মনের পিঞ্জরে পর্ব-০৫

0
935

#মনের_পিঞ্জরে
#Ariyana_Nur
#Part_05

ইশফা গুটিগুটি পায়ে সান এর সামনে গিয়ে একটা শপিং ব‍্যাগ সামনে ধরে বলল…..

—এটা আপনার।

সান একবার ইশফা আর ইশফার হাতের ব‍্যাগের দিকে তাকিয়ে সাভাবিক ভাবেই বলল……

—তা হঠাৎ কি মনে করে আমাকে গিফট দিচ্ছ?আজ কি কোন স্প‍্যেশাল ডে?

ইশফাঃআমি আপনাকে গিফট দিতে যাব কেন?

সান ভ্রু কুচকে বলল…..

—তাহলে?

ইশফা নিচু সুরে বলল….

—কালকে যে আপনার শার্ট নষ্ট করেছি তার জন‍্য।

—শার্ট এর জন‍্য আমি কি তোমাকে কিছু বলেছিলাম?

সান এর এমন কথায় ইশফার মাথা গরম হয়ে গেলো।নিজে না বলে অন‍্যকে দিয়ে বহু কথা শুনিয়ে এখন কি সুন্দর ভাব নিয়ে কথা বলছে।ইশফা এলির দিকে তাকিয়ে বলল…..

—আপনি না বললে কি হবে। আপনার কথা অন‍্যদের কাছে পৌচ্ছে দেবার জন‍্য আপনার চেলারাই যথেষ্ট।

এলি ইশফার কথা সুনে মুহূর্তে মধ‍্যে রেগে গেল।একে তো কালকে তাকে কথা শুনিয়েছে।এখন আবার ওকে সানের চেলা বলছে।এলি রেগে বলল….

—এই মেয়ে তোমার সাহস দেখি বেশি বেড়ে গেছে।তুমি আমাকে সানের চেলা বলছো।জানো সান কালকে ও না আমাকে অনেকগুলো কথা শুনিয়েছে।(ন‍্যাকা সুরে)

সান নরম গলায় বলল….

—তুই কি করেছিলি?

সান এর এমন নরম সুরের কথা সুনে এলি ঘামতে লাগলো।রাগের মাথায় কথা বলে নিজের কথায় নিজেই ফেসে গেল।সান যে ওর ব‍্যপারে অন‍্য কাউকে কথা বলা পছন্দ করে না সেটা সে ভালো করেই জানে।আর সান যে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না সেটাও তার অজানা নয়।তাই তো সে সানকে না জানিয়ে ইশফাকে কথা শুনিয়েছে।এলি মনে করেছিলো ইশফা সহজ সরল মেয়ে।ওকে কথা শুনালে পাল্টা প্রতিবাদ করবে না।এই মেয়ে যে উল্টো ওকে কথা শুনাবে আর ওমন এক কান্ড করবে তা ওর জানা ছিলো না।

সানঃকিরে কথা বলছিস না কেন?

সানের কথায় এলি ভাবনা জগত থেকে ফিরে এসে আমতা আমতা করে বলল…..

—আ-আমি কিছু করিনি।আমার কথা শোন।আমি সত‍্যি….

এলি আর কিছু বলতে পারলো না।তার আগেই সানের রাম ধমকে সে চুপ করে রইল।সান চোখ মুখ কঠিন করে বলল…..

—কি শুনবো তোর কথা?সে কারন রেখেছিস তুই?সামান‍্য একটু কোল্ড ড্রিংকস লাগার কারনে তুই এই মেয়েটার সাথে যা তা ব‍্যবহার করেছিস।এমনকি মেয়েটার ফ‍্যেমেলিকে নিয়ে আজে বাজে কথা বলেছিস।আবার শার্ট নিয়েও কথা শুনিয়েছিস।তুই এই মেয়েটার কাছে আমাকে শার্ট কিনে দেবার কথা বলে আমার আর তোর সম্মান তুই কতটা নিচে নামিয়েছিস ভাবতে পারছিস?এতোটা নিচে তুই কিভাবে নামতে পারলি?আর কোল্ড ড্রিংকস তো আমার শার্টে লেগেছিলো তুই এতো রিয়েক্ট কেন করেছিলি?

এলিঃসান বিশ্বাস করো আমি তেমন কিছুই করি নি।এই মেয়েটা তোমাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছে।এই মে……

সানঃআউট।

এলি সানের হাত ধরে বলল…..

—সান আমি তো……

সান হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে চেচিয়ে বলল…..

—আই সে গেট আউট।

এলি একবার ইশফার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে গটগট করে হেটে চলে গেলো।

সানকে এভাবে রাগ করতে দেখে ইশফার ও কেন যেন ভয় করছে।সান এর বাকি বন্ধুরাও চুপ করে রয়েছে।কারো কোন কথা বলার সাহস হচ্ছে না।ইশফা শপিং ব‍্যাগটা এক সাইডে রেখে আস্তের উপর কেটে পরতে নিলেই সান গম্ভীর গলায় বলল…..

—আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি?

সান এর কথা সুনে ইশফা চুপচাপ দাড়িয়ে রইল।সান ইশফার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল……

—তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।তুমি আমার গায়ে ইন ছুড়ে মেরে শার্ট নষ্ট করে আবার আমাকে শার্ট দিতে এসেছো।বাহ্ বেশ সাহস আছে তো দেখছি তোমার।

সানের এমন গম্ভীর গলার কথা সুনে ইশফা কাচুমাচু করে দাড়িয়ে রইল।কেউ মনে হচ্ছে গলা চেপে ধরে রেখেছে।যার জন‍্য সে কোন কথাই বলতে পারছে না।অনেক চেষ্টা করেও সে একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের করতে পারলো না।ইশফাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সান এক রাম ধমক দিল।সান এর ধমক সুনে সানকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ইশফা মাটিতে লুটিয়ে পরল।

💦💦💦💦💦💦

চোখে মুখে পানির ঝাপটা লাগতেই পিটপিট করে চোখ খুলল ইশফা।ইশফা চোখ খুলতেই বুঝতে পারলো সে কারো বাহুতে আছে।মানুষটা থেকে ফট করে সরে যেতে নিলেই তুশি ঝাঝালো গলায় বলল…..

—এমন করতাছোস কেন?আমার শরীরে কি কারেন্ট আছে নাকি তোরে শর্ট করতাছে?

ইশফা আস্তে আস্তে উঠে বসে দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে বলল……

—মিটার এমন গরম হইলো ক‍্যান?

তুশি ইশফাকে মারতে নিয়েও হাত গুটিয়ে বসে রইল।রিধি ইশফার কাধে হাত রেখে বলল……

—তুই ঠিক আছিস?আমরা তো অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ইশফাঃআমি ঠিক আছি।তখন হঠাৎ করেই মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠেছিল।

নিরব ইশফার সামনে এসে বলল……

—এই যে পিচ্ছি।এতো ভয় পেলে চলে?তুমি তো আমার বন্ধুকে জেলে পাঠানোর ব‍্যবস্থা করে দিয়েছিলে।এক ধমকেই সেন্সলেস হয়ে গেলে।

তুশি বিরবির করে বলল……

—এ আর ভয়।এর ভয়েই মানুষ সেন্সলেস হয়।

ইশফা তুশিকে একটা চিমটি কেটে বলল…..

—তেমন কিছু না।ইদানিং পেসার টা একটু বেশিই লো হয়ে আছে।তাই তখন……

নিরব মুচকি হেসে বলল…..

—নিজের খেয়াল রেখে।ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করো।

ইশফা কোন কথা না বলে শুধু মুচকি হাসলো।তার এই হাসিতে যে কেউ ঘায়েল হয়ে গেলো তার বিন্দু মাত্র টেরও সে পেলো না।

💦💦💦💦💦💦

ড্রয়িং রুমে দম ফাটানো হাসির রোল পরে গেছে।হাসির শব্দ শুনে ইশিতা বেগম এর মুখের হাসির ঝিলিক চলে আসলো।সে তো এই দিনটির অপেক্ষায়ই থাকে।কখন তার ভূতপুরী বাড়িতে একটু হৈ-হুল্লর হবে।হাতে ট্রেতে করে চায়ের কাপ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে চায়ের কাপ সামনের টি টেবিলে রেখে সোফায় আয়েশ করে বসে বলল….

—কি নিয়ে তোরা এমন হাসাহাসি করছিস?আমাকে একটু বল আমিও একটু হাসি?

ইশরা হাসতে হাসতে বলল…..

—ফুপি তুমি আমাকে বল না আমি নাটক বাজ।শোন তুশির থেকে তোমার আদরের মেয়ে ইশফা কি করেছে?

ইশিতা বেগমঃকি করেছে আমার ইশফা?

তুশিঃবেশি কিছু না।ইফু( ইশফা) একজনকে সরি বলার থেকে বাচতে ইরুর (ইশরা)টেকনিক অবলম্বন করে সেন্সলেস হওয়ার নাটক করেছে।

ইশিতা বেগমঃমানে?কিভাবে কি?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

ইশরা হাসতে হাসতে বলল……

—আমি বলছি।একেবারে প্রথম থেকে।

ইশরা ইশফার ভার্সিটিটে প্রথম দিন থেকে ইশফার সাথে যা যা ঘটেছে সব সংক্ষেপে বলল।( ইশফাকে যে কেউ চিরকুট দিয়েছিল তা বাদে)সব সুনে ইশিতা বেগম মাথায় হাত দিয়ে ইশফার দিকে তাকিয়ে বলল…..

—এগুলো কি শুনছি আমি?

ইশফা গাল ফুলিয়ে বলল…..

—তাছাড়া আর কি করতাম।ইশরার দিকে তাকিয়ে…

—এই শাকচুন্নীকে ভার্সিটির কাহিনী বলার সময় সে ফোন লাউডে রেখে আমার সাথে কথা বলছিলো।আর মা সব শুনে নিয়েছে।মা আমাকে প্রমিস করতে বলেছে আমি যেন কালকের থেকে ভার্সিটিতে গিয়ে কোন ঝামেলা না করি।আর হাতও যেন না চালাই।আর তুমি তো জানো ও সব সরি টরি আমার মুখ দিয়ে বের হয় না।তাই এই শাকচুন্নীর টেকনিক অবলম্বন করেছি।

তুশি অবাক হয়ে বলল….

—তার মনে তুই আন্টিকে প্রমিস করেছিস আর কখনো ঝামেলায় জড়াবি না?

ইশফাঃআমি মাকে সেদিন প্রমিস করেছিলাম কাল কোন ঝামেলায় জড়াবো না।সব সময়ের কথা বলি নি।(ভাব নিয়ে)তাই তো ঐ সেন্সলেসের টেকনিক অবলম্বন করেছি।

ইশফা মনে মনে বলল…..

—শুধু সরি বলার জন‍্য অমন করি নি।ঐ বাদর যেভাবে রেগে ছিল কেন যেন তখন তাকে দেখে ভয় করছিলো।ভয় আর সরি দুইটার থেকে বাচতেই তখন অমন করেছিলাম।কিন্তু তোদেরকে তা বলা যাবে না।তাহলে তোরা আমার মান-সম্মান সব অলু ভর্তা করে দিবি।

(ইশফা সান এর কাছ থেকে কেটে পরার জন‍্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই সানের কথায় থেমে গিয়েছিলো।তখন ইশফা চোখ দিয়ে তুশিকে ইশারা করে।ইশফার ইশারা পেয়ে ইশফা পরে যাবার পর তুশি কাউকে ইশফাকে ধরতে না দিয়ে নিজেই নিজের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।)

ইশিতা বেগমঃ সেন্সলেস হওয়ার কারণ না হয় বুঝলাম।কিন্তু প্রথম দিন ওমন সহজ-সরল সাজতে গিয়েছিলি কেন?

ইশফা হেলান দিয়ে সোফায় আয়েশ করে বসে বলল…..

—সব তোমার ভাইজানের দোষ।তিনিই ভার্সিটিতে যাবার আগে পইপই করে বলে দিয়েছে কোন ঝামেলা না করতে।সান্ত মেয়ের মত থাকতে।তাই তো একটু সহজ-সরল,সান্ত মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করছিলাম।বহুত কষ্টে মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম তখন।কিন্তু যখন ঐ লম্পটটা হাত ধরলো তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।ঠাটিয়ে দিয়েছি একটা।

ইশিতা বেগমঃমারে এভাবে মাথা গরম করলে চলে বল?মেয়ে হয়ে জন্মেছিস একটু তো মাথা ঠান্ডা করে চলতে হয় নাকি।হুটহাট রাগ করলে কি চলে?

ইশরাঃওকে বলে লাভ নেই ফুপি।ও এক কান দিয়ে ঢুকাবে অন‍্য কান দিয়ে বের করবে।

ইশফাঃআমি চাইলেও এটা ছাড়তে পারবো না।এই রাগ,জিদ আমার রক্তে মিশে গেছে।খান বাড়ির মেয়ে হয়ে যদি একটু রাগ,জিদ না দেখাই তাহলে তো আমার দাদার মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।(ভাব নিয়ে)

ইশিতা বেগম মুখটা মলিন করে বলল….

—তার মান সম্মান এমনিতেও ধুলোও মিশে গেছে।

ইশিতা বেগমের কথা শুনে ইশরা ইশফার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়।ইশিতা বেগমকে সাভাবিক করতে ইশরা বলল…..

—ফুপি বাদ দাও তো এই পাগলের কথা।এবার বল,কি খাওয়াবে?

ইশিতা বেগম মুচকি হেসে বলল…..

—আমার মামুনিদের যা পছন্দ তাই খাওয়াবো।

তুশিঃফুপি তুমি কিন্তু ঐ বার আমাকে হালিম খাওয়াও নি।এবার খাওয়াতে হবে।তোমার হাতের হালিমের কথা মনে পরলেই জিভে জল চলে আসে।

ইশিতা বেগমঃওকে মা এবার তোর হালিম পেয়ে যাবি।এবার চা টা শেষ কর।চা জুড়িয়ে তো পানি হয়ে গেলো।

ওরা চা খেতে থাক আমরা সবার পরিচয় জেনে নেই।কারো চায়ের দিকে নজর না দেয়াই ভালো।

জিনাত ইশিতা বেগম।ইশফা আর ইশরার বাবার চাচাতো বোন।চাচাতো বোন হলেও সব সময় তিনি তাকে নিজের আপন ছোট বোনের মত আদর,শাষন করেছেন।

ইশরা,ইশফা জমজ বোন।ইশফা,ইশরা জন্মের পর ইশিতা বেগম তার নামের সাথে মিলিয়ে একই রকম নাম রাখেন।একি রকম নাম হওয়ার কারনে সবাই তাকে বলেছিলেন, মিলিয়ে ভিন্ন নাম রাখতে।তার এক কথা এই নামই থাকবে আর এই নামেই সবার ডাকতে হবে।ছোট বোনের আবদার রাখতে ইশরা,ইশফার বাবা,মা তাই মেনে নেন।বাড়ির লোকদের সুবিধের জন‍্য ইশফাকে সবাই ইফা আর ইশরাকে সবাই ইরা বলে ডাকে।কিন্তু ইশিতা বেগম তাদের পুরো নামেই ডাকে।

ইশফা,ইশরা,ইশিতা ফুপি বলতেই পাগল।ফুপির সাথে তারা সব সময় বন্ধুর মত সব কিছু সেয়ার করে।

ইশফা,ইশরার বাবা একটা প্রাইভেট কম্পানিতে জব করে।মা স্কুল টিচার।তাদের নিজস্ব একটা ফ্লাট আছে।ইশফা,ইশরাদের বাসা থেকে ওদের বাবা যেখানে জব করে সেখান যাতায়াতের অসুবিধা থাকার কারনে সে তার অফিসের সামনে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।

ইশফার নতুন ভার্সিটি বাবা যেখানে থাকেন সেখান থেকে সামনে বিধায় ইশফা কিছুদিনের জন‍্য বাবার বাসা থেকেই ভার্সিটিতে যাতায়াতের সিদ্ধান্ত নেয় ।যাতে তার এক কাজে দু কাজ হয়ে যায়।বাবার সাথে সময় কাটানোও হবে আর প্রথম প্রথম যাতায়াতের কিছুটা সুবিধাও হবে।

#চলবে,

(ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)