মন কারিগর পর্ব-৪+৫

0
114

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৪]
~আফিয়া আফরিন

জুহি অনেকক্ষণ পর্যন্ত ছাদের দরজার হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনল। মনের ভাঁজে ভাঁজে পর্যন্ত সুর ছড়িয়ে গেছে। ছাদে মাহিদ, রিয়াদ, রাফি এবং আরও বেশ কয়েকজনের আড্ডার পসরা বসেছে। এতক্ষণ যাবত গান গেয়ে মনের অপরূপা শাশত্ব স্বত্ত সৃষ্টি করল রাফি। জুহি ছেলেটাকে পাগল বলুক আর যাই বলুক না কেন, এই মুহূর্তে স্বীকার করে নিল ছেলেটার গানের গলা অসাধারণ! অসাধারণ বললেও ভুল হবে, তার থেকেও বেশি কিছু; যা হয়তো মুখের ভাষা দিয়ে প্রশংসা করা যায় না।
এতক্ষণ মন বেশ রুক্ষ ছিল, গানটা শুনে এখন ফুরফুরে লাগছে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে জুহি যেভাবে চুপি চুপি এসেছিল সেভাবে চুপি চুপি নিচে নেমে গেল। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমানো জরুরি। নেত্রপল্লবও ভারী হয়ে আসছে, কিন্তু জুহি জানে বিছানায় মাথা দেওয়ার সাথে সাথে এই ঘুম কর্পূরের মত উবে যাবে। প্রতিনিয়ত তাই হয়ে আসছে। কতকাল ধরে যে আধো ঘুম আধো জাগরণের গোলকধাঁধায় সে বন্দী হয়ে আছে, তার হিসেব নিজেরও স্পষ্ট জানা নেই।

সকাল সকাল মিমির বৌভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সবাই রেডি হচ্ছিল। মিমি ওই বাড়ি থেকে ফোন করে বারবার তাড়া দিচ্ছে।
আফসার তালুকদার একবার জুহির রুমে উঁকি মারলেন। মেয়েটাকে যদি ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাজী করানো যেত!
দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘জুহি, আসব মা?’

জুহি অবিলম্বে বলল, ‘এতটাই পর করে দিয়েছ আমায় যে আমার ঘরে আসতেও তোমায় অনুমতি চাইতে হবে?’

আফসার তালুকদার হেসে বললেন, ‘পর আমরা করে দিচ্ছি নাকি তুই আমাদের পর করে দিচ্ছিস? এত করে বলছি মিমির শ্বশুরবাড়ি চল, তা তো তুই গায়ে মাখছিস না মা। এইবার বিবেচনা কর, পর কে কাকে করে দিচ্ছে?’

‘তুমি বসতো মামা। তুমি তো জানো আমার এইসব ভালো লাগে না। এতো মানুষজন, কোলাহল আমি একদম বিরক্ত হয়ে যায়। বিশ্বাস কর ছোট বোনের বিয়ে না হলে আমি এই অনুষ্ঠানেও আসতাম না। নেহাতই মিমি বাচ্চা মেয়ে, আমি না এলে মন খারাপ করত তাই এলাম।’

‘তারমানে শুধু দায়িত্ববোধ থেকে এসেছিস? আমাদেরকে আর একটুও ভালোবাসিস না তাই না?’

‘এইতো এই এক কথা, তোমার ভালো না বাসলে আমার নিজের কোন অস্তিত্ব থাকবে? অন্তত নিজের কথা ভেবেও তোমাদের এত এত ভালোবাসি।’

আফসার তালুকদার উদাসীন ভাবে বললেন, ‘কোথায় ভাবিস নিজের কথা? আমরা কী কিছু জানি না কিছু বুঝিনা? মামাকে এত বোকা মনে হয় তোর মা?’

জুহি প্রসঙ্গ পাল্টাল তৎক্ষণাৎ। বলল, ‘তুমি না আজ মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাবে মামা! এরকম মুখ করে না থেকে একটু হাসো তো। মাহিদ ভাইয়া কই? তোমাদের নিয়ে বের হবে কখন?’

‘মাহিদ যাবে না। ওর বন্ধুগুলো আছে না, ওদের নিয়ে আজকের দিনটা ঘুরবে। আগামীকালই তো ওরা সব চলে যাবে। তাই মাহিদ আজকের দিনটা ওদের সময় দিয়ে সময় পেলে যাবে ওই বাড়ি।’

‘ও আচ্ছা। ভাইয়া কাল চলে গেলে আমিও চলে যাব ভাইয়ার সাথে।’

‘আর কয়েকটা দিন থেকে গেলে হয় না?’

‘হয়না মামা, একদমই হয় না। অন্তু নামের একটা ছেলেকে প্রাইভেট পড়াই, ছেলেটার সামনের মাসেই পরীক্ষা। ওকে জোর করে পড়তে না বসালে ও পড়ে না। তাই আমাকে যেতেই হবে!’

‘আচ্ছা যাহ, আর কী বলব আমরা?’
আফসার তালুকদার চলে গেলেন। জুহি বুঝল মামা রাগ করেছে। তার আর কি করার? তার নিজেরও হাত-পা বাঁধা।
শুধু এই টিউশনি হলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু সে তো একটা এনজিওতে চাকরিরত রয়েছে। বছর তিনেক আগে জুহিসহ আরও বেশ কয়েকজন মিলে নারীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরই গঠন করা হয় ‘আমি নারী’ নামক একটি সংগঠন। সমাজে অবহেলিত নারী, নির্যাতিত নারী, স্বামী থেকে বিতাড়িত নারী তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে সর্বদা সোচ্চার এই সংগঠন।
এই সংগঠনের বেশিরভাগ দায়িত্ব জুহির উপর, যেহেতু সে এই সংগঠনের কর্তৃপক্ষ পদে রয়েছে। এত দায়িত্ব এক পাশে রেখে তো তার পক্ষে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে না।

আগামীকাল যাওয়ার দিন ঠিক করা হল। জুহি নিজের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রেখে নিচে নামল। বসার ঘর ফাঁকা দেখে খানিকক্ষণের জন্য বাহিরে বের হলো। শেষ বিকেলের গোধূলি আলো আছড়ে পড়ছে। পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভায় নীল সমুদ্র আর সূর্যের লুকোচুরি খেলার দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। পুব আকাশে সাতটি রংয়ের অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে বিশাল রংধনু আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছে।
মাহিদদেরকে মাঠে বসে থাকতে দেখে জুহি আর সে দিকে এগোল না। চুপিসারে পেছন দিয়ে উত্তরের সরু নদীর কিনারে পাটাতনের উপর গিয়ে বসল। এই নদীর পাড় জুহির গত ১৫ বছরের স্মৃতি ধরে রেখেছে। এখানে মায়ের সাথে অনেক স্মৃতি জমানো রয়েছে।
ঠিক এমন সময় পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল জুহি। উফফফ, আবার সেই বিরক্তিকর ছেলেটা! একটু আগেই দেখা গেল মাহিদ ভাইয়ার সাথে গল্প করতে, এখন আবার ঘুরতে ঘুরতে এইদিক পর্যন্ত চলে আসছে। আশ্চর্য! জুহিকে দেখলেই অযথা বক বক করা শুরু করে দেবে। তার আগেই জুহি উঠে গেল। এখান থেকে চলে যেতে নেবে এই সময় রাফি পেছন থেকে ডাক দিল, ‘এই যে ম্যাডাম শুনছেন!’

জুহি থামল। একরাশ হতাশ ভাব নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। রাফি জিজ্ঞেস করল, ‘আরে ম্যাডাম, একা একা এই নদীরপাড়ে কী করছেন বলেন তো?’

‘আপনাকে জবাব দিতে বাধ্য আমি?’

রাফি মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘একদমই না, কিন্তু আপনি যে এরকম হাইভোল্ডেজে কথা বলেন; শক খেয়ে গেলে দায়িত্ব কে নিবে ম্যাডাম?’

জুহি মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘আপনার ফালতু কথা বাদ দেন তো। কী জন্য ডাকলেন সেটা বলেন।’

রাফি ঠোঁট উল্টে উদাস গলায় বলল, ‘তেমন কোন কারণ না, দেখতে পেলাম তাই ডাকলাম আর কী! শুনলাম কাল নাকি আপনি আমাদের সাথে ঢাকা যাচ্ছেন?’

‘কেন কোন সমস্যা নাকি আপনার?’ জুহি ভুরুযুগল সংকুচিত করে জিজ্ঞেস করল।

‘কী যে বলেন না আপনি। সমস্যা কেন হবে? আমি তো এমনিতেই বলছিলাম। ঢাকা কোথায় থাকেন আপনি? আমার বাসাও কিন্তু ঢাকা।’

‘আমি তেজগাঁওতে থাকি। আপনি?’

‘বনানী মডেল টাউন। মাহিদ ভাইয়া তো ওখানেই চাকরি করে, আপনাকে তো কখনো দেখিনি।’

‘আমি ওখানে খুব একটা যাই না, খুব একটা বলতে একেবারেই যায় না। আর আমি কাজকর্মে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকি, তাই ইচ্ছে থাকলে আমারও যাওয়ার সময় হয়ে ওঠেনা।’ জুহির কথা বলতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না তবুও ভদ্রতাসূচক কথাগুলো বলল।

‘কী করেন আপনি?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রাফি।

‘পড়শোনা করছি, একটা এনজিওতে আছি পাশাপাশি তিনটে টিউশনি।’ তারপর সৌজন্যতা বজায় রেখে রাফিকেও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কী করেন?’

রাফি হেসে পকেটে হাত গুঁজে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমিও পড়াশোনা করছি আর আপাতত টুকটাক গান গাইছি, তারপর দেখি ভবিষ্যতে কী হতে পারি!’

‘মানে গায়ক হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে?’

‘ইচ্ছে তো মানুষের কত রকমই থাকে। কয়টা ইচ্ছে আর পূরণ হয়? গানের প্রতি আলাদা একটা ফ্যাসিনেশন রয়েছে, কিন্তু কখনো গায়ক পর্যায়ে উঠতে পারব কিনা জানিনা। তবে হ্যাঁ, এখন ছোটোখাটো অনুষ্ঠানে গান গাই।’

‘আপনার গানের গলা কিন্তু বেশ সুন্দর। চেষ্টা করলে গায়ক হওয়া সম্ভব।’

রাফি কিঞ্চিত ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাহ, আপনি না শুনেই বলে দিলেন আমার গানের গলা বেশ সুন্দর? তাহলে শুনলে কী বলবেন বলেন তো?’

‘শুনেছি। কাল রাতে তখন ছাদে গান গাইলেন তখন গিয়ে শুনে এসেছি। সত্যিই অসাধারণ! চেষ্টা করতে থাকুন, জীবনে নিশ্চয়ই বড়ো কিছু হবেন। এখন ছোটখাটো কনসার্টে গান গাচ্ছেন, একদিন হয়তো সিনেমায় প্লে-ব্যাকও করবেন। তখন আপনার ফ্যান ফলোয়াররা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য আপনার পিছে পিছে ঘুরবে।’

‘মজা নিচ্ছেন?’

‘মোটেও না। শুধু বলতে চাচ্ছি, মানুষ নিম্ন পর্যায় থেকেই উচ্চ পর্যায়ে ওঠে।’

‘হ্যাঁ তা ঠিক বলছেন।’

‘আচ্ছা আসি আমি। বাসায় না বলে এসেছি তার মধ্যে আবার সন্ধ্যাও হয়ে যাচ্ছে! মামী খুঁজবে আমাকে।’

জুহি রাফির অনুমতির অপেক্ষা না করে পা বাড়াল। রাফি নির্নিমেষ চেয়ে রইল।
মন জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত সাথে একটু বেপরোয়াও বটে। নয়তো এত নিয়ন্ত্রণহীনতা কেন করে!
জুহির নামের মত তার গড়নেও এক ধরনের মৌনতা রয়েছে। খুব সূক্ষ্ম ভাবে না দেখলে তার সেই উথাল পাথাল সৌন্দর্য কখনোই ধরা যাবে না।
অকারণেই জুহিকে ভালো লাগে রাফির। কাঠখোঁট্টা কথাগুলো শুনতেও ভালো লাগে। হাসিবিহীন ওষ্ঠদ্বয়ের কোণে ফুটে ওঠা ভগাঙ্কুর হাসি দেখতেও ভালো লাগে। এই শরৎকালে যেন রাফির মনে চৈত্র মাসের আবহাওয়া বয়ে গেল! সে নিজের সামনেই তার বহু প্রতীক্ষিত সর্বনাশ দেখতে পেল, এই শরৎকালেই। তবে জুহিকে দেখলে, বা তাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা; এটা ভালোবাসা না ভালোলাগার পর্যায়ে এটুকু বুঝতে পারল না রাফি! কবে বুঝবে কে জানে? এই জিনিস বুঝতে বুঝতে আবার জুহি রাফির জীবনের বেড়াজাল থেকে হারিয়ে যাবে না তো?

খুব সকাল সকাল যাওয়ার জন্য সবাই রেডি। কারণ সকাল সাতটায় সুবর্ণ এক্সপ্রেসে যাত্রা করবে তারা।তাহেরা জুহির কাছাকাছি এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভালোভাবে থাকিস মা। আবার কবে আসবি না আসবি, তার কোন ঠিকঠিকানা নেই।মামা-মামীকে মাঝেমাঝে একটু মনে করিস।’

‘আসব মামী। সেইভাবে সুযোগ-সুবিধা পাইনা তো, তাই আসতেও পারিনা। এইবার আসব ইনশাআল্লাহ, দোয়া কইরো।’

‘দোয়া তো তোর সাথে সব সময় থাকে রে মা।’

মামা মামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনে রওনা ‌হলো সবাই। জুহিদের বাড়ি থেকে মোর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে তারপর ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। কিন্তু মাঝপথে রাস্তার এক কোণে একটা বোম্বাই মরিচের গাছ দেখে রাফি কয়েকটা মরিচ তুলে নিল। রিয়াদ ধমক দিয়ে বলল, ‘বাচ্চা তুই? বাচ্চা মানুষের মতো যা পাচ্ছিস তাই তুলে নিচ্ছিস! রাখ, এসব।’

‘আরে ভাইয়া থামো। একটা মরিচ খেয়ে টেস্ট করে দেখি ঝাল কেমন।’ আনন্দে গদগদ হয়ে বলল রাফি।

মাহিদও পাল্টা ধমক দিয়ে বলল, ‘এসব রেখে তাড়াতাড়ি পা চালা।’
জুহি পেছন থেকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘সাতটা বাজতে আর মাত্র ২৫ মিনিট আছে। আপনার জন্য ট্রেন মিস দিব নাকি এখন?’

‘আরেহ ব্যাপার না। আমি কি আপনাদের টাইম ওয়েস্ট করছি নাকি? হাঁটব আর মরিচের ঝাল টেস্ট করব।’

‘হুহ! ঝালে সবার্ঙ্গ জ্বলে গেলে তারপর মজা বুঝবেন।’ ব্যঙ্গ করে কথাটা বলল জুহি।

রাফি গায়ে মাখল না জুহির কথা। উল্টো হাসি মুখ করে বলল, ‘আমি মানুষটা এতটাই সুইট যে এইটুকু ঝালে আমার কিছুই হবে না।’
বলে আস্ত মরিচে কামড় বসিয়ে দিল। তারপর একটার পর একটা কামড় দিয়েই গেল। একটু ভাব দেখাতে গিয়ে বর্তমানে তার অবস্থা শোচনীয়। ইতিমধ্যে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। জুহি সেটা খেয়াল করে মুখ টিপে হাসল। রাফিও চুপচাপ কোন কথা না বলে আগাচ্ছে।
জুহি মাহিদকে ডেকে বলল, ‘দেখো ভাইয়া তোমাদের অতিরিক্ত সুইট ড্যাশিং বয়ের কি অবস্থা হয়েছে। এনাকে তাড়াতাড়ি সামলাও, না হয় ঝালে হার্ট অ্যাটাক করবে।’
এতক্ষণে মাহিদ আর রিয়াদের খেয়াল হল রাফির দিকে।
রিয়াদ পুনরায় একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘বেয়াদবির একটা লিমিট থাকে যেটা তুই ক্রস করে ফেলছিস। কে বলেছে তোকে রাস্তার মধ্যে এসব ফাজলামি করতে? এখন ট্রেন মিস গেলে কী তোর ঘাড়ে ভর করে যাব আমরা?’

রাফি বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিয়ে অসহায় গলায় বলল, ‘অলরেডি সাতটা পার হয়ে গেছে তার মানে ট্রেনও মিস করে গেছি আমরা। আর কিছু করার নাই।’

জুহি হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে ক্রোধমিশ্রিত নয়নে তাকাল রাফির দিকে। রাফিও তাকাল, তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘নাহ, ম্যাডামের এই চাহনিটাও তো খারাপ নয়। রাগী রাগী মুখটা সুন্দর, বেশ সুন্দর!’
মুখে বলল, ‘আপনাকে রাগলে খুব সুন্দর দেখায়, মিষ্টিও দেখায় প্রচুর। আপনার ঐ মিষ্টি মুখ দেখে আমার ঝাল কেটে গেছে। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে!’
.
.
.
চলবে….

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৫]
~আফিয়া আফরিন

রাগে জুহির মুখ লালবর্ণ ধারন করেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে মাহিদকে ডাকল। মাহিদ বলল, ‘থাক, আজ যখন দেরি হয়েছে তাহলে না যাই। আগামীকাল সকাল সকাল রওনা দিব।’

জুহি উত্তরে বলল, ‘সরি ভাইয়া। আমার আজকে যেতেই হবে। তোমরা বরং থেকে যাও, আমি চলে যাই। একা এসেছি একা যেতে পারব।’

‘এসব কী বলছিস? একা কেন যাবি আমি থাকতে?’

‘উহু, আজকের দিনটা থেকে যাও তোমরা। আমার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে আমিও থেকে যেতাম। আমি সাড়ে আটটার বাস ধরে চলে যাব।’

‘আচ্ছা তাহলে চল তোকে বাসে তুলে দিচ্ছি।’

জুহি বাঁধা দিয়ে বলল, ‘সেটারও প্রয়োজন হবে না। তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও। আর মামা-মামীকে বল আমার জন্য যেন অযথা চিন্তা না করে। আমি পৌঁছে ফোন করে জানিয়ে দেব।’

‘তাই বলে তোকে এগিয়েও দিয়ে আসতে পারব না?’

রাফি এতক্ষন চুপচাপ তাদের কথা শুনছিল। মাহিদের কথার মাঝখানে বলে উঠল, ‘আমি তো দুইদিন ধরে বাড়িতেই আছি ভাবছি একটু ঘুরে আসি। তো ম্যাডাম আপনি যখন ওই দিকে যাবেন আমিও যাই, একটু ঘুরে দেখি আপনাদের শহরটা।’

মাহিদ নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘তাহলে তো হয়েই গেল। রাফি ওকে সাবধানে নিয়ে যাস।’
জুহি আর কিছু বলল না। এখন কথা বললে কথায় কথা বাড়বে আরো। রোষপূর্ণ চাহনিতে রাফির দিকে তাকিয়ে সামনে এগুল। রাফি পেছনে আসতে আসতে বলল, ‘এই চাহনি তো বুকের ভেতরটাকে এফোড় ওফোড় করে দিবে দেখছি! এতো অতৃপ্তি এই চাহনিতে?’

দুজন যখন বাস স্টেশনে পৌঁছেছে তখন সাড়ে সাতটা পার হয়েছে। রাফি পকেটে হাত গুঁজে আশে পাশে তাকাল। জুহি বলল, ‘থাকেন আসছি।’

রাফি মন খারাপ করে বলল, ‘চলে যাবেন এখনই? ভাবলাম আপনার সাথে এক কাপ চা খাব। অবশ্য আপনার হাতের চা যেই অসাধারণ, তাতে এখানকার চা কী আপনার মুখের রুচিতে আটকাবে?’

‘আমি এখানে চা খেতে আসি নাই মিস্টার।’

‘বাস কিন্তু সাড়ে আটটায়। ধরা বাঁধা আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় রয়েছে, চলুন এক কাপ চা খাওয়া যাক।’ হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল রাফি।

‘আপনার ইচ্ছা করলে আপনি খান না। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছেন কেন? বললাম না আপনাকে সেদিন, আমি চা খাই না!’

ঠিক সাড়ে আটটায় বাস এল। জুহি বাসে ওঠার আগে রাফিকে বিদায় জানিয়েই এসেছে। তবুও রাফি পিছু পিছু এলো। রাফির কর্মকাণ্ডে জুহি বিরক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।
জুহি যখন বাসে নিজের ছিটে গিয়ে বসেছে তখন রাফি আরেকবার জানালায় উঁকি দিতেই জুহি ফের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিপাত করল।
রাফি হাত নেড়ে মাথা চুলকে বলল, ‘এই, এই শেষ বার একটু বিরক্ত করতে আসলাম। বলছিলাম যে, আপনার সাথে আর দেখা হবে নাকি হবে না তা তো জানি না। তবে হ্যাঁ, আপনাকে ধন্যবাদ!’

‘ধন্যবাদ? ধন্যবাদ কেন?’ জুহি জিগাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

‘ঐ তো চা খাওয়ানোর জন্য, তারপর ঐ আর কী…..! নাহ আর কিছু না। ভালো থাকবেন কেমন?’

‘জি আমি সবসময় ভালোই থাকি। আপনিও ভালো থাকবেন।’

রাফি তড়িৎবেগে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ ভালো থাকব। তারপর বিড়ডিড় করে নিজের মনে মনে উচ্চারণ করল, ‘আপনার দেখা পেয়েছি এরপর আর খারাপ থাকি কী করে বলেন!’

রাফির হাবভাব পরখ করে জুহি বলল, ‘আর কিছু বলার আছে আপনার?’

‘শুনেন, সর্বনাশের দেবী…..!’ তারপর নিজের মাথায় নিজে একটা বাড়ি দিয়ে বলল, ‘আরে ধুর ধুর কী যে বলি না আমি? শোনেন, আপনার থেকে সেধে একদিন চায়ের দাওয়াত নিলাম। ঠিক দাওয়াত না, এটা আবদার বলতে পারেন। আশা করি অধমের এই আবদারটা আপনি পূরণ করবেন!’

জুহি ভ্রু নাচিয়ে হাসার ভঙ্গিতে রাফির কথায় সম্মতি দিল। রাফি ওষ্ঠ্যদ্বয় কিঞ্চিৎ বাঁকা করে হাসল।
তারপর আরেকবার বলল, ‘কী না কী বলেছি তাতে কিছু মনে করবেন না, কিন্তু হ্যাঁ মনে রাখবেন।’

বাস ছেড়ে দিয়েছে। ধীর গতিতে চলতেও শুরু করেছে। রাফির কথা শুনে জুহি চলন্ত বাসে বসেই মনে মনে বলল, ‘পাগলে কিনা বলে আমি ছাগলে কিনা খায়, তাতে আমি এতো কিছু মনে করি না।’
রাফি পেছন থেকে হাত নাড়ছে। রাফির কর্মকাণ্ড দেখে জুহির অনেকদিন পর খিল খিল করে হাসি পেল। সম্মুখে এভাবে পাগলের মত একা একা হাসলে লোকে কী ভাববে, সেটা ভেবে আপাতত হাসি গোপন করে গেল।

রাফি ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। যতক্ষণ না পর্যন্ত জুহি চোখের আড়াল হল, ততক্ষণ অপলক চেয়েই রইল। মন দেওয়া বোধহয় একেই বলে!
মনে মেঘ জমেছে। তবে, মেঘ বোধহয় আকাশের জন্যই উপযোগী মনের জন্য নয়। আকাশেও মেঘ, পেজা তুলোর মতো মেঘগুলো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। রাফি ছাউনির নিচ থেকে বেরিয়ে খোলা গগনের নিচে দাঁড়াল। অতঃপর বৃহৎ গগন পানে চেয়ে বলল, ‘ও মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে প্রিয়তমার শহর ভিজিয়ে দিয়ে আমার নামটা তার মনে খন্ডিত করে এসো!’
.
জুহি যখন ঢাকা পৌঁছাল তখন মাথার উপর তপ্ত রোদ। এমন রোদে চোখ খোলা রাখা দ্বায়। জুহি ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে ব্যাগ তুলে নিয়ে একটা রিকশা ডাকল। এখন গন্তব্যে তার বাড়ি। আজকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে আগামীকাল থেকে আগের মত ব্যস্ত জীবন শুরু করে দিতে হবে। জুহির কাছে তার এই ব্যস্ত জীবনটাই অধিক প্রিয়। ব্যস্ত থাকলে কোনো পিছুটান মনে পড়ে না, মায়া ত্যাগ করা যায় অতি সহজে; তবে সেটা ওই ব্যস্ত সময়টুকুর মধ্যেই আবদ্ধ। যখন ব্যস্ততা ঠেলে মুক্ত পাখির মত আকাশে ডানা ওড়ে, তখন আবার সেই পিছুটান আঁকড়ে ধরে। কিন্তু এইবার বাড়ি গিয়ে অদ্ভুত আনন্দ হয়েছে। মুক্তি আর অবসাদের স্বাদ বুঝতে শিখেছে জুহি। এই কারণেই পাখিরা হয়তো এতো সুখী। কারণ দিনশেষে তারা মুক্ত। মুক্তির অনাবিল স্বাদ গ্রহণ করে তারাও জীবনে বেঁচে থাকে। মুক্তি ছাড়া হয়তো জীবনের মানেটা বড়ো বেমানান। মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো প্রতিটি প্রাণীর চিরাচরিত অধিকার, তাদের জন্য বাধ্যতামূলক!
বাড়ি ফিরে এসে জুহি বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শুয়ে পড়তেই হঠাৎ মনে পড়ল বাসায় একটা ফোন করা দরকার। আলসেমি করল না, ঝটপট উঠে মামাকে ফোন করল। জানিয়ে দিল, সে ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিব।
দীর্ঘক্ষণ জার্নি করার ফলে শরীরটা নিষ্কর্মা দিয়ে গেছে। ওয়ারড্রবের সামনে থেকে বিছানা পর্যন্ত হেঁটে আসতেও বেশ বেগ পেতে হলো।
বালিশে মাথা দিতেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

রাফি আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরে এসেছে বিকেল নাগাদ। ততক্ষণে মাহিদ আর রিয়াদ মাঠে ক্রিকেট খেলা আরম্ভ করে দিয়েছে। রাফি আর তাদের সাথে যোগ দিল না। মনটা বড্ড বিষন্ন হয়ে রয়েছে। জুহি, জুহি এই নামের অদ্ভুত মেয়েটি তার দিন রাত এক করে ছেড়েছে। আজ এই বাড়িটায় থাকা কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে। যেখানে জুহি নেই সেখানে তার থাকার আদৌ কোন অর্থ আছে কি? নাহ নেই; মনের অন্তরাল থেকে এই একটা উত্তরই বেরিয়ে এলো।
রাফি কী তবে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? এটাকে আসলেই প্রেম বলে? হৃদয়ে যে ধীরে প্রশান্ত চিরন্তন বয়ে যাচ্ছে, এটা প্রেম হওয়াই তো স্বাভাবিক!
সে রাতে রাফির ঠিকঠাক ঘুম হল না। মস্তিষ্কের ভিতর শুধু একটা মানুষেরই বিচরণ চলছে। তার দেখা না মিললে যে শান্তি পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার দেখা কি মিলবে? সে কি ধরা দেবে? নাকি অস্পষ্ট হয়ে রাফির মস্তিষ্কে আজীবন বিচরণ সৃষ্টি করবে!
বড় বড় মানুষেরা আসলে ঠিক কথাই বলে, মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়লে স্বর্গও নরক হয়ে যায়। এই কথাটা এখন রাফির বেলায় খুব করে খাটছে, আসলেই তার রঙিন দিনগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
জুহি, এই নামটাই তার জীবনে সর্বনাশ হয়ে এসেছে। নাহ, সর্বনাশে না সমৃদ্ধিতে এসেছে সেই মানুষটা!
.
শুরু হয়ে গেল জুহির ব্যস্ত জীবন। সকালে একটা প্রাইভেট পড়িয়ে মাত্র এলো তার ঠিকানায়। ‘আমি নারী’ এই সংগঠনটি জুহির এক প্রকার ঠিকানায় বলা যায়। এসেই প্রথমে সবার খবর নিল, কার কী অবস্থা সে সব জেনে জাহিন ভাইয়ের রুমে উঁকি দিল। দরজায় নক করতেই তিনি তাকিয়ে জুহিকে দেখতে পেলেন। বিনয়ের সহিত এগিয়ে এলেন।
‘আরে জুহি যে? আসো আসো ভিতরে আসো! আজকে যে আসবে কই আগে তো জানাওনি?’

‘হুট করে চলে এলাম। আপনাদের কি খবর ভাই? আর প্রশিক্ষণ, এই ব্যাপারে কি কমিশনার সাহেবের সাথে কথা বলা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ কথা বলেছি। তিনি দুই একদিন সময় চেয়েছেন তার মধ্যে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিবেন।’

‘আচ্ছা।’
জুহি বেরিয়ে এলো। তামিমকে অফিসে ঢুকতে দেখে আজকের তারিখটা দেখে নিল। তারপর এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার তামীম ভাই আপনার ছুটি শেষ নাকি? এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে? বউ নিয়ে হানিমুনে যান নাই?’

তামিম বেশ বিরক্ত স্বরে বলল, ‘আরে আপা আর বইলেন না, বউ না তো মহা যন্ত্রণা! বললাম বাংলাদেশের মধ্যে থেকে আপাতত ঘুরিয়ে নিয়ে আসি, তা উনি শুনবে না ওনার ইচ্ছা উনি বিলেত যাবে। এদিকে ওর এখনো পাসপোর্ট ভিসা করা নাই। সময় লাগে না এসবে? সে সময় দিতে নারাজ।’

‘থাক ভাই, কষ্ট বিসর্জন দেন।’ হাসি চেপে বলল জুহি।

‘কেমনে দেই বলেন তো আপা? নিজে কাজ করি একটা নারী সংস্থায়। আর দেখেন না, আমার ঘরের নারীর কী অবস্থা? সহ্য হয় এসব বলেন? একদম বিনাশ করে ছাড়ছে।’

জুহি ওষ্ঠকোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘মেয়েরা যেমন বিনাশী, দিনশেষে তারাই আবার সুহাসিনী। আপনাকে ভালোবাসবে আবার শাসনও করবে। আপনি একটু মানিয়ে নিন, মেয়ে মানুষ তো! একটু ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারলে আপনার ঘরকে সে পরিপূর্ণ সংসারে রূপ দিবে!’
.
রাফি গিটারে ব্যর্থ সুর উঠাচ্ছে। আজ কেমন যেন সুর উঠছে না তবুও সে চেষ্টা চালাচ্ছে। গিটারের ছন্দে সুর তোলা এটা রাফির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এটা তাকে সুখ দেয়, অন্যরকম এক প্রশান্তির ভুবনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যখন মন খারাপ থাকে ঠিক তখন এই বাদ্যযন্ত্র তার বন্ধু হয়ে ধরা দেয়। এই বন্ধুকে নিয়ে এক আকাশ স্বপ্ন রাফির। মনটা অন্যান্য দিনের তুলনায় বড্ড বেশিই বিষন্ন। মানব মন তো! একটু বেশিই আশা করে ফেলে সবসময়। কিন্তু জুহিকে খুঁজে পাবে কোথায়? ফোন নাম্বারটাও নেওয়া হয় নাই যে ফোনে কনট্র্যাক্ট করবে। মাহিদ ভাইয়ার কাছ থেকে নেওয়া যায়, কিন্তু তিনি কি মনে করবেন এটা ভেবে বারংবার পিছিয়ে যাচ্ছে রাফি। জুহিকে নিয়ে কোন ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত মন শান্ত হবে না। আগামীকাল একবার তেজগাঁও যেতে হবে, যাইহোক না কেন যেতেই হবে। জুহির দেখা মিললে মিলুক, না মিললে না মিলুক। কিন্তু ঐ তেজগাঁও শহরের রাস্তায় তো জুহির পদধুলি কখনো না কখনো পড়ে। রাফি না হয় হৃদয়ের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে অনুভব করে নেবে জুহিকে!
.
.
.
চলবে…..