মনোভূমির ছায়া পর্ব-১৯+২০+২১

0
57

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১৯
#মাহীরা_ফারহীন

পরিষ্কার নীল আকাশে ছিন্নভিন্ন পেলব সাদা মেঘগুলো অজানা গন্তব্যে ভেসে চলেছে। মন ভালো করা মিষ্টি ফুরফুরে বাতাস পরশ বুলিয়ে যায় গাছপালা, ঘরবাড়ি। তিনতলা লম্বা স্কুল বিল্ডিংয়ের পাশের স্যাকামোর গাছগুলোর ঝাঁকড়া ডালের আড়ালে কোন অচেনা পাখি সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেছে। আজকের কোন ফাজিল ছাত্রছাত্রীর বদৌলতে অফিস রুমে আ*গুন ধরে গিয়েছিল। কাজেই পরপর দুটো পিরিয়ডের ক্লাস ডিসমিস করা হয়েছে। ফলে সকল শিক্ষার্থীরাই এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। সবগুলো করিডোর, ক্যাফেটেরিয়া, প্লেগ্রাউন্ড কোলাহল পূর্ণ।
এদিকে এমিলি বেশ কয়েকজনকে ক্যাফেটেরিয়ায় জড়ো করেছে গেম খেলার জন্য। একটা টেবিল মাঝে রেখে তার চারপাশে একেকটা চেয়ার নিয়ে বসেছে সবাই। নিনাকেও ওদের জোড়া-জাড়িতে অগত্যা বসতে হয়েছে। মাঝের লাল টেবিলে একটা কাঁচের বোতল রাখা। এমিলি বোতলটা হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরে বলল,
‘এটা কিন্তু ট্রুথ এন্ড ডেয়ার নয়। এটার নাম হলো ‘হু নোজ হুজ সিক্রেট’। এটা খেলার নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকে আমরা বৃত্তাকারে বসেছি। ঠিক সেভাবেই একজন থেকে শুরু করে তার পরের জন পালা করে প্রশ্ন করবে। এবং সে কাকে প্রশ্ন করবে এবং কে উত্তর দেবে এটা নির্ধারণ করবে এই বোতলটা। বলে হাতে থাকা বোতলটা ঝাঁকাল। এরপর আবার বলল, ‘বোতলের মুখ যার দিকে পরবে তাকে প্রশ্ন করা হবে এবং বোতলের বটম যার দিকে পরবে সে উত্তর দিবে। আর মূল মজাটা হলো যাকে প্রশ্ন করা হবে সে একদম চুপ থাকবে। উত্তরদাতা যা জানে একদম সত্য বললে অথবা তার সম্বন্ধে উলটাপালটা উত্তর দিলেও সে সেটা সংশোধন করতে পারবে না। ওকে? সো লেট দ্যা গেম বিগিন!’

বলে বোতলটা মাঝে রাখল। সর্বপ্রথম এমিলিই শুরু করবে। ও বোতল ঘোরাল। এর মুখ গিয়ে থামল কাইলির দিকে। এবং এর তলা থামল ক্লোইর দিকে। এমিলি দুষ্টু হাসল। জিজ্ঞেস করল,
‘সো কাইলি তুমি সত্যিই জেনিফার এনিস্টোন এন্ড ডেভিড সুইমারকে নিউইয়র্কের একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে দেখেছিলা?’

‘অবশ্যই ও দেখেছিল। এবং ফান ফ্যাক্ট কাইলিই কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে ওদের ডেটিংয়ের গুজবটা ছড়িয়েছিল।’
বলল ক্লোই। সকলেই হেসে উঠল। নিনা এই গেম কখনো খেলেনি। কিন্তু মাত্র বুঝতে পারল এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে একে অপরকে রোস্ট করা। আর কিছুই না। কাইলি লজ্জায় হাঁটুতে মুখ গুঁজল। এমিলির পাশে লিজা বসে। সে বোতল ঘোরাল। মুখটা গিয়ে পরল অমিতের দিকে। এবং তলানিটা রোজের দিকে। লিজা উচ্ছসিত কন্ঠে বলল, ‘তুমি কি সত্যি সত্যিই স্কুলের ওই ফ্রিকস গ্রুপের সদস্য ছিলে?’
অমিতের মাথায় হাত পরল। স্কুলের ফ্রিকস গ্রুপে থাকার চেয়ে হয়তো বেশি ইমব্যারেসিং আর কিছুই হতে পারে না। ওটা আগাগোড়া পাগল ছাগলের দল। এটাই সবাই বলে আরকি। রোজ হেসে বলল, ‘নট অনলি ফ্রিকস গ্রুপ বাট অমিত স্কুলের সকল গ্রুপের সদস্যই ছিল। আনফরচুনেটলি কোনটাতেই টিকতে পারে না।’
অমিত মুখে হাত চাপা দিল। সকলে হেসে উঠল। নিনাও হালকা হাসল। এরপর একে একে আরো কয়েকজন বোতল ঘোরাল। বোতল নিনার হাতে আসতেই ও সেটা ঘোরাল। এর মুখ পরল অরল্যান্ডোর দিকে এবং তলার দিকটা পরল লিজার দিকে। নিনা এক মুহূর্ত ভাবল। ওদের ইতিহাস তেমন কিছু জানা নেই ওর। তবুও একটু ভেবে জিজ্ঞেস করল,
‘বন্ধুদের কাছে তুমি কী হিসেবে পরিচিত?’

লিজা সাথে সাথে উত্তর দিল, ‘পার্ফেক্ট গায়? ওহ না না ব্রিটিশ বয় না না ওয়েট ওয়েট!’

‘আরে কী লিজা? কতগুলা নাম দিবা ওর?’ বলল রোজ।

লিজা আবারও ভেবে নিয়ে বলল, ‘ওহ না চিজি বয়! টনির মোবাইলে এটাই সেভ করা ছিল।’ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল ও।

‘হাহ চিজি বয় হু? বাই দ্যা ওয়ে টনির মোবাইলের কথা তুমি কিভাবে জানো?’ জিজ্ঞেস করল ওমানা।

লিজা অপ্রস্তুত হয়ে পরল। এমিলি ততক্ষণাৎ বলে উঠল,
‘আরে আমি টনি সবাই এটাই তো বলি। আমার মোবাইলেও এটাই সেভ করা।’

‘ওয়াট এভার এবার আমার পালা বোতল ঘোরানোর।’ ঘোষণা দিল অরল্যান্ডো। বোতল ঘোরাতেই এর মুখ পরল ইভানের দিকে। এবং তলা পরল অমিতের দিকে। কেন জানি এতটুকু দেখেই নিনার হাসি পেলো। যদিও অন্য কেউ এর মাঝে হাস্যকর কিছু খুঁজে পাবে না। অরল্যান্ডো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
‘গত বছর স্কুলের এনুয়াল পার্টিতে আতসবাজি ফোটানোর ব্যাপারে কিছু বলতে চাও?’

প্রায় সকলেরই চেহারায় চঞ্চলতা খেলে উঠল। মনে হলো এটা বড় আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন। যদিও নিনা কোন বছরের কোন এনুয়াল পার্টি সম্বন্ধে কিছু জানে না। ইভানের চোখে মুখে তীব্র বিচলন। অমিত একটু কেসে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘প্রিন্সিপালের বাড়ির গ্যারাজে থাকা ক্র্যাকার গুলো ইভান এনুয়াল পার্টির আগের দিন বের করে আনে। এরপর ঠিক পার্টির মাঝামাঝি সময়ে অরল্যান্ডো ও টনিদের পারফরম্যান্সের মাঝে চারিদিক আতসবাজিতে ভরে যায় ফলে ওদের পারফরম্যান্স টা বানচাল হয়ে যায়।’
ইভান কপাল চাপড়াল। অন্যরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর নিনা হা হয়ে রইল।
টনি বলেছিল ‘যে গত বছর কোন একটা পার্টিতে ওদের পারফরম্যান্স বাঞ্চাল হয়ে গিয়েছিল আতসবাজির জন্য।’ এখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা আসলে কী। এরপর আরো কয়েকজন বোতল ঘোরাল। শেষে বোতল ঘোরাল কাইলি। সেটার তলা গিয়ে ঠেকল এমিলির কাছে এবং এর মুখ লিজার দিকে। অবশ্য এটা হওয়ার কথা নয়। কারণ এমিলি ও লিজা একসাথে বসে ছিল। তবে কিছুক্ষণ পূর্বে এমিলি পানি খেতে উঠে গিয়ে আবার এসে ওর উল্টো দিকে বসেছিল। কাইলিকে দেখে মনে হলো খুব স্বস্তি পেয়েছে লিজাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে। প্রায় সাথেই সাথেই প্রশ্ন করল,
‘তোমার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ কে?’

লিজার মুখের উৎফুল্লতা মুছে গেল। এমিলি একবার লিজার দিকে তাকাল একবার কাইলির দিকে তাকাল। নিনার মনে হলো ও হারিনের নাম নিবে হয়তো। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমিলি উত্তর দিল, ‘কোকোনাট।’
সকলকেই বিভ্রান্ত দেখাল। অ্যালেক্স জিজ্ঞেস করল,
‘এরকম করলে কিন্তু হবে না। ছদ্মনাম টাম না বলে আসল নাম বলো।’

‘আরে ভাই আমরা নিজেরাও আসল নাম জানি না। কোকোনাট হিসেবেই চিনি ওকে।’

ওদের গেম প্রশ্নটা ছেড়ে এগিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু নিনা প্রশ্নটা আঁকড়ে ধরেই ভাবনায় পরে গেল। ভাবতে লাগল, ‘কোকোনাট আমার নাম। টনি এটাই তো আমার নিক নেম দিয়েছিল। এবং ওরাও জানে যে কোকোনাট নামক কোন ফ্রেন্ড টনির ছিল। কিন্তু লিজা তাকে অপছন্দ কেন করে? টেকনিক্যালি ও আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু কেন? আমি কী করেছি?’

‘নিনা? এখন তোমাকে প্রশ্ন করব।’ বলল ওমানা। ওর কথায় চমকে উঠল নিনা। বোতলের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর প্রশ্নের উত্তর দিবে জেফ্রি। জেফ্রির পাশেই ইভান বসেছিল। ওকে কানে কানে কী যেন বলল। নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
বলল, ‘হ্যা হ্যা আমি রেডি।’

ওমানা দুষ্টু হাসল। জিজ্ঞেস করল, ‘ওয়েল যেহেতু তুমি খুব রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে চলো। তবুও কখনো কী এমন হয়নি যে তুমি কখনো ভাবতেও পারোনি এমন কাজ করবা বাট ইভেনচুয়ালি করেছো?’

জেফ্রি একাই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলে নিনা স্বস্তিতে থাকত। তবে ওর পাশে তো বসে আছে মিচকে শয়তানটা। জেফ্রিকে আবারও কানে কানে কিছু একটা বললো ও।
‘ওফ এই কয়েক দিনে আসলেই ইভান আমার সম্পর্কে একটু বেশিই জেনে ফেলেছে। না জানি কী বলছে।’ ভাবল নিনা।
জেফ্রি হেসে উত্তর দিল, ‘অবশ্যই। সকলেরই ফ্লোজ এন্ড ফ্লওজ আছে। এই যেমন পরশুই তো মিড নাইট হ্যাঙ্গাউটে গিয়েছিল নিনা বাইসেনটেনিয়াল স্টেট পার্কে। ওহ হ্যা অনলি ইভানের সাথে।’

‘ওউউউ!’ শব্দ করে উঠল একসাথে অনেকে। নিনা খুব করেই বুঝতে পারল আবারও লজ্জার আইকনিক রঙে ওর গাল মেখে উঠেছে। কাজেই মুখে হাত চাপা দিল। এবার বোতল এলো নিনার হাতে। সেটা ঘোরাতেই মুখটা আবারও পরল লিজার দিকে। লিজার মুখটা ঠিক পরল এমন যে,
‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।’ এবং বোতলের তলা পরল অরল্যান্ডোর দিকে। নিনা যেন প্রশ্ন তৈরিই রেখেছিল এমন ভাবে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘কোকোনাট কে কেন পছন্দ করো না?’

লিজা কে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখা গেল। অরল্যান্ডোর হাবভাব এমন যেন ও ভালো করেই এর উত্তরটা জানে। বলল,
‘কোকোনাট কে আমরা কেউই চিনি না ঠিকই কিন্তু লিজার ওকে না পছন্দ করার বিশেষ কারণ রয়েছে। কোকোনাট ওর সবচাইতে কাছের জিনিসটা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অবশ্য আমরা এর সঙ্গে একমত নই।’

সকলেই একদম চুপ। কারো মুখে কোন রা নেই। অরল্যান্ডোর পর কাইলির বোতল ঘোরানোর কথা। সেও হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। এমিলি বলল,
‘হেই কী হলো সবার? আই গেজ গেমটা সাডেনলি ডার্ক ওয়েতে টার্ন করেছে। নো ম্যাটার চলো আমরা একটু ব্রেক নিয়ে আবার বসব না হয়।’

‘হ্যা হ্যা আমার কোমড় ব্যাথা হয়ে গিয়েছে বসে থাকতে থাকতে।’ বলল ক্লোই। ওরা সকলে উঠে গেল। নিনা উঠে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে গেল। ল্যাব রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে হলো জানালা দিয়ে ও কােন ছায়ামূর্তি দেখেছে। কৌতূহল বশত ফিরে গিয়ে ল্যাবের দরজাটা খুলল। এদিকে করিডর গুলো প্রায় নির্জন থাকে। ল্যাবের ভেতর জানালার দিকে মুখ করে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লিজা। নিনা ওকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। তারপর ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করল। সেই শব্দে লিজা পেছন ফিরে চাইল। চোখ ভরা উদাসীনতা। কেমন ক্লান্ত দেখাল। নিনা এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াল। বলল,
‘এখানে একা যে?’

‘ওখানে ভিরের মাঝে ভালো লাগছিল না।’ স্তিমিত স্বরে উত্তর দিল।

‘ওহ।’ বলে নিশ্চুপ হয়ে গেল নিনা। ওর নিস্পৃহ কন্ঠে কী যেন ছিল। নিনার মন টনটন করে উঠল। লিজার মনের ভেতরটা চোখে না দেখা গেলেও ওর মুখের ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। লিজাকে ভালো না লাগলেও এখন তার প্রতি মায়াই হলো। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘জানি কোন না কোন কারণে তোমার মন খারাপ৷ যদি চাও আমাকে বলে মন হালকা করতে পার।’ বলে থামল। লিজা মৌন রইল। নিনা আবার বলল, ‘আর যদি মনে কর আমার কাছেই সবকিছু আড়াল হয়ে রয়েছে ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি তোমার এবং টনির রিলেশনের কথা জানি।’

‘কিভাবে?’ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল লিজা।

‘ইভান বলেছে।’

‘ওহ।’ তারপর কিছুক্ষণের নিরবতা। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কেন মনে হলো যে আমার এই বিষয় সম্পর্কিত কিছু নিয়েই মন খারাপ?’

‘মনে হয়নি। এমনিই বললাম যে আমি জানি।’

লিজা আলতো করে মাথা নাড়ল। বলল, ‘আসলে আমাদের রিলেশনটা লুকোনোর মতোও কিছু ছিলো না কিন্তু আমিই চেয়েছিলাম গোপন রাখতে যেন কোন ভাবে মায়ের কানে না যায়। যদিও এসব করে কোন লাভ হয়নি। মা হয়তো জানেনি ঠিকই কিন্তু আমাদের সম্পর্কটাও তো টিকলো না।’

‘তোমার কেন মনে হলো ও তোমাকে চি*ট করেছে?’

‘মনে হয়নি বিশ্বাস করতে হয়েছে। আমি মেয়েটার সাথে টনির চ্যাটের স্ক্রিনশট পেয়েছিলাম। এরচেয়ে বড় আর কী প্রমাণ লাগে? ওদের কথাবার্তা দেখে ঘটনাটাকে অবিশ্বাস করার কোন অবকাশ ছিলো না।’

‘মেয়েটা কে ছিল?’

‘কোকোনাট। এটা বলেই সেভ করা ছিল ওর নাম। আর টনি মাঝেমধ্যেই এই মেয়েটাকে নিয়ে এটাসেটা বলতো। ও বান্ধবী হিসেবেই বলতো। আর আমিও ওকে নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর মতো কিছু দেখিনি।’

নিনা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে মুখে বিস্ময়। ধীরে ধীরে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে কপাল কুঁচকে গেল৷ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে স্ক্রিনশট গুলো পেয়েছিলা?’

‘একটা ইমেইল পেয়েছিলাম।’

‘কে করেছিল?’

‘জানি না। অপরিচিত।’

‘কী আশ্চর্য! একটা অপরিচিত ইমেইল একাউন্ট থেকে এমন সব ছবি আসল তোমার কাছে আর তুমি সেটা বিশ্বাস করে নিলা? টমি কী একবারও এ কথা শিকার করেছিল?’

‘না করেনি! কিন্তু তাতে কী? ও তো নিজেকে নির্দোষও প্রমাণ করতে পারেনি।’

‘কী আজব! এই স্ক্রিনশট গুলো ভুয়া হতে পারে বাট টনি যদি নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে হয় অবশ্যই ওর কাছে মেয়েটার সাথে চ্যাট ছিল লিস্টে বাট সেটায় এরকম কিছুই না। সেটাও ও একবারও দেখায়নি?’

‘হ্যা দেখিয়েছিল। ওকে স*ন্দেহ করার কারণে কয়েকদিন রেগে ছিল। তারপর খুব বড় মুখ করে সেগুলোই দেখাতে এনেছিল বাট গেজ ওয়াট সেগুলো দেখানোর পূর্বে দেখেও আনেনি মনে হয়।’

‘কী ছিল সেগুলোয়?’ উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।

‘যা সেই ইমেইলার আমাকে পাঠিয়েছিল।’

নিনা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। ও জানে কলম ঘোষে ঘোষে পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেলে এ কথা লিখলেও তা সত্য হওয়া অসম্ভব। কিভাবে সত্যি হবে যদি কোকোনাট নিনাই হয়ে থাকে। নিনা তো চোখ বন্ধ করে বলতে পারে টনির সঙ্গে কখনো ওর কোন রিলেশন ছিলো না। তাহলে? লিজা বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে তুমি কেন বারবার টনিকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছ?’

‘ব্যাপারটা এমন নয়। প্রতিটা ঘটনার সাইডস্টোরি থাকে।
দু’দিকের ঘটনাই শুনতে হয় নাহলে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং সৃষ্টি হয়। কী হবে যদি সত্যিই সেগুলো ভুয়ো হয়ে থাকে। এক সেকেন্ডের জন্য ধরেই নাও না।’

‘এখন আর ধরা না ধরা দিয়ে কিছু আসে যায় না নিনা। যদি টনি নির্দোষ হয়েও থাকে তাহলেও বা কী? ওকে আমরা সকলেই সবসময়ের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। এবং এই বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি শুধুই শুঁকিয়ে আসা ক্ষতটাকে তাজা করে তুলবে।’ স্তিমিত কন্ঠে বলল।

সম্পর্কের এই জটিলতা গুলো দীর্ঘশ্বাস রুপে বেরিয়ে এল নিনার বুক চিরে। লিজা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল বলল,
‘চলো তো। অনেকক্ষণ এই খালি ল্যাবে দাঁড়িয়ে আছি।’
নিনা মাথা ঝাঁকাল।
.
.
.
.
.
.
অক্টোবরের চার তারিখ। বড় বাস্কেটবল কোর্ট প্রানবন্ত চিৎকার চেঁচামেচি, হইহট্টগোলে। গ্যালারির প্রতিটি আসন ভরা। কিছুক্ষণ পরপর সমস্বরে চিৎকার করে উঠছে নির্দিষ্ট দলের সমর্থকরা। অনেকে পপকর্ন বা সফ্ট ড্রিংকস নিয়ে বসেছে। মাঝে বড় ময়দানে জমে উঠেছে খেলা। ন্যাশভিল হাই স্কুল দলের সঙ্গে ফেয়ারভিউ হাই স্কুলের বাস্কেটবল খেলা চলছে। বড় পয়েন্ট বোর্ড অনুযায়ী ন্যাশভিল চার পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছে। ওদের স্কুলের প্রায় সকলেই উপস্থিত এখানে। নিনা খেলা উপভোগ করছে ঠিকই। কিন্তু আশেপাশে কানফাটা হইচই মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। বুকে হাত বেঁধে গোমড়ামুখে চুপচাপ বসে আছে। ওর একপাশে লিজা, অপর পাশে এ্যাভরিল। কিছুক্ষণ পরপর ওরা বাঁশি বাজিয়ে লাফিয়ে উঠছে। সামনে ময়দানে ইভান দূরন্ত গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে। একপাশ থেকে বল নিয়ে প্রায়ই একাই সকলকে কাটিয়ে বাস্কেটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর মধ্যে একবার গোলও করেছে অবশ্য। ঘেমে উঠে মুখ, কান লাল হয়ে উঠেছে। মাথার চুল ঘামে ভিজে এলোমেলো হয়ে কপালের সাথে লেপ্টে আছে। নিনা হঠাৎ খেয়াল করল অনেকক্ষণ যাবৎ খেলা ও দেখেইনি। বরং ইভানের প্রতিটি চালচলন শুধু লক্ষ্য করেছে। ওর দিকেই হা করে তাকিয়ে ছিল। অবশ্য ন্যাশভিল বাসীদের আনন্দ শেষের আগ পর্যন্ত টিকলো না। শেষের দিকে এসে ফেয়ারভিউ ওদের চারটা পয়েন্ট শোধ করল একেএকে। এতেই থেমে রইল না। এরপর আরোও দুইটা গোল হয়ে গেল। ন্যাশভিলাররা দমে গেল। অপরদিকে ফেয়ারভিউয়ার রা উল্লাসিত হয়ে উঠল। শেষপর্যন্ত অনেক চেষ্টার পর ন্যাশভিলের উদ্যম পুনরায় ফিরে এলো। সেই গোলগুলো শোধ করে আর একটা অতিরিক্ত গোল করল ওরা। ফলে ন্যাশভিল ১ পয়েন্টে জিতে গেল। ফেয়ারভিউয়ের খেলোয়াড়রা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হতাশ চেহারা নিয়ে ময়দান ত্যাগ করল। অপরদিকে ন্যাশভিলাররা উল্লাসে মেতে উঠেছে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে গ্যালারিও ধীরে ধীরে খালি হয়ে আসছে। খেলা শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। লাল টকটকে সূর্যখানা দিগন্তে হেলে পরেছে। কোন শিল্পী যেন বেখেয়ালে অনেকগুলো রঙ ছুঁড়ে দিয়েছে আকাশের ক্যানভাসে। স্টেডিয়ামের পাশে বড় বড় ম্যাচল গাছ৷ কমলা পাতাওয়ালা গাছ বাতাসের তোরে মৃদু দুলছে এবং একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়ে গুলোকে। নিনা লিজা ও এ্যাভরিলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ইভানের। যেকোনো সময় সে ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে স্টেডিয়াম ত্যাগ করবে। এ্যাভরিল একটা উইন্ডব্রেকার পরে আছে। খোলা স্ট্রেইট চুলগুলো উড়ছে। তবুও কেঁপে উঠল। লিজা বলল,
‘তোমার এত ঠাণ্ডা লাগছে?’

‘হ্যা আমার ঠান্ডা বেশি লাগে। এই অক্টোবরেই কী ঠান্ডা পরেছে বাপরে বাপ।’ বলল এ্যাভরিল

‘সন্ধ্যা হয়ে এসেছে না তাই। রাতে তো ঠান্ডা বাড়ে। ওয়েদার ফোরেকাস্টে দেখলাম আগামীকালও টানা বৃষ্টি হবে।’ ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল নিনা।

‘ধুর ভাল্লাগে না এই বৃষ্টি! জানো বাগানে আমার স্নেক ট্রি বেশি পানি পাওয়ার কারণে যতবার লাগাই ততবার ম*রে যায়। ওফ!’ বিরক্ত কন্ঠে বলল লিজা।

এ্যাভরিল হালকা হেসে বলল,
‘ওটা তো ইনডোর ট্রি। বাইরে লাগাও কেনো?’

তখনই একটা হইহট্টগোলের শব্দ ভেসে এলো। ওরা চমকে সেদিকে দৃষ্টি ফেরাল। এখনো স্টেডিয়াম থেকে দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা বের হচ্ছে। সাত আটজনের একটা দল মূলত হইচই টা করছে। সেখানে সম্ভবত মা*রামা*রি লেগেছে কোন। নিজেদের দলের কয়েকজন খেলোয়াড়কে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখে কিছুটা নিকটে এগিয়ে গেল নিনা। ভিরের মাঝে দেখা গেল ইভান এবং অপরিচিত একটা ছেলে একে-অপরের গ*লা চেপে ধরেছে। সাংঘাতিক ক্রোধে ফেটে পরছে যেন ইভান। ছেলেটা কিছু একটা বলল। এতদূর থেকে শোনা গেল না যদিও। তবে তার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ ইভান সোজা ছেলেটার মুখে ঘু*ষি মা*রলো। গর্জে উঠে বলল, ‘মে*রে ফেলব কিন্তু!’
নিনা শুধু স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মিনিটের মধ্যে অবশ্য পরিস্থিতি সামলে ফেললো বাকি ন্যাশভিলাররা। লিজা এবং এ্যাভরিল সাথে সাথে ছুটে গেল ইভানের দিকে। নিনাও সেদিকেই যাচ্ছিল। তবে মাঝে অরল্যান্ডোর সামনে পরে গেল৷ হঠাৎ কী যেন মনে হতেই ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হেই ওখানে ঝামেলা হয়েছিল কী নিয়ে?’

অরল্যান্ডো ওর দিকে তাকাল। বলল,
‘ফেয়ারভিউয়ের ওই ছেলেটা তোমাদের দিকে আই মিন মূলত তোমার দিকে ইশারা করে ব্যাড কমেন্টস করছিল। আমরা ওর পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ ইভানের কানে এসব যেতেই ছেলেটার ওপর ঝাপিয়ে পরল।’

‘ওহ আচ্ছা।’ বলে নিশ্চুপ হয়ে গেল নিনা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে কনকনে ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। হৃদয় কেমন চিনচিন করে উঠল। এলোমেলো খোপা করা চুল। তবুও সামনের অল্পকিছু ছোট চুল উড়ে এসে মুখের ওপর পরছে। কপালে চিন্তার ভাজ। অরল্যান্ডো সেটা খেয়াল করে বলল,
‘এত অবাক হয়েও না। এই ধরনের ঘটনা সেই বহু আগে থেকেই ঘটছে।’

‘তাই নাকি? ওহ হ্যা সেদিন তো আর বললে না টনির সাসপেন্ড হওয়ার পেছনে ইভানের কী দোষ ছিল?’

অরল্যান্ডো কিছুক্ষণ মৌন থাকল। ওর চোখের দীপ্তি যেন নিমিষেই নিভে গেল। অত্যন্ত মৃদু স্বরে বলল,
‘সপ্তম গ্রেডে থাকতে আমাদের ব্রেন্টউডের সাথে একটা ম্যাচ ছিল। সেখানে টনির ব্যাগ থেকে ব্রেন্টউডের পক্ষ থেকে সই করা চেক পাওয়া যায়। ক্লিয়ারলি ম্যাচফিক্সিং। বাট গেজ ওয়াট? ইভানকে টনি দেখেছিল ওর ব্যাগে সেই খামটা রাখতে যদিও ও তখন অতটা গুরুত্ব দেয়নি সে ব্যাপারে…..ওর কথা শেষ না হতেই নিনা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ টনি যেটা দেখেছে সেটা যে সত্য তার প্রমাণ কী?’ প্রশ্নটা করে নিজেই আশ্চর্য বনে গেল। হয়তো প্রথমবার টনি সম্পর্কিত কোন বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললো। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না কথাগুলো। তাতে যদি টনিকে মিথ্যুক হিসেবে ধরে নিতে হয় তাও মেনে নেবে হয়তো। মরিয়া হয়ে অরল্যান্ডোর উত্তরের অপেক্ষায় রইল।
অরল্যান্ডো গাঢ় কন্ঠে বলল,
‘তার প্রমাণ হলো ইভান কখনো এটা অস্বীকার করেনি যে সেই খামটা ওই টনির ব্যাগে রেখেছিল।’

নিনার মুখে আর কোন কথা আসল না। বর্জ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল শুধু। অরল্যান্ডো ওর দিকে তাকিয়ে থাকল কোন উত্তরের আশায়। কিন্তু সেই উত্তর এলো না। নিনা বিনাবাক্যে মূর্তির মতো ঘুরে হাঁটতে শুরু করল ধীরে ধীরে। পেছব থেকে অরল্যান্ডো ডাকল, ‘নিনা?’
কিন্তু তা নিনার কর্ণকুহরে পৌঁছলো বলে মনে হলো না। হাঁটতে হাঁটতে মাথায় একটা কথাই বার বার ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে।

“মে*রে ফেলব কিন্তু!।”

“ইভানকে ওর ব্যাগে খামটা রাখতে দেখেছিল।”

“ইভান কখনো এটা অস্বীকার করেনি যে সেই খামটা ওই টনির ব্যাগে রেখেছিল।”

“হ্যা আমিই এনেছিলাম। জানতাম না তখন যে হেমলক এতটা বি*ষাক্ত একটা গাছ।’

“ইভানের ব্রেসলেট টনির কামরায় ভে*ঙে পরেছিল।”

“মৃ*ত্যুর পূর্বে টনির বাসায় যে শেষ ঢুকেছিল সে ইভান।”

“রাতে স্কুলে হারিনের সাথে ইভানই দেখা করতে গিয়েছিল।”

“টনি ইভানের বোনকে চিট করেছিল তাই ইভান টনিকে আরোও বেশি ঘৃ*ণা করত।”

“এতগুলো তাৎকালীয় ঘটনা হতে পারে না। পারে না! ইভানই হয়তো…সত্যিই বা খু*ন…করেছে।” তীব্র হর্নের শব্দে সম্বিত ফিরে পেল নিনা। সামনেই একটা গাড়ি আসছিল। কখন কিভাবে রাস্তায় চলে এসেছে কোন হুঁশ নেই৷ আচমকা ঠিক সময় মতো ফুটপাথের দিকে ঝাপ দিতেই গাড়িটা একদম ওর পাশ কেটে চলে গেল। হৃদয় তীব্র গতিতে দ্রিমদ্রিম করে বাজছে। পরে গিয়ে হাতের কনুই ছি*লে গেল। তবে ব্যাথাটা যেন অনুভবই হলো না। মনে হলো ওর হৃদয়টা হয় পাথর হয়ে গিয়েছে অথবা এমন ভাবে ভেঙে গিয়েছে যে আর কোন কিছু অনুভব করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে। পাশ থেকে একটা মেয়ে বলল,
‘আর ইউ ওকে?’ নিনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। মেয়েটা চলে গেল। খেয়াল করল একটা রোড সাইড ক্যাফের সামনেই দাঁড়িয়ে ও। ফুটপাথের ওপর চেয়ার টেবিল সাজানো। এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পরল। টেবিলে হাত ভাজ করে মাথা রেখে চোখ বুজল। ভাবল, ‘সব কিছু গোলমাল পেকে যাচ্ছে! কী হচ্ছে আমার সাথে। এখন তো আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার এত খারাপ লাগছে কেন? কেন? কেন ইভানকেই হতে হলো খু*নি? কেন শেষ পর্যন্ত আমিই বা বোকার নতো আশা করেছিলাম হয়তো…হয়তো বা ইভান জাস্ট নির্দোষ। এত মানুষ থাকতে কেন আমার ইভানকেই ভালো লাগতে হলো। নাহলে তো আর আবারও কাউকে হারিয়ে ফেলার কষ্টটা পেতে হতো না।’ ভাবতে ভাবতে ওর বন্ধ চোখের পাতা ভেধ করে এক বিন্দু জল গাল গড়িয়ে পরল। চারিপাশে কোলাহল এবং গাড়ির হর্নের অবিরাম শব্দ। ওকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলেছে কত অচেনা মানুষ নিজেদের গন্তব্যে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ২০
মাহীরা_ফারহীন

কান ফা*টা বিস্ফো*রণের মতো শব্দে আকাশ গর্জাচ্ছে। থেকে থেকে অন্ধকার ভারি পর্দায় ঢাকা আকাশ ভরে আলো ছিটকে পরছে। অনবরত ঝমঝম ঝমঝম বর্ষণের শব্দ। ঘরের প্রতিটা জানালা দরজা বন্ধ থাকার পরও কোথা থেকে যেন দক্ষিণ মেরুর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস ঘরময় জুড়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। লিভিং রুমের ল্যাম্প লাইটের টিমটিমে হলদেটে আলো জ্বলছে। সারা বাড়ি নিরবতা, নিষ্প্রাণতায় মোড়া। গা ছমছম করা তিমিরাচ্ছন্ন ভাব। নিনা বই হাতে ল্যাম্পের পাশে সোফায় বসে আছে। ‘হ্যানিবাল’ পড়ছে ও। মি. মালিক কিছুক্ষণ পূর্বে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি কোনো ত*দন্তের কাজে ন্যাশভিলের বাহিরে গিয়েছেন। ফিরতে দেরি হবে। এ্যাভরিল সন্ধ্যা সাতটার দিকেই কাজের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল। ফাতেমা আপা আজকাল কিছুটা অসুস্থ। অতএব নিনা সারা বাড়িতে একদম একা। আশেপাশে চোখের অগোচরে হওয়া প্রতিটা শব্দে চমকে চমকে উঠছে ও। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর অদ্ভুত ভারি অনুভূতি টা আষ্ঠেপৃষ্ঠে রেখেছে ওকে। একাকিত্ব ওর সবচেয়ে বড় ভয়। একদম একা থাকলে এঙ্গজাইটি এটাক হয়। নার্ভাস ব্রেক ডাউন হওয়ারও ইতিহাস আছে। তাই তো মি.মালিক কখনোই নিনাকে বাড়িতে একদম একা থাকতে দেন না। ক্যাডবেরির সফ্ট এন্ড সুইট গানটা বেজে উঠতেও নিনার বুকটা ধক করে উঠল। আঁতকে উঠে বইটাই হাত থেকে পরে যাচ্ছিল। বই রেখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো এ্যাভরিল কল দিচ্ছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝমঝম বৃষ্টির সাথে শা শা বাতাসের শব্দ শোনা গেল। এ্যাভরিলের কন্ঠ শোনা গেল বেশ দূর থেকে,
‘হ্যালো….না….নিনা….।’

‘হ্যালো এ্যাভরিল তুমি কোথায়? প্লিজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসো।’

‘হ্যাল…বের হচ্ছি….।’ এরপরের কথা গুলো শোনা গেল না। নিনা ফোন কেটে দিয়ে ম্যাসেজ দিলো।
‘তুমি বের হয়েছো?’

‘না আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই বের হবো। বাইরের অবস্থা ভয়াবহ। নেটওয়ার্কেরও বাজে অবস্থা।’

‘প্লিজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসার চেষ্টা করো। সব দোকানপাট তো লোকালিটি থেকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। এরপর উবারও তো পাবা না।’

‘হ্যা জানি। দোকান তো আমাদেরও বন্ধ দিয়েছে বাট আমরা সবাই আঁটকে আছি। প্রচন্ড ঝড়ের কারণে বের হতে পারছি না।’

‘ওহ।’

‘তুমি চিন্তা করো না। একদম ভয় পেয়েও না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরছি। আর খবরদার বাইরে বের হবা না এন্ড কেউ আসলে দরজা খোলার দরকার নাই। ওকে?’

‘ওকে।’

নিনা ফোনটা রেখে হলদেটে আলো ভরা লিভিং রুমে চোখ বুলালো। সিঁড়ি এবং রান্নাঘরের আঁধার মোড়া দিকটায় চোখ রাখতে গা শিউরে উঠল। মনে হয় যেন সেই ঘুটঘুটে আঁধারে ওত পেতে বসে আছে কোন বিদঘুটে অদৃশ্য সত্তা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অন্তরাত্মা ভেদ করে। বাইরের ধাতব চিঠি বাক্সের সঙ্গে কী যেন একটা থেকে থেকে বারি খেয়ে অলৌকিক বাজনা বাজাচ্ছে। স্নায়ুর শিরাগুলো শিরশির করে উঠছে সে শব্দে। বইটা হাতে নিয়েও আর পড়তে ইচ্ছে করল না। এই বাজে আবহাওয়ায়, গা ছমছমে পরিবেশে একা বসে কেউ হরোর থ্রিলার পড়ে? হঠাৎ কলিং বেলের তীক্ষ্ণ টিং টিং শব্দটা বাজলো। নিনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মাত্র একবার কানে এসেছে শব্দটা। আসলেই বেজেছে নাকি মনের ভুল? এ্যাভরিল এবং বাবা দুজনের কাছেই চাবি আছে। ওরা তো কলিং বেল বাজাবে না। নিনা চুপচাপ সোফায় প্রায় দম বন্ধ করে বসে রইল আরেকবার শব্দটা শোনার আশায়। একটু পরই পুনরায় বেল বাজলো। এবার খানিকটা জোরে। নিনা সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্তের দ্বিধাদ্বন্দের পর সন্তপর্ণে এগিয়ে গেল মূল ফটকের সামনের অন্ধকার করিডোরের দিকে। হৃদপিণ্ড দ্রিমদ্রিম করে বক্ষপিঞ্জরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। অ্যাড্রেনালিন হরমোনের নিঃস্বরণ বেড়ে গিয়েছে। করিডোরের বাতিটা জ্বালিয়ে বাহিরের আগুন্তুককে নিজের উপস্থিতির জানান দিতে চায় না। দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলো। ঝড়ের তান্ডবে লুকিং গ্লাস পানিতে ঝাপ্সা হয়ে আছে। আবারও কলিং বেলের শব্দে আরেক দফা চমকে উঠল নিনা। এবারের বেলের টিং টিং মিষ্টি শব্দটাও যেন কর্কশ ঠেকলো। আরো কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকার পর শুকনো ঢোক গিলে দরজাটা অবশেষে খুললো। দরজার ওপারে পোর্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে কালো একটা অবয়ব।
‘নিনা আমি ইভান।’ পরিচিত কন্ঠ কানে আসতেই নিনা পেছনে সরে গেল। করিডোরের হলদেটে আলো জ্বালিয়ে দিতেই ইভানকে দেখা গেল। বৃষ্টিতে কিছুটা ভিজে গিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সাথে লেপ্টে আছে। ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। এত সাংঘাতিক ঝোড়ো বৃষ্টির মাঝেও কিভাবে এখনো পুরো ভিজে যায়নি তা দেখেই নিনা অবাক না হয়ে পারলো না।
‘তুমি এইসময়, এখানে?’ বিস্ফারিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘আহ সরি ফর দ্যাট। আসলে হেমিং স্ট্রিটে একটা বড় গাছ পরে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

‘ওয়াট! তুমি বাসায় ফিরবা কিভাবে? ওদিকেই তো তোমার বাসা।’

‘হ্যা সেটাই। ফিরতে পারছি না এন্ড এইদিকে কোন দোকানপাট কিছুই খোলা নেই। তুমি ছাড়া আমার চেনা আর কেউ নেই।’

শুধু মাত্র দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই বাইরের বৃষ্টি মাখা ঝোড়ো বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাহিরে ইভানের গাড়ি আছে কিনা দেখার জন্য আশেপাশে তাকাল নিনা। ফ্রন্ট ইয়ার্ডের একপাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আর তখনই চোখে পরল ওর পোর্চের পাপোশের ওপর কয়েক ফোটা লালচে তরল পরে আছে। আপনাআপনি চোখ চলে গেল ইভানের বাম হাতের দিকে। বাম হাতটা র*ক্তে ভিজে চকচক করছে। এতক্ষণ কিভাবে দেখলো না নিনা? ভাবল, ‘ইভান যে হয়তো ষড়যন্ত্র করে টনিকে সাস*পেন্ড করিয়েছিল। যে… যে হয়তো
টনিকে খু*ন করেছে। একজন খু*নি। যে মাথা গরম হয়ে গেলে যেকোনো কিছু করতে পারে। গতকালই তো দেখলাম তার নমুনা। আর সেই মানুষটা এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ঝড় বৃষ্টির রাতে যখন আমি বাড়িতে একদম একা। একজন খু*নি! কি করে এসেছে ও? হাতে র*ক্ত কেন? আমি কী দরজাটা খুলে আসলেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি?’

‘নিনা!’ ইভানের ডাকে আঁতকে উঠল। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। গলা শুঁকিয়ে খসখস করছে। ইভান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে। এমন চেহারার রং উড়ে গেল কেন?’

‘তো..তোমার হাতে র*ক্ত?’

‘ওহ ওই যে গাছ পরে গিয়েছে, সেটা কয়েকজন মিলে সরানো যায় কিনা দেখছিলাম। তখনই হাতটা কেটে গেল। গাড়িতে ফার্স্টএইড ও ছিলো না।’

‘ইশ ভেতরে আসো। ব্যান্ডেজ করে দেই।’ বলেই জ্বিব
কামড়ালো। আবার এই খু*নি হতে পারে এমন মানুষকে ঘড়েও ডেকে ফেললো। কিন্তু না ডেকেও তো উপায় ছিলো না। মুখের ওপর তো আর বিপদের সময় দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। নিনা সরে দাঁড়াতেই ইভান ভেতরে ঢুকলো। দরজার পাশের স্ট্যান্ডে রেইনকোট টা খুলে ঝুলিয়ে রাখল। বৃষ্টিতে চুল গুলো ভিজে কপালের সাথে লেপ্টে আছে। নিনার হৃদয়ের ধুকপুকানির শব্দ যেন আরোও বেপরোয়া গতিতে চলছে। পাছে ভয় হয় ইভানও যদি শুনতে পায়। পরিবেশ এত ঠানৃডা হওয়ার পরও কপালে ঘাম জমে চোখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরল। নিনা আবার ভাবনায় হারিয়ে গেল,
‘বাবা কখন আসবে তার ঠিকানা নেই। এ্যাভরিল কোথায় আছে কে জানে। আমি একদম একা বাড়িতে। যদিও আমি সেল্ফ ডিফেন্সের ট্রেনিং প্রাপ্ত। কিন্তু তারপরও ও একজন খু*নি হলে, একবার খু*ন করতে পারলে আরেকবার মানুষের হাত কাপে না। আর আমি যে এতটা দূর চলে এসেছি। এতটা জেনে গিয়েছি সেটা হয়তো ও জানে। স্বাভাবিক ভাবেই ও আমাকে কাজটা শেষ করতে দিতে চাইবে না।’

‘তোমার বাড়ি এত অন্ধকার কেন? কারেন্ট এ সমস্যা?’

‘হ্যা!?’ চমকে উঠল নিনা।

ইভান নিনার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘নিনা তুমি ঠিক আছো তো?’

‘হ্যা হ্য আমি ঠিক আছি। আহ.. উম ফার্স্টএইড! ওটা আনছি।’ বলেই স্টাডি রুমের দিকে দ্রুত গতিতে চলে গেল। ক্ষণকাল পরেই লাল, সাদা বক্স এবং একটা টাওয়েল নিয়ে ফিরে এলো। ইভান এখনো দাঁড়িয়েই আছে।
‘দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

‘ভিজে আছি কেমন দেখো। আমি বসলে তোমার সোফা যাবে।’

‘আরে ধুর বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরাটা তো আমাদের কমন ব্যাপার। সোফার কিছুই হয় না। বসো।’ বলে টাওয়াল টা এগিয়ে দিল। ইভান যেই সোফায় বসল নিনা তার সামনের সোফায় বসল। ইচ্ছা করেই দূরত্ব বজিয়ে রাখল। পাশাপাশি বসার সাহস হলো না।
ইভান সোফায় রাখা বইটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ “হ্যানিবাল”? বাহ্।’

‘হুম তুমি পড়েছ?’ ব্যান্ডেজ বের করতে করতে বলল।

‘না। শুধু “সাইলেন্স অফ দ্যা ল্যাম্ব” পড়েছি। বাকিগুলোর মুভি দেখেছি।’

‘ওহ।’

ইভান থেকে প্রায় দুই তিন ফিটের দূরত্বে নিনা। কাজেই ইভানকে কিছুটা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিতে হলো। নিনা সাবধানে ওর হাত ধরে র*ক্তটা মুচ্ছে। প্রতি মুহুর্তে সতর্ক, সিংহের খাঁচায় খাবার দিতে ঢুকে কর্মচারীদের যেই অবস্থা হয় ঠিক সেরকম অবস্থা ওর। উৎকন্ঠা এবং বিচলতায় চোখ তুলে ইভানের চোখের দিকে তাকাতেই সাহস হচ্ছে না। হঠাৎ কি মনে হতে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। ইভান অনিমেষ নেত্রে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইভানের ধূসর চোখ ভরা ঘন পল্লব। ধারা*লো কাঁ*চের মতো চাপা চোয়াল। কালো চুল গুলো আদোতেই কালো নয়, গাঢ় চকোলেট রঙের। ভয়ে, অস্থিরতা, বিচলতার সঙ্গে সঙ্গে এক মন কেমন করা মুগ্ধতা এসে জায়গা করল মনের অন্তরালে। নিনা আরোও বেশি অপ্রস্তুত এবং বিব্রতবোধ করল। ভাবল, আমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছি? এতটা ভয় কিভাবে পেতে পারি একটা মানুষকে যার জন্য গতকাল চোখের পানি ফেলছিলাম। কেনোই বা আমার এতটা খারাপ লাগছিলো ও খু*নি এটা ভেবে? আর কেনোই বা এখন আমার এত অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে?’ ভাবনাগুলো কে টেনে মন থেকে সরিয়ে দিল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ইভানের হাতে মনোযোগ দিল৷ তড়িঘড়ি ব্যান্ডেজ করেই উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘এক কাপ গরম গরম কফি হলে কেমন হয়?’

‘তোমার হাতে করা যেকোনো কিছুই অমৃত।’ ঠোঁট ভরা দুষ্টু হাসি নিয়ে ব্যান্ডেজ করা হাতটার দিকে ইশারা করে বলল। নিনা হালকা হাসলো। রান্নাঘরে ঢুকে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আলো জ্বালিয়ে দিয়ে কফির দুটো কাপ বের করল। ভাবছে, ‘কী করব? ইভানের বাসায় যাওয়ার আরেকটা রাস্তা আছে কিন্তু সেখান থেকে যেতে হলে ঘুরে নেইবারহুড ছেড়ে ক্যাম্বারল্যান্ড নদীর পাশ দিয়ে ফিরে আসতে হবে। এই মারাত্মক ঝড়ের মাঝে সেটা করাটা অসম্ভব। কাজেই আপাতত ইভান এখানেই থাকবে। আমার সাথে একা! ওফ এ্যাভরিল কখন আসবা তুমি?’ ভাবতে ভাবতেই কফি বানাতে মনোযোগ দিলো। তখনই দরজায় ইভানকে দেখা গেল। প্রথমে দরজার ফ্রেমে হেলে দাঁড়াল৷ বলল,
‘এই সময় তুমি বাসায় একা কেন?’

‘আহ কারণ ঝড়ের কারণে সকলেই আঁটকে গিয়েছে কোথাও না কোথাও। এসে পরবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’ শান্ত কন্ঠে বলল নিনা। কফি মেশিনে কফি পাউডার ও পানি দিয়ে অপেক্ষা করছে৷ পরিস্থিতি সহজ করার জন্য জিজ্ঞেস করল,
‘আর তুমি এত রাতে বাইরেই বা ছিলা কেন?’

‘আমি বিকালের পরপরই একটা ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে ন্যাশভিলের বাইরে গিয়েছিলাম। নর্দান টেনেসি৷ সেখানেও বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু অবস্থা এত খারাপ না। এখানে ফিরে দেখি, ওমা দুনিয়া উল্টে যাচ্ছে!’

নিনা মুচকি হাসল। কফি মেচিনটা অন করে সেটার ূিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে থাকল। ইভান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে এসে রান্নাঘরের মাঝখানের বড় আইল্যান্ডের সামনে দাঁড়াল। আইল্যান্ডে ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিল। সেখানেই একটা ছু*রিও রাখা ছিল। যখন ও ছু*রিটা হাতে নিলো নিনার শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ইভান ওর দিকে তাকালে হয়তো চোখ ভরা স্পষ্ট আতঙ্ক লক্ষ্য করত। তবে ইভান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ছু*রি দিয়ে আপেল থেকে একটা টুকরো কেটে মুখে দিল। নিনা নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ওহ সেই বিকেলে ঘর থেকে বেরিয়েছ। এর মাঝে খাওয়া দাওয়া কী হয়েছে? খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।’

‘আরেহ না। অত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।’ বলতে বলতে ধীর পায় ঘুরে আইল্যান্ডের অপর পাশে এসে নিনার সামনা সামনি দাঁড়াল। এবার নিনার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আপেল সহ ছু*রিটা একদম নিনার সামনাসামনি ধরে আছে ইভান। নিনার হৃদপিণ্ড ডিপডিপ শব্দে প্রচন্ড তান্ডব করে চলেছে। সারা শরীরের স্নায়বিক শীরা গুলো শিরশির করে উঠছে।
ইভান ইতস্তত করে বলল,
‘আম আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছি কিছুক্ষণ ধরে। বুঝতে পারছি না তুমি কিভাবে নিবা।’
নিনা একদৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাবধানে এক হাত পেছনে নিয়ে পেছনে কাউন্টার টপের ওপর থাকা ছু*রিটা হাতে নিলো। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কোন একটা অদ্ভুত কারণে ইভান নিনার চোখে চোখ নিবদ্ধ করে রেখেছে। নিনা ভাবছে, কি বলবে ও? ও কি সত্যিই নিজের ক্রা*ইমের কথা কনফেস করে দিবে? তাহলে তো সত্যি আমি অনেক বড় বি*পদে আছি।’

ইভান একটু কেসে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
‘উইল ইউ গো আউট উইথ মি?’ কথাটা বলেই ছু*রি ধরা হাতটা নিচু করল। নিনা ওর কথা এবং কাজ উভয়েই চমকে উঠে খোলা হাত দিয়ে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার প্রভাবে ইভানের হাতে ধরা ছু*রির ধারা*লো অংশে হাত রাখলো। এবং সাথে সাথে বিস্ময়ের প্রতিক্রিয়ায় পেছনে নিজের হাতে ধরা ছু*রিটাও পরে গিয়ে তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ হলো। ইভান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর নিনার হাত বেয়ে গরিয়ে পরা কালচে লাল তরলের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘এটা তুমি কি করলা নিনা? ওহ সিট! দাঁড়াও ফার্স্টএইড আনছি।’ বলেই র*ক্তে মাখা ছু*রি ও আপেল আইল্যান্ডে ফেলে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিনা সর্বপ্রথম যেই কাজটা করল সেটা হচ্ছে, মেঝেতে পরে থাকা ছু*রিটা তাড়াতাড়ি তুলে একটা ড্রয়ারে রাখল। চোখ বন্ধ করে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। জর দিয়ে যেন ঘাম সেরেছে।
ভাবল, ‘ওফ! আমি কী পাগল? আমার সামান্য হাত কা*টা দেখে ইভান এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। গতকাল কেউ নিজেদের মধ্যে আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলেছে যেটা আমি হয়তো শুনতামও না অথচ ইভান তার নাক ফা*টিয়ে দিল? সেখানে ও কী আসলেও আমার ক্ষতি করার কথা জীবনেও ভাবতে পারে?’
ইভান ব্যস্ত পায় রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই ভাবনায় ছেদ পরল। ক্লান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল নিনা। ইভান ওর সামনে এসে ফার্স্টএইড বক্স থেকে ব্যান্ডেজ বের করল। নিনার হাতের র*ক্তটা সিঙ্কের পানিতে ধুয়ে নিল। বলল,
‘তোমার কী হয়েছে নিনা? কোন কারণে কী তুমি আতঙ্কিত? কিছু হয়েছে? তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো?’

‘কী? না… একদমই না। তোমাকে ভয় পাবো কেন? কিছুই না। আমি শুধু একা থাকতে পারি না। এঙ্গজাইটি এ্যাটাক হয়। তাছাড়া আমার র*ক্ত দেখেই কেমন জানি লাগে। তাই।’

ইভান নিনা থেকে ঠিক কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে দাঁড়িয়ে। তালুর কা*টা জায়গাটায় ব্যান্ডেজ বাঁধছে কিন্তু তাকিয়ে আছে নিনার দিকে। মোহ মেশানো সেই দৃষ্টি। রান্নাঘরের মোলায়েম আলোয় ইভানের সুদর্শন চেহারার আশেপাশে ভাসাভাসা আলো দেখতে পাচ্ছে নিনা। মাথা ঘুরছে কিনা ভেবে স*ন্দেহ হলো। ইভান অনেকটা ওর ওপর ঝুঁকে ছিল। নিনার মনে হলো ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস গালে এসে পরছে। নিনা আনমনেই যেন নিজেও সামনের দিকে এগিয়ে গেল। হয়তো দুজনেই অপ্রত্যাখ্য আকর্ষণে একে অপরের কাছাকাছি চলে এলো। দুইজোড়া ওষ্ঠ ছুঁয়ে গেল একে অপরকে। নিনার চোখ বুঁজে রয়েছে। অনুভব করল ইভানের এক হাত ওর কোমড় জড়িয়ে ধরেছে। আরেক হাত গালে। অসীম সুখে, অজানা, মোলায়েম স্বপ্ন জালের গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে ওরা। তখনই লিভিং রুম থেকে কারো শব্দ ভেসে আসতেই ছিটকে সরে গেল দুজন। সেকেন্ডের ব্যবধানে এ্যাভরিল রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টিতে ভিজে চুল, জামা সব গায়ের সাথে সিঁটিয়ে আছে। প্রথমে নিনার দিকে তাকাল তারপর ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আরে তুমি এখানে? তাই তো বলি আরেকটা কার জুতা দরজার সামনে রাখা।’

‘ইয়ে হ্যা। রাস্তা ব্লক হয়ে গিয়েছে তাই বাড়ি যেতে পারিনি।’

‘ওহ।’ বলেই আইল্যান্ডে রাখা র*ক্তে মাখা ছু*রি এবং আপেলের দিকে চোখ পরল। তারপর ওদের দিকে তাকাল। উত্তেজিত কন্ঠে ভেতরে ঢুকে বলল,
‘এইসব কী? ছু*রি আপেল র*ক্তে মেখে আছে কেন? আর তোমাদের দুজনের হাতেই ব্যান্ডেজ কেন? হাত কাঁ*টার গেম খেলছিলা নাকি?’

‘আরেহ আর বলো না। আমার তো বাইরে থেকে এক্সি*ডেন্টালি হাত কে*টেছিল। বাট উনি কী করেছে জিজ্ঞেস করো। আমি আপেল কাঁ*টার জন্য ছু*রি হাতে নিয়েছিলাম আর ও কী ভেবে যেন শক্ত করে ছু*রির সা*র্প অংশ ধরে বসেছে।’

এ্যাভরিল এমন ভাবে দুজনের দিকে তাকাল যেন ওদের দুজনের মতো বদ্ধ উন্মাদ পৃথিবীতে আরেক জোড়া নেই। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আচ্ছা যাই হোক। আমি ফ্রেস হতে গেলাম৷ তোমরা আবার কোন হাত পা কাঁ*টার গেম খেলা স্টার্ট করো না।’ বলে চলে গেল। নিনা তড়িঘড়ি কফির কাপ দুটো নিয়ে বলল,
‘চলো তো লিভিং রুমে। কতক্ষণ ধরে একজায়গায় বসে আছি।’

ইভান মাথা নেড়ে প্রথমে বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন নিনা তিনটি কাপে কফি ঢেলে নিয়ে এলো। গরম কফির কাপ তিনটা সেন্টার টেবিলে রাখল। ল্যাম্পের পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসল। ইভান বসে আছে লম্বা টানা সোফায়। এখনো ল্যাম্পের হলদে আলো ভিন্ন সারা ঘরে আর কোন আলো জ্বলছে না। ইভান কফির কাপ হাতে তুলে নিয়ে বলল,
‘গতকাল কী হয়েছিল? অমন হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়েছিলা কোথায়?’
নিনা কিছুক্ষণ মৌনতা পালন উত্তর প্রস্তুত করল। স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
‘আমার হঠাৎ খুবই শরীর খারাপ লাগছিলো। তাই তোমাদের ঝামেলায় ফেলতে চাইনি বলে ক্যাব ডেকে নিজেই চলে গিয়েছিলাম। এন্ড সরি বলেও যেতে পারিনি।’

‘ওহ্হ বাট আমাদের কোন ঝামেলাই হতো না৷ তোমার তো কিছু হয়ে যেতে পারত তাই না?’

‘হুম। কিন্তু ওইখানে কী অলরেডি কম ঝামেলা চলছিল? তুমি এইসব নিজের কী হাল করেছিলা? কে বলেছিল ওর সাথে মা*রামা*রি করতে যেতে?’

‘ওরা তোমাকে টিজ করছিল। আমি জানি না আমার কী হয়েছিল। ওরা তোমাকে নিয়ে যা যা বলছিল আমি জাস্ট কথাগুলো নিতে পারিনি।’
তখনই এ্যাভরিল প্রবেশ করল লিভিং রুমে৷ ভেজা কাপড়চোপড় সব পাল্টিয়ে এসেছে। তবে স্ট্রেইট চুলগুলো এখনো ভেজা। এ্যাভরিল এসে সোফায় বসে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার হাতের ব্যাথা ঠিক হয়েছে যে আজকে আরেকটা চোট লাগালা?’

‘তুমি হাতে ব্যাথা পেয়েছিলা?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘আহ্ তেমন কিছু না। মা*রামা*রির সময় একটু লেগেছিল আরকি।’ নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ওরা আরো প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় গল্প করে কাটিয়ে দিল। প্রায় রাত বারোটার দিকে বৃষ্টির তোর কমে এলো। বৃষ্টি না থামলেও তা গুঁড়ি গুঁড়ি আকারে হয়ে চললো। কাজেই ইভান ঝটপট উঠে পরল। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যেত হলো। ওকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগিয়ে গেল নিনা৷ দরজা খুলতেই একরাশ বরফ শীতল ঠান্ডা হাওয়া ঝুপ করে ঢুকে গেল ভিতরে। ইভান দরজা দিয়ে বের হতেই নিনা বলল,
‘হেই। ইভান একটা কথা ছিল।’

ইভান ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’

‘এরপর থেকে মুখের সামনে ছু*রি ধরে কাউকে ডেটের প্রস্তাব দিও না৷ নাহলে ভাববে হু*মকি দিচ্ছ।’ বলে মুচকি হাসলো
ইভান হাসলো। আমুদে কন্ঠে বলল,
‘ ডার্লিং তোমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে হুমকি দিচ্ছি?’ বলে ওর দিকে এক পা এগিয়ে আসল। নিনার দিকে অনিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘কাম অন গো আউট ইউথ মি নিনা।’
স্নিগ্ধ লালচে আভায় রঞ্জিত হলো ওর মুখ। লজ্জায় ইভানের দিকে চোখ তুলেই তাকাতে পারছে না। শুধুই আলতো করে হ্যা সূচক মাথা নাড়ল।

ইভান হাসল। নিনার থুতনি ধরে ওর মুখ উঁচু করে চোখে চোখ রাখলো। ইভানের ধূসর চোখের মণি করিডোরের হলদে আলোয় চিকচিক করছে। বলল,
‘শুভ রাত্রি সুইটহার্ট।’ বলেই ওকে ছেড়ে দিল। ঘুরে চলে গেল। আঁধারের মাঝে হারিয়ে গেল সে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ২০
মাহীরা_ফারহীন

কান ফা*টা বিস্ফো*রণের মতো শব্দে আকাশ গর্জাচ্ছে। থেকে থেকে অন্ধকার ভারি পর্দায় ঢাকা আকাশ ভরে আলো ছিটকে পরছে। অনবরত ঝমঝম ঝমঝম বর্ষণের শব্দ। ঘরের প্রতিটা জানালা দরজা বন্ধ থাকার পরও কোথা থেকে যেন দক্ষিণ মেরুর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস ঘরময় জুড়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। লিভিং রুমের ল্যাম্প লাইটের টিমটিমে হলদেটে আলো জ্বলছে। সারা বাড়ি নিরবতা, নিষ্প্রাণতায় মোড়া। গা ছমছম করা তিমিরাচ্ছন্ন ভাব। নিনা বই হাতে ল্যাম্পের পাশে সোফায় বসে আছে। ‘হ্যানিবাল’ পড়ছে ও। মি. মালিক কিছুক্ষণ পূর্বে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি কোনো ত*দন্তের কাজে ন্যাশভিলের বাহিরে গিয়েছেন। ফিরতে দেরি হবে। এ্যাভরিল সন্ধ্যা সাতটার দিকেই কাজের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল। ফাতেমা আপা আজকাল কিছুটা অসুস্থ। অতএব নিনা সারা বাড়িতে একদম একা। আশেপাশে চোখের অগোচরে হওয়া প্রতিটা শব্দে চমকে চমকে উঠছে ও। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর অদ্ভুত ভারি অনুভূতি টা আষ্ঠেপৃষ্ঠে রেখেছে ওকে। একাকিত্ব ওর সবচেয়ে বড় ভয়। একদম একা থাকলে এঙ্গজাইটি এটাক হয়। নার্ভাস ব্রেক ডাউন হওয়ারও ইতিহাস আছে। তাই তো মি.মালিক কখনোই নিনাকে বাড়িতে একদম একা থাকতে দেন না। ক্যাডবেরির সফ্ট এন্ড সুইট গানটা বেজে উঠতেও নিনার বুকটা ধক করে উঠল। আঁতকে উঠে বইটাই হাত থেকে পরে যাচ্ছিল। বই রেখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো এ্যাভরিল কল দিচ্ছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝমঝম বৃষ্টির সাথে শা শা বাতাসের শব্দ শোনা গেল। এ্যাভরিলের কন্ঠ শোনা গেল বেশ দূর থেকে,
‘হ্যালো….না….নিনা….।’

‘হ্যালো এ্যাভরিল তুমি কোথায়? প্লিজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসো।’

‘হ্যাল…বের হচ্ছি….।’ এরপরের কথা গুলো শোনা গেল না। নিনা ফোন কেটে দিয়ে ম্যাসেজ দিলো।
‘তুমি বের হয়েছো?’

‘না আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই বের হবো। বাইরের অবস্থা ভয়াবহ। নেটওয়ার্কেরও বাজে অবস্থা।’

‘প্লিজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসার চেষ্টা করো। সব দোকানপাট তো লোকালিটি থেকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। এরপর উবারও তো পাবা না।’

‘হ্যা জানি। দোকান তো আমাদেরও বন্ধ দিয়েছে বাট আমরা সবাই আঁটকে আছি। প্রচন্ড ঝড়ের কারণে বের হতে পারছি না।’

‘ওহ।’

‘তুমি চিন্তা করো না। একদম ভয় পেয়েও না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরছি। আর খবরদার বাইরে বের হবা না এন্ড কেউ আসলে দরজা খোলার দরকার নাই। ওকে?’

‘ওকে।’

নিনা ফোনটা রেখে হলদেটে আলো ভরা লিভিং রুমে চোখ বুলালো। সিঁড়ি এবং রান্নাঘরের আঁধার মোড়া দিকটায় চোখ রাখতে গা শিউরে উঠল। মনে হয় যেন সেই ঘুটঘুটে আঁধারে ওত পেতে বসে আছে কোন বিদঘুটে অদৃশ্য সত্তা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অন্তরাত্মা ভেদ করে। বাইরের ধাতব চিঠি বাক্সের সঙ্গে কী যেন একটা থেকে থেকে বারি খেয়ে অলৌকিক বাজনা বাজাচ্ছে। স্নায়ুর শিরাগুলো শিরশির করে উঠছে সে শব্দে। বইটা হাতে নিয়েও আর পড়তে ইচ্ছে করল না। এই বাজে আবহাওয়ায়, গা ছমছমে পরিবেশে একা বসে কেউ হরোর থ্রিলার পড়ে? হঠাৎ কলিং বেলের তীক্ষ্ণ টিং টিং শব্দটা বাজলো। নিনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মাত্র একবার কানে এসেছে শব্দটা। আসলেই বেজেছে নাকি মনের ভুল? এ্যাভরিল এবং বাবা দুজনের কাছেই চাবি আছে। ওরা তো কলিং বেল বাজাবে না। নিনা চুপচাপ সোফায় প্রায় দম বন্ধ করে বসে রইল আরেকবার শব্দটা শোনার আশায়। একটু পরই পুনরায় বেল বাজলো। এবার খানিকটা জোরে। নিনা সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্তের দ্বিধাদ্বন্দের পর সন্তপর্ণে এগিয়ে গেল মূল ফটকের সামনের অন্ধকার করিডোরের দিকে। হৃদপিণ্ড দ্রিমদ্রিম করে বক্ষপিঞ্জরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। অ্যাড্রেনালিন হরমোনের নিঃস্বরণ বেড়ে গিয়েছে। করিডোরের বাতিটা জ্বালিয়ে বাহিরের আগুন্তুককে নিজের উপস্থিতির জানান দিতে চায় না। দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলো। ঝড়ের তান্ডবে লুকিং গ্লাস পানিতে ঝাপ্সা হয়ে আছে। আবারও কলিং বেলের শব্দে আরেক দফা চমকে উঠল নিনা। এবারের বেলের টিং টিং মিষ্টি শব্দটাও যেন কর্কশ ঠেকলো। আরো কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকার পর শুকনো ঢোক গিলে দরজাটা অবশেষে খুললো। দরজার ওপারে পোর্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে কালো একটা অবয়ব।
‘নিনা আমি ইভান।’ পরিচিত কন্ঠ কানে আসতেই নিনা পেছনে সরে গেল। করিডোরের হলদেটে আলো জ্বালিয়ে দিতেই ইভানকে দেখা গেল। বৃষ্টিতে কিছুটা ভিজে গিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সাথে লেপ্টে আছে। ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। এত সাংঘাতিক ঝোড়ো বৃষ্টির মাঝেও কিভাবে এখনো পুরো ভিজে যায়নি তা দেখেই নিনা অবাক না হয়ে পারলো না।
‘তুমি এইসময়, এখানে?’ বিস্ফারিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘আহ সরি ফর দ্যাট। আসলে হেমিং স্ট্রিটে একটা বড় গাছ পরে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

‘ওয়াট! তুমি বাসায় ফিরবা কিভাবে? ওদিকেই তো তোমার বাসা।’

‘হ্যা সেটাই। ফিরতে পারছি না এন্ড এইদিকে কোন দোকানপাট কিছুই খোলা নেই। তুমি ছাড়া আমার চেনা আর কেউ নেই।’

শুধু মাত্র দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই বাইরের বৃষ্টি মাখা ঝোড়ো বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাহিরে ইভানের গাড়ি আছে কিনা দেখার জন্য আশেপাশে তাকাল নিনা। ফ্রন্ট ইয়ার্ডের একপাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আর তখনই চোখে পরল ওর পোর্চের পাপোশের ওপর কয়েক ফোটা লালচে তরল পরে আছে। আপনাআপনি চোখ চলে গেল ইভানের বাম হাতের দিকে। বাম হাতটা র*ক্তে ভিজে চকচক করছে। এতক্ষণ কিভাবে দেখলো না নিনা? ভাবল, ‘ইভান যে হয়তো ষড়যন্ত্র করে টনিকে সাস*পেন্ড করিয়েছিল। যে… যে হয়তো
টনিকে খু*ন করেছে। একজন খু*নি। যে মাথা গরম হয়ে গেলে যেকোনো কিছু করতে পারে। গতকালই তো দেখলাম তার নমুনা। আর সেই মানুষটা এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ঝড় বৃষ্টির রাতে যখন আমি বাড়িতে একদম একা। একজন খু*নি! কি করে এসেছে ও? হাতে র*ক্ত কেন? আমি কী দরজাটা খুলে আসলেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি?’

‘নিনা!’ ইভানের ডাকে আঁতকে উঠল। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। গলা শুঁকিয়ে খসখস করছে। ইভান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে। এমন চেহারার রং উড়ে গেল কেন?’

‘তো..তোমার হাতে র*ক্ত?’

‘ওহ ওই যে গাছ পরে গিয়েছে, সেটা কয়েকজন মিলে সরানো যায় কিনা দেখছিলাম। তখনই হাতটা কেটে গেল। গাড়িতে ফার্স্টএইড ও ছিলো না।’

‘ইশ ভেতরে আসো। ব্যান্ডেজ করে দেই।’ বলেই জ্বিব
কামড়ালো। আবার এই খু*নি হতে পারে এমন মানুষকে ঘড়েও ডেকে ফেললো। কিন্তু না ডেকেও তো উপায় ছিলো না। মুখের ওপর তো আর বিপদের সময় দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। নিনা সরে দাঁড়াতেই ইভান ভেতরে ঢুকলো। দরজার পাশের স্ট্যান্ডে রেইনকোট টা খুলে ঝুলিয়ে রাখল। বৃষ্টিতে চুল গুলো ভিজে কপালের সাথে লেপ্টে আছে। নিনার হৃদয়ের ধুকপুকানির শব্দ যেন আরোও বেপরোয়া গতিতে চলছে। পাছে ভয় হয় ইভানও যদি শুনতে পায়। পরিবেশ এত ঠানৃডা হওয়ার পরও কপালে ঘাম জমে চোখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরল। নিনা আবার ভাবনায় হারিয়ে গেল,
‘বাবা কখন আসবে তার ঠিকানা নেই। এ্যাভরিল কোথায় আছে কে জানে। আমি একদম একা বাড়িতে। যদিও আমি সেল্ফ ডিফেন্সের ট্রেনিং প্রাপ্ত। কিন্তু তারপরও ও একজন খু*নি হলে, একবার খু*ন করতে পারলে আরেকবার মানুষের হাত কাপে না। আর আমি যে এতটা দূর চলে এসেছি। এতটা জেনে গিয়েছি সেটা হয়তো ও জানে। স্বাভাবিক ভাবেই ও আমাকে কাজটা শেষ করতে দিতে চাইবে না।’

‘তোমার বাড়ি এত অন্ধকার কেন? কারেন্ট এ সমস্যা?’

‘হ্যা!?’ চমকে উঠল নিনা।

ইভান নিনার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘নিনা তুমি ঠিক আছো তো?’

‘হ্যা হ্য আমি ঠিক আছি। আহ.. উম ফার্স্টএইড! ওটা আনছি।’ বলেই স্টাডি রুমের দিকে দ্রুত গতিতে চলে গেল। ক্ষণকাল পরেই লাল, সাদা বক্স এবং একটা টাওয়েল নিয়ে ফিরে এলো। ইভান এখনো দাঁড়িয়েই আছে।
‘দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

‘ভিজে আছি কেমন দেখো। আমি বসলে তোমার সোফা যাবে।’

‘আরে ধুর বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরাটা তো আমাদের কমন ব্যাপার। সোফার কিছুই হয় না। বসো।’ বলে টাওয়াল টা এগিয়ে দিল। ইভান যেই সোফায় বসল নিনা তার সামনের সোফায় বসল। ইচ্ছা করেই দূরত্ব বজিয়ে রাখল। পাশাপাশি বসার সাহস হলো না।
ইভান সোফায় রাখা বইটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ “হ্যানিবাল”? বাহ্।’

‘হুম তুমি পড়েছ?’ ব্যান্ডেজ বের করতে করতে বলল।

‘না। শুধু “সাইলেন্স অফ দ্যা ল্যাম্ব” পড়েছি। বাকিগুলোর মুভি দেখেছি।’

‘ওহ।’

ইভান থেকে প্রায় দুই তিন ফিটের দূরত্বে নিনা। কাজেই ইভানকে কিছুটা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিতে হলো। নিনা সাবধানে ওর হাত ধরে র*ক্তটা মুচ্ছে। প্রতি মুহুর্তে সতর্ক, সিংহের খাঁচায় খাবার দিতে ঢুকে কর্মচারীদের যেই অবস্থা হয় ঠিক সেরকম অবস্থা ওর। উৎকন্ঠা এবং বিচলতায় চোখ তুলে ইভানের চোখের দিকে তাকাতেই সাহস হচ্ছে না। হঠাৎ কি মনে হতে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। ইভান অনিমেষ নেত্রে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইভানের ধূসর চোখ ভরা ঘন পল্লব। ধারা*লো কাঁ*চের মতো চাপা চোয়াল। কালো চুল গুলো আদোতেই কালো নয়, গাঢ় চকোলেট রঙের। ভয়ে, অস্থিরতা, বিচলতার সঙ্গে সঙ্গে এক মন কেমন করা মুগ্ধতা এসে জায়গা করল মনের অন্তরালে। নিনা আরোও বেশি অপ্রস্তুত এবং বিব্রতবোধ করল। ভাবল, আমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছি? এতটা ভয় কিভাবে পেতে পারি একটা মানুষকে যার জন্য গতকাল চোখের পানি ফেলছিলাম। কেনোই বা আমার এতটা খারাপ লাগছিলো ও খু*নি এটা ভেবে? আর কেনোই বা এখন আমার এত অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে?’ ভাবনাগুলো কে টেনে মন থেকে সরিয়ে দিল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ইভানের হাতে মনোযোগ দিল৷ তড়িঘড়ি ব্যান্ডেজ করেই উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘এক কাপ গরম গরম কফি হলে কেমন হয়?’

‘তোমার হাতে করা যেকোনো কিছুই অমৃত।’ ঠোঁট ভরা দুষ্টু হাসি নিয়ে ব্যান্ডেজ করা হাতটার দিকে ইশারা করে বলল। নিনা হালকা হাসলো। রান্নাঘরে ঢুকে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আলো জ্বালিয়ে দিয়ে কফির দুটো কাপ বের করল। ভাবছে, ‘কী করব? ইভানের বাসায় যাওয়ার আরেকটা রাস্তা আছে কিন্তু সেখান থেকে যেতে হলে ঘুরে নেইবারহুড ছেড়ে ক্যাম্বারল্যান্ড নদীর পাশ দিয়ে ফিরে আসতে হবে। এই মারাত্মক ঝড়ের মাঝে সেটা করাটা অসম্ভব। কাজেই আপাতত ইভান এখানেই থাকবে। আমার সাথে একা! ওফ এ্যাভরিল কখন আসবা তুমি?’ ভাবতে ভাবতেই কফি বানাতে মনোযোগ দিলো। তখনই দরজায় ইভানকে দেখা গেল। প্রথমে দরজার ফ্রেমে হেলে দাঁড়াল৷ বলল,
‘এই সময় তুমি বাসায় একা কেন?’

‘আহ কারণ ঝড়ের কারণে সকলেই আঁটকে গিয়েছে কোথাও না কোথাও। এসে পরবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’ শান্ত কন্ঠে বলল নিনা। কফি মেশিনে কফি পাউডার ও পানি দিয়ে অপেক্ষা করছে৷ পরিস্থিতি সহজ করার জন্য জিজ্ঞেস করল,
‘আর তুমি এত রাতে বাইরেই বা ছিলা কেন?’

‘আমি বিকালের পরপরই একটা ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে ন্যাশভিলের বাইরে গিয়েছিলাম। নর্দান টেনেসি৷ সেখানেও বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু অবস্থা এত খারাপ না। এখানে ফিরে দেখি, ওমা দুনিয়া উল্টে যাচ্ছে!’

নিনা মুচকি হাসল। কফি মেচিনটা অন করে সেটার ূিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে থাকল। ইভান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে এসে রান্নাঘরের মাঝখানের বড় আইল্যান্ডের সামনে দাঁড়াল। আইল্যান্ডে ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিল। সেখানেই একটা ছু*রিও রাখা ছিল। যখন ও ছু*রিটা হাতে নিলো নিনার শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ইভান ওর দিকে তাকালে হয়তো চোখ ভরা স্পষ্ট আতঙ্ক লক্ষ্য করত। তবে ইভান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ছু*রি দিয়ে আপেল থেকে একটা টুকরো কেটে মুখে দিল। নিনা নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ওহ সেই বিকেলে ঘর থেকে বেরিয়েছ। এর মাঝে খাওয়া দাওয়া কী হয়েছে? খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।’

‘আরেহ না। অত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।’ বলতে বলতে ধীর পায় ঘুরে আইল্যান্ডের অপর পাশে এসে নিনার সামনা সামনি দাঁড়াল। এবার নিনার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আপেল সহ ছু*রিটা একদম নিনার সামনাসামনি ধরে আছে ইভান। নিনার হৃদপিণ্ড ডিপডিপ শব্দে প্রচন্ড তান্ডব করে চলেছে। সারা শরীরের স্নায়বিক শীরা গুলো শিরশির করে উঠছে।
ইভান ইতস্তত করে বলল,
‘আম আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছি কিছুক্ষণ ধরে। বুঝতে পারছি না তুমি কিভাবে নিবা।’
নিনা একদৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাবধানে এক হাত পেছনে নিয়ে পেছনে কাউন্টার টপের ওপর থাকা ছু*রিটা হাতে নিলো। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কোন একটা অদ্ভুত কারণে ইভান নিনার চোখে চোখ নিবদ্ধ করে রেখেছে। নিনা ভাবছে, কি বলবে ও? ও কি সত্যিই নিজের ক্রা*ইমের কথা কনফেস করে দিবে? তাহলে তো সত্যি আমি অনেক বড় বি*পদে আছি।’

ইভান একটু কেসে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
‘উইল ইউ গো আউট উইথ মি?’ কথাটা বলেই ছু*রি ধরা হাতটা নিচু করল। নিনা ওর কথা এবং কাজ উভয়েই চমকে উঠে খোলা হাত দিয়ে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার প্রভাবে ইভানের হাতে ধরা ছু*রির ধারা*লো অংশে হাত রাখলো। এবং সাথে সাথে বিস্ময়ের প্রতিক্রিয়ায় পেছনে নিজের হাতে ধরা ছু*রিটাও পরে গিয়ে তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ হলো। ইভান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর নিনার হাত বেয়ে গরিয়ে পরা কালচে লাল তরলের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘এটা তুমি কি করলা নিনা? ওহ সিট! দাঁড়াও ফার্স্টএইড আনছি।’ বলেই র*ক্তে মাখা ছু*রি ও আপেল আইল্যান্ডে ফেলে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিনা সর্বপ্রথম যেই কাজটা করল সেটা হচ্ছে, মেঝেতে পরে থাকা ছু*রিটা তাড়াতাড়ি তুলে একটা ড্রয়ারে রাখল। চোখ বন্ধ করে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। জর দিয়ে যেন ঘাম সেরেছে।
ভাবল, ‘ওফ! আমি কী পাগল? আমার সামান্য হাত কা*টা দেখে ইভান এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। গতকাল কেউ নিজেদের মধ্যে আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলেছে যেটা আমি হয়তো শুনতামও না অথচ ইভান তার নাক ফা*টিয়ে দিল? সেখানে ও কী আসলেও আমার ক্ষতি করার কথা জীবনেও ভাবতে পারে?’
ইভান ব্যস্ত পায় রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই ভাবনায় ছেদ পরল। ক্লান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল নিনা। ইভান ওর সামনে এসে ফার্স্টএইড বক্স থেকে ব্যান্ডেজ বের করল। নিনার হাতের র*ক্তটা সিঙ্কের পানিতে ধুয়ে নিল। বলল,
‘তোমার কী হয়েছে নিনা? কোন কারণে কী তুমি আতঙ্কিত? কিছু হয়েছে? তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো?’

‘কী? না… একদমই না। তোমাকে ভয় পাবো কেন? কিছুই না। আমি শুধু একা থাকতে পারি না। এঙ্গজাইটি এ্যাটাক হয়। তাছাড়া আমার র*ক্ত দেখেই কেমন জানি লাগে। তাই।’

ইভান নিনা থেকে ঠিক কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে দাঁড়িয়ে। তালুর কা*টা জায়গাটায় ব্যান্ডেজ বাঁধছে কিন্তু তাকিয়ে আছে নিনার দিকে। মোহ মেশানো সেই দৃষ্টি। রান্নাঘরের মোলায়েম আলোয় ইভানের সুদর্শন চেহারার আশেপাশে ভাসাভাসা আলো দেখতে পাচ্ছে নিনা। মাথা ঘুরছে কিনা ভেবে স*ন্দেহ হলো। ইভান অনেকটা ওর ওপর ঝুঁকে ছিল। নিনার মনে হলো ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস গালে এসে পরছে। নিনা আনমনেই যেন নিজেও সামনের দিকে এগিয়ে গেল। হয়তো দুজনেই অপ্রত্যাখ্য আকর্ষণে একে অপরের কাছাকাছি চলে এলো। দুইজোড়া ওষ্ঠ ছুঁয়ে গেল একে অপরকে। নিনার চোখ বুঁজে রয়েছে। অনুভব করল ইভানের এক হাত ওর কোমড় জড়িয়ে ধরেছে। আরেক হাত গালে। অসীম সুখে, অজানা, মোলায়েম স্বপ্ন জালের গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে ওরা। তখনই লিভিং রুম থেকে কারো শব্দ ভেসে আসতেই ছিটকে সরে গেল দুজন। সেকেন্ডের ব্যবধানে এ্যাভরিল রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টিতে ভিজে চুল, জামা সব গায়ের সাথে সিঁটিয়ে আছে। প্রথমে নিনার দিকে তাকাল তারপর ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আরে তুমি এখানে? তাই তো বলি আরেকটা কার জুতা দরজার সামনে রাখা।’

‘ইয়ে হ্যা। রাস্তা ব্লক হয়ে গিয়েছে তাই বাড়ি যেতে পারিনি।’

‘ওহ।’ বলেই আইল্যান্ডে রাখা র*ক্তে মাখা ছু*রি এবং আপেলের দিকে চোখ পরল। তারপর ওদের দিকে তাকাল। উত্তেজিত কন্ঠে ভেতরে ঢুকে বলল,
‘এইসব কী? ছু*রি আপেল র*ক্তে মেখে আছে কেন? আর তোমাদের দুজনের হাতেই ব্যান্ডেজ কেন? হাত কাঁ*টার গেম খেলছিলা নাকি?’

‘আরেহ আর বলো না। আমার তো বাইরে থেকে এক্সি*ডেন্টালি হাত কে*টেছিল। বাট উনি কী করেছে জিজ্ঞেস করো। আমি আপেল কাঁ*টার জন্য ছু*রি হাতে নিয়েছিলাম আর ও কী ভেবে যেন শক্ত করে ছু*রির সা*র্প অংশ ধরে বসেছে।’

এ্যাভরিল এমন ভাবে দুজনের দিকে তাকাল যেন ওদের দুজনের মতো বদ্ধ উন্মাদ পৃথিবীতে আরেক জোড়া নেই। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আচ্ছা যাই হোক। আমি ফ্রেস হতে গেলাম৷ তোমরা আবার কোন হাত পা কাঁ*টার গেম খেলা স্টার্ট করো না।’ বলে চলে গেল। নিনা তড়িঘড়ি কফির কাপ দুটো নিয়ে বলল,
‘চলো তো লিভিং রুমে। কতক্ষণ ধরে একজায়গায় বসে আছি।’

ইভান মাথা নেড়ে প্রথমে বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন নিনা তিনটি কাপে কফি ঢেলে নিয়ে এলো। গরম কফির কাপ তিনটা সেন্টার টেবিলে রাখল। ল্যাম্পের পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসল। ইভান বসে আছে লম্বা টানা সোফায়। এখনো ল্যাম্পের হলদে আলো ভিন্ন সারা ঘরে আর কোন আলো জ্বলছে না। ইভান কফির কাপ হাতে তুলে নিয়ে বলল,
‘গতকাল কী হয়েছিল? অমন হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়েছিলা কোথায়?’
নিনা কিছুক্ষণ মৌনতা পালন উত্তর প্রস্তুত করল। স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
‘আমার হঠাৎ খুবই শরীর খারাপ লাগছিলো। তাই তোমাদের ঝামেলায় ফেলতে চাইনি বলে ক্যাব ডেকে নিজেই চলে গিয়েছিলাম। এন্ড সরি বলেও যেতে পারিনি।’

‘ওহ্হ বাট আমাদের কোন ঝামেলাই হতো না৷ তোমার তো কিছু হয়ে যেতে পারত তাই না?’

‘হুম। কিন্তু ওইখানে কী অলরেডি কম ঝামেলা চলছিল? তুমি এইসব নিজের কী হাল করেছিলা? কে বলেছিল ওর সাথে মা*রামা*রি করতে যেতে?’

‘ওরা তোমাকে টিজ করছিল। আমি জানি না আমার কী হয়েছিল। ওরা তোমাকে নিয়ে যা যা বলছিল আমি জাস্ট কথাগুলো নিতে পারিনি।’
তখনই এ্যাভরিল প্রবেশ করল লিভিং রুমে৷ ভেজা কাপড়চোপড় সব পাল্টিয়ে এসেছে। তবে স্ট্রেইট চুলগুলো এখনো ভেজা। এ্যাভরিল এসে সোফায় বসে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার হাতের ব্যাথা ঠিক হয়েছে যে আজকে আরেকটা চোট লাগালা?’

‘তুমি হাতে ব্যাথা পেয়েছিলা?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘আহ্ তেমন কিছু না। মা*রামা*রির সময় একটু লেগেছিল আরকি।’ নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ওরা আরো প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় গল্প করে কাটিয়ে দিল। প্রায় রাত বারোটার দিকে বৃষ্টির তোর কমে এলো। বৃষ্টি না থামলেও তা গুঁড়ি গুঁড়ি আকারে হয়ে চললো। কাজেই ইভান ঝটপট উঠে পরল। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যেত হলো। ওকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগিয়ে গেল নিনা৷ দরজা খুলতেই একরাশ বরফ শীতল ঠান্ডা হাওয়া ঝুপ করে ঢুকে গেল ভিতরে। ইভান দরজা দিয়ে বের হতেই নিনা বলল,
‘হেই। ইভান একটা কথা ছিল।’

ইভান ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’

‘এরপর থেকে মুখের সামনে ছু*রি ধরে কাউকে ডেটের প্রস্তাব দিও না৷ নাহলে ভাববে হু*মকি দিচ্ছ।’ বলে মুচকি হাসলো
ইভান হাসলো। আমুদে কন্ঠে বলল,
‘ ডার্লিং তোমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে হুমকি দিচ্ছি?’ বলে ওর দিকে এক পা এগিয়ে আসল। নিনার দিকে অনিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘কাম অন গো আউট ইউথ মি নিনা।’
স্নিগ্ধ লালচে আভায় রঞ্জিত হলো ওর মুখ। লজ্জায় ইভানের দিকে চোখ তুলেই তাকাতে পারছে না। শুধুই আলতো করে হ্যা সূচক মাথা নাড়ল।

ইভান হাসল। নিনার থুতনি ধরে ওর মুখ উঁচু করে চোখে চোখ রাখলো। ইভানের ধূসর চোখের মণি করিডোরের হলদে আলোয় চিকচিক করছে। বলল,
‘শুভ রাত্রি সুইটহার্ট।’ বলেই ওকে ছেড়ে দিল। ঘুরে চলে গেল। আঁধারের মাঝে হারিয়ে গেল সে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।