মন গহীনে পর্ব-২৩

0
384

#মন_গহীনে

#পর্বঃ২৩

#দোলন_আফরোজ

ডিনার শেষ প্রায় আধা ঘণ্টা আগে, কাব্য ডিনার করেই রুমে এসেছে কিন্তু তিথীর ফেরার নাম নেই। ডিনার টেবিলেও চুপচাপ ছিলো একদম।চঞ্চল চটপটে একটা মেয়ে এভাবে চুপ হয়ে গেলো তা সবার চোখেই পরেছে। মেধার তখনকার বলা কথাটা হয়তো সে সিরিয়াসলি ই নিয়েছে। নেয়ার ই কথা, মেধাকে তো আর তিথী চেনে না, তাই মেধা যে ফান করে কথাটা বলেছে তা তার বুঝার কথাও না।মনে মনে মেধাকে হাজার টা গালি দিচ্ছে কাব্য। কই বউ টার সাথে তার সম্পর্ক ভালো করে দিবে তা না করে উল্টো সব বিগড়ে দিচ্ছে। এমন বন্ধু থাকার চেয়ে যেনো শত্রু থাকাও ভালো।
এতো কিছুর পর ও কাব্য মনটা বেশ ভালোই লাগছে। তার পিচ্চি বউ টা মেধাকে দেখে জেলাস ফিল করছে। আনমনেই হাসে কাব্য।

তা ম্যাডাম কই এখনো? উনার অপেক্ষায় যে কেউ একজন চাতক পাখির মতো বসে আছে এই বোধ টা কবে হবে পিচ্চিটার। এভাবেই আরো ২০ মিনিট এর মতো কেটে গেছে। রাত ১০.৩৮ বাজে। নাহ আর অপেক্ষা করা যায় না। ভালোই রাগ করেছে বউ টা, রাগ করে আর ঘরেই আসছে না দেখছি। এসব ভেবেই নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তিথীকে খুঁজতে। হিয়ার রুম, ফুফির রুম সব রুমে দেখে, কোথাও পায় না।
মেধার রুমে যাওয়ার কথা না, তবে কোথায় গেলো?

কি মনে করেই কাব্য বাবা মার রুমে উঁকি দেয়। শাহানারা বেগম পানের বাটা নিয়ে বসেছে, আর তিথী সেলিম সাহেব এর পাশে বসে গল্প করছে। গল্প করতে করতেই সেলিম সাহেবের চশমা টা নিয়ে তার চোখে পড়ে দেখে। মাথা একটা চক্কর দেয়ার ভংগীতে মাথায় হাত রেখে হালকা ঘোড়ায় মাথাটাকে। তারপর চোখ বড় বড় করে বলে বাবা তোমায় দুটো দেখাচ্ছে, মামনী তোমাকেও।
তিথীর এরুপ কান্ডে সেলিম সাহেব শাহানারা বেগম দুজনেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আচ্ছা বাবা তুমি কি সবকিছু দুটো করে দেখবে বলেই চশমা পরো?

এমন কথা শুনে সেলিম সাহেব এর হাসি দুগুণ বেড়ে যায়। পাগলি মেয়ে বলে তিথীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। শাহানারা বেগম একমনে দেখে যাচ্ছে সেলিম সাহেব আর তিথীর কান্ড। উনি কল্পনাও করেননি সেলিম সাহেব এতো দ্রুত আপন করে নিবেন তিথীকে। আসলে তিথী মানুষ টাই এমন, কেউ ওকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।
ওদের কথার মাঝেই সেলিম সাহেব খেয়াল করেন কাব্য রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দরজার দিকে তাকিয়ে তিথীকে বলে অনেক রাত হয়েছে এবার শুয়ে পড়ো গিয়ে।
তিথী ও উনার চোখ অনুসরণ করে দরজায় তাকিয়ে কাব্য কে দেখে মুখ ভেংচি করে বলে ঘুম পাচ্ছে না আমার।

সেলিম সাহেব এর চোখে চোখ পড়তেই কাব্য চলে যায়। তিথী এখন না আসতে চাইলেও যে শাহানারা বেগম জোর করে পাঠাবে তাকে তা ওর ভালোই জানা।তাই সোজা রুমে চলে যায়।

হিয়াপু কি করো?( হিয়ার রুমে উঁকি দিয়ে)

পড়ছি, ভিতরে আসো।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, উহুম আসবো না। অনেক পড়া বাকি তোমার?

কিছু বলবে?

উহুম, ভালো লাগছে না। ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে। মন খারাপ করে।

বই বন্ধ করে, নাহ আর পড়া নেই, চলো। বলেই উঠে তিথীর হাত ধরে ছাদে চলে যায়।

ছাদে গিয়ে দুজন চুপচাপ বসে আছে।কেউ কোনো কথা বলছে না। হিয়া ই বলে উঠে ভাবি তোমার কি মন খারাপ?

উপর নিচ মাথা করে, হুম।

কি হয়েছে?

এবার বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে তিথী।

হিয়া অস্থির হয়ে তিথীকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এই ভাবি, কি হয়েছে, বলোনা? টেনশন হচ্ছে আমার খুব।

ফুঁপিয়ে নাক টেনে বলে, মেধা আপুকে আমার পছন্দ না। ভালোলাগে না ওকে আমার।

থম মেরে যায় হিয়া। বলছে কি এ মেয়ে। যা কেউ বুঝেনি এতো বছরে তা এই মেয়ে কি দুদিনেই বুঝতে পেরেছে?কি হয়েছে ভাবি? সবটা বলো আমায় প্লিজ।

তিথী সবটা বলে হিয়াকে।মেধার সাথে দেখার হওয়ার পর থেকে ওর সাথে বলা কথা গুলো বস বলে তিথী।
তোমার ভাই ওর মেধা বলতে অজ্ঞান। যে ছেলে কোনো দিন কোনো মেয়ের সাথে দুটো কথা বলে না তার কেনো মেয়ে বন্ধু থাকবে বলো? আমার ভালোলাগছে না কিছুই।ঐ মেধাকেই ভালোবাসে তবে আমাকে কেনো জোর করে বিয়ে করলো?

ভালোবাসো ভাইয়াকে?

উহুম মোটেও না। ভিলেন একটা। কোনোদিন ও ভালোবাসবো না।

হাসে হিয়া।
এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলো হিয়া।
ভাবি আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো যা তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আশা করি তুমি এতোটাও ছোট না যে আমার কথা বুঝবে না। ভাইয়া তোমাকে খুব খুব খুব ভালোবাসে। তার জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি তুমি। আর তার জীবনের একমাত্র নারী ও তুমিই। এক্সিডেন্টলি মেধা আপু ভাইয়ার জীবনের সাথে জুড়ে গেছে, তবে ভাইয়া নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে সব সময়। যদিও মেধা আপু তার চেয়ে বেশি ই ভেবে নিয়েছে। মেধা আপুর ভাইয়ার এতো কাছে আসতে অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছে। আমার মনে হয়ে সে এতো সহজে তার যায়গা ছাড়বে না। এক কথায় বলতে গেলে মেধা আপু ভাইয়াকে ভালোবাসে, আর তা যদি ভাইয়াকে কেউ বলে সে কক্ষনো বিশ্বাস করবে না। কারণ মেধা আপুর ভাইয়ার সাথে বন্ডিং টা অন্যরকম। তাই আমিও আগ বাড়িয়ে কখনো যাইনি ভাইয়াকে এসব বলতে। আর তাছাড়া ভাইয়ার সাথে আমার তেমন একটা কথা ও হয় না। ইনফেক্ট মেধা আপু ছাড়া ভাইয়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে তেমন কথা ও বলে না।

হিয়ার কথা শুনে তিথী পুরো ফ্রিজ হয়ে গেছে। কোনো কিছু বলার ভাষা তার নেই। শুধু বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছে। আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। এখন আর শব্দ করে কাঁদছে না সে।

তিথীর এমন অবস্থা বুঝতে পেরে হিয়া ওর দুবাহুতে হাত দিয়ে বলে, আমি আবারো বলছি ভাইয়ার জীবনের একমাত্র নারী তুমি। তুমি চাইলেই সব করতে পারো, আর ভাইয়াকে নিয়ে অন্তত তুমি সিকিউর। কথা গুলো বললাম শুধু মেধা আপু তোমার ক্ষতি করতে পারে তার থেকে সতর্ক থাকার জন্য।

এদিকে ঘড়িতে রাত সাড়ে ১১ টা প্রায়। তিথীর কোনো দেখা নাই। কাব্যর মেজাজ এখন আর তার কন্ট্রোলে নেই। কই ভেবেছিলো তখনই তিথী রুমে আসবে না তার কোনো খবর ই নাই।

আবারো সব রুমে উঁকি দিয়ে দেখে কোথাও নেই। হিয়ার রুমেও কেউ নেই, লাইট জ্বলছে। বুঝতে পারে হিয়া তিথী একসাথেই আছে আর তা হয়তো ছাদে। তাই কাব্য ও ছাদে চলে যায়। কাব্য কে আসতে দেখেই হিয়া নিচে নেমে যায়। তিথী যেতে নিলে হাত ধরে ফেলে কাব্য। হেচকা টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় তাকে।

নেশালো কন্ঠে বলে, একে তো ঘরে থাকো কাছে থাকো না, আর আজ ঘরেও যাচ্ছো না। কি হয়েছে তোমার?
এতোক্ষণে তিথীর কোমড় জড়িয়ে আছে কাব্য।

কাব্যর এতোটা কাছে এসে তিথী যেনো কথার তাল হারিয়ে ফেলেছে৷ কাব্য কে সরানোর জন্য হালকা ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করতেই আরো চেপে ধরে সে।
কেনো কষ্ট দাও পাখি? আমি তো দূরেই থাকতে চাই তুমি ই তো বার বার বাধ্য করো কাছে আসতে।

কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ছাড়ুন প্লিজ নিচে যাবো আমি।

কাঁদো কাঁদো কন্ঠ শুনে ঘাবড়ে যায় কাব্য। চাঁদের আবছা আলোয় তিথীর মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে। চোখ দুটো ফোলা, নাক টাও মনে হয় লাল হয়ে আছে। বাঁধন আরো শক্ত করে চোখে মুখে চিন্তা নিয়ে খুব বেশি অভিমান হয়েছে আমার উপর?

চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তিথীর।
কাব্য তা মুছে দিয়ে, এ চোখ থেকে পানি ঝড়ানোর জন্য নিজের করিনি। যা কষ্ট যা দুঃখ সব আমার সাথে ভাগ করার জন্যই করেছি আমার।
বলে তিথীর কোমড় ছেড়ে দেয়।

তখনই তিথী কাব্যর কলার চেপে ধরে পা দুটো উঁচিয়ে কাব্যর চোখে চোখ রেখে বলে মেধার আশেপাশে যেনো কক্ষনো যেতে না দেখি, দেখলে পা ভেংগে দিবো।

তিথীর এমন কান্ডে প্রথম ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও তারপর হাসে কাব্য।
Why? R u feeling jealous? এক ভ্রু উচিয়ে।

Yes i m feeling jealous dam it.রাগে ফুস ফুস করতে করতে।

এবার কাব্য বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে আবারো কোমড়ে হাত দিয়ে ওর সাথে আরো মিশিয়ে বলে
why r u feeling jealous?

রাগে তিথী যেনো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কাব্যর কলার আরো জোরে চেপে ধরে বলে Because she loves u.

এবার ভ্রু কুঁচকায় কাব্য। তুমি তো বাসো না, তবে মেধা বাসলে সমস্যা কি? কেউ একজন তো এই অভাগা কে ভালোবাসে। বাঁকা হেসে।

আমিও ভালোবাসি না আর কাউকে ভালোবাসতেও দিবো না। জানে মেরে ফেলবো একদম। বলেই গলা চেপে ধরে। এমন জোরে ধরে যে কাব্যর শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কোমড়ের বাঁধন হালকা হয়ে আসছে।
তখন তিথীর হুস ফিরে। কাব্যকে ছেড়ে দিয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুড়িয়ে বলে স্যরি মাথা ঠিক ছিলো না আমার।

কাব্য ওভাবে ধরে রেখেই বলে এতোটা ডেসপারেট? আই কান্ট বিলিভ। রিয়েলি ইটস ইউ? নেশালো কন্ঠে।

এবার বেশ লজ্জা পায় তিথী। নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, স্যরি তো।

মাথা খুব গরম হয়ে গেছিলো?

তিথী চুপ।

চলো আইসক্রিম খেয়ে আসি বাইরে থেকে।

লাফিয়ে উঠে তিথী। আইসক্রিম বরাবর ই তার পছন্দের। কিন্তু এতো রাতে?এখন তো ১২ এর বেশি বাজে।

তাতে কি, আমার বউ এর মাথা ঠান্ডা করতে হবে তো নাকি?

ছাড়ুন তবে। মাথা নিচু করে।

কাব্য হালকা হেসে ছেড়ে দেয়। এরপর বেড়িয়ে যায় আইসক্রিম পার্লার এর উদ্দেশ্যে।

**************

কলেজ ছুটির পর তিথীকে বাসার সামনে নামিয়ে বাইরে গেছে কাব্য। বাসায় ঢুকতেই মাংসের সুঘ্রাণ রান্নাঘর থেকে আসছে। তিথী শাহানারা বেগম কে ডাকতে ডাকতে রান্না ঘরে ঢুকে। রান্নাঘরে হেনা বেগম, অর্না আর মেধা আছে।

কি রান্না করছো গো ফুপ্পি? সেই স্মেইল বেরুচ্ছে।(তিথী)

কাব্যর পছন্দের কালা ভুনা করছি।(মেধা)

তিথী গিয়ে হেনা বেগম এর পাশে দাঁড়ায়।

তখন অর্না মেধাকে বলে, তোমার সব গুন ই আছে মেধা। যেমন পড়ালেখায় ভালো তেমন দেখতেও, আর তোমার রান্নার হাত কতো ভালো। তুমি যেই বাড়ির বউ হবে তারা খুব লাকি হবে গো।
আর কিছু মানুষ তো আছে শুধু সাদা চামড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর কোনো গুন নেই। সারাক্ষণ শুধু পারে মানুষ কে ইরিটেট করতে আর ন্যাকামো করতে। মাকালফল একটা।( কথা গুলো আড় চোখে তিথীর দিকে তাকিয়ে বলে)

তিথী আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সেখানে। নিজের রুমে চলে আসে।

খাওয়ার টেবিলে সবাই একসাথে বসেছে। আজ সেলিম সাহেব আর কায়েস ও আছে। এখন কাব্য সেলিম সাহেব এর সাথে এক টেবিলে বসে খায়, তবে কথা বলেনা। সেলিম সাহেব টেবিলে বসে তিথীকে না দেখতে পেয়ে হিয়াকে পাঠায় তিথীকে ডেকে আনার জন্য। কাব্য আগেই ডাইনিং এ ছিলো। সবাই একসাথে খেতে বসে। তখন মেধা গরুর কালা ভুনার বাটিটা এনে কাব্যর পাশে রাখতেই কাব্য বলে, ওয়াও কালা ভুনা!😯
তোর হাতের কালা ভুনাটা হেব্বি হয়। তাতে সবাই সহমত পোষণ করে। নিজের প্রশংসা শুনে মেধা বেশ লজ্জাই পায়।

আচ্ছা আচ্ছা প্রশংসা না করে খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।

সেলিম সাহেব বলেন, কেমন আর হবে, বরাবর এর মতোই অসাধারণ। কাব্য বাদে সবাই হাসে।

তিথী মুখ ঘোমড়া করে বসে ভাতের প্লেটে আংগুল বুলাচ্ছে শুধু।
সবাই খাওয়া শুরু করেছে। তিথী ভাতের সাথে শুধু ডাল নিয়েছে খাওয়ার জন্য।

কাব্য কালা ভুনা খেয়ে বলে আজ ও অসাধারণ হয়েছে। কায়েস ও তাই বলে। কিরে কি দিয়ে রান্না করিস এর কালা ভুনা? অর্নাকেও শিখিয়ে দিস তো।

মেধা বলে, রান্নাতে তেমন স্পেশাল কিছু দেই না। ভালোবাসার মানুষের জন্য শুধু উজাড় করা ভালোনাসা দেই তাতে। কথাটা সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিলেও হিয়া আর শাহানারা বেগম স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি।

তিথী তৎক্ষনাৎ খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তিথী সব সময় সেলিম সাহেব এর পাশের চেয়ার টাই বসে। সেলিম সাহেব বলে, কি হয়েছে মা? উঠলে কেনো? একি তুমি শুধু ডাল নিলে কেনো?

ভিষণ মাথা ব্যথা করছে বাবা, খেতে ইচ্ছে করছে না। রুমে যাই আমি। বলে সোজা ঘরে চলে যায়। হিয়া বুঝতে পারে ব্যাপার টা।

কাব্যর এবার হুস ফিরে। সে জানে তিথী মেধাকে পছন্দ করে না, তবু মেধার প্রশংসা করলো সে, যা তিথীর ভালো লাগেনি।তাই সে না খেয়েই উঠে গেছে।
কাব্যর গলা দিয়ে আর খাবার নামেনি। সেও কিছুক্ষণ খাবার নেড়ে না খেয়েই উঠে যায়। তা চোখ এড়ায়নি মেধার।

আজ পাঁচ দিন যাবৎ তিথী ইউ টিউব দেখে শুধু কালা ভুনা ই শিখছে। তার সারাদিন পড়াশোনা শেষে একটায় কাজ, ইউ টিউব দেখে রান্না শিখা। আজ ফ্রাইডে, সবাই বাসায় থাকবে। তাই আজ ই তিথী কালা ভুনা রান্না করবে প্ল্যান করেছে। আর তা শুধুই যে কাব্যর জন্য তা আর বলতে। সকাল থেকেই তিথী রান্না ঘরে আছে। শাহানারা বেগম হেনা বছর বেগম বার বার নিষেধ করা সত্বেও তিথী রান্না করতে গেছে। প্রায় ৩/৪ ঘন্টা কাটিয়ে রান্না করেছে সে কালা ভুনা। যা পুড়ে একেবারে কয়লা। আর রান্নাতে স্বাদ এর স্ব ও নেই। তিথীর মন টা ভেংগে খান খান হয়ে গেছে। সে আর কথা না বলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে কান্না করতে থাকে।
আমি সত্যিই মাকাল ফল। কিচ্ছু হবে না আমাকে দিয়ে।

তিথীর রান্নার এই অবস্থা দেখে মেধা আবারো কালা ভুনা করে সবার খাওয়ার জন্য। কারণ তিথীর খাবার টা তো আর মুখে নেয়ার মতো না।

কাব্য ঘরে এসে দেখে তিথী নেই। বাথরুম থেকে আওয়াজ আসায় বুঝতে পারে তিথী বাথরুমে আছে।

তিথী বেরুও তারাতাড়ি, সবাই খাবার নিয়ে বসে আছে।

কান্না আটকে রেখে কোনোমতে বলে, আপনি যান, আমি আসছি।

আসছি না, এসো এক্ষুনি। আমি ওয়েট করছি। বলে বাথরুমের দরজায় হাত রেখেই দাঁড়ায়। প্রায় ১০ মিনিট পার হয়ে গেছে এখনো বেরুইনি তিথী।
কি হলো? দাঁড়িয়ে আছি তো!

আপনাকে যেতে বললাম তো নাকি?

আমি তো বলিনি তোমায় ছাড়া যাবো। এক্ষুনি বেরুও।

চোখ মুছে চোখে বেশি করে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বেরুই তিথী।

কি হলো চোখ এমন লাল দেখাচ্ছে কেনো?

অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়েছি তো তাই।

এতোক্ষণ শাওয়ার নেয়ার কি দরকার ছিলো? ঠান্ডা লাগে যদি এখন।

লাগবে না, চলুন বলে বেড়িয়ে যায় তিথী।

খাওয়ার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে তিথী কাব্যর জন্য। ওরা নিজ নিজ চেয়ারে বসে। খাবার সার্ভ করে শেফালী।
কায়েস বলে ওমা আজ ও কালা ভুনা?বলে কালা ভুনার বাটিটা নিজের কাছে নেয়।

এদিকে অর্না মুচকি মুচকি হাসছে। কায়েস হালকা ধমক দিয়ে বলে কি হলো হাসছো কেনো?

অর্না হাসতে হাসতেই তিথীকে বলে, তিথী তোমার স্পেশাল কালা ভুনাটা কই? ওটা দিলে না কাব্যকে?

কাব্য অবাক হয়ে তাকায় তিথীর দিকে। তারপর অর্নার দিকে তাকিয়ে বলে তিথীর কালা ভুনা মানে?

এমা জানো না? তোমার বউ তোমার জন্য স্পেশাল কানা ভুনা রান্না করেছে।

কাব্য আবারো অবাক হয়ে তাকায় তিথীর দিকে। সত্যি?

তিথী মাথা নিচু করে আছে। কাব্য শেফালী কে বলে, কই তিথীর রান্না করা কালা ভুনাটা নিয়ে আসো।
তিথী শেফালী কে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে আনতে। শেফালী নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে কাব্য ধমকে উঠে। শাহানারা বেগম বলে থাকনা খোকা। ভালো হয়নি, তাই তিথী ই আনতে না করছে।

কাব্য আরো জোরে বলে আমি আনতে বললাম তো নাকি। শেফালী ভয়ে দৌঁড় লাগায় রান্না ঘরে। সাথে সাথেই তিথীর রান্না করা কালা ভুনার বাটি নিয়ে আসে।

তখন তিথী চিৎকার করে উঠে প্লিজ খাবেন না এটা।
কাব্য চোখ রাংগিয়ে তাকায় তিথীর দিকে, তারপর বাটি থেকে নিয়ে চুপচাপ খেতে থাকে। সবাই হা করে কাব্যর খাওয়া দেখছে। মেধা তো রাগে ফুসফুস করছে। খেতে খেতে বাটি প্রায় অর্ধেক করে ফেলেছে কাব্য। তখন সেলিম সাহেব বলে আমার মেয়ে রান্না করেছে আমাকে অন্তত এক পিস দাও। তখন তিথী সেলিম সাহেব এর হাত চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে প্লিজ বাবা।
আচ্ছা একপিস ই খাবো। বলে একপিস নেয় সেলিম সাহেব। মুখে দিয়ে দেখে একে তো পোড়া গন্ধ তার উপর জন্মের ঝাল। কষ্ট করে শেষ করে উনি বলেন প্রথম বারের মতো খুব একটা খারাপ হয়নি।

সেলিম সাহেব খাওয়াতে অর্নার রাগ বেড়ে যায়। সে বুঝে না এই মেয়েটাকে এতোটা প্রায়োরিটি দেয়ার কি আছে।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তিথী। আর ভাবছে কি করে খেলো কাব্য এই কালা ভুনা। তখন কাব্য এসে তার পাশে দাঁড়ায়। তিথী বলে কেনো কষ্ট করে খেলেন ঐ অখাদ্য?

কে বলেছে অখাদ্য? আমার বউ আমার জন্য প্রথম রান্না করেছে, তা আমার জন্য অমৃত ছিলো। পুরোটা কেনো খাইনি জানো? বাকি টা রাতে খাবো।

আপনি আবার খাবেন এটা?

অবশ্যই। এতোটুকুও ফেলতে দিবো না আমি।কেনো রান্না করলে বলো? ভালোবাসো? বলেই হাত ধরে টান দেয় তিথীর।

আহহহহহ বলে চিৎকার করে উঠে তিথী।

কি হলো বলে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে হাতের অনেকটা পুড়ে গেছে তিথীর। এত্তো বড় ফোসকা পড়ে গেছে।
কাব্য অস্থির হয়ে বলে, কি করে হলো?

চুপ করে আছে তিথী।

কাব্যর আর বুঝতে বাকি নেই কিছু। অগ্নিচক্ষু করে তাকায় তিথীর দিকে। আমি তোমায় বলেছিলাম রান্না করতে?

এবার তিথী কেদে দেয়। ফুপিয়ে বলতে থাকে কিচ্ছু পারি না আমি, সারাক্ষণ সবাইকে ইরিটেট করি, ন্যাকামো করি। সত্যিই মাকাল ফল আমি, সবাই ঠিক ই বলে। কোনো গুন নেই আমার।

হাত ধরে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে বলে, কে বলেছে তোমাকে এসব কথা?

চোখ মুচতে মুচতে বলে, কেউ বলেনি কিছু। আমিই বললাম, মেধা আপুর কতো গুন। রান্না করতে পারে, ভালো পড়াশোনাও করে আবার দেখতেও তো অনেক সুন্দরী।

হাতে ঔষধ লাগাতে লাগাতে, তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি কার সাথে নিজের তুলনা করছো? আমার কাছে তোমার কোনো তুলনা হয় না। তোমার তুলনা শুধুই তুমি।আর কক্ষনো রান্না করতে যাবে না তুমি। আমার এতো গুনবতী বউ এর দরকার নেই। আমার এই ন্যাকা ন্যাকা ইরিটেটিং পিচ্চি বউ ই পছন্দ।

রাতে তিথীর গোংরানির আওয়াজে ঘুম ভাংগে কাব্যর।উঠে তিথীকে ডাকতে গিয়ে দেখে তিথীর গায়ে খুব জ্বর। অস্থির হয়ে যায় সে। উঠে গিয়ে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেয় তিথীকে। জ্বর না কমায়, মাথায় জলপট্টি দেয় প্রায় ১ ঘন্টার মতো। জ্বর ছেড়েছে কিছুটা। হাতের পোড়ার ব্যাথার জন্যই জ্বর এসেছে। হাত টা কাব্য নিজের হাতে নিয়ে আলতো চুমু দিয়ে নিজে নিজেই বলে কেনো করতে গেলে পুতুল বউ। তোমার হাত টা জ্বালা করছে আর আমার যে বুকের ভিতর টা। কেনো করলে এই পাগলামোটা। তিথী ঘুমের ঘোরেই ঝাপটে ধরে কাব্যকে। কাব্য টেবিল ল্যাম্প টা নিভিয়ে দিয়ে তিথীর পাশে শুয়ে পড়ে। কাব্য শুয়ার পর তিথী ওর বুকে গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে পরে।কাব্য পরম যত্নে বুকের ভিতর লুকিয়ে নেয় তিথীকে। এই বুকে সারাজীবন এভাবে রাখতে চাই তোমার পুতুল বউ। কেনো সেই সুযোগ টা দাও না বলো? ঠিক ই ভালোবাসো, শুধু মুখে বলো না। যতোদিন না তুমি মুখে বলবে ততোদিন আমি তোমায় চাইবো না আপন করে। আমি অপেক্ষা করবো। অপেক্ষা টা যতোই দীর্ঘ হোক না কেনো।




চলবে…..