মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-১০+১১

0
482

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১০
🌸

জায়িন চলে যেতে চাইলেও তাকে যেতে দেওয়া হলো না। মাহিমা বড় খালামনি আর প্রিয়া আপুকে নিয়ে তাদের বাড়িতে গেছে। বোনের ভয়েই আবির বাড়ি যাচ্ছে না। তনি রুম থেকে বেরিয়ে এসে জায়িনকে দেখে খুশিতে ওকে কোলে তুলে নিতে পারল না শুধু।

“জায়িন তোর মনে আছে আমরা একসাথে কত দুষ্টুমি করেছি। টাইগার ম্যামের কথা মনে আছে?”

“আচ্ছা তোদের কি মনে হয় কয়েক বছর এলাকার বাইরে থেকে আমি সব ভুলে গেছি?”

“না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুই পর হয়ে গেছিস।”

“তোরা এমন মনে করলে আমার তো কিছু করার নেই। কিন্তু আমি তোদের পর করিনি।”

“মেডিক্যালে তোর অনেক নতুন ফ্রেন্ড হয়েছে না? এই তুই প্রেম করিস?”

“সময় কই?”

“কাউকে পছন্দ তো করিস নাকি? এখন এটা বলিস না পছন্দও করিস না। তুই বেডা মানুষ ভাই। তোর তো কোন সমস্যা নেই।”

তনির কথা শুনে আবির একচোট হাসলো। জায়িন অস্বীকার করল না। মাথা নেড়ে জানালো পছন্দের একজন আছে। তনি কৌতূহলী হয়ে জায়িনের কাছে চেপে বসে বলল,

“কে রে মেয়েটা? তোর ব্যাচমেট? সিনিয়র? জুনিয়র? মেডিকেলের মেয়ে নিশ্চয়। আমি জানি মেয়েটা তোর সাথেই পড়ে। বল না।”

“তুই তো আগে এত কথা বলতি না। হুট করে এমন বাচাল হয়ে গেলি কেন?”

আবিরের হাসি আরও বেড়ে গেল। তনি কনুই দিয়ে ওর পাঁজরে খোঁচা মারল।

“তুই সবসময়ই এমন কম কথা বলতি। এখনও স্বভাব পরিবর্তন করতে পারলি না?”

“মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয়না।”

“এত কম কথা বললে গার্লফ্রেন্ড ভেগে যাবে। বল না মেয়েটা কে? পিক আছে নিশ্চয়। দেখা না।”

“একদিনে বেশি জেনে ফেললে বদহজম হয়ে যাবে।”

আবির জায়িনের সামনেই তনিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল,

“তুই বুঝতে পারছিস না জায়িন ওর গার্লফ্রেন্ডকে আমাদের কাছে সিক্রেট রাখতে চাচ্ছে। বেচারা দেখাতে চাচ্ছে না। তুই জোর করে যাচ্ছিস।”

তনি ঠোঁট উলটে বলল,

“বন্ধুদের মাঝে সিক্রেট কিসের?”

জায়িন অনেকটা বিস্মিত হয়ে ওদের দেখলে আবির বলল,

“চোখ অমন বড় বড় করেছিস কেন শালা। তুই তো বলবি না। কিন্তু আমরা কি তোর মতোন? তিন বছর ধরে রিলেশন করছি। শীঘ্রই বিয়ের দাওয়াতও পেয়ে যাবি।”

ইভান অফিস থেকে বাড়ি ফিরে জায়িনের সাথে হালকাপাতলা কথা বলে ফ্রেশ হতে গেল। রাতে খাবার টেবিলে সবাই এলেও মীরা আসেনি দেখে ইভান জিজ্ঞেস করল,

“মীরা আপার খাওয়া শেষ? আমাকে রেখে খেয়ে ফেললো আজ!”

আবির খেতে খেতে জবাব দিল,

“আমাকে ও ভাইয়ের লিস্ট থেকে কেটে দিয়েছে। তাই আমার সামনে আসবে না।”

“না আসাই উচিত। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের মন ভেঙেছিস। নিয়ে যেতে পারবি না তাহলে আশা দিয়েছিলি কেন?”

“আমি তো তোর আশায় ওদের আশা দিয়েছিলাম। তুই-ই তো গেলি না।”

“মীরা মাহির এক বছর তোর সাথে কথা না বলা উচিত।”

জায়িন ওদের কথা শুনতে শুনতে চুপচাপ খাচ্ছে। ইভানের মা জোর করে জায়িনের পাতে বেশি বেশি মাংস তুলে দিচ্ছে। জায়িন না করলেও শুনছে না। তনি একটা হাড্ডি খেতে খেতে বলল,

“আরে লজ্জা পাস না। তুই তো ঘরেরই ছেলে। পেট ভরে খা।”

ইভান বড় ফুপুকে না দেখে বলল,

“বড় ফুপু কই? মাহিও কি চলে গেছে?”

“আমাদের বাড়িতে। এইজন্যই তো আমি তোদের বাড়িতে। মাহিটা পাগলা কুত্তা হয়ে আমাকে কামড়ানো জন্য খুঁজছে।”

“মীরা যে তোকে এতক্ষণেও কামড়ে দেয়নি এটা তোর ভাগ্য।”

“ওকে ডাক না। তোর ডাকে আসবে। নুন ছাড়া তরকারি যেমন বিস্বাদ লাগে। মীরাবাঈকে ছাড়া আমাদের আড্ডা তেমন বিস্বাদ।”

“তুই ডাক। দেখি পরিস্থিতি কতটা গরম।”

আবির গলা উঁচিয়ে ডাকলো।

“মীরা আপু, আপনার পছন্দের চিংড়ি মাছ আমি একাই খেয়ে ফেলছি। আপনি খাবেন না?”

সাথে সাথে মীরার জবাব এলো।

“মিথ্যাবাদী মানুষের সাথে আমি কথা বলি না। সব খেয়ে ফেলে তোমার মামাদের ফকির করে ফেলো। আমার কিছু আসে যায় না।”

ইভান হাসতে হাসতে বলল,

“বাব্বাহ! মাথা অনেক গরম।”

ইভান মীরার মন ভুলিয়ে ওকে খাবার টেবিলে আনতে বলল,

“ভাবছিলাম এপ্লাস পাওয়ার আগেই ফোন কিনে দিব। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ফোনটা তার লাগবে না। যাক আমার অনেকগুলো টাকা বাঁচল। জানিস আবির, কালই যেতাম।”

ইভান এরকম ভাবে বলেছে যেন মীরা ঘরে বসেও ওর কথা শুনতে পায়। ঠুস করে মীরার ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। সে কোনদিকে না তাকিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছে। ইভান বলল,

“আস্তে। পড়ে গেলে দাঁত ভেঙে যাবে।”

মীরা ফোনের কথা শুনে খুশি হয়ে দৌড়ে এসেছিল। কিন্তু খাবার টেবিলে অপ্রত্যাশিত এই মানুষটাকে দেখে তার মুখ থেকে খুশি চলে গেল। ইনি এখানে কেন? মীরা কি চোখের ভুল দেখছে। মীরা ধীরে করে ইভান ভাইয়ের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। আবির ইচ্ছে করে মীরাকে রাগিয়ে দিতে বলল,

“এইচএসসি পাস করলে কক্সবাজার নিয়ে যাব। প্রমিজ।”

“আমি আর জীবনেও কক্সবাজার যাব না।”

“হায় আল্লাহ! আমার সাথে রাগ করে বরের সাথেও যাবি না?”

মীরা কটমট চোখে আবিরের দিকে তাকাল। বাইরের মানুষের সামনেও এসব কথা বলতে হবে?
আবির মীরার চোখের শাসন বুঝলে তো চুপ করত। সে বলেই যাচ্ছে।

“মীরাকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিব যে মীরাকে নিয়ে দেশবিদেশে ঘুরবে। কক্সবাজার, কাশ্মীর, রাঙামাটি, বালি। ওহ আরেকটা কথা। মীরা আপা গায়ের উপর বমি করলেও কিছু বলতে পারবে না। মরে টরে হলেও আমার বোনের শখ পূরণ করতে হবে।”

মীরা রাগ করে ইভান ভাইকে বলল,

“ইভান ভাই তুমি আবির ভাইয়াকে কিছু বলবে!”

ইভান আবিরকে শাসন করে দিল,

“ইভান মীরাকে জ্বালাস না তো।”

মীরা পাতে চিংড়ি মাছ নেওয়ার সময় তনি বলল,

“এটা খেয়ে এলার্জিতে মরে যাবি। তবুও এই পোকা খাওয়া ছাড়বি না।”

“পছন্দের জিনিস ক্ষতিকর হলেও ছাড়া যায় না। ছাড়া উচিতও না।”

ভাইবোনের আলাপের মাঝে আরও একজন যে আছে তা সবাই ভুলে গেল। বড় মা ধমক না দিলে কেউ হয়তো থামতো না।

“চুপ করে খা তো। খাওয়ার সময় এত কিসের কথা তোদের? খাওয়ার পরে রুমে গিয়ে সারারাত আড্ডা দিস। আরেকটা ছেলেও তো তোদের সাথে বসে আছে। কই ওর মুখ থেকে একটা বাজে কথা বেরিয়েছে?”

তনি জায়িনের দিকে তাকিয়ে খোঁচা দিয়ে বলল,

“ওর মুখ দিয়ে তো কাজের কথাই বেরোয় না মা। বাজে কথা কী বলবে। ওর এই কম কথা বলার জন্য দেখবে ওর বউ পালিয়ে গেছে।”

তনি আপু এই প্রথম একটা ঠিক কথা বলেছে। মীরা না চাইলেও ফোঁস করে হেসে ফেলল। বরং হেসে ফেলেই ঠোঁট কামড়ে মুখ বন্ধ করে নিল। বড় মা কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকালেও কাজ হলো না। জায়িন এসবের মাঝে অস্বস্তিতে পড়েছে। সে তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করতে চাইল। এই ভাইবোনদের মুখের কোন লাগাম নেই। কখন কী যে বলে ফেলে। মীরাকে মুখ টিপে হাসতে দেখে তনি বলল,

“জোরে হাসছিস না কেন? হাসির কথা শুনে জোরে না হাসলে পাপ হয় জানিস না।”

মীরার হাসি তো অনেকই পাচ্ছে। কিন্তু জায়িন ভাইয়ের সামনে হাসতেও পারছে না। তনি বলে চলল,

“স্কুলে ওর এই স্বভাবের জন্য ওকে আমার ভালো লাগত না। খালি আবিরের জন্য বন্ধুত্ব হয়েছে। ভেবেছিলাম বড় হয়ে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ তো ঠিক হলোই না। উল্টো আরও গম্ভীর হয়ে গেল। আন্টি তোকে পেটে নিয়ে কী খেয়েছিল রে? যে জিনিস খাওয়ার ফলে তুই এমন বোবা হয়েছিস সেটা পৃথিবী থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বোবার সংখ্যা বাড়তে দেওয়া যাবে না।”

জায়িনের কাশি উঠে যাচ্ছে। ইভান ওকে পানি এগিয়ে দিল। জায়িন পানি খেতে খেতে তনি বলল,

“মীরা তুই যে মুবিনের কাছে পড়তে যাস। জায়িন কোনদিন বাড়িতে থাকলে তোর সাথে কথা বলে?”

মীরা আড়চোখে জায়িনকে দেখে মাথা নেড়ে না জানাল।

“জানা কথাই বলবে না। এজন্য তুই ওকে অহংকারী ভাবলে তোর কি কোন দোষ আছে? কিন্তু গাধাটা তো অহংকারী না। ও ছোটবেলা থেকেই কম কথা বলে।”

আবিরের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে মীরাকে ইশারা করে পানি দিতে বলল। মীরা মুখ মোচড় দিয়েও পানি দিল।

“ইভান ভাই, আমি যেমন তোর ভাই। জায়িনও তেমন তোর বড় ভাই। রাস্তাঘাটে দেখা হলে সালাম দিয়ে ওর সাথে কথা বলবি। ওকে একদম অহংকারী ভাববি না। আমার সামনে এখন একবার সালাম দিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস কর তো।”

ইভান এদের পাগলামি দেখে হাসতে হাসতে বলল,

“কী শুরু করলি আবির?”

“না এটা করা দরকার। দেখা গেল এলাকার আণ্ডাবাচ্চা গুলা ওকে চিনে না। দে মীরা, দেখি জায়িন কীভাবে তোর সাথে কথা না বলে থাকে।”

মীরা এবার আর আড়চোখে না, সোজা চোখেই জায়িনকে দেখল। পানি খেয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম জায়িন ভাই। আপনি ভালো আছেন?”

ইভান হো হো করে ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগল। তনিও হাসছে। জায়িন বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। আবির বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল,

“হ্যাঁ হয়েছে। মীরা তুই পাস। একশোতে একশো।”

চলবে_

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১১
🌸

রেজাল্টের দিন সকালে বাবা, কাকারা কেউ কাজে গেল না। বাড়ির দুইটা মেয়ের রেজাল্ট দিবে। টেনশনে সবাই আধমরা হয়ে বারবার ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছে।

“টেনশন করিস না মা। জিপিএ দিয়ে তো মানুষের যোগ্যতা যাচাই করা যায় না। তোরা ভালো ছাত্রী আমরা জানি। রেজাল্ট খারাপ হলেও সমস্যা নেই।”

যাদের সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে তাদেরই তো কোন টেনশন নেই। উল্টো তারা সবাইকে এত বেশি টেনশন করতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে। পরীক্ষা তো দিয়েই ফেলেছে। রেজাল্টও চলে এসেছে। এখন টেনশন করে মরে গেলেও তো কোন লাভ নেই।
মীরা মাহিমা সব বান্ধবীদের কল করে খোঁজ নিয়েছে। ওহ আরেকটা কথা। বাড়ি থেকে তাদের ফোন কিনে দিয়েছে। কাল রাতেই ফেসবুক আইডিও খুলে ফেলেছে। মীরার আইডির নাম ভোরের পাখি। মাহিমার আইডির নাম রাতের পাখি। দুই পাখিই অনেক খোজাখুজি করে মুবিন ভাইয়ের আইডি বের করে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। মুবিন ভাই এখনও এক্সেপ্ট করেনি। শুধু মুবিন ভাইকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এলাকার সব বড় ভাইদের রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। সুন্দর প্রোফাইল পিক দেখে কয়েকজন সাথে সাথে এক্সেপ্টও করে নিয়েছে। কয়েকজন মেসেজও করেছে। কিছু হাই, হ্যালো মেসেজ। কেউ কেউ জানতে চেয়েছে, আপনি কে? আপনি কি আমাকে চেনেন? মীরা মাহি বড় ভাইদের প্রোফাইলে ঢুকে লাভ রিয়েক্ট আর ওয়াও নাইস কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিয়েছে।
রুমে এসে মীরা রিমুকে কল করল।

“হ্যালো রিমু।”

“মীরা আমার ভীষণ ভয় করছে। কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি আমি ফেল করেছি। বাবা মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ভোরের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেলে সত্যি সত্যিই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে আমি কোথায় যাব?”

“কোথায় যাবি আবার? দেশে অনাথ আশ্রম কম আছে? কোন একটায় গিয়ে উঠে পড়বি।”

“মীরা তোর কি মনে হয় আমি সত্যিই ফেল করব।”

“পরীক্ষা তুই দিয়েছিস। খাতায় কী লিখেছিস তুই জানিস। আমি কীভাবে বলব তুই পাস করবি নাকি ফেল করবি?”

“জানি না। মাহি কি তোদের বাড়িতে?”

“হ্যাঁ। কথা বলবি?”

“না। এই ভোরের পাখি, রাতের পাখি কি তোদের আইডি?”

“আমাদের আইডি হতে যাবে কেন? ওসব নামে আইডি খুলব এটা ভাবলি কীভাবে তুই? আমাদের বাপ মা আকিকা দিয়ে যে নামটা রেখেছে ওটা কি কম সুন্দর।”

“না। কিন্তু কেনই যেন মনে হলো। সবার সাথে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে দেখলাম।”

মাহিমা ইশারা করে বারণ করছে রিমুকে না জানাতে। ঠোঁট পাতলাটা সবাইকে বলে দিবে। তখন আর মজা করা যাবে না।
ইভান ভাই রেজাল্ট জেনে অফিস থেকে আসার সময় মিষ্টি নিয়ে এসেছে। মীরা মাহি দু’জনই এপ্লাস পেয়েছে। আবির খুশিতে টপাটপ পাঁচটা মিষ্টি খেয়ে নিল। আসলে এপ্লাস যে পাবে এটা ওরাও ভাবেনি। ইভান বোনদের নিয়ে গর্ব করছে।

“আমার কলিগরা সবাই জানতো আমার দুই বোন পরীক্ষা দিয়েছে। ওরা আগেই মিষ্টি আনিয়ে রেখেছিল। আমি কিছুটা ভয়ে ছিলাম। কিন্তু বোনেরা আমার ইজ্জত রেখেছে। সবাই আমাকে কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছিল। যেন পরীক্ষা আমিই দিয়েছি।”

আবির একহাতে নিজের বোনের ঘাড় পেঁচিয়ে ধরে দম আটকে মেরে ফেলার উপক্রম করে বলল,

“পরীক্ষায় টুকেছিলি তাই না? নইলে তোরা দুইটাই এপ্লাস পেলি কীভাবে? আমি শিওর তোরা নকল করেছিস।”

মাহিমা রেগেমেগে বলল,

“আমি কি তোমার মতো খারাপ ছাত্র। কত কষ্ট করে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি।”

তনি ওসব কিছু জানে না। তার ট্রিট পাওয়াই হলো কথা।

“ট্রিট কবে দিচ্ছিস তোরা? ফাইভ স্টার হোটেলে খাব। কোন টালবাহানা চলবে না।”

মীরা মুখ মুচড়ে বলল,

“আমরা তো কষ্ট করে পড়ে এপ্লাস পেয়েছিই। এখন ট্রিট তোমরা আমাদের দিবে। তাই না রে মাহি?”

“হ্যাঁ। কষ্ট করেছি আমরা। এখন ট্রিটও দিব আমরা। এটা শুধু অন্যায় না, জুলুম।”

ইভান ওদের ঝগড়া দেখে রাজি হলো। ট্রিট সে দিবে। এতেই সবাই খুশি হয়ে গেল।
রাতে সবাই বাইরে খেতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। ছোট ফুপা মীরা মাহিমাকে রেজাল্টের উপলক্ষে নতুন ড্রেস এনে দিয়েছে। দু’জনের জামা একইরকম। মীরা মাহিমা সাদা চুরিদার পরে নিজেরাই হালকা সেজে সবার আগে রেডি হয়ে বসে রইল। দেরি করছে প্রিয়া আপু। তার সাজগোজ শেষই হচ্ছে না। তনিও চলে এলে আবির বলল,

“প্রিয়া আপুকে ছাড়াই চলে যাই চল। ও রেডি হয়ে এসে দেখবে আমরা নেই।”

ইভান প্রিয়াকে ডাকল। প্রিয়া আর একটু বলে আরও দশ মিনিট সময় নিল। শেষে সবাই একসাথে বের হচ্ছে। মীরা মাহিমা নতুন ফোনে পিক তুলেই যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হাঁটতে হাঁটতে তুলেছে। গাড়িতে বসেও বাদ রাখেনি। এখন রেস্টুরেন্টে এসেও ছবিই তুলে যাচ্ছে। তনি বিরক্ত হয়ে বলল,

“তোদের দুইটার মোবাইল ধরে কিন্তু আছাড় মারব। এত ছবি তুলতে হয়?”

কে শুনে কার কথা? তনি আপুর বকা ওরা গায়েই মাখল না। উল্টো ইভান, আবিরকে নিয়ে ছবি তুলতে লাগল।

“ভাইয়া আমাদের সাথে কয়টা সেল্ফি তুলো না।”

আবির নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেল।

“সেল্ফি তুলবি? আয় আয়।”

একেকজন একেক রকম মুখের ভঙ্গিমা বানিয়ে পোজ দিচ্ছে। আবির দু’জনের কান ধরে টানছে। কয়েক ছবিতে জিভ বের করে দিয়েছে।
প্রিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,

“আগে খেয়েদেয়ে তারপর পিক তোল। পিক তো আর চলে যাচ্ছে না।”

রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় ফোনের দিকে ধ্যান থাকায় মাহিমা কারো সাথে ধাক্কা খেল। ওর হাত থেকে ফোন পড়ে গেলে মাহিমা চিৎকার করে উঠল,

“আমার নতুন ফোন! ইশ, ভেঙে গেল রে। গ্লাসটা মনে হয় ভেঙেই গেছে।”

মুবিন দেখেই আসছিল। কিন্তু মাহিমাই পাশ থেকে এসে ধাক্কা খেল। তবুও মুবিন দুঃখিত হলো। সে ঝুঁকে নিচে থেকে মাহিমার ফোন তুলে নিল।

“কপালের নিচে চোখ নেই? চোখে দেখতে পান না?”

বলতে বলতে মাহিমা সামনের ব্যক্তিটির দিকে তাকাল। এবং মুবিনকে দেখে কথার মাঝপথেই থেমে গেল। মুবিন চেহারার ভাব যথেষ্ট করুণ বানিয়ে বলল,

“সরি। আসলে আমি দেখিনি।”

মুবিন মাহিমার দিকে ফোন এগিয়ে দিল। মাহিমা সেটা মুবিনের হাত থেকে নিল। কিন্তু তাৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। দোষ যে তার এটা সে-ও জানে।

“সরি। আমি সত্যিই দেখতে পাইনি।”

“ইট’স ওকে মুবিন ভাই।”

যাক মেয়েটা রাগ করেনি। মুবিন সামান্য হেসে বলল,

“তুমি এখানে?”

“আমি একা না। ভাইয়ারা সবাই এসেছে। আপনি কার সাথে এসেছেন?”

ওরা কথা বলতে বলতেই জায়িনও চলে এসেছে। জায়িনকে দেখে মাহিমা বিশাল সাইজের একটা ক্রাশ খেয়ে ফেলল। ব্লু শার্টে জায়িন ভাইকে যে কী সুন্দর লাগছে! মাহিমা হাঁ করে তাকিয়েই রইল।
এদিকে মাহিমাকে খুঁজতে খুঁজতে মীরা হয়রান। ওরা সাথেই ছিল। পেছন থেকে মাহিটা আবার কোথায় চলে গেল। মীরা দূর থেকে মাহিমার ড্রেস দেখে চিনে ফেলে ডাকল।

“ওই আবাইত্তার বংশ তোরে রেখে সবাই খেয়ে ফেলল। এখানে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাও তুমি।”

মীরা ওদের কাছাকাছি এসে জায়িনকে দেখে থেমে গেল। সাথে মুবিনও আছে দেখে ভরসা পেল। সে এগিয়ে এসে জায়িনকে দেখে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম জায়িন ভাই। কেমন আছেন আপনি?”

আবির ভাই-ই তো বলেছিল। রাস্তাঘাটে জায়িনকে যেখানে পাবি সালাম দিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস করবি। মীরা সেটাই করেছে। মুবিন মীরাকে ভাইকে সালাম দিতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে সালাম নিল।
মীরা মুবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আপনারা এখানে কি করেন মুবিন ভাই? যা কী প্রশ্ন করছি! রেস্টুরেন্টে তো খেতেই আসে মানুষ।”

“আজ তো রেজাল্ট বেরিয়েছে, না?”

মাহিমা ফট করে বলে উঠল,

“সেজন্যই তো আমরা এখানে এসেছি। আমরা দু’জনই এপ্লাস পেয়েছি। তাই ইভান ভাই আমাদের সবাইকে খাওয়াচ্ছে।”

“অভিনন্দন। কলেজে কোথায় এডমিশন নিবে?”

মীরা বলল,

“জানি না। ভাইয়া চাচ্চুরা যেখানে বলবে।”

মীরা মাহিমা জোর করে জায়িন মুবিনকেও ওদের সাথে নিয়ে এলো। বাকিরাও ওদেরকে তাদের সাথেই বসতে বলল। জানা গেল গতকাল মুবিনের জন্মদিন গেছে। আজ সে ভাইয়ের থেকে ট্রিট নিতে এসেছে। মাহিমা শুনে বলল,

“যার জন্মদিন সে ট্রিট নেয় নাকি দেয়? আমাদের জন্মদিনে তো সবসময় আমরা ট্রিট দিয়ে এসেছি। তাই না রে মীরা?”

“হুম।”

তনি মুবিনের সাপোর্ট করে বলল,

“জায়িনের মতো বড় ভাই থাকলে তোরাও নিজের জন্মদিনে ট্রিট পেতি। এটাই হলো ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা।”

মীরা মাহিমা মন খারাপ করে দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল। ভাইয়েরা সেটা বুঝতে পেরে বলল,

“আজকে কার ট্রিট দেওয়ার কথা ছিল? আর কে দিচ্ছে হু? তবুও বলবি তোর ভাইয়েরা ভালো না?”

মীরা মুখ মুচড়ে বলল,

“ইভান ভাই দিচ্ছে। তুমি জীবনেও দিতে না।”

“ওরে পাগল, ইভান ভাই আর আমি কি আলাদা রে?”

সবাই হাসতে লাগল। এদিকে প্রিয়া জায়িনকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে। কারো কোন কথা তার কানে যাচ্ছে না। সে এক ধ্যানে জায়িনকেই দেখে যাচ্ছে। জায়িন বলল,

“তোরা থাক তাহলে। আমরা উঠি।”

আবির বাধা দিয়ে বলল,

“উঠবি কেন? ভয় পাস না। তোর খরচা হবে না। আজ সব খরচা ইভান ভাইয়ের। বোস। ছোট ভাইয়ের জন্মদিন গেল গিফট দিব না? এই মীরা, তুই তোর টিচারকে কোন গিফট দিলি না!”

চলবে_