মন গহীনের গল্প পর্ব-৫+৬

0
766

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৫
#রূবাইবা_মেহউইশ
________________
দু’হাতে খুব শক্ত করে মেহউইশের গাল চেপে ধরলো রিশাদ। আজ দু দিন গত হলো মেহউইশের জীবন নরকের যন্ত্রণায়। বারবার মনে হচ্ছে সে কোন কিডন্যাপারের হাতে বন্দী যার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে বড় কোন দাম দিতে হবে। সকাল বেলা ভুল করেই সে পাতলা জামা পরিয়েছে নির্জনকে। বাচ্চা পালার কিংবা তাদের কেয়ার করার অভিজ্ঞতা আগে ছিলো না তার। আবহাওয়া কতটুকুইবা বদলেছে! শরৎ শেষ তাতে কি বাতাসে শীতের আভাস একটুও নেই। চারদিকে প্রচুর গরম সেখানে সকাল সকাল এই বাচ্চার শীত লাগে কি গরম সে কি করে বুঝবে!কিন্তু রিশাদ তো কে কি বুঝলো তা শুনবে না । সে শুধু তার আর তার সন্তানের ভালোটা দেখবে বাকিরা যাক জাহান্নামে। এমনই মনোভাবনা তার। সে মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছিলো। নিজের পাশেই নির্জনকে দেখতে পেল সে হাত,পা ছুঁড়ে খেলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একদম পরিপাটি মাত্রই হয়তো কাপড় চেঞ্জ করে ক্রিম মাখিয়েছে। কিন্তু পরনে তার পিওর কটন হাফ হাতা জামা। ঘরে এসির টেম্পারেচার যথেষ্ট শীতল হওয়ায় রেগে যায় সে। যেখানে তার শরীরে এই তাপমাত্রা ঠান্ডা ঠেকছে সেখানে বাচ্চার নিশ্চয়ই আরও বেশি লাগছে! এই ভেবেই সে বিছানা ছেড়ে মেহউইশকে খুঁজলো। মেয়েটা সবে বাথরুম থেকে বের হয়েছে অমনি রিশাদ তার গাল চেপে ধরেছে। এমন ব্যথা মেহউইশ তার ইহজীবনে কখনও পেয়েছে কিনা মনে নেই। আসার পর থেকে চড়, থাপ্পড় এখন আবার এই চেপে ধরা। মাতাল একটা! চোখ ছলছল হয়ে এলো মেহউইশের তবুও রিশাদের ছাড়ার নাম নেই। সে তার ভারী গম্ভীর ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ বাপের জন্মে দেখিস নি বাচ্চা কি করে পালে? আমার ছেলের যদি ভুলক্রমেও স্বর্দি,নিউমোনিয়া কিছু হয় তবে তোদের পুরো গুষ্টি জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেবো।’ সহ্য হলো না কথাটা মেহউইশের সে কোনমতে নিজের বা হাতটা উঠিয়ে চড় মারলো রিশাদের গালে। হতভম্ব হয়ে গেল রিশাদ তবে চড়ের আঘাতে নয়। মেহউইশের চড় তার গালে চামড়াতেও বোধহয় ঠিকঠাক লাগেনি এত ধীরে ছিলো৷ কিন্তু মেহউইশ মানে এই মেয়েটা চড় মেরেছে তা যেন তাকে আশ্চর্য করলো ভীষণ। আচমকা মেহউইশের গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো সে এবং তড়িঘড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এমনটা মেহউইশ আশা করেনি। ভয় হচ্ছে তার ; এত অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব নয়। অযাচিতভাবে জীবনে আসা এই লোকটি হুটহাট তাকে মারবে, অপমান করবে সে কোন দ্বায়ে পড়ে মানবে সেসব!মনে মনে খুব স্বস্তি অনুভব হচ্ছে রিশাদকে থাপ্পড় লাগাতে পেরে যদিও সেই থাপ্পড়ের ওজনে একটা মশাও মরার মত না।

আজও তার পরার মত কাপড় না পেয়ে রাইমার থেকে আরেক সেট জামা নিয়েছে। রাইমা বলেছে তাকে আজকে কিছু শপিং করে দিবে দাদাভাইয়ের অনুমতি নিয়ে। কিন্তু এখানেও সমস্যা সকাল সকাল থাপ্পড় খেয়ে লোকটা যদি না দেয় শপিং করতে? বুদ্ধি এখানেও একটা আছে। এ বাড়ির কারো ফোন নিয়ে ট্রিপল নাইনে কল করে পুলিশ ডাকবে আর নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেবে৷ ইশ, এই বিয়ে শিকল হয়ে পা জড়িয়ে নিয়েছে তার। আজ দুটো দিন গেল মা আর ভাইকে দেখে না আর ইভান! সুক্ষ্ম একটা ব্যথার উদ্রেক হলো বুকের কোথাও ইভান নামটা মনে পড়তেই৷ মানুষটা নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে তাকে খুঁজতে বাড়ি পর্যন্তও এসেছে! চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু এবার গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দিলো৷ ভালোবাসার মানুষটাকে ভেবে তার যেমন বুকে চাপা ব্যথা হয় মানুষটারও হয় নিশ্চয়ই? নির্জন অও অও করে কেমন শব্দ করতেই মেহউইশ নিজের দুঃখজড়িত ভাবনা থেকে ছিটকে পড়লো। এই বাচ্চাটার জন্য মন খুলে দুঃখবিলাসও করা যাবে না! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো তার। বিয়ের আগ পর্যন্ত মেহউইশের বাচ্চা খুব প্রিয় ছিলো কিন্তু গত দু দিনে সে বাচ্চা বলতেই ক্রুদ্ধ । সে জানে এই মাসুম বাচ্চাটার কোন দোষ নেই তার জীবনের এই দুঃসময়ের পেছনে আবার আছেও কিছুটা। বাচ্চাটার মা পালিয়ে না গেলে তার বাবা মেহউইশকে বিয়ে করতো না৷ দূর্ভাগ্য তারও সাথে এই বাচ্চাটারও। তাই মন খারাপ করেই সে বিছানায় গিয়ে দেখলো নির্জন ওরকম অদ্ভুদ শব্দ করলো কেন? ওমাগো! অস্ফুটে মেহউইশের মুখ থেকে বেরুলো নির্জনকে দেখে৷ বিছানায় থাকা ব্লুটুথ নির্জন তার দূর্বল হাতেই তুলে নিয়ে মুখে পুরেছে৷ ভয়ে জান যায় মেহউইশের গলায় না আটকালো আবার! দ্রুত তার মুখ থেকে ব্লুটুথ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালো রিশাদ আসছে না তো? ওই দানবের চোখে পড়া মানেই গালে আবার দু চারটা পড়বে। এত দুঃখ আর সয় না!

রিহান আজ তিনদিন ধরে নানা বাড়িতে আছে। স্কুলে কঠিন কোন পড়া থাকলেই সে এখানে ওখানে যাওয়ার বাহানা করে। এবারও তাই করেছিলো কিন্তু আজ সে সকাল সকাল ফিরে এসেছে। বড় মামীর মুখে আজই শুনেছে দাদাভাই আবার বিয়ে করেছে তাই আর নাশতাটাও করেনি। বাড়িতে পা রেখেই সদর দরজায় দেখা হলো দাদাভাইয়ের সাথে। সে সালাম দিতেই দাদাভাই তার দিকে একবার তাকিয়েই চলে গেল বাইরে। সালামের জবাবটাও নিলো কিনা কে জানে! কিন্তু মুড যে তার প্রচন্ড খারাপ তা বুঝতে পারলো। অন্যসময় তো সালামের জবাব দেয় বরং সে যদি সালাম জোরে না দেয় তবে ধমকে উঠে। থাক এখন আর দাদাভাইকে নিয়ে ভেবে কাজ নেই। প্রথমেই মায়ের ঘরে গিয়ে সালাম দিলো। জেবুন্নেসা চায়ের কাপ হাতে বারান্দার দিকে যাচ্ছিলেন। রিহানের কন্ঠ শুনে বিরক্তি নিয়ে তাকালেন৷ যেন এই মুহূর্তে রিহানের চেহারা দেখার মত অকাজ আর একটিও নেই দুনিয়ায়। তার মতে রিহানও এক কালসাপ যা রাশেদ খানের ঔরসজাত। তবুও নিজেরই গর্ভের সম্পদ বলেই হয়তো ফেলে দিতে পারেন না একেবারে৷ সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘ এত সকালে এসেছিস কেন? আমার বাপ, ভাইয়ের খাবারে তো এতোটাও কমতি পড়েনি যে তোকে এই সাতসকালে চলে আসতে হবে! রিহানের রাগ হলো মায়ের কথা শুনে৷ এখন দাদাভাই বাড়িতে তাও আবার খারাপ মুডে নইলে সে মায়ের এ কথার জবাবে কিছু একটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতো। দাঁতে দাত চেপে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। চোখ মুখ খিঁচে বলল, ‘ ভালো করে কথা না বললে আমার সাথে বলারই দরকার নেই। আমি এসেছি বলতে স্কুলে একটু ফোন করে দিন। কোন একটা সমস্যার কথা বলুন যেন আমি স্কুলে গেলেও ক্লাস টিচার আমায় দাঁড় না করায়। আমি গিয়ে কৈফিয়ত দিতে পারবো না।’

রাগ এবার জেবুন্নেসারও হলো এবং ছেলেকে ঠাটিয়ে এক চড় মারারও প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগলো৷ কিন্তু আফসোস এই কালসাপের বাচ্চাকে মারলে বাপ কালসাপ পর্যন্ত খবর যাবে এবং তখনই কিছু বিশ্রী কথা শুনতে হবে অতীত মিশ্রিত৷ তিক্ত হয়ে উঠলো জেবুন্নেসার মন। এই সংসারে তার থাকা খুবই দুঃখজনক। খাবারে থাকা এলাচের মত বিনাদোষেই তাকে দোষী হতে হয় সবসময়। কখনও ভালোবাসার দাম পায় নি, না ভালোবাসার পরিবর্তে একটু সম্মান পেয়েছে আর না কারো খুশির কারণ হতে পেরেছে। অর্ধেকটা জীবন তার এভাবেই কেটে গেল। রিহান ঘর ছেড়ে চলে যেতেই দু ফোটা অশ্রু গড়ালো জেবুন্নেসার গাল বেয়ে।

সকাল থেকেই আজ মিহাদ জেদ করছে আপির কাছে যাবে৷ আজ নিয়ে তিনদিন হলো মেহউইশের বিয়ে হয়ে গেছে অথচ একদিনও আপির সাথে কথা বলতে পারেনি। বোনের ন্যাওটা মিহাদ তার জন্য খুবই কষ্টদায়ক মেহউইশের কমতি। তার মায়ের জন্যও কম কষ্টের নয় মেয়েকে ছাড়া থাকা কিন্তু ভবিষ্যৎ ভেবেই সে চুপচাপ হয়ে আছে। কালও রিশাদের লোক এসে গেছে তাদের দেখতে এবং বাজার করে দিতে। তবুও ভয় হচ্ছে মেয়েকে নিয়ে। বেশি ভাবতে গিয়ে মেহউইশের ক্ষতি করে ফেলল নাতো আবার! মেহউইশ তো ইভানকে ভালোবাসে কিন্তু এই ভালোবাসাতে কি আর সুখ আসবে? সুখে থাকতে টাকার প্রয়োজন। রিশাদের একটা ছেলে আছে কিন্তু ছেলে মাত্র তিন মাসের। মেহউইশ চাইলেই এই ছেলেকে নিজের মত করে মানুষ করতে পারবে৷ আর শেষ পর্যন্ত মায়ের জায়গাটাও তারই হবে সাথে জামাই পাবে ভালো। ছেলেটা দেখতে কি সুন্দর লম্বা,চওড়া। মানিয়েছে তাদের দুজনকে। প্রেম ভালোবাসায় কি আছে, পেটে টান পড়লো এমন ভালোবাসা পালিয়ে যাবে। মায়ের মন মেয়ের বিপদ ভাবতে ভয় লাগে বলেই এতসব যুক্তিতর্ক করছে নিজেই নিজের সাথে৷ আদৌও কি তিনি চেয়েছেন মেয়েটার বিয়ে রিশাদের মত কারো সাথে হোক! নাহ, তিনি বরং চেয়েছিলেন মেহউইশের বিয়ে ইভানের সাথে হোক। ইভানের মা নেই বাবা আছে আর তিনি মেহউইশের কথা জানেন। ইভানের বড় বোন আর বাবা দুজনেই মেহউইশকে খুব স্নেহ করে। সুখে থাকতো মেয়েটা তার ইভানের সাথে। কিন্তু রিশাদ! কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে ভাবতেই যে লোক দৈত্যের মত এসে তাদের ভয় দেখিয়ে বিয়েটা করেছে সেই লোক কি ভালো হতে পারে? মেহউইশের কোন ক্ষতি না করলেই হয়। কালও ইভান এসেছিলো মেহউইশকে ফিরিয়ে আনতে বলেছে। এ বিয়ে সে মানে না। ঠিকানাও চাইছিলো রিশাদের বাড়ির সে গিয়ে নিয়ে আসবে মেহউইশকে। খুবই চতুরতার সাথে তিনি কথা এড়িয়ে গেছেন। মনটা খুব খচখচ করছে রিশাদ কি আজও মেহউইশের সাথে কথা বলার সুযোগ দেবে না!

আবহাওয়ার পরিবর্তন খুব দ্রুতই ঘটে আজকাল। সকাল থেকে সোনালি তেজহীন রোদ্দুর আর দুপুর পেরুতেই কেমন মেঘে ঢেকে গেছে শহর। সকাল থেকে মনের মধ্যে যে ভয় ছিলো রিশাদ অফিসে চলে যাবার পর তা দূর হয়েছিলো। কিন্তু এখন আবার সেই ভয় ফিরে এসেছে এক দৌড়ে। একটু আগেই রাইমা এসে বলে গেছে তৈরি হতে। তার দাদাভাই মানে ওই দানব শপিং করতে নিয়ে যাবে। নিজের পরনের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে ভালো লাগলো তার। এসব কাপড় পাল্টানোর সুযোগ হবে তাহলে। অন্যের ব্যবহৃত কাপড় সে জীবনেও পরেনি৷ অথচ গত দু দিন ধরে নিজের বলতে তার কোন কাপড়ই ছিলো না। মনে মনে ঘিনঘিন একটা ব্যপার থাকলে বাধ্য হয়েই তাকে রাইমার অমন হাওয়াই শার্ট টাইপ জামা কাপড় পরেছে। আজ আলহামদুলিল্লাহ নতুন কাপড় আসবে৷ ইশ, কত আনন্দ লাগছে নতুন কাপড় পাবে ভেবেই আবার ভয় হচ্ছে ওই লোক পাবলিকের সামনেই আবার মাইর শুরু করবে নাতো! কোন ভরসা নেই যতোটা সুন্দর দেখতে লোকটা ঠিক তার চেয়েও দ্বিগুণ কুৎসিত তার ব্যবহার। হায় আল্লাহ! ওই বাচ্চাকে কোথায় রেখে যাবে? তার পক্ষে সম্ভব নয় ওই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় বেড়োনো। তবুও যদি নিজের সন্তান হতো! হুহ, ওই অসভ্য, দৈত্যের সন্তান তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে! শেষের কথাটা ভাবতে গিয়ে কান্না পেল মেহউইশের। আবার মনে পড়লো ইভানের কথা। কত স্বপ্ন ছিলো তার আর ইভানের। বিয়ে করবে, সংসার হবে নিজেদের জমজ দুটো বাচ্চা হবে৷ সেই দুটো বাচ্চাকে একই পোশাক পরাবে সবসময়। তার স্বপ্নে এক দৈত্য এসে হানা দিলো আর কোলের মধ্যে সতীনের বাচ্চা ধরিয়ে দিলো। বুক ফাটা কান্না বলতে কিছু থেকে থাকলে মেহউইশের এখন তাই করতে ইচ্ছে করছে৷সে অপরাগ মন খুলে কাঁদার জন্যও। এতোটা অসহায়ত্ব যেন কোন শত্রুর জীবনেও না আসে।

বিকেল তিনটায় বের হবার কথা বলেও রিশাদ এলো সন্ধ্যে নাগাদ। পুরো বিকেল সে তার বেস্টফ্রেন্ড রাইসার বাড়িতে ছিলো। রাইসা পেশায় এডভোকেট । রিশাদ প্রায়ই নিজের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো রাইসাকে বলে৷ আজ বলার উদ্দেশ্যে না গেলেও তার মুখ দেখে রাইসা নিজেই অনেক প্রশ্ন করলো। এবং কথায় কথায় বেরও করে ফেলল রিশাদের বিগত কিছুদিনের জীবন সম্পর্কে। রাইসা সব শুনে কিছু উপায়ও বলল তবে সে উপায় এখন নয় কিছুদিন সময় নিয়ে পরেই যেন এপ্লাই করে। মেয়েটার সাথে যা হয়েছে তা জঘন্য ব্যপার। রিশাদ বন্ধু না হলে হয়তো রাইসা নিজেই ওকে পুলিশে দিতো। মেয়েটা এডাল্ট এবং ওভাবে ভয় দেখিয়ে মেয়েটির পরিবারকে রাজী করানোর কারণে অনেক সমস্যাই হতে পারতো রিশাদের। ওই মা, মেয়ে নেহায়েতই অভিভাবকহীন বলেই হয়তো চুপ আছে। রিশাদ গরম মাথার মানুষ রাইসার কথায় রাগ চড়ে গেল। চেঁচিয়ে, ধমকে সে বেরিয়ে গেল রাইসার বাড়ি থেকে এবং যাওয়ার সময় রাইসার দেওয়া চা সহ চায়ের কাপটা ভেঙে দিয়ে গেল। রাইসা হাসলো খুব কারণ, সে জানে তার এই বন্ধুর মাথাটা ঠান্ডা হলে নিজেই আবার কল দিয়ে স্যরি বলবে।

রিশাদ গরম মেজাজ নিয়েই বাড়ি এলো মেহউইশ আর রাইমাকে নিতে। শপিংয়ের কথা সে রাগের মাথায়ও মনে রেখেছিলো। অথবা তার মাথায় অন্য কোন কিছু চলছে যার জন্য এই শপিং করা একটা বাহানামাত্র। বাড়ি এসে নিজের ঘরে গেল সে। মেহউইশের কাজ বলতে সারাক্ষণ বারান্দা কিংবা ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করা। এখনও তাই করছিলো সে। নির্জন একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে তাই তাকে খাইয়ে কাঁধে ফেলে হাঁটছে। ঘর থেকে বারান্দা আর বারান্দা থেকে ঘর। রিশাদ ঘরে ঢুকেই ডাকলো, ‘মেবিশ! ‘

মেহউইশ চমকে তাকালো কিন্তু মনে মনে বলল, ‘শালা শয়তানের দাদা আমার নাম মেবিশ না মেহউইশ। মেহ-উইশ ; অন্নেক সুন্দর একটা নাম অর্থও সুন্দর। কিন্তু তুই শালা মানুষ শয়তান ভালো নাম ভালো করে নিবি কেমনে?’ মনের কথা মনেই রইলো মেহউইশের অত সাহস নেই মুখে বলার৷ রিশাদ আবার ডাকলো তবে এবার মেহউইশের খুব কাছে দাঁড়িয়ে। ভয় হচ্ছে তার কি বলবে এই লোক? এভাবে ডাকছে কেন! রিশাদ এবার আলতো করে কাঁধ ছুঁলো মেহউইশের এবং চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নির্জনকে আমার কাছে দিয়ে তুমি তৈরি হও।’

চলবে

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৬
#রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
বড় বড় শপিংমল গুলোতে কোন একদিন শপিং করবে এমন স্বপ্ন মেহউইশের খুব পুরনো। বাবা বেঁচে থাকতে কত জেদ করতো বাজেট ধরে কেনাকাটা করবে। জামার দাম পাঁচ হাজার জুতো হবে দু হাজার, কসমেটিক হবে তিন হাজার এমন সব বাজেটে ঠিক করতো সে। কিন্তু বাবার সাধ্য অত বেশি ছিলো না। ঈদ এলে দু ভাই বোনের কাপড়,জুতা,চুড়ি,দুল সব মিলিয়ে পাঁচ কি ছয় হাজারেই ঈদ শপিং হতো। অথচ সেই মেহউইশ আজ সতেরো হাজার টাকার একটা শাড়ি কিনলো। শুধু মাত্র হাত রেখেছিলো সে শাড়িটাতে তাতেই তার তিনদিন ধরে হওয়া স্বামী শাড়ি তার নামেই কিনে নিলো৷ এদিকে জুতোও নিলো শখ পূরণ করে পাঁচ হাজার টাকায়। ভাবতেই অবাক লাগে মেহউইশের বাড়িতে পরার জন্য একসাথে আট, দশটা ড্রেস কেনা হয়ে গেছে। অথচ একটা দোকানও ঘোরাঘুরি করতে হয় নি। বিশাল এক দোকানে নিয়ে এলো রিশাদ। দোকানের কাঁচের দরজাটা খুলতেই পারেনি মেহউইশ । অবশ্য সেখানকার গার্ড নিজেই এগিয়ে এসে খুলে দিলো৷ তখন মেহউইশের নিজেকে কোন এক বিশাল প্যালেসের রাণী বলে মনে হচ্ছিলো।স্বপ্ন কি এমন করেই পূরণ হয়! এক স্বপ্নের কাঁধে পা রেখে অন্য স্বপ্ন পূর্ণ হয়? নাকি আগে দেখা স্বপ্নগুলো আগে পূরণ হয়? এতসব বাজেটকরা কেনাকাটার স্বপ্ন তার শৈশবের। কৈশোরে শুধু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতো আর এখন! ভালোবাসার মানুষের সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। রিশাদের ভয়ে ভীত,সন্ত্রস্ত থাকা মনটা আনমনেই চঞ্চল হয়ে উঠলো। মন বলল পূরণ হবে স্বপ্ন সব এক এক করে। এখন এটা পূরণ হচ্ছে পরে নিশ্চয়ই ভালোভাবে খেয়ে,পরে বেঁচে থাকার এরপরই ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকার। ইভান কি ততদিন অপেক্ষা করবে তার জন্য? আর রিশাদ! সে কি মুক্ত করে দেবে? মেহউইশ ভাবনার অতলে ডুবে যাচ্ছিলো। সেই অতল থেকে টেনে তোলার জন্যই বুঝি নির্জন কেঁদে উঠলো। শপিং শেষ হলে আর এক সেকেন্ডেও দেরি করতে চায়নি রিশাদ তাই দ্রুতই বাড়িতে ফিরতে হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো রাস্তাঘাট ডুবে একাকার। শহরতলীর রাস্তায় নিয়ন বাতির হলদে আলোয় বৃষ্টির ফোঁটা কি দারুণ লাগছিলো। ফুরফুরে মনে এক চাপা কষ্ট তখন মেহউইশের চোখে যন্ত্রণার ছাপ।

কাজকর্ম সব যেন মেহউইশের সাথেই শেষ হয়ে গেছে ইভানের। সকাল-সন্ধ্যা মাইমুনা বেগমের কাছে হাতজোড় করেই তার দিন যাচ্ছে । মিহাদটা পর্যন্ত মুখ খোলেনি। ইভান দিকবিদিকশুন্য মানুষের মত উন্মাদ আচরণ করছে। বারবার শুধু মেহউইশের ঠিকানা চাইছে কিন্তু কিছুতেই মাইমুনা মুখ খোলেননি। মেয়ের নতুন জীবন,গোছানো সংসার সামনে সেটা কিছুতেই তিনি নষ্ট করতে চান না। আজও সন্ধ্যা থেকে ইভান বসে আছে মেহউইশের মায়ের কাছে। তিনি আজ আর কথাও বলছেন না। মিহাদ পড়তে বসবে বলে নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছে। সাতটা,আটটা,নয়টা করে দশটা যখন ঘড়ির কাটায় তখন আর ইভান নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করলো এক পর্যায়ে মেহউইশের মায়ের ঘরে যেখানে ইভান বসেছিলো সেই খাটের কার্নিশে রাখা মেহউইশের ফটো ফ্রেমটা উঠিয়ে আছাড় মারলো। কাঁচের হওয়ায় মূহুর্তেই ঝনাৎ করে ভেঙে গেল ফ্রেমটা। সেই কাঁচেই ইভান নিজের হাতের শিরা কাটলো। মাইমুনা ফ্রেম ভাঙার শব্দেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছিলেন৷ ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। বাইরে বৃষ্টির তেজ কম কিন্তু বাতাস অনেক৷ কি করবেন কি করবেন না ভেবে না পেয়ে ফোন নিয়ে মেহউইশের নতুন নাম্বারে ডায়াল করলেন এবং ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই তিনি এক নাগাড়ে বলে গেলেন ইভানের কথা৷ কথা শেষ হতেই ফট করে কল কেটে গেল৷ কিন্তু বিধিবাম, তিনি জানেনই না কথাগুলো কে শুনেছে।যাকে শোনাতে বলছে আদৌও সে শুনেছে কিনা!

রাতে খাবার টেবিলে আসতেই মেহউইশ অবাক হলো বেশ। টেবিল জুড়ে বরাবরের মতোই অনেক পদের খাবার কিন্তু যেটুকু বোঝা গেল বেশিরভাগই মেহউইশের প্রিয় খাবার। চোখ ছানাবড়া একদম এতোগুলো প্রিয় খাবার একসাথে! কিন্তু তার প্রিয় খাবার এভাবে কেন আর এ বাড়িতে কারো জানা নেই তার প্রিয় অপ্রিয় খাবার।নাকি ব্যপারটা কাকতালীয়? তাতে আমার কি! আমি তো পেট পুরে খাবো এখন। মনে মনে এমনটাই ভাবছিলো মেহউইশ। সেই ভাবনার বন্দরে নাও ভিড়িয়ে রিশাদের আগমন৷ আলতো করে কাঁধ ছুয়ে ইশারা করলো বসতে এবং ম্যানারস ফলো করে রিশাদ নিজেই স্ত্রীর জন্য চেয়ার টেনে দিলো নিঃশব্দে। আজ রিশাদের আচরণ মেহউইশের খুবই ভয়ংকর লাগছে। ঝড়ের আগে থম মেরে থাকা আবহাওয়ার স্বরূপ৷ এতোটা পরিবর্তন মেহউইশের দ্বিগুণ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তবুও চুপচাপ বসে পড়লো চেয়ারে। পুরো ডাইনিং স্পেসে নজর বুলিয়ে দেখলো একজন কাজের লোক পর্যন্ত নেই এখানে৷ কি আজব! অন্যসময় খেতে এলেই দু জন মহিলা এপাশে ওপাশে উপস্থিত থাকে। একের পর এক অর্ডার ফলো করে অথচ আজ এত সুনশান ঘুমন্তপুরী লাগছে কেন? মেহউইশ খেয়াল করলো বাড়ি ফিরে আসার পর নির্জনকেও আর তার কাছে দেওয়া হয় নি৷ বরং রাইমা আজ বারবার বলছে নির্জন তার কাছেই থাক৷ মেয়েটাও অনেক আদর করে একমাত্র ভাতিজাটাকে৷ আর সেই সৎ শ্বাশুড়ি! উনি কোথায় আজ? রিহানকেও দেখা গেল না৷ রিশাদ প্লেট এগিয়ে দিলো মেহউইশকে পরে আবার সেই প্লেট সরিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করো না আমি নিজে হাতে খাইয়ে দেবো তোমায়।’ খালি গলায়ই বিষম খেলো মেহউইশ৷ কাওয়ার আগেই গলায় কিছু আটকে গেল। কি আটকালো? ভয়! বাড়ির গত দু দিন সে আবহাওয়া দেখেছে আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ কি! খাবারে কি বিষ আছে? তাকে কি এই দানব আজ মেরে ফেলবে? যে থাপ্পড় সে মেরেছিলো এটাই কি তার প্রতিশোধ । মুভিতে এমন অনেক দেখেছে বড়লোকের ছেলে মেয়েরা প্রতিশোধ নিতে এমন আদর যত্ন করে। সেখানে এমনই বড় বড় ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকে৷ এত চাকর বাকর থাকে। অথচ যখন নায়ক বা নায়িকাকে বিষ খাওয়ায় তখন কাউকে পাশে পাওয়া যায় না।

‘হা করো।’ মেহউইশ যখন ভয়ে মুভির কাহিনি নিয়ে ভাবছিলো তখন রিশাদ খাবার মেখে তার মুখের সামনে ধরলো। সাদা ভাত, গরুর কষা মাংস সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর কচি দেখে কাচা মরিচ প্লেটে। না চাইতেও জ্বিভে পানি এলো মেহউইশের। এমন খাবার খেয়ে মরে গেলেও শান্তি। আহ্! এত সুখ সে কই রাখবে৷

ভয় মনে তবুও হা না করে উপায় নেই। রিশাদের চেহারাটা দারুণ। বাপের কোটি কোটি টাকার কারণেই হয়তো এত সুন্দর ফিটনেস। টাকা থাকলে নাকি বাঘেরও চোখ কেনা যায়। রিশাদের এই রুপ সৌন্দর্যও হয়তো টাকার জোরেই। খেতে খেতে হাজারো ভাবনায় ভাসতে থাকে সে। আর রিশাদ চুপচাপ খাইয়ে দিতে লাগলো। মেহউইশের খাওয়া শেষ হতেই রিশাদ তাকে ঘরে যেতে বলল। সে নিজের খাওয়া হলে ঘরে আসবে। মেহউইশ চলে যেতেই খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল রিশাদও। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দিলো। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই রিশাদ বলল, ‘ যতটুকু খরচ লাগে দিয়ে দাও। ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি। আর কালকের মধ্যে ওদেরও শিফট করো। আর কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায় নতুন ঠিকানা।’

রাত যত বাড়ছে বৃষ্টিও তত বাড়ছে। বৃষ্টির ছাঁটে বারান্দা ভিজে চপচপে। বেখেয়ালে পা পড়লেই পিছল খাবে ভাব। তবুও মেহউইশের ইচ্ছে হলো একটু বারান্দায় দাঁড়াতে। নিজের বাড়িতে দু ঘরের এক ফ্ল্যাটে ঠিকঠাক পা ফেলার জায়গাটুকুও নেই। আর এখানে কি বিশাল বারান্দা,বাথরুম আবার বাড়ির নিচেও কত বড় বাগান। ইশ, মা আর মিহাদ যদি থাকতে পারতো এখানে।বৃষ্টিতে গেছে পুরো শরীর । অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছে একটু শীত শীতও লাগছে। মনের যত দুশ্চিন্তাকে এই বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে একাকার করে দেওয়ার এক অসম্ভব ইচ্ছে জাগছে। সে ইচ্ছেকে পূরণ করতেই বুঝি মেহউইশ তার দুটো হাতই বারান্দার বাইরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আর তখনি অনুভব হলো কোমড়জুরে এক জোড়া শক্ত,পুরুষালী উষ্ণ হাতের ছোঁয়া। এই ছোঁয়া বিশ্রী এতে কামনার আভাস স্পষ্ট। দেহের ভেতর আত্মাটা খাঁমচে ধরলো দেহকে যেন এই মূহুর্তেই কেউ টেনে হিঁচড়ে বের করে নিতে চাইছে তাকে।

চলবে