মনোহারিণী পর্ব-২+৩

0
321

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
আজ আমার মনটা ভীষণ, ভীষণ খারাপ। সুন্দর সন্ধ্যাটা চোখে সুন্দর লাগলেও, মন তাতে সায় দিচ্ছে না। মন খারাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিষ্ঠুর মুগ্ধতাও দেখার চোখকে অসুন্দর করতে লেগে পড়েছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আবছা আকাশটা দেখার উৎসাহ পাচ্ছি না। অনুভব করতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছি। অনুভব করার চেষ্টা করলেই ঘাড়ত্যাড়া মনটা অতি মধুর কন্ঠে বার্তা পাঠাচ্ছে, তোমার মন খারাপ। মন খারাপের মাঝে আমি আজকের সন্ধ্যার নাম দিলাম, মন খারাপের এক সন্ধ্যা। তাই নয় কি? আসলেই তো তাই। আমার আজকের সন্ধ্যাটা তো মন খারাপে ছাওয়া এক বিরক্তিকর সন্ধ্যা। আমার মতোই আমার মন খারাপগুলোও ভীষণই অদ্ভুত প্রকৃতির। আমি খুব সহজেই মন খারাপ করি না। মন খারাপ করে থাকতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। কেমন অসহ্য লাগে! প্রচন্ড বিরক্তিতে ছেয়ে যায় মস্তিষ্ক। মাসে দুবার মন খারাপ করার আগে আমি চারবার ভাবি। অথচ আজ আর ভাবাভাবির সময় হলো না। হুট করেই মন খারাপের ডাকপিওন দোরে কড়া নাড়ল। আমি না চাইতেও দোর খুলতে বাধ্য হলাম। এটাই হলো আমার মন খারাপের এক সন্ধ্যার মূল কারণ। সাড়ে
আট মাস আগে তাজ ভাই যখন সুইডেন থেকে ফিরেছিলেন, তখন আমি ছিলাম শরীয়তপুর নিজের বাড়িতে। এইচএসসির চিন্তায় সিলেবাসের পদতলে পিষ্ট। তাই আব্বু ছাড়া কেউই ঢাকায় আসতে পারিনি। তাজ ভাইও সঙ্গে-সঙ্গে শরীয়তপুর যাননি, তাই আমার সাথে দেখাও হয়নি। তারপর উনি চলে গেলেন ট্রেনিংয়ে। উনি ট্রেনিংয়ে যাবার পর অবশ্য আম্মি শরীয়তপুর গিয়েছিল। তারপর আমার রেজাল্ট বের হলো। অ্যাডমিশন নিলাম ঢাকাতে। আব্বু হলে রাখার কথা বলায় নূর আঙ্কেল আর আম্মি রেগে যায়। তাদের কথাতেই আমি তাদের বাসায় উঠি। রাজ ভাই বাড়িতে থাকেন না। চাকরিসূত্রে চট্টগ্রাম থাকেন। মাঝেমধ্যে এসে কয়েকদিন থেকে যান। পুরো বাসায় আম্মি একা। গত পাঁচ বছর ধরে আম্মির একা সংসারে সঙ্গী ছিল নূর আঙ্কেলের বড়ো ভাইয়ের পরিবার। তারা পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। তাজ ভাইয়ের বড়ো কাকার মেয়ে আমিরা আপু আর মিনহা আপু আম্মিকে সঙ্গ দিত। শরীয়তপুর থেকে নূর আঙ্কেল আর আম্মির পরিবারের লোকজনও আসত। প্রত্যেক মাসে আসেন হিমেল কাকা। আমি আসার পর আমিরা আপু আর মিনহা আপু ছুটি পেয়েছিল। তারপর থেকে আম্মির সংসারে আমিই একমাত্র সঙ্গী। ট্রেনিং শেষে গতকালই তাজ ভাই ফিরলেন। আর এটাই সুইডেন থেকে ফেরার পর ওনার সাথে আমার প্রথম দেখা। তাজ ভাই ফেরার পর আমার পরীক্ষার জন্য আব্বু ব্যতীত আর কেউ তাকে দেখতে আসতে পারেনি। এ কারণেই এবার আমার পরিবারের ঢাকায় আসা। মিথি আর ইকরার ক্লাস কামাই যাচ্ছে বলে তারা আজই চলে গেছে। পরিবার থেকে দূরে থাকার অভ্যাস আমার কোনোকালেই ছিল না। অথচ এখন পড়াশোনার জন্য দূরে থাকতে হচ্ছে। তারা চলে যাওয়ার সময়ও ইচ্ছে করছিল সবাইকে নিজের কাছে আটকে রাখতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তারা যাওয়ার পর থেকেই তীব্র মন খারাপে ছেয়ে গেছে আমার সুন্দর সন্ধ্যা। রাজ ভাইও আগামীকাল চলে যাবেন। তাই উনি গেছেন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। আম্মি রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। এই মহিলা যে সারাক্ষণ রান্নাঘরে কীভাবে থাকে, আমি ভেবে পাই না। সে পারলে বোধ হয় চব্বিশ ঘন্টাই ওখানে কাটিয়ে দিত। তাজ ভাই বাসায় আছেন, কিন্তু কী করছেন, সেই খবর আমি রাখিনি। রাখার ইচ্ছে নেই আর কী। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। মন খারাপের সময়গুলো আমার একা কাটাতেই ভালো লাগে। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগার টানাপোড়েনে এসে বাঁধ সাধলেন তাজ নামক বিপজ্জনক লোক। উনি কখন বেলকনিতে এসেছেন, আমি টেরই পাইনি। হঠাৎ পেছনে খুকখুক করে কাশির শব্দ শুনে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই কাঁচের দরজায় হেলান দিয়ে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনার চোখে চোখ পড়তেই আমি খানিক অপ্রস্তুত বোধ করলাম। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার কথা মাথায় আনতেই উনি বললেন,
“আমি যেতে বললে তবেই যাওয়ার সাহস করিস। তার আগে এক পা-ও নড়বি না। বি কেয়ারফুল।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ভাবলাম বেখেয়ালে কি চলে যাওয়ার কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছি না কি? কই? বলিনি তো। তবে? উনি জানলেন কীভাবে? ট্রেনিংয়ে ডিটেকটিভিটির সঙ্গে কি মাইন্ড রিডিংটাও শিখেছেন? না কি ক্রিমিনোলজির সঙ্গে মাইন্ড রিডিং সাবজেক্টেও পিএইচডি করেছেন? কী জানি! এই লোক এত বাড়তি মেধা কোথায় রাখে রে বাবা! আমি তো দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছি, তা রাতেই ভুলে বসে থাকি। তাজ ভাই আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখে মৃদু শব্দ তুলে হাসলেন। পরক্ষণেই পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে সেটা আমার সামনে মেলে ধরলেন। বাঁকা হেসে বললেন,
“চেনা যায়?”
আমি কাগজটায় চোখ বুলিয়েই চিনতে পারলাম, পাঁচ বছর আগের সেই অভিশপ্ত চিরকুট এটা। কাগজ পুরোনো হয়ে যাওয়ায় লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। উনি পুনরায় অবাক হবার ভান করে বললেন,
“চিনতে পারিসনি? তোর সেই বিখ্যাত চিরকুট। পিচ্চিকালের আবেগ।”
আমি নিজের বিরক্তিটা চেপে রাখার চেষ্টা করে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
“পাঁচ বছর ধরে আপনি এই একই ভুল ধারণা নিয়ে আছেন? আপনি বিশ্বাস না করলেও সত্যিটা তো আর পালটাবে না। সেদিনও আমি বলেছিলাম এই চিরকুট আমি লেখিনি, আজও তা-ই বলছি। এসব আফরা আপুর দেওয়া ডেয়ারের কারণে হয়েছিল।”
উনি ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে কাগজটা ভাঁজ করে পুনরায় পকেটে রেখে দিলেন। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তারপর? পড়াশোনার কী অবস্থা? পড়াশোনা ঠিকমতো চলে, না কি এই সং সাজানো মুখ দেখিয়ে কূল পাস না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“মানে?”
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“আসলেই কি তুই সেই আগের মতো ভোলাভালা আছিস, না কি অ্যাক্টিং করছিস? মনে তো হয় না আগের মতো আছিস। পাঁচ বছরে হয়তো সাপের পাঁচ পা দেখে ফেলেছিস। ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে আছিস। পরিবর্তন হবারই কথা। কিন্তু আমি ভাবছি তোর সেই আবেগের কথা। তার খবর তো বললি না, পিচ্চি।”
আমি এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। চোয়াল শক্ত করে বললাম,
“আপনি আসলে নিজেকে যতটা স্পেশাল ভাবেন, ততটাও স্পেশাল আপনি নন। না আগে ছিলেন, আর না এখন। তাই দয়া করে একটা ভুল চিরকুটের জের ধরে খোঁচা মেরে কথা বলা বন্ধ করুন। যে কাজটা আমি স্ব-ইচ্ছায় করিনি, তার জন্য কোনো কটুক্তি আমি সহ্য করব না।”
তাজ ভাই ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রাখলেন। বললেন,
“আরে বাহ্! এ তো দেখছি আমার ধারণা সত্যি। বোবার মুখে কথা ফুটেছে।”
আমি চরম বিরক্তি নিয়ে ওনাকে পাশ কাটিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে এলাম। মাথাটা বিরক্তিতে দপদপ করছে। কী ভেবেছে কী লোকটা? একটা ভুল চিরকুটের জন্য পাঁচ বছর পর এসেও অপমান করবে, আর আমিও মেনে নেবো! এত সহজ? আমার কি আত্মসম্মান নেই? নেহাতই আফরা আপু আমার বড়ো। ছোটো হলে যে কী করতাম, আমি নিজেও জানি না। পাঁচ বছর আগে তাজ ভাই সুইডেন যাওয়ার আগে শরীয়তপুর আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আম্মি আর রাজ ভাইও গিয়েছিল। সেবার আড্ডা দিতে বসে আফরা আপু আমাকে ডেয়ার দিয়েছিল। আমার হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল ওটা তাজ ভাইকে দিতে। তখন ছিলাম নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া পঞ্চদশী বালিকা। অত মারপ্যাঁচ বুঝতাম না। সবকিছু সরলভাবে নিতাম। নিতান্তই সবার বাধ্য ছিলাম বলে আফরা আপুর দেওয়া কাগজটা নিয়ে তাজ ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলাম। আপুর কথামতোই তাজ ভাইকে কাগজটা দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেদিন বিকেল বেলায় তাজ ভাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। উনি কোনো ভূমিকা ছাড়াই আমাকে বকাঝকা শুরু করেছিলেন ওই চিরকুটের জন্য। অথচ আমি তখনও জানতাম না যে, ওই কাগজে কী লেখা ছিল। তাজ ভাই ছোটোবেলা থেকেই যেমনি চঞ্চল, তেমনি মিশুক ছেলে। হুটহাট রাগ উঠে গেলেও তাকে সামলানো সহজ ছিল না। আমাদের সাথে সবসময়ই উনি দুষ্টুমি করতেন। কারণে-অকারণে জ্বালিয়ে মা’রতেন সবাইকে। ওনার রাগ সম্পর্কে অবগত থাকলেও, সেবার ওই প্রথম আমি তার রাগের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেদিন আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি বড়োদের সামনে কথা বলার সাহস করতাম না। ওই যে সবার বাধ্য আর ভোলাভালা ভীতু মেয়ে ছিলাম যে, তাই। বকাঝকার এক পর্যায়ে আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাগজে কী লেখা। তাজ ভাই আমার এই কথা নিয়েও কৌতুক করেছিলেন। তবু অবশ্য কাগজটা আমার সামনে মেলে ধরেছিলেন। কাগজের লেখা পড়ে আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হয়েছিল। ভয়ে, লজ্জায় আমি তাজ ভাইয়ের সামনেই কেঁদে উঠেছিলাম। কাগজে লেখা ছিল,

তাজ ভাই,
আপনার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলার সাহস নেই, তাই লিখে জানিয়ে দিলাম। আমি আপনাকে ভালোবাসি। কবে থেকে তা বলতে পারব না। কিন্তু অনেক ভালোবাসি, বিশ্বাস করুন। আমি জানি আপনি অনেক রাগী মানুষ। হয়তো এই চিঠি পেয়ে আমাকে খুব বকবেন। কিন্তু আমার কথা বদলাবে না। আপনি তো সুইডেন চলেই যাবেন। আমি আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকব। আমাকে ভুলে যাবেন না। আমি তো খুব একটা সুন্দরী বা চঞ্চল মেয়ে না, তাই প্রেমও করতে পারি না। আপনি কি আমায় ভালোবাসবেন? প্লিজ জানাবেন। আমি কিন্তু আপনাকে সত্যিই অনেক, অনেক ভালোবাসি।
ইতি
ইলোরা

চিরকুটের কথাগুলো বলে বলেও তাজ ভাই আমাকে বকেছিলেন। আমি অল্প বয়সে বেশি পেকে গেছি, আবেগে ভাসছি, প্রেম করার জন্য ম’রে যাচ্ছি, তাকে হাত করতে চাইছি, আরও কত কী! অথচ তখন প্রেম নামক শব্দটাও উচ্চারণ করার আগে আমি দশবার ভাবতাম। ভয় হত। পাছে না আবার আব্বু বকে। আফরা আপু তার কথা বলতে নিষেধ করায় আমি তার নামটাও মুখে আনিনি। মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম সব অপমান। যখন বলেছিলাম আমি ওটা লেখিনি, তখন তাজ ভাই রীতিমতো হেসেছিলেনও। আফরা আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে আমার সাথে এমন মজা কেন করল। আপু স্বাভাবিকভাবেই বলেছিল সে এতটাও জটিল ভাবেনি ব্যাপারটা। তাজ ভাইয়ের রাগের ভয়ে সে আমাকে অনুরোধ করেছিল যাতে তাজ ভাইয়ের সামনে তার নাম না নিই। তাজ ভাই ঢাকায় ফেরার আগ পর্যন্ত আর আমি ভুল করেও তার মুখোমুখি হইনি। তবে খুব কেঁদেছিলাম। এরপর তাজ ভাইয়ের ফ্লাইটের দুদিন আগে পরিবারের সাথে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে তাজ ভাইদের বাসায় আসতে হয়েছিল। সেদিন আবার সে ওই চিরকুটের জন্য আমাকে নতুন করে কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল এসব ফালতু চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে। আমি সেদিন রাগে দুঃখে আফরা আপুর নামই বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু কপাল! লোকটা আর আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করেনি। বাকি দুদিন আমি সামনে থাকলেও উনি আমার দিকে ফিরেও তাকাননি। চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে উনি সবার থেকে বিদায় নিলেও, একমাত্র আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আমার কী হয়েছিল জানি না, ওয়াশরুমের দরজা আটকে আবারও খুব কেঁদেছিলাম। কাঁদতে-কাঁদতে মুখের যা-তা অবস্থা হয়েছিল! সেদিন না বুঝতে পারলেও, উনি চলে যাওয়ার অনেকদিন পর টের পেয়েছিলাম ওনার প্রতি আমার এক অজানা দুর্বলতা ছিল। অদ্ভুত এক টান জন্মেছিল, অথচ তখন উনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সব বিষয়ে আমার ভয় ছিল আকাশ ছোঁয়া, সেজন্যই হয়তো নিজের মনের অনুভূতিটুকুও ধরতে পারিনি আমি। প্রথম-প্রথম খারাপ লাগা কাজ করলেও, পরে ওসব কাটিয়ে উঠেছিলাম। তাজ ভাই ফোন করে বাসার সবার সাথে কথা বলত, শুধু আমি ছাড়া। সেজন্য আমিও খুব একটা আগ্রহ দেখাতাম না। মাঝে-মাঝে ঢাকায় আম্মির কাছে এলে আম্মি ওনার সাথে কথা বলার সময় আমার কাছে ফোন দিতে চাইত। কিন্তু উনি নানান বাহানায় এড়িয়ে যেতেন। আমি আর ওসবে কান দিতাম না। পাঁচ বছরে ওসব কথা প্রায় ভুলে বসেছিলাম। কিন্তু ভুলে আর লাভ কী হলো? পাঁচ বছর পরে এসেও তো সেই পুরোনো ক্ষত খুঁচিয়ে নতুন করে রক্তাক্ত করতে শুরু করেছেন উনি। হুট করে এসেই আবার ওসব নিয়ে মজা নিবেন জানলে হয়তো আমি ম’রে গেলেও এই বাসায় উঠতাম না। তবে এটা ভেবে একটু অবাক লাগছে যে, উনি আর আমার ওপর পুরোনো রাগ দেখাচ্ছেন না। শুধুই মজা নিচ্ছেন। এটা কি কেবলই আমাকে ক্ষেপানোর ধান্দা, না কি অন্যকিছু? জানি না ওনার মাথায় কী চলছে; তবে এটুকু আঁচ করতে পারছি যে, ওনার এমন আচরণে আমি ওনার ওপর চরম বিরক্ত। বিপদের সামনে যাব না ভাবলাম, অথচ বিপদ নিজেই সহাস্যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কী মুশকিল! ওনার জন্য কি এখন আমি স্পাই রাখব? যাতে উনি কখন ঘর থেকে বেরোন, সেই খবর পেয়ে আমি আগে থেকেই সরে থাকতে পারি? এই ভাবনা মাথায় আসতেই হুট করে মনে পড়ল কুলসুম আপার কথা। ওনাকে একটু হাত করলেই আমার স্পাই জোগাড়ের কাজ হয়ে যাবে। কী বুদ্ধি আমার! এমন অসাধারণ এক বুদ্ধি মাথায় আসার জন্য নিজেই নিজেকে এক দফা বাহবা জানালাম। কুলসুম আপা চলে গেছেন কি না দেখার জন্য রুম থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই কলিংবেল বাজল। আম্মি রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়ল,
“ইলো, দেখো তো কে এসেছে।”
আমি ভাবলাম আমিরা আপুদের বাসার কেউ এসেছে। নাচতে-নাচতে গিয়ে না দেখেই দরজা খুলে দিলাম। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো অতিশয় সুন্দর যুবককে চিনতে না পেরে ভদ্রভাবে প্রশ্ন করলাম,
“জি? কাকে চাই?”
লোকটা ক্যাবলাকান্তর মতো হেসে বললেন,
“আমি তাজের বেস্ট ফ্রেন্ড, শ্রেয়ান চৌধুরী।”
আমি দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
“ভেতরে আসুন।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বিনা বাক্যে ভেতরে ঢুকলেন। আমি দরজা বন্ধ করে তাকে বসতে বললাম। উনি আরাম করে বসে আমাকে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি ইলোমিলো?”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। এ আবার কার নাম?
“জি?”
“ওহ্ সরি, ইলোরা তো তুমি?”
“হ্যাঁ।”
মনে-মনে ভাবলাম, আমাকে চেনে কীভাবে? আর আমার নাম জানলে প্রথমেই নামের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করার মানে কী? আমার মনের প্রশ্নটা হয়তো শ্রেয়ান ভাইয়া ধরতে পারলেন। একগাল হেসে বললেন,
“তোমাকে আমি চিনতাম না। আন্টির সাথে যে থাকে, তার নাম ইলোরা, এটুকু জানতাম। তোমাকে দেখে আঁচ করলাম, এ বাসায় তুমি ছাড়া তো অন্য কোনো রমণী নেই, তাই। তোমার নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই নাম শুনে প্রথমেই আমার মাথায় এসেছিল ‘ইলোমিলো’ নামটা। ভেবেছিলাম তোমার সাথে দেখা হলে বলব। ফাইনালি বলেই দিলাম। তারপর বলো, কেমন লাগল তোমার নতুন নাম?”
এক দমে কথাগুলো শেষ করে শ্রেয়ান ভাইয়া প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। বুঝলাম লোকটা বেশ মিশুক আর হাসিখুশি। নইলে প্রথম দেখাতেই কেউ অচেনা কারো নাম নিয়ে গবেষণা করতে বসে না। তাজ ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও লোকটার মিশুক স্বভাব আমার বেশ লাগল। আমিও হেসে ফেললাম। বললাম,
“বেশ সুন্দর।”
লোকটা নিজের কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে অনেক খুশি হয়ে গেলেন। রান্নাঘর থেকে আম্মি জিজ্ঞেস করল,
“ইলো, কে এল?”
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আমিও ওনার পিছু নিলাম। দেখলাম আম্মিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে উনি আনন্দে গদগদ হয়ে আম্মির সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আম্মিও তাকে পেয়ে বেশ খুশি। আম্মি রীতিমতো চেঁচিয়ে তাজ ভাইকে ডাকতে শুরু করল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই তাজ ভাই এসে উপস্থিত হলেন। শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে কোলাকুলি করলেন। পরে জানতে পারলাম শ্রেয়ান ভাইয়া আর তাজ ভাই একসঙ্গেই সুইডেনে পিএইচডি করেছেন। ট্রেনিং-ও দুজনের একসঙ্গে কেটেছে। সুইডেন যাওয়ার আগে থেকেই না কি শ্রেয়ান ভাইয়া এ বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। দুই পরিবারের মাঝেও বেশ ভালো সম্পর্ক আছে। ঢাকায় আমার খুব একটা আসা হত না। আম্মি সুযোগ পেলে তার ছেলেদের নিয়ে নিজেই শরীয়তপুর যেতেন। সেজন্যই শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আমার পরিচয় নেই। আম্মি আমাদের বলল টেবিলে বসতে। সে তাজ ভাইয়ের পছন্দের পাটিসাপটা তৈরি করেছে। তা খাওয়ার জন্য তাড়া দিলো। আমি বসলাম না। কিন্তু আম্মি বলামাত্রই তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া গিয়ে চেয়ার দখল করে বসলেন। টেবিলে আমার আদরের বিড়াল জেমি সটান শুয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিল। ওনাদের শব্দ পেয়েই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। গোলগোল চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“বিড়াল কার?”
আম্মি বলল,
“কার আবার? ওই যে আমাদের বিড়ালপ্রেমী।”
শ্রেয়ান ভাইয়া জেমির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার বিড়াল তোমার মতোই মিষ্টি দেখতে। ওর নাম কী?”
আমি সহাস্যে উত্তর দিলাম,
“জেমি।”
“সুন্দর নাম।”
পাশ থেকে তাজ ভাই পাটিসাপটায় কামড় বসিয়ে বললেন,
“এখান থেকে সরা এটাকে। আমার থেকে দূরে রাখবি, নয়তো এ বাসায় এর জায়গা হবে না।”
আমার মুখ থেকে হাসিটা গায়েব হয়ে গেল। উনি যে বিড়াল পছন্দ করেন না, এ কথা আমি ভুলে বসেছিলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“বিড়াল তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে,‌ বল তো? বিড়াল হচ্ছে আদুরে প্রাণী। ওদের দেখলেই তো আদর করতে ইচ্ছে করে। তুই আসলেই নিরামিষ।”
তাজ ভাই কপাল কুঁচকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
“নিরামিষ,‌‌ না আমিষ বুঝলি কীভাবে? এখনও তো বিয়ে-টিয়ে করলাম না। বিয়ের পর বউয়ের সাথে রোমান্স করে তোকে সেসবের ভিডিয়ো ক্লিপ দেখানোর মতো মহান কাজটা আমি অবশ্যই করব। তারপর না হয় নিরামিষ, আমিষের প্রকারভেদ করিস।”
অদূরে দাঁড়িয়ে আমি এ কথা শুনে আহাম্মক বনে গেলাম। লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করল। আমার সামনে এমন বিশ্রী কথা বলতে ওনার একটুও বাঁধল না! আমাকে কি ওনার মতো নির্লজ্জ মনে হয়? লোকটা আর শুধরাল না। এদিকে শ্রেয়ান ভাইয়া আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে তাজ ভাইয়ের সাথে তাল মেলাতে লেগে পড়েছেন। দুই নির্লজ্জের পাশে আমার মতো এক অসহায় প্রাণীর লজ্জায় টিকে থাকা সম্ভব হলো না। তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যিস আম্মি ওসব শোনার আগেই রান্নাঘরে চলে এসেছিল। শ্রেয়ান ভাইয়াকে কত ভদ্র ভেবে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অথচ ওনার মাঝেও এত ভেজাল! ছিঃ, ছিঃ! মূলত বিপজ্জনক লোকের বেস্ট ফ্রেন্ডকে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবাটাই ছিল আমার চরম ভুল। এসব সাংঘাতিক লোকদের নির্লজ্জ স্বভাব অস্বাভাবিক কিছু নয়। এদের বাক্য ব্যয়ের মাঝে লাগাম নামক কোনো শব্দ আছে বলে আমার মনে হয় না। না বাবা, এসব লোকদের বিশ্বাস করার মতো ভয়াবহ ভুল আর আমি ইহজীবনে করব না। পৃথিবী উলটে গেলেও না। আমার শান্তিপ্রিয় স্বভাব এর থেকে ঢের ভালো।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
“হায় হায়! কী একটা ছ্যাঁকা খেলাম রে ইলো! শ্রেয়ান ভাইয়া যে এত সুন্দর হয়ে গেছে, ভাবতেই তো আমার মগডালে ঝু’লে পড়তে ইচ্ছে করছে। আমার প্রেম হওয়ার আগে কেন এল না? কেন, কেন? এখন আমি এ ছ্যাঁকাকথন কাকে শোনাব?”
মিনহা আপুর আহাজারি শুনে আমিরা আপু হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে চকচকে মুখ করে বলল,
“ধুর! তুই তো অলরেডি সেটিংস। এখন আর আহাজারি করে কী লাভ? হ্যাঁ, শ্রেয়ান ভাইয়াও আগের থেকে অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে; কিন্তু তাজ ভাইকে টেক্কা দিতে পারেনি, হুঁহ্। তাজ ভাই ইজ তাজ ভাই। দ্য গ্রেট ইয়াং ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার। উনি মিঙ্গেল হলে শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু উনি যখন সিঙ্গেল আছেন, তখন আপাতত অন্যদিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছি না। এখন ভালোয়-ভালোয় তাজ ভাইকে পটাতে পারলেই জীবন ধন্য।”
মিনহা আপু ঠোঁট উলটে বলল,
“আমার দুঃখে একটু তো দুঃখিত হ, আপু। কষ্টে আমার কলিজা, ফুসফুস, কিডনি হৃদপিন্ড যা কিছু আছে, সব ফেটে যাচ্ছে। গিভ মি সাম সিমপ্যাথি প্লিজ।”
আমার ইচ্ছে করল নিজেই এই দুটোকে মগডালে ঝু’লিয়ে দিই। আহাজারি করে-করে ম’রে যাচ্ছে, আবার বলছে ছ্যাঁকাকথন কাকে শোনাব! এরা এত ওভার অ্যাক্টিং কোত্থেকে শেখে মাবুদ জানে। হতেই পারে এসব তাদের গোষ্ঠিগত রোগ। শ্রেয়ান ভাইয়াকে দেখে হতে এক বোন বুকফাটা আহাজারি আরে চলেছে, আরেকজন স্বান্তনা দিয়ে চলেছে। স্বান্তনা দিতে গিয়ে সে-ও আবার তাজ ভাইয়ের গুণগান গাইছে। এরা এত কীভাবে পারে ভাই? ছুঁকছুঁক স্বভাবের মেয়েমানুষ। আমি আলগোছে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গেই মিনহা আপু প্রশ্ন করল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“ভালো লাগছে না, আসছি একটু,” মিথ্যে বললাম আমি। এদের এই আজাইরা বকবক শুনতে ইচ্ছে করছে না। এতক্ষণ সোফার কোণে বসে সৌরভ ভাইয়া ফোনে বুঁদ ছিলেন। এই ছেলে চব্বিশ ঘন্টা ফোনে মুখ গুঁজে কী করে তা সে জানে আর মাবুদ জানে। দীন দুনিয়ার খবর তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। আমার ধারণা এই ছেলে ওপরে ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না ভাব করলেও, ভেতরে-ভেতরে দুনিয়ার সবচেয়ে বাঁদর প্রকৃতির মানবের মধ্যে একজন। প্রেম ভালবাসার কেসও আছে নিশ্চিত। নিতান্তই ভদ্র ছেলে বলে কারো বুঝার জো নেই। এই ছেলে আবার পড়াশোনা, কথাবার্তা, দুদিকেই ব্রিলিয়ান্ট। কথা বলে বড়োদের মতো। তাজ ভাইয়ের বড়ো খালার ছোটো ছেলে সৌরভ ভাইয়া। ঢাকাতেই পড়াশোনা করে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র‌। হলে থাকে। তাজ ভাই এসেছে বলেই তার আগমন। অবশ্য সে প্রতি সপ্তাহেই আসে আম্মির আদরের টানে। আমার সমবয়সী হলেও, আমাকে সবসময় আপনি সম্বোধন করে। এর কারণ অবশ্য আমার জানা নেই। তার দেখাদেখি আমিও তাকে অযথাই আপনি সম্বোধন করি। সে আমাকে আপু আর আমি তাকে ভাইয়া ডাকি। আমি চলে যাওয়ার কথা বলায় সৌরভ ভাইয়া বললেন,
“যান আপু। এখানে বসে এই ফাও প্যাঁচাল না শোনার থেকে, এক পাতা উপন্যাস পড়েন। মনেও শান্তি আসবে আর সময়ও নষ্ট হবে না।”
আমিরা আপু সৌরভ ভাইয়ার বাহুতে চটাস করে এক চ’ড় বসিয়ে বলল,
“ফাও প্যাঁচাল মানে কী, হ্যাঁ? নিজে তো এই ফোনটার মধ্যে ঢুকে থাকিস সারাদিন। তুই আড্ডার কী বুঝবি? কালই তুই হলে ফিরে যাবি, নইলে আঙ্কেলকে বলে তোর এই ফোন আমি বুড়িগঙ্গায় ফেলব। গাধা কোথাকার!”
মুখ ঝামটা শুনে সৌরভ ভাইয়া রাগ করল না। আমিরা আপুদের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক আছে। একসঙ্গে থাকলে মনে হয় এরা আপন ভাই-বোন। অথচ এদের মাঝে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই।
“এই পাগলা গারদে থাকার চেয়ে আমি তাজ ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিই, তা ভালো” বলেই সৌরভ ভাইয়া উঠে ফোন ঘাটতে-ঘাটতে চলে গেল। আমিরা আপু পেছন থেকে বিদ্রুপের সুরে বলল,
“ওই ফোন নামক যন্ত্রটা যেদিন এক মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া করতে পারবি, সেদিন তুই আড্ডার উপযুক্ত হবি। বুদ্ধু!”
মিনহা আপু ভাবুক হয়ে বলল,
“আপু, তুই কিন্তু ভুল বলেছিস। সৌরভকে একবার গাধা, আরেকবার বুদ্ধু বললি। বাট একচুয়্যালি হি ইজ আ ব্রিলিয়ান্ট গাই, অ্যান্ড ইউ নো দ্যাট।”
সঙ্গে-সঙ্গে আমিরা আপু চটাস করে মিনহা আপুর মাথায় এক চা’টি মা’রল। বলল,
“তোকে ওর চামচামি করতে বলছি?”
ব্যস, মিনহা আপুও এবার ফুঁসে উঠল। শুরু হলো দুই বোনের ক্যাঁচক্যাঁচনি। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আলগোছে সেখান থেকে সরে এসে ডাইনিং রুমে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে কুলসুম আপার খোঁজ করলাম। তিনি এখন আম্মিকে রাতের খাবার রান্নায় সাহায্য করছেন। পড়তে বসতে ইচ্ছে করছে না। রুম থেকে একটা উপন্যাসের বই আর চশমাটা নিয়ে এসে ডাইনিং রুমের লাগোয়া বেলকনিতে চলে গেলাম। এই নিরিবিলি জায়গাটা বই পড়ার জন্য আমার কাছে বেশ প্রিয়। বেলকনির লাইট অন করে চেয়ারে পা তুলে বসলাম। তারপর বই খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ায় বুঁদ হলাম। কতক্ষণ পার করলাম খেয়াল নেই। আমার গভীর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে চোখে পরতে-পরতে বই থেকে চোখ তুলে তাকালাম। তাজ ভাই কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আমার হাতের বইয়ের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন। আমি বিরক্তি বোধ করলাম। আমার এত সুন্দর মনোযোগে বাঁ হাত না ঢুকালে কি লোকটার বদহজম হত? এই লোক আসতে না আসতেই ভূতের মতো আমার ঘাড়ে চেপে বসল কেন? আশ্চর্য! এখন নিশ্চয়ই আবার ওই চিরকুট নিয়ে খোঁচা মা’রবে। উফ্! কী মুশকিলে পড়লাম রে বাবা! তাজ ভাই শিরদাঁড়া সোজা করে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে তার চমৎকার গা জ্বালানো হাসিটা দিলেন। বললেন,
“বাহ্! একাডেমিক বই পড়ার সময় নন একাডেমিক বই পড়া হচ্ছে? বলছি কী, ওসব একাডেমিক বই ঘরে রাখার কী দরকার? পড়বি তো না। তার চেয়ে বরং ওসব ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ফাঁকা জায়গায় আরও কিছু নন একাডেমিক বই রেখে দে। আর হ্যাঁ, এই চমৎকার আইডিয়ার বিনিময়ে অবশ্যই আমার অগোছালো কাপড়গুলো ভাঁজ করে দিবি।”
আমি গাল ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“আপনার সব বস্তা পচা আইডিয়া গিয়ে ডিটেকটিভিটিতে লাগান। আমার এসবের প্রয়োজন নেই” বলতে-বলতে লম্বা-লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করলাম।

নূর আঙ্কেলের ফোন আসায় আম্মি রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে লক্ষ্য করেই আমি এক ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। কুলসুম আপা চমকে উঠে চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে আমার দিকে তাকালেন। চট করে দোআ পড়ে নিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বললেন,
“এমনে কেও আহে না কি আফা? ডরাই গেছি আমি। মনে হইতাছে আফনারে ডাকাইতে দৌড়ানি দিছে।”
আমি মনে-মনে স্বগতোক্তি করলাম,
“যেন-তেন ডাকাত না। উচ্চশিক্ষিত ডিটেকটিভ ডাকাত।”
মুখে অসহায়ত্ব এনে বললাম,
“আপনি কি আমায় একটা ছোট্ট সাহায্য করতে পারবেন, কুলসুম আপা?”
“কইয়া ফালান।”
“আম্মিকে বলবেন না। শুধু আম্মি না, কাউকেই বলবেন না। ঠিক আছে?”
কুলসুম আপা দৃষ্টি সন্দিহান হলো। উনি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
“কী ব্যাপার কন তো, আফা?”
আমি মন খারাপ করে বললাম,
“আপনি তো জানেন কুলসুম আপা, আমি অনেক শান্তিপ্রিয় মেয়ে?”
“হ, হ, জানি। আফনে খুব ভদ্র মাইয়া।”
“আপনি কি জানেন, আমি আমার কাজিন আর নিজের গোটা তিনেক বন্ধুরা ছাড়া অন্য সব ছেলেদের থেকে দূরে-দূরে থাকি?”
কুলসুম আপা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“আফনেরে লইয়া আমার কোনো সন্দেহ নাই, আফা। আফনে হইলেন আমার দেহা সবচাইতে খাঁটি মাইয়া। কিন্তু আফনে হঠাৎ এইগুলান কন ক্যান?”
আমি গলা ঝেড়ে নিচু স্বরে বললাম,
“আসলে তাজ ভাইয়ের সাথে তো আমার দেখা হয়েছে অনেক বছর পর। আগে তো আমি ছোটো ছিলাম, আর এখন বড়ো হয়ে গেছি। তাই এখন উনি সামনে এলে আমার সঙ্কোচ হয়।”
“ভাইজান তো অনেক ভালা।”
আমার চোয়াল শক্ত হয়ে এল। লোকটা সবাইকে হাত করে নিয়েছেন! আমি কুলসুম আপাকে বুঝিয়ে বললাম,
“তাতে কী? উনিও তো এখন অন্য সব ছেলেদের কাতারেই পড়ে। সেজন্যই বললাম।”
“ও…। তয় অহন আমি কী করমু?”
কুলসুম আপা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
“এই সমস্যার কারণে আমি ওনার সামনে পড়তে চাই না। উনি যখন বাসায় থাকবেন, তখন আপনি একটু খেয়াল রাখবেন যে, কখন উনি রুম থেকে বেরোন। বেরোলেই আমাকে আগেভাগে জানিয়ে দিবেন। তাহলে আমি আর ওনার সামনে যাব না। পারবেন না?”
কুলসুম আপা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“পাড়মু। কিন্তু এক বাসায় থাইকা কয়দিন এমন করবেন?”
“ওসব আমার ব্যাপার। আপনি শুধু কাজটা ঠিকমতো করলেই হবে।”
“আইচ্ছা,” ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বললেন কুলসুম আপা। ওনার মুখে চিন্তার ছাপ। আমি মনে-মনে নাচতে-নাচতে ওনার কাছ থেকে সরে এলাম। কুলসুম আপা যে কাজটা সত্যিই করবেন, এই নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এই মহিলা আবার আমার দারুণ ভক্ত। আমার সবকিছুই তার কাছে বেস্ট মনে হয়। এ বাসায় কাজ করেন গত দুই বছর যাবত। কিন্তু তার একটা দারুণ সমস্যা আছে। তিনি হচ্ছেন সার্বজনীন আপা। তার অবশ্য কারণও আছে। তিনি শুধু আমাকেই আপা ডাকেন না। আম্মি, আমিরা আপু, মিনহা আপু, এমনকি আমিরা আপুর মাকেও আপা ডাকেন। আবার শুধু তাজ ভাইকেই ভাইজান ডেকে ক্ষান্ত নন। রাজ ভাই, সৌরভ ভাইয়া, হিমেল কাকা, মিনহা আপুর বাবা, ভাইয়া সবাই ওনার ভাইজান। ওনার এই অদ্ভুত স্বভাব কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যায়নি। এজন্য প্রথম দিকে মজা করে সবাই ওনাকে আপা ডাকত। আর এখন সেটা সবার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অদ্ভুত হলেও আমার অবশ্য ব্যাপারটা খুব ভালোই লাগে। ওনার কথার ধরণ শুনতেও মজা লাগে। অশুদ্ধ ভাষায় কেমন সুর টেনে-টেনে কথা বলেন। ড্রয়িংরুমে এখনও আমিরা আপু আর মিনহা আপুর কথা শোনা যাচ্ছে। এখন আবার তাদের সাথে যোগ হয়েছে জুম্মান ভাইয়া। চেঁচামেচি শুনে বুঝলাম এরা টিভির চ্যানেল ঘুরানো নিয়ে ঝামেলা করছে। অথচ নিজেদের বাসায় কেউ সুযোগ পায় না। কারণ আন্টি সারাক্ষণ ইন্ডিয়ান সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকেন। মা সিরিয়াল লাভার বলেই এরা তিন ভাই-বোন সুযোগ পেলেই এ বাসায় এসে টিভির রিমোট নিয়ে রীতিমতো মা’রামা’রি বাঁধিয়ে দেয়। আর আম্মি কাজের ফাঁকে একটু-আধটু হাঁক ছাড়ে। মাঝে আমি শুধু চেয়ে-চেয়ে এদের ড্রামা দেখি। ওদিকে যাওয়া যাবে না ভেবে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই দেখলাম তাজ ভাই রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এক বাক্যে বললেন,
“পড়াশোনা নেই কারো?”
সঙ্গে-সঙ্গে তিন ভাই-বোন মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে গেল। সুরসুর করে একে-একে সবকটা বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। এদের মেলোড্রামা দেখে অভ্যস্ত আমার আর হাসিও পেল না। তাজ ভাই ড্রয়িংরুম থেকে হুট করে এগিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে একটা গ্লাস হাতে তুলে উঁচিয়ে ধরে শক্ত মুখে আমার দিকে তেড়ে আসতে-আসতে বললেন,
“এখানে কী? যা, পড়তে বোস।”
আমি চোখ বড়ো করে উলটো দিক ঘুরে দিলাম ভোঁ দৌড়। রুমে ঢুকেই ঠা’স করে দরজা লাগালাম। এই লোককে পাহাড়া দিবে কুলসুম আপা! কীভাবে? এই বিপজ্জনক ডিটেকটিভকে পাহাড়া দেওয়া তার কর্ম নয়। ধুর! আমার প্ল্যানটাই জলে গেল।

পরদিন সকালে ভার্সিটি যাওয়ার আগ পর্যন্তও তাজ ভাইকে বাসায় দেখলাম না। আম্মি আর রাজ ভাইয়ের কথোপকথনে বুঝলাম উনি সকাল-সকাল বেরিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত ফেরেননি। আম্মি ফোন করার পর জানিয়েছেন পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছেন। ব্রেকফাস্ট তাদের সঙ্গে করেই ফিরবেন। বেরোতে দেরী হচ্ছে বলে আমি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলাম। দুর্ভাগ্যবশত আমিরা-মিনহা আপু আর আমি আলাদা ভার্সিটিতে পড়ি। সৌরভ ভাইয়াও আলাদা। তবে জুম্মান ভাইয়া আর আমি একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। জুম্মান ভাইয়া এবার মাস্টার্সের স্টুডেন্ট। পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী না হলেও, ক্লাস কামাই করেন না। আমার সুবিধা হচ্ছে, একই ভার্সিটিতে পড়ার দরুন আমাকে ভার্সিটিতে একা যাওয়া-আসার চিন্তা করতে হয় না। ভাইয়ার সাথেই যাওয়া-আসা করি। ছেলেটা একটু পাজি হলেও, এ কদিনে আমার প্রতি ওনার স্নেহের পরিমাণ আরও বেড়েছে। আমি একা রাস্তা পেরোতে পারি না, ভ্যাপসা গরম সহ্য করতে পারি না, অতিরিক্ত ঝামেলা সহ্য করতে পারি না। জুম্মান ভাইয়া এসব বিষয় খেয়াল রাখতে ভোলেন না। প্রতিদিনের মতোই আজও জুম্মান ভাইয়া ড্রয়িংরুমে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি ড্রয়িংরুমে যেতেই একগাল হেসে রওয়ানা হলেন। জুম্মান ভাইয়ার ক্লাস না থাকলে বা আগে শেষ হলেও, উনি ক্যাম্পাসে আমার জন্য অপেক্ষা করেন। আবার মাঝে-মাঝে আমার বেশি দেরী হলে আমাকে মেসেজ করে জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরে এসে আমাকে নিয়েই বাড়ি ফিরেন। আজ আমার ক্লাস শেষ হলো দুপুর একটায়। জুম্মান ভাইয়াকে ক্যাম্পাসেই পেয়ে গেলাম। দুপুরে বাসায় ফেরার সময় ক্লান্ত থাকায় সারা রাস্তা আমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে সিটে পড়ে থাকি। জুম্মান ভাইয়াও চুপচাপ শুধু ড্রাইভ করেন। প্রয়োজন ছাড়া আমাকে একদম বিরুক্ত করেন না। তার এ আচরণগুলো আমার বেশ লাগে। আজও বাসায় ফিরলাম ক্লান্ত শরীরে। বাসায় ঢুকতেই বড়োসড়ো এক ঝ’টকা খেলাম। বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। ডাইনিং রুমের একপাশে বিরাট একটা বুক শেলফ রাখা। কী সুন্দর তার কারুকাজ! দেখেই মন জুড়ে যায়। বুক শেলফের চেয়ে পাশে রাখা বইয়ের স্তুপ দেখেই আমার বেহুঁশ হবার জোগাড় হলো। তাজ ভাই আর রাজ ভাই মিলে বুক শেলফে বই সাজাচ্ছেন। পাশেই আম্মি আর মিনহা আপু দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। মূর্তির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে চোখ দুটো ছানাবড়া করে আমিও ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আম্মি কোমরে হাত রেখে আমাকে বলল,
“দেখো আমার পা’গল ছেলে কী কাজ করেছে। ইয়া বড়ো বুক শেলফের সাথে বস্তা ভর্তি বই নিয়ে হাজির হয়েছে। এমন কাজও মানুষ করে?”
রাজ ভাই বললেন,
“মা, ওর ইচ্ছে হয়েছে তাই এনেছে। কী হয়েছে তাতে?”
“আনতে ইচ্ছে করলেই একসঙ্গে এত বই আনতে হবে? অল্প করে আনলে কি পরে আবার আনতে পারত না? না কি পরে আর পেত না এসব?”
তাজ ভাই এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বই সাজানোয় মনোযোগ দিয়ে বললেন,
“বই পড়তে-পড়তে অভ্যাস হয়ে গেছে, আম্মি।”
“তো তুই কি এই বস্তা ভর্তি বই সব একসঙ্গে পড়বি? এতে তো বছর পার হয়ে যাবে।”
মিনহা আপু ঠোঁট টিপে চিন্তা করে বলে উঠল,
“তাজ ভাই তো ওই ডিটেকটিভ, থ্রিলার ধরণের বই পড়েন, তাই না? রোমান্টিকও পড়েন না কি? সব ধরণের বই দেখছি এখানে।”
তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
“সবই পড়ি।”
“বাপ রে! ব্যস্ত মানুষ হয়ে এত সময় কোথায় পান আপনি? এ-ও সম্ভব!” চোখ বড়ো করে বলল মিনহা আপু।
তাজ ভাই বিদ্রুপ করে বললেন,
“টাইম মেইনটেইন করে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানলে সবই সম্ভব। তোর মতো রূপচর্চার পেছনে আজাইরা সময় নষ্ট করি না আমি। আটা-ময়দা-সুজি ঘষাঘষি বাদ দিয়ে ওই সময়টুকু বাঁচিয়ে রাখতে জানলে তোরও বই পড়ার সময় থাকত, বেকুব।”
রাজ ভাই হাসলেন। মিনহা আপুর মুখটা চুপসে গেছে। এই কথা অন্য কেউ বললে এতক্ষণে এই মেয়ে নিশ্চিত তুফান ডেকে আনত। কিন্তু এখানে অন্ধকার মুখে বলল,
“আমার এসব গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে না।”
তাজ ভাই আবার শ্লেষের সুরে বললেন,
“তা লাগবে কেন? গেইম, মুভি, ভিডিয়ো যত হাবিজাবি আছে, তোরা তো ওসব গিলবি। গিলতে-গিলতে যেদিন বদহজম হবে, সেদিন বই পড়ার ইচ্ছে জাগবে। গাধা জেনারেশন!”
মিনহা আপু এবার গাল ফুলিয়ে চুপ মে’রে রইল। আম্মি আমাকে তাড়া দিলো রুমে গিয়ে গোসল সেরে নেওয়ার জন্য। নইলে আবার দুপুরের খাবারে দেরী হয়ে যাবে। আমার ইচ্ছে করছিল এত-এত বই নিজ হাতে শেলফে সাজাতে। কিন্তু এরা তো আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না। তাই আম্মির কথামতো রুমে চলে গেলাম। গোসল সারলাম তাড়াহুড়ো করে। মাথায় এখন শুধু ওই বইয়ের স্তুপ ঘুরছে। গোসল সেরে বেরিয়ে ভেজা চুলগুলো আঁচড়ানোর সময় দরজায় টোকা পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাই দাঁড়িয়ে। দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু উনি হঠাৎ আমার রুমে কেন, বুঝতে পারলাম না। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি ভেতরে ঢুকে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হলো। পরক্ষণেই উনি বললেন,
“শেলফ ভর্তি বই দেখে লোভ সামলাতে পারবি না জানি। কী, শেলফ থেকে বই পড়বি তো?”
আমার তো ইচ্ছে করছে শেলফের সব বই এখনই পড়ে শেষ করে বসে থাকি। অগত্যা আমি কাঁচুমাচু মুখে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম। উনি আমার দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে ধরলেন। আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলাম,
“কী এটা?”
“উত্তর এখানেই আছে। শেলফ থেকে বই পড়তে হলে এটা নিতে হবে,” চোখের ইশারায় ব্যাগ দেখিয়ে বললেন উনি।
আমি চিন্তিত মুখে ব্যাগটা হাতে নিলাম। উনি আর কথা বাড়ালেন না। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ঝুলিয়ে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। আমি বিছানায় পা তুলে বসে ব্যাগের ভেতর উঁকি মেরে দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেললাম। কালো কাপড়! ব্যাগ থেকে কাপড়টা বের করলাম। কাপড়টার ভাঁজ খুলে আমি খানিক থমকালাম। কাপড়টাতে সাদা রংয়ের হ্যান্ড পেইন্টিংয়ে গুটি-গুটি অক্ষরে লেখা,‘বুক শেলফ পরিষ্কার রাখার কাপড়। হাত বদল করা নিষেধ। যে এর ভাঁজ খুলেছে, তার ওপর বুক শেলফ পরিষ্কার ও গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব আরোপ করা হলো। দায়িত্বে হেরফের হলে বইয়ে হাত ছোঁয়ানোও নিষেধ।’
বারকয়েক লেখাটা পড়ে আমি বিস্ময় নিয়ে কাপড়টার দিকে তাকিয়েই রইলাম। এত ঢং করে আমাকে বুক শেলফের দায়িত্ব দেওয়ার মানে কী? আমাকে নিয়ে মজা করার নতুন ফন্দি না কি? কী জানি! উলটা-পালটা ভাবনা মাথায় চাপিয়ে বসলাম। আবার এ-ও ভাবলাম। যা-ই হোক। বই তো পড়তে পারব। আহ্, কত্ত বই! দেখলেই তো মনে আপনা-আপনি শান্তি চলে আসে। হুট করে কোত্থেকে যেন এসে জেমি আমার হাতের কাপড়টা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে টানতে শুরু করল। আমার হাতের সবই ওর খেলনা। আমি প্রশস্ত হেসে কাপড়টা ওর মাথায় ঘোমটার মতো পরিয়ে দিয়ে বললাম,
“নে, এবার তুই বুক শেলফের দায়িত্বে নিয়োজিত। গিয়ে শেলফের ওপর হাত-পা তুলে সারাদিন বসে থাক।”
জেমি মিয়াও, মিয়াও করে কাপড়টা হাত-পা দিয়ে খামচে ধরে দাঁত দিয়ে এলোপাথাড়ি কামড়াতে শুরু করল। কাপড়টা নিয়ে শুয়ে রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে ও। আমি জিবে কামড় দিয়ে ওর থেকে কাপড়টা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
“হাত বদল নিষেধ। ছাড় বাপ, নইলে আমার সাধের বই পড়ার বদলে চেয়ে-চেয়ে শুধু দেখতে হবে। যেচে কলিজা ফুটো করতে চাই না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

নোট: ভুলত্রুটি মার্জনীয়।