মন গহীনের গল্প পর্ব-২০+২১+২২

0
594

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২০
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে। নির্জনের জন্যই ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে ঘুমানো হয় না রিশাদের। মেহউইশেরও অভ্যাস হয়ে গেছে এখন এমন মৃদু আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর। কোমরে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে মেহউইশ সামনে তাকায়। রিশাদ, নির্জন দুজনেই গভীর ঘুমে। নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো আজ তারা তিনজনই একই কম্বলের নিচে। একটুখানি কম্বল উঠিয়েই বুঝতে পারলো ঘুমের ঘোরেই রিশাদ হাত তার গায়ে ফেলেছে। ভেবে পায় না সে এই মধ্যরাতেও কম্বলের নিচে লোকটার হাত এত ঠান্ডা কেন! যা তার জামার উপর দিয়েই অনুভব হচ্ছে । গায়ের উপর লোকটা হাত জেনেই অস্বস্তি হচ্ছে৷ তাই নিজেই কম্বলের তলা দিয়ে রিশাদের হাত সরিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ একনাগাড়ে চেয়ে রইলো ঘুমন্ত রিশাদের মুখে। হালাল বিয়ের নাকি অসীম শক্তি অপরিচিত দুটো মানুষকে একসাথে আজীবন বেঁধে রাখার৷ কিন্তু এই লোকটা যেভাবে বিয়ে করেছে সেটাকে কি হালাল বিয়ে বলে!

সকালে আজ কারোই তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙলো গেইটের দারোয়ানের ডাকে।রেহনুমাই প্রথমে বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে তারপর রিশাদ। মেহউইশ কিংবা রাইমা দুজনের কেউই ঘুম থেকে উঠেনি। রিশাদ ঘর ছেড়ে করিডোরে আসতে আসতে রেহনুমা বাইরেই এসে দাঁড়িয়েছে৷ দারোয়ানকে ডাকার কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই চোখে পড়লো গেইটের সামনে দাঁড়ানো জেবুন্নেসাকে। গোলাপি রঙের একটা সিল্ক শাড়ি পরনে, এক হাতে তার ফোন অন্য হাতে সানগ্লাস । মুখের ভাবে মনে হচ্ছে শীতের সকাল তার গায়ে নিজের তীব্রতার বাহাদুরি একদমই করতে পারেনি।কাচরঙা রোদ্দুরে জেবুন্নেসাকে এই মধ্যবয়সেও তরুণীর মত প্রখর সৌন্দর্যে ঝলসানো সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে রেহনুমার৷ যেই সৌন্দর্য বুকের ভেতর খচ্ করে কাঁটার মত বিঁধছে। নিজেও সে কম সুন্দরী নয় বরং রুপ তো জেবুন্নেসার চেয়ে তারই বেশি। কিন্তু তাতে কি আসে যায় যেই সৌন্দর্য তার মনপুরুষকে তার প্রতি আকর্ষিতই না করে! জেবুন্নেসাকে দেখতেই রেহনুমার দুনিয়ায় সব থমকে গিয়ে অতীতের একজনকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে । চোখ দুটো ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। শরীরটাও টলছে কি! রিশাদ এগিয়ে গেইটের কাছে যেতেই জেবু এসে তাকে জাপটে ধরলো। চোখে তার পানির ঢল সেই সাথে গলা কাঁপছে । কাঁপা কাঁপা স্বরে কত কি বলেও চলছে৷ রিশাদ প্রথমে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও পরে ধীরে ধীরে হাত উঠিয়ে জেবুন্নেসাকে জড়িয়ে ধরলো৷ কত বছর! ঠিক কত বছর পর তা মনে নেই রিশাদের শুধু মনে হচ্ছে বহুবছর পর সে খালাকে এত কাছে পেয়েছে। মা মা গন্ধটা যেন আজই তার নাকে লাগলো প্রথমবার। মায়ের স্মৃতি ঠিকঠাক কিছুই মনে আসে না তার কিন্তু খালার আদর এখনও মনে আছে। ঠিক সেইদিন পর্যন্ত খালার আদর পেয়েছে যেদিন খালা শুধু খালা ছিলো। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার পরই খালা বদলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে জেবুন্নেসার তা দেখে রেহনুমা রিশাদকে ডেকে বলল, ‘ঘরে নিয়ে আয় রিশাদ।’ কথাটা জেবুন্নেসার কানেও গেছে সে রিশাদকে গালে,মুখে হাত বুলিয়ে কত কি বলতে লাগলেন তার মধ্যে রিশাদ শুধু নির্জনের নামটাই বুঝলো।জেবুন্নেসাকে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলে রেহনুমা এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিলো রিশাদের হাতে। রিশাদ পানিটুকু খেতে ইশারা করে জেবুন্নেসাকে ডাইনিংয়ের একটা চেয়ার এনে বসতে দিলো। রাইমা ততক্ষণে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে।মাকে দেখে চমকপ্রদ মুখ করে রিশাদের দিকে তাকালো। রিশাদ ইশারা করলো যার অর্থ সে কিছুই জানে না জেবুন্নেসার আগমন সম্পর্কে। জেবুন্নেসা নিজেই দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অত ইশারা ইঙ্গিত করার কিছুই নেই৷ কাল থেকে তোদের কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারিনি বলে হোটেলের ম্যানেজারকে বলে গাড়ি ব্যবস্থা করে চলে এসেছি। আমার উপস্থিতিতে কি কারো কোন প্রকার সমস্যা আছে?’ শেষে করা প্রশ্নটা বোধহয় জেবুন্নেসা না চাইতেও রেহনুমাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে। রেহনুমাও যেন জানতো এমন কোন প্রশ্ন তাকে শুনতে হবে তাই সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলো।

‘কোন সমস্যাকেই সমস্যা বলে ভাবার মত উপলব্ধি আল্লাহ আমাকে এ জনমে কখনো দেয়নি আর দেবেন বলেও মনে করি না।’

রিশাদ তেমন কিছু মনে না করলেও রাইমা অবাকের চরমে পৌঁছে গেছে। মা আর ফুপুর এই কথাবার্তা তার কাছে কোন তর্ক বিতর্ক শো বলে মনে হচ্ছে। মেহউইশ আধখোলা চোখে নির্জনকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে মাত্রই। তার হয়তো ঘুমটা এখনো পূর্ণ হয়নি শুধুমাত্র নির্জন উঠে শব্দ করেছে বলেই তাকে নিয়ে বিছানা ছেড়েছে। রিশাদ খেয়াল করলো সে এলোমেলো পা ফেলে হাটছে আর তার খেয়ালও নেই করিডোরে কেউ আছে কিনা!

‘আমার দাদুভাই উঠে গেছে?’ চেয়ার ছেড়ে জেবুন্নেসা হাত বাড়ালেন নির্জনের দিকে। মেহউইশ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই নির্জনকে তার কোল থেকে নিয়ে নিয়েছে জেবুন্নেসা।এমন আকষ্মিক আচরণে হতভম্ব মেহউইশের ঘুম আপনাআপনি উবে গেছে। সে জেবুন্নেসাকে খেয়াল করতেই সালাম দিলো। সালামের জবাব নিলো কি নিলো না তা বোঝা গেল না। রিশাদের মনে হলো আপাতত বলার মত কোন কথা বাকি নেই তাদের তাই সে ঘরে গেল এবং যেতেই জোরে ডাকলো, ‘মেবিশ।’

সকাল সকাল একেকজনের আচরণে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠছে মেহউইশের কিন্তু তা প্রকাশ করার সুযোগটাও যেন নেই তার৷ রোদ ঝলমলে সকালে নির্জনকে নিয়ে উঠোনের শেষে চলে গেল জেবুন্নেসা। এখান থেকে যে পাহাড়টা সামনে আছে সেটা খুব উঁচু । রিশাদের এই বাড়ির চেয়েও শ’খানেক ফুট উঁচু হবে হয়তো। কিন্তু দক্ষিণ দিকটা ভয়ংকর খাঁদ । বাড়িটা এত পিছিয়ে কেন করেছে? যদি কোন বিপদ হয়! গায়ের লোম শিউরে উঠেছে জেবুন্নেসার। এসব কি ভাবছে সে, আর কেন? এই বাড়িতে রেহনুমা থাকে বলে! স্নেহমাখা পরশে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছে সে নির্জনকে৷ সব অতীত আজই কেন কুঁড়ে কুঁড়ে তাজা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে ভেবে পায় না সে৷ কি দরকার পুরনো স্মৃতিদের আজ আবার জ্বালাতন করার, নতুন করে ঘা গুলোকে তাজা করার! বেশতো কাটলো একুশ বছর৷

সকালের নাস্তা তৈরি হতে দেরি আর আজ এমনিতেই দেরি হওয়ায় নাস্তা না করেই চলে গেল রিশাদ। ফোন চালু করতেই দেখলো হোটেলের ম্যানেজার অনেকবার ফোন করেছিলো। আজ সে এতোটাই ঘুমে বিভোর ছিলো যার ফলে ফোনকল কান পর্যন্ত আসেনি৷ আবার কোন এক ফাঁকে ফোনটা চার্জের অভাবে বন্ধও হয়ে গিয়েছিলো। রিশাদ চলে যেতেই মেহউইশের মনে হলো আজ লোকটা কিছু ভুলে গেছে৷ কি ভুলে গেছে তা বুঝতে পারছে না। তবে জরুরি কিছু ভুলেছে বলেও মনে হচ্ছে না। একসময় জীবনে বেঁচে থাকার প্রতি যে আসক্তি ছিলো সেই আসক্তিতে লুকিয়ে থাকা যে বিতৃষ্ণা জমা আছে তা যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে মেহউইশের জীবন থেকে। এ জীবনে সে কিংবা তার আশেপাশের মানুষ যাই ভুলে যাক তাতে এতো ভাবনার কি হলো বুঝে পায় না সে! তবুও ভাবনা আসছেই কি ভুলে গেল আজ লোকটা! নাস্তার টেবিলে মুখোমুখি চার নারী৷ সেখানে দুজন নারী, দুজন মধ্য বয়স্ক নারী তাদের আচরণে লুকোচুরি প্রকাশ করছে না চাইতেও। রাইমা কতটুকু খেয়াল করলো কে জানে! মেহউইশ খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে ওই দুজন মধ্যবয়স্ক নারীর মধ্যে একজনের কথাবার্তায় ক্ষোভ,অহংকার এবং চিমটিখানিক তিরস্কারও মিশ্রিত ছিলো৷ আর দ্বিতীয় নারীটি বেশ অসহায়তা লুকিয়ে নিজেকে প্রচণ্ডরকম সুখী আর স্বাভাবিক দেখাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। নাস্তার পরপরই আবার জেবুন্নেসা নির্জনকে নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। রাইমা জেদ ধরে বসেছিলো সে পাহাড় ঘুরে ঘুরে দেখবে আর তার সঙ্গী হতে হবে মেহউইশকে। কিন্তু রেহনুমা তাদের একা ছাড়ার সাহস পাচ্ছে না আবার রিশাদকে না জানিয়েও অনুমতি দিতে ভয় পাচ্ছে। ফোন কয়েকবার রিশাদকে কল করেও নেটওয়ার্ক সমস্যায় কথা বলা গেল না। রাইমা জেদ ধরে বসে আছে। প্রথমবার ফুপুর কাছে আবদার করে তা পূরন হবে না ভাবতেই রেহনুমার মন খারাপ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উপায় ভেবে আনতুংকে সঙ্গে পাঠালো তাদের। বাড়ি থেকে বের হতেই আনতুং আরো কয়েকজন তার পরিচিত মেয়েকেও জুটিয়ে নিলো। একদল মেয়ে বেরিয়ে পড়লো পাহাড় ভ্রমণে। মেহউইশ আর রাইমা দুজনেই চরম উত্তেজিত এই হঠাৎ বের হওয়া ভ্রমণে। পাহাড়,সবুজবীথি, জানা অজানা হাজারো জংলী ফুল, পাখি, ফল আরো কত কি এই পাহাড়ের গায়ে। এত এত সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে মেহউইশের খুব করে মনে পড়ছে হাসপাতালের বাগানে বসে ইভানের সাথো বোনা কিছু স্বপ্ন। এই স্বপ্ন যখন মেহউইশের দৃষ্টি ঘোলাটে করে কিছুটা সময় পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই সে তার গ্রীবাদেশে কারো আলতো স্পর্শ পেল। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বুনোফুলের লতায় দুলে দুলে যাচ্ছে মাতাল হাওয়া। এ স্পর্শ মেহউইশের খুব চেনা,খুব আপন।

চলবে।

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২১
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

ঘাড়ে পাওয়া শীতল স্পর্শটা প্রথমে চেনা মনে হলেও স্মৃতির ঘোর কাটতেই বোঝা গেল এ স্পর্শ অচেনা। এক রাতের জবরদস্তির স্পর্শ যা মনে থাকার কথা না। এই মানুষের স্পর্শ সে মনে রাখতেও চায় না। পাহাড়ে ঘুরতে বের হওয়ায় মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো মেহউইশের। চারপাশে জংলী পোকার ঝি ঝি স্বর গাছের পাতায় বাতাসের ঝিরিঝিরি কাঁপন আর দূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের গর্জন । সব মিলিয়ে অর্ধমাসে জীবনের ঘটে যাওয়া দুঃসময় ভুলে তার হঠাৎ সুখানুভব হচ্ছিলো। কিন্তু রিশাদের এই স্পর্শ আর ডাকে নিমেষেই সব হারিয়ে গেল। এই পাহাড়ের জঙ্গলে এসেও স্বস্তি নেই দানবের জন্য পেছন পেছন ঠিক এখানেও এসে হাজির।

‘জঙ্গলে আসতে ভয় লাগেনি তোমাদের?’ রিশাদ যথেষ্ট কোমল সুরে জিজ্ঞেস করলো। মেহউইশের মনে মনে কয়েকরকম জবাব তৈরি থাকলেও মুখে বলার সাহস তার হলো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায় অন্যদিকে রাইমা বাকিদের সাথে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। মনে তিক্ততার পর্যায় অনেক বেশি মেহউইশের। লোকটা সত্যিই অসভ্য নয়তো কাউকে এভাবে স্পর্শ করা রুচিতে বাঁধলো না কেন। হোক তারা কথিত স্বামী স্ত্রী কিন্তু তাদের তো কোন স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। মেহউইশের মুখ দেখে আর নিরুত্তর থাকা দেখেই বুঝলো মেয়েটা জবাব দিবে না তাই সেও আর জবাবের অপেক্ষা করলো না। আলতো করে একটা হাত ধরে সামনে আগাতে থাকলো আর মেহউইশও চুপচাপও আগালো। হোটেলে আজ যাওয়ার পরই রিশাদের মনে হলো খালা আর ফুপু বাসায় একসাথে থাকবে। কোন প্রকার ঝামেলা না তৈরি হয়ে যায় তাদের মধ্যে ভাবতেই রিশাদের আর কাজে মন বসলো না। আজ একাউন্টস আর স্টাফদের বিল চেকও উইথড্র করার কথা ছিলো। কিন্তু কি করে করবে এত কাজ সারাদিন সময়ের ব্যপার। তারওপর বাড়িতে কোন প্রকার অঘটনের লেশমাত্র চাচ্ছে না সে। বাধ্য হয়েই ম্যানেজারকে কিছু কাজ বুঝিয়ে টাকার ব্যাপারটা আনক্লিয়ার রেখেই বেরিয়ে এসেছে সে। কক্সবাজার থেকে বাড়িতে আসতে তার ঘন্টার বেশি সময় লাগে। এখানে সমতল রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় আসতেই মনে পড়লো ফুপু কাল বাজার করানো নিয়ে আফসোস করছিলো সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায়। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে এপাশে বাজারে এসে আন্দাজ মত মাংস আর কিছু মশলাদি কিনেছে সে৷ ঘরে কি লাগবে বা লাগতে পারে সঠিক জানা নেই তার তবুও নিজের বুঝ মতোই অনেক বাজার করেছে। ফেরার পথেই পাহাড়ের উপর দিকে পায়ে চলা রাস্তায় চোখ আটকায় তার। ড্রাইভিং বন্ধ রেখে গাড়ি থেকে বের হয়ে লক্ষ্য করে যা দেখছে তা চোখের ভুল কিনা! পরক্ষণেই কনফার্ম হয় ভুল দেখেনি সামনে রাইমা আর কিছু পাহাড়ি মেয়ে আর সবার পেছনের মেয়েটি মেহউইশ৷ ট্রেকিং করে বহু পাহাড় ঘুরে বেরিয়েছে রিশাদ ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়েই তাই এইটুকু পাহাড় বেয়ে উঠতে মোটেই সময় লাগেনি। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো রিশাদ উপরে আসতে আসতে পাতার শব্দ, পায়ের শব্দ কত শব্দই হলো অথচ মেহউইশ এক ধ্যানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো যেন কোন কিছুই তার কানে পৌঁছায়নি। মেহউইশের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে তার খোঁপা করা চুলের নিচের অংশে চোখ যেতেই রিশাদের ঘোর লাগে। মন কেমন করে আবার মনের মাঝে হঠাৎ একটু দুষ্টুমিও চড়ে বসে তাই অতকিছু না ভেবেই আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মেহউইশের ঘাড়। আর সকল দুষ্টুমি তার পালিয়ে যায় মেহউইশের ফিরে তাকানো দৃষ্টি দেখে। মুখে রা না থাকলেও দৃষ্টিতে ছিলো অজস্র ধারমাখা ক্ষোভ।নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলো রিশাদ সেই দৃষ্টিতে আর সেই অস্বাভাবিকতা লুকাতেই বুঝি প্রশ্ন করেছিলো, ‘জঙ্গলে আসতে ভয় লাগেনি তোমাদের? ‘

মেহউইশকে নিজেদের মাঝে না দেখে রাইমা থেমে যায়।

‘মেহউইশ কোথায়? ইয়ে মানে ভাবী কোথায় আনতুং?’

রাইমার কথায় আনতুংও থেমে পেছনে তাকায়। নেই তাদের সাথে মেহউইশ আর তা দেখে কিছুটা ভীত হয় আনতুং। রাইমা ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ সে কি পালিয়ে গেল!’

‘কি বলেন? কই যাইবো!’ আনতুং অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো । রাইমার ভয় হচ্ছে সুযোগ পেয়ে মেহউইশ পালিয়ে গেল নাতো! দাদাভাই তো তাহলে তুলকালাম করে ফেলবে বাড়িতে৷ ভয় নিয়েই কাঁপা কাঁপা গলায় জোরে চিৎকার করে ডাকলো রাইমা, ‘ভাবী! মেহউইশ’ পরপর দু বার ডাকতেই জবাব এলো।

‘নিচে আয় রাইমা। আমরা নিচে আছি। ‘

‘দাদাভাইয়ের গলা না আনতুং?’

আনতুংও খেয়াল করেছে জবাবটা রিশাদ দিয়েছে। আবার তড়িঘড়ি নিচে নেমে এলো রাইমা আর বাকিরা। উপর থেকে ঝোপের পথ পেরিয়ে নিচের পথে আসতেই দেখলো গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিশাদ তার পাশেই মেহউইশ।

‘দাদাভাই, তুমি এই পথে কি করে? হাইওয়েতে তো ওদিক থেকে যেতে হয়। ‘ কৌতূহলী হয়ে রাইমা জানতে চাইলো।

‘ এ পথে বাজার আছে পাহাড়ি। মাছ,মাংস পাওয়া যায় ভালো তাই এসেছিলাম৷ আর তোকে কে বলল হাইওয়েতে শুধু ওদিক থেকেই যায়। এই পথেও চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে যাওয়ার পথ আছে।আর তোরা এই অসময়ে ঘুরতে বেরিয়েছিস কেন? বারোটার বেশি বাজে এত প্রখর রোদে কেমন করে ঘুরবি?’ কথাটা বলেই রিশাদ আঁড়চোখে মেহউইশের দিকে তাকালো। ফর্সা ঘর্মাক্ত মুখ হালকা গোলাপিবর্ণ ধারণ করে আছে। রোদ সয় না আবার রোদে ঘুরতে বেরিয়েছে! অতঃপর রিশাদের গাড়ি করেই মেহউইশ, রাইমা আর আনতুং বাড়ি ফিরলে। বাকিরাও কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় চলে গেল নিজেদের মত করে।

রিহান ঢাকায় একদম একা আছে বাড়িতে। ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটা মহলের মত বিশাল বাড়িটাতে সম্পূর্ণ একা। কাজের লোকগুলো নিয়ম করে তিনবেলা খাওয়ার খেয়ালটাই রাখছে তার এর বেশি কেউ কিছুই দেখছে না। মা বাবার সম্পর্ক সে আগে তেমন একটা বুঝতে না পারলেও ইদানীং তার বুঝে আসছে। দুজনের মধ্যে কিছু একটা আছে সে এবার খুব করে টের পেয়েছে। মায়ের ঘর আলাদা, বাবার ঘর আলাদা । বাবা দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেছে অথচ বাড়িতে ছিলো মাত্র দুদিন৷ আর সেই দু দিনের একদিন ছিলো রাইমা আপির জন্মদিন বলে হয়তো দেশে আসার কারণটাও আপির জন্মদিনই ছিলো। এছাড়া বাবা কখনো তার কিংবা দাদাভাইয়ের জন্মদিনে কাজ ফেলে আসেনি আর না হাসিমুখে দুটো কথা বলেছে। বাবা সর্বদাই স্পেশাল আর খুব দামী কোন গিফট দেওয়া ছাড়া জন্মদিনের উইশ কি জানেইনা বোধহয় তাদের ক্ষেত্রে । এবারে আপির ইচ্ছে ছিলো সে সারাদিন বাবার সাথে ঘুরবে, নুহাশপল্লীতে যাবে। আর তাই তারা বাবা মেয়ে সেই কাজটাই করেছে। দ্বিতীয় দিন সে দেখেছিলো বাবা বাড়িতে এসে মায়ের সাথে বন্ধ দরজা কোন বৈঠক করেছে এবং তারপরই মা তার লাগেজ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। তারপর আজ দুদিন হলো রাইমা আপিও চলে গেছে কক্সবাজারে। রিহান একা এইটুকুনি বয়সেই। মাঝেমধ্যে হিংসা হয় খুব তার আপিকে নিয়ে। বাবা ভালোবাসে আপিকে খুব, দাদাভাইও আপিকেই ভালোবাসে। আপির উপর রাগ করলেও আদর বেশি আপিকেই করে সবাই । তার কথা কারো মনেই আসে না। মন খারাপ হলো তার , চোখ ঘোলাটে হলো।কেউ নেই তার কারো খেয়াল নেই তার প্রতি মা দাদাভাইকে হাজারটা কটুকথা শোনালেও মনে মনে দাদাভাইয়ের কথা ভেবেই আফসোস করে। সে চলে যাবে এই দেশ ছেড়ে আর আসবে না। দূরে কোথাও একা একা থাকবে সে এখনও তো পাশে কেউ নেই। মনের কোণে অভিমানের পাহাড় সৃষ্টি হয়ে গেছে তার শূন্য ঘরে নিজেকে পেয়ে।

গমগমে রোদ্দুরে সবুজ পাতায় চকচকে রঙ৷ বাহারি রঙের প্রজাপতিরা ওড়াউড়ি করছে ফুলে ফুলে। কিছু ফুল আজ রান্নাঘরের সামনের করিডোরে রাখা ডাইনিং টেবিলে সজ্জিত। এই বুনো ফুলগুলো এতোটাই সুগন্ধি যে পাহাড়ে থাকা অজস্র প্রজাপতি উড়তে উড়তে এখানেই চলে এসেছে। রেহনুমা বাড়ির পাশেই কোন গাছ থেকে তুলে এনে সাজিয়েছে এগুলো। মেহউইশ রান্নাঘর থেকে তরকারির বাটিগুলো আনতে আনতে প্রজাপতিদের খেলাও দেখছে মুগ্ধ হয়ে। এই মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে সে খেয়ালই করেনি তরকারির বাটি টেবিলে না রেখে চেয়ারে বসা রিশাদের হাতে দিয়েই চলে গেছে। রেহনুমা মাত্রই গিয়েছে রান্নাঘর থেকে আর যেতে যেতে বলে গেছে খাবারগুলো টেবিলে এনে রাখতে। সে কাজ পেয়ে খুশি হয়েই করছিলো কিন্তু এই রংবাহারি প্রজাপতি তার মনকে এলোমেলো করে দিলো আরো একবার। সকালে যে ভুলটা করেছিলো আবারও তাই করছে। রিশাদকে ইভান ভেবেই যেন সে একের পর এক বাটি এনে তার হাতে দিচ্ছে । আর রিশাদও চুপচাপ প্রতিটা বাটি নিয়ে টেবিলে রাখছে। সর্বশেষ ভাতের বোলটা এনে রাখতেই রিশাদ তার হাতটা ধরলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবার এবং খুবই মোহমত্ততায় মেতে কোমল স্পর্শে মেহউইশের গাল ছুঁলো। এতেই যেন বিভোরতা কেটে হুঁশ এলো মেহউইশের। কি করছে সে! ইভানকে ভুলে যাওয়া দরকার! নাকি এখান থেকে পালানো? তার মনপ্রাণ একনিষ্ঠভাবে ইভানেই আটকে আছে এখনো। তার চোখ রিশাদের মাঝেও ইভানকে খুঁজে পায় কেন! রিশাদ লক্ষ্য করেছে মেহউইশের আদলখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে আচানক। মেহউইশের গালটাতে নিজের হাত বড্ড বেমানান লাগলো তার তাই নিজেই আবার সরিয়ে নিলো। কি হয়েছে তার! এত কেন নরম হয়ে যাচ্ছে মেহউইশের প্রতি? ভালো সে নীলিমাকেই তো ঠিকঠাক বাসতে পারেনি এখন কি আবার মেহউইশের মোহে আটকাবে? নীলিমাকে শুধু বিয়ে করতে হয়েছে বলেই যথেষ্ট সম্মান দিয়ে নিজের করতে চেয়েছিলো। সন্তানের মা হিসেবে আপন ভাবতে চেয়েছিলো। সকল সম্মান সকল আদর উপেক্ষা করেই তে চলে গেল মেয়েটা। আর এই মেয়েকে তো জোর করেই অর্ধাঙ্গিনী করেছে এই মেয়েও আর সম্মান পেলেইবা থাকবে কেন! নিজের নরম হতে থাকা ব্যক্তিত্বকে কঠিনই রাখতে হবে ধরে নিলো রিশাদ। ডাইনিং ছেড়ে হুট করেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। কিছু সময় চাই তার। কিছু ভুল আছে শুধরে নেওয়ার কিছু কাজ বাকি নিজেকে মুক্তি দেওয়ার। কিছু প্রয়োজন আছে সন্তানের খুশি নতুন করে গুছিয়ে নেওয়ার।

চলবে

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২২
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

সন্ধ্যের মুখে শীত জড়িয়ে পাহাড় যখন কুয়াশায় লুকিয়ে গেল তখনই রিশাদ বাড়ির কোর্টইয়ার্ডে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাইমা বেছে বেছে বড় বড় কাঠগুলো রেহনুমার দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে এনে জড়ো করছে রিশাদের সামনে। শীত এখানে এত বেশি হবে তা বুঝতে পারেনি জেবুন্নেসা। কক্সবাজারে এতোটাও কাঁপুনি লাগেনি তার এখানে এসে শারীরিক অবস্থা করুণ। রেহনুমা ঘরে ঢুকেই জেবুন্নেসাকে ওরকম কাঁপতে দেখে চুপচাপ নিজের আলমারি থেকে ভারী একটা উলের সুয়েটার আর মোজা বের করে দিলো হাত আর পায়ের। জেবুন্নেসা প্রথমে সেদিকে ফিরেও তাকায়নি আর রেহনুমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ঝটপট সুয়েটার গায়ে দিলো সে। না চাইতেও মনে মনে ধন্যবাদ বলে দিলো আনমনেই। এই শীতের সন্ধ্যায় সবাই বাইরে বসে বার বি কিউ খাবে আয়োজন করেছে। জেবুন্নেসা মনটা ভালো লাগছে না একদমই। এখন দুজনকে কাছে পেয়ে স্বস্তি লাগলেও রিহানের জন্য খারাপ লাগছে। ছেলেটা একা বাড়িতে আছে তার বাবা বাড়িতে এসেছেই কিনা কে জানে! ছেলেটা বার বি কিউ পার্টি খুব পছন্দ করে আর এজন্যই হয়তো কষ্টটা বেশি লাগছে তার। ছোট ছেলেটাকে রেখে এসব তার গলা দিয়ে নামবে না। রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো মেয়েটা লেজের মত পিছন পিছন সেখানেও চলে গেছে কাল আবার আঠার মত এখানেও চলে এসেছে। রিহানটা কেন এলো না? সেও তো দেখেছে মা রাগ করে চলে যাচ্ছে জেদ ধরে সেও আসতো! চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ঘরে বসে।

মেহউইশ নির্জনকে আজ প্রতিদিনকার চেয়ে দ্বিগুন কাপড়ে মুড়ে নিচ্ছে। মুখটা ছাড়া তার একটা নখও দেখার উপায় নেই। রিশাদ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বলো গেছে নির্জনকে যেন একদম প্যাকেটমোড়া করে নেওয়া হয়। বাইরের ঠান্ডা লেগে তার যেন জ্বর,ঠান্ডা না লাগে কিছুতেই। মেহউইশও নিজের বুঝমত তৈরি করলো বাচ্চাটাকে। হিম শীতল পরিবেশে নিজেরও কাপড়ে মুড়িয়ে যেতে হবে ভেবেই কাপড় খুঁজছে সে।এদিক ওদিক খুঁজে যে কাপড় চোখে পড়লো তাতে কোনটা এখন পড়া ঠিক হবে বুঝতে না পেরে বিছানায় বসলো। রাইমা ড্রেসের ওপর মোটা একটা লং স্লিভ গেন্জি পরেছে আবার তার ওপর হুডি। হাত মোজা,পা মোজা সবই পরেছে৷ মধ্যবয়স্ক শ্বাশুড়ি দুজনও কি চমৎকার সব সুয়েটার পরেছে৷ সে কি পরলে ভালো লাগবে বুঝতেই পারছে না। এখানে এতো শীত না পড়লেই হতো! নির্জনকে মোটা মোটা গরম কাপড়ে আবৃত করায় ছেলেটাকে ভালোই বড় লাগছে দেখতে৷ মেহউইশ নিজে তৈরি হওয়া বাদ দিয়ে নির্জনের হাতের মোজা খুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে খেলছে। কখনও আঙ্গুলে চুমু খাচ্ছে কখনওবা নিজের গালে তার আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে।মেহউইশ এখনও নির্জনকে নিয়ে বের হচ্ছে না বলেই রেহনুমা বলল, ‘রিশাদ দেখে আয় তো মেহউইশ এখনও আসছে না কেন?’

রাইমা বসা থেকে উঠতেই যাচ্ছিলো কি রেহনুমা তার হাত টেনে ইশারা করলো, সে চাইছে রিশাদই যাক। রিশাদই উঠে ঘরে গেল আর যেতেই দেখলো মেহউইশ খিলখিলিয়ে আসছে নির্জনের আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে৷মন ভালো করার মত এক দৃশ্য যা রিশাদের শূন্য হৃদয়ের মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মত লাগছে। হাসি মুখে মেহউইশ নির্জনকে আদর করছে। রিশাদের উপস্থিতি টের পেয়েই পেছনে ফিরে একপলক দেখলো সে। রিশাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে, ঠোঁটের কোণে তার এক চিলতে হাসিও ফুটে উঠেছে।

‘তোমরা এখনও বাইরে এলে না?’ বলতে বলতেই রিশাদ খাটের কাছে এগিয়ে এলো। মেহউইশ বসা থেকে উঠে সরে যাচ্ছিলো তার আগেই রিশাদ হাত টেনে ধরলো মেহউইশের। চমকে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকালো মেহউইশ । রিশাদের চোখ তার চোখে আবদ্ধ হলো। দু জোড়া চোখে জড়তা আর অস্বাভাবিকতার বাস তা আজই প্রথম উপলব্ধি হলো দুজনের।

‘হাত ছাড়ুন।’

‘একটু বসো এখানে। ‘

‘আমার শীত লাগছে শাল নেবো।’

‘তুমি বসো আমি দিচ্ছি ‘ বলেই রিশাদ মেহউইশকে খাটে বসিয়ে আলমারি থেকে একটা লং জ্যাকেট বের করলো৷ জ্যাকেটটা রিশাদের এবং পুরনো আর সেটাই মেহউইশকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পরো।’ সাথে নিজেরই মোজাও দিলো। মেহউইশের নিজেরই অনেকগুলো শীতের কাপড় কেনা হয়ে গেছে এখানে আসার পর থেকে। সব রিশাদ নিজেই কিনে এনেছিলো এবং সাইজেও পারফেক্ট তবুও কেন নিজের গুলো বের করে দিলো তা মেহউইশের মাথায় ঢুকলো না। রিশাদ বিছানা থেকে নির্জনকে কোলে তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মেহউইশের রাগ হলো এসব বড় বড় জ্যাকেট আর মোজা দেখে। সে এগুলো পরবে না নিজের থাকতে অন্যের ব্যবহৃত জিনিস কেন পরবে? কিন্তু নাহ, রিশাদ তার মনে যতোটা তিক্ত ব্যক্তি ঠিক ততোটাই ভয়ংকর তার কি সাধ্য রিশাদের কথার বিপরীত করে! মুখ ফুলিয়ে সেই জ্যাকেটটাই গায়ে দিলো। প্রথমে পায়ের মোজা তারপর হাতের মোজা পরে রিশাদের খুব সুন্দর একটা মাফলার ছিলো যা রিশাদের ড্রয়ার থেকে ইচ্ছে করেই নামিয়ে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। এটা যেন রিশাদকে তার কথার জবাব না দিতে পেরে এভাবেই মনের ক্ষোভ ঝাড়লো।বাইরে থেকে রাইমার গলা শোনা যাচ্ছে সে ‘ভাবী ভাবী’ বলে ডাকছে। তড়িঘড়ি মাফলারটা ভালো করে গলায় বেঁধে বের হলো মেহউইশ। কর্টইয়ার্ডে আগুনের শিখা বাড়ির পুরো দক্ষিণ অংশই কমলাভ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে এ বাড়িতে বর্তমানে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকটা মানুষ। মেহউইশ বসেছে রাইমার পাশে তার পাশেই বসে আছে রেহনুমা আর রিশাদ , রিশাদের পাশেই নির্জনকে কোলে নিয়ে বসে আছে জেবুন্নেসা তার থেকে আবার একটু দূরত্ব রেখে আনতুং, গেইটের দারোয়ান আর আনতুংয়ের ছোট্ট মেয়েটি। আজ বারবিকিউ করবে বলেই রেহনুমা মেয়েটাকে আনতে বলেছে৷ এমনিতেও মেয়েটা এ বাড়িতে আসতে পছন্দ করে খুব৷ রাতের বেলায় আনতুং এখানে থাকে বলে প্রায়ই মেয়েটা মন খারাপ করে৷ অথচ তাকেও এসে থাকতে বললে সে রাজী হয় না। তার নানীকে ছাড়া নাকি ঘুম আসে না। হতে পারে জন্মের পর মাকে ছাড়া থাকলেও নানীকে ছাড়া কখনও থাকেনি বলেই এই সমস্যা৷ কিন্তু আজ খাওয়ার কথা বলায় মেয়েটা খুব খুশি হয়েই এসেছে। কাঠ পুড়ছে ফট ফট শব্দ হচ্ছে কাঠ জ্বলার। বাতাসে ভেসে আসছে মৃদু সৌরভ জংলী ফুলের। মেহউইশ হাত পা মুড়িয়ে বসায় নাকের কাছে জ্যাকেটের হাতটা থেকেও একটা ঘ্রাণ আসছে। অচেনা সে ঘ্রাণে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে। কিসের ঘ্রাণ এটা? কোন পারফিউম এর ঘ্রাণ এমন! পরিচিত নয় তবে ঘ্রাণটা বেশ লাগলো। এমন ঘ্রাণ আগেও কোথাও পেয়েছিলো সে। তবে তা শুধু একবারই পেয়েছিলো বলে মনে হলো। নাক টেনে সে ঘ্রাণ নিতে চোখ বুঁজে রইলো। রাইমা তার কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসেছে। একের পর এক গল্প সে তার ঝুলি থেকে বের করছেই। রিশাদ চারপাশে তাকিয়ে যখন মেহউইশের দিকে তাকালো, চোখদুটি তার যেন ঝলসে গেল মুহূর্তেই৷আগুনের আলোয় মেহউইশের মুখের রঙ বদলে দিয়েছে। বদলটা এতেটাই প্রখর তেজদীপ্ত যা অলৌকিক শক্তিতে ভস্ম করছে রিশাদকে। আজ এই প্রথম মনে হলো সে আবার নতুন কোন মোহে আটকা পড়ছে। এতগুলো দিনে কখনও এই মোহ তাকে ছুঁতে পারেনি অথবা তার মনের ওপর পড়া শয়তানী রাগের প্রলেপ ছুঁতে দেয়নি।রিশাদের তাকানো,তার নরম সুরে কথা বলা সব কিছুই মেহউইশের চক্ষুগোচর। তাই মনে মনে ভয় জাগছে অন্যরকম আজ। লোকটার মতিগতি ঠিক নেই আর একটা পুরুষ তার ঠিক কি কি প্রয়োজনে এমন আচরণ করে তা তার ধারণাতেই একটাই আছে কারণ। ‘দৈহিক আনন্দ’ ঠিক এই একটাই প্রয়োজনেই রিশাদের আচরণ সেই রাতে এমন নরম হয়েছিলো। আজও কি তবে এমন কিছু হতে চলেছে! শিউরে উঠলো গা বুকের ভেতর আত্মাটাও কাঁপছে তার।

বার বি কিউ পার্টি বলতে খাওয়া ছাড়া তেমন একটা আনন্দ কারোই হলো না। ঘুমানোর সময় বাঁধলো বিপত্তি দু’ঘরেই। রেহনুমার ঘরে এক খাটে ঘুমাতে হবে জেবুন্নেসা আর রেহনুমাকে। রেহনুমার মধ্যে আড়ষ্টতা আর জেবুন্নেসার ভেতর ক্ষোভ।অথচ তৃতীয় ঘরটিতে থাকার মত বাড়তি কম্বল নেই একজনকে আলাদা থাকতে দেওয়ার মত৷ রিশাদ অবশ্য সন্ধ্যায় শুনেই যেতে চেয়েছিলো কক্সবাজারে। হোটেলে এখনও অনেক নতুন আসবাব, কম্বল,বিছানাপত্র অনেক কিছুই আছে যা সে তার নতুন ফ্লোরের জন্য কিনেছিলো। কিন্তু জেবু কিংবা রেহনুমা কেউই চায়নি রাত করে তাকে বাইরে যেতে দিতে। বাধ্য হয়ে আজ রাত তাদের এক বিছানায় এক কম্বলে কাটাতে হবে।

রিশাদ আজ বিছানা নিজেই গুছিয়েছে। নির্জনকে শুইয়ে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একি! মেহউইশ তো সেই যে রান্নাঘরে ঢুকলো আর বের হয়নি৷ আজ কি সে রাতটা ওই রান্নাঘরেই কাটাবে!

চলবে