মন কারিগর পর্ব-৬+৭

0
205

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৬]
~আফিয়া আফরিন

টানা দুটো দিন কেটে গেল। রাফির মনের সুরাহা হল না। একজন মানুষকে দেখার তৃষ্ণা এতো কাতর হতে পারে তা রাফির আগে কখনোই জানা ছিলো না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল, মাহিদ ভাইয়ার কাছ থেকেই ফোন নাম্বার নিবে। উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে তখন কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে।
মাহিদের সাথে যোগাযোগ করার আগেই রাফির কাছে মাহিদের ফোন এল। রাফি অবাক হল, পাশাপাশি ভাবতে লাগল মাহিদ ভাই কেন ফোন করছে? সে কী তবে কিছু টের পেয়ে গেল? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করল, ‘হ্যালো মাহিদ ভাই কী খবর?’

‘আমার খবর রাখ। রাব্বি যে এক্সিডেন্ট করছে এই খবর শুনছিস?’ মাহিদের কণ্ঠে ব্যাপক অস্থিরতা।

‘কই না তো। কখন এক্সিডেন্ট করছে? আর এখন কোথায় আছে?’ উত্তেজিত কন্ঠে বলল রাফি।

‘সিটি হসপিটালে। আমরা ওখানেই আছি, আয় তুই। আর দেখ তো, ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত যোগাড় করতে পারিস নাকি? রক্তের প্রয়োজন অথচ রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘আচ্ছা দেখতেছি।’
জুহির কথাটা আর তোলা হল না রাফির। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে হসপিটালের দিকে ছুটল। সারাদিনে পার হয়ে গেলেও যখন রক্তের সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন মাহিদের হঠাৎ করেই মনে পড়ল জুহির কথা।
কথায় কথায় একদিন জুহি বলেছিল তার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। মাহিদ আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। তৎক্ষণাৎ ফোন করল জুহিকে। কিন্তু পরপর দুইবার রিং হওয়ার পরও জুহি ফোন তুলল না। মিনিট দশেক পর নিজেই কল ব্যাক করল। মাহিদের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে জানাল, সে আধা ঘন্টার মধ্যে আসছে।
মাহিদ রিসেপশনে আসতেই রাফি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। বলল, ‘ভাই রক্তের কোনো ব্যবস্থাই তো করতে পারলাম না। এখন কি হবে? কোথা থেকে কী করব?’

মাহিদ নির্বিকার ভাবে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে পাশে বসে পড়ল। রাফি কাঙ্খিত উত্তর না পেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল কিছু বললে না যে? এখনো উপায় কী আমাদের?’

‘চুপ করে বোস তো ভাই। অনেকক্ষণ ধরে ছোটাছুটি করছিস। এইবার বসে একটু বিশ্রাম নে।’

‘কিন্তু কিন্ত….!’
কথা শেষ না হতেই রাফির দৃষ্টি সামনের দিকে গেল আর দৃষ্টিগোচর হল জুহি। প্রথমে ব্যাপার টাকে ভ্রম মনে হলেও জুহি যত সামনে এগিয়ে আসছে ততই বাস্তব মনে হচ্ছে মুহূর্তটাকে। রাফির দৃষ্টি অনুসরণ করে মাহিদও সামনের দিকে তাকিয়ে জুহিকে দেখতে পেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লি?’

জুহি এগিয়ে এসে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ এখানেই ছিলাম তো তাই চলে এলাম। তোমার রোগী কোথায়? এখানের কাজ শেষ করে আমার আবার ফিরতে হবে।’

‘এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন? এখন কাজ আছে কোনো?’

‘বিশেষ কাজ নাই তবে বাসায় যাব তো। গিয়ে রান্নাবান্না করার ব্যাপার আছে না!’

‘হয়েছে চুপ কর। এতো পাকা গিন্নি সাজতে হবে না তোকে। এইতো সেদিন-ই চোখের সামনে হাফ প্যান্ট পড়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ালি, এখন আসছে ফর্মালিটি দেখাতে! এখানেই অপেক্ষা কর তুই, আমি ডক্টর এর সাথে কথা বলে আসছি।’
মাহিদ চলে গেলে রাফি হো হো করে হেসে উঠল। হাসির শব্দে জুহি পাশ ফিরে তাকাল। রাফিকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এখানে?’

রাফি হাসি থামিয়ে হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে দেখেন নাই? আমি তো অনেক আগে থেকেই এখানে ছিলাম। মাহিদ ভাইয়ের সাথেই তো এসেছি। আপনার চোখ কোথায় থাকে বলেন তো? আস্ত জলজ্যান্ত এই আমাকে দেখতে পারলেন না?’

‘পাগল-ছাগল আমার চোখে পড়ে না। আমি এদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।’

‘আমাকে পাগল আবার সাথে ছাগলও বললেন মিস সর্বনাশিনী! আপনার জন্য মানুষ থেকে আর কি কি…।’
মাহিদ এসে পড়ায় পুরো বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না রাফি। জুহি মাহিদের সাথে গিয়ে কিছু ডকুমেন্টস পূরণ করে আরেকবার রক্তের গ্রুপ টেস্ট করিয়ে নিল। যতক্ষণ জুহি রক্ত দিল রাফি ততক্ষণ বুকে হাত দিয়ে রিসিপশনেই দাঁড়িয়ে রইল। এত দিনের অশান্ত মনটা আজ স্থির হল। আজকে জুহির দেখা পাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার ছিল। আশা করে নাই একদম, আর জুহির এভাবে আসার ব্যাপারটা মাথায়ও আসে নাই রাফির। মাঝেসাঝে এরকম দুয়েকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটুক। এই অল্পসল্প ঘটনা মনে কী পরিমাণ আনন্দের বন্যা বয়ে দেয়, কস্মিনকালেও তা মুখে প্রকাশ করা সম্ভব না।
জুহি কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বসল। মাহিদ এক পলক এসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আবার চলে গেল। রাফি পাশে বসে বলল, ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে?’

‘উহু। আমার সমস্যার কথা আপনার না ভাবলেও চলবে।’

‘শুধু চলবে না দৌঁড়াবে। মাহিদ ভাইয়া কই?’

জুহি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘আপনি নিজে গিয়ে খুঁজে নেন তো, আমাকে জিজ্ঞেস করেন কিসের জন্য? আমি কি ভাইয়াকে কোলে নিয়ে বসে আছি? আশ্চর্য!’

‘সব সময় রাগ কি সপ্তমে চড়ে থাকে? ঠিকঠাক ভাবে হাসিমুখে কথা বলতে পারেন না? হাসতে পারেন না? আমি আপনাকে কখনো হাসতে দেখলাম না।’

‘হাসির বহুত দাম। এতো দাম দিয়ে হাসি কিনে নিজের মুখে লেপ্টে দেওয়ার মত সাধ্য আমার নাই।’ ফ্যাকাসে মুখে বলল জুহি।

রাফি বিষ্ময় নিয়ে বলল, ‘কেনো?’

‘সব কেনোর উত্তর হয় না। যাই হোক আপনি কাইন্ডলি গিয়ে একটু দেখবেন ভাইয়া কোথায়? ভাইয়াকে বলে বাড়ি ফিরে যাব।’

‘পৌঁছে দেব?’

‘নো, থ্যাংকস!’

মাহিদ এসে তাড়া দিয়ে বলল, ‘চল জুহি, পাশে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। এখন তোকে বাড়ি ফিরে গোয়েন্দাগিরি করতে হবে না।’

জুহি স্থির কণ্ঠে বলল, ‘তার দরকার হবেনা ভাইয়া। আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা। একব্যাগ রক্ত শরীর থেকে চলে গেছে তারমানে এই না যে, আমি মরে যাচ্ছি। আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন ততদিন বেঁচে আছি।’

‘এভাবে বলছিস? ভাই হিসেবে সামান্য দায়িত্বও পালন করতে দিবি না?’

‘দিব না কেন? অবশ্যই দিব। তবে তোমার বোন যে এখন বড় হয়ে গেছে এটা ভুলে গেলে চলবে? চলো, রোগীকে দেখে আসি।’
মাহিদ জুহিকে নিয়ে দুই তলায় এল। তাদের রোগী ঘুমে, তাই কথা বলার সুযোগ হল না। শুধুমাত্র দূর থেকে দেখল জুহি।
রাফি জুহিকে নিয়ে বেশ কৌতূহলবোধ করছে। মেয়েটা এতো অদ্ভুত কেন? এতো রহস্যময়ী এই মেয়েটা?

রাফি আর মাহিদ দুজন মিলেই জুহিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল। মনে মনে অবশ্য রাফি এটাই চেয়েছিল, এই সুযোগে জুহির বাড়িটা চিনে আসা হলো।
যাওয়ার পথে মাহিদ খাবার দাবার কিনে দিয়ে কড়া শাসনে বলেছে, খবরদার বাড়ি গিয়ে রান্না বান্নার ধারে কাছেও যাবি না।
জুহি মুচকি হেসে ভাইয়ের কথায় সম্মতি জানিয়েছে।
.
শিউলি ফুলের উদাস করা ঘ্রাণ, নদের তীরে কাশফুলের শুভ্র সমারোহ!
তীরের সাদা কাঁশফুল আর আকাশে সাদা মেঘের ভেলার অপরূপ মিতালি সারা দিনের ক্লাস, পরীক্ষা আর কাজের ক্লান্তি দূর করে দিল এক নিমিষেই। জুহির খুব প্রিয় কিছু জায়গা রয়েছে; যখন ক্লান্তি, অবসাদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরে তখন সে নদীর তীরে বিস্তর গগনের ছায়ায় এসে নিজ মন‌কে মেলে দেয়। এই শান্ত নদীতে কোন কুজন নেই, নেই কোনো বেদনা। এতে সে আত্নতৃপ্তি পায়। আজও ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আপন অন্তরালয়ে ফিরে চলল।

এতদিন রাফি নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু ইদানিং সে তার আপন অনুভূতি সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চিত। বিগত কয়েকদিন জুহির প্রতি তার অনুভূতিটা ভালোলাগা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অনুভূতি বদলে যাচ্ছে। ভালোলাগা অথবা মোহ থেকে সেটা ভালবাসায় পরিণত হচ্ছে, যেটা রাফি প্রতিনিয়ত হারে হারে টের পাচ্ছে। মেয়েটা দিন দিন তার হৃদয়ের অন্তরালে নিজের জায়গা খোদাই করে নিচ্ছে।
জুহির সাথে ইদানিং রাফির প্রায় দেখা হয়, আগের তুলনায় বেশ কথাবার্তাও হয়। কিন্তু জুহির সামনে পড়লে রাফির হার্টবিট বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। একটু কেমন লজ্জা লজ্জা পায়, কণ্ঠে জড়তা সৃষ্টি হয়। বারবার ঐপক্ষের দিকটা শুধু মনে হয়; সে কী করছে, কেমন আছে ইত্যাদি। রাফির মতো জুহির ভেতরেও কি এইরকম অনুভূতি হয়? হয়না বোধহয়! হবে কেন? জুহি তো আর রাফির প্রেমে পড়ে যায় নাই। জানতে ইচ্ছে করলেও এই উত্তরটা জানার কোন উপায় নেই রাফির।
ভালোবাসা আর ভালোলাগা, দুটো জিনিস নিয়ে গত কয়েকদিন থেকে বেশ গবেষণা করছে রাফি। এত গবেষণা করে শেষমেষ যেটা বের হলো সেটা হচ্ছে, “ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু ভাললাগা!”
একবার জুহিকে সাহস করে বলে দেওয়া উচিত কিন্তু রাফি সবচেয়ে বড় বাঁধাটা এখানেই পাচ্ছে। জুহি রাফির সাথে কখনো এমন ভাবে মিশে নাই, যে রাফি তাকে ভালোবাসার কথাটা বলার সুযোগ পাবে। আর রাফির এটা জানা কথা, জুহি কখনোই মানবে না। সে তার সংক্ষিপ্ত তেইশ বছরের জীবনে এই একটা বার মাত্র প্রেমে পড়ল, তাও আবার এমন মানুষের প্রেমে পড়ল যে কিনা কখনো সেই প্রেমটা মানবেই না! তাও, একবার তো বলে দেখা যেতেই পারে।
সামনে রাফির ক্যাম্পাসে একটা প্রোগ্রাম আছে। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও রয়েছে। এই ধরনের গানের অনুষ্ঠানগুলোতে, সে এখন যেখানেই হোক না কেন; রাফি নির্দ্বিধায় পা বাড়িয়ে দেয়। এইবারও দিল। ক্যাম্পাসের প্রোগ্রাম বলে কথা, অংশগ্রহণ না করলে হবে?
.
.
.
চলবে…..

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৭]
~আফিয়া আফরিন

আজকেও কাঙ্খিত ঠিকানায় পৌঁছে গেল রাফি। তবে আজকে আর উঁকি ঝুঁকি মেরে জুহিকে দেখতে হয় নাই। রাস্তায়ই দেখা পেয়ে গেছে। রাফির চেয়ে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে জুহি।
তাই রাফি একটু দোনোমোনো করছিল এই ভেবে যে, ডাক দিবে কী না! তবে খুব দ্রুত ভাবনাটা একপাশে সরিয়ে ডাক দিল, ‘এই যে মিস জুহি।’

চেনা কন্ঠ শুনে জুহি পেছনে ফিরে তাকাল। রাফি একলাফে জুহির সামনে এসে দাঁড়াল। জুহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফি বলে উঠল, ‘উহু, এখন এত রাগি স্বরে একদম কথা বলবেন না। একটু মিষ্টি করে একটু মিষ্টি স্বরে আমায় জিজ্ঞেস করেন, আমি এখানে কেন এসেছি?’

জুহি রাফির কথার ধার দিয়েও গেল না। উল্টো জিজ্ঞেস করল, ‘সমস্যা কোন জায়গায় আপনার? সেদিনের পর থেকে দেখছি আমার পিছে পিছে ঘুরছেন? অযথা তো আপনার সাথে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কই, এর আগে কখনো তো আপনাকে দেখি নাই। এইবার কারণ কী?’

রাফি মাথা চুলকে বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ওই যে আপনি আমায় পাগল বলেন না? জানেনই তো, পাগলের পাগলামির কোনো দাড়ি কমা থাকে না।’

‘তার মানে নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করে নিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ তারপর মনে মনে ফিসফিস করে বলল, ‘প্রেমে পাগল হয়ে গেছি। যার প্রেমে পাগল হয়েছি সে নিজেই পাগল উপাধি দিয়ে বসে আছে। আজব দুনিয়া!’

‘যাইহোক আপনার সাথে আজেবাজে কথা বলার সময় নাই। আমি তো সারাদিন আপনার মত বেকার ঘুরতে পারি না, আমার কাজ আছে। আসছি।’

‘আরেহ আরেহ আসছি কেন? আমি যে কথাটা আপনাকে বলতে এলাম সেটা তো বলাই হল না। সামনে রবিবার আমাদের ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম আছে, আপনার আমন্ত্রণ রইল।’

‘আপনি বলতে না এলেও আমি যেতাম। ওখানে আমার অনেক চেনা-পরিচিত মানুষ আছে, যেখান থেকে অলরেডি কতকগুলো ইনভাইট পেয়েছি।’

‘ওহ। আসছেন তাহলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা দেখা হবে।’
জুহি প্রত্যুত্তর করল না। বড় বড় পা ফেলে নিজের গন্তব্যে এগিয়ে গেল। আর রাফি, সে ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে রইল। সময়টা বোধ হয় থমকে গেছে তার। নিজের মনটা কাউকে দিয়ে দিলে, এরকম অগোছাল অনুভব হয় সেটা আগে জানলে কখনোই নিজ মন অন্য কাউকে দিয়ে দিত না। কিন্তু এখন তো দিয়ে ফেলেছে, ফিরিয়ে আনার উপায় নেই তো!
রাফি ফুটপাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা আসলেই এক জটিল অনুভূতি। না দেয় ভালো থাকতে, না দেয় কিছু প্রকাশ করতে!
এই ভালোলাগা এবং ভালোবাসার সূত্র ধরে রাফির মনে ঘটল মনস্তাত্ত্বিক কিছু পরিবর্তন। তেমন বিশেষ কিছুই না, শুধু একটু কবি কবি ভাব এল। এরপর সব কিছুই ভালো লাগতে আরম্ভ করল। মা বকা দিলে সেখানেও রাফি ৩২ টা দাঁত বের করে হিহি করে হেসে ফেলে। এই ভালোলাগা তাকে ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিল।
এইবার কবি থেকে ভাবুক মনে জাগ্রত হল সে। ভাবতে ভাবতে বুঝল, তারা দুইজন না চাইলেও এই প্রেমের সুন্দর এক সূচনা হবে কোন একদিন; কোন এক নতুন ভোরে স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে!

রবীন্দ্র সংগীত বরাবরই খুব প্রিয় রাফির। যেদিন থেকে সে গান বুঝতে শিখেছে, যেদিন থেকে প্রতিনিয়ত গান গেয়ে চলছে, সেদিন থেকেই রবীন্দ্র সংগীত তার অন্তরের অন্তস্থলে ঠাঁই নিয়েছে। কী আশ্চর্যজনক স্থিরতা প্রতিটি গানের ভিতর! অনুভব না করেও অনুভবের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাণী এবং সুরের সম্মেলন রাফিকে সবচেয়ে বেশি টানে। গানের চারিত্র্য নির্ধারণে কী অকৃত্রিম পটু ছিলেন তিনি!
এইবার ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠানেও রাফি রবীন্দ্র সংগীত গাইবে বলেই ঠিক করল।
যথারীতি সেই কাঙ্খিত দিনটা চলেই এল। রাফি ভালো গান গায়, মাঝে মাঝে বিভিন্ন কনসার্টেও অংশ নেয়, তাই লোকসমাজে সে গায়ক হিসেবে টুকটাক পরিচিত। কোথাও কোন গানের প্রোগ্রাম হলে চেনা পরিচিত কারো মাধ্যমে সেখানে রাফির ডাক পড়েই। রাফিও খুশিমনে অংশ নেয়। গায়ক হওয়ার একটা স্বপ্ন বুকের ভেতর অনেক কাল যাবত লালন করে রেখেছে, স্বপ্ন কখনো সত্যি হবে কিনা সে জানে না! কিন্তু রাফি চেষ্টা করে যাবে, যতটুকু তার পক্ষে সম্ভব ততটুকু নির্দ্বধায় করে যাবে। লোকের মুখে বেশ প্রশংসা রয়েছে তার। তাদের কাছে রাফির গান মানেই নতুন কিছু! নতুন কোন সুর বন্ধনার সাথে পরিচিত হওয়া। এই যুগে দাঁড়িয়েও সে নব্বই দশক এবং আশি দশকের গানগুলোয় অসম্ভব মাদকীয়তা বজায় রাখে।

আজ প্রোগ্রামে এসে দুটি নেত্রপলব হন্যে হয়ে জুহিকে খুঁজে যাচ্ছে। অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মাহিদের কাছ থেকে জুহির ফোন নাম্বার জোগাড় করেছে রাফি, কিন্তু কখনো ফোন দেওয়ার সাহস করতে পারে নাই। আজ শুধু মাত্র একটা বার ফোন করতে ইচ্ছে করছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, সে কি আসবে? যদি আসে তাহলে আজকের এই দিনের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। মঞ্চে ওঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাফি একমনে প্রার্থনা করে গেল, জুহি যেন আজকে আসে!
রাফির প্রার্থনা বিফলে গেল না। ক্যাম্পাসের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে ইপ্সিতা, মেয়েটা জুহির বেশ পরিচিত। তার সাথেই আজকের প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়েছে জুহি। কিন্তু রাফির নজর তখনও পর্যন্ত জুহিকে স্পর্শ করে নাই।
উপস্থিত সহস্রাধিক দর্শকের সামনে যখন ধ্বনীবর্ধক যন্ত্রে রাফির নাম ঘোষণা করা হলো তখন পর্যন্ত রাফির হুঁশ এলো না।
দর্শক সারিতে ইতিমধ্যে শোড়গোল পড়ে গেল। মঞ্চ থেকে আবারও ভেসে এলো ‘রাফায়েত মাহতাব রাফি’ নামটি। রাফি তখনো জুহির ধ্যানে বিভোর। পাশ থেকে এক বন্ধুর কনুইয়ের সংঘর্ষে তার হুঁশ ফিরল। বড় একটা শ্বাস নিয়ে মঞ্চে এগিয়ে গেল। ওইখান থেকেই তার চোখ পড়ল জুহির দিকে। শুরু হল অস্থিরতা, অনুভব করতে পারল প্রেমের সংজ্ঞা!
কিন্তু এখন অধৈর্য হলে চলবে না। গান গাইতে হবে। জুহির সাথে চোখাচোখি হল একবার, মৃদু হাসি বিনিময়ও হল।
ব্যাকগ্রাউন্ড এ মিউজিক বাজছে ধীর থেকে ত্বরান্বিত গতিতে। অকৃত্রিম মাদক নেশা রাফির কণ্ঠে!

“ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে,
আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে।।
আমারও পরানে যে গান বাজিছে,
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণও মঞ্জিরে।।
ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে,
আমার নামটি লিখো
তোমার মনেরও মন্দিরে।।
ধরিয়া রাখিয়ো
সোহাগে আদরে
আমার মুখরও পাখি
তোমার প্রাসাদও প্রাঙ্গণে!
আমার নামটি লিখো, তোমার মনেরও মন্দিরে।।
মনে করিয়া সখি, বাঁধিয়া রাখিও
আমার হাতের রাখি,
তোমার কনকও কঙ্গনে।।
আমারও লতার, একটি মুকুল ভুলিয়া তুলিয়া রেখো,
তোমার অলকও বন্ধনে।
আমার স্মরণে ওই সিন্দুরে একটি বিন্দু এঁকো
তোমার ললাটও চন্দনে!
আমারও মনেরও,
মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া
দিয়ো তোমার অঙ্গ সৌরভে!
ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে,
আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে।।”

গান শেষ হতে দেরি হল, কিন্তু দর্শকমন্ডল হতে করতালির আওয়াজ ভেসে আসতে এক সেকেন্ড দেরিও হল না। রাফি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে তাদের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। এইতো স্বপ্ন, এইটুকু নিয়েও তো সারাজীবন পার করা যায়!

জুহি প্রথম যেদিন তাদের বাড়ির ছাদে রাফির গান শুনেছিল সেদিনই মুগ্ধ হয়েছিল। আজ আরেকদফা মুগ্ধতার সৃষ্টি হল। কিছু জিনিস সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত, রাফির গানের গলাটাও এমনই। আর এতো আবেগ মাধুর্য মিশিয়ে গান করে যে, যেকোনো নিষ্প্রাণ গানেও প্রাণ ফিরে আসবে! ঠিকঠাক ভাবে গান চালিয়ে গেলে জীবনে অনেক নাম করতে পারবে।

জুহি ইপ্সিতার সাথে বসে গল্প করছিল, ঐ সময় রাফির আগমন ঘটে। জুহির সাথে কথা বলতে আসছিল কিন্তু ইপ্সিতাকে দেখে নাকমুখ কুঁচকাল। ম্যাডামের সাথে পাঁচ ছয় দিন পর দেখা হল, একটু কথা না বললে কি চলে?
রাফিকে দেখে জুহি নিজেই এগিয়ে এলো। বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘গান তো ভালোই গাইলেন তবে যখন আপনাকে মঞ্চে ডাকা হচ্ছিল তখন অন্যমনস্ক হয়েছিলেন কেন?’

রাফি মাথা নিচু করে ওষ্ঠ্যদ্বয়ে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। তারপর ধীরকণ্ঠে বলল, ‘ঐ আর কী, একজনের অপেক্ষায় ছিলাম!’

‘ওহ।’

‘জি ম্যাডাম, আপনার শরীর ভালো আছে?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ। আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে?’

‘ভালোই।’
রাফি আর কিছু বলার আগেই তার ডাক পড়ল। জুহির মন মেজাজ আজকে ভালো আছে মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করলে বেশ খানিকক্ষণ কথা বলা যেত। কিন্তু এমন সময় রাফির ডাক পড়ল, উফফফ বিরক্তিকর! রাফি জুহির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সামনে এগোল।

আজকের প্রোগ্রামে একজন মিউজিক ডিরেক্টর উপস্থিত ছিলেন। তিনি শর্ট ফিল্ম এবং পাশাপাশি নাটকেরও পরিচালনা করেন। তিনি রাফির গান শুনে খুব পছন্দ করেছেন এবং রাফিকে অফার করেছে তার একটা নাটকের জন্য গান গাইতে হবে। রাফির কর্ণকুহরে কথাটা পৌঁছানো মাত্রই কেমন অবিশ্বাস্য ভ্রম হলো। এই একটা মুহূর্তের জন্য সে যে কত কাল অপেক্ষা করেছে, সেটা একমাত্র রাফি আর আল্লাহ-ই ভালো জানে। এই অফারটা পেয়ে সে ভালো মন্দ কোন কিছুর কথা আর এক মুহূর্তও কিছু ভাবল না, সাথে সাথে হ্যাঁ বলে দিল। তারা রাফির ফোন নাম্বার সহ আরো বিভিন্ন ইনফর্মেশন সংগ্রহ করে নিল, সময় মত যোগাযোগ করবে।
রাফি হল রুম থেকে এক ছুটে বাহিরে বের হয়ে এল। সেইখানটায় এসে দাঁড়াল যেখানে জুহি ছিল। কিন্তু জুহিকে এই মুহূর্তে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এইটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় চলে গেল মেয়েটা? নাকি সময়টা একটু বেশিই গড়িয়েছে?
রাফি তৎক্ষণাৎ ফোন করল মাকে। জীবনের সবচেয়ে আনন্দের এই খবরটা তো মাকে দিতে হবে! মায়ের সাথে কথা বলা শেষে আবার জুহিকে খুঁজতে উদ্যত হলো। নাহ, কোথাও পাওয়া গেল না। চলে গেল নাকি মেয়েটা? কোমড়ে দু’হাতে গুঁজে অস্থির ভঙ্গিতে পাইচারি করল কিছুক্ষণ।
.
.
.
চলবে….

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]