মন গহীনের গল্প পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
616

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২৩
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

মনের ভেতর জমে থাকা অস্বস্তিটা এবার কাঁটার মত বিঁধছে বুকে। চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি খুবলে নিতে চাইছে মেহউইশের দেহের সকল শক্তি৷ এক মগের জায়গায় তিন মগ কফি বানিয়ে দিয়েছে সে রিশাদকে তবুও লোকটা কেমন নেশাতুর চোখে চেয়ে আছে যেন আরো চাই তার। এত শীতে বারবার খোলামেলা করিডোর পেরিয়ে রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরে আসা যাওয়া সত্যিই কষ্টদায়ক৷ কিন্তু লোকটার মুখের ওপর না করার সাহস তার হচ্ছে না। পাশের ঘরে ফুপু, খালা সব ঘুমিয়ে পড়েছে অথচ তার ঘুমানোর প্রস্তুতিটুকু নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না।

‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত কি ভাবছো?’ গলা খাঁকড়ি দিয়ে রিশাদ প্রশ্ন করলো৷

‘কিছু না।’

‘শিওর!’

জবাবে মাথা নাড়লো মেহউইশ। কিন্তু রিশাদের পছন্দ হয়নি এমন নিঃশ্চুপ জবাব। সে জানতে চাইলো ঘুম পেয়েছে কিনা? মেহউইশ এ ার আর কোন জবাবই দিলো না তা দেখে রিশাদ বলল, ‘বিছানায় আসো।’

নির্জন আজ এ ঘরে নেই জেবুন্নেসা জেদ ধরে নিয়ে গেছে। রেহনুমারও ব্যাপারটা ভালো লেগেছে কিন্তু সমস্যা খাটটা অনেক বড় হলেও কম্বলগুলো চারজনের জন্য যথেষ্ট নয়। নির্জনের ছোট কম্বল আছে কিন্তু সেগুলো থাকবে খাটের মাঝামাঝি এতে করে কম্বলে টানাটানি থাকবেই। রিশাদ নিজেই জিনিসটা খেয়াল করে তার আর মেহউইশের জন্য রাখা আলাদা কম্বল থেকে দুটো দিয়ে দিলো রেহনুমার ঘরে। এখানে অবশ্য অনেকটা চালাকিই করেছে সে। ইচ্ছে করেই মেহউইশ ব্যবহার করতো সেগুলোই দিয়েছে আর নিজের গুলো রেখে দিয়েছে। মেহউইশকে ঘুমোতে ডাকলে সে বিছানায় উঠে বসে রইলো পা গোঁজ করে। পরনে তার এখনও রিশাদের জ্যাকেট, মোজাগুলো। রিশাদ হাত বাড়িয়ে মেহউইশের হাত ধরতে চাইলো। ঘরের মৃদু আলো আজও জ্বলবে আগের মতোই। জড়তা কাটছে না মেহউইশের ঘৃণা জমা মনে রিশাদের স্পর্শ তার কাছে কাঁটার মত। রিশাদ দেখলো মেহউইশ হাত এগিয়ে দিচ্ছে না কারণ তারও জানা। কিন্তু সে তো চাইছে সম্পর্কটা বদলাক, স্বাভাবিক হোক। প্রেম হওয়াটা হয়তো অসম্ভব তবুও অভ্যাসটা হোক৷ ভালোবাসা নাই’বা থাকলো মায়াটা অন্তত জন্মাক। একটা জীবন পার করতে একটুখানি যত্ন তো তারও দরকার। মেহউইশের স্থির হয়ে বসে থাকা দেখেই এবার নিজেই টেনে হাতটা ধরলো। শুধু কি হাতটা ধরা! জাপটে টেনে নিজের বুকের নিচে ফেলল এক হাতে আর অন্য হাতে কম্বলটা জড়িয়ে নিলো গায়ে। আকস্মিক ঘটনায় হাতে ব্যথাও পেলো বোধহয়। আহ্ করে শব্দ করতেই রিশাদ একটু নিজেকে সরালো। মেহউইশের মুখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যথাটা কি বেশিই পেল? চোখ বন্ধ , মুখ স্বাভাবিক চোখের উপর ভ্রু দুটো ইষৎ কুঁচকে আছে। শীতের রাত, মুখের উপর কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস আর হাতের নিষিদ্ধ বিচরণ শক্ত হয়ে থাকা মনটাকেও নরম করে উন্মাদ করে দেয় বুঝি! মেহউইশ তো হচ্ছে উন্মত্ততা সাময়িকভাবে তাকে অস্থির করে তুলছে রিশাদ কি ইচ্ছে করেই এমন আক্রমণ করলো আজ! মেহউইশ যখন পুরোপুরি নিজের ইচ্ছের বাইরে রিশাদকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো ঠিক তখনি রিশাদ নিজেকে থামিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো। রাগে,লজ্জায়,সংকোচে মেহউইশের চোখের কোণে জলের ঢেউ আছড়ে পড়লো গাল বেয়ে। ছিহ, কি হচ্ছিলো তার সাথে এখনই? কম্বলের নিচে থেকেই রিশাদ তার গায়ের জ্যাকেট আর মোজা খুলে নিয়েছিলো।তখনও মনে রাগ ছিলো।পরপর যখন তপ্ত অধরের আদুরে বর্ষণ করলো তখনি যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলো মেহউইশ। ঘোর লেগেছিলো অকাতর মন গহীনের ক্ষোভ দ্রবীভূত হয়ে মিশে গিয়েছিলো কুয়াশায় মোড়ানো পাহাড়ে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত রাত্রীপ্রেম মানব মানবীর দেহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ তবুও মেহউইশ ভুলে যেতে চেষ্টা করেছিলো একটুক্ষণ নিজের ঘৃণা। রিশাদ ফায়দা লুটেনি আজ বরং অকূল তৃষ্ণার সাগরে তৃষিত করে ছেড়ে দিয়েছে মেহউইশকে।

ভোরের নরম আলোয় ডগমগিয়ে নতুন গুল্মলতার মত করে মাথা উঁচু করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নির্জন৷ছোট ছোট হাত পা ভারী আবরণে আবৃত শুধু তার ছোট্ট গোল মুখখানিই দেখা যাচ্ছে। বাড়ির কর্টইয়ার্ডের এক পাশে দারুণ সব ফুলে সজ্জিত জায়গায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন রেহনুমা। তার কোলেই পূর্ব দিকে মুখ করে নির্জন। রোদের আলো পাহাড় ছুঁয়ে তাদেরকেও ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। হয়তো সেই রোদের পরশে উম পেতেই ছেলেটা অমন কোল থেকেই মাথা উঁচু করছে বারবার।জেবুন্নেসা রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি৷ রিহানের চিন্তায় অস্থির পরশু তবুও একটু ফোনে কথা হয়েছিলো কিন্তু কাল থেকে সেটাও আর সম্ভব হচ্ছে না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তাই তৈরি হচ্ছে ঢাকায় ফিরবে বলে।এমনিতেও হোটেলে তেমন কিছু নেই। রাইমাও জলদি জলদি তৈরি হওয়ায় রিশাদের সাথেই বেরিয়ে পড়েছে তারা। মেহউইশ ঘুম ভাঙতেই কোনদিকে না তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। ঘড়িতে সময় কত ঠাওর করা মুশকিল রোদ দেখে। হাসি হাসি মুখ করে নির্জন আর রেহনুমাকে দেখছিলো সে। এলোমেলো চুল , চোখের কোণে জলের ছাপ স্পষ্ট।

‘আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল তোমারও?’

‘আমারও মানে!’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

‘ রাইমা আর তার মা তো ভোরেই উঠে রিশাদের সাথে চলে গেছে।’

‘রিশাদ চলে গেছে’ আর সে কিনা বিছানায় রিশাদ আছে ভেবে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে! নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত, একটা মানুষ পাশে আছে কি নেই সেইটুকু বোঝার মত বুদ্ধি তার নেই। ইয়া মাবুদ! আবার দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলো মেহউইশ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিলো। গা থেকে রিশাদের জ্যাকেটটা খুলতে গিয়ে মনে হলো সেই ঘ্রাণটা আবারও নাকে লাগছে। এটা রিশাদের গায়ের ঘ্রাণ সে আজ জানে। কাল রাতেই পেয়েছিলো ঘ্রাণটা তীব্রভাবে যখন রিশাদ তাকে বাহুবন্ধনীতে জবরদস্তি বন্দী করে রেখেছিলো। জোরে নিঃশ্বাসে আবারও ঘ্রাণটা টেনে নিতেই মনে পড়লো রাতের সেই ছেড়ে দেওয়া। নির্লিপ্ত আচরণের মুহূর্তটুকু মনে পড়তেই জ্যাকেটটা ছুঁড়ে মারলো সে। তড়িঘড়ি বিছানার কম্বল গুছাতে লাগলো৷ বালিশ গুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়েই চোখে পড়লো সাদা একটা চিরকুট। মেহউইশের বালিশের তলায় ছিলো চিরকুটটা।

‘আলমারির তৃতীয় ড্রয়ারে নির্জনের নতুন কিছু কাপড় আছে। আজকে পুরনো গুলো ফেলে দিয়ে সেগুলোই ব্যবহার করবে। প্রথম ড্রয়ারে আমার মেরুন রঙের শার্টের নিচে হাজার পাঁচেক টাকা আছে তোমার হাত খরচার।’

ছোট্ট চিরকুটখানি পড়েই তা বারান্দা থেকে মুচড়ে ফেলে দিলো। এই কাগজের টুকরো হাওয়ায় ভেসে উড়ে গেল হয়তো দূর থেকে দূরান্তে৷ সেই সাথে ভেসে গেল মেহউইশের মনের ঘৃণার কিছু অংশ কিছুটা রাগের।

দিনভর নির্জন আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত কেটেছে মেহউইশের। রিশাদের দেওয়া মোবাইল ফোনটাতে প্রতিদিন একবার কল আসে মাইমুনার। তিনি মেয়েকে সারাদিনই কল করতে থাকেন। কখনো নেটওয়ার্ক থাকলে মেহউইশ সেই কল পায় কখনো পায় না। তবে কথা বলো যখন মায়ের সুখী সুখী গলাটা শুনতে পায় তখন সে ভুলে যায় ইভানের কমতি। যখন জানে মিহাদের শখের কোন জিনিস আজ কেনা হয়েছে কিংবা খুব দামী কোন খাবার সে খেয়েছে তখন সে নিজেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলে শুকরিয়া জানায় আল্লাহর আর ভালোবাসা জাগে নির্জনের প্রতি। নির্জনের মাতৃহারা হওয়ার কারণেই আজ সে এখানে আর তার দ্বায়িত্ব সব রিশাদ নিজের কাঁধে নিয়েছে। এতকিছুর পরও তার রিশাদের প্রতি সম্মান আসেনা কেন সে নিজেও জানে না৷

হোটেল ম্যানেজমেন্টে প্রচুর ভুল হঠাৎ করেই চোখে পড়েছে আজ রিশাদের। ইচ্ছে ছিলো দ্রুত সকল কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে। ফেরার পথে রাতের খাবার সব এখান থেকেই নিয়ে যাবে সে। গত বছরও এই সিজনে তাকে কক্সবাজার থাকতে হয়েছে। তখন নির্জন ছিলো না নীলিমা ছিলো। বিয়ের চার মাস পূর্ণ হয়েছিলো বলে নিজের হোটেলেই স্পেশাল একটা সন্ধ্যা তৈরি করেছিলো সে। ভালোবাসাহীন বৈবাহিক সম্পর্ককে দুনিয়ার চোখে পরম সুখী প্রমাণ করারই মিথ্যে চেষ্টা ছিলো সেটা। হোটেলের সামনের লনে ফুলের বাগান তার পাশেই মাঝারি আকারের সুইমিংপুল। আলোয় আলোয় ঝলমল করে তুলেছিলো পুলের চারপাশ। ছোট ছোট ক্যান্ডেলে সজ্জিত হয়েছিলো পুলের পানি। আইডিয়াটা অবশ্য নীলিমারই ছিলো। সে হিন্দি সিরিয়ালে আসক্ত ছিলো খুব আর তাই বলেছিলো এতসব আয়োজনের কথা। অভিনয়টা দারুণ ছিলো নীলিমার তাই রিশাদের মত ছেলেকেও হার মানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে পেরেছিলো। শুধু মাত্র ছেলের কারণেই রিশাদ তাকে আটকে রাখার সকল কৌশল প্রয়োগ করেছিলো। হাসি পায় এখন তা ভাবতেই।

‘স্যার, স্পেশাল কাপল স্যুইট সব গুলোই ডেকোরেট হয়ে গেছে।যদি একটু চেক করতেন?’

হাতে থাকা পেপারওয়েটটা ঘুরাতে ঘুরাতে ম্যানেজারের দিকে তাকালো রিশাদ৷ তার মুড আজ ঠিক থেকেও যেন নেই। বিশ্রীরকম কোন গালি বের হয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে কিন্তু সে তা করবে না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মুখ খুলল, ‘ ডেকোরেশন গুলো যদি আমিই ঘুরে ঘুরে গিয়ে চেক করবো তবে লাখ টাকা বেতন দিয়ে অরগানাইজার, প্ল্যানার কোন বা* ফেলার জন্য রাখা হয়েছে!’ কথার শুরু আস্তে ছিলো প্রথমে এবং শেষে এসে তা লাউড হলো। রিশাদের এমন আচরণে ভড়কে গেল ম্যানেজার সাহেব। কিন্তু কিছু বলার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে ডাক এলো যা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রিশাদ। দ্রুত হাতে শার্ট,টাই সব ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে তৎক্ষনাৎ।

চলবে

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২৪
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

সুইমিংপুলের সাথের বাগানের প্রতিটি ফুলগাছে ছোট ছোট আধুনিক রঙবেরঙের বাতি লাগানো হয়েছে। সেই সাথে সুইমিংপুলের পানিতে ঠিক গত বছরের মতোই প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গত বছর সব হয়েছে নীলিমার ইচ্ছেতে এবার হয়েছে মডেল কন্যা তিশমার ইচ্ছেতে। রিশাদ যখন নিজের কেবিনে বসে ম্যানেজারের উপর রাগ ঝাড়ছিলো কাপল স্যুইট ডেকোরেশন দেখা নিয়ে তখনই আবির্ভাব ঘটে তিশমার। সে রিশাদ বলে ডাকতেই সুচতুর রিশাদ নিজের অগোছালো অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। শার্টের কলার,ইন ঠিক করে টাইটাকে সোজা করে। হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করতে করতেই কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে তিশমা। রিশাদের অমন অগ্নি থেকে জল হওয়া দেখেই চরম বিষ্ময়ে বিষ্মিত হয় ম্যানেজার।রিশাদকে তিনি চেনে অনেক বছর হলো। বয়সেও রিশাদের চেয়ে জুনিয়র হলেও পড়াশোনায় রিশাদের ব্যাচমেট ছিলো। পরিচয় ছিলো বলেই লোকটার চরিত্র এবং কাজের প্রতি আগ্রহ দেখেই রিশাদ তাকে নিজের করা প্রথম কাজে তাকে জবের অফার করেছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই ছেলেটির জন্য তখন চাকুরিটা ছিলো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতন। বিনাবাক্যে চাকরিতে জয়েন করে আর তারপর থেকেই একসাথে অনেক সময় দুজন এখানে কাটিয়েছিলো। সেই সুবাদেই রিশাদের কঠোরতা,গম্ভীরতা এবং নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সে অবগত৷ আর সেই ধারনা আজ আমূল বদলে গেলো মেয়েটিকে কেবিনে ঢুকতে দেখেই। রিশাদের মত লোক কিনা কোন এক মেয়ের জন্য এভাবে নিজেকে অপ্রস্তুত ভাবছে! তিশমা বর্তমানে আমাদের দেশের একজন উঠতি তারকা। কিছু কিছু বিজ্ঞাপনে কাজ করেই এ পর্যন্ত অনেক সাড়া পেয়েছে বড় বড় কাজের। রিশাদের সাথে তার পরিচয় অস্ট্রেলিয়ার যাত্রাপথে বিমানে। পাশাপাশি সিট হওয়ায় টুকিটাকি গল্প এবং দুজন সুন্দর মানুষের টুকটাক পরিচয় থেকেই ফোন নাম্বার আর সোশ্যাল সংযোগ আদান প্রদানে পরিচয় গভীর হয়। বয়সের পার্থক্য অনেক থাকা সত্ত্বেও দুজনের বন্ধুত্ব হয় দারুণ। বলতে নেই মেয়েটা মনে মনে রিশাদকে নিয়ে ভাবেও অনেকদূর কিন্তু সেই ভাবনায় ছেদ ঘটে বছর দেড়েক আগে রিশাদের বিয়ের নিউজ পেয়ে। তারপরও একটু আধটু কথাবার্তা সবসময়ই চলতো। নীলিমার পালিয়ে যাওয়া আর নির্জনের জন্মের কথাটাও সে জানে, শুধুই অজানা মেহউইশ নামের রিশাদের জীবনের নতুন অধ্যায়।

ছোট ছোট হাত চালিয়ে মেহউইশের গাল বার বার খামচে ধরছে নির্জন। আজকাল জাপটে ধরে, থাবা বসায় নির্জন সামনে কিছু পেলেই । মেহউইশের প্রথম প্রথম নির্জনকে দেখলেই মনে হতো ইভান হারিয়ে গেছে,তার জীবন তছনছ হয়ে গেছে শুধু মাত্র এই বাচ্চাটার কারণে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এখন আর তেমন লাগে না। মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতায় ইভানের শূন্যতা বুকের ভেতর সুঁচের মত বিঁধলেও সেই কষ্টের দায় এখন আর নির্জনের ওপর দেয় না সে।ভাগ্য বলেও মেনে নেয় না। সবকিছুর জন্য দ্বায়ী সে রিশাদকেই ভাবে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পেটের উপর বসিয়ে দেয় নির্জনকে। ঘাড় এখনও হেলেদুলে বাঁকিয়ে পড়ে এদিক, ওদিক আর মেহউইশ খুব সতর্কভাবে তার ঘাড়ের পেছন হাত রেখেছে। যেন বেকায়দায় পড়ে ঘাড় না ভাঙে,বাচ্চাটা ব্যথা না পায়! দুপুরের খাওয়া একটু আগেই শেষ হয়েছে তার আর রেহনুমার। কিন্তু নির্জন জেগে থাকায় তার আর ভাতঘুম দেওয়া হয়নি। বিছানায় শুয়েই খেলা করছে সে আর অমনি মেহউইশের ফোনটা বাজলো। উপর থেকে নির্জনকে বিছানায় শুইয়ে ড্রেসিংটেবিল এর ওপর থাকা ফোনটা নিতেই চমকালো ভীষণ, স্ক্রীণে ভেসে থাকা নামটা দেখে৷ এত দিনের মাঝে রিশাদ তাকে মাত্র দু দিন ফোন করেছিলো। প্রথমবার চেক করেছিলো মেহউইশ ফোনটা ধরে কিনা আর দ্বিতীয়দিন জিজ্ঞেস খোঁজ নেওয়ার ছিলো সে নির্জনের টিকার কার্ড সাথে এনেছিলো কিনা ভুলে গেছে। মেহউইশ যেন একটিবার আলমারিতে চেক করে। তখন সে মনে মনে রেগেছিলো খুব অলৌকিকভাবেই আজকে তার রাগ হলো না। ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে রিশাদের গলা পাওয়া গেল, ‘নেট পাওয়া গেলে একটু হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দাও তো। আমার এক ফ্রেন্ড নির্জনকে দেখবে।’ নিজের কথা শেষ করেই কল কেটে দিলো রিশাদ। মেহউইশ বোকা বনে গেল, কি হলো এটা? ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ আছে কিনা, নেট আছে কিনা এখানে ডাটা নেট কানেক্ট হবে কিনা কিছু না খবর নিয়েই অর্ডার করলো শুধু । নবাবজাদা ভাব সবসময় হুহ! নিজের মনেই বলতে বলতেই ফোনে দেখলো মেসেজ এসেছে রিশাদের নাম্বার থেকে।

‘ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ, এমবি সবই আছে। তুমি শুধু ডাটা কানেক্ট করে নির্জনকে নিয়ে বাগানের দিকে যাও।’

মেসেজ পড়তেই ভয় লাগলো মেহউইশের। ভূতে দিলো নাকি এই মেসেজ! সে তো মনে মনে বলেছে এসব কথা এরই জবাব ওই লোকটা কি করে পাঠালো! লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা,,,,৷ পড়তে পড়তেই মেহউইশ ফোনের ডাটা কানেক্ট করলো। সিম নেটওয়ার্ক একবার দেখা যাচ্ছে তো আরেকবার ভ্যানিশ। ভয় তো বেড়েই চলছে, লোকটার ওপর কি জ্বীন, ভূতের আছর আছে?

শীতের আকাশে সূর্য একটু জলদিই লুকিয়ে পড়ে গৌধূলিবেলায়। এখন গৌধূলির শুরু আকাশ কালচে হয়ে কুয়াশার চাদর নেমে আসছে এখনই পাহাড়ে। মেহউইশ নির্জনকে কোলে রেখে চেয়ারে বসেছিলো কিন্তু ফোন ধরায় সমস্যা হচ্ছে । বাধ্য হয়ে রেহনুমাকে ডেকে চেয়ারে বসিয়ে নির্জনকে তার কোলে দিলো। নিজে ফোনটা ধরে ভিডিও কল দিতেই ক্যামেরায় ভেসে উঠলো একজোড়া মুখ৷ রেহনুমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিশমা বলল, ‘ইনি কে?’ ক্যামেরার পেছন থেকে সচকিত মেহউইশ নারী কন্ঠ শুনে কৌতূহলী হলো বেশ তবুও দেখার চেষ্টা করলো না। এবার রিশাদের গলা পাওয়া গেল, ‘আমার ফুপি আর আমার ছেলে৷’

‘ওহ, স্লামালিকুম আন্টি।’ বেশ উৎফুল্ল গলায় জানতে চাইলো তিশমা। ততক্ষণে রিশাদের নজর স্ক্রীণে আরো একটি মুখ দেখার প্রতীক্ষায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুখটি দেখা গেল না৷ রেহনুমা সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ক্যামেরায়। এদিকে ছোট্ট হাতে বার বার ফোনটা খাবলে তুলে নিতে চাইছে নির্জন সাথে বাবার মুখ দেখেও উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বিভিন্নরকম শব্দ করছে।

‘ফুপি এ হলো তিশমা।আমার বান্ধবী।’ মেহউইশের কানে বাক্যটা প্রবেশ করা মাত্রই সে ফোন ঘুরিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরলো৷এপাশে রিশাদ,তিশমা দুজনেই হকচকিয়ে গেল আচানক মেহউইশকে দেখে ওপাশে মেহউইশ হতভম্ব অপরুপ সুন্দরী মডেল কন্যা তিশমাকে দেখে। দ্রুত আবার ফোন ঘুরিয়ে সে রেহনুমার দিকে তাক করলো। কয়েক সেকেন্ড পর তিশমার গলা পাওয়া গেল, ‘ওটা কে ছিলো রিশাদ?’

‘বেবিসিটার।’

‘বেবিসিটার!’ কথাটা কানে বাজলো মেহউইশের সাথে রেহনুময়ারও। রিশাদ তার ফ্রেন্ডের সামনে মেহউইশের পরিচয় লুকালো! কলিজায় লাগলো যেন রিশাদের বলা কথাটা। লোকটার মতলব কি? জোরজবরদস্তি বিয়ে করে এনে এখনও লোকের সামনে বলছে আমি তার ছেলের কাজের লোক। অসভ্য, হারামি বেবিসিটারের সাথে রাত কাটাতে আসিস তুই! শালা বজ্জাত। মনে মনে গালির ফোয়ারা ছুটলো মেহউইশের কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই রেহনুমার সামনে। শত হলেও রেহনুমা তো রিশাদেরই ফুপু৷ ফোনকল কেটে দিয়েছে রিশাদ অনেক আগেই তবুও চেয়ারে থম মেরে বসে আছে রেহনুমা৷ রিশাদের আচরণ তার নিজেরও ভালো লাগেনি। রিশাদকে সে দূর থেকেই জানে তবুও এতখানি জানে রিশাদ কখনো কোন মেয়েকে পটাতে তার স্ত্রী’র পরিচয় লুকাবে না। নাকি ওই মেয়েটা তার বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু! রেহনুমা মনে প্রাণে চাইছে তার মনের ভাবনাগুলো ভুল হোক। রিশাদের জীবনে নীলিমাকে নিয়ে যে তামাশা হয়ে গেছে তা আবার নতুন করে তার আর মেহউইশের সম্পর্কেও হোক৷ এমনিতেও রিশাদের বন্ধুটি দেখে অনেক বেশিই সুন্দরী মনে হলো। অন্তত নীলিমা,মেহউইশের তুলনায় তো অনেক বেশিই। বয়সেও মেহউইশের সমানই হবে হয়তো।

রাশেদ খানের তর্জনে গর্জনে খান বাড়ি আজ তুঙ্গে। থমথমে মুখে বসে আছে রাইমা আর রিহান তাদের মায়ের ঘরে। তাদেরই সামনে বসে আছে জেবুন্নেসা আর দরজামুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে রাশেদ খান। তার এক কথা, মেয়ে তার কাছেই থাকবে। আর এই কথাটা রিহানের কান ভেদ করে অন্তরের ভেতরে গেঁথে গেল৷ বাবা- মা ডিভোর্স চায় আর সেই ডিভোর্সে তার মেয়েকেও চায় নিজের সঙ্গে৷ আর মা বলছে মেয়েকে সে কিছুতেই এ বাড়িতে রেখে যাবেন না। আজই চলে যাবে সে বাপের বাড়ি সাথে রাইমাও যাবে৷ রিহানের দুঃখটা এখান থেকেই শুরু, মাও তাকে চায় না, বাবাও৷ সে কি তবে ফেলনা! রিহানের কিশোর মনে বড়সড় আঘাতটা এখান থেকেই লাগা যা তার খুব কাছের আর আপন কেউ জানতেই পারলো না। রাইমা বিমর্ষ মুখে বসে আছে। বাবাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে সাথে মাকেও, যদিও মায়ের সাথে তার মিষ্টি মুহূর্ত কখনো ছিলো বলে মনে পড়ে না। আজ মা বাবার লড়াই তার সকল প্রাণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। সত্যিই কি মা-বাবা ডিভোর্স নেবে! তাদের বিচ্ছেদে কি তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে? নাহ, কিছুতেই সে এমনটা হতে দেবে না। ছোট থেকেই তো মা বাবার কখনো বনিবনা দেখেনি তাই বলে এভাবে বিচ্ছেদ তার কল্পনার বাইরে।

চলবে

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ২৫
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
বাবা-মায়ের ঝগড়া যখন তুমুল হয়ে গেল তখন আর রিহানের পক্ষে ঘরে থাকা সম্ভব হলো না। সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাইমা অনেক চেষ্টা করলো বাবা মাকে থামানোর কিন্তু তারা কিছুতেই থামলো না উল্টো একসময় রাশেদ খান হাত উঁচিয়ে থাপ্পড় দিতে চাইলো জেবুন্নেসাকে৷ ঘটনাটা আর সহনীয় রইলো না রাইমার পক্ষে আর না জেবুন্নেসার পক্ষে । রাশেদ নিজেকে থাপ্পড় দেওয়া থেকে সামলে নিলেও রাগ সামলাতে পারলো না। রাইমা ঘর থেকে বেরুতেই সে বলে উঠলো, ‘আমার বোনকে বিধবা করেও তোমার স্বাদ মেটেনি তাই না? এজন্যই গিয়েছিলে চট্টগ্রাম এবার যেন তাকেই খুন করতে পারো!’ রাইমার পা থেমে গেল ‘ফুপু বিধবা!’

ঘরের ভেতর আবারও চিৎকার শোনা গেল তবে এবার জেবুন্নেসার।

‘খুনি আপনি, আপনি ধর্ষক আপনি প্রতারক। আর আপনারই ছায়ায় আমার বোনের শেষ চিহ্ন রিশাদটাকেও তেমনই বানিয়েছেন। আমার রাইমা, রিহানটাকেও এখন তেমনই করতে চাচ্ছেন? ডিভোর্স আমার চাই এবং সেটা যতদ্রুত সম্ভব।’ এই অব্ধি শুনে রাইমা আর দাঁড়াতে পারলো না। সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। সহ্য হয় না তার এমন জীবন। ছোট থেকেই এমন দূরত্ব তাকে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড দূর্বল সত্তায় পরিণত করে দিয়েছে। ভয় পায় সে এ জীবনে সবরকম সম্পর্ককেই৷ নিজের প্রয়োজনে মাকে পায় না মায়ের আদর,শাষণ কিছুই পায় না আর না পায় বাবাকে কাছে। বাবার আদর আর আদরেভর্তি টাকাই তার প্রাপ্তির খাতায় আছে। এক দাদাভাই আছে যে কিনা আদরটাও শাষণের ভঙ্গিতে করে। তবুও স্বস্তি গত কয়েকটা মাস নির্জনকে পেয়েছিলো বাবার কারণে এখন সেও নেই। আর এত এত বছর পর জানলো একটা ফুপি আছে কিন্তু সেখানেও জানতে হলো মা আর ফুপির মধ্যকার সম্পর্ক বিষাক্ত। কিন্তু বাবা কেন বলল, ফুপির বৈধব্যদশা মায়ের কারণে! রাইমার মাথায় জট পাকিয়ে গেল যেন। ফুপুর বাড়িতে গিয়েও মনে হয়েছিলো মা ফুপুকে সহ্য করতে পারে না আর ফুপিও কেমন মাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলছিলো। যদি মায়ের কারণেই ফুপু বিধবা হয়ে থাকেন তবে তো মায়ের না ফুপুরই মাকে সহ্য করারই কথা না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। সব জানতে হবে তাকে মা বাবার বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য হলেও তাকে সব জানতে হবে, কোন উপায় বের করতে হবে।

‘শী ইজ মাই ওয়াইফ’ বলেই রিশাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কথাটা শুনে তিশমার মুখ বিষ্ময়ে ‘হা’ হয়ে গেল।

‘কি বলো রিশাদ? তোমার বউ তো নীলিমা ছিলো তার চেহারা,,,,’

‘নীলিমা পালিয়ে গেছে তা তো অজানা নয় তোমার।’ মাথা নেড়ে জবাব দিলো তিশমা সে জানে।

‘ওর নাম মেবিশ না মানে মেহ উইশ’ ভেঙে ভেঙে বললো রিশাদ মেহউইশের নামটা। তারপর আবার বলল, ‘ মেবিশকে আমি জোর করে বিয়ে করেছি৷ আসলে নীলিমা যাওয়ার পর নির্জনকে আমিই সামলেছি কিন্তু কাজ তো আর ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় আবার নির্জনকে মায়ের যত্ন দিতে গেলে কাজ করাও সম্ভব নয়। আব্বু ফোন করে করে পাগল করে দিচ্ছিলো বিয়ের জন্য আর এবারও তার পছন্দের কোন এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। বিয়ের কথা শুনলেই তো মাথায় আগুন ধরে যায় তার ওপর আব্বুর মতের দাম দিতে গিয়েই আমি আজ ছেলে মানুষ করতে কাজ ছাড়তে বসেছিলাম। রাগে মাথা কাজ করছিলো না তার ওপর নির্জনের অসুখ হলো। এই অসুখে আমার ছেলেটা কান্না করতো প্রচুর। হাসপাতালে যাওয়ার পর মেহউইশ চোখে পড়ে তার কোলে নির্জন যেতেই চুপ হয়ে যায়। আর বাড়িতেও খালামনি কোন না কোন কটু কথায় বিয়ের কথা তুলতে থাকতেন। সব মিলিয়ে রাগ,জেদ আর সমস্যার সল্যুশন আমার তখন শুধু মেবিশকেই মনে হয়েছিলো।’ এ পর্যন্ত বলেই থামলো রিশাদ। তিশমা এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে রিশাদের কথা শুনছিলো এবার প্রশ্ন করলো, ‘যদি মেহ উইশ বিবাহিত হতো? তখন কি করতে তুমি!’

তিশমা যেন মেহউইশ নামটা উচ্চারণ করতে পারলো না ঠিকঠাক । রিশাদ আবার জবাব দিলো, ‘তাতে কি? সে বিবাহিত না হলেও কারো প্রেমিকা তো ছিলোই৷ আমার জন্য সে তার প্রিয় মানুষকে হারালো।’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে রিশাদের গলা কাঁপলো। সে ব্যথিত নিজের কর্মের জন্য কিন্তু ব্যথিত হওয়ার বাইরে সে কিছু করতেও চায় না। এদিকে তিশমা অপলক চেয়ে আছে রিশাদের দিকে৷ হঠাৎ ম্যানেজার এসে দাঁড়ালো রিশাদের সামনে৷ গলা খাঁকড়ি দিয়ে সে প্রশ্ন করলো, ‘ স্যার সব রুম কমপ্লিট হয়ে গেছে আজ। চাইলে কাল থেকেই আমরা ফোর্থ ফ্লোরের বুকিং নিতে পারি৷ শীত তো এখন ভালোই জমছে ট্যুরিস্টও বেশ আসছে।’ ম্যানেজারের কথার কোন জবাব দিলো না রিশাদ। সে এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাশ থেকে তিশমা বলল, ‘ এই যে মিস্টার হাংকি পাংকি এখানে কি আপনার? এখন আমরা কথা বলছি পরে আসুন।’

তিশমাকে প্রথম দেখে যতখানি আপ্লুত হয়েছিলো সে এই মুহূর্তে ততোটাই বিরক্তিবোধ করলো৷ কত বড় রকমের খারাপ হলে মানুষ এমন বিচ্ছিরি নামে ডাকতে পারে! মেজাজ খারাপ হলো ম্যানেজারের কিন্তু এই সেলিব্রেটি টাইপ মানুষ তার একদম পছন্দ না। ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে বলে তিশমা আবারও বলল, ‘ এই যে হাংকি পাংকি কথা কি কানে যায় না?’ তারই মাঝে রিশাদ বলল, ‘ আমার রুমটাও গুছিয়ে রাখবেন তো, কাল আমার পরিবার আসবে এখানে। আর শুনুন আমার পুরনো রুমটাকে ট্যুরিস্ট রুম করার ব্যবস্থা করান আমি কালকে থেকে দ্বিতীয় ফ্লোরে থাকবো। আর ঘরের পর্দা সব ল্যাভেন্ডার কালারের রাখবেন৷ওহ হ্যাঁ রুম দুইটা লাগবে আমার ফুপিও এখানেই থাকবে যতদিন আমি থাকবো।’ কপাল কুঁচকে, নাক ফুলিয়ে ম্যানেজার চলে গেল চুপচাপ। মেজাজ চড়ে গেছে খুব তার কিন্তু বসের সামনে কারো সাথে তর্কে জড়ানোটা পছন্দ নয় বলেই চুপ ছিলো সে। তাছাড়া ওই মডেলকে সে দুই পয়সার দামও দেয় না। হুহ,

‘বাহ্, তোমার ম্যানেজার তো দেখি তোমার মতোই নাক উঁচু লোক।কি ভাব দেখিয়েই না গেল।’ তিশমা অবাক হয়ে বলল।

‘কেন খামোখা ওসব বললে? ‘

‘কিসব বলেছি!’

‘ওই যে হাংকি পাংকি। ও আসলে তার নামের ব্যাপারে খুবই পজেসিভ।ওকে দুটো গালি দিয়ে কথা বললেও জবাব দিবে না কিন্তু নাম নিয়ে মজা করলে খুব লাগে তার।’

‘ এই এটা কি তোমার ঘরের বউ! এত গভীর খবর মানুষ তো নিজের বউয়েরও রাখে না।’ ব্যঙ্গ করলো তিশমা সেও দেখে নেবে এই ফালতু ম্যানেজারকে। এক সপ্তাহ থাকবে এই এক সপ্তাহে ওই ম্যানেজারের ঘুম যদি হারাম না করে তবে তার নামও তিশমা নয়।

‘আচ্ছা পরের কাহিনি কি?’ তিশমা কৌতূহল মেটাতে আবার প্রশ্ন করলো।

‘কিসের কাহিনি?’

হাঁটতে হাঁটতে বলি, চলো বিচের দিকে। বিকেলের শুরু সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে হাওয়া আসছে পাল্লা দিয়ে৷ শীত নেই এ সময়ে এখানে অথবা আজ সূর্যের তাপ বেশি। বেগুনি রঙের ফুল স্লিভ টপ আর হোয়াইট লেগিংস পরনে তিশমার পিঠ পর্যন্ত চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে। লনের সামনে দাঁড়ানো কালো কোট পরিহিত ম্যানেজার অগ্নি দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছে লন ছাড়িয়ে গেইটের দিকে পা বাড়ানো তিশমার দিকে। পাশাপাশি রিশাদ এক হাত চুলে বুলিয়ে পা মেলাচ্ছে তিশমার সাথে। তিশমার প্রশ্ন মেহউইশ যদি তার বউ হয় তবে কেন সে বেবিসিটার বলে পরিচয় দিলো!

‘আমি কল করে বলেছিলাম নির্জনকে নিয়ে সে যেন ভিডিও কলে আসে। সে কি করলো ফুপির কোলে নির্জনকে দিয়ে দিলো। ফুপিকে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলো দু হাতে নির্জনকে ধরে রেখেছ!’

‘হ্যাঁ তাই তো দেখলাম।’ তিশমা জবাব দিলো।

‘ফোনের পেছনে মেহউইশ ছিলো তা বুঝতে পেরেছি তখনই। কিন্তু এতেও সমস্যা নেই কিন্তু সে কেমন তোমার কন্ঠ শুনতেই ঘাড় বাড়িয়ে দেখে নিলো তোমায়।’

‘হুম, আমি বেশ অবাকই হয়েছি। আমি কথা বলার সাথে সাথেই অমন করলো কেন? ‘

‘কারণ, ও আমার সাথে সংসার করবে। নীলিমা হলেও এমন করতো তবে নীলিমা করতো নিজের প্রয়োজনে।’

কোন কথাই মাথায় ঢুকছে না রিশাদ কি বলছো এসব? তিশমা যেন এবার বিরক্তই হলো। রিশাদ দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিলো। এলোমেলো চুল বাতাসে দোল খাচ্ছে খুব সেই সাথে কপালে ঠেকছে বারবার। আনমনা দৃষ্টি তার সামনেই সমুদ্রের জলরাশিতে সে আবার বলল, ‘ মেবিশকে বিয়েটা আমি জোর করে করলেও সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আর সেটাই স্বাভাবিক কারণ সে কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু তার দ্বায়িত্ব, তার মা আর ভাইয়ের সুখ তার কাছে নিজের চেয়েও বেশি। ও প্রথমে আমাকে দেখলে যতোটা অসহ্যবোধ করতো এখন তা করে না। আমি টের পাই সে আমার প্রতি কোমল হচ্ছে একটু একটু। সে নির্জনকেও আদর করে , আগলে রাখে যা নীলিমা তার আপন মা হয়েও করেনি। ওই তো এসেছিলো ছেলের প্রতি দরদ দেখাতে কিন্তু সে দরদ কতটুকু দেখালো? নতুন জামাই যেই ওকে অবহেলা করলো অমনি ছেলেকে ফেরত দিয়ে গেল। পনেরো দিনের জায়গায় সাত দিনেই নির্জনকে তার বাপের কাছে দিতে হলো। আর মুখে কি বড় বড় ডায়লগ দিয়েছিলো জানো? সে নাকি সারাজীবনের জন্য কেড়ে নেবে নির্জনকে আমার কাছ থেকে হুহ। ‘ কথাটা শেষ করেই অস্পষ্ট স্বরে গালি দিলো একটা৷ তিশমা হাত ধরলো রিশাদের, হাঁটতে হাঁটতে হাতটা ছাড়লো না৷ আশ্বাস দিলো যা হয় ভালোর জন্যই হয়।

‘মেহহউইশ এর পরিবারের দ্বায়ভার আমি নিজের কাঁধে নিয়েছি। তার মা ভাই খুব খুশি আর সেই খুশি সে প্রতিদিন একবার করে নিজের মায়ের কথা শুনেই বুঝতে পায়। এ কারণেই মেহউইশ নিজেকে আমার সাথে সারাজীবন আটকে রাখবে। আমাকে স্বামীর মর্যাদাও দিবে আবার নির্জনের মা’ও হবে। তার প্রথম ধাপই ছিলো বোধহয় ওভাবে তোমাকে দেখা।’ রিশাদের কথা শেষ হতেই তিশমা তার হাত ছেড়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

‘তার মানে বলতে চাইছো তোমার বউ তোমাকে সন্দেহ করে আমাকে দেখেছে? রিয়্যালি! মানে তার বরের সাথে কোন নারী কন্ঠ শোনা গেছে বলেই সে ওরকম হুট করে ক্যামেরার সামনে এসে দেখে নিলো মেয়েটা কে! Are you sure Rishad?’

ভীষণরকম অবাক হয়ছে তিশমা। ভালো না বেসেও স্বামীর উপর সন্দেহ করা যায়? কই সে তো দেড় বছর প্রেম করেছিলো তৈমুরের সাথে কিন্তু তৈমুরের অন্য আরো একটি সম্পর্কের কথা জানার পরও তো সে এমন করে তাকায়নি তৈমুরের ওই গার্লফ্রেন্ড এর দিকে যেভাবে মেহ উইশ তাকিয়েছিলো তার দিকে! হঠাৎই মন খারাপ হলো তিশমার। তৈমুরের সাথে প্রেম করেছে ব্রেকাপ করেছে তার তো মন একটুও কেমন করেনি বরং আজ রিশাদের কথা শুনে মেহউইশের তীক্ষ্ণ সেই কয়েক সেকেন্ডের চাহনি দেখে নতুন করে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে খুব। কারো সাথে বাঁধা পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে। মিল নেই, ভালোলাগা নেই তবুও রিশাদের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে এখানেই লুকিয়ে আছে গভীর কোন প্রেমের কাহিনি।

চলবে