মনের গহিনে পর্ব-০৯

0
330

#মনের_গহিনে (৯)
sarika Islam(mim)

নৌকা চলা যেই না শুরু হলো ইয়াদ আমার হাত ঘামছে ধরলো।আমি ইয়াদের দিকে তাকালাম সে হাল্কা হেসে খিচে চোখ বন্ধ করে নিল।আমার ইয়াদের ভয়ার্থ চেহারা দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছে।কখনো উচু হয় নামতে গেলেই ইয়াদ আমাকে একদম চেপে ধরে আবার উপরে উঠলে বাধন কিছুটা আলগা হয়।আমাদের সামনে বসা ইফতি ভাইয়ারও সেম সিচুয়েশন সোনিয়াকে ধরে বসেছে তাও কেপে কেপে উঠছে যেন।আমি নিজে ভয় পাবো নাকি তাদের দেখে হাসবো খুজেই পাচ্ছি না।

কিছুক্ষন পর শেষ হলো ইয়াদ এখনো চোখ বন্ধ করে আমার হাত ধরে বসে আছে।আমি ইয়াদকে হাল্কাভাবে নাড়ালাম।
-ইয়াদ চোখ খুলুন শেষ।

মুখ চিপে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করলাম।দেখলো আসলেই শেষ ইফতি আর সোনিয়া নামছে ইয়াদ আমাকে ধরেই নামলো।নিচে নেমে ইয়াদ হঠাৎ পরে যেতে নিল আমি এক হাত দিয়ে ধরলাম দ্রুত আরেক সাইড দিয়ে ইফতি ভাইয়া ধরলো।এক কর্নারে একটা বেঞ্চিতে তাকে বসালাম মাথা হয়ত চক্কর দিয়ে উঠেছে হেলান দেওয়ার মতো জায়গাও তো পাচ্ছি না।সোনিয়া হাতে পানির বোতল নিয়ে এসে তাড়াহুড়ো করে বলল,
-ভাবী তোমার কাধে ভাইয়ার মাথাটা রাখো।তাহলে কিছুটা ঠিক হবে হয়তো।

আমি ইয়াদের পাশে তাকে ধরে বসে আছি।আর কোন উপায় না পেয়ে ইয়াদের মাথা আমার কাধে রাখলাম।মুখে আলতো ভাবে হাত রাখলাম।
ইয়াদের নিঃশ্বাস আমার বুকের উপর আচড়ে পরছে কেমন যেন আমার হার্ট বিট দ্রুত হয়ে গেল।বুক কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে নিজের কাছেই নিজের এইসব ফিলিং গুলো খুবিই অজানা।

কিছুক্ষন পর ইয়াদ রিলেক্স হলো মাথা তুলে কিছুটা পানি পান করলো।ইফতি ভাইয়া হেসে ফেলল,
_ভয় পাই আমি আর তুই সাহসিকতা দেখিয়ে এই বের হলি?

ফারাহও ইফতির কথা ফিক করে হেসে দিল।ইয়াদ লজ্জায় পরে গেল বিষয়টি আগেই ক্লিয়ার করলে বেশি ভালো হতো অযথা হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে জিরো হয়ে গেল।ইয়াদ মনে মনে লজ্জা পাচ্ছে সেখান থেকে সামনে হাটা ধরলো সবাই তার পিছুপিছু।

ফুচকা হাউজের ভিতরে ঢুকলো পেছনে চার সিটের বেঞ্চিতে তারা চারজন বসলো।চার প্লেট ফুচকা অর্ডার করলো।হঠাৎ ফারাহর ফোন বেজে উঠলো ফারাহ ফোন রিসিভ করে কিছুটা দূরে গেল।
-হ্যালো ইমা কেমন আছিস?

অপর পাশ থেকে ইমা কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
-রাখ তোর ভালো খারাপ সেই কবে এসেছিস আর আসলিই না আমার কথা কি মনে পরে না?
-ওলে বাবুটা লাগ করেছে?থাক কালকে আসবো কান্দে না।

বেবী টাইপ শান্তনা দিচ্ছে ফোনের ভিতরের মানুষকে ফারাহ।ফোন কেটে পিছে ফিরতেই ইয়াদকে দেখে চমকে উঠলো।মুখে জোরপুর্বক হাসির রেখা টেনে বলল,
-আপনি এইখানে?

ইয়াদও হাসির চেষ্টা করে বলল,
-তোমাকে ডাকতে এলাম এসে পরেছে খাবার।
-হুম চলুন।

ফারাহ আগে হাটা ধরলো ইয়াদ পিছুপিছু।ইয়াদ ফারাহর রোমাঞ্চকর কথা শুনেছে কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং কাজ করছে তার ভিতরে এইটাকে জেলাসি বলে কিন্তু ইয়াদ এইসবের সাথে বরাবরই অপরিচিত।

ফারাহ ফুচকা মুখে দিতেই পাশে থাকা ইয়াদ হাত ধরে ফেলে।ফারাহ সহ উপস্থিত সবাই অবাক নয়নে তাকায়।
-কাল মাত্র নাক ফুরিয়েছ আর আজিই টক?

ইয়াদের কথায় আমার মনে পরলো আসলেই তো টক খাওয়া বারন কিছুদিনের জন্য নাহয় পেকে যাবে।আমি জিনিসটা সম্পুর্ন ভুলে গিয়েছিলাম ভাগ্য ভালো আমার ইয়াদের মতো একটা স্বামী পেয়ে।সবাই খাচ্ছে আমি আলতো হেসে ইয়াদের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।কি সুন্দর করে খায় চিবুতে গেলেও গালের টোলটা দেখা যায়।আমিতো পুরোই ফিদা হয়ে যাচ্ছি ইয়াদের প্রতি।এই ভেবে নিজে নিজেই লজ্জা পেলাম।
খাওয়া শেষে আর কিছুক্ষন থেকে রাত নয়টার দিকে রিকশার খোজে রাস্তায় দাড়ালাম।ছুটির দিনে সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে তাদের প্রিয় মানুষদের সাথে রিকশা পাওয়াটা খুবিই মুশকিল হয়ে পরেছে।ইয়াদ রেগে গিয়ে বলল,
-বলেছিলাম গাড়ি নিয়ে আসি না রিকশায় চড়বে এখন খোজো রিকশা।

ইফতি ভাইয়া বিরক্তি হলো ইয়াদের এহেন কথায়।
-তুই কেন সব সময় নেগেটিভ ভাবিস?অবশ্যই আমরা রিকশা পাবো একটু অপেক্ষা কর!

বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করায় দুটো রিকশা পেলাম উঠে পরলাম।উঠতে গিয়ে শাড়ির আচলের সাথে রিকশার কোন বেজে গিয়েছিল ইয়াদ পরম যত্নে ছাড়িয়েছে।

ফারাহ ইয়াদের হাতের ভিতরে নিজের ছোট্ট হাত রাখলো।ইয়াদ ফারাহর স্পর্শ পেয়ে তার দিকে ফিরে তাকালো।ফারাহ ঠোঁট উলটে বলল
-যদি পরে যাই?একটু ধরে বসাই ভালো।

ইয়াদ হাল্কা হাসলো।
একটা দোকানের সামনে হঠাৎ ইয়াদ রিকশা থামালো।সোনিয়াদের রিকশা আমাদের রিকশার থেকে আগে চলে যাচ্ছে সে এখন এত রাতে রিকশা থামিয়ে করবে টাকি কে জানে?
-আরে আরে নামছেন কেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর না করেই সে একটা দোকানের ভিতর ঢুকলো।হাতে কিছু কিটকেট আর ডেইরি মিল্ক ধরিয়ে দিল।আর সে উঠলো দুটো চোকবার আইস্ক্রিম নিয়ে।
-তুমি তো কিছুই খেতে পারলে না এখন এইগুলো খাও।

আমার হাতে একটা আইস্ক্রিম ধরিয়ে বলল।আমি শুধু অবাক হয়ে যাই তার কান্ড দেখে সে কিভাবে এতশত জিনিস মনে রাখে।ওইযে বলে না ভালোবাসার জীবনসঙ্গী থেকে কেয়ারিং জীবনসঙ্গী খুজো দেখবে জীবনটা খুব সুন্দর।এখন আবার সেই লাইন গুলো অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস হচ্ছে।আসলেই কেয়ারিং লাইফ পার্টনার থাকলে জীবনে আর কিচ্ছুই দরকার হয়না।

রাতে,,
ইয়াদ বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পরলো আজ একটু বেশিই টায়ার্ড লাগছে তার।ফারাহও ঘুরে শুয়ে পরলো কাল সকালে কলেজ যাবে এই ভেবে।

———–

সকালে ইয়াদ অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে আর আমি কলেজের জন্য।একটা গোল জামা পরলাম লং, চুলগুলো খোপা করে কাঠি দেয়া আর ওড়না গলায় ঝুলিয়ে নিলাম।
ইয়াদ আয়নায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের টাই বাধছে আর ফারাহর রেডি হওয়া দেখছে।এই কেমনভাবে ফারাহ রেডি হলো?এইভাবে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে যাবে?এইভাবে খোপা করে সামনের কাটা চুলগুলো বেরিয়ে থাকবে?আর কলেজের সব ছেলেরা তার দিকে খারাপ নজরে তাকাবে?তা ইয়াদ মোটেও সহ্য করতে পারবে না।গায়ে ব্লেজার দিয়ে ফারাহকে নিজের সামনে দার করালো।

ইয়াদ হঠাৎ আমাকে তার সামনে দার করানোর কারন আমি মোটেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না।আমার সামনে কাটা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল।গলায় ওড়না খুলে ঘুমটা দিয়ে দিল।ড্রসিংটেবিলের ড্র‍য়ার খুলে হাতে একটা মাস্ক ধরিয়ে দিল।
-মাস্ক পরেই যাবা।আজ বোরকা আনবো কাল থেকে বোরকা হিজাবে যাবা।আর হা মাস্ক পরেই থাকবা।

আমি ইয়াদের কথায় শুধু মাথা ঝাকালাম।বুঝলাম না হঠাৎ করে কি হয়ে গেল।ইয়াদ বারংবার ঘাড়ে হাত দিয়ে ডলছে যায়গাটা।মাথা এপাশ ওপাশ করছে আমি অনেকক্ষন ধরেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম।ইয়াদ রুম থেকে বাহিরে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম,
-ঘাড়ে কি হয়েছে?

ইয়াদ যেন আমার থেকে মোটেও এমন প্রশ্ন আশা করেনি।আমার দিকে ঘুরে হাবলার মতো তাকিয়ে থেকে বলল,
-ঘাড়ে ব্যাথা।সোফায় শুতে আনকাম্ফরটেবল ফিল করি তাই হয়তো কাল রাতের ঘুম ঠিকভাবে হয়নি।

আমার মনে মনে গিলটি ফিল হতে লাগলো।আহারে বেচারা আমার জন্য সোফায় শুয়ে শুয়ে নিজের একি হাল করেছে। মায়া হতে লাগলো তার প্রতি আর নিজের করা কাজের প্রতি লজ্জা।ইয়াদকে বসিয়ে ড্রয়ার থেকে ব্যাথার একটা স্প্রে এনে ঘারে লাগিয়ে দিলাম।ইয়াদ আমার কত্তকত্ত খেয়াল রাখে আমারও তো এইটুকু রাখা উচিত।

———–

নীলা একটা টপ্স জিন্স সাথে ম্যাচ করে কানে টপ হাতে ব্রেসলাইট আর কাধে সাইড ব্যাগ নিয়ে পুরোপুরি নিজেকে তৈরি করলো।আফটার অল এখন ইয়াদের সামনে যাচ্ছে সে নিজেকে ঠিক সেইভাবেই পরিপাটি করে রেডি করতে তো হবেই।বাড়ি থেকে বের হতে নিলেই নিশি বেগম আটকে দেয়।
-নীলা কোথায় যাচ্ছিস সকাল সকাল?

নীলা খুশি মনে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে।নিশি বেগম নীলার জরিয়ে ধরাতে বিরক্তি হলেন।নীলা এক্সাইটেড হয়ে বলল,
-আম্মু আমার মডেলিং হওয়ার আর মাত্র এক ধাপ দূরে আমি।

নিশি বেগম ভ্রু কুচকে বলল,
-তোকে কে সিলেক্ট করেছে?

নীলা কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,
-শেখ কাম্পানির একমাত্র ওনার ইয়াদ শেখ।

নিশি বেগম ইয়াদের নাম নীলার মুখে শুনে অবাকের সপ্তম আসমানে পৌছে গেলেন।এতকিছু হওয়ার পরও ইয়াদ নীলাকে চুস করলো?ফারাহ কি আদো জানে?ইয়াদ তার ফারাহকে ধোকা দিবে?এইসব ভেবে নিশি বেগম অসুস্থ হয়ে পরলেন।তুর্য আম্মুকে ধরে ভিতরে রুমে শোয়ালো।নীলা আম্মার কাছে বসলো।নিশি বেগম ছলছল চোখে বলল,
-আমার ফারাহর জীবন ধংস করিস না নীলা।

নীলা কোন ধরনের উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ইয়াদের কাম্পানির নিচে দাঁড়িয়ে মাথা উচু করে বিল্ডিংটা দেখলো।পৈচাশিক হাসি হাসলো তার স্বপ্ন পুরন হতে আর মাত্র একটি সিড়ি।
ইয়াদের কেবিনে নক করায় সে ভিতরে আসতে বলল।কিছু ফাইল দেখছিল আজ প্রেজেন্টেশন অনেক কাজ পরে আছে সবাই অনেক ব্যস্ত।ইয়াদ মাথা তুলে নীলার দিকে তাকালো হাস্যজ্বল মুখে তাকিয়ে আছেন।নীলা ইয়াদের কাছে আসতে নিলেই ইয়াদ আটকে দেয়।কিছু স্টাফদের ডেকে আনলো।নীলাকে দেখিয়ে তাদের উদ্দেশ্য বলল,
-এইটা আমাদের নিউ মডেল ওকে রেডি করাও দ্রুত।

সব স্টাফরা অবাক চোখে দেখছে ইয়াদকে।কাল পর্যন্ত কোন মডেল ছিল না আজ কোথা থেকে আসলো।নীলাকে সেখান থেকে নিয়ে মেকাপরুমে নিয়ে গেল।একমেয়ে আরেক মেয়েকে বলছে,
-দেখেছিস ইয়াদ স্যার কতটা বুদ্ধিমতি!সব সমস্যার সমাধান তুড়ি বাজিয়ে ঠিক করে দেয়।

সাথের মেয়েটা মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো।আসলেই ইয়াদ স্যার খুবিই ভালো।নীলা ড্রেসাপ করছে আর তাদের আলাপ শুনছে সেও হাসলো।

————-

ইয়াদ আর ফারাহ একত্রে বের হয়েছিল ফারাহকে কলেজ ড্রপ করে নিজে অফিসে গিয়েছিল।ফারাহ ক্লাসে পেছনে বেঞ্চিতে ইমার সাথে বসে বসে এইকয়দিনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলতে ব্যস্ত।ইমা শুনে অবাক হয়ে বলল,
-ইয়াদ তোকে মেনে নিল?

আমি মাথা ঝাকালাম।ইমা আরেকদফা অবাক হলো।আমার উপর কিছুটা রেগে বলল,
-ওই নীলাপুর জন্য তুই নিজের জীবনের সাথে এমন করলি?এইটা কি ঠিক হলো?আমাদের ভার্সিটির কি হবে?আমাদের এত এত প্লান?

আমি ইমার মলিন মুখ করে থাকা গালে একটা চুমু খেয়ে বললাম,
-নাহ আমার জান সব হবে ইনশাআল্লাহ।আর আমি হয়তো ইয়াদকে ভালোবেসে ফেলেছি।

বেঞ্চিতে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল।ইমা পুরো অবাক আখিজোরায় দেখছে ফারাহকে।মনে হচ্ছে কোন এলিয়েনকে দেখছে।ফারাহ ইমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
-তাহলে রনির কি হবে?

ইমা অবাক হয়ে বলল।আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
-রনি তো জাস্ট ভালোলাগা ছিল কিন্তু ইয়াদ তো ভালোবাসা।

ছুটির সময় কলেজ গেটে প্রচুর ভিড় লেগে যায়।ভিড়ের মাঝে ঠেলাঠেলি করে যেতেই পরে যেতে নিলাম।এক জোড়া হাত আমার কোমর পেচিয়ে ধরলো।

চলবে,,
(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।)