মনোভূমির ছায়া পর্ব-২২+২৩+২৪

0
64

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ২২
#মাহীরা_ফারহীন

‘এটা তুমি?!’ অবাক কন্ঠে বলল এ্যভরিল। তারপর নিনার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। বলল,
‘ওউউ কী গোলুমোলু ছিলা!’

নিনা হালকা হেসে এ্যভরিলের হাত থেকে ছবিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘ছোটবেলায় সবাই ওইরকমই থাকে।’

সেন্টার টেবিলের উপরে বোঝাই করে রাখা বড় বড় কয়েকটা এ্যলবাম। নিনার পারিবারিক ছবির এ্যলবাম সেগুলো।

‘উঁহু তোমার বোন আর তুমি একদম একই রকম দেখতে।’

‘হ্যা। অবশ্য সামনে থেকে বোঝা যায় যে কে কোনটা।’

‘ওহ্হ এখন তো ওকে দেখা ইচ্ছা হচ্ছে।’

সোনালী রোদে মাখা বিকেল। ফুরফুরে বাতাস আসছে বাগানের দরজা গলে। দরজাটা হা করে খোলা। নিনা ও এ্যভরিল মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে।
‘এ্যই তোমার ছোটবেলার ছবি কোথায়? কখন থেকে বলছি দেখাও না।’

‘আচ্ছা আচ্ছা দেখাচ্ছি। তোমার গুলো দেখতেই মজা লাগছে। যাই হোক।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কিছুক্ষণ বাদে নিচে নেমে এলো একটা ডায়েরি হাতে। এসে নিনার পাশে আবার বসে পরল। ডায়েরির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, ‘আমার কাছে তেমন কোন ছবি নেই। যা কিছু ছিল ওসব চাচার বাসায় আছে। হয়তো স্টোররুমের ময়লা আবর্জনার নিচে চাপা পরে আছে। আনা সম্ভব হয়নি।’ বলতে বলতে একটা পৃষ্ঠা মেলে ধরল। ডায়েরির পাতায় তারিখ সহ টুকটাক লেখা তার পাশাপাশি একটা হলদেটে ছবি আটকানো। পুরনো হয়ে আসায় বেশ ঘোলাটে ভাব বসে গিয়েছে। সুন্দর চিকনচাকন দেখতে একজন মহিলা হাসছে। তার হাতে ছোট একটা মেয়ে। দুই তিন বছর বয়স হবে। তার পাশে একজন লম্বা চওড়া লোক। তার হাতে এক ছোট্ট নবজাতক। নিনা ছবিটা মনোযোগ সহকারে পরখ করে বলল, ‘ওহ্ কী সুখী এক পরিবার ছিল! এটা তোমার বোন?’

‘হ্যা।’

‘আর পেছনের বাড়িটা তোমাদের? এত বড়?’

‘হুম।’ ছোট্ট করে উত্তর দিল এ্যাভরিল। বলল,
‘এখন অবশ্য এর ওপর আমার কোন দাবি নেই। এটা ওদের বাড়ি এখন।’

নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
‘তোমার মায়ের সাথে তোমার মিল আছে।’

‘হ্যা এটা অনেক শুনেছি।’

‘ওহ তোমাদেরও জ্যাকারান্ডা গাছ ছিলো? আমাদের বাগানেও আমি ছোট থাকতে একটা লাগিয়েছিল।’

‘কোই দেখি নাই তো।’

‘কারণ ওটা নেই এখন। ম*রে গিয়েছে।’

‘ওহ।’

এ্যাভরিল ডায়েরিটা রেখে বলল,
‘আমার খুব বেশি ছবি নেই। আমি তোমার ছবি গুলোই দেখি।’ বলতে বলতে পুনরায় ও নিনার এ্যালবাম গুলো ঘাটতে আরম্ভ করল। এ্যাভরিলের ডায়েরিটা আর বেশি না ঘেটে বন্ধ করে রেখে দিল। এ্যাভরিল তখনই একটা ছবি তুলে ধরে বলল,
‘ওউ তোমার আর টনির ছবি!’

নিনা সেদিকে দৃষ্টি দিল। নিনা এবং টনি দুজনেই একটা কাউন্টারের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। এটা সেই ফ্রুট সপেই তোলা। নিনা মাথা ঝাঁকাল। এ্যাভরিল আরেকটা ছবি বের করল। এখানে নিনা ও টনি কোন একটা ব্রিজের রেলিঙের ওপর বসে আছে। এ্যাভরিল বলল,
‘তোমরা কত দিনের ফ্রেন্ড ছিলা?’

‘প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি।’

‘তুমিও তো ওর আরোও পুরনো ফ্রেন্ড ছিলা। তাই না?’

‘হ্যা।’

তখনই কলিং বেজে উঠল। এ্যাভরিল লাফ দিয়ে উঠল।
উৎকন্ঠিত চিত্তে বলল,
‘ওহ ইভান।’

‘কী!?’

‘ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ইভানের আসার কথা ছিল।’

‘কেন আসার কথা ছিল?’

‘ওই যে ওকে ঘুষ গিয়ে আমার এসাইনমেন্ট পেপার ধরিয়ে দিয়েছিলাম। ওটাই এনেছে।’

‘ওহ ওটা। হ্যা আগামীকালই তো জমা দেওয়ার ডেট।’ বলতে বলতেই টেবিলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল।
উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘ছবিগুলো সব সরাতে হবে। বিশেষ করে আমার আর টনির ছবি গুলো।’

‘আচ্ছা আমি এগুলো সামলাচ্ছি। তুমি দরজা খোলো যাও।’

নিনা তাড়াতাড়ি ওকে কিছুটা সাহায্য করে তারপর আস্তে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পুনরায় কলিং বেল বাজলো। দরজাটা খুলতেই দেখা গেল ইভান পোর্চের কলামের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা প্যাকেট। মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ব্যাড গেস্ট সার্ভিস।’

‘নেভার মাইন্ড।’ প্রতুত্তরে বলল নিনা।

‘ওহ ইয়াহ এজ অলওয়েজ আমাকে দেখে মনে হয় খুশি হওনি তুমি।’

‘ওহ না আসতো। ভেতরে আস।’ বিচলিত ভাবে কথাটা বলে সরে দাঁড়াল। নিনা ভয়ে ভয়ে ইভানের পেছন পেছন এগিয়ে গেল। লিভিং রুমে উঁকি দিতেই সমস্ত দুশ্চিন্তা কেটে গেল। একটা লম্বা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সেন্টার টেবিল একদম ফাঁকা। এ্যাভরিল আরামসে সোফায় বসে মোবাইলে ডুবে রয়েছে। ইভানের দেখা পেতেই সোজা হয়ে বসে বলল,
‘হেই।’

‘ওহ হ্যালো। তুই আমাকে আগে কেনো বলিসনি যে তুই নিনার সাথে থাকছিস?’

এ্যাভরিল একটু অপ্রস্তুত হলো। তবে পরমুহূর্তেই বলল,
‘উম সুযোগ হয়নি পুরো ঘটনাটা বলার। এর মাঝে স্কুলেই বা কয়দিন গিয়েছি।’

‘আমি তো রিতীমত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এখানে থাকার কথা শুনে।’ বলতে বলতে পাশের সোফায় বসল ইভান। নিনা বলল,
‘আমি কফি বানিয়ে আনছি। চলবে তো?’

‘জানো তো তোমার অফার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই আমার।’

নিনার গালে হালকা লালচে আভা ছড়িয়ে পরার পূর্বেই দ্রুত গতিতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। এ্যাভরিল মিটিমিটি হাসছিলো। ইভান প্যাকেটটা এগিয়ে দিল,
‘আপনি মিটিমিটি হাসা বন্ধ করেন। আপনার এসাইনমেন্ট।’

এ্যাভরিল সেটা ছো মেরে নিজের হাতে নিয়ে নিল। একবার প্যাকেট খুলে কাগজগুলোয় চোখ বুলিয়ে আবার গুছিয়ে রেখে বলল, ‘থ্যাঙ্কস!’

‘হ্যা এখন বল হঠাৎ এখানে এসে থাকার কারণটা কী? তোর সাথে এত কিছু ঘটে গেলো আমাকে একবার বললিও না।’

‘আরেহ আমার এইসব সমস্যা তো সবসময়ই চলতে থাকে। একই কথা বারবার বলে মানুষকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে বল?’

‘তোকে কে বলসে আমি বিরক্ত হই?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে বুচ্ছি তুই অনেক খুশি হইস আমার ঝামেলার কথা শুনে।’ বলে থামল। তারপর সংক্ষেপে পুরো ঘটনা বর্ণনা করল।

‘ভাই তুই তোর বোনের কাস্টাডির জন্য কেস না করে এখনো বসে আছিস কেন এটাই তো আমি এখনে বুঝি না।’

‘আরেহ হুদাই কেস করলেই হবে নাকি? আমার নিজেরই থাকার জায়গার ঠিক নেই। আমি ওকে নিয়ে কী করব? ও অন্তত যেখানে আছে ভালো আছে। আর এমনিতেও দেখ আমি তো ভালোই আছি। যতক্ষণ শ্বাস চলছে কোন না কোন একটা ব্যবস্থা তো মানুষের হয়েই যায়। তাই না?’

‘হ্যা কিন্তু….এতটুকু বলতেই ও থেমে গেল। নিনার কন্ঠস্বর ভেসে এলো রান্নাঘর থেকে। এ্যাভরিলকে ডাকছে। এ্যাভরিল লাফ দিয়ে উঠে বলল,
‘ওয়েইট এখুনি আসছি।’
এ্যাভরিল চলে যেতেই ইভান চুপচাপ বসে এদিকওদিক পরখ করতে লাগলো। ও বসে আছে বাগানের উল্টো দিকে। দরজা গলে পেছন থেকে বাতাস আসছে। সোফার সামনা সামনি দেয়াল টিভি। সেলফের ওপর কমলাটে আলো এসে পরছে। টিভির নিচে শো-পিসের থাকে নিনা ও ওর মায়ের একটা ছবি বর্নিল নকশায় ফ্রেম করে রাখা ছিল। উঠে গিয়ে সেটা কাছ থেকে পরখ করল। তারপর আবার ঘুরে আসতে গিয়েই চোখে পরল কিছু একটা। কাবার্ডের পাল্লার ফাঁকা থেকে কিছু একটা সামান্য বেরিয়ে আছে। ইভান ঝুঁকে সেটা টান দিয়ে বের করে হাতে তুলে নিল। একই রকম দেখতে দুটো ছোট্ট মেয়ে। নিশ্চয়ই নিনা আর ওর বোন হবে। যদিও ইভান বুঝতে পারলো না বাচ্চার দুটোর মধ্যে কোনটা কে। যেই কাবার্ড থেকে সেটা বেরিয়ে ছিল ঝুঁকে সেটা খুলতেই ওকে অবাক করে দিয়ে একগাদা ছবি স্রোতের মতো মেঝেতে এসে ছড়িয়ে পরল। ইভান অবাক হয়ে বিড়বিড় করল,
‘আয়হায়! এগুলো কী হলো!?’
ছবিগুলো কোন রকমে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে একটা ছবির দিকে চোখ আঁটকে গেল। সেটা তুলে নিল হাতে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ছবিটায় টনি এবং নিনা কোন একটা ব্রিজের রেলিঙের ওপর বসে আছে, হাসি মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। তখনই এ্যাভরিল লিভিং রুমে প্রবেশ করল। এবং চমকে উঠে বলল,
‘তুই ওখানে কী করছিস!?’

‘নিনা আর টনি পূর্ব পরিচিত ছিল?’ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কঠোরভাবে জিজ্ঞেস করল। ওর কন্ঠে কিছু একটা ছিল। এ্যাভরিল কেঁপে উঠল। মিনমিন করে বলল, ‘ইভান একটা ছবি দেখে মাথা গরম করিস না। নিনা এক্সপ্লেইন করতে পারবে।’

‘আমি যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। হ্যা নাকি না।’

এ্যাভরিল ইতস্তত করে বলল, ‘হ্যা।’
ইভান সাথে সাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এ্যাভরিল বলল,
‘ওহ নো প্লিজ ইভান। আবার না! যতবার তুই মাথা গরম করিস ততবারই একটা গন্ডোগোল লাগে। তুই….

‘সাট আপ! তুইও জানতি কিন্তু আমার কাছ থেকে লুকিয়ে গিয়েছিস।’
নিনা ট্রে হাতে লিভিং রুমে প্রবেশ করল। হঠাৎ ইভানকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল।

এ্যাভরিল পেছনে ঘুরে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘নিনা সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!’

‘কী হয়েছে টা কী?’

‘ইভান তোমার আর টনির ছবিটা দেখে ফেলেছে।’

‘কী?!’ আশ্চর্য হয়ে কথাটা বলল নিনা। কফির ট্রেটা তাড়াহুড়ো করে এ্যাভরিলের হাতে ধরিয়ে দিল। ঝাঁকুনিতে কিছুটা কফি ছলকে উঠল। ততক্ষণাৎ ছুটে লিভিং রুম পার হয়ে মূল সদর দরজায় এলো। ইভান ওর গাড়ির গেট খুলছে তখন। কিছুক্ষণ পূর্বের উজ্জ্বলতা, উৎফুল্লতা ও আমোদ ক্ষণেই হারিয়ে গেল। তার স্থানে এখন শুধু চোখ ভরে অগ্নি শিখা নেচে উঠছে। চোয়াল শক্ত। কপালে ভাজ পরেছে এমন যেন কোন কাগজকে ধরে কেউ মুচড়ে দিয়েছে। নিনা ছুুটতে ছুটতে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁপাচ্ছে। কালো গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে বলল,
‘ইভান একবার আমার কথা শোন। প্লিজ!’

‘আমার শোনার কিছু নেই।’ শীতল কন্ঠে বলে ড্রাইভিং সিটে ঢুকে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেওয়া আগেই দরজা খুলে পাশের সিটে উঠে বসল নিনা। কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করেই চোখ বুজল। দু’হাতে মুখ ঢেকে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। ইভান ধমক দিয়ে বলল,
‘নামো আমার গাড়ি থেকে!’

কিন্তু নিনা ওর কথায় আমল করার কোন লক্ষণ দেখাল না।
‘কী আশ্চর্য শুনতে পাচ্ছ না?’ পুনরায় বলল ইভান।

অবশেষে নিনা শান্ত কন্ঠে বলল,
‘তুমি যেখানে যাচ্ছ আমিও সেখানে যাব। আর ততক্ষণ গাড়ি থেকে নামবো না যতক্ষণ না নিজেকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিচ্ছ।’

‘জাহান্নামে যাচ্ছি। চলবে?’ তিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ইভান।

‘চলবে।

স্টার্ট দিতেই ভো করে তীব্র একটা শব্দ হলো। সবসময়ই হয় তবে এই মুহূর্তে মনে হলো ইভানের সাথে সাথে তার গাড়িটিও তার মতো রেগে গর্জে উঠছে। গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। ন্যাসভিলের নেইবারহুড গুলোয় সাধারণত গাড়ির গতিবেগ লিমিট ২৫ মিটার পার আওয়ার পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া থাকে। সেখানে ইভানের গাড়ির গতি উঠল চল্লিশ এমপিএইচ এ। নিনা উদ্বিগ্ন চোখে স্পিড মিটার দেখলো। কোন পুলিশের চোখে পরলেই স্পিডিং টিকেট ধরিয়ে দেবে। ফের গুনো জরিমানা। নিনা বলল,
‘দু বছর পূ্র্বে একটা ফ্রুটসপে কাজ করতাম আমি। সেখানেই টনিও পার্ট টাইম জব করত। ও কোন স্কুলে পরত, কে ওর বোন, কে ওর গার্লফ্রেন্ড কার সাথে ওর শত্রুতা এত কিছু আমার জানা ছিল না। সাধারণ ভাবেই ও আমার ভালো বন্ধু ছিল। আমার বন্ধু বলতে মাত্র দুজন মানুষই ছিল। টনি এবং অমিত। কিছুদিন পূর্বে হঠাৎ বাবা এসে খবর দিল সেই দুটো মাত্র বন্ধুর মধ্যে একজন আর বেঁচে নেই। তাও আবার খু*ন হয়েছে।’ এতটুকু বলে থামল। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। শাঁই শাঁই করে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও যানবাহন গুলো পার হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড বাতাসে বারংবার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ইভান অবিশ্বাস্য শান্ত কন্ঠে বলল,
‘এবং এরপরই তুমি সিদ্ধান্ত নিলা যে তুমি নিজেই এই রহস্যের কিনারা করবা। তার জন্য নিজের স্কুল ছেড়ে চলে এলা আমাদের স্কুলে। তোমার কোন কাজই বিনা কারণে করোনি। তুমি টনির ফিউনেরালে গিয়েছিলা। একটা নতুন স্কুলে এসে যাকে চেনোই না তার ফিউনেরালে তুমি কেনোই বা যাবে তাই না?’

‘লিজা তোমাকে বলেছিল তাই না?’

‘না। লিজা তোমাকে দেখেনি। অ্যালেক্স উপস্থিত ছিলো ওখানে।’

নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইভান বলে গেল, ‘অন্যান্যরা হয়তো খেয়াল করেনি কিন্তু তোমার প্রতিটা পদক্ষেপই আমি খেয়াল করেছি। কিন্তু তবুও এটা মাথায় আসেনি যে তুমি আগে থেকে ওকে চিনো।’

‘কেনো? কেন আমার প্রতিটা পদক্ষেপের দিকে নজর রাখতা?’

‘কারণ….এমনিই। বললাম না তোমার কথাবার্তা, কাজকর্ম অন্যরকম লাগতো। তুমি যে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতা, আমি জানতাম কেনো… কারণে…আমি তোমার স*ন্দেহের তালিকায় ছিলাম।’

নিনা ঠোঁট কা*মড়ে ধরে চোখ বুঝলো। ধক ধক করে ডংকা বাজচ্ছে বুকে। ইভান ওর দিকে না তাকিয়েই বলে গেল,
‘আমি কিছু মনে করিনি। জানতাম এমনিতেই আমি সবার স*ন্দেহের তালিকায় আছি। কিন্তু তুমি যেভাবে আমার পেছনে পরেছিলা আমি দেখতে চেয়েছিলাম তুমি আসলে কতদূর জিনিসটাকে নিয়ে যাও।’

‘কিন্তু তারপর তো আমি তোমার পিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম।’

‘হ্যা। হঠাৎ সেটাও আমার ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল কেনো তুমি আমার পিছু ছেড়ে দিলা। তাই আমি তোমার আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম।’

‘তার মানে এইসব শুধু এই কারণেই ছিলো?’ ভ্রু কুঁচকে বলল নিনা। ইভানের চোখের দিকে তাকাল। তবে ইভান ওর দিকে তাকাল না। গাড়ির জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল,
‘তো তুমি কী ভেবেছিলা?

কথাটা নিনার বুকে শেলের মতো আ*ঘাত করল। ছলছল নয়নে জানালার দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ২৩
#মাহীরা_ফারহীন

বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর নিনা স্তিমিত স্বরে বলল,
‘তাহলে এতদিন সব জেনে বুঝেও কেন নাটক করে গেলা? আর যখন সব জানতেই তখন এত রাগ হওয়ার কী আছে?’

‘কারণ আমি যখন জানতে পেরেছিলাম তুমি একজন পুলিশ অফিসারের মেয়ে তখন ধরেই নিয়েছিলাম এইজন্যেই তুমি কে*সটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ। ভাবিনি যে টনিকে তুমি আগে থেকে চেনো। কিন্তু যখন যেকোনো কারণেই হোক আমার ওপর থেকে তোমার স*ন্দেহ চলেই গিয়েছিল, আমাদের সম্পর্কটা একটা সুন্দর পর্যায় পৌঁছনোর পরও কেন আমাকে বিশ্বাস করে এটা নিজেই আমাকে জানালে না? আমাকে এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারলা না?’ বলে কিছুক্ষণ মৌন থাকলো। নিনাও চুপ রইল। ও জানে না ও কী বলবে।
ইভানই পুনরায় নিরবতা ভে*ঙে বলল,
‘সেদিন রাতে তুমি স্কুলে মোটেও মোবাইল নিতে আসোনি। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম কারণ দুপুরে স্কুলের পর আমাদের নেইবারহুডে ঢোকার সময়ও তোমাকে রাস্তায় দেখেছিলাম মোবাইল হাতে। সেটা আবার স্কুলের লকারে কিভাবে পৌঁছায়?’

‘তুমি যখন ধরতেই পেরেছিলা তাহলে তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?’

‘বললাম না এমনিই।’

‘আর তুমি কেনো স্কুলে এসেছিলা? তুমিও যে আমাকে হঠাৎ স্কুলে আসতে দেখে আমার পেছনে আসোনি সেটা আমিও জানি।’

ইভান বাঁকা হাসল। বলল, ‘হুম আমরা দুজনেই বোধহয় দুজনের মোটিভ গুলো জানতাম কিন্তু কী মজার ব্যাপার না? দুজনেই অজান্তের মতো থেকে গিয়েছি।’

‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।’

ইভান প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থতা মেনে নিয়ে বলল,
‘তুমি বোধহয় জানো যে আমি আসলে কেন এসেছিলাম?’

‘হ্যা। তুমি লিজার পেছনে এসেছিলা। ওখানে যে হারিনের সঙ্গে কথা বলছিল সেটা লিজা। পুরোটা সময় আমার মনে হয়েছিল আমি একা নই। কেউ আছে… আমার আশেপাশেই। আর সেটা তুমি ছিলা।’

‘হ্যা। ঠিক ধরেছো।’

‘তুমি…মানে আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম লিজার হাতে যেই হেমলকের জন্য ইনফেকশন হয়েছে সেই হেমলক তুমি এনেছিলা কিনা। তুমি বলেছিলা সেটা তুমি এনেছো। কিন্তু ওটা মোটেও তুমি আনোনি। ইভেন ফার্স্ট প্লেসে লিজার হাতের ইনফেকশনের কথা জানতেও পারোনি নিশ্চয়ই। মিথ্যা কেনো বলেছিলা?’

ইভান অপ্রস্তুত হলো। দু’পাশে বন ঘেরা নির্জন এক রাস্তায় এসে গাড়ি থামল। কাঠ পোড়া ছাইয়ের মতো ধূসর মেঘ জমা হয়েছে মাথার ওপর। ইভান ইতস্তত করে বলল,
‘কারণ লিজা একটা গাধা! ও আমার ছোট বোন। আমি ওকে সবচাইতে ভালো করে চিনি। আমি জানি ও কী করতে পারে না পারে। ও কিছু না করেও অহেতুক বোকামি করে স*ন্দেহের তালিকায় এসে পর…. ওর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই নিনা আবার জিজ্ঞেস করল,

‘তাহলে তোমার ব্রেসলেটটা? সেটাও এমনি এমনি ওই বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল। যদি আমার ধারণা ভুল না হয় তাহলে লিজা সেদিন হয় ইচ্ছে করে অথবা হয় ভুলবশত তোমার ব্রেসলেটটা পরে গিয়েছিল আর। প্লাস ওর হাতে হেমলকের ইনফেকশন হয়েছিল সেটা অস্বীকার করতে পারো? এসবের কী যুক্তি দাঁড় করাবে?’

‘না নিনা! লিজা…..

‘না আমার কথা শেষ হয়নি!’ কঠোরভাবে বলল নিনা। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে বলল,
‘ওই দিন ওই বাড়িতে তুমি আর তোমার বোন দুজনেই গিয়েছিলা। তুমি চলে যাওয়ার পর লিজা আবারও গিয়েছিল ওখানে। আর কী মজার ব্যাপার যে সেটা সিসিটিভিতে রেকর্ড হয়নি।’

‘নিনা প্লিজ লিজাকে এর মধ্যে….নিনা পুনরায় ইভানের কথা মাঝে বলে উঠল,

‘আমি তো লিজাকে টানছি না। রহস্য জট ছাড়াতে যত ডরি গুলো টান দিচ্ছি ততই লিজা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে আমি কী করব বলো?’

ইভান সহসা গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। নিনাও ততক্ষণাৎ বাইরে বের হয়ে আসল। ধূসর মেঘের আড়াল থেকে আকাশের মৃদু গর্জন ভেসে আসছে। বাতাসের বেগ বেড়েছে। নিনা বলল,
‘ইভান তুমি যদি তোমার বোনকে বিশ্বাস করো তাহলে তো চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমি যতই ঘাটাঘাটি করে জল ঘোলা করি না কেন চিন্তা করার মতো কিছুই বের হবে না যদি না লিজা কোনভাবে এর সাথে সত্যিই জড়িত থাকে।’

ইভান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকে হাত বেঁধে চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি লিজাকে বিশ্বাস করি। ও বাইরে থেকে যেমনই হোক না কেনো ওর মনটা খুবই নরম। আমার বিশ্বাস এমন কিছু ও করতে পারে না।’

নিনা হালকা হেসে বলল, ‘তোমার বিশ্বাসের যদি মর্যাদা রেখে থাকে লিজা তাহলে তো চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’

নিনা গাড়ির সামনের অংশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বললো না। শুধু বাতাসের সা সা শব্দ। গাছের মড়া পাতা এবং ধূলো বালির উড়াউড়ি চলছে। আকাশের গর্জনের তোর বাড়ছে। দুপাশ ঘেরা ঘন বনের গাছপালা গুলো বাতাসের ঝাঁপটায় নৃত্য শুরু করেছে। ইভান হঠাৎ নিরবতা ভে*ঙে বলল,
‘শুধু একটা বন্ধুর জন্য কেউ নিজের স্কুল পাল্টিয়ে, আরেকটা নতুন স্কুলে আসে তাও আবার সিনিয়র গ্রেডে উঠে? কেউ একটা বন্ধুর জন্য রাতদুপুরে ঘুম বাদ দিয়ে ইনভেস্টিগেশন করতে বেরিয়ে পরে? কেউ তার বন্ধুর জন্য সত্যিই এতটা করতে পারে?’
বলে নিনার দিকে তাকাল। নিনা চকিতে ইভানের দিকে তাকাল। এতক্ষণে মনে হলো হৃদয় থেকে ভারি কিছু একটা নেমে গেল। নিনা একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘এদিকে আসো তোমাকে খুলে বলছি।’ ইভান কিছু বললো না কিন্তু এসে ওর পাশে দাঁড়াল ঠিকই। নিনা কথা আরম্ভ করল,

‘আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমি আমার পরিবারের সাথে ফ্লোরিডায় ট্রিপে গিয়েছিলাম। সেটাই আমাদের সপরিবারে যাওয়া শেষ ট্রিপ ছিল। আমরা একটা বিচে গিয়েছিলাম, যেখানে তীরে একটা ব্রিজ ছিল। ব্রিজের নিচে ছিল হুইয়ার্লপুল বা ঘূর্ণি ছিল। অনেক মানুষ জড়ো হতো সেটা দেখার জন্য। ব্রিজের কোন রেলিঙ ছিলো না। এবং… এবং আমি বেশি আগ্রহ দেখাতে গিয়ে ওখানে পরে যাই।’
এতটুকু বলে থামল। ইভান চমকে উঠে বলল,
‘কী?! তুমি ওই হুইর্লপুলের মধ্যে পরে গিয়েছিলা?’

নিনা সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল। বলল,
‘এবং মা আমাকে বাঁচাতে ওর মধ্যে ঝাপ দেয়। হুইর্লপুলটা অনেক বড় এবং শক্তিশালী ছিল। মা কোনরকমে আমাকে তীরে থাকা মানুষগুলোর হাতে তুলে দেয় ঠিকই কিন্তু নিজে উঠে আসতে পারে না এবং এইভাবেই আমি আমার মাকে হারিয়ে ফেলি।’ শেষের কথাটা বলতে গলা কেঁপে উঠল। ইভান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নিনা তার আগেই বলে উঠল,
‘এই ঘটনাটা শুধু বললাম যেন আমার বোনের সাথে আমার সমস্যাটা বুঝতে পারো। আমার বোনের সাথে আমার সম্পর্ক খুব সুন্দর ছিলো। কিন্তু….বলতে বলতে চোখ ছলছল করে উঠল। ধরা গলায় কোনক্রমে বলল, ‘ও মায়ের মৃ*ত্যুর জন্য আমাকেই দায়ী করতে লাগলো। ও এরপর কিছুতেই আমার সা…সাথে ভালোভাবে কথা বলতো না।’ বলতে বলতে চোখের কোটর পেরিয়ে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল। ও বলে গেল,
‘ও আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে লাগলো যে বাবা আমাদের দুজনকে একা বাসায় রেখে বের হতেই আর পারতেন না। যেমন একদিন নিমা আমাকে আলমারির মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছিল। বাবা যদি বাসায় না থাকতেন আমি বোধহয় সেদিনই মা*রা যেতাম। মায়ের চলে যাওয়ার পর থেকেই আমার এই প্যানিক এটাকের সমস্যা। বাসায়ই একা থাকতে পারি না। তখন ফাতিমা আপা ছিলো না মানে যে আমার দেখাশোনা করে আরকি। শেষে বাধ্য হয়ে নিমাকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে আসেন। এবং আমি ঘরে একা থাকব বলে আমার দেখাশোনার জন্য ফাতিমা আপাকে রাখেন।
আমি আর নিমা দুজনই তো ছোট ছিলাম। একটা বাচ্চার ওপর সেসময় এই ব্যাপার গুলো কিরকম মানসিক প্রভাব ফেলে সেটা বাবা একবারও খেয়াল করল না। সোজা নিমা কে আমাদের থেকে দূর করে দিল। এই ঘটনা ওকে বড় একটা ঢা*ক্কা দেয়। নিমা এরপর আর কখনোই বাসায় ফিরল না। ওকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি আরকি। ও আমার থেকেও বেশি জেদি। এভাবে আমার সবচাইতে প্রিয় মানুষটা, আমার বোনকে হারিয়ে ফেলি।’ বলে থামলো। হঠাৎ হাতের আঙ্গুল গলে শক্ত করে নিনার হাত ধরল ইভান। নিনা বলে গেল,
‘এর পর থেকে আমি সবসময় চুপচাপ থাকতাম। স্কুলে অনেকেই আমাকে বুলি করত। আমাকে অহংকারী ভাবত কারণ মূলত আমি চুপচাপ থাকতাম, কারো সাথেই কথা বলতাম না,পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, আমি আবার দেখতেও খুব একটা খারাপ ছিলাম না। তাই অনেকেই আমাকে দেখতে পারত না। সেসব সহ্য করতে করতে একসময় ভাবলাম আর না। আমি এমন হবো যে সকলে আমাকে ভয় পাবে। এই সমস্যার কারণে পরে বাবা আমাকে সেল্ফ ডিফেন্সের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এরপর আমাকে সেভাবে কেউ বিরক্ত করতো না। কিন্তু আমার পৃথিবী সেই দুটো মানুষের মধ্যেই থেমে রইল। বাবা এবং ফাতিমা আপা। আমার একটা ফ্রেন্ডও ছিল না। এরপর আসলো অমিত। সপ্তম গ্রেডে থাকতে একটা লিটারেচার ক্লাব জয়েন করলাম। সেখান থেকে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। এবং তারপর প্রায় দেড় বছর পূর্বে টনির সাথে বন্ধুত্ব হলো। বুঝতে পারছো যে আমার জীবনে মাত্র দুজন মানুষের পরিবারের পর বন্ধু শুধু ওরাই ছিলো? মা এবং বোনকে হারিয়ে ফেলার পর আবার! আবার আরেকজন কে হারালাম…বলতে বলতে চোখ থেকে অবিরাম অশ্রুধারা নেমে আসতে লাগলো। এবার ইভান ওকে টান দিয়ে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইভানের বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে নিজের ঠাই খুঁজে নিল। বুকের ভেতর জমে থাকা ক্লেশ, দ্বিধা, ভয় সবকিছু বের করে দিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হলো। মুহুর্তের জন্য মনে হলো পৃথিবীতে ওরা ভিন্ন আর কেউ নেই। শুধু আছে এই দুটো মানুষ এবং তাদের না বলা অনুভুতি গুলো। কিছুক্ষণ পর কান্নার দমক যখন কমে এলো তখন মাথা তুললো নিনা৷ চোখ মুখ ফুলে আছে। গাল লাল হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো গালের সাথে লেপ্টে গিয়েছিল। ইভান সেগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আর একটাও চোখের পানি ফেলবা না। যত হাই হয়ে যাক আমি তোমার পাশে আছি। তোমার সাথে আছি।’ নিনা ঝটকা দিয়ে সরে গেল ওর কাছ থেকে। নিজেকে সামলে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘
‘নাহ। তুমি তো আমার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করেছ শুধু আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার জন্য। তোমার তো আমার পাশে থাকার কথা নয়।’ ইভান মুচকি হেসে আবার নিনার হাত ধরে হ্যাচকা টানে কাছে নিয়ে এলো। কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘বোকা মেয়ে। ওটা আমি রাগ করে বলেছি।’

‘তো আসল কথাটা কী?’

‘আসল কথাটা হলো….এতটুকু বলে নিনার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘তুমি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে এমন একটা সমস্যা দাঁড় করালে যে তোমার থেকে আর দূরে থাকাটাই মুশকিল হয়ে গেল।’

লজ্জায় নিনার গাল পুনরায় র*ক্তিম হয়ে উঠল। রাস্তার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। শুঁকনো পাতাগুলো বাতাসের তোড়ে উড়াউড়ি করছে। ইভান দুষ্টু হেসে বলল,
‘এইতো লজ্জায় এমন ভেসে গেলেই তো সমস্যা। আহ! এইজন্যেই তো আসল কথা কিছু বলি না। লজ্জা পেলে যে তোমাকে সাংঘাতিক গর্জিয়াস লাগে বলেছি না?’
নিনার ঠোঁটের কোণে লজ্জা রাঙা হাসি ফুটে উঠল।
‘ওফ যাতা বলো না তো!’ বলে দূরে সরে যেতে চাইল নিনা। কিন্তু ইভানের দৃঢ় আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পেল না। তখনই এক বিকট গর্জনের সাথে মেঘ নিংড়ে বৃষ্টির পরশ ছুঁয়ে গেল ওদের। নিনা বলল,
‘চলো ফিরে যাই। ভিজে যাব তো।’

‘ভিজতে দাও।’ প্রমত্ত কন্ঠে বলল ইভান।
চারিপাশে বৃষ্টিভেজা মাটির সুবাস ছুটোছুটি করতে লাগলো। নির্জন রাস্তাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়েমুছে গেল। চারিদিকে শুধু অনবরত ঝমঝম সংগীত বেজে চললো। নিনা পানির ছটা এড়িয়ে কোনক্রমে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাউ ডু ইউ ফিল আবাউট মি?’

‘মি? নাথিং স্পেশাল।’

‘ওহ রিয়েলি? দেন আমাকে ছাড়ো।’

‘ওমা এটা কেমন কথা?’

‘কেমন কথা মানে? অহেতুক আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবা কেনো?’

‘আমার ইচ্ছা।’

‘কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই।’ বলে ইভানকে ঢা*ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল। ইভান বলল,
‘আচ্ছা আচ্ছা ফাইন। তুমি আমাকে প্ল্যান প্রোগ্রাম অনুযায়ী কিচ্ছু করতে দিবা না। বুঝেছি।’ বলে থামল। তারপর নিনার চোখের দিকে অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে বলল,
‘এটা বুঝিয়ে বলা যায় কিভাবে জানি না। বলতে পার তুমি তোমার ডেরি মিল্ক চকোলেট যতটা পছন্দ করো আমিও তোমাকে অতটাই পছন্দ করি। সারাদিন সাথে সাথে থাকতে চাই৷ তোমাকে দেখলেই আমার মনে ডেরি মিল্কের গান বাজতে আরম্ভ করে।’

নিনা হেসে উঠল, ‘বাপরে বাপ! তোমার উদাহরণ শুনে আমি শিহরিত। বাট তুমি আমাকে প্রথম থেকে বুঝতেই দাওনি সেটা। খালি বিরক্ত করতা।’

‘আমি লিটারেলি আমাদের প্রথম কনভার্সেশন থেকে তোমার সাথে ফ্লার্ট করতেসি।’

‘ধুরু ওটা দেখে মনে হতো তুমি আমার সাথে ফাজলামো করে আমাকে সিম্পলি জ্বালাচ্ছ।’

‘তাই নাকি? আমাকে এত খারাপ মনে হয়?’

‘খুব।!’

ইভান মুচকি হেসে আবার নিনাকে আলিঙ্গনে টেনে নিল। নিনা ওর বুকে মাথা রেখে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে মিশে যাওয়া হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে লাগলো। সে হৃৎস্পন্দন অত্যন্ত দ্রুত। অস্থিরতায় পূর্ণ।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ২৪
#মাহীরা_ফারহীন

“A Friend to all is a friend to none”

Taylor swift –

উক্তিটি একটা সোনালি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেওয়ালে ঝুলানো ছিল। সেটা একটু বাঁকা হয়ে থাকতে দেখে এমিলি সোজা করে দিল। ড্রইং রুমে এসে আইসক্রিম দুটো টেবিলে রেখে বসলো। নেটফ্লিক্সে ওয়েনসডে সিরিজটা চালু করল লিজা। আইসক্রিমের একটা কাপ খুলে একটা মোবাইল হাতে নিলো এমিলি। আইফোনটা দেখেই লিজা চিনতে পারল। বলল,
‘টনির মোবাইল? কোথা থেকে বের করলি?’

‘আরে ওর মোবাইল সেই যে ইনভেস্টিগেশনের পর দিয়ে গিয়েছিল তারপর খোলাই হয়নি। বাট সারাদিন ফেসবুক এন্ড ইনস্টাগ্রাম থেকে নোটিফিকেশন আসতেই থাকে।’

‘ওমা সকলেই তো মোটামুটি জানে ও আর নেই। কে এত ম্যাসেজ পাঠায়?’

‘না না ম্যাসেজ পাঠায় না। এমনি যে নোটিফিকেশন গুলো আসে, যেমন কেউ কোন স্টোরি বা পোস্ট দিয়েছে যাকে ও ফলো করে? ওইসব নোটিফিকেশন।’

‘ওহ।’ বলে টিভির দিকে চোখ রাখল লিজা। তারপর আবার বলল,
‘কিন্তু তুই এখন কী করছিস?’

‘ডিএক্টিভেট করছি এগুলো।’

‘ওহ আচ্ছা।’

লিজার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে। ও একদৃষ্টিতে টিভির বড় পর্দার দিকে চোখ স্থির রেখে দাঁত দিয়ে নখ খুটরাচ্ছে। এমিলি আড় চোখে ওকে পরখ করে জিজ্ঞেস করল,
‘ঠিক আছিস?’

‘হ্যা!?’

‘কী হইসে?’

‘আচ্ছা আসলেই কী টনির ফোনে ওই মেয়েটা…..বাকি কথাগুলো ওর কন্ঠ নালীতেই হারিয়ে গেল।

‘কোকোনাট?’ আন্দাজ করে বলল এমিলি।

‘হ্যা। ওর আইডি আছে? টনির কাছে ওর ফোন নাম্বার আছে? ও কী সত্যি সত্যিই ওর জীবনে ছিলো?’ অদম্য কৌতূহলের সমেত জিজ্ঞেস করল।

‘উম। কি জানি…শ্রাগ করে বলল এমিলি। মোবাইলটা লিজার হাতে দিয়ে বলল,
‘আমি টনিকে অবিশ্বাস করি না কিন্তু তুই চাইলে নিজেই দেখতে পারিস, তাতে যদি তোর শান্তি লাগে।’

লিজা এমন ভাবে মোবাইলটা কেঁড়ে নিল যেমন করে ক্ষুধার্থ নেকড়ে তার শিকার আঁকড়ে ধরে। ইন্সটাগ্রাম ঘেঁটে কোকোনাট নিক নেমের একটা চ্যাট পেলো। এটা আগেও দেখেছে ও। টনিই দেখিয়েছিল৷ এই মেয়েটার কথা অনেক ওর মুখে এসেছে কিন্তু কখনো তার আসল পরিচয়টা প্রকাশ করেনি। লিজা মাঝেমাঝে ভাবে, হয়তো ও টনিকে অবিশ্বাস করতে চায়নি। মনে মনে ঠিকই ওকে মাফ করে দিতে চেয়েছিল। হয়তো টনি সেই দোষটা কখনো করেইনি যার জন্য এত ভোগান্তি কিন্তু তবুও লিজা একটা ধারণা সবসময়ই মনে পুষে রেখেছে, কি হতো যদি ওকে জানিয়ে দিত এই “কোকোনাট” এর আসল পরিচয়? এটা নিয়ে এত লুকাচুরি কেন করা? লিজা ওদের চ্যাট ঘেটে এমন বিশেষ কিছু খুঁজে পেলো না। সাধারণ কথাবার্তা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কিন্তু স*ন্দেহজনক কিছু নয়। এরপর হোয়াটসঅ্যাপ খুললো। সেখানেই একই নামে সেভ করা ছিলো একটি চ্যাট। এই চ্যাটটায় বেশ কথাবার্তা ছিলো। ঠিক যেগুলো লিজা খুঁজছিল। টনির তরফ থেকে কনফেশন। জানুয়ারির ২২ তারিখ দুপুর তিনটা সতেরোতে ম্যাসেজটা পাঠানো হয়েছে।
এরপর কোকোনাট আবার সেটা গ্রহণও করেছে।

——————

টনি: ওয়েল আমি জানি না কী করছি। কেন করছি। কিন্তু কিছু আছে যা তোমাকে না বলে থাকতে পারছি না। জানি না তুমি কিভাবে কথাগুলো নিবা। আই মিন আই গেজ আইএম ইন লাভ উইথ ইউ।

কোকোনাট: ওয়াট! তুমি মজা করছো?

টনি: না আমি সিরিয়াস।

কোকোনাট: হুহ্ ঠিক আছে। আমি অবাক হয়েছি যে অন্তত এই ব্যাপারটা তুমি রিয়েলাইজ করেছো। নাহলে তো ভাবলাম তোমার সারাজীবনই বোধহয় ওই ঢঙ্গি মেয়েটার বেবি-সিটিং
করতে করতে কাটিয়ে দিবা।

টনি: কী বলতেসো? লিজার সাথে আমার এখনো ব্রেকআপ হয়নি।

কোকোনাট: গস! ফাইন আই লাভ ইউ টু। এখন তো বলো ওর সাথে ব্রেকআপ করছো?

টনি: দেখো আমি কনফিউজড। আমি তোমাদের কারোরই মন ভা*ঙতে চাই না। আমাকে একটু সময় দাও।

লিজা এতটুকু পড়তে পড়তেই ওর হাত কাঁপতে আরম্ভ করেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। রাগে কপালের শিরাগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এমিলি ওর প্রতিক্রিয়া দেখে নড়েচড়ে বসল। বলল,
‘হেই? থাম, থাম এগুলো তো আহেই পড়েছিলি ওই ইমেইল থেকে। অহেতুক এখন আবার পড়েও বা লাভ কী?।’ বলে মোবাইলটা ওর হাত থেকে নিতে গিয়েও পারল না। লিজা চোখের পলকে হাত সরিয়ে নিল। নিজের মোবাইল বের করে কোকোনাট এর নম্বরটা একে একে ডায়াল করতে লাগলো। এমিলি উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,
‘ওহ ড্যাম! লিজা তুই নতুন করে পুরনো ঝামেলাগুলোর সাথে জড়াইস না। ওকে ফোন দেওয়ার কী দরকার আশ্চর্য’

বলে টনির ফোনটা অবশেষে ছিনিয়ে নিল। কিন্তু মনে হলো না লিজা ওর কোন কথাতেই কান দিয়েছে। বরং সে নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে রসগোল্লার মতো চোখ করে তাকিয়ে আছে। কী দেখে এত অবাক হয়েছে ও দেখার জন্য এমিলি ঝুঁকে এসে স্ক্রিনে উঁকি দিলো। দেখলো যেই নম্বরটা ও ডায়েল করেছে সেটা আগেই লিজার ফোনে সেভ করা ছিল। তবে ও যেই নামে সেটা সেভ করেছে সেটা বড়ই অপ্রত্যাশিত ছিলো।

“নিনা”

লিজা ততক্ষণাৎ পুনরায় এমিলির হাত থেকে টনির মোবাইলটা কেঁড়ে নিল। ঝড়েরবেগে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এমিলি হাত থেকে মোবাইল আইসক্রিম সব নামিয়ে রেখে ছুটে গেল ওর পিছু। লিজার বেনি দুটো রীতিমতো লাফাচ্ছে ওর দ্রুত পদক্ষেপের সাথে সাথে। কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত রাগে ত্বক লাল হয়ে রয়েছে। লিজাকে এত রেগে যেতে শেষ কবে দেখেছিল এই মুহুর্তে মনে পরছে না এমিলির। লিজা নিজের সাইকেলে উঠে বসল। এমিলি উচ্চস্বরে বলল,
‘লিজা থাম! কাম ডাউন! এভাবে তুই এক্সিডেন্ট করবি। আর তুই যাচ্ছিস টা কোথায়?’

‘আমি বাসায় যাচ্ছি যেন ভাইয়াকে বলতে পারি যে ওই বিচ যাকে ও গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছে সে কতবড় একটা চি*টার!’ যতটা তিক্ত কারো কন্ঠ হতে পারে ততটাই তিক্ততা কন্ঠে ঘৃণার সঙ্গে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। এমিলি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সোনালী উষ্ণ রোদ স্নান করিয়ে যাচ্ছে এমিলির সারাদেহ। বাতাসে হালকা সোনা রঙা বাদামি চুল উড়ে চোখে এসে পরছে। সোনালি চুলগুলো ধরে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বিরবির করে বলল,
‘আমি জানতাম নিনা কে। অনেক আগে থেকেই জানতাম। আমি এটাও জানি নিনা টনির শুধু ফ্রেন্ড ছিলো। আর টনি কখনোই তোকে চি*ট করেনি। কিন্তু আমি যা জানি তা শুধু আমিই জানি। আর কেউ না।’
.
.
.
.
.
বেশ অনেকগুলো কাগজের পাতা জড়ো করে রাখা। পানিতে কফি গুলে ব্রাস দিয়ে সেটা কাগজে লাগাচ্ছে ইভান। এগুলো শুঁকিয়ে পুরনো,এস্থেটিক চিঠি লেখার পাতা বানাচ্ছে। নিজের কামড়ার মেঝেতে বসে আছে। একটা ফ্রেঞ্চ গান চলছে মৃদুস্বরে। জনালার পর্দা সরানো। সোনাবরণ রোদ জানালার কপাট চুয়ে পরছে। হঠাৎ ওর শান্তির মাঝে বিঘ্ন ঘটিয়ে গটগট পদশব্দে হেঁটে এসে কেউ দরজাটা খুললো। ইভান দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লিজার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল,
‘কী চাই?’

‘তুমি এইসব কী করছ?’

‘দেখতেই তো পাচ্ছিস। এস্থেটিক চিঠি লেখার কাগজ তৈরি করছি।’

‘ওহহো! অবশ্যই তোমার ওই সো কল্ড গার্লফ্রেন্ডকে দেওয়ার জন্য তাই না?’

‘কী!? এটা কী ধরনের কথাবার্তা?’ বিস্মিত হলো ইভান।
কপাল কুঁচকে লিজার দিকে তাকাল।

‘আমি ভুল কিছু বলিনি। নিনা কী করেছে আদৌও জানো তুমি? না না আসলে নিনা কে এটাও আদৌ জানো তুমি!?’

‘মানে টা কী? এইসব কথা কেনো বলছিস হঠাৎ করে?’
ইভান উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

‘নিনা অনেক আগে থেকেই টনিকে চিনতো। এতদিন ও জাস্ট ভান করে গিয়েছে। আমাদের সামনে নাটক করেছে। নাটক!’

ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে বলল,
হ্যা লিজা আমি জানি। আমি জানি যে নিনাকে আগে থেকে চিনতো।’

‘কীহ!? ওয়াও! জাস্ট ওয়াও! তুমি জেনেও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না? তুমি জানো নিনাই কোকোনাট? জানো নিনার সাথে মিলেই টনি আমাকে চিট করেছে!?’

এবার ইভান আরেক দফা বিস্মিত হলো। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ওয়েট ওয়েট কী? এইসব কী বলছিস? কোথা থেকে জেনে আসছিস এইসব?’

লিজা টনির মোবাইলটা সামনে তুলে ধরল। সেই চ্যাটগুলো বের করে পড়তে দিল। ইভান মনোযোগ দিয়ে সেগুলো পড়ার পর বলল,
‘বুল*শিট! এইগুলা ফেক।’

‘বাপরে বাপ প্রেমের কী পট্টি পরেছে তোমার চোখে। ঠিক আছে খুব ভালো কথা। তাহলে ব্যাপারটা আমাকেই দেখতে দাও।’ দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলে ঝড়েরবেগে বেরিয়ে গেল। ইভান উচ্চস্বরে বলল,
‘দাঁড়া! উল্টা পাল্টা কিছু করিস না!’
বলেই তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে নিজের মোবাইল ও মানিব্যাগটা হাতে নিল। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পা লেগে ওর কফি গোলা পানিটাও পরে গেল। ইভান সেসব দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখে ওর গাড়িটা নেই। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ওহ শিট! ওই রাগের মাথায় আবার ড্রাইভ করতে গেসে!’
.
.
.
.
.
‘আমি ফুড কালার খুঁজে পাচ্ছি না।’ কেবিনেটের মধ্যে প্রায় ঢুকে গিয়ে বলল নিনা। এ্যাভরিলের হাত ডোয় মাখা। কল ছেড়ে হাত ধুয়ে নিয়ে নিনার পাশে এসে দাঁড়াল। বেকিং পাউডারের বয়ামের পেছন থেকে ফুড কালারের ছোট শিশিটা বের করে আনলো। নিনা বিচলিত ভাবে হেসে বলল,
‘আমি এতবছর এ বাড়িতে থেকেও জিনিসপত্র খুঁজে পাই না। আই এম জেলাস। তুমি কিভাবে পারো?’

‘কারণ আমি তোমার রান্নাঘরে বেশ কয়েকবার রান্না করেছি। তুমি রান্নাঘরের ধার দিও যাও না। কোন বই না পড়লে কিভাবে জানবা তার ভেতরের কাহিনী কী?’

‘রিজোনেবল।’

এ্যাভরিল গোলাপি ফুড কালারটা এনে কয়েক ফোটা ডো তে দিল। আরেকটা বোলে আলাদা করে রাখা ডো তে পার্পল রঙের ফুড কালার দিল। তারপর সেগুলো বেলতে লাগলো।

‘আমি কী দেখতে পারবো না রান্নাঘরটার কী অবস্থা করছিস তোরা?’ বলে ফাতিমা আপা ভেতরে উঁকি দিলেন।

এ্যাভরিল ততক্ষণাৎ বলল,
‘না না না।৷ আপা আপনি বাইরে থাকেন। আমরা এক ডিব্বা কুকিজ বানিয়ে তবেই বের হবো।’
উনি মুচকি হেসে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বেজে উঠল। নিনা ও এ্যাভরিল দুজনেই রান্নাঘরেই রইল। ফাতিমা আপা গেলেন দরজা খুলতে। ক্ষণকাল পর ফাতিমা আপা রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বললেন,
‘একটা মেয়ে এসেছে। বলছে তোর সাথে দেখা করতে চায়।’
নিনার দিকে তাকিয়ে বললেন।

‘কে এসেছে?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘মেয়েটা বলল ওর নাম লিজা।’

‘লিজা কেন এসেছে?’ নিনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল এ্যাভরিল।

‘নো আইডিয়া। দাঁড়াও দেখছি।’

‘যাও। আমি হাত ধুয়ে আসছি।’

‘হুম।’ বলে রান্নাঘর ছাড়ল। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখা গেল লিজা সামনের ইয়ার্ডে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। সবসময়ের মতোই দুবেনি করা চুল। কপালে গভীর ভাজ। নিনা বাইরে বের হয়ে দরজা বন্ধ করল। লিজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ও থেমে গেল। নিনার দিকে এমন একটা দৃষ্টিতে তাকাল যেন ওকে দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম করে দিতে চাইছে। নিনা কিছু বলার পূর্বেই একটা হাত এসে পরল ওর গালে। আচমকা চড়টা হতভম্ব করে দিল নিনাকে। পরমুহূর্তেই ক্রোধ উথলে উঠল মাথায়। কঠিন স্বরে বলল,
‘আর ইউ ম্যাড! কোন সাহসে তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ?’

তখনই পেছনে দরজা খোলার শব্দ হলো। এ্যাভরিল নিনার পেছনে এসে দাঁড়াল। লিজার চোখমুখ রাগে জর্জরিত। ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
‘তুমি!..তুমি এমন নিকৃষ্ট একটা কাজ কিভাবে করলা! আমি ভাবতেও পারিনি তুমি….

‘মানে কী? কী করেছি আমি? আর যাই করেছি তার জন্য তোমাকে কে অধিকার দিয়েছে আমার গায়ে হাত তোলার!?’

‘ওহ প্লিজ এমন ভান করো না যে কিছু জানো না। তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনেছি এখন। তুমি টনির গার্লফ্রেন্ড! তুমি! তোমার সাথে মিলে ও আমাকে চি*ট করেছে!’

‘ওয়াট!’ নিনার চোখ বিস্ফারিত হলো।

‘আর ইউ আউট ওফ ইউর মাইন্ড? এইসব ফাউল কথা কোথা থেকে জেনে এসেছো?’ বলল এ্যাভরিল।

‘ওটা ম্যাটার করে না। আমার কাছে ইনাফ প্রুফ আছে ওকে দোষারোপ করার।’

‘তাই? কোথায় দাও। আমিও দেখি না জেনেও কিভাবে কোন রিলেশনে ছিলাম।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল নিনা।

লিজা ওর হাতে থাকা টনির ফোনটা অন করল। তারপর সেটা এ্যাভরিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘টনির ফোন এটা। নিনা আর ওর চ্যাট গুলো চেক করো একবার। শুধু এটা না আমার কাছে আগেও ওদের চ্যাটের স্ক্রিনশটের ছবি এসেছে। ওর ফোনে কোকোনাট নামে যেই নম্বরটা সেভ করা সেটা নিনার নম্বর। আর কিছু?’

এ্যাভরিল কয়েক ঝলক দেখলো সেগুলো। নিনা সেদিকে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করলো না। এ্যাভরিল ফোনটা লিজার ধাতে পুনরায় ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এইগুলো সব ফেক। আই উইশ তুমি তোমার ব্রেইনটার সঠিক ব্যবহার করতা।’

‘ওহ প্লিজ সাট আপ! আর নিনা তুমি। তোমার মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে কেন? তোমার ট্রু ক্যারেক্টার এক্সপোজ হয়ে গিয়েছে তা….বলতে না বলতেই নিনা সজোড়ে চড় মা*রলো ওকে।

তখনই একটা সাইকেল এসে থামল বড় গেটের সামনে।
সোনালী রোদের বিপরীতে সাইকেলের ছায়া পরল রাস্তায়।
ইভান তাড়াহুড়ো করে সাইকেল থেকে নেমে সেটা ফেলে দিয়ে ছুটে আসল। লিজা গাল চেপে ধরে রাগে ফেটে পরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই ইভান এসে ওর হাত খা*মচে ধরল। কঠিন স্বরে বলল,
‘স্টপ ইট! এখানে সিন ক্রিয়েট করছিস কেন?’

লিজা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে চোখ ফেরাল।
‘তুমি এমন ভাবে বলছো যেন কিছুই হয় নি! আমি তোমাকে বলিনি যে এই মেয়েটা কী করেছে?’ নিনার দিকে ইশারা করে বলল।

নিনা বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান বলল,
‘ওহ শিট! আমরা সেগুলো নিয়ে ঠান্ডা মাথায়ও কথা বলতে পারতাম। এগুলো নিয়ে বারাবাড়ি করার কোন মানেই হয় না। আর…..
লিজা মাঝখান দিয়ে বলল,
‘ওকে জিজ্ঞেস করছ না কেনো ও এমন কেন করলো? কেন!’

‘উম’হু আমি তো কিছু করিনি। তুমি আমার ওপর যেই অপবাদটা দিচ্ছ সেটা পুরোটাই মিথ্যা। আর আমি সেটা প্রমাণও করতে পারি।’ ঠান্ডা ভাবে বলল নিনা।

‘সত্যি? কী প্রমাণ করবা তুমি? নাথিং!
দেয়ার ইজ নাথিং ইউ ক্যান প্রুভ।’

‘লিজা আর একটাও কথা না। বাসায় চল এখন!’

‘ওহ না ভাই। তুমি এই ফিলথি উইচটার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়ে…….

‘ইনাফ!’ প্রায় হুংকার দিয়ে বলল ইভান। লিজা ঝট করে চুপ হয়ে গেল। ওকে টানতে টানতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। জোর করে ভেতরে বসিয়ে দিয়ে দরজা লক করে দিল৷ লিজা প্রথমেই গাড়ি নিয়ে একা চলে এসেছিল ফলে পরে ইভানকে সাইকেল নিয়ে আসতে হয়েছে। ইভান দ্রুত পায় নিনার সামনে এসে দাঁড়াল। লজ্জিত ভাবে বলল,
‘লিজার তরফ থেকে সরি। ও বেশি ওভার রিয়্যাক্ট করেছে। বাট… এতটুকু বলে বিরতি দিল। নিনা নিশ্চুপ ভাবে বাউন্ডারি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ভরা শূন্যতা। নিনা জিজ্ঞেস করল,
‘বাট? তুমি বিশ্বাস করো ওর দেখানো স্ক্রিনশট গুলোকে?’

‘না করিনা। কিন্তু আই মিন তোমাদের কোন সম্পর্ক ছিল সেটা সম্ভব না। আমি বিশ্বাসও করি না। কিন্তু তবুও কে করবে এগুলো? ওদের মাঝে ঝামেলা লাগিয়ে কে কী পাবে? আর এত মানুষ থাকতে তোমার নামই বা কিভাবে জড়িয়ে গেল এর সাথে? কোথা থেকেই বা এলো এইসব…এতটুকু বলে নিশ্চুপ হয়ে গেল। নিনা তীব্র কন্ঠে বলল,
‘আমি বুঝে গিয়েছি যা বোঝার।’

এবার ইভান নিশ্চুপ রইল। দ্বিধা এবং অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসছে যেন ও। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের নিরবতাই বছর সমান মনে হলো। অবশেষে ইভান বলল,
‘তুমি যদি কখনো টনিকে পছন্দ করেও থাকো আমি তোমাকে দোষারোপ করবো না। যে চলে গিয়েছে সে তো চলেই গিয়েছে।’

ইভান কী বুঝতে পারল নিনার ভেতরে কী চলছে? বুঝতে পারল ওর হৃদয়ে ধারা*লো কাঁ*চের টুকরো বিঁ*ধে তা র*ক্তাক্ত হয়েছে। নিনার অসাঢ় লাগলো। নিজের ভেতর, বাহির, আশপাশের পরিবেশ, মানুষজন সবকিছুকে অসহ্য, অসহনীয় মনে হলো। ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইভানের চোখের দিকে তাকাল। নিনার গাঢ় বাদামি চোখের মণি স্থির। সম্পূর্ণ মুখ ভাবলেশহীন। কোমড় হতে একটু উঁচু লম্বা চুল গুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করা। নিনা অস্বাভাবিকভাবে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ইভান টনির সাথে আমার কোন রিলেশন ছিলো না সেটা আমি প্রমাণ করব। বাট আমাকে যে বিশ্বাস করে না তার প্রতি আমার আর কোন আশা নেই।’
বলেই গটগট করে ঘুরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এ্যাভরিল কঠোরভাবে বলল,
‘আমি তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি ইভান।’
বলে নিজেই চলে গেল।
————————–

‘হ্যালো হেনরি।’

‘গুড আফটারনুন ম্যাডাম। অনেক দিন পর আমার কথা মনে পরলো?’

‘আহ হ্যা। ভালো আছো?’

‘ওয়েল আমি ভালো না থাকলে সেটা তোমার বাবার দোষ।’

‘জানি জানি বাবা অনেক স্ট্রিক্ট। বাই দ্যা ওয়ে আমার একটা হেল্প লাগবে।’

‘অবশ্যই বলো।’

‘আমি একটা ইমেইল এড্রেস পাঠাচ্ছি। সেটার লোকেশন ট্র্যাক করে দিতে হবে।’

‘হোয়াট!? বাট এটা ইলিগ্যাল।’

‘আই নো। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই জরুরি এবং টনি গ্রেউড মা*র্ডার কে*সের সঙ্গে জড়িত।’

‘মি.মালিক জানেন এ ব্যাপারে?’

‘অবশ্যই। তুমি চাইলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে তারপরই কাজ করো। বাট ইমেইল এড্রেসটার মালিক কে সেটা আমার জানতে হবেই।’

‘আচ্ছা আমি মি.মালিকের সঙ্গে কথা বলছি। তারপর দেখছি কী করা যায়।’

‘ওকে। গুড বায়।’ ফোট কেটে দিয়ে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিনার। নিজের কামরার বিছানায় বসে আছে। পড়ার টেবিলে বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। সেই কখন পড়তে বসেছিল এখনো সেগুলো গোছানো হয়নি। মাঝে মাঝে ঘর এলোমেলো হয়ে থাকলে খুব মনে পরে মায়ের কথা। উনি সবসময়ই বকা দেওয়ার বদলে নিনাকে ক্যাডবেরি চকলেটের লোভ দেখিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিতেন।

‘নিনা? নিনা।’ এ্যাভরিলের ম্লান কন্ঠে চমকে উঠল নিনা।
দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো ওর হাঁকডাক। বিকেলের এই ঘটনার পর নিনা এসে নিজের কামরার দরজায় ছিটকিনি দিয়ে বসে আছে। এখন সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমেছে।

‘নিনা প্লিজ এখন দরজা খোল। দেখো ফাতিমা আপাও চিন্তিত হচ্ছেন। আচ্ছা আই প্রমিজ তোমাকে একদম ডিস্টার্ব করবো না। শুধু দরজাটা খোল।’

নিনার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। এ্যাভরিলের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছোঁয়া। নিনাকে দেখা মাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নিনা বলল,
‘ভেতরে আসতে পারো।’ বলেই পুনরায় গিয়ে বিছানায় বসল। এ্যাভরিল এসে সিঙ্গেল সোফায় বসল। নিনা উদাসীন নয়নে ওর দিকে তাকাল। ওর লালচে বাদামি ট্রেইট চুল গুলো কাঁধের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। গালের ফ্রেকল গুলো আজ খুব বেশিই চমকে উঠছে। এখন ছোটছোট তীক্ষ্ণ তবে মায়াবী চোখে উদ্বিগ্নতা এবং কৌতূহল ভর করছে। সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে ও। নিনা বলল,
‘কিছু বলবা?’

‘হুম আই মিন…. বাইরে থেকে তোমার কথা বলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। তাই ভাবলাম…এতটুকু বলে থেমে গেল।

‘যে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি?’

‘আরে না না।’

‘আমি হ্যানরির সঙ্গে কথা বলছিলাম।

‘হ্যানরিটা কে?’

‘ হ্যানরি একজন প্রোফেশনাল হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার। আমার বাবার আন্ডারে কাজ করে। চাচ্ছিলাম যে লিজাকে যেই ইমেইল এড্রেস থেকে স্ক্রিনশট গুলো পাঠানো হয়েছে সেটার আসল মালিককে খুঁজে বের করতে। যে স্ক্রিনশট গুলো পাঠিয়েছে সেই এই ঝামেলা টা সৃষ্টি করেছে।’

‘কিন্তু কে টনি এবং লিজার মধ্যে এভাবে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে? এমন নয় তো যে কেউ টনিকে বা লিজাকে পছন্দ করত?’ প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল এ্যাভরিল।

‘হয়তো।’

‘কিন্তু টনির জন্য করে থাকলে লাভ কী? তার সেই চাওয়াটা কখনোই আর পূর্ণ হবে না।’

‘একবার শুধু মানুষটাকে খুঁজে বের করতে দাও। তারপর এত সহজে পার পাবে না সে। ওই মানুষটার জন্যই মৃ*ত্যুর পূর্বে কয়েক মাস পর্যন্ত টনি ডিপ্রেশড ছিলো, ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলো।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল নিনা।

‘হুম। খুব কষ্ট দিয়েছে ওকে।’ স্তিমিত স্বরে বলল এ্যাভরিল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।