মনের মানুষ পর্ব-১০+১১

0
409

#মনের_মানুষ❤️
#দশম_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸

জীবনে একবার অনন্ত প্রতিটা মানুষের আঘাত পাওয়া উচিত….তবে সেই আঘাত শারীরিক নয় বরং মানসিক।জীবনে চলার পথে একবার ধাক্কা খেলে পরবর্তী সময়ে খাঁটি মানুষ চেনার একটা আলাদা শক্তি পাওয়া যায়…..নকল মানুষ আর আসল মানুষের তফাৎ বোঝা যায়।তবে সেই মানসিক আঘাতটা যে আহেলি এমনভাবে পাবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিলো।সেই কবে থেকে ঋষির প্রতি একটু একটু করে ভালোবাসা জমিয়ে নিজের মনে ওকে জায়গা দিয়েছিলো…..বাউন্ডুলে আপনভোলা ছেলেটাকে কবে যে এতখানি ভালোবেসেছিলো তা জানে না আহেলি।তবে ঋষভ যেদিন নিজের মুখে আহেলি কে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো সেদিনটা আহেলির কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিলো,ঋষভ যে ওকে ভালোবাসতে পারে তা ওর ধারণার বাইরে ছিলো……দুজনের সম্পর্কটা বাড়ি থেকে মানার পর তো আহেলি স্বপ্নের সংসারটা অব্দি সাজিয়ে ফেলেছিলো নিজের মতন করে…..তাইতো ঋষভ এর শত অবহেলার পরেও একটু যত্ন ওকে বিগলিত করে দিতো।বাকি সব প্রেমিকাদের মতো আহেলি অভিমান বা রাগ করেনি কখনো….ও জানতো ঋষভ সব্বার থেকে আলাদা।মানুষটা যেমনই হোক সে শুধুই আহেলির।আহেলির স্বপ্নের সংসারটা কাঁচের ঘরের মতো….সামান্য একটা টোকায় ভেঙে খান খান হয়ে গেলো।

গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহেলির বুক চিড়ে…..হৃদয় ছিন্নভিন্ন হওয়ার যন্ত্রণা যে এতটা কষ্টের আজ তা প্রথম উপলব্ধি করলো আহেলি।ঘরের দরজা দিয়ে সেখানেই হাঁটু মুরে বসেছিলো……তখনই ঘরের দেওয়ালের দিকে নজর গেলো।সাদা দেওয়ালে একটা ফটোফ্রেম ঝুলিয়ে রাখা যেখানে আহেলি আর ঋষভ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে…….গত বছর দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন তোলা ছবিটা যদিও এটা আহেলি নিজেই ফ্রেম করে ঘরে রেখেছিলো।আহেলির ঘরে অনেক ফটোফ্রেম আছে…..কোনোটায় আহেলি একা তো কোনোটায় বাবা মায়ের সাথে।ঋষভ কে একান্ত আপন ভাবতো আহেলি তাই ওকেও নিজের ঘরে জায়গা দিয়েছিলো।দুহাতে চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো আহেলি……দেওয়াল থেকে ফটোটা নামিয়ে এনে কিছুক্ষন একদৃষ্টে সেদিকেই চেয়ে রইলো।তৎক্ষনাৎ আহেলির চোখের সামনে ভেসে উঠলো আজ সকালের দৃশ্যটা……চোয়াল শক্ত করে মেঝেতে ছুড়ে মারলো ফটোফ্রেমতা,উল্টে পরায় সাথে সাথে ঝনঝন শব্দ হলো….কয়েকটা কাঁচের টুকরো আশেপাশে ছিটকে পরলো।ঋষভ ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর পাকাপাকি ভাবে রাজনীতিতে যখন প্রবেশ করলো তখন থেকেই আহেলি জানতো ওই মানুষটার স্বপ্নগুলো একদিন ঠিক পূরণ হবে…..তখনো আহেলিকে ঋষভ মনের কথাগুলো বলে উঠতে পারে নি।এরপর আহেলি ঋষভ কে দেখলেই বুঝতো সে কেবল একা দুর্বল নয়….অপরপক্ষও তার প্রতি দুর্বল।এভাবেই কেটে যায় অনেকটা সময়…..ঋষভ দলে একটা পোক্ত জায়গা পায়।তারপর হটাৎ একদিন আহেলি কে ডেকে ওর মনের কথা বলে।তবে কি সব মিথ্যে ছিলো?!এতো কথা,এতো প্রতিশ্রুতি সব মিথ্যে?!

হ্যাঁ মিথ্যেই তো।নাহলে আহেলি যখন ঋষভকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হয়েছিলো তখন ওই মেয়েটা এগিয়ে এসে বললো,,,,

“আই থিংক তুমি আহেলি…..ঋষভ তোমার কথা বলছিলো আমায়।কিভাবে তোমায় ফেস করবে সেটা ও বুঝে উঠতে পারছে না।তুমি হয়তো ভাবছো আমি কি বলছি…..একটু আগে যেটা তুমি দেখলে সেটা নিশ্চই বন্ধুত্ব নয়!একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসলে তবেই এরকম মুহূর্ত কাটানো যায়……এবার তুমি বলবে তুমি তো ঋষভ এর হবু-স্ত্রী তাহলে ও কেনো আমার সাথে!একমিনিট…আমি আমার পরিচয়টা দিই।আমি শ্রেয়া…..তোমার ঋষিদার কলেজ লাইফের ভালোবাসা।আমাদের মধ্যে একটা স্ট্রং রিলেশন ছিলো…কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমরা ব্রেক-আপ করতে বাধ্য হই!কিন্তু আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটা শেষ হয়নি……ওই যে বলে না প্রথম ভালোবাসা ভোলা যায় না,সেটাই আর কি।আজ এতগুলো বছর পর আমরা মান-অভিমান সব দূরে সরিয়ে আবার কাছে এসেছি।তাই প্লিস তুমি আমার আর ঋষভ এর মাঝে এসো না।হ্যাঁ এটা ঠিক যে ও তোমার কাছে কমিটেড বিয়ের জন্য…..কিন্তু ও ভালোবাসে না তোমায়।জাস্ট আমায় ভুলতে তোমায় কাছে টেনেছিলো।এখন আমরা আবার এক হয়েছি…..আচ্ছা তুমি কি ভালোবাসা বিহীন একটা সম্পর্কে হ্যাপি হবে?তারচেয়ে এখনই যা হওয়ার হয়ে যাক।হয়তো কষ্ট হবে তোমার….কিন্তু পরে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এটাই ভালো হবে”

শ্রেয়ার কথা শুনে আহেলি ঋষভের দিকে তাকাতেই দেখলো ঋষভ মাথা নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে…..শ্রেয়া ঠিক তখনই আহেলির কাছে সরে এসে ধীর গলায় বললো,,,,
“একটু আগে যেমন আমাদের ইন্টিমেট দেখলে এরচেয়েও বেশি গভীর সম্পর্ক আমাদের।এবার বুঝতে পারছো তো ঋষভ তোমায় ভালোবাসে না…..যদি ভালোবাসতো তাহলে প্রাক্তন প্রেমিকার ডাকে তার সাথে রাত কাটাতে পারতো?”

শ্রেয়ার কথা শুনে আহেলি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকালে শ্রেয়া হালকা হেসে বলে,,,

কষ্ট পেও না।সব ঠিক হয়ে যাবে….

তখনকার কথাগুলো মনে পরতেই আহেলি দেওয়াল ঘেষে বসে পরলো মেঝেতে….আবারো চোখ বেয়ে জল পরতে লাগলো আহেলির।

কেনো ঋষিদা?কেনো এরকম করলে আমার সাথে তুমি….আমার ভালোবাসা নিয়ে এভাবে কেনো খেললে?কি পেলে আমায় ঠকিয়ে?আমি যে তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসলাম তার দাম এভাবে কেনো দিলে?একবারও তুমি আমার কথা ভাবো নি?

পায়ের কাছেই ফটোফ্রেমের একটুকরো কাঁচ এসে পরেছিলো আহেলির….সেটা হাতে নিয়ে আহেলি কান্নাজড়ানো গলায় বললো,,,,

আমার ভালোবাসাকে অন্যের বিছানায় পিষে ফেললে ঋষিদা?ছিঃ……আমার নিজের ঘেন্না হচ্ছে।কিন্তু আমি যে তোমার পাশে কাউকে সহ্য করতে পারিনা…..আর তুমি কিনা!

আহেলি কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলো….তারপর হঠাৎই বাঁহাতটা মুখের সামনে ধরে ওপর হাতে থাকা কাঁচের টুকরোর দিকে তাকালো।চোখ বন্ধ করে বাঁহাতের কব্জির ওপর চালিয়ে দিলো কাঁচের টুকরোটা…..!

🌸🌸🌸🌸🌸

একটা কেবিনে পেশেন্ট চেক করছিলো প্রান্তিক…..সেখান থেকে বেরিয়ে আইসিইউ এর সামনে দিয়ে আরেকটা কেবিনে যাচ্ছিলো।কাঁচের দরজাটা ক্রস করে এগিয়ে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো প্রান্তিক……আবারো পিছিয়ে এলো কয়েকপা।কাঁচের দরজার ফাঁক দিয়ে একবার দেখেই ভেতরে ঢুকে গেলো।

প্রান্তিককে দেখেই সামনের নার্স এগিয়ে এসে বললো,,,,

“স্যার আপনি এখানে?আপনার কোন পেশেন্ট তো এখানে নেই।”

নার্সের কথায় উত্তর না দিয়ে প্রান্তিক সামনের বেডের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে….বেডের মধ্যে থাকা ব্যক্তির অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখটা বড্ড চেনা প্রান্তিকের…..এই মুখের মায়ায় প্রান্তিক পরেছিলো কিন্তু তখন তো সেখানে হাজার আলোর রোশনাই ছিলো…তবে আজ এমন ফ্যাকাসে কেনো?!প্রান্তিক চেয়েছিলো আহেলির সাথে যেনো আবারো ওর দেখা হয়….তবে এভাবে তো চায়নি।প্রান্তিক কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নার্সটা নিজেই বললো,,,,

আর বলবেন না স্যার।ওই একই….সুইসাইড কেস।এখনকার ছেলে-মেয়ে তো…একটু কিছু হলেই সব মরতে ছোটে।আপনি কি ওকে চেনেন স্যার?

এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে প্রান্তিক?সামনে থাকা মেয়েটা হয়তো ওর অনেকদিনের চেনা কোনো আপনজন নয় কিন্তু….মাত্র কদিনেই যে সে প্রান্তিকের মনের মানুষ হয়ে উঠেছে।

চলবে……

#মনের_মানুষ ❤️
#একাদশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸

প্রযুক্তিগত কারণে আজ আমরা অনেক উন্নত…তাই হয়তো ফোন থেকে অবাঞ্চিত বস্তু খুব সহজেই ডিলিট বটন প্রেস করে মুছে দিতে পারি।আচ্ছা জীবনে যদি এরকম একটা ডিলিট বটন থাকতো তাহলে কেমন হতো?সমস্ত অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্চিত অনুভূতিগুলো যদি ডিলিট বটনের মাধ্যমে মুছে দেওয়া যেতো তাহলে কতো ভালো হতো…..অন্তত তিক্ত স্মৃতিগুলো তো মনে থাকতো না।কিন্তু এটা তো হয় না…..অতীতের সমস্ত ঘটনাই সারাজীবন মনের মধ্যে বিদ্যমান থাকে,হাজার চেষ্টা করলেও সেসব ভোলা যায় না।

হসপিটালের বেডে হেলান দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো আহেলি…..আজ কতগুলো দিন পর সে সুস্থ্য হয়েছে তা জানে না,তবে জ্ঞান ফেরার পরের মুহূর্তে বাবা-মায়ের শুকিয়ে যাওয়া চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখে আহেলির নিজের ওপর রাগ হয়েছিলো…..আর যার জন্য আহেলি এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিলো সেই মানুষটা?সেকি একবারের জন্যেও এসেছিলো?

ওয়ার্ডে পাশাপাশি আরো কয়েকটা বেডে আরো কয়েকজন রোগী আছে…তাদের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো।কাল ওকে ডিসচার্জ করা হবে….আজকের দিনটাই হসপিটালে থাকতে হবে।একটু আগেই ওর বাবা মা এসে দেখা করে গেছে।ভিসিটিং আওয়ার্স শেষ হতে এখানে আর কারোর থাকার অনুমতি নেই।এমনটাই নিয়ম এই নার্সিং-হোমের।আহেলি একেবারে চুপ করে গেছে….এখনো অব্দি কাউকে কিছু জানায়নি।এমনকি বিকালে অনুও আর সপ্তক এসে জোর করার পরেও ওর মুখ থেকে কথা বের করতে পারে নি।কাঁচের জানলার ওপারে রাতের কলকাতাকে দেখে আহেলির ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিলের হাসি ফুটে উঠলো।
🌸🌸

আহেলির বেডের পাশে অনেকক্ষণ আগেই ডিনার রেখে গেছে যদিও আহেলি এখনো অব্দি এক টুকরো খাওয়ার মুখে দেয়নি।একজন নার্স এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তিমাখা গলায় বললো,,,,

“এইই তুমি খাওনি কেনো?কোনো সমস্যা আছে?”

নার্সের প্রশ্নে আহেলি মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি প্রকাশ করলো।

“তাহলে?চুপচাপ বসে আছো কেনো?একটু পরেই ওষুধগুলো দিতে হবে নাকি….না খেলে আমি ওষুধ দেবো কেমন করে?”

“আমার খেতে ভালোলাগছে না।”

“তা লাগবে কেনো?বাবা মাকে কষ্ট দিতে তো খুবই ভালোলাগে…..যত্তসব ন্যাকামো।”

নার্সের কথায় আহেলি মুখ তুলে তাকাতেই উনি বললেন,,,,

“তুমি জানো তোমার অবস্থা কিরকম হয়েছিলো?যখন তোমায় আনা হয় তখন তোমার অবস্থা কতটা খারাপ ছিলো?তোমার শরীর থেকে যা রক্ত বেরিয়েছিলো তাতে তোমায় তো বাঁচানো যেতো না।হসপিটালেও তো ব্লাড ছিলো না…..তোমার বাবা কোথা থেকে খুঁজে ঠিকই জোগাড় করলেন।তুমি তোমার বাবা-মায়ের কথা নাই ভাবতে পারো কিন্তু তারা ঠিকই ভাবে।কি পাও এসব করে?”

আহেলি মাথা নামিয়ে নিতেই আবারো নার্সটি বলে উঠলো,,,
“নিজের জন্য না হোক তোমার বাবা মায়ের জন্য সুস্থ্য হও…..এই পাঁচদিন ধরে ওনাদের যা অবস্থা করেছো তাতে যে ওনারা ঠিক আছেন এই অনেক।”

প্রতুত্তরে আহেলি কিছু বললো না।চুপচাপ খেতে শুরু করলো…..নার্সের দেওয়া ওষুধগুলো খেয়ে আবারো চুপচাপ শুয়ে পরলো আহেলি।শরীরটা ভীষণ দুর্বল…..কিন্তু কোনোভাবে ঘুমও আসছে না।

“ঠিকঠাক সময়ে মেডিসিনগুলো নিতে হবে….নাহলে সুস্থ্য হবে কিকরে?এখন সব নিয়ম না মানলে তো অপারেশনের সময় সমস্যা হবে,আর তখন কিছু উল্টোপাল্টা হলেই তো আবার আমাদের পিটতে আসবে।তারচেয়ে ভালো নিজে নিজের খেয়াল রাখো।”

চেনা একটা গলা পেয়েই উঠে বসলো আহেলি….এদিক ওদিকে তাকাতেই একটা বেডে গিয়ে ওর চোখের চঞ্চল দৃষ্টি শান্ত হলো।এটা কি ঠিক দেখছে আহেলি?হ্যাঁ…..ঠিকই দেখছে।ফর্সা রোগা ছেলেটা,গালে হালকা দাঁড়ির ছোঁয়া….এলোমেলো হয়ে থাকা মাথার চুল,পরনে ডিপ নেভি ব্লু শার্ট তার ওপরে এপ্রোন,গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ…..প্রান্তিক!ডক্টর প্রান্তিক।

আহেলির ভাবনার মাঝেই প্রান্তিক ওর সামনে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনই আহেলি নিজে থেকে বললো,,,,
প্রান্তিক।

আহেলির গলার শব্দে থমকে দাঁড়ালো প্রান্তিক…..কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে আহেলির দিকে ফিরলো।প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে আহেলি ম্লান হেসে বললো,,,,

আপনি এই নার্সিংহোমে চাকরি করেন?

হুমম।

ওহ!

আহেলি আর কোনো কথা বলতে পারলো না।কারন প্রান্তিকের তরফ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না……আহেলি আবারো হালকা হেসে বেডে হেলান দিলো।প্রান্তিক হাতের থাকা ফাইলটা দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলো ওয়ার্ড থেকে।প্রান্তিক চলে যাওয়ার সাথে সাথে আবারো দরজার দিকে তাকালো আহেলি…..প্রান্তিকের থেকে এমন ব্যবহার আশা করেনি আহেলি।অন্তত দুটো কথা বলতে পারতো।

পরেরদিন সকাল হতেই আহেলি উসখুস করছিলো বাড়ি যাওয়ার জন্য…..কথা ছিলো সকাল এগারোটায় ডিসচার্জ করা হবে কিন্তু কোনো কারণবশত সেটা বিকেল চারটেয় পিছিয়ে দেওয়া হলো।আহেলির বাবা-মা কে ফোনে সবটা জানিয়ে দিয়ে বলা হলো বিকেলে আসতে।

খবরটা নার্সের থেকে জেনে আহেলি একটু আশাহত হলো….মা আর বাবার সাথে টুকটাক কথা বলে ফোনটা রেখে আহেলি অপেক্ষা করতে লাগলো বিকেল হওয়ার।বেলা সাড়ে এগারোটার সময় প্রান্তিক এলো ওয়ার্ডে…..কয়েকজন পেশেন্টকে চেক করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকালো আহেলির বেডের দিকে।মেয়েটা চুপচাপ বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে….মনটা শক্ত করে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো প্রান্তিক।মস্তিষ্ক আর মনের লড়াইয়ে হার মানলো মস্তিষ্ক…..আহেলির বেডের পাশের একটা টুলে বসতেই আহেলি চমকে উঠলো।প্রান্তিক কে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো…..আহেলির বেডের পাশের টেবিল থেকে একটা চার্ট নিয়ে তাতে একপলক চোখ বুলিয়ে প্রান্তিক বললো,,,,

“কেমন আছেন?”

“ভালো….বাড়ি যেতে পারলে আরো ভালো লাগতো।”

আহেলির কথায় প্রান্তিক ওরদিকে মুখ তুলে তাকালো….চার্টটা যথাস্থানে রেখে বললো,,,,

“বাড়ি যাওয়ার এতো তাড়া কিসের?আপনি তো বাড়ি ফেরার জন্য হাত কাটেন নি….তাহলে আজ হটাৎ বাড়ি যেতে চাইছেন?”

“সত্যিই তো আর যেতে চাইনি…..এখনো যেতে ভয় লাগছে।না জানি কতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।”

“সেকি?এতো ভয়?তা প্রশ্নের উত্তর যদি দিতেই না চান তাহলে এরকম কাজ করেন কেনো?”

“সবসময় তো পরিস্থিতি এক থাকে না….কিছু পরিস্থিতি এমন হয় যার জন্য মানুষ সবচেয়ে ভয়ের কাজটা করে ফেলে আর তাই হয়েছে আমার সাথে।”

“তা বাবা মায়ের আগে এমন কোন ভালোবাসার মানুষ আছে যার জন্য প্রাণ ত্যাগ করতে গেলেন?কি কেস?”

প্রান্তিকের কথায় আহেলি ম্লান হেসে বললো,,,,

“আমি তো বাকিদের মতো নয়….হাজার যন্ত্রণা- আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা হয়তো ভগবান আমায় দেন নি।তাই তো বাবা মার কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতোই নিজেকে নিয়ে ভেবেছি।আর বাবা মায়ের কাছেও বা কি বলতাম?তারা যদি জানতো তাদের মেয়ে প্রতারিত হয়েছে তার প্রেমিকের কাছে তাহলে ওরাও সহ্য করতে পারতো না।আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু কারোর প্রতারণা সহ্য করতে পারিনা।তাই আগেপিছে না ভেবেই আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছি…..”

আহেলির কথায় প্রান্তিক প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো….গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহেলি বললো,,,,

যার কথা আপনাকে অহংকার করে বলেছিলাম….সেই মানুষটা যে আমায় ঠকাতে পারে আমি জীবনে কল্পনা করতে পারিনি।যার কাছে এতটাই সময়ের মূল্য যে প্রেমিকা কে আধঘন্টা দিতে পারে না…..কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে আলাদা করে সময় কাটায় না।অথচ সেই ছেলেটাই আরেকটা মেয়ের ডাকে তার কাছে ছুটে যায়….তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেখানেই রাত কাটায়।কারণ মেয়েটা তার প্রাক্তনী…এখনো অব্দি তাকে ভুলতে পারেনি।তাই যার কাছে বর্তমানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাকে ভুলে আবারো প্রাক্তনীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করে।আমি পারিনি এটা সহ্য করতে….নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারিনি।যাকে এতো ভালোবাসলাম,কঠিন সময়ে পাশে থাকলাম সে আমায় আসলে কোনোদিন ভালোবাসেনি….একজনকে ভুলতে জাস্ট রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে ইউস করেছে।এটা শোনার পর আর মাথার ঠিক ছিলো না আমার।তাইতো আমি কি করেছি আমি নিজেও জানিনা…..

আহেলির কথায় স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রান্তিক।কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দিতেই পারছে না।প্রান্তিক তো মনেমনে চেয়েছিলো যে আহেলি যাকে ভালোবাসে তাকে নিয়েই যেনো ভালো থাকে।কিন্তু তা তো হয়নি…..এই ফুলের মতো নরম মনের মেয়েটা প্রতারিত হয়েছে কারোর দ্বারা….কথাটা ভাবতেই শান্ত প্রান্তিকের রাগ হলো।আহেলির চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বললো,,,,

আপনি ভুল করেছেন আহেলি….নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়ে আদতে ওদের সুবিধে করে ফেলেছেন।নিজেকে আঘাত না করে শক্ত করুন আহেলি।যে আপনার ভালোবাসা নিয়ে প্রতারণা করলো তাকে এতো সহজে ছেড়ে দেবেন না….যতখানি আঘাত আপনি পেয়েছেন তার দশগুন আঘাত ফিরিয়ে দিন।

চলবে……