত এই আধো বাচন আবিরের ভেতরটা যে ভয়াবহ ভাবে দগ্ধ করে তুলেছে।কথা শেষ না হওয়া অবদি সে কোথাও যেতে দিবে না।কয়েক কদম এগুতেই বাঁধা পেল সামিরা!আবির তার বা’হাতে কব্জি আলতোভাবে ধরে রেখেছে।সামিরা তার দিকে তাকানোর সাথে সাথে আবির হেঁচকা টান দিলো।আবদ্ধ করে নিলো নিজের পুরুষালি রোমশ বক্ষে!একহাতে আঁকড়ে ধরলো কটিদেশ।অপর হাত সামিরার মাথায়,যা তার বুকের মাঝে চেপে ধরা।আবির আকুতির সহিত বলল,

—“আমাকে বিশ্বাস করে সবটা উন্মোচন করো মিরা।নিজেকে তুমি এভাবে কষ্ট দিতে পারো না।!

সামিরা বুঝতে পারলো তার নিস্তার নেই।চোখ বন্ধ করতেই সেই দিনের স্মৃতি ভেসে উঠলো। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো।আচমকা সে আবিরের পিঠ খামচে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিলো।আবির থামালো না। আলতোভাবে মাথা হাত বুলিয়ে দিলো।অপরাহ্নের শেষে।মানুষ নেই বললেই চলে।তারা দুজনেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।ফোঁপানো কমতেই সামিরা বলতে লাগলো।

—-“অন্য সব দিনের মতো আমি মামার কাছে বসে ছিলাম।বাহিরের খুব ঝড় হচ্ছিল।সেই সাথে মেঘের তুমুল গর্জন। মা-বাবা,আপাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো।খেলা,হাসি,তামশা মধ্যে আমি হঠাৎ আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরলাম।মামা বললেন ঝড় থামতেই তিনি আমাকে আইসক্রিম এনে দিবেন।প্রত্যাখান শুনতে পেয়ে আমি চিৎকার শুরু করলাম।চেচামেচির মাত্রা বেড়ে গেলে এক পর্যায়ে নানী আমাকে বুঝাতে লাগলে।তখন আমি রাগে অন্ধ!কিছু না বুঝে তাকে কামড়ে দিলাম।এরপর নিজের মাথা দেয়ালে ঠুকতে লাগলাম।
আমাকে শান্ত করতে মামা সেদিন ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝে বেরিয়ে গেলেন।আধাঘন্টা না যেতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সে রাতে মামা ফিরে আসে নি।পরদিন ফিরে এলেন লাশ রূপে।বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়েছিলো।”

সামিরা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।আবিরের মনটাও খারাপ হয়ে গেল। প্রথমে কি বলবে বুঝতে পারলো না।কিছুটা ভেবে বলল,

–“জন্ম,মৃত্যু জীবনের সম্পূর্ণটাই উপরওয়ালা হাতে।এখানে তোমার কোনো দোষ নেই,সোনা।তুমি ইচ্ছে করে কিছুই করো নি।তার মৃত্যু এভাবেই লেখা ছিলো।”

সামিরা আবিরের বুকে থেকে মাথা নাড়ালো।এরপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,

–“প্রথম প্রথম সকলে একই কথা বলতো।মামার মৃত্যুর পর আমি চুপচাপ হয়ে গেলাম।ট্রমাতে ছিলাম।চিকিৎসার পর,সময়ের সাথে সাথে সবটা ভুলে গেলাম।এছাড়া বাবা-মাও আমাকে এতো বছর ভুলিয়ে রেখেছিলেন।আপা এখনো এসবের কিছুই জানে না।নানীর থেকে খারাপ ব্যবহার পেতাম কিন্তু আমার মনে না থাকায় আসল কারণ বুঝতে পারতাম না।যে দিন মালদ্বীপ চলে আসি সেদিন সকালে নানী আমাকে ডেকে নিয়ে সবটা বলেন।নিজের ছেলের মৃত্যুর জন্য আমাকেই দোষী মনে করেন।সত্যি বলতে আমার কারণেই মামা আজ আমাদের মাঝে নেই।”

সামিরা এবার বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো।আবির বুঝতে পারলো অনুতাপে সামিরার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে।সে সামিরা মুখটা দু’হাতে তুলে ধরলো। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়ার দিকে চোখ পড়তে তার মাথায় আগুন ধরে গেল।সামিরা ও নিজেকে শান্ত করতে ভয়াবহ এক পদক্ষেপ নিলো।শুষ্ক পুরু ওষ্ঠজোড়া ডুবিয়ে দিলো পেলব ঠোঁটের মাঝে।গভীর আশ্লেষে শুষে নিতে লাগবো সমস্ত কষ্ট, বেদনা!কটিদেশ কিছুটা চেপে ধরলো। অপরদিকে সামিরার কান্না থেমে গেল।ফট করে চোখ মেলে তাকাল।দেখলো আবির চোখ বুঝে রেখেছে।তার উদ্দামতা সামিরাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।আজ মহুয়ার নেশায় মাতোয়ারা এক প্রেমিক পুরুষ সে।

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৯ (শেষাংশ)
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
সূর্য অস্তমিত হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক অতিবাহিত হয়েছে।আবহাওয়া বেশ মনোরম।উত্তাল হাওয়ার বিচরণ। সমুদ্রের আবেশী গন্ধ ভেসে আসছে।সামিরা চোখ বন্ধ করে সমস্তটা নাকে টেনে নিলো।নিমেষেই ভেতরটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো।চোখ খুলে আড়চোখে আবিরের দিকে তাকাল।মানুষটা তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো তার।পরক্ষণে চোখ বুঝে নিলো!বিকালের শেষ সময়টা চোখের পাতায় কড়া নাড়লো।আবির ভেবেছিলো সামিরা হয়ত তাকে চড় মেরে বসবে।কিন্তু তাকে অবাকের মহাসমুদ্রে ডুবিয়ে মেয়েটা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো।সবটা দিয়ে উপভোগ করেছিলো তার সান্নিধ্য।সে তো এমনিতেই উন্মাদ,উপোসিত প্রাণনাথ!বহুকষ্টে নিজেকে সামলিয়েছে।বিপরীতের সামিরা নিজের কর্মকাণ্ডে নিজেই হতবাক।সে কি আবিরকে কাছে টেনে নিলো?কিন্তু কেন?আবেগ নাকি ভালোবাসা!
তার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে সে আবিরকে চায়,ভীষণভাবে চায়।যেই চাওয়ায় মাহিদের কোনো অস্তিত্ব নেই।পৃথিবীর কেউই নেই!কেবল সে আর আবির।কিন্তু আবির কি তাকে ভালোবাসে নাকি শুধুই স্বামী হিসেবে জৈবিক তাড়নায় তার কাছে আসছে।তার যে জানতে হবে!!মানুষটা তাকে ভালোবাসলে,সেও সবটা উজাড় করে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করবে।খারাপ ভালো,সব ভাবেই ভালোবাসবে।কিন্তু আবির যদি শুধুই দায়সারার জন্য তাকে কাছে টানে,সেক্ষেত্রে সে নিজেও কমার্শিয়ালী সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।আগের বারের মতো জেনেশুনে অপাত্রে ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়ার মতো ভুল করবে না।একদিকে মানুষটার যত্নশীল,সৌজন্যময়ী স্বভাব দেখলে যে অন্যকিছু মনে হয়!তাকে কতোই না চায়,বুঝি?এসব ব্যবহারের সামনে সে কেন,পৃথিবীর প্রতিটি নারী যে দূর্বল।সে তো মনে মনে এমনই একজনকে চেয়েছিলো।যার চোখে মুখে শুধু তার জন্যই মুগ্ধতা থাকবে।রইবে এক সাগরসম সম্মান,সহনীয়তা,অবসেশন।ভাধু দ্বীপে আসার সময় রাস্তা কেউ কারো সাথে কথা বলে নি।পুরোটা সময় সামিরা নিবদ্ধ ছিলো জলের গভীরতায় আর আবিরের আঁটকে ছিলো প্রেয়সীর লাবণ্যতায়।
রা এটলের সবচেয়ে বিখ্যাত স্পটগুলির মধ্যে একটি হল ভাধু দ্বীপ।এখানে সমুদ্রের নোনতা জলে হাজার হাজার তারার খেলা করে।বছরের একটা সময় বিশেষ করে গ্রীষ্মের শেষের দিকে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।সাঁঝের সময়টায় জ্বলজ্বলে নীলাভ আভা ছেয়ে যায় সায়র!”সি ওফ স্টারস”বা তারার সমুদ্র নামে জনপ্রিয় এই জায়গায় বিশেষত্ব হলো বালুকাময় তীরে যখন ঢেউ আছড়ে পড়ে অথবা খালি পায়ে ভেজা বালিতে কেউ প্রবেশ করে তখন একটি উজ্জ্বল নীল আভা দেখা দেয়। এই জাদুকরী প্রভাব মূলত বায়োলুমিনেসেন্ট রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্লাঙ্কটন দ্বারা সৃষ্ট হয় যা প্রায়শই উষ্ণ উপকূলীয় জলে উপস্থিত হয়।সবার চোখে এই সৌন্দর্য সব সময় ধরা পড়ে না।আবির সামিরার জন্য অনেকটা খুঁজে একটি স্থান পেয়েছে।যেখানে ডাইনোফ্ল্যাজেলেটগুলি উজ্জ্বল রশ্মি বিকিরণ করছে।তীরের কোলে যতোবার টেউ আছড়ে পড়ছে,ততোবার অপরূপ সৌন্দর্য্যের দেখা মিলছে। সবকিছু মিলিয়ে আজকের এই ট্রিপ সামিরার জন্য অনেক চমকপ্রদ।চারপাশটা ফাঁকা। কেবল সে আর আবির।সামিরা একান্তে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো।অনুভব করলো আবির তার পিছু পিছু হাঁটছে।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে ফিচলেমির সাথে বলে উঠলো,

—“কিডন্যাপারের মতো ফলো করা বাদ দিয়ে,সাহস থাকলে পাশাপাশি এসে হেঁটে দেখান।”

আবির তাৎক্ষণাৎ এগিয়ে এলো না।সে তীর্যক হাসলো।অতঃপর আগের মতোই বীচ লাইটের মৃদুমন্দ আলোয় সামিরার উন্মুক্ত লম্বা চুলের দুলুনি তৃপ্ত চোখে দেখতে লাগলো।সামনে থেকেও সামিরা আবিরের মাদকাময় চাহনি উপলব্ধি করতে পারলো।এক রকম জড়োসড়ো হয়েই চলতে লাগলো।হঠাৎই লক্ষ্য করলো টেউয়ের পানি যখন তার নগ্ন পদপৃষ্ঠে আঘাত করছে,ঠিক তখনই নীলাচে রঙের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে।অসাধারণ প্রতিপ্রভ এই দ্যুতি!এমনটা হওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে সে দাঁড়িয়ে রইল।
অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতিকে উপভোগ করতে থাকা সামিরার কানের কাছে আচানক পৌরুষ্য হাস্কি টোন বেজে উঠলো।

—“লেট মি এক্সপ্লেন ইউ!”

পানির দিকে ইশারা করে আবির বলে উঠলো।সামিরা আবিরের কথায় মন দিলো।

—“এখানকার জলে, ডাইনোফ্ল্যাজেলেটস নামক মাইক্রোস্কোপিক প্ল্যাঙ্কটন দ্বারা বায়োলুমিনিসেন্স হয়।ছোট ছোট জলজ উদ্ভিদ সমুদ্রের নীচে একটি প্রাণবন্ত নীল আলো বিকিরণ করে।অ্যাকচুয়েলি ইট’স এ ন্যাচারাল অ্যাক্ট।”

আবির কিছুটা চুপ থেকে পুনরায় বলল,

—“মনে হচ্ছে না যেন হাজার তারা নেমে এসেছে,সমুদ্রকে শোভিত করতে।”

সামিরা আবিরের কথায় কোনো জবাব দিলো না।সে এই মূহুর্তটাকে শুধুই উপভোগ করতে চায়।কিছুটা দূরে চোখ যেতেই সামিরার হতবাক।মুখে তার বিস্ময়।কৌতুহল দমাতে না পেরে সে আবিরকে রেখেই এক প্রকার ছুটে গেল সেদিকে।বালুকাময় তীরের পাশে ছোটাখাটো সুশোভিত টেবিল পাতানো।টেবিলের উপরে ফকফকে সাদাক্লথ বিছানো এর ওপরে ক্রিস্টাল ক্যান্ডেল হোল্ডারের সাথে আঁটকে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির সেন্ট ক্যান্ডেল।মিষ্টি ঘ্রাণের সাথে আবছায়া আলো ছড়িয়ে পড়ছে টেবিলে।দুটো ডিনার প্লেট,ট্রাফলস, চকোলেট, ক্যাভিয়ার,কডফিশ ফ্রাই এছাড়া মালদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী খাবার “রোশি” ও এক বোতল ম্যাসেটো রেড ওয়াইন দিয়ে পুরো টেবিল সাজানো।সামিরার দম বন্ধ হওয়ায় উপক্রম। সে কি স্বপ্ন দেখছে?সবকিছুই তার ড্রিম মনে হচ্ছে।ফিল্মের নায়িকারা যেমন নায়কদের থেকে সারপ্রাইজ পায়,আবির তার জন্য সবটা একইভাবে এ্যারেঞ্জ করেছে।এমন ধরনের সারপ্রাইজের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না!আবির মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও যে বেশ শৌখিন।কি করে সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের স্ত্রীকে খুশি রাখা যায় সে খুব ভালো করেই জানে।সামিরার আচমকা কান্না পেয়ে গেল,সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।আবির এগিয়ে এসে ফ্লাওয়ার দিয়ে ডেকোরেশন করা এটা চেয়ার সরিয়ে দিলো। মৃদুস্বরে বলল,

–“প্লিজ ম্যাম,টেক ইউর সিট এন্ড ব্লেসড মি।”

আবিরের কথা বলার ভঙ্গিতে সামিরা কাঁপা গলায় হেঁসে উঠলো।সে সময় ব্যয় না করে বসে পড়লো।আবিরও বিপরীত পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো।ভাধু দ্বীপে আসার আগে তারা দুজনেই নিজেদের আউটফিট চেঞ্জ করেছে। সামিরা পড়েছে নেভী ব্লু কালারের ডিপ নেক স্লিভলেস লং ইভিনিং ড্রেস।আবির তাকে এই ড্রেস গিফট করেছে। লাইট মেকওভার ও খোলা চুলে সম্মোহনী মনে হচ্ছে তাকে।আবির বরাবরের মতো ফর্মাল পরেছে।কালো রঙের শার্ট জড়িয়েছে নিজের বলিষ্ঠ কায়ায়।ওপরের বোতাম দুটি বরাবরের মতো খোলা।হাতে ঘড়ি।তার বেহায়া চোখ দুটি বারবার সামিরার খোলা মসৃণ হাতে ও উন্মুক্ত বক্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছে।গলার কিছুটা নিচে ফর্সা ত্বকের ওপরে কুচকুচে কালো তিলজোড়া তাকে বাজে ভাবে উত্ত্যক্ত করছে। সে চোখ বুঝে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লোপ্রথম কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলেও,এখন আবিরের দৃষ্টিতে সামিরার দেহের শিরা-উপশিরা কেমন শিরশিরিয়ে উঠছে।সে উপভোগ করতে লাগলো।খাওয়া শেষ হতে আবির উঠে দাড়িয়ে সামিরার দিকে তার ডান হাত এগিয়ে দিলো।ঘন গলায় বলল,

—“লেটস’ ভাইব অন এ সফট মিউজিক।”

সামিরা খানিক ইতস্ততভাবে আবিরের হাতের ওপর হাত রাখলো।আবির এক হাত মিরার কোমরে।পেলব দেহ ও কোমল হাতের সংস্পর্শে আসতে সে ঘামতে লাগলো।তার মনে হচ্ছে সে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
টেবিলের কোণায় থাকা সাউন্ড বক্সে বেজে উঠলো মৃদু সুর!সামিরা বুঝতে পারলো সবটাই আবিরের প্রি-প্ল্যান করা।তারা দুজনেই হালকা ভাবে দুলতে লাগলো।আবির সামিরাকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।নাক ডুবিয়ে দিলো কেশগুচ্ছে।আবিরের নিশ্বাসের ওম সহ্য করতে না পেরে সামিরা ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়ালো। এক হাত রাখলো আবিরের কাঁধে।লম্বায় সে আবিরের কাঁধ হতে কিছুটা নিচে হওয়ায় তেমন সমস্যা হলো না।তার চোখ আবিরের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে।মিনিট পাঁচেক যেতেই সে খানিকটা উঁচু হয়ে আবিরের কপালে চুমু খেয়ে বসলো।হুঁশে আসতেই সে আবিরকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে সমুদ্র কিনারা চলে গেল।এরপর দু’হাতে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলো।লাজে তার মাথা হেট হয়ে গেছে।কান থেমে অদৃশ্য গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে।ফর্সা গাল দুটোয় রক্তিম বর্ণ ছড়িয়ে পড়েছে।এদিকে আবির আগের কয়েক পল এক জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে,বাঁকা হাসলো।

চলবে