মনের গহিনে পর্ব-০১

0
588

#মনের_গহিনে (০১)
sarika Islam(mim)

‘আমি পালাচ্ছি ফারাহ যতক্ষনে তুই চিরকুটটা পাবি আমি অনেকদুরে চলে যাবো।বাবা মাকে বলিস না আমাকে খুব করে বকবে জানিস তো। আজ বিয়ের আসর থেকে পালাচ্ছি এইটা অনেকবড় অপরাধ তোদের কাছে লাগলেও আমার কাছে তা আমার স্বপ্নের সামনে সামান্য।আমি মডেলিং এ সিলেক্ট হয়ে গেছি আজ অডিশন আমি কিছুতেই এই চান্স মিস করতে পারবো না।ফারাহ তুই ইয়াদকে বিয়ে করেনে মা বাবার ইজ্জত এখন তোর হাতে।’

আজ নীলা আপু (আমার বড় বোন)এর বিয়ে।তাকে নিতেই আম্মু পাঠিয়েছিল কিছুক্ষন পর বরযাত্রি আসবে রাস্তায় তারা।রুমে এসেই বিছানায় আপুর পরে থাকা লাল রঙের লেহেঙ্গা আর ড্রেসিংটেবিল এ পরে থাকা অর্নামেন্টস এর সাথে এই চিরকুট টা ছিল।

চিরকুটটা পরে আমার দম বন্ধ হয়ে গেল শ্বাস নিতে যেন অনেক সমস্যা হচ্ছে ঠিকভাবে শ্বাস ভিতরে নিতে পারছিনা।হাতে চিরকুটটা নিয়েই বিছানায় ধপ করে বসে পরলাম চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার অপ্রান চেষ্টা করতে লাগলাম।এখন আমি কি করবো?বাড়ি পুরো মেহমান ভর্তি আম্মু ভাই কাজে ব্যস্ত আমি এখন কি করি?কিছুক্ষন পরিই বরযাত্রী চলে আসবে এসে যদি আপুকে বধুসেজে না দেখে অনেক কান্ড রটাবে আম্মুর কেলেংকারী হয়ে যাবে।না আমি হতে দিব না কিছু একটা তো করতেই হবে।

কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম বিছানা ছেরে দারালাম এখন আমি কি করবো?যদি আম্মু চলে আসে আমি কি জবাব দিব?দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশ করলো আমার হার্টবিট ফাস্ট হতে লাগলো।এই বুঝি আম্মু অজ্ঞান হয়ে পরবে হার্ট স্টোক করবে নানান ধরনের কথা ভেবেই চলছে আমার মস্তিষ্ক টা।দরজা ঠেলে ভাইকে প্রবেশ করতে দেখে আত্মায় জান ফিরে এলো।তুর্য আমার দিকে এগুতে এগুতে বলল,
-ফারাহ নীলা আপু কোথায়?

আমি এখন কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।হাতে ধরে রাখা চিরকুটটা লেহেঙ্গার পেছনে লুকাতে নিলে ভাইয়া ধরে ফেলে।
-কি লুকাচ্ছিস?

হাতটা ওড়নার পেছনে দিয়ে কাপা গলায় বললাম,
-ক,,,কই, কি,,,ছুইনা,,,

তুর্যর কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন ভালো ঠেকছে না।ভ্রু কুচকে ফারাহর দিকে তাকিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলালো।নীলার পরে থাকা লেহেঙ্গা চুড়ি দেখে অবাক হয়ে গেল।
-নীলাপু কই ফারাহ?
-ওয়া,,,শ,রুমে,

কাপা কাপা গলায় ভাইয়াকে মিথ্যে বললাম।ভাইয়ার যেন তাও আমার বলা কথায় এক ছিটে ফোটাও বিশ্বাস হলো না।আমার আকুপাকু করা দেখে ওড়নার পেছনে লুকানোর হাতটা ধরলো।আমার হাত প্রচুর বেগে কাপতে শুরু করলো।এখনি বুঝি কষে আমার গালে এক চড় পরবে আমি কেন বলিনি এই দোষে।।ভাইয়া হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে নিজে পরলো।আমি ভয়ার্থ চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাইয়া বলে উঠলো,
-আর একটু পর বরযাত্রী গেটে এসে দারাবে তুই যলদি বধু সেজে বসে থাক।

যত না ভাইয়ার চর কে ভয় পাচ্ছিলাম তার চেয়ে দ্বিগুন রুপে অবাক হলাম ভাইয়ার বলা কথায়।মানি আমি?এই আমি বধু সেজে বসবো আপুর যায়গায়?মানি ইয়াদ জিজুকে বিয়ে করবো?তা কি করে সম্ভব হবে?এটা আমার দ্বারা মোটেও হবে না।ভাইয়াকে মাথা দুলিয়ে না করতে করতে বললাম,
-এ আমার দ্বারা সম্ভব না ভাইয়া আমি এই রকম ধোকা বাজি কাজ মোটেও করবো না।
-তাহলে তোর আটকানো উচিত ছিল যখন নীলাপু মডেলিং এর কথা বলতো।কিন্তু তুই সবসময় তাকে সাপোর্ট করে এসেছিস এখনও তুই সাপোর্ট করে যাবি এই ছাড়া উপায় নেই।

আমি বেশ ঘাবরে গেলাম।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো।আপুকে সব পদক্ষেপে সাহায্য করতাম বিধায় আজ এত বড় কুরবানী করবো!!যাকে সব সময় জিজু বলে সমন্ধন করেছি আজ তার সাথেই বিয়ে করে নিব?এত্ত সহজেই নাকি?আম্মুকে বলে দিব তারপর যা হবার দেখা যাবে।এই ভেবে বাহিরের জন্য পা বাড়ালাম।ভাইয়া মুহুর্তেই আমার হাত ধরে ফেলল,
-কোথায় যাচ্ছিস?

ঘাড় ঘুরে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
-আম্মুকে সবটা বলতে,
-হার্ট অ্যাটাক দিতে চাস?

আরেক কদম ফেলার আগেই ভাইয়ার কথা শুনে পা পিছিয়ে গেল।ভাইয়ার দিকে ঘুরে দারালাম।চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পরতে লাগলো এমন ক্রিটিকেল সিচুয়েশন একমাত্র আম্মুই ঠিক করতে পারতো কিন্তু এখন তাকে বলা পর্যন্ত যাবে না।

নীলার রুমে দরজা খুলে নিশি (আম্মু) রুমে ঢুকলো।মেয়েকে ড্রেসিংটেবিল এর সামনে বসে থাকতে দেখে সামনে এগিয়ে গেল।তুর্য হাতের কাংনা পরিয়ে দিচ্ছে।নিশি আয়নার দিয়ে মেয়েকে দেখে ভ্রু কুচকে এলো।
-এত বড় ঘোমটা টেনেছিস কেন নীলা?

ভাইয়ার আর নীলা আপুর সেই চিরকুটে লেখা অনুযায়ী আমি ঠিক বধু সেজেই বসেছি।হঠাৎ আম্মুর করা প্রশ্নে আমার বুক জোরে জোরে কম্পন করতে লাগলো।পরান যায় যায় অবস্থা কি উত্তর করবো এখন আমি?না জানি কথা বললেই আওয়াজ চিনে যায় নানান ধরনের কথায় জোট পাকাচ্ছে আমার মস্তিষ্ক।

ফারাহ হাত ডলাডলি করছে কি বলবে না বলবে তুর্য সিচুয়েশন সামলাতে বলল,
-নতুন বউ একবারে বিদায় হলেই খোলা হবে তার আগে নয়।
-এইটা কেমন নিয়ম?
-আমি বানালাম।

জোর পুর্বক হাসি দিয়ে বলল তুর্য।নিশি বেগম ছেলের মাথার হাল্কা চাপর মেরে হাসলো।বাবা মারা যাওয়ার পর নিশি বেগম অনেকটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল তিন সন্তান তাকে সামলেছে এখন আর কোন বড় ধরনের শক দেওয়া যাবে না নিশি বেগম কিছুতেই তা নিতে পারবেন না।নিশি বেগমের সুস্থতার কথা ভেবেই ফারাহ নিজেকে বিসর্জন করতে রাজী।

এক সাইড দিয়ে নিশি আরেক সাইডে তুর্য ধরে নিয়ে যাচ্ছে বিয়ের আসরে।বরযাত্রী এসে পরেছে।ছোট খাটো একটা গার্ডেন সেখানেই এরেঞ্জমেন্ট করানো হয়েছে।হঠাৎ নিশি বেগম চারদিকে তাকিয়ে বলল,
-ফারাহকে দেখছি না যে?কোথায় ও?নীলা কেও আনতে পাঠিয়েছিলাম আর দেখলাম না।

বধু সেজে ঘোমটা দেওয়া ফারাহর কদম থমকে গেল।হাত পা অসম্ভব রকমের কাপতে লাগলো আর যেন হাটা হচ্ছে না তার দারা কদম নড়ছেই না।নিশি বেগম মেয়ের আচমকা থেমে যাওয়াতে সেও আটকে গেল।
-কি হলো নীলা চল?

কাপা কাপা পায়ে আমি পুনরায় হাটা ধরলাম।স্টেজের মধ্যে ইয়াদের পাশেই বসানো হলো আমাকে ঘোমটার নিচে দরদর করে ঘামছি এত বাতাস চারপাশে এত ফ্যান থাকতেও।এই বুঝি ধরা খেয়ে গেলাম এই বুঝি তামাশা হলো!!না জানি কি হবে এর পরিনাম কিচ্ছুই জানা নেই আমার।যখন আমাকে দেখবে তখন কি হবে?যদি একত্রে খেতে বলে তখন?আম্মুর কি অবস্থা হবে?নানান বাজে কথা ঘুরছে আমার মাথার চারপাশে।
আম্মুর ঝাকানিতে হুশ ফিরলো কাজী সাহেব আমাকে সাইন করতে বলছেন।আমার দিকে কলম এগিয়ে দিলেন আর কবুল বলতে বললেন।আমার গলা দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না কান্না দলা পাকিয়ে আটকে গেছে গলা।গোংগানো গলায় বললাম ‘কবুল’ সাথে সাইন করতে কলম হাতে নিলাম।নিজের নামটা ভুলে লিখেও ফেলেছি এখন কি করবো?কাটাও দেওয়া যাবে না।এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো এই বুঝি সব শেষ।চোখ বন্ধ করে বুক টেনে শ্বাস নিলাম।

ফারাহর সাইডে তুর্য দারিয়ে ছিল ফারাহর করা এমন বোকামি দেখে তুর্য ভয় পেয়ে গেল।ধরে ফেলল নাকি?কারো দেখার আগেই সে খাতাটা বন্ধ করে দিল।সবাই দেখলো সাইন শেষ মোনাজাত ধরলো।তুর্য মনে মনে শান্তির নিঃশ্বাস নিল।
অনেক কার্যক্রম থেকে বেচে উঠে এখন বিদায়ের পালা।এত বড় ঘোমটার কারনে প্রথমে বরপক্ষরা নানান কথা বললেও তুর্য আর নিশি সামলে নিয়েছে।

বিদায় হওয়ার সময় ফারাহ নিশিকে ধরে ইচ্ছে মতো কাদলো মার অজান্তে সে বিয়েটা করেও ফেলল তাও নিজ দুলাভাইয়ের সাথে যার সাথে নীলাপুর বিয়ের কথা ছিল।মা জানলে কি রিয়েকশন দিবে তা জানা নেই।ভাইকে ধরেও কান্না করলাম কান্না জড়িত কন্ঠে আস্তে করে বললাম,
-ভাইয়া না জানি কি হবে এখন?

ভাইয়া সান্তনা স্বরুপ বলল,
-চিন্তা করিস না আল্লাহর রহমতে সব ঠিক হবে ভরসা রাখ।

বিদায় দিলাম তাদের।গাড়িতে চড়ে বসলাম চলে যাচ্ছি গন্তব্যহীনা মঞ্জিলে যেখানে আমার কোনই ঠাই নেই এইটা নিশ্চিত।আমাকে দেখলে না জানি কিইবা রিয়েকশন হবে তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিতে পারে।এখন শুধু বাকি যা হয় তা দেখার পরবর্তী কোন ঝড় অপেক্ষা করছে আমার এই জীবনে তা জানা তা দেখা।বুক টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে পিছনে মাথা এলিয়ে দিলাম।

চলবে?