তুমিময় নেশা পর্ব-০৭

0
202

#তুমিময়_নেশা (৭)

দুটো ব্যক্তি একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। কি এক ব্যথায় তপ্ত হয়ে আছে চারপাশ। অদ্রি দ্বিধার চোখে পুরুষটিকে দেখে চলেছে। এদিকে পুরুষটি একেবারেই চুপ।

“কথা বলুন মিস্টার রাগীব।”

রাগীব নিরুত্তর। সে মেয়েটিকে ভালো মতন দেখে চলেছে। অদ্রির দু চোখ যেন জ্বলন্ত অগ্নি শিখা।

“কি বলব? বললেও তুমি বুঝবে না।”

অদ্রির এবার হাসি পেল। তবে হাসিটুকু ভেদ করে বেরিয়ে এল কান্না।

“কি বুঝব না? এরা কারা রাগীব? আপনি বলতে পারেন?”

রাগীব কথা না বলে সামনের দিকটায় এল। অদ্রি দু হাতে পুরুষটিকে ঠেলে দিয়ে বলল,”সরে যান।”

“তুমি মিথ্যে ভুল বুঝলে অদ্রি। এদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“তবে এই ক্লোজ ছবি গুলো? তা ও এত গুলো মেয়ের সাথে!”

রাগীব এবার চুপ। অদ্রির দু চোখ বৃষ্টি ঝরাতে ব্যস্ত।

“বিষয়টি আমি বলতে চাই না অদ্রি। তবে তুমি আমায় ভুল বুঝলে।”

কথাটি বলেই চলে গেল রাগীব। অদ্রি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। রাগীবের সাথে একাধিক নারীর খুব ক্লোজ ছবি সে একেবারেই মেনে নিতে পারছে না।

অদ্রি আর রাগীবের সমস্ত কথাই শুনেছেন রোকেয়া। তিনি বড়ো হতাশ হলেন। ছেলেটা কেন যে অতীত স্মরণ করতে চায় না।

তখন প্রায় রাত এগারোটা বাজে। অদ্রি নিজ রুমে বসে চাপা কান্নায় ভাসাচ্ছিল। এদিকে রাগীব এখনো ফিরে নি। সেই যে সকালে বের হয়েছে তারপর আর ফিরে নি। রোকেয়া মৃদু শব্দ করে ঘরে প্রবেশ করলেন। তবে অদ্রির হেলদোল নেই। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ওর সমস্ত ধ্যান জ্ঞান তুলে নিয়েছে যেন। রোকেয়া খুব করে মেয়েটির মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তবে তিনি বিচলিত হলেন না। কারণ তিনি জানেন একটু পর ই মেয়েটির সমস্ত মান অভিমান জলের মত হয়ে যাবে।

“অদ্রি, মা কী হয়েছে?”

অদ্রি বোধহয় শুনে নি। তাই জবাব দিচ্ছে না। রোকেয়া আলগোছে কন্যাটির বাহুতে হাত রাখলেন। এতে ধ্যান ফিরল ওর। ও চাইল, তবে চোখে মুখে দুঃখের ছায়া।

“কী হয়েছে মা?”

রোকেয়ার মায়ায় ভরা কণ্ঠটা অদ্রির সমস্ত শরীরে কম্পন ধরিয়ে দেয়। অদ্রি নিজের কান্না লুকাতে পারে না। ওমনি কেঁদে ওঠে। রোকেয়াকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।

“আন্টি, আন্টি এটা কী হয়ে গেল। আমি আপনার ছেলেকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু ও বাসে না। ও ভালোবাসে না আন্টি।”

টানা কয়েকবার বাক্যটি বলতে লাগল অদ্রিতা। রোকেয়া মৌন। তিনি শুরুতেই কিছু বললেন না। বরং অদ্রির জমানো ব্যথাটা বের হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। বেশ কিছু সময় পর যখন অদ্রির কান্না থামল। তখন রোকেয়া বললেন,”সব সময় যা দেখা যায় তা কিন্তু সত্যি হয় না মা।”

অদ্রি চুপ। দু হাতের তালুতে চোখের জল মুছে নিচ্ছে। রোকেয়া দীঘল একটা শ্বাস নিয়ে বললেন,”জানো আমার রাগীব সব সময় সেরা ছাত্র ছিল। তবে ওর বেশি ঝোঁক ছিল মডেলিং এর প্রতি। এটা অনেক আগের কথা। তোমার আঙ্কেল তখন সাধারণ একজন মানুষ। তার ওপর এই জগৎ এ পরিচিত কেউ নেই। রাগীব কঠিন পরিশ্রম শুরু করল। নানান জায়গায় আসা যাওয়া করল একটা কাজের আশায়। তবে বলে না টাকা না থাকলে কোনো কিছুর মূল্য নেই। ঐ ভয়ংকর দিনের কথা আমি আজও স্মরণ করতে পারি না। আমার ছেলেটা এক বাটপারের হাতে পড়েছিল। লোকটা ওকে মদের নেশায় বুদ করিয়ে দিয়ে প তি তা পল্লীতে নিয়ে ফেলল। জানো তো এ সমাজে শুধু নারীরাই টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় না, অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ রা ও টাকার বিনিময়…..

পুরোটা শেষ না করেই রোকেয়া বললেন,”এই ছবি গুলো এমন কেউ হয়তো তোমাকে পাঠিয়েছে যারা আমাদের নজরে রাখে। আমাদের সম্পর্কে ভীষণ ভালো ভাবে জানে। তুমি ওকে ভুল বুঝো এটির তার উদ্দেশ্য। তবে বিশ্বাস করো, এই মেয়ে গুলোর সাথে আমার ছেলের কোনো সম্পর্ক নেই। নেহাতই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিল। তবে অনেক কষ্টে আমার ছেলেটা সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। তবে যে দাগ লাগে সেটা তো সহজে যায় না মা। লোকজন তখন রাগীবের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতো। অথচ সে নিজ ইচ্ছায় ওমন জায়গায় পৌছায় নি। আর না ওর দ্বারা কোনো খারাপ কাজ নিকৃষ্ট লোক গুলো করাতে পেরেছিল। শুধু এই ক্লোজ ছবি গুলো ছাড়া।”

সবটা শুনে থ হয়ে যায় অদ্রি। ওর হাত পা কাঁপছে। রোকেয়া একবার মেয়েটিকে দেখে নিয়ে চলে যান। কারণ অদ্রিতার নিজস্বতা রয়েছে। রাগীবের প্রতি তার ভালোবাসা কতখানি সত্যি, এখন সেটাই দেখার পালা।

রাগীব এখনো ফিরে নি। অথচ রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলেছে। অদ্রির চোখে ঘুম নেই। সে বার বার গেটের দিকে তাকাচ্ছে। অধৈর্য সে পাগলের মতন ছুটোছুটি করছে। ওর ভালো লাগছে না। রাগীবের ফোন ও বন্ধ বলছে। তবে ছেলেটার কী হলো? অদ্রির কান্না পাচ্ছে। কেন সে ভুল বুঝেছিল? কেন সবটা না জেনে বুঝে অভিযোগ তুলল। ভীষণ রাগে অদ্রির দু চোখে বর্ষণ শুরু হয়েছে। তপ্ত সে জলে মেখে যাচ্ছে সমস্ত মুখশ্রী।

ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে সূর্যের আলো আধিপত্য বিস্তার করছে। অদ্রি মেঝেতেই বসে আছে। চোখ দুটো শুকিয়ে আছে নোনা জলের রেখাতে। হলুদ রঙা আলোতে মুখের সৌন্দর্য যেন বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেকটা সময় পর গাড়ির হর্ন শোনা গেল। অদ্রির বুকের ভেতর লাফিয়ে ওঠল। ও ছুটে বেরিয়ে পড়েছে। কোথায় তার চুলের অবস্থা, কোথায় তার মুখের সাজসজ্জা। কোনো কিছুই ওকে দমাতে পারল না। ও ছুটে গেল গেটের কাছে। রাগীব যেন একটু বেশিই অবাক হলো ওকে ছুটে আসতে দেখে। তবে তারচেয়েও বেশি অবাক হলো যখন দেখল অদ্রি একদম ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। শক্ত হাতে।

“আমি সরি, আমি সরি রাগীব। ক্ষমা করে দেও। আমি বুঝতে পারি নি। বুঝি নি আমি। খুব সরি আমি।”

টানা বাক্য গুলো বলতে লাগল অদ্রিতা। কাঁদতে কাঁদতে কন্যাটির হিচকি ওঠে গেছে। রাগীব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,”ইটস ওকে অদ্রি। আসলে আমার অতীতটা খুব বেশি সুন্দর নয়। জানো তো কলঙ্ক শুধু মেয়েদের ই নয় ছেলেদের ও হয়।”

কি এক আশ্চর্য ব্যথা ছেয়ে গেল অদ্রিতার সমস্ত শরীর। পিঠের বাঁক বেয়ে নেমে যেতে লাগল ঘামের স্রোত। সে বড়ো ঘেমে গিয়েছে। রাগীব দু হাতের মুঠোতে মেয়েটির মুখ তুলে নিয়ে শুধাল,”না খেয়ে আছ?”

অদ্রি প্রশ্নটির জবাব না দিয়ে বলল,”রাগীব আমায় মাফ করেছ তো?”

রাগীব একটু করে হাসল। তবে সেই হাসিতেও কোথাও একটা ব্যথা দেখতে পেল অদ্রিতা। ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পুরুষটিকে।

“আমরা আজই বিয়ে করব রাগীব। আজ ই বিয়ে করব।”

সত্যিই খুব দ্রুত আয়োজন করা হলো। গ্রাম থেকে অদ্রির বাবা-মা বোন এল। তারা ভীষণ বিস্ময়ের সাথে সবটা দেখে চলেছে। অদ্রির মাঝের পরিবর্তনটি খুব করে দেখতে পারছেন লুবনা। মুজাহিদ নিশ্চুপ। মেয়ের এই সিদ্ধান্তে তিনি যে খুব একটা খুশি হয়েছেন এমনটাও নয়। অদ্রি নিজের রুম থেকে তৈরি হয়ে বাবা মায়ের কাছে এল। লুবনা মেয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুজাহিদ ও তাই। তাদের সেই ছোট্ট অদ্রি আজ এত বড়ো হয়ে গেল? যে নিজে সবটা সিদ্ধান্ত নিয়ে অতিথির মতন করে তাদের জানাল। প্রচন্ড আক্রোশ থেকে কন্যাকে চড় মারলেন মুজাহিদ। অদ্রি কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। ও বরং বাবা মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল,”আব্বু-আম্মু দোয়া করো, যাতে আমি পৃথিবীর সবথেকে সুখী হই।”

স্পেশাল পর্ব :

বিয়ের ঠিক আগ মুহুর্তে পালিয়ে গেছে অদ্রিতা। এমন খবর পেয়ে লুবনা আর মুজাহিদের চোখে মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে। রউফ এসে মুজাহিদের পাশে দাঁড়ালেন। আফসোস করে বললেন, “শেষমেশ মেয়েটা এ কাজ করবে আমরা কেউ ই ভাবতে পারি নি। জানি না কোন বুদ্ধি থেকে এই কাজটি করল।”

মুজাহিদ লজ্জায় মুখ তুলতেও পারছেন না। লুবনা তো যায় যায় অবস্থা। তার মেয়েটা এতটা বিগড়ে গেল!

দেড় ঘন্টা পর দেখা মিলল রাগীবের। শুকনো তার মুখশ্রী। ছেলেকে দেখে ছুটে এলেন রোকেয়া,”রাগীব বাবা পেলি ওকে?”

“না আম্মু। পেলাম না। অদ্রি আমার সাথে এমনটা কেন করল আম্মু? শেষমেশ আমারই বন্ধুর সাথে….

এ কথা বলেই একটা বেঞ্চে বসে পড়ল রাগীব। মেয়েটার প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল কি?

ট্রেন চলছে। অদ্রির পরনে লাল বেনারসি। মুখে প্রসাধনীর ছোঁয়া। কি সুন্দর লাগছে তাকে। অথচ ভেতরটা গুপ্ত ব্যথায় ম র ছে। অদ্রির পাশে বসে থাকা ছেলেটা এক বোতল পানি এগিয়ে দিল। মুখে বলল,”অদ্রিতা পানি খান।”

অদ্রি কিন্তু পানির বোতলটা ছুঁয়েও দেখল না। ওর পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছে রাজবি। তাই জোর না করে সাহস জোগাতে বলল,”অদ্রিতা শুনেন আমার কথাটা। আপনার লড়াই সবে শুরু। আপনাকে অনেক লড়তে হবে অদ্রিতা। অনেক লড়তে হবে।”

অদ্রিতা আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ওকে দেখে রাজবির বড়ো মন খারাপ হলো। ও বেশি সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। বুকের ভেতর কোথাও একটা কষ্ট অনুভব হলো।

অতিরিক্ত কান্নার ফলে অদ্রির শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তর তর করে বাতাস আসছে। রাতের আঁধারে সেই সমীরণ শরীরকে হীম করে দিচ্ছে। মেয়েটি তাই আরো বেশি কুঁকড়ে যাচ্ছে। রাজবি প্রথম প্রথম নিজেকে সংযত রাখলেও এবার কেন যেন পারল না। সাথে কোনো কিছু নেই। তাই ওঠে পাশের বগি থেকে একজনের থেকে চেয়ে চাদর নিয়ে এল। সেটা শরীরের ওপর দিতেই অদ্রির মুখশ্রী কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এল। রাজবি একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ঠিক কোন নেশায় পড়ে নিজের ঘাড়ে এত বড়ো বিপদ নিল সে?

নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গুলো নিতে শিখেছে অদ্রি। ছোট থেকেই তো চটপটে সে। তবে প্রেমের ব্যাপারে এত বড়ো ভুল হবে তা কেউ কী জানত? উহু না। অদ্রির জীবনটা কেমন যেন। যে থাকতে চাইল তাকে সে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আর যে ভোগ্য পন্যের মতন ব্যবহার করল তার কাছেই শান্তি খুঁজেছিল ও। অথচ ভাগ্য, ভাগ্য কার সাথে পাঠাল? অদ্রির এই জীবন বড়ো সংকট পূর্ণ। কে জানে কী আছে মেয়েটির ভাগ্যে। যেখানে এত দিনের পরিচিত ভালোবাসার মানুষ রাগীবই চরম নিকৃষ্ট বের হলো। সেখানে তারই সঙ্গী রাজবি নামক মানুষটাই বা কেমন হবে? অদ্রি জানে না, জানে না সে কোন আঁধারে এক টুকরো আলো খুঁজে চলছে। ট্রেনের বিরক্তিকর শব্দেই ঘুম ছুটল অদ্রির। ও ওঠে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই এত বড়ো একটা ঘটনার পর ওর মস্তিষ্ক চাপে রয়েছে। তার ওপর নিজেকে একা দেখে ও আরো বেশি বিভ্রান্ত হয়ে ওঠল। ও চিৎকার করে ওঠল। কয়েকবার চেচিয়ে ও বের হতে চাইল। ঠিক সে সময়েই একটা শক্তপোক্ত দেহে গিয়ে ঠেকল ওর মাথাটা। ওর ভীত হয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখেই রাজবি বলল,”অদ্রিতা ভয় পাবেন না। আমি আছি, আপনি শান্ত হয়ে বসুন।”

স্বাভাবিক হতে কিয়ৎক্ষণ সময় লাগল অদ্রিতার। ও জানালার পাশে এসে বসল। রাজবির হাতে খাবার। সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,”অনেক সময় ধরে না খেয়ে আছেন। খাবারটা খেয়ে নিন।”

অদ্রিতা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। দেখল রাজবি নামের পুরুষটিকে। এই ব্যক্তিটিকে এর আগে আরো দু বার দেখেছে ও। প্রথমবার রাগীবের সাথে। আর দ্বিতীয় বার ট্রেনে। তবে তখন চট করেই বুঝে ওঠতে পারে নি ব্যাপারটা। অদ্রির মৌনতা দেখে রাজবি পুনরায় বলল,”খাবারটা নিন।”

অদ্রি এবার শক্তপোক্ত কণ্ঠে বলল,”আমি কেন আপনাকে বিশ্বাস করব বলতে পারেন?”

জবাবে রাজবি একটু হেসে নিল। ওর ঠিক পাশটায় বসে বলল,”অদ্রিতা, আপনি ভুলে যাচ্ছেন। গতকাল আপনি আমাকে বিশ্বাস করেই এত দূর এসেছেন।”

সত্যিই তো তাই। রাজবিকে বিশ্বাস করেই তো এত দূর এসেছে অদ্রি। সেটা স্মরণ করেই ওর সমস্ত দেহ শিউরে ওঠল।

রাগীব আর তার পরিবার সম্ভবত পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্টদের কাতারে পড়ে। রউফ, রোকেয়া কিংবা রাগীব তাদের তিনজনের অভিনয়ের জালেই আটকে গিয়েছিল অদ্রি। খুব সুন্দর এক প্ল্যান করে অদ্রিকে প্রেমে ফেলল রাগীব। এটি মূলত তাদের বিজনেসের একটি অংশ। এর আগেও বহু মেয়েকে ভাগিয়ে এনে বিক্রি করেছে ওরা। অদ্রির সাথে অবশ্য এমনটা প্ল্যান ছিল না। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে অদ্রি যেদিন প্রথমবার রাগীবদের বাড়িতে এল। কথা ছিল অদ্রি শুধু পরীক্ষা দিয়েই চলে যাবে। যেহেতু মুজাহিদের সাথে ছেলেবেলা থেকেই বন্ধুত্ব রউফের। তাই কথাটা তিনি ফেলতে পারেন নি। তবে কে জানত খেলা এভাবে বদলে যাবে। অদ্রি যেদিন বাড়ি এল সেদিন রাতেই একটা মিটিং চলছিল। আর সেখান থেকেই ক্লায়েন্ট অদ্রিকে ডিমান্ড করে ফেলে। রাগীব তখন বিষয়টিকে পাত্তা দেয় নি। তবে ক্লায়েন্ট যখন কোটি কোটি টাকা অফার করল তখন রাগীবের মাথায় বিষয়টা চড়াও হয়ে ওঠে। তার ওপর ক্লায়েন্টের কথা ছিল মেয়েটির শরীরে কোনো রকম আ ঘা ত করা যাবে না। একটি সুস্থ সুন্দর দেহের অদ্রিতাকে চায় সে। তবে অদ্রি যেহেতু ওদের পরিচিত তাই আর পাঁচটা প্রজেক্টের মতন কাজ করা রাগীবের জন্য কঠিন ছিল। কোনো ভাবে অপহরণ ও করা যাচ্ছিল না। কারণ এতে করে ওর পরিবারের ভোগান্তি বাড়বে। কেইস হলে ওদের ঝামেলা হতে পারে। তাই এমন কিছু করতে হবে যাতে সবটা ঠিক থাকে। তবে কী করা যায়, এ চিন্তা থেকেই রিস্ক না নিয়ে মেয়েটিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। তবে নানা ভাবে অদ্রির কাছে ধরা পড়তে থাকে ও। বিষয়টা কঠিন হচ্ছিল ক্রমশ। সেদিন যখন ছবি গুলো পাওয়া গেল তখন রাগীবের মাথায় আকাশ ভে ঙে পড়ে। ও বুঝতে পারছিল কাছের কেউ ই এই কাজটি করেছে। তবে কে হতে পারে? এই বিষয়টি ও বুঝতে পারছিল না। রোকেয়া যেভাবে অদ্রিকে বুঝ দিয়েছিল তারপর রাগীব বেশ অনেকটাই চিন্তা মুক্ত হয়েছিল। তবে অদ্রিই বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করল। তখন রাগীব চাইলেও নিষেধ করতে পারত না। এতে অদ্রি হাত ছাড়া হতে পারত। তাই নানান কৌশলে বিয়ের মিথ্যে প্ল্যানটা সাজাল। রাজবিকে বলা হয়েছিল অদ্রিকে বলতে গেটের বাইরে রাগীব অপেক্ষা করছে। কোনো এক সারপ্রাইজ আছে। সেই অনুযায়ীই সবটা হলো। তবে শেষে একটু টুইস্ট এল। রাগীব দেখাতে চেয়েছিল অদ্রি রাজবির সাথে পালিয়ে গেছে। সেটা সাকসেস ফুল তো হলোই। তবে টুইস্ট এল তখনই যখন সত্যিই অদ্রিকে নিয়ে পালাল রাজবি। সবটা বুঝতে পেরে চিৎকার করে ওঠল রাগীব। জিনিসপত্র ভাঙতে লাগল। এতদিন কাঠি নাড়া মানুষটা ছিল রাজবি! তার ই সামনে দিয়ে, তার করা প্ল্যানে, তাকে মাত দিয়ে গেল তার পোষা ছেলাটা! যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করত রাগীব।

পরিশিষ্ট: আজ দু বছর হতে চলল অদ্রি একটি কেজি স্কুলে পড়াচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াতে ওর ভালোই লাগে। অদ্রির আজ ক্লাস কম ছিল। তাই আগে ছুটি হয়েছে। ও বের হয়েই দেখল স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করছে রাজবি। ছেলেটার প্রতি অসম্ভব কৃতজ্ঞ ও। এই মানুষটা ছিল বলেই রাগীব আর তার পরিবারে নিকৃষ্টতা থেকে বেঁচে গিয়েছিল ও। শুধু তাই নয় এই যে বেঁচে আছে, বলা চলে বেশ ভালো ভাবেই বেঁচে আছে এই সবটা রাজবির জন্য। ছেলেটা নিজের জানের মায়া ত্যাগ করে রাগীবের মতন হায়নার চোখ এড়িয়ে অদ্রিকে আগলে নিয়েছিল। তবে সবথেকে দুঃখের বিষয়টি হলো আজ ও বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারল না অদ্রি। এর কারণ রাগীব। যদি কোনো ভাবে জানে বাবা-মায়ের সাথে অদ্রির যোগাযোগ আছে তবে তাদেরকে মে রে ফেলতে দু বার ভাববে না নিকৃষ্ট লোকটা। তাছাড়া বাবা-মা এই বিষয় গুলো জানতে পারলে কষ্ট পাবেন। সেই সাথে নানান সমস্যা ও রয়েছে। রাজবি অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রির ভাবলেশহীন চাহনি দেখে মুখের সামনে হাত দিয়ে শব্দ করল। এতে করে ধ্যান ভাঙল ওর।

“কোথায় হারিয়ে গিয়েছ?”

“না এমনি।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে,চলো।”

“কোথায়?”

“বলা যাবে না। চলো আগে।”

কথাটি বলেই অদ্রির হাত আগলে নিল রাজবি। এতে অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেল অদ্রিতার সমস্ত দেহে। ও অপলক নয়নে ছেলেটাকে দেখতে লাগল। খুব বেশি সময় নিয়ে দেখলে বোঝা যায় রাজবি অসম্ভব সুন্দর একজন পুরুষ। গভীর দুটো চোখ। কালচে হওয়ার ঠোঁট। পুরো মুখশ্রীতে মায়া রয়েছে।

হুট করেই চোখ বাঁধতে শুরু করেছে রাজবি। অদ্রি এবার ধৈর্য হারিয়ে বলল,”কী মশাই পাচার করে দেওয়ার ধান্দা নাকি?”

“একদম তাই। এখন তুমি চুপ করো তো।”

“কিন্তু আমরা কোথায় চলেছি।”

“উফ অদ্রিতা, এত কেন কথা বলো?”

“আশ্চর্য তো আপনি।”

রাজবি এবার জবাব দিল না। অদ্রিকে ধরে সাবধানে পথ চলতে লাগল। আজ অদ্রিতার জন্মদিন। সেটির জন্যেই ছোট এক আয়োজন করেছে ছেলেটা। রাজবি চুপ করতে বললেও, অদ্রি তো অদ্রিই। মেয়েটা কথা না বলে এক সেকেন্ড থাকতে পারে না। ও এবার বলল,”একটা কথা বলেন তো, আপনি কেন এতটা আমার জন্য করলেন? কেন নিজের জীবন রিস্কে রেখে আমাকে আগলে রেখেছেন? যদি রাগীব খোঁজ পায় তবে নিশ্চিত মে রে ফেলবে।”

রাগীব জবাব দিল না। এই প্রশ্নটি সে নিজেও নিজেকে সহস্রবার করেছে। তবে কোনো উত্তর আসে নি। কি এক নেশায় অদ্রিকে আগলে রেখেছে সে। অদ্রি জবাব না পেয়ে থেমে গেল। রাজবি বলল,”কী হলো?”

“জবাব কেন দিচ্ছেন না?”

রাজবি আবার চুপ। অদ্রি নিজের চোখের বাঁধন খুলে ফেলল। রাজবি দেখল মেয়েটার চোখ ফুলে গেছে। চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতন নোনা জল ঝরছে।

“কেন এতটা করলেন আমার জন্য?”

রাজবি মাথাটা নত করে চোখ বুঝল। ভেতর থেকে সে কিছু একটা অনুভব করে বলল,”অদ্রিতা আমি জানি না কেন আমি এমনটা করে চলেছি। তবে তুমিময় নেশাটা আমার কখনো না যাক। আমি তোমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সেই যে ছোট বেলায় পরিবার হারালাম তারপর আমি কখনো কোনো কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখে নি। কত খারাপ কাজের সাথে জড়িয়ে ছিলাম। তবে এত গুলো মাস তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছি। তবে কোনো জোর নেই। আমি সব সময় চাই আমার তুমি ভালো থাকো। সুখে থাকো, সুস্থ থাকো….

বাক্যটি শেষ না হতেই অদ্রিতা ছুটে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। যার ফলে হুট করেই শক্ত কিছুর আ ঘা ত অনুভব করে রাজবি। আকস্মিক সে ঘটনা ওর ভেতর অবধি নাড়িয়ে দিল। আচমকা জড়িয়ে ধরার জন্যেই সে কিছুটা ব্যথা পেয়েছে। তবে বাইরের এই ব্যথার থেকে সুখের ব্যথাটা বেশি মনে হচ্ছে। অদ্রি তার চোখের জলে ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরুষটির বুকের মাঝখান। রাজবির চোখ গুলো ইষৎ বড়ো হয়ে গেছে। তবে কি তার নেশাটা এবার ব্যক্তিগত তুমিতে পরিনত হতে চলেছে?

~সমাপ্ত~
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি