মনের উঠোন জুড়ে পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
366

#মনের_উঠোন_জুড়ে

#পর্ব_৩৪

#নূন_মাহবুব

-” আশ্চর্য! এসিপি স্যার এতো রাতে আমাকে কেন কল করেছেন? স্যার জানেন আজ আমার বাসর রাত , তবু ও তিনি আমার বাসর রাতে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে ঢুকে পড়লেন।অথচ আমি তাকে কল করেই যাচ্ছি কিন্তু তার কল রিসিভ করার কোনো নাম নেই বলে সাহিত্য ফোন রেখে চলে আসবে এমন সময় তার ফোনে এসিপি সাইফুজ্জামান এর নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এলো। মেসেজ টা দেখে যেন সাহিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মেসেজে টা ছিলো এরকম ” আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি সাহিত্য। জানি আজ তোমার জীবনের বিশেষ একটা রাত। অনেক ঝড় ঝাপটার পরে তোমরা এক হতে পেরেছো। আমার তোমাদের ডিস্টার্ব করা একদম উচিত হয় নি। তবু ও আমি বাধ্য হয়েছি । আমি চাইলেই কথা টা তোমাকে কল করে বলতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই না এই ব্যাপারটা উষ্ণতা মা জানুক। মেয়ে মানুষ তো খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়বে। তোমার শ্বাশুড়ি রাবিহা সবার চোখে ধুলো দিয়ে জেল থেকে পালিয়েছে। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি সে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। তোমাকে এক্ষুনি এই মুহূর্তে এয়ার পোর্টে যেতে হবে।তাকে ধরতে হবে। হ্যাঁ নিজের গাড়ি করে যেও না কিন্তু। আমি তোমার জন্য বাসের টিকিট কে’টে রেখেছি। তুমি বাসে করে চলে যাও।তবে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলো না । এমনকি উষ্ণতা মামনি কে ও না।”
-” সাহিত্য কোনো কিছু না ভেবে গায়ে একটা শার্ট জরিয়ে নিজের ওয়ালেট আর বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় শিক্ষা তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বললো, এতো রাতে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আর কার ফোন ছিলো?”

-” সাহিত্য শিক্ষার কপালে চোখে মুখে অজস্র চুমু দিয়ে বললো, কোথাও যাচ্ছি না সোনা। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে ঐ একটু বাইরে যাচ্ছি। ব্যাস পাঁচ মিনিটে ফিরে আসবো।”

-” আমি ও যাবো আপনার সাথে । চলুন।”

-” সাহিত্য আমতা আমতা করে বললো,তোর এই রাতে কোথাও যেতে হবে না। দাদু যদি জানতে পারে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। দাদু আগেকার দিনের মানুষ। তিনি সবসময় বলেন বিয়ের পর মেয়েদের রাতের বেলা কোথাও যেতে হয় না। তাহলে নতুন ব‌উয়ের গায়ে যে তেল হলুদ লেগে থাকে , সেই গন্ধে নাকি তার উপর পেত্মী ভর করে।”

-” আমাকে আপনি ভূতের ভয় দেখাচ্ছেন? লাইক সিরিয়াসলি? আমি বাচ্চা ন‌ই সাহিত্য। আমার মন বলছে আপনি আমার থেকে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন।”

-” সাহিত্য শিক্ষা কে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো, তুই আমার অঙ্গনা।তোর কাছে কিছু লুকিয়ে রাখার সাধ্য নেই আমার। আমি সত্যিই দূরে কোথাও যাচ্ছি না। আমি যাবো আর আসবো।আর আমি আসলে তোর কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছিস তো? পুড়তে পারবি তো আমার ভালোবাসার আগুনে?”

-” শিক্ষা সাহিত্যের বুকে নাক ঘষে বললো, কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন। মনটা বড্ড কু ডাকছে আমার। মনে হচ্ছে আপনি বড়ো কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন।”

-” আমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসিস তাই না?”

-” কেন আপনি বুঝতে পারেন না?”

-” হু বুঝি তো আমার বউ আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।আর সেই ভালোবাসার জন্যেই তোর মনে হচ্ছে আমার কোনো ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু তুই দেখিস আমার কিছু হবে না। আমি ঠিক আমার ভালোবাসার কাছে ফিরে আসবো বলে সামনে পা বাড়ানোর আগেই শিক্ষা পেছন থেকে তার শার্ট টেনে ধরে বললো,আমি আপনাকে কিছুতেই যেতে দিবো না।”

-” তাহলে আমার আর করার কিছুই নেই। ক্ষমা করে দিস আমাকে তুই বলে সাহিত্য শিক্ষার নাকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে তাকে অজ্ঞান করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো, খুব শ্রীঘ্রই আমি ফিরে আসবো অঙ্গনা।আজ আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে বলে সাহিত্য নিজের গন্তব্যে ছুটে গেল।”

___________________________________

-” কারো কান্নার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল শিক্ষার। শিক্ষা তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল প্রায় দশটা বাজতে চলেছে। যা দেখে শিক্ষা যেন একদফা চমকে উঠলো।এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে সে? তৎক্ষণাৎ শিক্ষার রাতের কথা মনে পড়ে যায়।সে রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কোথাও সাহিত্য কে দেখতে না পেয়ে বলে, সাহিত্য এখনো ফিরে আসে নি? ও তো বলেছিলো পাঁচ মিনিটে ফিরে আসবে।তার মানে আমার ধারণা সত্যি ছিল।মনে হচ্ছে নিচে থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। সকাল সকাল কার কি বিপদ ঘটলো বলে শিক্ষা নিচে এসে দেখে তার পাপা, বড় আম্মু,বড় আব্বু, আবৃত্তি আপু ,দাদী এমনকি সাথী পর্যন্ত কান্না করছে। শিক্ষা তাদের কে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই সামনে থাকা মনিটরের দিকে চোখ পড়তেই যেন সে পাথর হয়ে যায়। তার কানে স্পষ্ট ভেসে আসে , ব্রেকিং নিউজ। চাঞ্চল্যকর এক তথ্য জানা গিয়েছে।গত কাল রাতে একটা চলন্ত বাসে বোম ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা বাসে বোম রেখেছে সেই খবর এখনো আমরা জানতে পারি নি। তদন্ত কমিটি তদন্ত করছেন।আশা করি খুব শীঘ্রই আমরা জানতে পারবো কে এই বোম ফিট করেছিলো বাসে।এই বোম ব্লাস্ট হ‌ওয়ার দরুন মা’রা গিয়েছে অনেক গুলো নিরিহ মানুষ।আহত হয়েছে ও অনেকে। কিন্তু তাদের শরীর এমন ভাবে পুড়েছে যে তাদের কে চেনার কোনো উপায় নেই। আমরা এমন খবর ও পেয়েছি যে সেই বাসে সিআইডি অফিসার সাহিত্য শিকদার ও ছিলেন।সে কি বা কোন কারণে নিজের গাড়ি ছেড়ে বাসে জার্নি করছিলেন সে কারণ আমাদের কাছে অজানা।তবে নিহতের মধ্যে একটা লাশের পকেট থেকে আমরা তার ওয়াইফ ওরফে এসিপি রায়হান মীরের মেয়ে উষ্ণতা মীরের ছোটবেলার একটা ছবি পেয়েছি। যেহেতু তার চেহারা অত্যান্ত বাজে ভাবে ঝলসে গিয়েছে,তাই আমরা এই ছবির উপর ভিত্তি করে বলছি এটা সিআইডি অফিসার সাহিত্য শিকদারের লাশ। যদি ও এটা দুঃখজনক তবু ও বলতে হচ্ছে সিআইডি অফিসার সাহিত্য শিকদার আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। তিনি এই জগত সংসারের মায়া ত্যাগ করে তার নিজের ঠিকানায় পাড়ি জমিয়েছেন। শিক্ষা মনিটরের পর্দায় স্পষ্ট দেখতে পেলো রাতে সাহিত্য যেরকম শার্ট পরেছিলো সেই সেইরকম একটা শার্ট পরা ব্যক্তি নিহত হয়ে পড়ে হয়েছে। যা দেখে শিক্ষা দৌড়ে গিয়ে ভারি যন্ত্র দিয়ে মনিটর টা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো, সব মিথ্যা কথা। শা’লা’রা গাঁ’জা খেয়ে এমন ভুয়া নিউজ বানিয়েছে। আমার সাহিত্য আমাকে রেখে ম’র’তে পারে না। কিছুতেই না।”

-” শিক্ষা কে কান্না করতে দেখে অন্তরা শিকদার এগিয়ে এসে তাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে বললো,শান্ত হ মা। নিজেকে শক্ত কর।রাতে তো সাহিত্য তোর সাথে ছিলো তাই না? তাহলে এসব হলো কিভাবে?”

-” সব আমার দোষ। আমি একটা পোড়া কপালী। বেশি সুখ সহ্য হলো না আমার কপালে।যখনি নিজের পরিবার নিজের ভালোবাসা ফিরে পেলাম, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলাম, ঠিক তখনি সৃষ্টিকর্তা আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিলো। গতরাতে আমি পারি নি আমার ভালোবাসা দিয়ে সাহিত্যে কে আটকে রাখতে।এক মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছে।নিজেকে বড্ড সুখী মনে হচ্ছিল। হঠাৎ করে সাহিত্যের ফোনে কল আসে।কল পেয়ে সাহিত্য বেরিয়ে যেতে গেলে আমি তাকে আটকাতে যাই । কিন্তু সাহিত্য হয়তো আমাকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়েছিলো ।ব্যাস আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।আর উঠে তোমাদের কান্নার আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসি বলে হু হু করে কেঁদে উঠলো শিক্ষা।
শিক্ষার অবস্থা বেগতিক দেখে রায়হান মীর ছুটে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো, তুই যদি এমন করিস তাহলে তোর বড় আব্বু , বড় আম্মু, আবৃত্তি এদেরকে কে সামলাবে?”

-” আমার সাথে এমন কেনো হলো পাপা? সাহিত্য গতরাতে ও আমাকে বলছে আমাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।আমরা এক সাথে বাঁচবো। কিন্তু বেইমানের বেইমান তার কথা রাখলো না।আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। আমার #মনের_উঠোন_জুড়ে যার ছবি এঁকেছিলাম ,যাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলাম সে কেন এমন টা করলো পাপা? কেন কথা দিয়ে তার কথা রাখতে পারলো না।”

-” তুই একটু শান্ত হ মা।”

-” শিক্ষা হঠাৎ বুকে হাত চেপে ধরে বললো,আমি বোধহয় আর বাঁচব না পাপা। বুকের বাঁ পাশে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে যেন বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে।।বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার পাপা।”

-” তোর কিছু হবে না মা।আমরা এক্ষুনি তোকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।”

-” শিক্ষা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, অক্সিজেন ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না পাপা।এই মুহূর্তে আমার অক্সিজেন প্রয়োজন।সাহিত্য আমার কাছে অক্সিজেন স্বরুপ। অক্সিজেন ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না। তেমনি আমি ও সাহিত্য কে ছাড়া বাঁচতে পারব না।আমি ম’রে যাবো পাপা বলে রায়হান মীরের কোলে ঢলে পড়লো শিক্ষা।”

___________________________________

-” ওটির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে শিকদার ভিলার সবাই। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে সবাই যেন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে।যার লাশ ফরেনসিক ল্যাবে রয়েছে। হয়তো সমস্ত ফর্মালিটি শেষ হলে তার দাফন কাফন সম্পন্ন করা হবে। ছেলের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মেয়েটা ও ম’র’তে বসেছে। প্রত্যেক টা মানুষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে তিনি যেন তাদের মেয়েটাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। তারা মনে প্রাণে আল্লাহ কে ডাকছেন এমন সময় ওটি রুম থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসে। ডক্টর কে চিন্তিত হয়ে আসতে দেখে রায়হান চোখের পানি মুছে জিজ্ঞেস করলো, আমার মেয়ের কি অবস্থা ডক্টর। প্রশ্ন টা শুনে উক্টর কেমন যেন ভড়কে গেল। তিনি ভীত কণ্ঠে আমতা আমতা করে বললো, সরি আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। সি ইজ নো মোর । কথাটা শোনা মাত্র অন্তরা শিকদার অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে গেল। রায়হান মীর সাদ্দাম শিকদার কে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। জাকিয়া জেসমিন এর প্রেশার লো হয়ে গেল।কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেল । একটা পরিবার শেষ হয়ে গেল। আবৃত্তি কাঁদতে কাঁদতে বললো, এ কোন ইতিহাস রচনা করলি তোরা? ইতিহাসের পাতায় অনেক ভালোবাসার গল্প শুনেছি, নাটক সিনেমায় অনেক দেখেছি ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে। কিন্তু তোরা তো আজ বাস্তবে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে দিলি। কিন্তু আফসোস ভাইয়া এটা জানতে পারলো না যে , সে যার ছবি #মনের_উঠোন_জুড়ে এঁকেছিলো ,যার হাত ধরে সারাজীবন একসাথে বাঁচার অঙ্গীকার করেছিলো, সেই মানুষটা তার কথা রেখেছে।এক সাথে বাঁচতে পারে নি তো কি হয়েছে ? একসাথে ম’রে গিয়ে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছে।লাইলি, মজনু, শিরি, ফরহাদ এর সাথে আরো একটা নাম যুক্ত হয়েছে শিক্ষা , সাহিত্য।

সমাপ্ত