মনোহারিণী পর্ব-১৪+১৫

0
232

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
মনোহারিণী,
জানো কি? নারীর ওষ্ঠাধরে সব পুরুষের নেশা হয় না। কিছু পুরুষের নেশা হয় ব্যতিক্রম। এই যে তুমি নিজের ওষ্ঠাধরকে কারণ করে লুকোচুরি খেলছো, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। ওই ওষ্ঠাধরে যে আমার মোহ নেই। এত স্বাভাবিক নেশা আমায় কাবু করার ক্ষমতা রাখে না। আমার নেশা অভিন্ন। অতি ক্ষুদ্র; তবে সুবিশাল অনুভূতি মিশ্রিত। লজ্জাবতী ইলুরানি, তোমার কোমল ওষ্ঠে আমার নেশা নেই। আছে ডান গালে রাজত্ব করা ওই মিশমিশে কালো তিলটায়। ওষ্ঠের মাদকতা যার সৌন্দর্যের কাছে অকাতরে হার মানে। রোজ ওই মাদকতায় আসক্ত হই আমি। এর নাম মাদকাসক্তি নয়, তিলাসক্তি। অদ্ভুত না? অবশ্য তোমার চোখে গোটা আমিটাই তো অদ্ভুত। অদ্ভুত মানুষের আসক্তিও অদ্ভুত। এই অদ্ভুত আসক্তিটাই আমার বিশেষ প্রশান্তি।
ইতি
তোমার তিলাসক্ত অদ্ভুত মানব

এই অবধি এটাই একমাত্র চিরকুট, যা পড়তে গিয়ে আমি বারবার থমকে গেছি। লজ্জায় কুঁকড়ে পড়েছি। দৃষ্টির লক্ষ্য গুলিয়ে ফেলেছি। ডান গালের তিলটাকে ছুঁয়ে লাজুক হেসেছি। সবশেষে চিরকুট হাতে থম মে’রে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দৃষ্টি ওই সৌভাগ্যবান তিলটার ওপর। অথচ দূর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, শত খুঁজেও চোখের এক ইঞ্চি নিচে গালের ওই বিশেষ তিলের বিশেষ কোনো সৌন্দর্য পেলাম না। আমার চোখে বোধ হয় সৌন্দর্য উপভোগের পাওয়ার কমে গেছে। হতাশ হওয়ার অবকাশ পেলাম না। মা’রাত্মূক লজ্জা লাগছে। এই মানুষটা বোধ হয় রোজ আমায় নতুন-নতুন পদ্ধতিতে লজ্জায় ফেলার চিন্তাতেই নিজের রাতের ঘুম হারাম করে। দু-দুবার ঠোঁট নিয়ে লজ্জায় ফেলল, এখন আবার তিল নিয়ে। লজ্জা কা’টিয়ে ওঠার ফুরসতটুকুও দেয় না। এই তো আজ তিন দিন হলো আমি পুনরায় তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। নিজের কাজ আর রাজ ভাইয়ের বিয়ের বিভিন্ন প্ল্যানিংয়ের চাপে পড়ে সে-ও হয়তো কারো লুকোচুরি গল্পে নজর দেওয়ার ফুরসত পায়নি। আজ বুঝি সূয্যিমামা ভুল করে পশ্চিমাকাশে উদয় হয়েছে। তাই তো ঘুম থেকে উঠে এই অদ্ভুত চিরকুট জুটে গেল। চিরকুটের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটালাম। মানুষটা কি আমায় লজ্জা কা’টিয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র সুযোগ দিবে না? এই তো এবার আরও এক ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দিলো। অথচ আজ তার আশেপাশে থাকাটা আমার জন্য অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। ঘুম থেকে উঠেই শুনেছি আফরা আপু এসেছে। ঘুমুচ্ছে হয়তো। আমি নিশ্চিত তাজ ভাইয়ের সাথে সে এবার ওই অভিশপ্ত চিরকুট নিয়ে কথা তুলবেই। কখনও না কখনও তো অবশ্যই তুলবে। একবার হলেও তুলবে। এত বছর পর মুখোমুখি হলে পুরোনো কথা মনে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার আগেই পাজি লোকটা এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছে। না কি আমাকে এভাবে লজ্জায় ফেলে সরিয়ে রেখে সুন্দরী মেয়ে পটানোর ধান্দা? একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। কত প্রমাণই তো পেলাম। এমনিতেই কি আর মেয়েরা দেখামাত্রই বরফের মতো গলে যায়? আমার ভ্রু দ্বয়ের মাঝে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। বহুকষ্টে লজ্জা তাড়ানোর চেষ্টা চালালাম। ভাবলাম কোনোভাবেই এই লজ্জার খ’প্পরে পড়ে পালিয়ে বেড়ানো চলবে না। এই সময়টা অতি ভয়ানক। আশেপাশে থাকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই চিরকুটের কথাগুলো যেকোনোভাবে আমায় ভুলে থাকতে হবে। খাবার টেবিলে যখন ডাক পড়ল, তখনই পড়ে গেলাম ফ্যাসাদে। তাজ ভাই আগেই ডাইনিংয়ে বসে ছিলেন। গত দিনের মতো আজও নিজের খাবার নিয়ে রুমে পালানোর পাঁয়তারা করতেই আফরা আপুর আগমন ঘটল। আমাকে দেখে মুচকি হেসে সে নিজে থেকেই কুশল বিনিময় করল। আমিও হাসিমুখে কথা বললাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেয়েটাকে দেখেই আমার হাত নিশপিশ করছে। তাজ ভাইয়ের সাথে আমার যত গণ্ডগোলের মাথা এই মেয়ে। ইচ্ছে করে আমাকে ফাঁ’সিয়েছিল। মনে-মনে পণ করলাম তাজ ভাইয়ের চোখে আমাকে বিষ বানিয়ে তার কী এমন সুফল হয়েছিল, তা এবার জেনেই ছাড়ব। আফরা আপু তাজ ভাইয়ের দিকে পা বাড়িয়েছে দেখেই আমি তার উদ্দেশ্য ধরে ফেললাম। তাজ ভাইয়ের ওপাশে রাজ ভাই বসেছে, আর এপাশের চেয়ার ফাঁকা। খাবার নিয়ে রুমে পালানোর চিন্তাটা ফুস করে মাথা থেকে উবে গেল। আফরা আপু চেয়ারের কাছাকাছি আসার কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আমি ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লাম। তাজ মহাশয় ভাবলেশহীনভাবে খাচ্ছিলেন। তার মাঝে কোনোরকম হেলদোল দেখা গেল না। ওদিকে আফরা আপু আমার চেয়ারের পাশে মনক্ষুণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে দেখলাম চোখ দিয়ে আমাকে ভষ্ম করে দেওয়ার জোগাড়। তার দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে আমি হাসিমুখে পাশের চেয়ারটা টেনে দিয়ে বললাম,
“আপু, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
সে আমার পাশের চেয়ারে বসল না। রেগেমেগে গিয়ে তার বাবার পাশে বসে পড়ল।
“গাধার মুণ্ডুতে দেখছি বুদ্ধি জন্মেছে।”
পাশ থেকে চাপা স্বরের কটাক্ষ শুনে ভ্রুকুটি করে আড়চোখে তাকালাম। সঙ্গে-সঙ্গেই আরও এক লাইন শ্লেষ উপহার পেলাম।
“তোদের মেয়ে জাতির হিংসুটে স্বভাব তো অতি ভয়ঙ্কর রে। কেমন লজ্জা-শরমেরও মাথা খে’য়ে ফেলে! বাহবা হিংসুটে রমণীর জাতি।”
সেই যে আমি প্লেটে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। খাওয়ার ইতি টানা অবধি ভুল করে আড়চোখেও আর পাশ ফিরে তাকালাম না। তাজ ভাইও আর বিরক্ত করলেন না। বড়োদের সামনে ভদ্র মানুষটি সেজে রইলেন। কিন্তু আফরা আপুর ওপর ইতোমধ্যেই আমার ভীষণ বিরক্তি এসে গেছে। খাওয়ার মাঝে তার সেই পুরোনো বিখ্যাত স্বভাব বজায় রেখে বারবার যেচে পড়ে তাজ ভাইয়ের সাথে গল্প জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তাজ ভাই নিজে থেকে বিশেষ কোনো আগ্রহ না দেখালেও সে অযথা কথা বাড়িয়েছে। তাজ ভাইদের বংশধর না হলেও, এই মেয়েকেও নিঃসন্দেহে ওভার অ্যাক্টিংয়ের দলের সদস্য বলা যায়। যেহেতু তাজ ভাইয়ের একমাত্র ফুপির মেয়ে, সেহেতু কোনো না কোনোভাবে একটু হলেও রক্তের সম্পর্ক আছে বলা চলে। যদিও ফুপি একদমই ওমন না। নূর আঙ্কেলসহ তার ভাই-বোনরা সবাই খুব বেশিই ভালো। যত গণ্ডগোল তাদের পরবর্তী বংশধর বিচ্ছুগুলোর ভেতর।
বিয়ের বাকি আর মাত্র পাঁচ দিন। ভেবেছিলাম জুম্মান ভাইয়া আজ ভার্সিটি যাবেন না। কিন্তু সে নিজেই আমাকে তাড়া দিলেন ভার্সিটি যাওয়ার তাগিদে। ফাঁকিবাজ বাসায় থাকতে চায় না কাজের ভয়ে। বাসায় থাকলেই যে তাকে বারবার এটা-ওটা আনতে বাজারে যাওয়া লাগে। সৌরভ ভাইয়ার সাথে এই নিয়ে রীতিমতো খোঁচাখুঁচি বেঁধে যায় তার। নিজের বদলে একজন আরেকজনকে খাটানোর ধান্দায় থাকে সারাক্ষণ। বাসায় মেহমানের আগমন আস্তে-আস্তে বাড়বে। তাই সে যেচে পড়ে নিজের ঘাড়ের বোঝা বাড়াতে চায় না, বিধায় ভার্সিটি গিয়ে কাজে ফাঁকি দেওয়ার মতলব। আম্মির অনেক ইচ্ছে ছিল তার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে হবে। কিন্তু পাত্রীর পরিবার যেহেতু ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা, সেহেতু বাড়তি ঝামেলা বাড়ানোর ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে হয়েছে। নূর আঙ্কেল আম্মিকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, এক ছেলের বিয়ে ঢাকা হলে সমস্যা নেই। আরেকজন তো এখনও বাকি আছে। তার বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান না হয় গ্রামেই হবে। আম্মিও তা-ই মেনে নিয়ে দুঃখ ভুলেছে।
রাতে তাজ ভাই বাড়ি ফেরার পরমুহূর্তেই খেয়াল করলাম আফরা আপু কোনো এক বাহানায় ওনার রুমে গেছে। সেই থেকে মনের ভেতর খচখচ শুরু হলো। এই খচখচানি সহ্যের মাত্রা ছাড়াতেই কোনোকিছু না ভেবে আমিও দ্রুত পায়ে ওনার রুমের সামনে চলে এলাম। আফরা আপু রুমে ঢোকার পর দরজা খোলাই ছিল। তাই আমিও নির্বিঘ্নে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আফরা আপু টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টেবিলের একেকটা জিনিস ছুঁয়ে দেখছিল। তাজ ভাইকে রুমের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে না কি? আমার আগমন আফরা আপুর কাছে অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল।‌ আমাকে দেখেই সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“তুই এখানে যে?”
আমিও কোনোরকম ইতিউতি ছাড়াই উত্তর দিলাম,
“প্রয়োজনে এসেছি। তাজ ভাই কোথায়?”
“আমাকে বসতে বলে সেই যে ওয়াশরুমে ঢুকল, এখনও বেরোনোর নাম নেই। ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছে কি না আল্লাহ্ জানে।”
আফরা আপুর কথা শেষ হতেই তাজ ভাই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন,
“আমার রুম গল্প করার জায়গা না। ড্রয়িংরুমে যান আপামনিরা।”
আফরা আপু বলে বসল,
“ওয়াশরুমে ঢুকে কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাজ ভাই?”
“মশা বাবাজিরা আর ঘুমাতে দিলো কই? খোঁচাখুঁচি করে ঠিকই বের করে ছাড়ল।”
“ইলো বোধ হয় কোনো প্রয়োজনীয় কাজে এসেছে আপনার কাছে।”
তাজ ভাই এক ভ্রু কিঞ্চিত উঁচিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ওনার চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দৃষ্টি সরালাম। আফরা আপু পুনরায় আমাকে বলল,
“এই ইলো, তুই কিন্তু নক না করেই রুমে ঢুকে পড়েছিস। সেই খেয়াল আছে? না কি তুই এই কাজটা সবসময় করিস? এই স্বভাবটা কিন্তু একদম ভালো না। সবার একটা প্রাইভেসি আছে। এমন ভুল আর করবি না, বুঝলি? স্বভাব পালটানোর চেষ্টা করবি।”
আমি প্রত্যুত্তর করার জন্য মুখ খুলতেই তাজ ভাই ঘাড়ে হাত বুলাতে-বুলাতে ফট করে বলে উঠলেন,
“আফরা, এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? মাথাটা ধরেছে। বাইরে থেকে এসেছি তো।”
আফরা আপু হয়তো এই মুহূর্তে প্রস্থান করতে চাইছিল না। মুখটা একটু চুপসে গেল। আমার দিকে একবার সরু চোখে তাকিয়ে ‘আনছি’ বলে অনীহা নিয়েই রুম থেকে চলে গেল। তার প্রস্থানে স্বস্তি পেলেও, পরমুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে গেলাম। তাজ ভাইয়ের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। লজ্জা, দ্বিধা দুটোই একসঙ্গে ভর করল। এবার যদি উনি আমার প্রয়োজনীয় কাজের কথা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে কী উত্তর দিব? ওটা তো অযথা ঢপ ছিল। চিন্তায় জবুথবু হয়ে চলে যাওয়ায় কথা মাথায় আসার আগেই বাঁধা পড়ল। উনি এগিয়ে এসে আমার একদম মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ট্রাউজারের পকেটে দুহাত পুরে সটান দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,
“প্রয়োজনীয় কাজ?”
কোনো অজুহাত ঠিক না করে চলে এলেও, হুট করে আরও এক মিথ্যে উত্তর মাথায় আসতে এক মুহূর্তও সময় নিল না আমার মস্তিষ্ক। প্রশ্নের জবাবে বললাম,
“গতকাল যে বইটা এনেছিলেন, ওটা নিতে এসেছি।”
“কিন্তু গতকাল তো আমি কোনো বই আনিনি।”
ব্যস, হাতেনাতে ধরা খাওয়ার কাজ সারা। এরপর ফের কোনো বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে মাথায় এল না। চুপসানো মুখে আমতা-আমতা করতে লাগলাম। উনি তখনও আমার মুখ থেকে দৃষ্টি সরাননি। শেষমেষ বলে বসলাম,
“ওই, আগের দিনের বই। ভুলে গিয়েছিলাম আমি।”
“নিজের জিনিস নিজে খুঁজে নিতে শেখ।”
কথাটা বলেই উনি সরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলেন। ওনার ত্যাড়ামি কথায় এবার আর বিরক্তি এল না। অতি সন্তর্পণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বই খুঁজতে লেগে পড়লাম। পেয়েও গেলাম খুব সহজেই। যেহেতু বই পেয়ে গেছি, সেহেতু আর এখানে দাঁড়ানো যাবে না। কিন্তু আফরা আপু যে আবার আসবে। এই অসভ্য লোক তো সুন্দরী মেয়ে পটানোর পেছনেই পড়ে থাকে। গোমড়া মুখে একবার আয়নার দিকে তাকালাম। উনি তখন আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের দিকেই সরু চোখে তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই বললেন,
“বই পেয়েও দাঁড়িয়ে আছিস কোন মতলবে? নিজের রুমে জায়গা নেই? না কি এখানেই রাত পার করার ধান্দা? আমার রুমে ভাইয়ার শেয়ার আছে, ইউ হ্যাভ নো চান্স। গিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে শুয়ে পড়।”
আমি বিনা প্রতিক্রিয়ায় কথা ঘুরিয়ে ফেললাম।
“কাল এয়ারপোর্টে কে কে যাবে?”
উনি আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চুলের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে উত্তর দিলেন,
“ছেলেরা যাবে। তোরা মেয়েরা হলি একেকটা সাংঘা’তিক সুবিধাবাদী। বাইরে গেলেই শুধু খাই-খাই করিস। একটাকেও নিব না। যেচে পকেট খালি করার সাধ নেই।”
“আমি কবে খাই-খাই করলাম?”
“তুই তো জাতীয় ধান্দাবাজ। নিজে ফাঁসবি না। অন্যগুলো কাজ হাসিল করবে, আর তুই ফ্রি সার্ভিস নিবি। ধান্দাবাজ গাধী।”
আফরা আপু চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। হয়তো তার ধারণা ছিল আমি অনেক আগেই চলে গেছি। তাজ ভাইকে বলে রুমে ঢুকে চা এগিয়ে দিলো। তাজ ভাই হাসিমুখে চা নিয়ে চুমুক দিতেই হাতটা শিরশির করে উঠল। গরম চায়ের কাপটা ওনার মাথার ওপর উলটে ধরার প্রবল ইচ্ছেটাকে অতি কষ্টে দমিয়ে রাখলাম। আফরা আপু জানাল সবাইকে ডিনারের জন্য ডাকছে। তাজ ভাই চায়ের কাপ হাতে নিয়েই হাঁটা দিলেন। আফরা আপুও তার পেছনে চলল। অগত্যা আমিও তাদের সাথে চললাম। আফরা আপু তাজ ভাইকে পাশ কা’টিয়ে আগেই রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই তাজ ভাই হাঁটার গতি কমালেন। আমিও ওনাকে পাশ কা’টিয়ে যাওয়া ধরতেই চাপা স্বর কর্ণগুহরে ধাক্কা খাওয়ায় থমকে গেল পা জোড়া। কানের কাছে বেজে উঠল,
“আমার সামনে তোমার যেকোনো মিথ্যে বিশ্বাসযোগ্য হতে অক্ষম। নিজের অক্ষমতা বুঝতে শেখো, ইলুপাখি।”
চকিতে চোখ তুলেও ওই স্বরের উৎপত্তিস্থল পেলাম না। ততক্ষণে মানুষটা রকেটের গতিতে গিয়ে চেয়ার দখল করে বসে পড়েছে। হাবলার মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কেবল ওই নতুন ডাক, নতুন সম্বোধন স্মরণ করলাম, অনুভব করলাম। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হতেই বিচলিত পায়ে সোজা রুমে চলে গেলাম। রুমে ঢোকার আগে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম, মশাই কেবল এক চুমুক দেওয়া চায়ের কাপটা আলগোছে আম্মির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ইশারায় ওটা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছেন বোধ হয়। রুমে ঢুকেই ঠোঁট টিপে হেসে ফেললাম। আহারে সাধের চা!
পরদিন সকাল হতে না হতেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরি হলো। কী কী রান্না হবে এই নিয়ে বড়োরা একের পর এক সিদ্ধান্ত বদল করে চলল। পরিবারের কর্তা আসছে যে আজ। মেয়েদের কাউকে এয়ারপোর্ট নেওয়া হবে না, এই নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গেছে। বাসায় যারা উপস্থিত আছে তারা তো আছেই, সাথে আবার যোগ হয়েছে তাজ ভাইয়ের মামাতো বোন। তারা আজ বিকেলের মধ্যেই আসছে। উক্ত খবর জানামাত্রই ফোন করে-করে আমিরা আপুদের আন্দোলনে যোগদান করেছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সৌরভ ভাইয়া বারবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করছেন,
“ভাগ্যিস আমার আপু ম্যারিড। নইলে এই পাগলা গারদে আরও একটা পাগলি বাড়ত। যাক বাবা, একটা আপদ কমল।”
আমি হেসে জানতে চাইলাম,
“আপনার পরিবার কবে আসবে, ভাইয়া?”
“সম্ভবত বিয়ের আগের দিন। দেরী করে আসুক তা-ই ভালো। নইলে আমার আর সোফাতেও জায়গা হবে না। ফ্লোরে ঘুমাতে হবে। ফ্লোরে শুয়ে ফোন চাপতে বহুত কষ্ট হয় আমার।”
এদিকে তাজ ভাইকে কোনোভাবেই মানাতে না পেরে সবাই রাজ ভাইয়ের পিছু নিয়েছে। কোনোভাবে রাজ ভাইকে রাজি করাতে পারলেই হলো। যাওয়ার ইচ্ছেটা আমারও প্রবল। কিন্তু এখানকার হৈ-চৈ দেখে মুখ খুলতেও ইচ্ছে করছে না। মনকে বুঝালাম, সবাই যেতে পারলে আমিও যাব, না পারলে নেই। হুট করে তাজ ভাইয়ের গতকালের ওই কথাটা মনে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে আমার ভাবনার খবর জানতে পারলে হয়তো আরও একবার কটাক্ষ করে বলতেন, ‘এই তো আজ আবার ঠিকই ফ্রি সার্ভিস নেওয়ার ধান্দায় আছিস।’ কিন্তু পরমুহূর্তে বরাবরের মতোই অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। তাজ ভাই রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছিলেন। আমি তখন ড্রয়িংরুম থেকে আসছিলাম। ওনার পাশ দিয়ে যাওয়া ধরতেই চুলের মুঠিতে মৃদু টান অনুভব করলাম। আকস্মিক বাঁধায় পা দুটোও থেমে গেল। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করার ফুরসত পেলাম না। ততক্ষণে মহারাজ চাপা স্বরের একটা বাক্য ব্যয় করেই চুল ছেড়ে চোখের পলকে হনহন করে হেঁটে সদর দরজা খুলে চলে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত কে’টে যাওয়ার পরও আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। কথাটা সত্যি ছিল, না কি চাপাবাজি? পরক্ষণেই মনটা চেঁচিয়ে উঠল, তার চাপা স্বরে বলা কথাগুলো একটাও মিথ্যে না। এটা যে তার সত্য বলার অনন্য ধরণ। জুম্মান ভাইয়ার ডাকে গাঢ় ভাবনায় ছেদ পড়ল। উনি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য ডাকছেন। আমিও তড়িঘড়ি করে রওয়ানা হলাম। কিন্তু তখনও আমার মস্তিষ্ক ওই বাক্য স্মরণ করে সন্তর্পণে আনন্দিত হচ্ছে।
“সন্ধ্যায় এসে যেন রেডি দেখি। এক মিনিট লেট করলে এয়ারপোর্ট যাওয়ার ভিসা বাতিল।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
আমার ভাগ্যেরও ভাগ্যে তাজ পরেছে। দুর্ভাগ্যবশত ভাগ্যের মাথা নেই, তাই তার ভাগ্যেই তাজ পরেছে। কে পরিয়েছে তা মূখ্য বিষয় নয়, পরতে যে পেরেছে এটাই আপাতত মূখ্য। তবে এই ভাগ্য থেকে আদৌ তা মাথা পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না, সে বিষয়ে আমি নিজেই অবগত নই। সমস্ত ভূখণ্ডের মেয়েরা তাজ পরে নিজেদের মাথায়, আর আমার জুটেছে ভাগ্যে। মাথা পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে যে লুকোচুরির দেয়াল ভাঙতে হবে। ভাগ্যের বেলায় তো আর ওমন বাধ্যবাধকতা নেই। সে কোনো দেয়াল মানে না। তার হাজারো গল্প চলে আড়ালে আবডালে, অদ্ভুত কাণ্ডে। এই তো আজ ভাগ্যের জোরে কুখ্যাত ডিটেকটিভ মিস্টার আহনাফ তাজওয়ারের গ্যাংয়ের সাথে এয়ারপোর্ট অবধি পৌঁছে গেছি। অথচ কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল, আমরা মেয়েরা কেউ তাদের সাথে যেতে পারব না। এই নিয়ে হ’রতালের শেষ পর্যায়ে তাজ ভাই মেয়েদের জন্য এক শর্ত দাঁড় করালেন। সেই শর্ত শুনে একেকজনের মাথায় আস্ত-আস্ত বজ্রপাত আছড়ে পড়েছে। রুদ্ধশ্বাসে থম মে’রে বসে কা’টিয়েছে কয়েক মুহূর্ত। তীব্র আক্ষেপ, আফসোস নিয়ে অনুরোধের বস্তা খুলে বসেছে। শর্ত হলো এয়ারপোর্টে কেবলমাত্র তারাই যেতে পারবে যারা রাজ ভাইয়ের বিয়ের কোনো প্রোগ্রামে মেকআপ ব্যবহার করবে না। অর্থাৎ বিয়ের কটা দিনের জন্য মেকআপকে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করতে হবে। নচেৎ কোনো মূল্যেই তাদের সাথে নেওয়া হবে না। শর্ত শুনে সর্বপ্রথম আহাজারি করে উঠল আমিরা আপু আর মিনহা আপু। বড়ো ভাইয়ের বিয়েতে মেকআপ ব্যবহার করতে পারবে না, এটা তাদের কাছে ফাঁ’সির রায় ঘোষণার সমান। তারপর শুরু হলো তাজ ভাইয়ের মামাতো বোন আনহা আপুর আহাজারি। আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে আমি বলে দিলাম আমার কোনো সমস্যা নেই। কারণ আমি এমনিতেও খুব একটা মেকআপ করি না। মাঝখান থেকে আফরা আপু চুপ মে’রে রইল। বহু চিন্তা ভাবনার পর বিনীতভাবে বলল সে একদমই সামান্য মেকআপ করবে, যেটুকু না করলেই নয়। প্রথমে কেউ রাজি না হলেও, পরে কী ভেবে তাজ ভাই মেনে নিলেন। শেষে তাদের সাথে আসার ভাগ্য হয়েছে আমার, অলির আর আফরা আপুর। এয়ারপোর্ট আসার পথে অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড ঘটল। যে আফরা আপু এসে হতে তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে চলছেন, সেই আফরা আপুকেই নিজের গাড়িতে নিজের পাশের সিটে ডেকে বসিয়েছেন তাজ ভাই। ওনার গাড়িতে আফরা আপু, রাজ ভাই আর ওনাদের মামাতো ভাই আদনান ভাইয়াকে বসালেন। জুম্মান ভাইয়ার গাড়িতে বসালেন আমাকে, অলিকে, হিমেল কাকাকে আর সৌরভ ভাইয়াকে। তখন থেকে পুরোপুরি আহাম্মদ বনে গিয়ে বসে আছি আমি। এখানেই থেমে যায়নি। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমরা এয়ারপোর্ট পৌঁছে যখন নূর আঙ্কেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম, তখন দৃষ্টিগোচর হলো তাজ ভাই আফরা আপুর সাথে গুজ-গুজ করছেন। নিজেদের গুজগুজানি নিয়ে দুজন এতটাই ব্যস্ত যে, অন্য কোনোদিকে কারোর নজর নেই। আদনান ভাইয়াকে জুম্মান ভাইয়াদের সাথে বলতে শুনলাম গাড়িতে বসেও দুজন সারাটা পথ এমন গুজ-গুজ করেছে। হুট করেই আমার মনের কোথাও একটা অজানা শঙ্কা কড়া নাড়ল। বুকের ভেতর শুরু হলো মৃদুমন্দ শব্দের ধুকপুকানি। কোনো এক অমূল্য সম্পদ হারানোর ভয়ে কন্ঠনালি শুকিয়ে এল। বারবার ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখলাম। দ্বিতীয়বার আর ওই মানুষ দুটোর দিকে ফিরেও তাকালাম না। চুপচাপ জুম্মান ভাইয়া আর সৌরভ ভাইয়ার খোঁচাখুঁচি দেখলাম। নূর আঙ্কেলের দেখা পাওয়ার পর সবাই আনন্দে মেতে উঠলাম। হাসিমুখে সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর সবাই গাড়ির কাছে ফিরে আসতেই আঙ্কেল আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা বাইরে থেকে কিছু খেয়ে যাব কি না। রাজ ভাইয়ের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন ছোটোদের নিয়ে বাইরে খাওয়া-দাওয়া করে পরে বাসায় ফিরতে। আর আঙ্কেল হিমেল কাকাকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাবেন। বাকি সবাই এতে চাপা স্বরে হৈ-হৈ করে উঠলেও, আমি সঙ্গে-সঙ্গেই বলে দিলাম আমি আর বাইরে থাকতে পারব না। আঙ্কেলের সাথেই বাসায় ফিরে যাব। কারণ হিসেবে দাঁড় করালাম মাথা ব্যথাকে। তবু সবাই একটু জোরাজুরি করলেও নূর আঙ্কেল বাঁধ সাধলেন। আমাকে ওনাদের সাথে নিয়ে বাকি সবাইকে বললেন খাওয়া-দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। ফিরে আসার মুহূর্তে কারো স্থির, শীতল দৃষ্টি টের পেয়েও ইচ্ছে করে চোখে চোখ রাখলাম না। আঙ্কেল আর হিমেল কাকার সাথে চুপচাপ বাসায় ফিরে এলাম। নূর আঙ্কেলকে পেয়ে বাসায় উৎসবের আমেজ তরতর করে বেড়ে গেল। আমার মাথাব্যথার কথা শুনে আম্মি চটপট চা করে দিলো। চা খেয়েই আমি চুপচাপ রুমে চলে এলাম। এসেই ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। মস্তিষ্কের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু চোখ জোড়া বড়ো অবাধ্য হয়ে উঠল। কিছুতেই ঘুমের রাজ্যের দেখা মিলল না। এপাশ-ওপাশ করে রীতিমতো বিরক্তি বাড়ল। তবু চরম অলসের মতো বিছানায় পড়ে রইলাম। অনেকটা সময় পর চোখ জোড়া ক্লান্ত হয়ে বুজে এল। ঘুমের স্থায়িত্ব কতক্ষণ হয়েছে জানা নেই। কানে লাগাতার সুরসুরি অনুভব করায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে দারুণ অনীহা নিয়েই পিটপিট করে চোখ খুললাম। বিছানার পাশে দণ্ডায়মান গম্ভীরমুখো পুরুষটিকে দেখে চোখ কুঁচকে ফেললাম। চোখে চোখ পড়তেই সূক্ষ্ম এক অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ওপাশ থেকে ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর ভেসে এল,
“মাথাব্যথার ভং ধরে পড়ে থাকতে হবে না আর, উঠে পড়। খেতে ডাকছে।”
প্রথম কথাটা এড়িয়ে গিয়ে আমি থমথমে মুখে শেষ কথার উত্তর দিলাম,
“ক্ষুধা নেই, ঘুমাব আমি।”
“ত্যাড়ামি উত্তর শুনতে চাইনি। উঠতে বলেছি।”
“আমার ক্ষুধা পেলে আমি নিজেই যেতাম, ডাকতে হত না। আপনি গিয়ে নিজের ক্ষুধা মেটান।”
পাশে ধপ করে কিছু পড়ার শব্দ হতেই চোখ খুললাম। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম উনি পেছনে বসেছেন। কন্ঠে আফসোস নিয়ে বললেন,
“সব ক্ষুধা কি আর ভাতে মেটে রে গাধি?”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। লোকটা কখন কী উদ্দেশ্য করে কী কথা বলে নিজেই জানে না। কথার ধরণ! আমি পূর্বের ন্যায় বললাম,
“আপনি যান তাজ ভাই,‌ প্লিজ। আমার মাথাব্যথা কমেনি।”
“তোর মাথাব্যথা হয়েছে কখন যে কমবে? সত্য হলে এতক্ষণে কমে যেত, মিথ্যে বলে কমেনি। কমার কোনো চান্সও নেই।”
এবার আমি বিরক্তির সুরে বলে উঠলাম,
“কত সত্যই আমাদের আড়ালে ঘটে। আপনার কোনো বিষয়ে তো আমি ডিকটিভিটি করতে যাই না। আপনি কেন করতে আসেন? আমার সব বিষয়ে আপনাকে ডিটেকটিভিটি করতে ডাকিনি আমি।”
তারপর কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা চলল। সাড়া না পেয়ে আমি ভ্রুকুটি করলাম। এখনও পাশে বসে আছে, অথচ মুখে রা নেই কেন? কথাটা গায়ে লাগল বুঝি? বেশ হয়েছে। এবার বুঝুক মজা। হাতের কব্জিতে টান অনুভব করতেই চট করে ঘাড় ঘুরালাম। ততক্ষণে তাজ ভাই এক টানে আমাকে সটান বসিয়ে দিয়েছেন। আমি কিছু বলার আগেই রুষ্ট গলায় বললেন,
“নাম, আর একটা কথা বললে শুট করে খুলি উড়িয়ে দেবো। নাম, কুইক।”
ওনার মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে আমি বললাম,
“কী শুরু করেছেন আপনি? আজব! বললাম না আমার ক্ষুধা নেই? আমি খেলে কি আপনার পেট ভরবে? রোজ-রোজ খাবার নিয়ে আপনার এই টানাহেঁচড়া ভালো লাগে না আমার।”
উনি এবার ধমকে উঠলেন,
“থাপড়ে ত্যাড়ামি ঘুচিয়ে দেবো। সবাই খাচ্ছে বলে আমি ডাকতে এসেছি। এতক্ষণ অবধি তোর ত্যাড়ামি দেখতে আসিনি। পাছে সবাই না ভেবে বসে এতক্ষণ ধরে তোকে ওরে সোনা, ওরে ময়না বলে কোলে নিয়ে বসে ঘুম ভাঙাচ্ছি আমি। দেখ, আমি আগাগোড়া খুব বেশি ভদ্র ছেলে। তোর জন্য কোনো মিথ্যে অপবাদ নিতে পারব না। তারপর দেখা গেল সেই অপবাদ ঘোচাতে সবাই তোকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলো। তোর মতো আস্ত এক মাথামোটা, বলদ, ধান্দাবাজকে গলায় ঝুলিয়ে আমার শান্তিপূর্ণ জীবনটা বরবাদ করার কোনো শখ নেই।”
আমি অবাক হয়ে ওনার কথা শুনলাম। এত ছোটো একটা ব্যাপারকে টেনেহিঁচড়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল! সাধে কি একে বিপজ্জনক বলি? কপট রাগত স্বরে বললাম,
“কী সব বলছেন! সারাক্ষণ বাজে কথা ছাড়া টিকতে পারেন না আপনি? এই রাত-দুপুরে আমাকে বিরক্ত করে কী মজাটা পাচ্ছেন, শুনি? সবাই খাচ্ছে, আপনিও খান গিয়ে। আমার খাওয়া নিয়ে জোর করার কী দরকার ছিল? আপনার প্রাণপ্রিয় মানুষদের গলা দিয়ে খাবার নামবে না আপনাকে ছাড়া। দয়া করে যান।”
উনি শক্ত মুখে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কথা শেষ হতেই আলগোছে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি ভাবলাম রেগেমেগে বুঝি চলে যাবে। কিন্তু তা হলো না। যা হলো তা দেখেই আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। আমার পাশেই জেমি আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে ছিল। নিষ্ঠুর, পাষাণ মানুষটা চোখের পলকে আমার পাশ থেকে জেমিকে নিজের দুই হাতে তুলে নিলেন। গভীর ঘুমের মধ্যে শূন্যে ভাসতেই হকচকিয়ে জেমির ঘুম ভেঙে গেল। নিজের অবস্থান দেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিয়াও, মিয়াও করে ডাকতে লাগল। আমি চকিতে রসগোল্লার মতো চোখ করে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম,
“আরে! ওকে এভাবে তুললেন কেন? ভয় পেয়েছে। দিন ওকে, ঘুমাচ্ছিল তো। এটা কেমন কাজ তাজ ভাই?”
উনি দুহাত তুলে জেমিকে আরও ওপরে উঠিয়ে বলল,
“আর একটা শব্দও যেন মুখ থেকে না বেরোয়। চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে গিয়ে ডাইনিংয়ে বসবি। নইলে তোর এই হীরার টুকরো বিলাই আমার হাত ফসকে পড়ে ফ্লোরে আছাড় খেলে, পরে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবি না।”
রাগে আমার মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। ডান পা দিয়ে মেঝেতে সজোরে আঘা’ত করে ধুপধাপ পা ফেলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখলাম উনি জেমিকে পূর্বের জায়গায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি খানিক অবাক হলাম। জেমিকে তো দুচোখে সহ্য করতে পারে না। তাহলে এভাবে কী দেখছে? লোকটা আসলেই অদ্ভুত! আমাকে দেখে উনি একগাল হাসলেন। আহা কী মিষ্টি হাসি! যেন কিছুক্ষণ আগে যা হয়েছে সবই তার অজানা। ওনার দিকে আর তাকালাম না। ঈষৎ রাগ নিয়েই চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। টেবিলে এসে দেখলাম আম্মি, ফুপি আর আফরা আপু এখনও খাচ্ছে। বাকিদের খাওয়া শেষ। আমাকে দেখে আম্মি খেতে বসতে তাড়া দিলো। আমি বসতেই আফরা আপু প্রশ্ন করল,
“তাজ ভাই না তোকে ডাকতে গেল? এতক্ষণ লাগে ডাকতে? কোথায় উনি?”
আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এজন্যই ওনাকে বলেছিলাম চলে আসতে। ঘাড়ত্যাড়া লোকটা কথা তো শুনলই না, এখন আমাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলল। আমি আম্মির হাত থেকে নিজের প্লেটটা নিয়ে বললাম,
“জেমির সাথে দুষ্টুমি করছে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তো, প্রথমে ডাক শুনতে পাইনি।”
আফরা আপুর শকুন দৃষ্টি দেখে মনে হলো সে আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আম্মি গলা বাড়িয়ে তাজ ভাইকে ডাকতেই উনি দ্রুত পায়ে হেঁটে টেবিলের কাছে উপস্থিত হলেন। আমার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে আম্মির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমাদের এই কুম্ভকূর্ণকে ঘুম থেকে তোলার কাজটা দয়া করে আর আমাকে দিবে না, আম্মি। একে তুলতে-তুলতে আমার নিজেরই ঘুম পেয়ে যায়।”
আমি খাবার চিবোতে-চিবোতেই সবার অগোচরে মুখ বাঁকালাম। উপস্থিত ব্যক্তিরা তো আর এই মিথ্যেবাদীর মধুর সুরের সত্যতা ধরতে পারবে না। গিরগিটি একটা! ফুপি খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। আম্মিও এঁটো বাসন রান্নাঘরে নিতে ব্যস্ত হলো। আফরা আপুর হাবভাব দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না সে ইচ্ছে করেই রিল্যাক্সে খাচ্ছে। এরমধ্যে তাজ ভাইয়ের সাথে গল্পও জুড়ে দিয়েছে। আমি চুপচাপ খাবারের সাথে আস্ত-আস্ত অভিমান গিলে চলেছি। অথচ যাকে ঘিরে এত অভিমানের মেলা, সে কি মাইন্ড রিড করতে ভুলে গেছে? এই তো কিছুক্ষণ আগেও আমার মিথ্যে মাথাব্যথার কথাটা অকপটে বলে দিলো। এখন সেই দৈব ক্ষমতা আফরা নামক তৃতীয় ব্যক্তির জন্য গায়েব হয়ে গেছে? হঠাৎ আফরা আপুর মুখ থেকে এক বিষ তীর ধেয়ে এসে কানে বিঁধতেই আমি চরম বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকালাম। সে বলে উঠল,
“ইলো, কথা বলছিস না যেহেতু, সেহেতু দ্রুত খাবারটা শেষ করে উঠে গেলেই পারিস। শুধু-শুধু গোঁ ধরে বসে থেকে কারোর মাঝে থার্ড পার্সন হয়ে তো কাজ নেই, তাই না? অবশ্য তোর তো আজীবনই থার্ড পার্সন হওয়ার অভ্যাস। বদ অভ্যাস থেকে বেরোতে পারিসনি আজও। তাড়াতাড়ি খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়।”
আমি হতবিহ্বল হয়ে একবার আফরা আপুর দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাজ ভাই তখন আফরা আপুর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। আমার মৌনতায় উনিই আফরা আপুকে বলে উঠলেন,
“তুইও দেখছি মানুষকে ফাঁসানোর বদ অভ্যাসটা থেকে আজও বেরোতে পারিসনি। ফুপি হয়তো সময়মতো তোকে দু ঘা লাগাতে পারেনি। অ্যানি ওয়ে, আমি কিন্তু এনকাউন্টারটা খুব ভালোই জানি। ট্রেনিং প্রাপ্ত তো। তোর ওপর ট্রাই মা’রা যায়? ধাক্কা সামলে উঠতে পারবি তো?”
উনি মিষ্টি হাসিতে সুমিষ্ট সুরে যেভাবে কথাটা বললেন, আফরা আপুর সাথে আমি নিজেও বিশৃঙ্খলায় পড়ে গেলাম। এই মিষ্ট সুরে তিক্ত কথাটা আফরা আপুকে না রাগতে দিলো, না খুশি হতে দিলো। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জোরপূর্বক বোকা হেসে বলল,
“থাক, আপনার ডিটেকটিভিটি ডেস্ক, ফিল্ড অবধিই রাখুন। বাসায় দেখানোর দরকার নেই।”
এরপর আর আফরা আপু দেরী করল না। দ্রুত পানি পান করে টেবিল ছাড়ল। আমি কেবল নীরব দর্শকের মতো আফরা আপুর মুখের নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখলাম। আফরা আপু দৃষ্টির আড়াল হতেই চাপা অভামানটা মনের দ্বারে ঠক-ঠক করে কড়া নাড়ল। খাবারটা পুরোপুরি শেষ না করেই একটু পানি মুখে দিয়ে উঠতে যেতেই আবার উনি পাশ থেকে খপ করে ডান হাতের কব্জি ধরে ফেললেন। বাঁধা পেয়ে আমার আর ওঠা হলো না। তাজ ভাই শক্ত গলায় বললেন,
“কী সমস্যা? খাবার শেষ না করে ওঠার অভ্যাস কবে থেকে হলো?”
আমি ওনার চোখে স্থির দৃষ্টি আটকে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললাম,
“থার্ড পার্সনদের দূরে থাকাই ভালো। যত কাছে থাকবে, তত অসুবিধা বাড়বে। আমি আসলে কখনোই কারোর মধ্যে এলাচি হতে চাই না। না বাসায়, না বাইরে।”
ওনার দৃষ্টি শান্ত হয়েই আমার মুখে নিবদ্ধ রইল। আমি হাত মোচড়াতে-মোচড়াতে বললাম,
“আমার খাওয়া শেষ। হাত ছাড়ুন। আরও আগে ওঠা উচিত ছিল বোধ হয় আমার। অজান্তেই এলাচি হয়ে গেলাম। ছাড়ুন।”
ওনার মাঝে হাত ছাড়ার কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হলো না। বরং নিজের ডান হাতে তোলা খাবারটুকু হুট করে আমার মুখে পুরে দিলেন। আবার পুরোপুরি বোকা বনে গিয়ে আমি মুখের খাবারটুকু চিবোতে ভুলে গেলাম। এই লোকটার সাথে আদৌ কি পেরে ওঠা সম্ভব? এই যে এক সামান্য কাণ্ডে কারো চাপা অভিমানের পাহাড় এক নিমিষে ধ্বসে পড়েছে, সে খবর কি সে রাখে? মাইন্ড রিডার হয়েও কেন পারছে না? অবশ্য পারলেও কবে প্রকাশিত হলো? না হয়েছে, না হচ্ছে। ভবিষ্যতে হবে কি না, তা-ই বা কে জানে? এ যে গোটাটাই এক চরম অদ্ভুত মানব। ভেতরের অনুভূতি ধামাচাপা দিয়ে মেকি বিরক্তি প্রকাশ করতে যেতেই উনি পুনরায় স্বভাবসুলভ বাঁধ সেধে বসলেন। আমায় আরেক দফা বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় কৈফিয়তের সুরে বলে চললেন,
“আমাদের চোখের দেখার আড়ালে অনেক সত্য থাকে, যা ইচ্ছে করলেই আমরা দেখতে পারি। কিন্তু ওভার থিংকিংকে ওপরে রেখে যেচে নিজেদের দেখার চোখকেই অন্ধ করে ফেলি। নতুন একটা কেসের ইনভেস্টিগেশনে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ইনফরমেশন দরকার ছিল। আফরার সাথে ওই ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করেছিলাম। ও মেডিক্যালের স্টুডেন্ট তো, তাই ওর থেকেই ইনফরমেশনগুলো জোগাড় করার সুযোগ পেয়েছি। নাথিং এলস্।”
আমি ফট করে বলে বসলাম,
“তাহলে কি গত ছয় বছর আগে ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারও যেচে নিজের দেখার চোখকে অন্ধ করে ফেলেছিল?”
উনি মৃদু হাসলেন। ওনার এই অকৃত্রিম হাসিটা খুব সূক্ষ্মভাবে আমার সেই অতি পুরোনো অভিমানকে এলোমেলো করে দিলো। পরমুহূর্তেই এলোমেলো অভিমানের ভীত নড়বড়ে করে উনি আমার মুখে আরও এক লোকমা খাবার পুরে রহস্যময় এক বাক্য আওড়ালেন,
“ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের টার্গেট খুব সূক্ষ্ম, ইলুপাখি। ডেস্ক, ফিল্ড অর মাই হোম, অ্যানি প্লেস। আই অ্যাম দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ, ইউ নো?”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤