মনোভূমির ছায়া পর্ব-৩+৪

0
79

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৩
লেখা – #মাহীরা_ফারহীন

‘ক্যাথেরিনার অভ*দ্রতা, বদমেজাজী, ঠোঁট কাটা কথাবার্তা কী শুধুই তার ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের কারণে ছিল নাকি এর পেছনে অন্য কারণ আছে? এ বিষয়ে কি মতামত তোমাদের?’ জিজ্ঞেস করে মি.ফিলিক্স আগ্রহী দৃষ্টিতে গোটা ক্লাসের দিকে তাকালেন। এটা লিটারেচার ক্লাস। উনি শ্যাকসপিয়ারের “ট্যামিং অফ দ্যা শ্রু” রম্য নাটক পড়াচ্ছেন।
তার প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউই তেমন আগ্রহ প্রকাশ করল না। কিন্তু নিনা ঠিক তার প্রশ্ন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল বোধহয়। সাথে সাথে হাত তুললো। মি.ফিলিক্স আনন্দিত হয়ে মাথা দুলিয়ে ওকে কিছু বলার অনুমতি দিলেন। নিনা যতটা সম্ভব পরিষ্কার কন্ঠে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করল, ‘স্যার আমার মতে ক্যাথেরিনার স্বভাব মোটেও শুধুই তার চরিত্রের ওপর নির্ভর করে না। তার বাবা নিজের দুই মেয়ের মধ্যে বিয়াংকাকে ক্যাথেরিনা হতে অধিক ভালোবাসতেন। তাছাড়াও বিয়াংকার সুমিষ্ট ভাষী হওয়া থেকে শুরু করে তার বিনয়ী এবং দয়ালু স্বভাবের কারণে সকলেই তাকে যোগ্য মেয়ে এবং যোগ্য পাত্রি বলে বিবেচনা করত। অপরদিকে ক্যাথেরিনার আত্মনির্ভরশীলতা, বদমেজাজ, অভ*দ্রতা তাকে সকলের কাছেই অপছন্দের পাত্রী করে তুলেছিল। যার ফলে সে হীন*মন্যতায় ভুগত।’ টানা এতটুকু বলে এক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে থামল নিনা। বোধহয় মি.ফিলিক্স ওর বক্তব্য শেষ হয়েছে ভেবে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলেন তবে নিনা আবারও আরম্ভ করল। এবার টানা সাত মিনিট ওর মতামতের ইতিবৃত্তি দেওয়ার পর সকলকে যেন এক স্বস্তির খবর দিয়ে বক্তব্যের ইতি টানল। সকলেই ওর বলা শেষ হতে হাফ ছেড়ে বাঁচল। মি.ফিলিক্সও বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন। তবুও তিনি হাত নেড়ে বললেন, ‘অসাধারণ হয়েছে মিস মালিক।’
নিনা থেকে পেছনের দিকে বসা একটা ছেলে বিদ্রুপ করে বলল, ‘অতিরিক্ত জ্ঞান দান করার আগে এটা দেখা উচিৎ যে এখানে সবাই তোমার মতো মস্তিষ্কের বারোটা বাজাতে আসেনি।’
নিনাও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘যাদের মস্তিষ্কের ইতোমধ্যেই বারোটা বেজে আছে তাদের আর কী বারোটা বাজতে পারে?’ বলে পেছনে ঘুরে সেই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তাই না? তোমার তো এটা আরোও ভালো বোঝার কথা।’
ছেলেটার যেন রাগে গা রি রি করে উঠল। ছেলেটা আরোও কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই মি.ফিলিক্স বললেন,
‘অনেক হয়েছে রিক। ক্লাসে শান্তি চাই আমি।’
কিছুক্ষণ পর ঘন্টা বাজতেই নিনা সবার আগে উঠে গটগট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে ছোট কাগজটা বের করল যেটায় ক্লাসের রুটিন লেখা রয়েছে। ক্লাস শুরুর পূর্বে প্রথমেই গিয়ে রুটিনটা যোগার করে এনেছে। এবার কাগজটির দিকে মনোযোগ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ওর মাথায় একটাই জিনিস ঢুকল। তা হলো দ্বিতীয় পিরিয়ডে একই সাথে ক্যালকুলাস এবং ল্যাঙ্গুইজ। কিভাবে দুটো ক্লাস একই সাথে হতে পারে? নিনা পুনরায় কাগজটির লেখাগুলোর ওপর চোখ বুলালো। না ঠিকই আছে। দ্বিতীয় পিরিয়ডের পাশে পর পর ক্যালকুলাস এবং ল্যাঙ্গুইজ লেখা। নিনা বিরক্তি সহকারে এদিকওদিক তাকাল। রুটিনটা হাতে পাওয়ার পর অমিত বলেছিল ওদের ক্যালকুলাস ক্লাসের সময় একই পরেছে। কিন্তু ল্যাঙ্গুইজ? নিনা অবশেষে অফিস রুমের পথ ধরল। তবে মাঝপথে লকার করিডরে এসে নিজের লকারটা খুলে ব্যাগটা সেখানে রেখে দিলো। অফিস থেকে রুটিনের ত্রুটি*টা সংশোধন করে এসে ব্যাগ নিয়ে যাবে। সাধারণত অন্যান্যরা প্রয়োজনীয় দুই একটা বই নিয়ে স্কুলে হাজির হলেও নিনা তার সাথে সাথে যেন পুরো সংসার নিয়ে ঘোরে। কাজেই ওর ব্যাগ সাধারণের থেকে অধিক ভারি। নিনা অফিসে পৌঁছে দেখে যেই কাউন্টারের পেছনে এসব রুটিন, বেতন, নোটিশ নিয়ে কাজ করনে ওয়ালা মহিলা বসেছিল সেটা এখন ফাঁকা। ভেতরে একজন গোল্ডেন ব্রাউন চুলধারী মধ্য বয়সি মহিলা দাঁড়িয়ে। ওনাকে দেখেই নিনা বুঝতে পারল, উনি একজন টিচার। এগিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এক্সকিউজ মি ম্যাডাম।’
উনি নিনার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘ইয়েস?’
‘মিসেস ইউয়ান কোথায়?’
‘উনি বোধহয় দুইতলার অফিস রুমে গিয়েছেন। বলে একটু থেমে আবার বললেন, ‘তবে এখন দুইতলার স্টাফ রুম বন্ধ থাকার কথা। যদি উনি সেখানে না থাকেন তাহলে ঢুকতে যেও না।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসল ও। সোজা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সকল স্থানে ছেলেমেয়েরা হইচই করছে। কিছু কিছু জায়গায় এমন জটলা যে সকলের মাঝে প্রায় ঢাক্কা*ঢাক্কি করে নিনাকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, ‘ওফ এই অমিতটা গেল কোথায়? ওকে পেলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ফোন দিচ্ছি সেটাও রিসিভ করছে না। যাই হোক আপাতত অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেই এই ক্যালকুলাস বা ল্যাঙ্গুইজ ক্লাসটা কোথায় হবে। পরে নাহয় রুটিন ঠিক করে নেব।’ দ্বিতীয় তলায় উঠে একটা বেগুনি চুলো মেয়েকে বলল, ‘এক্সকিউজ মি? সিনিয়র ইয়ারের ক্যালকুলাস ক্লাসটা কোথায় হবে?’
মেয়েটা সামনের লম্বা করিডোর দেখিয়ে বলল, ‘ডানে সিনিয়রদের এবং সোজা গিয়ে জুনিয়রদের হয়। তবে এখন তো সম্ভবত হিস্টোরি ক্লাসের সময়।’ বলেই চলে গেল। ধন্যবাদ দেওয়ার সময় দিলো না। তাতেও নিনা বিরক্ত হলো। আবারও ভাবতে লাগল, ‘সময় চলে যাচ্ছে এদিকে আমি অমিতের সঙ্গে দেখাও করতে পারছি না। ওকে সব খুলে বলতে হবে নাহলে তো কাজ এগোবে না। সবার আগে আমাকে খোঁজ নিতে হবে এই ইভান দানির সম্পর্কে। তারপর টনির বোন এবং টনির বেস্ট ফ্রেন্ড অরল্যান্ডো। আর ওর যে গার্লফ্রেন্ড ছিল, সেটাও বা কে তাকেও খুঁজে বের করতে হবে। এদের সকলের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। আর ইভানের সাথে তো অবশ্যই। এবং দেখতে হবে আর কে কে এই বিষয় কতটা জানে বা আর কে কে টনির সঙ্গে সম্পর্কিত।’ ভাবতে ভাবতেই যখন নিনা বাস্তব জগতে ফিরে এলো তখন সে নিজেকে একটা নির্জন করিডোরে আবিষ্কার করল। প্রথমেই বুঝতে না পারলেও পেছনে ঘুরে দেখল ওই মেয়েটা ওকে রাস্তা দেখানোর পর ও সোজা চলে এসেছে। অথচ মেয়েটা বলেছিল সিনিয়রদের ক্লাস ডান দিকে, সোজা নয়। নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা চাপ*ড়াল। দেখল ওর পাশেই দুইতলার স্টাফ রুম। যেহেতু স্টাফ রুমে ওর আসার কথা ছিলো কাজেই ও এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। কিন্তু দরজা বন্ধ। তার মানে সেই টিচার ঠিকই বলেছিল স্টাফ রুম বন্ধ আছে। নিনা আবার ঘুরে দাঁড়াতে যাবে তখনই রুমের ভেতর থেকে মেঝেতে থপ করেন জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। মনে হলো যেন কেউ কোন জায়গা থেকে মেঝেতে লাফ দিয়েছে। নিনা থমকে দাঁড়ালো। দরজার পাশের জানালার লক খোলাই ছিলো শুধু কাঁচের পাল্লাটা চাপানো ছিলো। নিনা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল ভেতরে একটা ছেলে জানালার সামনের টেবিলে রাখা কতগুলো খাতা ঘাটাঘাটি করছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। কিছু না ভেবেই কাঁচের পাল্লা সরিয়ে জানালায় উঠে বসল। কামরার ভেতরের দিকে ঘুরে মেঝেতে লাফিয়ে নামল। ছেলেটা প্রায় ভুত দেখার মতো চমকে উঠল ওর আগমনে। পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। বেশ লম্বা চওড়া গড়ন। রোদের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সে। রোদের ছোঁয়ায় তার ডার্ক চকলেট রঙা ছোট সিল্কি চুলগুলো বাদামি দেখাল। হিরের মতো ধারাল মসৃণ চিবুক। তবে নিনাকে দেখার পর শরীর থেকে যেন আত্না উড়ে গিয়েছে এমন ফ্যাকাসে লাগলো তাকে।

নিনা কঠিন স্বরে বলল, ‘স্টাফরুম যখন বন্ধ তখন সেখানে ঢোকার অনুমতি কারোও নেই! তুমি কোন সাহসে নিয়ম ভেঙেছ?’
ছেলেটার মুখভঙ্গি এবার কিছুটা স্বাভাবিক হলো। স্বাভাবিক নয় বরং সে যেন বেশ কৌতুক করেই বলল, ‘হেই সানসাইন! তুমি কী আমাদের নতুন প্রিফেক্ট?’

‘কেনো জিজ্ঞেস করছো? তোমার নিয়ম ভাঙার সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক নেই। আর কোন স্কুলে প্রিফেক্ট থাকার নিয়ম নেই জানো না?’

‘অবশ্যই জানি। বাট না থাকলেও সেই কাজগুলে সামলানোর জন্য কেউ তো নির্ধারিত থাকে। তাছাড়া প্রিফেক্টরা ছাড়া কেউ সাধারণত অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।’

‘সো লিসেন আমি ঘামাই। এন্ড যতই তোমাদের স্কুলে কোন নিয়ম কানুন কেউ না মানুক স্টাফরুমে চু*রি করে ঢুকে পরীক্ষার খাতা ঘাটাঘাটি কোন স্কুলই মেনে নেবে না। সেটা বুঝতে হলে আইনস্টাইন হতে হয় না।’

ছেলেটা বাঁকা হেসে পেছনে ঘুরে পুনরায় খাতা ঘাটতে ঘাটতে বলল, ‘আমার যে কিছুই হবে না সেটা আমি ভালো করেই জানি। তবে কিভাবে হবে না সেটা তুমি জানো না এবং আমি না বরং বিপদে তুমিই পরবা।’

‘কথা ঘুরানোর চেষ্টা করো না। বের হও এখান থেকে এবং তোমাকে কিভাবে সোজা করতে হয় সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।’ তীব্র কন্ঠে বলল নিনা। ছেলেটা একটা খাতা হাতে তুলে নিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, ‘দেখো আমি তো তোমার ভালোর জন্যেই বলছিলাম। নতুন এসেই বিপদে পরো না।’ নিনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই বাইরে থেকে ফাঁকা করিডোর হতে খটখট পদশব্দের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। এতক্ষণে ছেলেটা যেন সিরিয়াস হলো। সে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবারও পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘আরেহ দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো!’

নিনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় আসবো? আকাশে?’

‘নিশ্চয়ই মিসেস ট্যামোক আসছেন। উনাকে তুমি এখনো চিনো না। উনি যদি…নিনা কথার মাঝখান দিয়ে বলল,

‘কী হবে? পালানো উচিৎ তোমার। আমার না। আমি এখানে চুরি করতে আসিনি কিছু।’

‘ ঢুকেছ জানালা দিয়ে চুরি করেই সে যেই কারণেই হোক। এবং মিসেস ট্যামোক সেসব দেখবেন না উনি শুধু কাউকে এখানে পেলেই হলো। তার খবর আছে।’ নিনা তবুও মানতে চাইল না। অবশেষে ছেলেটা এসে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে ওকে জানালার কাছে টেনে নিয়ে গেল। সে এক লাফে জানালা পার করে সানসেটে গিয়ে দাঁড়াল। নিনা ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল, ‘তুমি কী পাগল! তুমি চাইছ আমি এখন জানালা দিয়ে বের হয়ে বিল্ডিং বেয়ে নিচে নামবো?’

‘আর নয়তো কী?’ তখনই দরজায় একটা ক্লিক করে শব্দ হলো। এবার আর নিনাকে কিছু বলা লাগলো না। সে নিজেই সেকেন্ডের মধ্যে জানালায় বসে লাফ দিয়ে সানসেটে নামল। ততক্ষণে ছেলেটা পাশের পানির পাইপ ধরে নিচের সানসেটটার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। পানির পাইপের গায়ে রিংয়ের মতো একটু চওড়া অংশ আছে যেখানে কোন রকমে পা রাখা যায়। তবে একটু অসাবধান হলেই পা ফস্কে যাবে এবং ব্যস। ছেলেটার কথা মতো ও পাইপ ধরে একটু নিচে নামলো এবং বাকিটা না নেমে নিচের তলার সানসেটে লাফ দিয়ে নেমে গেল। নেমেই এক মুহূর্ত শ্বাসও না নিয়েই বলতে শুরু করল, ‘কী আশ্চর্য তুমি! একে তো নিজে নিয়ম ভেঙেছ, তারওপর তোমার জন্য আমাকে কিনা বিল্ডিং বেয়ে পালাতে হলো? অবিশ্বাস্য! এখান থেকে খালি একবার নিচে নামতে দাও তোমাকে যদি আমি কিছুদিনের জন্য সাসপেন্ড না করিয়েছি তাহলে আমিও নিনা না। তুমি…এতটুকু বলতেই ছেলেটা ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
‘হায়রে আমি কী এমন পাপ করেছিলাম যে তোমার মতো একটা ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে আমার ঘাড়ে এসে পরল। দুই মিনিটের জন্য চুপ থাকো প্লিজ! আমরা এখনো নিচেও নামিনি। আর তুমি এত চিৎকার করলে ওপর থেকে উনি আমাদের শব্দ শুনতে পাবেন।” নিনা ওর হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল। তবে আর কিছু বলল না। ছেলেটা আবারও একই ভাবে পাইপের রিংয়ের মতো চওড়া স্থানে কোনরকমে পা দিয়ে একটু একটু করে কিছু নিচে নেমেই বাকিটা লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে গেল। নিনা ঠিক সেভাবেই নিচে নামল। তখন খেয়াল করল ছেলেটা হাতে করে সেই খাতাটা ঠিকই এনেছে। সেখানে এক ঝলকের জন্য নামটা দেখা গেল। অ্যালেক্স লেখা৷ অর্থাৎ ওর নাম অ্যালেক্স। নিনা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। তবে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছেলেটা একটা গা জ্বালানো দাম্ভিক হাসি দিয়ে বলল, ‘তোমার সাথে এডভেঞ্চারটা বেশ ফান ছিলো এবং আমি দোয়া করছি আমাদের যেন আর কখনো না দেখা হয়। গুডবাই সানসাইন।’ বলেই প্রায় ছুটে চলে গেল। নিনা বিরক্ত হয়ে মাটিতে লা*থি দিলো। তারপর ভাবল, ‘আগেই জানতাম আমার জন্য এই স্কুলে একটা, মাত্র একটা দিনও স্বাভাবিকভাবে কাটানো সম্ভবই নয়!’
.
.
.
.
ক্যালকুলাস ক্লাস শুরু হয়েও বেশ কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর গিয়ে নিনা সেখানে পৌঁছেছিল৷ একই ক্লাসে অমিতও উপস্থিত ছিলো। ক্লাস শেষ হতেই অমিতের পূর্বে নিনাই ওর নিকট ছুটে গেল। অনেক কিছু যে বলার আছে ওকে৷ ক্লাস থেকে বের হয়ে ভিরের মাঝে করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অমিত বলল, ‘ নিনা আগে আমাকে এটা বল অর্ধেক ক্লাস পর্যন্ত তুই ছিলি কোথায়? হারিয়ে গিয়েছিলি নাকি?’

‘ওফ এটা আর বলিস না। ইতোমধ্যেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কোন একটা ফাজিলের চক্করে পরেছিলাম।’

‘কোন ফাজিল? আর কী হয়েছে?’

‘আমি বন্ধ স্টাফরুমে ঢুকেছিলাম। তারপর স্টাফরুমের জানালা দিয়ে বেরিয়ে বিল্ডিং বেয়ে নিচে নেমেছি।’
অমিত কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধুই নিনার দিকে তাকালো প্রথমে। তারপর এমন ভাবে হাসতে শুরু করল যেন এর চাইতে হাস্যকর কথা ও আর দ্বিতীয়টা শোনেনি। নিনা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘অমিত তুই কোন কিছু নিয়ে সিরিয়াস হইস না কেন? আমি যা বলছি সিরিয়াসলি বলছি।’

অমিত এবার হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অবাক কন্ঠে বলল, ‘ওয়াট দ্যা হেল ইজ রঙ ইউত ইউ! এসব তুই করছিসটা কী? তুই তো আগে এমন ছিলি না। আমি এতবছর যাবত এই স্কুলে পড়ার পর আজ পর্যন্ত অনেক অকাম করেছি কিন্তু জানালা দিয়ে বের হয়েছি অথবা বিল্ডিং বেয়ে নিচে নেমেছি এইসব করিনি ভাই।’
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা কক্ষে গিয়ে ঢুকলো। এখন তৃতীয় পিরিয়ড। এখানে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস হবে। নিনা হতাশ ভঙ্গিতে জানালার সাথে লাগানো একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। অমিত সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে অদম্য আগ্রহের সমেত জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু তুই ওখানে কেন ঢুকেছিলি? আর বিল্ডিং বেয়ে নামতে হলো কেন? আর কোন ফাজিলের চক্করে পরেছিল? সব বল, সব!’
নিনা সম্পূর্ণ ঘটনাটা খুলে বলল। অমিত প্রথমে হাসলো তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলেটা কে ছিলো?’
‘সম্ভবত অ্যালেক্স।’

অমিত কিছুটা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল, ‘অ্যালেক্স! তুই শিওর ওটা অ্যালেক্স?’
‘কেন কী হয়েছে? অ্যালেক্সও মা*রা গেছে নাকি যে ও আসতে পারবে না।’

‘আরেহ না অ্যালেক্স যেই ভিতু সেটা আর বলতে হয় না। ওর এত সাহস আছে নাকি দুই তলা বিল্ডিং বেয়ে উঠবে। এত রি*স্ক নিয়ে পরীক্ষার খাতা চু*রি করবে। প্লাস অ্যালেক্স তো এতটাও সুন্দর দেখতে না যতটা তুই বললি।’

‘ভাই আমি এত কিছু জানি না। নাও হতে পারে ও অ্যালেক্স। আমি তো আর চিনি না কাউকে। আমার তো মনে হয় এখানে সবার মধ্যেই কোন না কোন গলদ আছে।’
অমিতকে তবুও কিছুটা দ্বিধানিত্ত্ব দেখাল। ওকে বিভ্রান্তি থেকে বের হওয়ার সুযোগ না দিয়েই নিনা জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা এখন আমাকে হেল্প কর তো।’

‘হ্যা বল কী করতে হবে।’

‘যাদের যাদের আমি সন্দেহ করছি তাদের তাদের চিনিয়ে দে। প্রথমেই ইভান দানির। ওকে তো এখনো দেখলাম না।’

‘ইভান? ও তো গত দুইদিন ধরে স্কুলে আসে না।’

‘মানে যেদিন টনি খু*ন হয়েছে সেদিনও আসেনি।’ কথাটা যেন নিজেকেই বলে আবার জিজ্ঞেস করল নিনা, ‘আচ্ছা আর টনির বোন কোথায়? আর অরল্যান্ডো কোথায়?’

‘অরল্যান্ডো?’ বলেই পেছনে দৃষ্টি ফিরিয়ে ক্লাসের শেষের দিকের একদম কোণার টেবিলটায় বসে থাকা ছেলেটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘এইযে অরল্যান্ডো।’
ছেলেটার লালচে চুল। চিকন চশনার পেছনে চোখের পাপড়িও ফ্যাকাসে বাদামি রঙা। গোলগাল চেহারা।

নিনা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরে ওতো আমার ক্লাসেই বসে আছে। বাহ! আর এমিলি মানে টনির বোন?’

‘এমিলি তো এবার সফোমোর ইয়ারে। আমাদের সাথে না ও।’

‘ওহ আচ্ছা যাই হোক। আর টনির সেই গার্লফ্রেন্ড টা কে কিছু স*ন্দেহ হয় কাউকে?’

“ওয়েট তুই না বলেছিলি ওর সাথে ব্রেক আপ হয়েছিল?’

‘ওহ হ্যা, ওইতো ওর এক্সটা আসলে কে?’

‘আমি কেমনে জানবো৷ ওর যে একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল, তারপর আবার ব্রেকআপও হয়েছে এইসব কিছুই আমি তোর কাছ থেকেই জেনেছি। এমনিতে তো এগুলো সিক্রেট হিসেবেই ছিল।’

‘হ্যা হ্যা জানি। আমি বলতে চাচ্ছি স্কুলের কাউকে দেখে কী তোর কখনো স*ন্দেহ হয়েছে যে হয়তো ওর সাথেই টনির কোন সম্পর্ক থাকতে পারে?’

‘আরেহ বাপরে, টনি সবার সাথেই এত সুইটলি এন্ড পোলাইটলি কথা বলতো, আমার তো সবাইকেই ওর গার্লফ্রেন্ড মনে হত। প্লাস আমি তো ওর অতটা ক্লোজ ছিলাম না। আমি বেশির ভাগ ইভানের আশেপাশে থাকতাম।’

‘তুই না একটু আগেই বললি তুই ইভানকে পছন্দ করিস না?’

‘আমি কখন বললাম এই কথা? আমি জাস্ট বলসি ও একটু সেন্টিমেন্টাল আরকি। এন্ড সাম হাউ আমার বেশির ভাগ সময় ওর সাথে ঘোরা হয় যেহেতু ওর এন্ড আমার বেশির ভাগ ক্লাসই একসাথে।’

‘ওহ এই কথা আগে বলবি না। এনি ওয়েজ টনির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো এমন সকলের লিস্ট দিবি আমাকে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। টনির একজন বেশ ভালোই স্টাডি ফ্রেন্ড ছিলো। টনি যখনই ক্লাস মিস দিত হারিন নিজ দায়িত্বে টনিকে নোট দিয়ে আসতো।’
বলেই অমিত পেছনের দিকে অরল্যান্ডোর পাশের খালি সিট টা দেখিয়ে বলল, ‘আর ওখানেই বসতো টনি। ওটা আপাতত খালি আছে।’
সেদিকে তাকিয়েই নিনার খালি খালি একটা অনূভুতি হলো। ভাবতে লাগল, ‘যাকে আমি এত দিন যাবৎ চিনতাম সে এখন আর নেই আমাদের মাঝে। তার স্থানটাও এখনো খালি
পরে আছে শুধু সেই-ই নেই। সবই সময়ের সাথে ঠিকই চলছে নিয়মমাফিক। শুধু তাকে অসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। যে এই কাজটা করেছে আমি তাকে অবশ্যই খুঁজে বের করব!’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৪
লেখা – #মাহীরা_ফারহীন

নিনা অনেকক্ষণ যাবৎ ব্যাগ ঘাটাঘাটির পরও তার সেই ক্লাস রুটিনের দেখা পেল না। কোথায় যে পরে গিয়েছে কে জানে।
অবশেষে আবারও নিচ তলার অফিস রুমে গিয়ে হাজির হলো। ছুটির ঘন্টা পরে গিয়েছে। অনেকেই বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার অনেকেই করিডোর গুলো দখল করে আড্ডা দিচ্ছে। অমিতও নিনার সাথে সাথে ঘুরছে। অফিস রুমে গিয়ে দেখা গেল মিসেস ইউয়ান একটা মেয়ের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলছেন,
‘এটা অবশ্যই স্কুল থেকে বেরিয়েই ইভানের বাসায় পৌঁছে দিবে। আর হ্যা অবশ্যই যেন ও আজকের মধ্যেই থা*নায় যায়।’
নিনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস না করতেই আমিত নিজে থেকেই বলল, ‘গতকাল মি.মালিক সহ অন্য অফিসাররা এসেছিল তারা ইভানকেও জেরা করতে চেয়েছিল কিন্তু ও আসেইনি স্কুলে৷ এই লেটারটা দিয়ে গিয়েছিল ওর উদ্দেশ্যে। সম্ভবত ওকে একবারে থা*নায় বসে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। ঝামেলা তাই না? বাড়ি থেকে থানায় গেলে অভিভাবকও সাথে যাবে।’ নিনার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘আজকেও ও আসেনি বলে এখন ওর বাসায় পাঠাচ্ছে এটা?’ বলল নিনা।

‘হ্যা তাই তো মনে হয়।’

‘আমি নিয়ে যাব এটা।’

‘কী! মানে?’ অমিতের কথার কোন উত্তর না দিয়েই নিনা এগিয়ে গেল কাউন্টারের সামনে। কোন আগুপিছু না ধরে সোজাসাপটা বলল, ‘মিসেস ইউয়ান আমি লেটারটা ইভানের বাসায় পৌঁছে দিতে পারবো।’
উনি এবং মেয়েটা দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেয়েটা বলল,
‘তুমি না আজকেই এসেছো? তুমি কেন এসব করবা?’

‘কারো না কারো ওপর তো এসব দায়িত্ব থাকেই। আমি ইভানকে চিনি এবং সেম নেইবারহুডে থাকি। তাই বাসায় যাওয়ার সময় ওর কাছে এটা পৌঁছে দেব।’

মিসেস ইউয়ান বললেন, ‘বাট তুমি আজই এসেছো স্কুলে। আর ইউ শিওর? তোমার নাম কী?’
নিনা একবার মেয়েটার দিকে তাকাল। তারপর পেছনে ঘুরে অমিতের বিচলিত মুখের দিকে তাকাল। আবার সামনে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘আমি নিনা মালিক।’
মিসেস ভ্রু উঁচু করলেন। অতঃপর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
মেয়েটার কপাল কুঁচকে গেল।
মিসেস ইউয়ান এবার নির্দ্বিধায় বললেন, ‘ঠিক আছে। যাও।’
মি.মালিক পূর্বেই নিনাকে জানিয়ে দিয়েছেন মিসেস ইউয়ানের এ বিষয় অবগতির কথা। মিসেস ইউয়ান মি.মালিকের একজন কলিগের ওয়াইফ। কাজেই ওনার সঙ্গে পূর্বপরিচিত উনি। মেয়েটা খানিক অবাক হয়ে বলল, ‘মিসেস ইউয়ান?’
‘ন্যাট খামটা ওকে দাও।’
বিনাবাক্যে বাধ্য মেয়ের মতো খামটা নিনার দিকে এগিয়ে দিল। নিনা সেটা নিয়ে ব্যাগে রাখল। মনে করে রুটিন হারানোর কথাটাও তুললো নিনা।
.
.
.
.
বেশ কিছুক্ষণ ধরে রিং হওয়ার পর মি.মালিক ফোন রিসিভ করলেন। ফোন রিসিভ করতেই নিনা বলে উঠল, ‘তোমরা কী ইভানের জন্য কোন চিঠি দিয়ে গিয়েছিলা?’

‘হ্যা দিয়েছিলাম। আজ ওকে থা*নায় আসতে হবে জিজ্ঞাসা*বাদের জন্য।’

‘তোমরা তো সরাসরি ওর বাসায় গেলেই পারতা।’

‘ও শুধুই একজন সাস*পেক্ট এখন পর্যন্ত। তবে আজকেও যদি ও থা*নায় না আসে তাহলে অবশ্যই আগামীকালই ওর বাসায় যেতাম আমরা।’ বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বললেন, ‘স্কুল তো ছুটি হয়েছে। তুই বাসায় যা আমি আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার চেষ্টা করব, তখন কথা হবে।’

‘না না আমি এখন বাসায় যাচ্ছি না। আমি ইভানের বাসায় যাচ্ছি।’

‘কী? তাই বলে এতটা ডেস্পারেট হয়ে কাজ করিস না। এই কেস থেকেও তুই অনেক বেশি ইমপোর্টেন্ট নিনা। নিজের নিরাপত্তা সবসময় আগে।’

‘ আমি ওই চিঠিটা দেওয়ার নাম করে যাচ্ছি বাট এতে এত চিন্তার কিছু নেই। জাস্ট একজন ছাত্রই তো ও।’

‘ফাইন। আচ্ছা মিসেস ইউয়ান সাহায্য করেছেন তাহলে?’

‘হ্যা। তবে ওনাকে কী আসলেই বিশ্বাস করা যায়?’

‘যায়। উনিনাকে আমি আগে থেকেই চিনি। বলেছিলাম না।’

‘ঠিক আছে। তোমাকে জাস্ট জানিয়ে দিলাম। রাখছি এখন।’

‘আচ্ছা যা কর সাবধানে করিস। আল্লাহ হাফেজ।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’
নিনা ফোন কেটে দিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল।
দুপুরের কড়া রোদে ভেসে যাচ্ছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গাছপালা। নিনাকে চোখ একদম ছোট ছোট করে দেখতে হচ্ছে। রোদের অতিরিক্ত তেজে চোখ মেলা দায়। বেশ গরমও লাগছে। আজ সেপ্টেম্বরের মাসের চৌদ্দ তারিখ। সবে গ্রীষ্মকে বিদায় দিয়েছে প্রকৃতি। অবশ্য সে পুরোপুরি বিদায় নিয়েছে বলে মনে হয় না। মেইন রাস্তা থেকে শুরু করে ফুটপাথ সবই ঘষেমেজে পরিষ্কার করা যেন। মাঝেমাঝে ফুটপাথের পাশে ফুলের ঝোপ বা গাছের ছায়ায় মন জুরিয়ে আসে। রঙিন ফুল গুলো রৌদ্রস্নান করে মন খুলে হাসছে। নিনা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের অতি পরিচিত শান্তশিষ্ট ছিমছাম নেইবারহুড ওল্ড সিটিতে প্রবেশ করল। এখানেই থাকে নিনা তবে আরোও কিছুটা ভেতরে। ঠিকানা অনুযায়ী ভাইন স্ট্রিটের একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাল। সামনে কোন গেট নেই। রাস্তার পাশে খোলা বাগান। দুই তলা বড় বাড়ি। ডর্মার নকশার টেরা কোটা টালি দেওয়া ছাদ লেবু রঙের। উজ্জ্বল রোদে সিক্ত বাড়ি এবং বাগান। দারুণ মিষ্টি সুবাস বাতাসে মিশে উড়ে বেড়াচ্ছে বাড়িটা ঘিরে। দরজার সামনে খোলা বারান্দা। বাহিরের দিকে সিলিং হতে লোবেলিয়া ফুল লাগানো টব ঝুলছে। বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। এর পূর্বে অসংখ্য বার বাড়িটার সামনে দিয়ে গিয়েছে। অথচ একদিন এখানে আসতে হবে কখনো ভাবেনি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। পাশাপাশি চোখ বুলিয়ে চারিপাশটা পর্যবেক্ষণ করছে। অবশেষে এই ইভান ছেলেটার সঙ্গে দেখা হবে ভেবেই কিছুটা নার্ভাস লাগলো বটে। তবে কাজ এগোতে হলে ভালো না লাগলেও এসব করতেই হবে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। নিনা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। তবে দরজার ওপাশে যাকে দেখল বোধহয় তাকে মোটেও এখানে আশা করেনি ও৷
লম্বা, ফর্সা সুদর্শন সেই ছেলেটা। সেই ছেলেটা যে ওকে আজ সকালেই স্কুল বিল্ডিং বেয়ে নামতে বাধ্য করেছিল। নিনা প্রথমে বিস্ময়ের তোরে কিছু বলতে পারলো না। ছেলেটাও কম কিছু অবাক হয়নি৷ নিনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তবে নিনাই প্রথমে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘অ্যালেক্স? মানে তুমি…..তুমি অ্যালেক্স?’

‘অ্যালেক্স মানে? অ্যালেক্স আমার ফ্রেন্ড। আমি অ্যালেক্স হতে যাবো কেন? আমি ইভান।’ ছেলেটারও ততক্ষণাৎ উত্তর।
নিনা কিছুটা সময় নিলো সকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটা ঘটনার তাল মেলাতে। তারপর সবিস্ময়ে উচ্চস্বরে বলল, ‘কী আশ্চর্য! তুমি আজ স্কুলে না যাওয়া সত্ত্বেও বন্ধুর জন্য পরে গিয়ে চুরি করে স্টাফরুমে ঢুকেছিলা খাতা চুরি করতে? এটা কেউ করে? পাগল তুমি?’
ইভান এবার কিছুটা সর্তক হয়ে বলল, ‘আস্তে! এই কথা এত জোরে বলো না।’
“ইভান” তখনই পেছন থেকে একজন মহিলার ভারি কন্ঠস্বর শোনা গেল। ইভান খানিকটা চমকে উঠল। একজন মহিলা এসে ইভানের পেছনে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
‘তুই এই কান্ড ঘটিয়েছিস তাও আবার তোর সেই অপদার্থ বন্ধু অ্যালেক্সের জন্য?! আশ্চর্য!’ বলে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। উনি মায়মুনা আহমাদ, ইভানের মা। ইভান মাথা নত করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। একটা টু শব্দও করছে না। নিনা বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। মিসেস দানির এবং ইভান নিজে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। উনি আবারও কঠিন স্বরে বললেন,
‘ওই ছেলের সাথে মিশতে মিশতে খারাপ হয়ে যাচ্ছিস। একে নিজে তো কিছু করতে পারেই না, পড়াশোনারও কোন নামগন্ধ নেই আর তোকে পাঠায় খাতা চুরি করতে? !’

‘অমিতের কথা অনুযায়ী অ্যালেক্সের তো ভিতুর হদ্দ হওয়ার কথা। তার আবার এত সাহস আছে নাকি এসব কাজ করে বেড়াবে? আসলে অ্যালেক্সের নয় আন্টি আপনার ছেলেই সকল নষ্টের গোড়া।’ মনে মনে ভাবল নিনা। এতক্ষণে মিসেস আহমাদের চোখ নিনার দিকে গেল। তিনি কিছুটা নরম কন্ঠে বললেন,
‘আসো ডিয়ার তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’ বলে উনি সরে দাঁড়ালেন। ইভানও সরে দাঁড়াল। উনি ঘরের ভেতরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ‘লিজা! নিচে আয়।’

নিনা একমুহূর্ত ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে দাঁড়াল। মূল দরজার সামনে এবং বামে করিডর। বামের করিডর হতে দোতলায় উঠে গিয়েছে প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়ি। ওপর থেকে ধুপধাপ পদশব্দে নেমে আসছে কেউ। সামনের কামরাটা ড্রাইংরুম। ড্রইংরুমের দেয়াল জুরে থাকা কাঁচের টানা জানালা গুলো খোলা। বাতাসে পর্দা উড়ছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদ চুয়ে পড়ছে কার্পেটে মোড়া কাঠের মেঝেতে। চিকন দুটো বেনি করা একটা ছোট খাটো মেয়ে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে৷ মেয়েটা হলদেটে ফরসা। তীক্ষ্ণ চাহনি। হাতে বেগুনি রঙের লম্বা লম্বা নকল নখ লাগানো। কানে দু তিনটে ছিদ্র। ছোট ছোট রঙবেরঙের পাথরের টপ পরা। লিজা মেয়েটার বাহ্যিক আবরণ বড্ড বেশি রঙচঙে। তবে পরনে ঘরে পরার সাধারণ পোশাক। মিসেস দানির বললেন, ‘লিজা ওর সাথে একটু কথা বল। তোর ভাইয়ের সাথে আমার কথা আছে।’ বলে ঘুরে ড্রইংরুম দিয়ে ভেতরের দিকে গেলেন। ইভানও নিশ্চুপ ভাবে তার সাথে সাথে চলে গেল। একা থেকে গেল শুধু নিনা ও লিজা। নিনার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। লিজা মেয়েটা বিনাবাক্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিনাকে আপাদমস্তক পরখ করল একবার। যেন নিনার চেহারা দেখেই সে তার মন পড়ে ফেলার প্রয়াস করছে। অবশেষে মেয়েটা ঠোঁটের দুকোণ প্রসারিত করে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আই এম লিজা দানির। তোমাকে আগে কখনো দেখিনি। কে তুমি?’

‘নিনা মালিক। সিনিয়র ইয়ার।’ বলে করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত তুলতেই লিজা নিজের হাতটা সরিয়ে নিল। তারপর নিনাকে পাশ কাটিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে বলল, ‘আসো নিনা। আমার কামরায় যাই।’
মেয়েটার এভাবে হাত সরিয়ে নেওয়াতে বেশ অপমানিত বোধ করল নিনা। নিজের স্থান হতে এক চুলও নড়ল না। পরিষ্কার ভাবে বলল,
‘লিজা।’
লিজা ঘুরে দাঁড়িয়ে আবারও হেঁটে নিনার সামনে আসল।
চোখে মুখে প্রশ্ন। নিনা ব্যাগ হাতড়ে খামটা বের করে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ইভানকে এটা দিয়ে দিও। আমাকে এখন যেতে হবে। দুঃখীত।’
লিজার ভ্রু কুঁচকাল। বলল, ‘ওমা সেকি? যাবে কেন? ভালো করে কথাও তো হলো না। না কিছুক্ষণ অন্তত না থাকলে আমি ছাড়ছি না।’
‘না না আমার হাতে সময় নেই।’
‘আরেহ কী এমন কাজ? তোমার সাথে এই প্রথম দেখা। একটু ভালো করে কথাও হবে না?’
হঠাৎ নিনার মাথায় যেন তার উদ্দেশ্যটা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। তার তো অস্বস্তির বাহানা দিয়ে এসব স্থান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা নয়। বরং যেভাবে হোক যার কাছ থেকে হোক কথা বের করতে হবে। অগত্যা জোড় করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ না।’

মেয়েটার মুখে হাসি ফুটল। এবার নিনার বাহু আঁকড়ে ধরে টেনে আনতে আনতে বলল, ‘আর খামটা নিজেই ভাইকে দিও। আমাকে নয়।’ নিনা কিছুই বলল না। লিজা বলতে লাগলো, ‘তো আজকাল তুমি এইসব কাজের দায়িত্ব নিয়েছো?
‘না তো। কেন জিজ্ঞেস করছো?’
লিজা ভ্রু উঁচু করল। বলল, ‘না মানে আগে তো তোমাকে কখনো এসব কাজ করতে দেখিনি। আসলে তোমাকেই আগে কখনো দেখিনি।’

নিনা হালকা হাসল। ও জানে ব্যাপারটা অদ্ভুত দেখানোটাই স্বাভাবিক। তাও যখন আজই স্কুলের প্রথম দিন ওর। লিজা যুগ্ম রান্নাঘর ও ডাইনিং পার হয়ে একটা কামরায় ঢুকলো। এই কামরায় ঢুকেই নিনার দমবন্ধ লাগলো। কেমন গুমোট একটা ভাব। কামরায় যেন এক রত্তি স্থানও স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ফাঁকা রাখা হয়নি৷ সারা দেওয়াল জুড়ে শুধু মুভি এন্ড এ্যালবামের পোস্টার, সেলিব্রেটি ও তাদের সিগনেচার এগুলোয় ঠাঁসা। বিছানার ওপর এক গাদা বালিশ। গিটারের মতো নকশা হতে শুরু করে ড্রামের মতো দেখতে বালিশও রয়েছে ৷ দেওয়াল গুলো সব পোস্টার ও ছবিতে ভরা৷ বিছানার দুপাশেই কাপবোর্ড। বিছানার সামনা সামনি সম্পূর্ণ দেয়াল জুরে স্টার ওয়ারসের বেবি ইওদার ছবি আঁকা। নিনা প্রথমেই দেওয়ালের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এটা কী!’
‘বেবি ইওদা।’
‘সেটা তো আমিও জানি। তবে দেওয়াল জুড়ে…. এতটুকু বলে থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ও জানে সব স্থানে সকলে ওর ইচ্ছেমতো চলবে না। ও তাদের সেভাবে চালাতেও চায় না৷ কাজেই এই কামরা যে ওর পছন্দ হয়নি তা আর প্রকাশ করল না।
‘কী? ভালো লাগে নি?’ ভ্রু উঁচু করে বলল লিজা।
‘না তেমনটা নয়। হঠাৎ করে এত বড় একটা ছবি দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’ বলে গোটা কামরায় একবার চোখ বুলিয়ে আবার বলল, ‘তোমার কামরাটা খুবই ইন্টারেস্টিং।’ অত্যন্ত সুক্ষ্ণভাবে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল কথাটা। লিজা সেটা ধরতে পারলো না বরং ওর মুখে গর্বের হাসি ফুটে উঠল। বলল,
‘অবশ্যই। আমার খুব শখের কামরা বলে কথা। এখানকার প্রতিটা জিনিস নিজে পছন্দ করে আনিয়েছি।’
নিনা ওর পাশে থাকা সেলফের ওপর দিয়ে চোখ বুলালো। চোখে পরল একটা গ্লাস ক্যান্ডেল। গ্লাসের মধ্যে লেখা হোম-সিক। নিনা মুচকি হেসে বলল, ‘এটা সেরকম মোমবাতি না যেটা থেকে বাড়ির মতো নরম, মিষ্টি এবং চেনা চেনা একটা সুগন্ধ বের হয়?’

‘হ্যা।’

মোমবাতিটা একেবারেই অস্পর্শ মনে হলো। কখনো বোধহয় জ্বালানো হয়নি। নিনা সেটা ধরতেই লিজা বলে উঠল,
‘ধরো না!’
নিনা ততক্ষণাৎ রেখে দিল মোমটা।
‘আমি পছন্দ করিনা কেউ আমার জিনিস ধরুক। দুঃখীত।’ বলল লিজা।
‘না আমি দুঃখিত। আমি জানতাম না। একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কখনো জ্বালাওনি?’
‘না। ভালো লাগে না এসব। হোম-সিকনেস একটা বিরক্তিকর জিনিস তার জন্য আবার ক্যান্ডেল?’ মুখ বাঁকা করে বলল লিজা।
‘তাহলে কিনেছো কেন?’

‘কিনি নি। উপহার পেয়েছিলাম। সাধারণত উপহার পছন্দ না হলে সেটা বদলিয়ে আনি তবে এটা রেখে দিয়েছিলাম।….. বলে একটু থামল। তারপর চোখের মণি ঘুরিয়ে বলল,
‘কারো টক্সিক মাইন্ড সেটে যে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে হোমসিক বানানোর ইচ্ছা জেগেছিল সেটা মনে রাখতেই রেখে দিয়েছি।’
নিনা আর কিছু বলল না। মোমবাতিটির দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল, ‘ হোমসিক ক্যান্ডেল খুবই সুইট একটা জিনিস। যেই ওকে দিয়েছিল এটা, সে পরিষ্কার ভাবে ওর জন্য কেয়ার করত।’
‘কী ভাবছো?’ জিজ্ঞেস করল লিজা। নিনা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘কিছু না।’ বলে বিছানার পেছন দিকে চোখ ফেরাল। গোটা কামরার চার দেওয়ালের মধ্যে শুধু বিছানার পেছনের দেয়ালটা সম্পূর্ণ ফাঁকা শুধু মাত্র একটি জিনিস ছাড়া। ‘ড্যান্ডালাইন’ গানের দুটো লাইন ফ্রেম করে দেয়ালে ঝুলানো।

“Cause I’m in a field of dandelions
Wishing on every one that you’ll be mine, mine”

নিনা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল ফ্রেমটির দিকে। নিনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিজা নিজে থেকেই বলল,
‘ড্যান্ডালাইন ফুল এবং গান দুটোই আমার প্রিয়।’

‘খুব সুন্দর।’ আনমনেই বলল নিনা। তারপর জিজ্ঞেস জরল,
‘আচ্ছা তো এমনিতে কী কর তুমি সারাদিন?’
লিজা বলল, ‘উম সকালে স্কুলে যাই। সেখান থেকে কখনো সরাসরি ফ্রেন্ডদের সাথে হ্যাঙ্গআউটের জন্য বেরিয়ে যাই আবার কখনো বাড়ি ফিরে আসি। তারপর কি আর ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হয় যতক্ষণ না আমার কোন ফ্রেন্ড এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’

‘তো মোট কথা তুমি মোটামুটি সারাদিনই ফ্রেন্ডদের সাথে থাকো?’

‘অনেকটা তাই।’
নিনা আলতো করে মাথা নাড়ল। লিজা জিজ্ঞেস করল,
‘তোমরা কয় ভাইবোন?’

‘দুই বোন।’

‘ওহ তোমার বোন নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের মতো বোরিং না।’
হেসে বলল লিজা।

‘বোরিং? যেমন?’

‘কী যেমন?’

‘মানে তোমার ভাইকে যে বোরিং বললে সেটার কারণ জিজ্ঞেস করছি।’

‘ওহ। বোরিং নয় তো আর কী? স্কুল যায়। দুনিয়ার দায়িত্ব পালন করতে করতে ঘাড় ত্যাড়া করে ফেলেছে যেটা করার কোন প্রয়োজনও ছিলো না। কাজের কাজ তো কিছু করেই না খালি ঝামেলা পাকায়। তারপর চুপচাপ বাসায় চলে আসে। অর্ধেক বেলা পার করে বই পড়তে, তারপর সন্ধ্যায় প্রতিদিন তার বাবার সাথে দাবা খেলতে বসাই লাগবে। আর মাঝেমাঝে ঘুরার জন্য কোথায় কোথায় যে গিয়ে ঢুকে কাউকে বলেও না। কাজেই তার কোন হদিসই খুঁজে পাওয়া যায় না।’

‘বাহ অনেক বিচিত্র তোমার ভাইয়ের লাইফস্টাইল।’

‘আরেহ আমার ভাই বলে বলছো তো? মোটেও না খুবি বোরিং ও।’
নিনা আর কিছু বলল না। লিজা বলল, ‘আচ্ছা তোমার পরিবারের কথা বল?’
নিনা চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল, ‘আমার পরিবারটা খুবই ছোট। তেমন কিছুই নেই বলার। যাই হ…বলতে বলতে লিজার হাতের দিকে চোখ পরল। বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলটার চামড়া একেবারে ফুলে ড্যাবড্যাবে লাল হয়ে আছে। নিনা সেদিকে তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’এটা কী হয়েছে?’
লিজা সঙ্গে সঙ্গে হাতটা চোখের সামনে থেকে আড়াল করে বলল, ‘আহ ইন*ফেকশন।’

‘কিভাবে হলো?’

‘আরেহ কয়েকদিন আগে কী হয়েছে, ভাইয়া অকাজের একটা ফুল এনেছিল। সেটা ধরেই আমার এই অবস্থা হয়েছে। হয়তো বি*ষাক্ত ছিলো।’

‘তোমার ভাই জেনেশুনে তোমাকে বি*ষাক্ত ফুল কেন দেবে?’

‘না ও আসলে আমাকে ঠিক দেয়নি সেটা। ওর পকেটে ছিলো আমি নিজেই বের করেছিলাম দেখার জন্য।’

‘আর ওর কিছুই হয়নি?’

‘না ভাইয়া জানতো যে সেটা একটা বি*ষাক্ত ফুল তাই নিজে সাবধানেই ধরেছিল।’

‘কবে হয়েছিল এটা?’
লিজা একটু ভেবে বলল, ‘দুই একদিন আগেই তো হয়েছিল মনে হয়।’
তখনই দরজার বাইরে ইভানকে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল। লিজা লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আরেহ ভাইয়া তোমার ক্লাস শেষ? এত তাড়াতাড়ি?’

‘ফাজলামো করিস না।’ বিরক্ত কন্ঠে কথাটা বলে নিনার দিকে তাকাল। নিনাও উঠে দাঁড়াল। কিন্তু কোন কথা খুঁজে পেল না। লিজা বলল,

‘এই-যে এই মেয়েটা তখন থেকে অপেক্ষা করছে তোমার সাথে কথা বলার জন্য।’

‘হুম জানি। আর তুই মায়ের কাছে যা।’ ওর মুখমণ্ডল গম্ভীর দেখাল।

‘কেন কেন?’

‘নিশ্চয়ই তুই কোন আকাম করেছিস।”

‘আজব তুমি নিশ্চয়ই মাকে উলটাপালটা কিছু বলেছো।’ চোখ সরু করে বলল লিজা।

‘আমি কিছুই বলিনি। যা তুই।’ লিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। ইভান ভেতরে ঢুকতেই নিনা খামটা এগিয়ে দিল। খামটা হাতে নিয়ে তৈরিই হয়ে ছিল ও। ইভান নির্বিকার চিত্তে খামটা নিল। নিনা বলল, ‘এই চিঠি অনুযায়ী অবশ্যই আজকের মধ্যেই তোমাকে থা*নায় যেতে হবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।’

‘জানি ধন্যবাদ।’
নিনা অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বুঝতে চেষ্টা করল, ইভান এত নিশ্চুপ কেন? সকালে যেমনটা দেখেছিল সেরকম লাগছে না ওকে। তবে কিছু বলার পূর্বেই ইভানের চোখের তারা নেচে উঠল। সে কিছুটা তিক্ততার সাথে জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার সব কিছুতে নাক গলানোর একটা বদভ্যাস আছে তাই না?’

‘একটা সামান্য চিঠি তোমার হাতে পৌঁছে দিতে এসেছিলাম তাও আসতাম না যদি জানতাম ইভান দানির আসলে তুমি।’

‘তুমি আমাকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছ সেটা তো আমার ভুল না। এন্ড আজকের সকালেই না তোমাকে উপদেশ দিয়েছিলাম স্কুলের এইসব দায় দায়িত্ব নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।’

‘আর তোমার মনে হয়েছে সেই উপদেশ আমি গ্রহণ করেছি? আসলে তোমার সমস্যা টা কী আমার সাথে?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল নিনা।

ইভান স্তিমিত স্বরে বলল,
‘আমার মুখের প্রশ্ন ছিনিয়ে নিলে। এনিওয়েজ সমস্যা হলো তুমি এইখানে সবার ওপর খবরদারি করতে পারবা না। শেষে সবদিক থেকেই বিপদে পরবা। বলে রাখলাম।’

নিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘হুহ এখানে এসে তোমাকে বেজায় বিরক্ত করেছি বাট আই এম নট সরি। এনিওয়েজ এখন আমার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।’

ইভানও উঠে দাঁড়াল। বিদ্রুপ করে বলল, ‘তোমার অপর নাম যদি যন্ত্রণা হতো তাহলে তো আর বিষয়টা বুঝিয়ে বলাই লাগতো না।’
নিনা দাঁতে দাঁত চাপল। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে স্বাভাবিক ভাবেই বলার চেষ্টা করল, ‘হুম আমি মানুষকে যন্ত্রণা দিতপই ভালোবাসি। ভুল ভাবোনি।’ বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কাঠের মেঝেতে ঠকঠক শব্দ তুলে গটগট করে সোজা হেঁটে মূল ফটকের কাছে পৌঁছে গেল। ইভান দ্রুত গতিতে হেঁটে আসল। ইভান দরজাটা খুলে ধরে বল, ‘আমি যেটা গেস করি সেটা সাধারণত ভুল হয় না। এবারও ধারণাটা আশা করি ভুল হবে না।’

‘কোন ধারণা?’ বিরক্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘দেখা যাবে কে কাকে বেশি যন্ত্রণা দেয়।’ কথাটা বলার সময় এক নিগূঢ় হাসি ওর ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। নিনা শক্ত ভাবে উত্তর দিল, ‘অবশ্যই দেখা যাবে।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।