মন কারিগর পর্ব-১+২

0
228

#মন_কারিগর🩷 [সূচনা পর্ব]
~আফিয়া আফরিন

মানব মন মাঝে মাঝে বড় অদ্ভুত কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে আমাদের বেকায়দায় ফেলে দেয়। তারমধ্যে সবচেয়ে ভিত্তিহীন, বিশ্রী, অকথ্য, অযাচিত কাণ্ড হলো; বলা নেই কওয়া নেই সহসা কারো প্রেমে পড়ে যাওয়া। যেরকম রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে অচেনা মেয়েটাকে দেখে রাফির প্রেম-প্রেম পাচ্ছে। আশ্চর্য! মেয়েটাকে সে চেনে না, জানেও না, ভবিষ্যতে আর কখনো দেখা হবে কিনা সেটা সম্পর্কেও অনিশ্চিত; তারপরও মনটা অদ্ভুতভাবে হাতছানি দিয়ে বেড়াচ্ছে।
সময়টা শরতের মাঝামাঝি। পত্রঝড়া বৃক্ষের পাতা ক্রমশ ঝরছে। শিমুল তুলোর মতো আকাশে মেঘের খেয়া ভেসে বেড়াচ্ছে।
এমনই এক অভূতপূর্ণ আনন্দ অনুভূতি এবং শুভ্র আকাশকে সাক্ষী রেখে রাফির সাথে প্রথম দেখা হয় মেয়েটির।
রাফি যতক্ষণ সম্ভব হলো ততক্ষণ একদৃষ্টিতে অগোছালো মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল। এলোমেলো চুলগুলো বারবার কপালে এসে আছড়ে পড়ছিল আর মেয়েটি বিরক্ত হয়ে চুলগুলোকে কানের পশ্চাতে গুঁজে দিচ্ছিল। একসময় মেয়েটি স্টেশন ছাড়ল। রিকশা করে নিজ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল।
কিন্তু, রাফির মনটা পড়ে রইল অচেনা মেয়েটির দিকে। মেয়েটির কপালে লেপটে থাকা এলোমেলো চুলের গোঁছায়, তার হাসির সময় গালের গভীর ভাঁজে, গালে থাকা অস্পষ্ট তিলত্তোমায়।
কিছু কিছু ভালোলাগা বোধহয় তৈরি হয় ক্ষণিকের জন্য, এটাকেই সম্ভবত অস্পষ্ট ভালোলাগা বলে।

রাফির ধ্যান ভাঙল বড় ভাই রিয়াদের ডাকে।
‘কি ভাই? এখানে আর কতক্ষণ? মাহিদ সেই তখন থেকে ফোন করেই যাচ্ছে। আমরা কি অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ওখানে গিয়ে পৌঁছাব? শুন্যে তাকিয়ে কি হাওয়া গিলছিস?’
রাফি নিজের কপালে থাকা চুলগুলো হাতের স্পর্শ স্ববিন্যস্তভাবে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ চলো।’

রাফি আরেকবার সতর্ক দৃষ্টি বোলাল আশেপাশে। জানা কথা, ওই মেয়েটার দেখা আর দ্বিতীয়বার সে পাবে না। তবুও, মনের মধ্যে কেমন কেমন করছে! এই ক্ষণিকের অতিথি হয়ে মেয়েটাকে কে দেখা দিতে বলেছে?

রিয়াদ আর রাফি সম্পর্কে চাচাতো ভাই। মাহিদের সাথে রিয়াদের পরিচয় কলেজ জীবনের প্রথম ধাপ থেকেই। দুজনই খুব ভালো এবং খুব কাছের বন্ধু। বড় ভাইয়ের সূত্রপাত ধরে এবং গানের মাধ্যমে রাফির সাথে আলাপ হয়েছিল মাহিদের। তারপর থেকে তাদের দুজনের মধ্যেও ভাই ভাই সম্পর্ক। রাফি গান গায়, এই গানের মাধ্যমেই কমবেশি অনেকের কাছে সে পরিচিত মুখ। মাহিদের সাথেও আলাপটা একটা গানের কনসার্টের মাধ্যমে হয়েছিল। রিয়াদের থেকে মাহিদের সাথেই বর্তমানে রাফির ভাব বেশি। আজ মাহিদের ছোট বোনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। তাই এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই চট্টগ্রাম ছুটে আসা।
মাহিদ অবশ্য আরো কয়েকদিন আগেই আসতে বলেছিল, কিন্তু মাঝখানে রাফির একটা কনসার্ট ছিল বলে আটকে পড়েছে। আজও একটা কনসার্ট ছিল, বহু কষ্টে সেটা কাটিয়ে এখানে আসতে হয়েছে।

মাহিদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী দুই ভাই পৌঁছে গেল। কিন্তু এখানে আশেপাশে কোন বিয়ে বাড়ি দেখছে না‌। রিয়াদ মাহিদকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাই আর কতদূর?’

মাহিদ উত্তরে বলল, ‘আরেকটু সামনে এগিয়ে বা’য়ে একটা মোড় দেখতে পাবি। সোজা হাঁটতে হাঁটতেই বিয়ে বাড়ি দেখতে পাবি। একটু ভিতর দিকে এই আর কী।’

‘চিনে আসতে পারব তো?’ রিয়াদ ভাবনাগ্রস্থ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

‘আচ্ছা তোরা ওখানেই অপেক্ষা কর। আমি আসছি অথবা কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

রিয়াদের সাথে কথা বলে মাহিদ ভেতরের ঘরের দিকে উঁকি দিল। এখন আগত অতিথিদের বরণ করতে কাকে পাঠাবে? সে নিজেও তো যেতে পারবে না, যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। বোনের বিয়ের সমস্তটা সে একা হাতেই তদারকি করছে। সেই সকাল থেকেই কেয়ারটেকারের লোকদের পিছু পিছু ছিল। কোন কাজে সামান্য ভুল ভ্রান্তি হতে দেয় নাই। কেউ বলতেই পারবে না, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এই দুপুর দুটো পর্যন্ত মাহিদকে একদণ্ড বসতে দেখেছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু সেই ক্লান্তি শরীর ভেদ করে মন পর্যন্ত যেতে পারে নাই।
শেষ ভরসা হিসেবে মাহিদ জুহিকে দেখতে পেল। যদিও মেয়েটা মাত্র ঢাকা থেকে এসেছে। তাকে পাঠানো ঠিক না হলেও বাধ্য হয়ে পাঠাতে হবে।
জুহিকে বলতেই সে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেল। মাহিদের কাছ থেকে ফোন নাম্বার টুকে নিয়ে বাড়ির বাহিরে পা বাড়াল।
বিয়ে বাড়িতে সাধারণত একটু বেশিই হইচই থাকে, কিন্তু এই বাড়িতে হইচই বিয়ে বাড়ি ব্যতীত সর্বক্ষণই লেগে থাকে। আর বিয়ের অনুষ্ঠানে তো বাড়িটাকে বাড়ি রাখে না কেউ, একদম গোয়ালঘর বানিয়ে ছাড়ে। এসব অতিরিক্ত হইচইয়ের কারণে জুহি বিয়ে বাড়ি বা এসব ধরনের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে বরাবরই। কিন্তু এইবার তার মামাতো বোনের বিয়ে, মেয়েটা কত করে আবদার করেছে। মামা মামী কত করে আবদার করেছে, এদিকে কাজকর্ম না থাকলে তো মাহিদ নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে আসত। এতগুলো মানুষের অনুরোধ জুহির একার পক্ষে ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই ঝামেলা মনে হলেও চলে এসেছে। অবশ্য এখানে তার কোনো বিশেষ কাজকর্ম নাই, কেউ তাকে বিরক্ত করতেও আসবেনা।

জুহি রাস্তার মোড়ে এসে দুটো ছেলেকে দেখতে পেল। একজনের মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, চেহারায় ছেলেমানুষী ভাবটা একটা স্পষ্ট। আরেকজন একদম ফিটফাট, বাংলা ভাষায় ফুল বাবু বলা হয় যাকে; মাহিদের বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে দুজনের চেহারা। এরাই মাহিদ ভাইয়ার বন্ধু কিনা ভাবছিল জুহি। নাও হতে পারে আবার হতেও পারে।
সে এগিয়ে গিয়ে ছেলে দুটোর সামনে দাঁড়াল। নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি মাহিদ ভাইয়ার বন্ধু?’

রাফি আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছিল। একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে তাকাল। আর সাথে সাথেই বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘনঘন কয়েকবার চোখের পলক ফেলল। বিষ্ময় ভাবটা সে যেন কোনভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। এটা কি আসলেই সত্যি? এটাই তো সেই রেলওয়ে স্টেশনে দেখা মেয়েটা! এটা কি স্বপ্ন না সত্যি? নিজের হাতে একটা চিমটি মেরে দেখতে হয়।
রাফি যেই নিজের হাতে চিমটি কাটবে ওমনি রিয়াদ ধমকে উঠল, ‘তোর কী এরকম শূন্যে হাওয়া খাওয়ার শখ হয়েছে? হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? ইনি মাহিদের ছোট বোন, আমাদের নিতে এসেছে। তাড়াতাড়ি চল।’
না স্বপ্ন নয়, ঘটনাটা তাহলে সত্যি। কিন্তু রিয়াদ ভাইয়া যে বলল এটা মাহিদ ভাইয়ার ছোট বোন। আজকে তো মাহিদ ভাইয়ার ছোট বোনেরই গায়ে হলুদ হওয়ার কথা। তবে কী ইনিই? রাফির ভাললাগাটা কী তাহলে আবারও বড়সড়ো ছ্যাকা খেল?

বাড়ি ঢুকতেই মূল ফটকের নেমপ্লেটে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা চোখে পড়ল রাফির।
——————————
“মায়াকুঠির”
তালুকদার বাড়ি, ১১/০৬ (১৯২৭)।
——————————
বেশ বড়ো, পুরনো আমলের বাড়ি। এরকম বাড়ি সচরাচর ইদানিং যুগে দেখা যায় না। আর এই ধরনের বাড়িগুলো মানুষ এখন আর পছন্দও করে, এসব পুরনো ধাঁচের বাড়ি ভেঙে সেখানে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে তোলে। রাফির কাছে এই ব্যাপারটা বেশ লাগল। আশেপাশের পরিবেশটা খুব সুন্দর। মূল শহর থেকে একটু দূরে এই জায়গাটা অবস্থিত। ঠিক গ্রাম বলা চলে না, আবার সাধারণ অর্থে শহর বলতে আমরা যা বুঝি তাও না।

রাফি হাসি হাসি মুখ করে জুহিকে বলল, ‘আপনাদের বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের, তাইনা?’

জুহি গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিল, ‘পুরনো আমলের বাড়িতে থাকতে কি আপনার খুব বেশি সমস্যা হয়ে যাবে?’

এমন উত্তরে রাফি হঠাৎ করে অপ্রস্তুত বনে গেল। আমতা আমতা করতে লাগল।
ব্যাপারটা সামলে রিয়াদ বলল, ‘না না ও আসলে এমন কিছু বলতে চায় নাই। পুরনো আমলের জিনিসপত্রের প্রতি ওর খুব টান, এই জিনিসগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ ওর বেশি। তাই জিজ্ঞেস করছে আর কী। দয়া করে কিছু মনে করবেন না।’

জুহি শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘না সমস্যা নেই। আসুন, ভেতরে আসুন আপনারা।’
মাহিদ দরজায় দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল। বন্ধু আর ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ায় কুশল বিনিময় করে নিল। বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
কিন্তু রাফির বেহায়া দৃষ্টি ঘুরে ফিরে জুহির দিকেই যাচ্ছে। মেয়েটার সাথে কথা বলে বুঝেছে, মেয়েটা একটু নাক উঁচু স্বভাবের।
এই দিক সামলে জুহি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরের ঘরে চলে গেল। রাফি একপলক তাকিয়ে আশেপাশে দর্শনে মনোযোগ নিবেশ করল। পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির মতই এই বাড়িটা। নিচ তলায়ই অনেকগুলো ঘর, সবগুলোতেই বোধহয় সে আমলের কাঠের দরজা। কথায় কথায় জানতে পারল জুহি মাহিদের মামাতো বোন। ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষে এখানে বেড়াতে এসেছে। সে বর্তমানে ঢাকায় থাকে, ওখানেই পড়াশোনা করে এবং একটা এনজিওতে জব করে। জুহি ঢাকায়ই থাকে শুনে রাফির অশান্ত মন আরেকবার তিরিং বিরিং করে নেচে উঠল। পরে সময় সুযোগ বুঝে মাহিদ ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নেওয়া যাবে।
মেয়েটাকে অকারনেই তার বড্ড পছন্দ হয়েছে। চেহারা যে খুব আকর্ষণীয় তা নয়, কিন্তু চোখ দুটি খুব স্বচ্ছ। এতটাই স্বচ্ছ যে, চোখের মণিকোঠুরিতে অপর পক্ষের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যায়। জুহি যতক্ষণ আশেপাশে ছিল, রাফি অপলক দেখে গেছে তাকে।
যদিও আপেক্ষিক ভাবে কাজটা নিষিদ্ধ, তবুও মাঝে মাঝে অকারণেই কিছু ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিতে হয়। মন জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। মন আমাদের একান্ত নিজেদের হওয়া সত্বেও আমাদের নিজস্ব কোন নিয়ন্ত্রণ বা ভূমিকা নাই এখানে।
মেয়েটার নামের মত চেহারায়ও এক ধরনের স্বচ্ছতা আছে। গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল, আলস্য ধরনের সৌন্দর্য চোখে মুখে, ‘লাবণ্য’ শব্দটা দিয়ে যেটা বোধহয় সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায়।
কিন্তু জুহি সেই যে তখন ঘরে ঢুকেছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত তার আর বের হওয়ার নামগন্ধ নাই। রাফি অনেকবার উঁকিঝুঁকি মেরে দেখেছে। এর থেকে বেশি করলে তো শেষমেষ কপালে চোর অপবাদ জুটবে। অবশেষে জুটেও গেল তাই। আর সেটা তার হঠাৎ দেখা ভালো লাগার মানুষটার তরফ থেকেই।
‘কি ব্যাপার? সমস্যা কী আপনার? এসে থেকেই দেখছি সারা বাড়ি উঁকি ঝুঁকি মেরে বেড়াচ্ছেন? কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন কি? বাই দ্যা ওয়ে, আপনারা সত্যি সত্যি মাহিদ ভাইয়ার বন্ধু তো? মানে ছদ্মবেশ নিয়ে আবার এই বাড়িতে ধান্দাবাজি করতে আসেন নাই তো?’
আচমকা পেছন থেকে কারো কথার আক্রমনে রাফি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পেছন ফিরে তাকাল। তাকাতেই বুকে আড়াআড়ি ভঙ্গিতে দু’হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা জুহিকে দেখতে পেল। তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে। এই চোখের চাহনি মারাত্মক, একদম বুকের ভেতরটা ভেদ করে ফেলে; সবকিছু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
রাফিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুহি ফের জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন যে?’

সে আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ‘না মানে, আপনার কথা শুনে আমি আর কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছি না। ধান্দাবাজি কেন করতে আসব বলেন তো? বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছি একটু।’

‘এভাবে দেখলে আমি যেটা বললাম মানুষ আপনাকে সেটাই ভাববে। কাউকে বললেই তো আপনাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখায়, আর না হয় মাহিদ ভাইয়াকে বলতেন।’

রাফি আশেপাশে পরখ করে করে বলল, ‘মাহিদ ভাই ব্যস্ত আছে তাই আর তাকে ডিস্টার্ব করতে চাইলাম না। আচ্ছা থাক, আমি যাচ্ছি ওই দিকে। আর ভুল বুঝবেন না, দুঃখিত আমি।’

জুহি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,’কোথায় ঘুরবেন? বাড়ির ভেতরেই?’
রাফি কিছু না বলে উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল। তা দেখে জুহি বলল, ‘আসেন আমার সাথে।’

রাফি বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সাথে? আপনি আমায় পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাবেন?’

জুহি কিঞ্চিৎ ভুরুযুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আমার সাথে যেতে কি আপনার খুব অসুবিধা হবে? যদি খুব অসুবিধা হয় তাহলে দরকার নাই।’

রাফি তৎক্ষণাৎ একগাদা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘আরে কী যে বলেন আপনি, অসুবিধা কেন হবে? আপনি যে আমার এইটুকু সময় দিবেন এটাই তো আমার সাত পুরুষের ভাগ্য।’

জুহি মনে মনে বিরক্ত প্রকাশ করলেও মুখে আর কিছু বলল না। যত যাইহোক এরা মাহিদ ভাইয়ার পরিচিত, মুখ ফসকে কিছু বলে তো আর অপমান করা যায় না।
জুহি রাফিকে নিয়ে প্রথমে উপরের দিকটায় গেল। ঘর গুলো পেরিয়ে সোজা ছাদে চলল। এই সময়টুকু জুহি চুপচাপই ছিল। রাফি অনেকবার কথা বলতে চেয়েও চুপ করে গেছে। পাছে এই রাগী ম্যাডাম যদি আবার জোরেশোরে ধমক দিয়ে বসে!
বার কয়েক খুসখুস করে কাশল রাফি, জুহির মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায়। জুহি সামনের দিকে এগোতেই ছাদে অন্যান্য ভাই বোন এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখতে পেল। তাদের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে হাত নেড়ে এগিয়ে এলো। ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে রাফি উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এখান থেকে বাড়ির পিছনের দিক পুরোটাই দেখা যায়। ঐ তো দেখতে পাচ্ছেন, পেছনে ঘন জঙ্গল।’
রাফি বাঁ’দিকে আঙ্গুলের ইশারা করে জিজ্ঞেস করল, ‘ঐ টা নদী?’

‘খাল। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ এবং আশেপাশের বেশ কয়েকজন মানুষ ওই খালে গোসল করে। ওইদিকে বরং আগামীকাল সকালে গিয়ে ঘুরে আসবেন। মাহিদ ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে যাবেন, অনেকগুলো আঁকাবাঁকা পথ আছে একা গেলে হারিয়েও যেতে পারেন।’

রাফি হেসে বলল, ‘না না কী যে বলেন? এত সহজে হারালে চলবে?’

‘হু।’ ছোট্ট করে উত্তর দিল জুহি।

রাফি আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জুহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা তো আপনার মামা বাড়ি তাই না? আপনার বাসা কোথায়?’

জুহি জবাব দিল না এমনকি ভদ্রতাসুচক কোন কথাও বলল না। রাফি জুহির এই নীরবতার মানেটা ঠিক ধরতে পারল না। নিজের মনে সামনে থাকা দৃশ্য সম্পর্কে প্রাকৃতিক বর্ণনা করে যাচ্ছে। জুহি চুপচাপ শুনছে ঠিকই, কিন্তু কোন কথা বলছে না।
একপর্যায়ে রাফি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘বললেন না তো আপনার বাসা কোথায়?’

এইবার জুহি নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দিল, ‘বাসা বলতে কী নিজের ভাষা বোঝাচ্ছেন নাকি যেখানে থাকি সেই বাসা বোঝাচ্ছেন?’

‘না মানে, আপনি যেখানে থাকেন।’

‘আমি ঢাকায় থাকি।’ নিষ্প্রাণ কণ্ঠে উত্তর দিল জুহি।

‘ও আচ্ছা এটাই জানতে চাচ্ছিলাম। আপনার মা-বাবাও বুঝি আপনার সাথে ওখানেই থাকে?’

জুহির কন্ঠে সেই নির্লিপ্ততার রেশ। ‘আমার বাবা-মা কেউ নাই। আমি ওখানে একাই থাকি।’

জুহির কথা শুনে রাফির মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন, দুনিয়ায় এত কথা থাকতে মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করা লাগল কেন তার? আর জুহি কী রকম কর্ম কুশলে উত্তরটা দিল।
রাফি ধীর কন্ঠে বলল, ‘আমি দুঃখিত। আসলে বুঝতে পারিনি..!’
জুহি হাত উঁচিয়ে রাফিকে থামিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি আমাদের বাড়ির অতিথি। বাড়িটা ঘুরে দেখতে চেয়েছিলেন তাই আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম। আজকে তো ছাদ এবং আশেপাশে দেখলেন, আগামীকাল না হয় বাকিটুকু দেখে নিবেন। আমার পক্ষে আজকে আর সম্ভব না। আপনার যদি একান্ত দেখতে ইচ্ছে হয়, তাহলে নিজে ঘুরে ঘুরে দেখবেন। আর তখন আপনার সাথে হয়ত বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি, জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত! আপনি ছাদে থাকতে চাইলে নির্দ্বিধায় থাকতে পারেন, আমার মত অন্তত কেউ আপনাকে “ধান্দাবাজি করতে আসছেন”—এ কথা বলবে না।’
রাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জুহি উল্টো পথে পা বাড়াল। রাফি জুহির কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না। হয়তো মা-বাবার কথা তোলায় রাগ করেছে। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটা তো দিতে হবে একবার। রাফি তো আর জেনে বুঝে ইচ্ছে করে ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এই কথা বলে নাই। সেটা তো বুঝতে হবে, তা না করে নিজের মত কী কী বলে চলে গেল। এমন আশ্চর্য ধাঁচের মেয়ে রাফি তার জীবনে আর দ্বিতীয় একটাও দেখে নাই।
.
.
.
চলবে……

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০২]
~আফিয়া আফরিন

প্রকৃতির রঙ্গশালায় অন্যতম চিত্তরঞ্জনকারী দৃশ্য ফুটে উঠেছে। মনোরম ও সুন্দর পরিবেশ নব রূপে সেজে উঠেছে। চারিদিকে তৈরী হয়েছে উৎসবের আমেজ। আকাশের মতো আজ এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের বুকে নতুন রঙের ছোঁয়া লেগেছে।
নীল অম্বর জুড়ে শুভ্র মেঘমালা এক খুশির আমেজ গড়ে তুলেছে। বাড়ির প্রতিটি মানুষ খুব ব্যস্ত। ব্যস্ত পায়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। জুহির এই ব্যস্ততা দেখতে ভালো লাগছে। উপরের বারান্দা থেকে দৃষ্টি নিম্নে সজাগ রেখেছে। কে কী করছে সবটাই তার নজরে পড়ছে। কিন্তু এখন আর এই ব্যস্ততা দেখতে ইচ্ছে করছে না।
আজকের আকাশটা সুন্দর। এই অনিন্দ্য সুন্দর রূপের মাঝে বেজে ওঠে ছুটির মন কেমন করা বাঁশি। অনেকদিন পর তা প্রায় মাস ছয়েক পর তো হবেই, গতকাল বাড়ি ফিরেছে জুহি। মামা মামী হাজার জোর করা সত্ত্বেও সে সহজে বাড়ি আসে না, সবসময় কাজের মধ্যেই ডুবে থাকে। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই জুহির জীবনটা অন্যরকম। ছোটবেলা থেকে মামা মামীর কাছে বড় হয়ে তাদের ঋণী করে রেখেছে, তারপর এসএসসি দেওয়ার পর ঢাকায় চলে এসেছে। মামা মামীর ঋণ আর বাড়াতে চায় নাই জুহি। এত ঋণ শোধ করার সাধ্য যে তার নাই!
তবে আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে অবকাশ আর ছুটির আনন্দ যেন অঢেল। আজকের সকালটা যেন সারা বছরের দুঃখ, ক্লান্তি, পরিশ্রমের গ্লানি সহজেই গুচিয়ে দিয়েছে। অদূর থেকে ঢাক আর শঙ্খের আওয়াজ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই দুর্গাপূজার আরাধনা চলছে।

জুহি কী মনে করে মিমির সাথে দেখা করতে এলো। আজকের আর কিছুটা সময় মাত্র, তারপরই মেয়েটা শশুর বাড়ি পাড়ি জমাবে। আর পরবর্তীতে তার বিগত বিশ বছরের স্মৃতিতে ঘেরা এই বাড়িটায় সে আসবে দুই দিনের অতিথি হয়ে।
মিমি জুহিকে দেখে একটু চমকাল। জুহি মূলত চুপচাপ ধরনের মানুষ। বাড়ি এলেও দরকার ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না। আর আজ তার ঘরে নিজে থেকে, ব্যাপার কী? চমকানো ভাবটা চোখে মুখে প্রকাশ করল না মিমি।
জুহি দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইল, ‘আসতে পারি?’

মিমি এগিয়ে এসে বলল, ‘ছিঃ, ছোটো বোনের ঘরে আসার জন্য কেউ আবার অনুমতি নেয় নাকি? আসো তো আসো।’

‘তুই আর ছোট আছিস নাকি? আজকে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তারপর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করবি। এইতো বড়োই হয়ে গেলি!’ একগাল হেসে বলল জুহি।

মিমি হাসল। জুহি মিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘বর পছন্দ হয়েছে?’
মিমি মাথা নেড়ে সম্মতি সূচক জবাব দিল। জুহি পুনরায় বলল, ‘আমায় তো ছবি দেখালি না? নাহ থাক একেবারে বিয়ের আসরে দেখব। তোকে সাজাতে কখন আসবে রে?’

‘একটু পরেই আসবে। আমাকে সাজানোর সময় এখানেই থেকো কেমন? শাড়ী দেখবে, আসো দেখাই।’
মিমি নিজ উৎসাহে বিয়ের শাড়ি গয়নার সব এক এক করে দেখাতে লাগল। জুহির খুব একটা ভালো না লাগলেও, মন্দও লাগছে না। মেয়েটা এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে আর সে যদি চুপ করে থাকে তাহলে তো মিমির এই আগ্রহে ভাটা পড়বে। সে মন খারাপ করবে। ছোটো এই বোনটা তার একটু বেশিই অভিমানিনী। আর আজ বিয়ের দিন মেয়েটাকে জুহি কিছুতেই মন খারাপ করিয়ে দিতে পারে না। তাই মিমির কথার সাথে তাল মিলাচ্ছিল।
.
.
রাফি গতকালের মত আজ আবারও উঁকি ঝুঁকি মারছে। একবার দোতলায় যাচ্ছে তো আরেকবার নিচে নেমে আসছে। কিন্তু সকাল থেকে জুহির দেখা মিলে নাই। হয়তো বিয়ে বাড়ির কোন কাজে ব্যস্ত না হয় এখনো ঘুম থেকে উঠেই নাই।
রাফি উপর থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে গিয়ে অসাবধানতাবশত মাহিদের সাথে ধাক্কা খেলো।
মাহিদ চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘চোখের মাথা খেয়েছিস রাফি? দেখেশুনে চলবি। আর তোদের সকালের খাওয়া হয়েছে? ইকবাল ভাইকে বলে রেখেছিলাম, তোদের খাওয়ার দিকটা দেখার জন্য। বিশ্বাস কর ভাই, আমি একদমই ছাড়া পাচ্ছি না ঐদিক থেকে। কাছে পিঠের আত্মীয় স্বজনরা সবাই অলরেডি আসতে শুরু করেছে।’

রাফি মাহিদকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আরে ভাই সমস্যা নাই। তুমি তোমার কাজ করো। আমাদের খাওয়া-দাওয়া সব হয়েছে। আর কোন সমস্যা হলে আশেপাশে লোকজন তো আছেই তাদের বলব।’

মাহিদ রাফির পিঠ চাপড়ে বলল, ‘একদম ভাই, নিজের বাড়ি মনে করবি।’
মাহিদ নিজের কাজে অগ্রসর হলো। অদূরেই রিয়াদকে কয়েকটা ছেলের সাথে সোফায় বসে গল্প করতে দেখা যাচ্ছে। রাফিও ওখানেই ছিল বেশ খানিকক্ষণ, কিন্তু তার দৃষ্টি এবং মন পড়েছিল দোতলার কোন একটা ঘরে। এরপর যে কতবার নিচতলা আর দোতলায় পা চালিয়েছে, সেটা সে নিজেও জানে না। অবুঝ, ভোলাভালা মন জুহিকেই খুঁজে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। কাল বোধহয় মেয়েটা রাগ করেছিল? নয়তো এমন করে চলেই বা যাবে কেন? আজ দেখা হলেই সাথে সাথে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। কারো কাছে অপরাধী হয়ে থাকা মোটেও ভালো কথা নয়।

মিমির ঘর থেকে বের হচ্ছিল জুহি। মাহিদও ঐ দিক দিয়ে উঠোনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। জুহিকে দেখা মাত্রই হঠাৎ থামিয়ে বলল, ‘জুহি তুই কি ফ্রি আছিস? একটা কাজ করে দিতে পারবি রে?’

জুহি এগিয়ে এসে বলল, ‘হ্যাঁ ভাইয়া বলো।’

‘আমাদের বাসার রান্নাঘর টা মনে হয় ফাঁকাই আছে। তুই ঝটপট ৬-৭ কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। আমার কয়েকজন বন্ধু আছে, আমি সময় দিতে পারছি না ব্যাপারটা বড্ড খারাপ দেখায়। একটু চা পানির ব্যবস্থা কর, আর শুধুমাত্র একটু খেয়াল রাখিস কার কখন কি লাগে। কি, পারবি না? যদি পারিস তো তোকে ছোটবেলার মতো আইসক্রিম খাওয়াতে তোর পছন্দের সেই জায়গায় নিয়ে যাবো।’

জুহি সৌজন্যমূলক হেসে বলল, ‘আমি আর এখন ছোট নেই ভাইয়া। আমাকে আর ঘুষ দিয়ে দিয়ে তোমার কাজ করাতে হবে না। আমি এমনিতেই ওদের দেখাশোনা করব না, তোমার বন্ধু পরে; আগে এই বাড়ির অতিথি। যতোযাই হোক, আমার মামাবাড়ির আলাদা একটা সম্মান আছে না!’
মাহিদ হেসে বিদায় নিল। জুহি ছোটোবেলা থেকেই তার অতি আদরের। মিমি জুহি দুজনকেই ভালোবাসে; কিন্তু জুহির প্রতি ভালোবাসা তুলনামূলক একটু বেশি। এর কারণটাও অবশ্য জুহি নিজেই।
জুহি যখন প্রথম একেবারে পাকাপোক্তভাবে ওর মায়ের সাথে এই বাড়িতে এসেছিল তখন জুহির বয়স সবে ছয় বছর।
কপালের উপর অগোছালো ভাবে লেপ্টে থাকা চুল, ফোঁকলা দাঁতের হিহি করা হাসি, একটা হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে সারা বাড়িময় দৌঁড়ানো; সবটাই ভালো লেগেছিল ছোট্ট মাহিদের।
অপরদিকে মিমির তখন চার বছর চলে। সে মাহিদের ধারে কাছে একটুও ঘেঁষতো না, সারাক্ষণ শুধু মা আর বাবা। মাহিদ তখন তার একলা জীবনে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিল জুহিকে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সারা পাড়া এক করে বলতো, ‘এটাই আমার বোন!’
জুহিও সারাক্ষণ ভাইয়া ভাইয়া করে পাশে থাকত। তারপর একটা সময় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। গোছানো সম্পর্ক গুলোর মধ্যে কেমন ফাটল ধরে গেল। মিশুক জুহি সেই নয় বছর বয়স থেকেই নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ করে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। যেই জুহি ভাইয়া ভাইয়া করে ডেকে সারা বাড়ি মাথায় তুলতো, সেই জুহি ভুলেও মাহিদের সাথে আর কথা বলে না।
ভীষণ আফসোস হতো মাহিদের। কেন ফুফি এভাবে জুহিকে একলা করে দিয়ে চলে গেল? কেন তার সবকিছু থেকেও কিছুই নেই। ভাই বোন, মামা মামী থাকতেও জুহি কেন নিজেকে এত অবজ্ঞা আর অবহেলা করে? মা-বাবা ছাড়া বোধহয় জীবন এমনই ফিকে। আশেপাশে এতো আপনজন থাকতেও কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে না। পৃথিবীর সবাইকে তখন বিষন্ন লাগে, সবকিছু অন্ধকার মনে হয়।
মাহিদ যে এসব মনে করে করে দিনে কতবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিছু মানুষ জীবনে এতটাও দুঃখী হয়?
.
.
জুহিকে এই সময় রান্নাঘরে দেখেই মামি তাহেরা এগিয়ে এলেন। চায়ের পানি চুলোয় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই সময় চা বানাচ্ছিস কার জন্য রে মা?’

‘ওইযে মাহিদ ভাইয়ার বন্ধুগুলো আছে না, ভাইয়া বলল তাদেরকে একটু চা বানিয়ে খাওয়াতে।’

‘আচ্ছা তুই যা, আমি দেখছি।’

জুহি শাসনের সুরে বলল, ‘আজকে তুমি কাজে হাত লাগাবা কোন সাহসে? যাও, মিমির কাছে গিয়ে বসো খানিকক্ষণ। একটু পর নিয়ে চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি, আর উনি এখানে কাজ করছেন। যাও তো মামী।’

তাহেরা জুহির গাল টিপে দিয়ে আদুরে স্বরে বললেন, ‘মেয়ে দেখি আমার একেবারে মা হয়ে গেছে। কেমন শাসন করছে দেখো? হ্যাঁ রে মা, বিয়ে থা করবি না? আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে, কখন আল্লাহর কাছে চলে যাই বলা তো যায় না। তোকে এভাবে দেখে মরেও যে শান্তি পাবো না রে। এইবার তো একটু নিজের দিকটা ভাব। তোর মামাকে পাত্র দেখতে বলি?’

জুহি সহসা কথাটা ঘুরিয়ে নিল। তড়িৎবেগে বলল, ‘মামা কই গো? সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছি না যে? এই দেখো আমার চায়ের পানি উথলে যাচ্ছে। তুমি যাও তো মিমির কাছে। দেখো তো, তোমার মেয়েকে কেমন সাজানো হচ্ছে। নিজের মেয়ে বাদ দিয়ে তুমি পড়ে আছো আমায় নিয়ে!’

তাহেরা বিষন্ন গলায় বললেন, ‘তুই কী নিজের মেয়ের থেকে কম? বড় হয়ে একেবারে মামা মামীকে পর করে দিয়েছিস?’

জুহি একপ্রকার ঠেলে মামিকে মিমির ঘরে রেখে আসল। মূলত এসব কারণেই সে বাড়ি ফিরতে চায় না। মামী এমন সব ইমোশনাল টাইপের কথা বলে যে কান্না করতে ইচ্ছে করে। অথচ তার কান্না‌ পায় না। চোখের পানি বোধহয় একেবারেই শুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তো জুহির নিজেকে নিজের কাছে রোবট মনে হয়। কষ্ট তো দূরে থাক, সামান্য ব্যথা পেলেও চোখ দিয়ে পানি পড়ে না।
আর মামীর এসব কথা শুনলে দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতেও তখন কষ্ট হয়। নিঃশ্বাসের ওজনও তখন কয়েক টন বেড়ে যায়। এই মানুষগুলো এত ভালোবাসা দিয়েছে ছোটবেলা থেকে, কিন্তু জুহির ধারণা সে এই মানুষগুলোর ভালোবাসার দাম দিতে পারছে না। নিজের প্রতি এখন আর রাগও হয় না। কেমন যেন আবেগশূন্য হয়ে থাকে। জীবন সম্পর্কিত সকল আশা সে মুছে ফেলেছে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে বেঁচে আছে। এই মানুষগুলো পাশে না থাকলে হয়তো সেই বেঁচে থাকাটার ইচ্ছেটাও এতদিন মরুভূমির ব্যবচ্ছেদে পরিণত হতো।

রাফি আরেকবার আশেপাশে দৃষ্টি দিতেই জুহিকে ট্রে হাতে এগিয়ে আসতে দেখল। সে নড়েচড়ে বসল। বারকয়েক গলাখাঁকাড়ি দিয়ে নিজের অবস্থান বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু জুহি প্রতিবার এর মতোই নির্লিপ্ত। চায়ের ট্রে টি টেবিলের উপর রাখতেই উপস্থিত সবার দৃষ্টি তার দিকে পড়ল।
জুহি সেসব পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া ওইদিকে একটু ব্যস্ত রয়েছে তাই আপনাদের সময় দিতে পারছে না, কিছু মনে করবেন না। বিয়ের অনুষ্ঠান টা মিটে যাক, তারপর প্রচুর সময় পাবে। আমি এইদিকেই আছি, যদি কোন প্রয়োজন পড়ে ছোট বোন ভেবে আমায় অবশ্যই জানাবেন।’

তাদের মধ্যে থেকে একজন সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল।
জুহি চলে যেতে উদ্যত হতেই রাফি পিছু ডেকে বলল, ‘আমিও আসুন আমাদের সাথে চায়ের আড্ডায় অংশগ্রহণ করুন।’

জুহি ঘুরে তাকিয়ে রাফির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। এই দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থাপন করা বড় দুষ্কর। সাধারণ দৃষ্টি নয়, অন্তর্ভেদি দৃষ্টি। একদম হৃদয়ের ভেতরটাকে পর্যন্ত ফালাফালা করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
রাফি এই প্রথম জুহির দৃষ্টি বাদে আপাদমস্তক জুহিকে পরখ করে নিল। গোলগাল মুখের গড়ন, কাঁচা হলুদের ন্যায় গায়ের রং, টিকালো নাক, ধারালো চিবুক, ঝকঝকে সাদা দাঁত, ডাগর ডাগর দুটি নেত্রপল্লব; সব মিলিয়ে মেয়ে যেন সর্বনাশের দেবী!
তবে হ্যাঁ, কণ্ঠে বেশ ঝাঁঝ। যেটা তার কথায় এইবারও স্পষ্ট বোঝা গেল।
‘ধন্যবাদ। আমি চা খাই না, আপনারা খান।’ এই সামান্য কথারও যে এতটা ঝাঁঝ হতে পারে, সেটা হয়তো রাফি জুহিকে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করত না।
রাফি আর কোন প্রতুত্ত্যর করল না। জুহিও চলে গেল। রাফিকে মনে মনে পাগল-ছাগল বলে যা তা কাহিনী করল। তার এতো দরদ কিসের জন্য? আবার ঢং করে বলা হচ্ছে, আপনিও এসে আমাদের চায়ের আড্ডায় অংশগ্রহণ করুন। যত্তসব ন্যাকা!
.
.
বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততা অনেকক্ষণ আগেই শুরু হয়েছে। তবে বর আসার পর থেকে সেই ব্যস্ততা দ্বিগুণে রূপ নিয়েছে। মেহমানে বাড়ি সমাগম করছে দেখে জুহি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বসল। নানু এসেছে তার ভাইয়ের বাড়ি থেকে, জুহিকে দেখলেই হাজারটা কথা শুনিয়ে ছাড়বে। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে এসব কথা বেশ অপমানে লাগে। কিন্ত নানুকে বোঝাবে কে? সে নিজের মতো বাগবিতণ্ডা করতেই থাকে। সেই বাগবিতণ্ডার বিষয়গুলো বড় অদ্ভুত লাগে জুহির কাছে।
ঘরে এসে জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দিল। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে মৃদু হাওয়া বয়ে বেড়াচ্ছে। পেছন দিকের মাঠে ছোটো বড়ো ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি ভাবনাতে ডুবতে না ডুবতেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে বাস্তবে ফিরে এলো জুহি। খাটের উপর থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে দিতেই রাফিকে দেখতে পেল জুহি।
রাফি জুহির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পরখ করে বলল, ‘মাহিদ ভাই আপনাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলেছেন।’

কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও জুহি থেমে গেল। শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনি যান আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।’

‘না না মাহিদ ভাইয়া বলল আপনাকে যেন আমি সাথে করে নিয়েই আসি। আর আপনি যদি না আসেন তাহলে যেন কান টেনে ধরে নিয়ে আসি।’

‘আপনার সাহস দেখে আমি বরাবরই খুব অবাক হচ্ছি।’ বেশ জোরাল কণ্ঠে বলল জুহি।

রাফি মুচকি হেসে বলল, ‘আমার সাহস একটু বেশি ম্যাডাম।’

‘নিজেকে বোধহয় খুব চালাক ভাবেন তাই না? প্রচলিত বাংলা উক্তিটি শুনেন নাই, অতি চালাকের গলায় দড়ি!’ ঝাঁঝ লেগে যায় জুহির কণ্ঠস্বরে।

রাফি শ্রাগ করল, ‘আগে কখনো শুনি নাই। তবে এইতো আপনি বললেন, এখন জেনে নিলাম। তবে এটা আমার মাথায় কতক্ষণ থাকবে সেটা আমি জানিনা।’
জুহি শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। রাফির আজ কী যে হলো, হড়হড় করে কতগুলো কথা বলে দিচ্ছে।
জুহির তাকানো দেখে রাফি শুকনো ঢোক গিলে বলল, ‘ওইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে? আর সব সময় এত রগরগে কন্ঠে কথা বলেন কেন? শুনুন, সকাল বিকাল দুই বেলা মধু খাবেন। এইভাবে আর কারো সাথে কখনো কথা বলবেন না, আপনার কিছু নাই হতে পারে কিন্ত ওপর পক্ষের মানুষটার ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাকও তো হতে পারে তাইনা..!’

জুহি রাফিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘সামনে থেকে সরে যান, নিচে নামব।’
রাফি সাইড দিলে জুহি নিচে নেমে গেল। রাফি ওখানে দাঁড়িয়েই জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। পারতপক্ষে, জুহিকে কেমন ভয় ভয় করে। মেয়েটা খুবই চুপচাপ, এইরকম মানুষকে সহজে বোঝা যায় না। এরা সবসময় নিজেকে শক্ত খোলসের মধ্যে বদ্ধ করে রাখতে চায়। কেন করে কে জানে? এর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বোধ হয় সেই মানুষগুলোরও জানা নেই।

জুহি ফিরে গিয়েও আবার মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এলো। রাফি তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে নিজ মনে বিড়বিড় করছিল। এইবার জুহি নিশ্চিত হয়ে গেল, এই ছেলেটা সত্যি সত্যিই পাগল। নয়তো কেউ একা একা দাঁড়িয়ে এইরকম বিড়বিড় করে নাকি?
জুহিকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাফি থম মেরে গেল। রাফিকে আমতা আমতা করতে দেখে জুহি চড়া গলায় বলল, ‘সরুন সামনের থেকে।’
রাফি শুধু সরেই গেল না, বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে চলে গেল।
.
.
.
চলবে……