মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-৮+৯

0
479

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

রিমুর জন্মদিন থেকে এসে পরের দিনই মীরা মাহিমা ছোট চাচ্চুকে নিয়ে সিলেট বড় ফুপুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। চাচ্চু ওদের রেখে চলে আসবে। ওরা অনেকদিন থাকবে। বড় ফুপু দুই ভাইঝি, বোনঝিকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। কী রেখে ওদের কী খাওয়াবে। বড় ফুপুকে এত ব্যস্ত হতে দেখে মীরা বলল,

“ফুপু এবার কিন্তু অনেকদিন থাকব। এক দিনে সব খাইয়ে ফেলতে হবে না। রয়েসয়ে অনেক দিনে খাব।”

“খালামনি প্রিয়া আপু কখন আসবে। প্রিয়া আপুকে নিয়ে ঘুরতে যাব। আমাদের কিন্তু সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।”

“ঠিক আছে দেখিস।”

এক রাত থেকে চাচ্চু ওদের রেখে চলে এলো। সিলেট ঘুরাঘুরি করার ওদের একমাত্র সাথী প্রিয়া আপু। প্রিয়া আপুর সব চেনা থাকায় সে দুই বোনকে খুব সুন্দর করে অর্ধেকটা সিলেটই ঘুরিয়ে দেখিয়ে ফেলল। পনেরো দিন ফুপুর বাড়ি থাকার পরই নিজের বাড়ির জন্য মন কেমন করতে লাগলো। এখানে আসার জন্য দু’জন যতটা পাগল ছিল। যাওয়ার জন্যও ঠিক তেমন পাগল হয়ে গেল। শেষে কোনোভাবেই ওদের বোঝাতে না পেরে বড় ফুপু বলল,

“আর একটা সপ্তাহ থাক। প্রিয়ার পরীক্ষা শেষ হলে আমরাও যাব।”

দু’জন সমস্বরে জিজ্ঞেস করেছে,

“সত্যি যাবে তো?”

“না গেলেও তোদের চাচা/মামা এসে নিয়ে যাবে।”

মীরা আপত্তি জানিয়ে বলল,

“না না। তুমিও যাবে বড় ফুপ্পি। কতদিন আমাদের বাসায় যাও না।”

“ঠিক আছে যাব।”

এক সপ্তাহ পর ফুপু আর প্রিয়া আপুকে নিয়েই ওরা বাড়ি ফিরল। মাহিমা দীর্ঘ দিন নিজের বাড়ি থেকে দূরে থেকে আর মামার বাড়ি থাকতে চাইল না। সে সবার জোড়াজুড়ি অমান্য করেই বাড়ি চলে গেল। বোন বাড়িতে না থাকায় আবির বুঝেছে মাহিমাকে ছাড়া বাড়ি এতটা খালি খালি লাগে। এদিকে মীরাকে ছাড়া ওদের বাড়িও খা খা করছিল। রুশমি বোনদের জন্য প্রতিদিনই নাকি কেঁদেছে। বাড়ি এসে মীরা বাবাকে পেল। বায়েজিদ সাহেব অনেকদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে কপালে চুমু খেয়ে আদর করে বললেন,

“আমার মা-টা এতদিন ফুপুর বাড়িতে ছিল! বাবাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়নি মা?”

মীরা অভিমানে বুজে আসা গলায় বলল,

“তুমি কি বাড়িতে থাকো বাবা? আমাকে কি তুমি সময় দাও? তোমার বিজনেসই তো তোমার কাছে সব।”

“আমি তো এসব তোমার জন্যই করছি মা। আমার সবকিছু তোমার জন্য। তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে না পারলে আমি যে একজনের কাছে হেরে যাব মা।”

“বাবা আমার টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি কিচ্ছু চাই না। আমি তোমাকে কাছে চাই। তোমার ভালোবাসা চাই। চাচ্চুরা আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তো আমার বাবা।”

মীরার মা টাকাপয়সার জন্যই চলে গিয়েছিল। তার পর থেকেই বায়েজিদ সাহেবের টাকা কামানের জেদ মাথায় চেপে বসল। তিনি এখন দুই হাতে টাকা কামাচ্ছেন। উনার এক মেয়ে সারাজীবন বসে খেয়েও শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তিনি এটা বুঝতে পারলেন না মেয়েকে টাকার সুখ দিতে গিয়ে ভালোবাসা দিতে ভুলে যাচ্ছেন।

🌸

বাড়ি ফেরার তিনদিন পরই ছোট চাচীর পেইন উঠল। তখন বাড়িতে বাবা, চাচারা কেউ ছিল না। ব্যথায় ছোট চাচীর কান্না দেখে মীরাও কাঁদতে লাগল। বড় মা মীরাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তিনি বারবার স্বামীকে কল করে যাচ্ছেন। অবশেষে আবিরকে কলে পাওয়া গেল। ছোট মামীর কথা শুনে আবির বাড়ি পৌঁছুতে পাঁচ মিনিটও সময় নিল না। এর আগেও ছোট মামীর দুইটা বাচ্চা মারা গেছে। এবার তেমন কিছু হলে ছোট মামী সহ্য করতে পারবে না। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে আবির গাড়ি করে মামীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মীরা পুরো পথ ছোট চাচীর হাত ধরে কেঁদেছ। ছোট চাচীকে সান্ত্বনা দিয়েছে।

“তোমার কিছু হবে না ছোট চাচী। বাবুরও কিছু হবে না। তুমি দেখো।”

“মীরা আমার বাবুটার যেন কিছু না হয় রে।”

“কিছু হবে না। তুমি দেখো কিচ্ছু হবে না। আমার আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি। আল্লাহ আমার কথা শুনবেন।”

রাত এগারোটায় পুরো পরিবার হাসপাতালে এসে জড়ো হলো। সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করতে করতে কাঁদছে। মীরা মাহিমাকে জড়িয়ে ধরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে পরিবারের প্রতিটা মানুষ ভয়ে আতঙ্কে অপারেশন রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার যেন কোন খারাপ খবর শুনতে না হয়। এগারোটা চুয়ান্ন মিনিটে ছোট মামীর ফুটফুটে একটি মেয়ে হয়েছে। মেয়ের কান্নায় হাসপাতালে সবাই তাদের ক্যাবিনের সামনে চলে এসেছে। ডাক্তার বের হয়ে জানাল।
মেয়ে এবং মেয়ের মা দু’জনই সুস্থ আছে। অবশেষে ভয় কেটে গিয়ে সবার মুখে হাসি ফুটলো। ইভান চোখ মুছে বলল,

“আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি।”

তনি আপু তার মা’কে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমি আমার বোনকে দেখব মা। ও কার মতো হয়েছে?”

সদ্যোজাত শিশুটি পিটপিট করে তাকিয়ে তার পরিবারের মানুষ গুলোকে দেখছে। মেয়েটার ঠোঁট লাল টকটকে। মীরা অবাক হয়ে দেখছে। এই মেয়ে এত সুন্দর হয়েছে কেন? কাগজের মতো সাদা। মাহিমা বাবুকে ছুয়ে দিয়ে বলল,

“কী নরম! তুলোর মতো তুলতুলে। মীরা ছুঁয়ে দেখল। এত নরম কেন?”

মীরাও ছুঁয়ে দেখল। সত্যিই। মীরার মেয়েটাকে হাওয়াই মিঠায়ের মতো লাগছে। এর নাম কি দিবে? মিঠাই? না। মীরা সুন্দর একটা নাম ভেবে রেখেছে। রুশমিও বাবুর চোখে মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে। বাবু তার হাত ধরতে চাইলে খুশিতে চিৎকার করে উঠছে। মেয়েটা চিকন চিকন হাত নাড়িয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষ গুলোকে দেখছে। আবির বিস্মিত চোখে বলল,

“আরে এত তো দেখি আমাদের দ্বিতীয় মীরা। মামী তুমি আরেকটা মীরার মা হয়েছ। দুইটা মীরা আমাদের।”

ভাইয়ের কথা শুনে মাহিমা মুখ কাঁদো কাঁদো করে ফেলে বলল,

“এটা কি আমার বোন না? তাহলে আমার মতো দেখতে হয়নি কেন? মীরার মতো হয়েছে পাঁজি মেয়ে।”

ইভান মাহিমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

“আরে আবির কী ছাতা বুঝে। আমার কাছে তো বাবুকে তোর মতোই লাগছে। দেখ চোখ দু’টো পুরো তোর চোখের মতো।”

তনি ঘোষণা করল,

“বাবু যার মতোই দেখতে হোক। কিন্তু এই মেয়ের নাম আমি রাখব। এটা বড় বোনের অধিকার।”

মীরা মনে মনে কষ্ট পেল। সে তো একটা নাম ঠিক করে রেখেছিল। প্রিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“এহ আসছে আমার বড় বোন! তোর বড় আমি। বাবুর নাম রাখার অধিকার একমাত্র আমার। তোরা বাচ্চা পোলাপান নাম রাখার কী বুঝিস রে।”

বাড়িতে ছোট্ট অতিথি আসায় সবাই কত খুশি। মেয়েটা ওদের জীবনে নতুন খুশি নিয়ে এসেছে। ছোট চাচ্চু প্রথম বার মেয়েকে কোলে নিয়ে সবার সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। প্রিয়া, তনি, মীরা মাহিমা চাচ্চুকে শান্ত করতে এলে ওদের জড়িয়ে ধরেও কাঁদল। রুশমি চাচুর কান্না দেখে ভয় পেয়ে মায়ের কোল জড়িয়ে থাকল। এ যেন কান্নাকাটির প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। কে কার থেকে বেশি কাঁদতে পারে। চাচী কাঁদে, চাচা কাঁদে। দামড়া দামড়া ভাই গুলোও কতক্ষণ কেঁদেছে। মীরা আর মাহিমার কান্না তো কেউ গোনায় ধরে না। কারণ ওরা কারণে অকারণে কাঁদতেই থাকে।
দুই দিন পর বাবুকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এই বাড়ি সবসময় হৈচৈ হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে থাকত। কিন্তু বাবু বাড়ি আসার পর যেন সেই খুশি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। মাহিমা আবির বাড়ি যাওয়ার নামই নিচ্ছে না। ছোট ফুপুও চলে এসেছে। ভাইঝিকে রেখে তিনি কোথাও যাবেন না।
বাবুর উছিলায় অনেকদিন তনি আপু, আবির ভাইয়ার ভার্সিটি, ইভান ভাইয়ের অফিস সবই বন্ধ ছিল। মীরাদের ঘোরাঘুরিও আটকে আছে। পরীক্ষার পর কক্সবাজার যাবার প্ল্যান ছিল। কই কেউ তো কক্সবাজার এর নামই নিচ্ছে না। অনেকদিন বাড়ি থেকে বের হয়নি। মীরা ভাবল আজ বিকেলে সুমনা আন্টির সাথে দেখা করে আসবে। পরীক্ষার পর থেকে দেখা হয় না। আন্টি তো সারাক্ষণ বাড়িতে একা থাকে। মীরা বের হওয়ার সময় বড় মা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল।

“বোন হয়েছে। ওদেরকে মিষ্টি মুখ করাবি না?”

মীরা মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুবিন ভাইদের বাড়িতে চলে এলো। এতদিনে তার একবারও মুবিন ভাইয়ের কথা মনে পড়েনি।
কলিংবেল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আন্টি ফোন কানে নিয়ে দরজা খুলে দিয়েই বকাঝকা শুরু করে দিল।

“তোর কি ধৈর্য বলতে কিছু নেই মীরা? মানুষকে আসার সময় তো দিবি।”

“আমি ধৈর্যহীন একটা মানুষ। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দেয়নি।”

“এতদিন কোথায় ছিলি? পরীক্ষা দিয়ে আন্টি ভুলে গেলি?”

“বড় ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার ছোট বোন হয়েছে আন্টি। মিষ্টি এনেছি। বাবুটা যে কী সুন্দর হয়েছে তুমি যদি দেখতে। একদম তুলোর মতো নরম। আমার ওকে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

“তোর ছোট কাকীর বাবু হয়েছে? ছেলে না মেয়ে?”

“মেয়ে। আবির ভাইয়া কী বলে জানো, বাবুটা নাকি পুরোপুরি আমার মতো দেখতে হয়েছে। আবির ভাই ওকে দ্বিতীয় মীরা ডাকে। মাহিমা হিংসে করে বলে ইভান ভাই বলে বাবু নাকি ওর মতো হয়েছে। কিন্তু আমি দেখেছি বাবু আমার মতোই হয়েছে।”

মীরা একনাগাড়ে বকবক করেই যাচ্ছে। সুমনাও হাঁ করে শুনছিল। হঠাৎ ফোনের ভেতর থেকে কেউ একজন মা বলে ডেকে উঠায় সুমনার মনে হলো জায়িন কলে ছিল। এখনও আছে। ছেলে হয়তো রেগে গেছে ভেবে সুমনা জিভ কামড়ে বলল,

“মীরা মিষ্টি নিয়ে এসেছে। ওর চাচীর মেয়ে হয়েছে। ওসবই বলছিল। একদম ভুলে গিয়েছিলাম তুই যে কলে আছিস।”

“হু।”

“তুই কি এই মাসে বাড়িতে আসবি না।”

“জানি না। দেখি। পড়ার ভীষণ চাপ যাচ্ছে।”

“যতই পড়ার চাপ থাকুক বাবা। তুই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস। দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস দেখেছিস?”

“মা আমি রাখি। পরে কথা বলব।”

“শোন, জায়িন…

কল কেটে দিয়েছে। মীরা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

” কার সাথে কথা বলছিলে আন্টি?”

“জায়িনের সাথে। খাওয়াদাওয়ার কথা বললেই কল কেটে দেয়। নিজের প্রতি একদম খেয়াল নেই। এই ছেলেকে নিয়ে যে আমি কী করব? হোস্টেলের খাবার ভালো না লাগলেও কিছু বলবে না। দিনের পর দিন পানির মতো ডাল খেয়ে খেয়ে ছেলেটা আমার শুকিয়ে গেছে।”

কে শুকিয়ে গেছে? জায়িন ভাই! হাহ্, আন্টির কি চোখের পাওয়ার কম। ওরকম বডি বিল্ডার ছেলেকে বলছে শুকিয়ে গেছে। আন্টি তুমি যাকে শুকিয়ে যাওয়া বলো, তোমার ছেলে ওটাকে ডায়েট বলে। আবাইত্তার মতো খেলে কি আর সিক্স প্যাক থাকবে। তুমি ওসব বুঝতে না। কারণ মায়েদের কাছে তার হাতির মতো ছেলেকেও চিকনই মনে হয়। মোটাকে খাইয়ে খাইয়ে ফাটিয়ে ফেলতে চায়।

চলবে_

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

মীরার রেজাল্টের আরও অনেকদিন বাকি। বড় ফুপু, ছোট ফুপু সবাই বাড়িতে থাকায় কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে না। মীরা মাহিমা কয়দিন ধরেই ইভান ভাই, আবির ভাইয়ার পেছনে ঘুরঘুর করছে। ওদের কক্সবাজার নিয়ে যেতেই হবে। ইভান কক্সবাজার যাওয়ার কথা শুনে বলল,

“ছোট বোনটা মাত্র দুনিয়ায় এসেছে। ওকে বাড়িতে রেখে তোরা কক্সবাজার যাওয়ার কথা মুখে আনিস কীভাবে? ছি মীরা! ছি মাহি!”

ইভান ভাই কোনরকমে ওদের এড়িয়ে গিয়ে বাঁচছে। কিন্তু মীরা মাহিও তো সহজ পাত্রী নয়। ওরা ইভান ভাইকে ছেড়ে আবির ভাইকে ধরল। সাথে তনি আপুকেও জুটিয়ে নিল। জানে তনি আপু দলে থাকলে তাদের দল ভারী হবে। অন্তত তনি আপু যেতে চাইলে আবির ভাই কিছুতেই না করবে না। আবিরকে বললে সে খুব সহজ গলায় বলল,

“কক্সবাজার যাবি? সে আর এমন কি কথা। কক্সবাজার তো বেশি দূরে না। বাড়ির পেছনেই। কবে যাবি?”

“তুমি যেদিন নিয়ে যাবে।”

“কে কে যাবি? তোরা দুইটাই?”

“না। সবাই যাবে। শুধু ছোট বাবু আর রুশমি বাদে।”

“কেন ওদেরকে নিয়ে নে সাথে। নইলে কথা বলতে শিখে ছোট বোনটাও অভিযোগ করবে। আবির ভাই তুমি আপুদের নিলে আমাকে কেন নিলে না?”

মীরা মাহিমা বাড়িতে থাকছে। বাবু কোলে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজেরা ঝগড়া করে এক দু’দিন কথা না বলে থাকছে। মামী, ফুপুরা মিলিয়ে দিলে আবার আগের মতো গলা জড়াজড়ি করে সবখানে যাচ্ছে। আবির ভাই বলেছে কক্সবাজার নিয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ির কেউ রাজিই হচ্ছে না। ওদের পাগলামি অসহ্য পর্যায়ে চলে গেলে ছোট চাচা আবিরকে ডেকে বলল,

“তুই নাকি মীরা মাহিকে কক্সবাজার নিয়ে যাস?”

“হুম। বোন দুইটা আবদার করলো। আমি না করতে পারলাম না।”

“আবির তুই কি ওদের চিনিস না? সান্ত্বনা দিতে এক কথা বললেও ওরা সেটা সত্য মেনে নেয়। এখন তুই যদি পারিস ওদের দায়িত্ব নিয়ে কক্সবাজার নিয়ে যেতে তাহলে যা। আমার কোন আপত্তি নেই।”

“মামা তুমি পাগল! এরা প্রাইভেট কারে উঠলেও বমি করে মরে যায়। এদের আমি বাসে করে কক্সবাজার নিয়ে যাব।”

“প্লেনে নিয়ে যা। আশা দিয়েছিস বোনদের আশা ভঙ্গ করবি।”

আবির মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,

“আচ্ছা দেখি ইভান ভাই কী বলে। ও রাজি হলে নাহয় নিয়ে যাব।”

কক্সবাজার যাবার খুশিতে মীরা মাহিমা শপিংও সেরে ফেলল। আবির ভাইয়া ওদের হাতপা বেঁধে রাখলেও তো ওরা পানিতে নামবে। মীরা বাবাকে বলল তাকে একটা ক্যামেরা কিনে দিতে। প্রচুর ছবি তুলবে। কলেজে ভর্তি হয়ে সব ফ্রেন্ডদের দেখাবে কোথায় কোথায় ঘুরেছে ওরা। বাড়ির সবাই মনে মনে জানে আবিরের কথার কোন দাম নেই। ইভান না গেলে সে জীবনেও দুই বোনকে নিয়ে একা যাবে না। এদিকে ইভান ভাইয়ার অফিসে ছুটি নেই। ওদের আগ্রহ, খুশি দেখে সবাই মনে মনে ভয় পাচ্ছে। কক্সবাজার যাওয়া বাতিল হলে এরা পাগল হয়ে যাবে। কান্নাকাটি করে বাড়িঘর ভাসিয়ে ফেলবে। অবস্থা হাতের বাইরে চলে যেতে দেখে আবির ইভানের কাছে এলো।

“ভাই তুই না গেলে তো হবে না। তোকে যেতেই হবে। চাকরি গেলে চলে যাক। তবুও তোকে যেতেই হবে।”

“কেন? আমি কি ওদের উসকানি দিয়েছি? তুই দিয়েছিস। এখন তুই নিয়ে যা। পাগলের পাগলামিতে তো খুব সঙ্গ দিস। এবার মজা বোঝ।”

“কিন্তু এই দুই রোগীকে নিয়ে আমার একা যাওয়া তো সম্ভব না।”

“আবির তুই তো ওদের মতো অবুঝ না। আমার সত্যিই একটা দিনেরও ছুটি নেই। এমনিতেই কয়দিন আগে ছুটি নিয়েছি। এখন কীভাবে ছুটি চাইব বল?”

“হুম।”

আবির পুরোপুরি ফেঁসে গেল। বোনেরা দেখলেই খুশিতে গদগদ করে কক্সবাজার গিয়ে কী কী করবে ওসব বলতে লাগে। আবির অসহায় মুখে ওদের খুশি দেখে। এদের কীভাবে বলবে, এবার না। পরের বার যাব। কত খুশি মেয়ে দুইটা। বোনদের মন ভাঙতে পারবে না ভেবে আবির ওদের থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকছে। মীরার ভয়ে নানির বাড়ি তো আসছেই না। নিজের বোনের ভয়ে বাড়িতেও থাকছে না। এদিকে মীরাদের রেজাল্ট দেওয়ার সময় চলে এসেছে। মীরা, মাহিমা হন্য হয়ে আবিরকে খুঁজছে। তনি আপুর সাথে নিশ্চয় আবির ভাইয়ার রোজ কথা হয়। ওরা তনি আপুকে ধরল। মীরা বলল,

“তনি আপু, আবির ভাইয়ার কী হয়েছে? ভাইয়া আমাদের বাড়িতে আসছে না কেন?”

আবির তনির হাতে পায়ে ধরে এই দুইটার মাথা থেকে কক্সবাজার যাবার ভূত নামাতে বলেছে। তনি বলল,

“আমি তো জানি না মীরা। তুই আবির ভাইকে কল দে। জিজ্ঞেস কর।”

“কল তো ধরে না। আবির ভাইয়া কি আমাদের নিয়ে যাবে না?”

“সেটা আমি কীভাবে বলব বল?”

মাহিমা তনি আপুর গা ছাড়া ভাব দেখে রেখে বলল,

“তুমি জানবে না কেন? তুমি আবির ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করো ও কি আমাদের নিয়ে যাবে নাকি যাবে না।”

“তোর নিজের ভাইকে তুই জিজ্ঞেস করতে পারছিস না? আমি জিজ্ঞেস করলে আমাকে এক ধমক দিবে। না বাবা। আমি কারো ধমক খেতে পারব না।”

মাহিমা রাগ করে বলেই ফেলতে যাচ্ছিল। আমার ভাই তোমাকে ধমক দিবে? উল্টো তুমিই তো ওর নাকে দম করে রাখো। এখন এমন একটা ভাব করছো যেন আমরা কিছুই জানি না। শুনো আপু, আমরা সব জানি। শুধু বলি না। কিন্তু তুমিও ভাইয়ার দলে থাকতে চাইলে জীবনেও আমি তোমাকে ভাবী বানাতে দিব না। বাবার কানে এমন কাঠি ভাঙব। বাবা জীবনে তোমাদের বিয়েতে রাজি হবে না। মাহিমা বলতে তো চেয়েছিল অনেক কিছুই। কিন্তু মীরার জন্য বলতে পারল না। মীরা ওর মুখ চেপে ধরে তনি আপুর রুম থেকে নিয়ে চলে এলো। বাইরে এসেও মাহিমা বলছে,

“মীরা আমাকে ছাড়। ছাড় মীরা। কী শয়তান দেখেছিস। এমন ভাব করছে যেন আমরা কিছুই জানি না। ছাড় আমাকে।”

“শান্ত হ। মাথা ঠান্ডা কর। আমরা সব জানি। আমাদেরও সময় আসবে। তখন আমরাও মজা দেখাব। এখন আমাদের সময় খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু আবির ভাইকে তো এর শিক্ষা দিবই। তুই কিন্তু তখন নিজের ভাইয়ের জন্য দয়া দেখাতে পারবি না।”

“আরে কিসের ভাই! আমার কোন ভাই নাই। ভাই হলে এভাবে আশা দিয়ে বোনের মন ভাঙতে পারত না। তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদেরও সময় আসবে। তখন দেখিস কী করি।”

কক্সবাজার যাওয়ার প্রসঙ্গ ওখানেই চাপা পড়লো। আবিরও আবার ভয়ে ভয়ে নানির বাড়ি আসা ধরলো। কিন্তু মীরার সামনে পড়ার সাহস করলো না। এদিকে দিন ফুরিয়ে এসেছে। দুই দিন পর মীরার রেজাল্ট। মীরা রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করছে না। তার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। এপ্লাস না পেলেও ফোর পয়েন্টের উপরে আসবে। ফোর পয়েন্টই বা কম কি?
একদিন সন্ধ্যায় আবির ভাই বাড়িতে এলো। মীরা তখন নিজের ঘরে। আবির ভয়ে ভয়ে মীরাকে ডাকল।

“মীরা! মীরা আপু। ও মীরা আপু…

মীরা তার ঘরের দরজা দড়াম করে লাগিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

” আবির ভাই, তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। তুমি মানুষ ভালো না। আমি তোমার সাথে জীবনেও কথা বলবো না। তুমি আমার ছোট্ট মনটা ভেঙে খানখান করে দিয়েছ। আমার স্বপ্ন এমন ভাবে ভেঙেছ সেই টুকরো গুলো এখন জোড়া লাগাতে পারছি না। তুমি নিয়ে যাবে না তারপরও কথা দিয়েছ। চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে থেকেছ। তোমার সাথে আমি জীবনে কথা বলবো না। জীবনে আর কক্সবাজারও যাব না। কোনোদিনও না। তুমি তোমার মামার বাড়িতে আসবে কিন্তু আমাকে ডাকবে না। আমি তোমার বোন না।”

আবির জোর করে হাসার চেষ্টা করে জায়িনের দিকে তাকাল। জায়িনের মুখ দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না সে কিছু মনে করেছে। তবুও আবির কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলল,

“কক্সবাজার নিয়ে যাব বলেছিলাম। কিন্তু এরা মরা যাবে মরা আসবে। জার্নি করতে পারে না তবুও শখ কমে না। নিয়ে যাইনি বলে এসব বলছে। তুই কিছু মনে করিস না। ছোট মানুষ।”

জায়িন বাড়িতে এসেছে। আজ সন্ধ্যায় দেখা হয়ে গেল। আবির জোর করে ওকে সাথে ধরে নিয়ে এসেছে। ভেবেছিল জায়িনের সামনে মীরার সাথে ভাব করে নিবে। কিন্তু মীরা তো ওদের সামনেই আসলো না। জায়িনকে দেখে সবাই অনেক খুশি হয়েছে। জায়িন এলাকার ছেলে। চোখের সামনে বড় হয়েছে। এখন পড়াশোনার খাতিরে দূরে থাকে। দেখা হয় না। বড় মামী বলল,

“জায়িনকে ধরে নিয়ে এসে ভালোই করেছিস। ইশ কতদিন পর দেখলাম। কত বড় বেটা হয়ে গেছে। এখন তো আমাদেরকে চিনবে না।”

জায়িন মৃদু হেসে বলল,

“যতই দূরে থাকি কাকী। কিন্তু আপনাদের কোনদিনও ভুলব না।”

“ভুললে খবর আছে। ডাক্তার হয়ে আমাদের বিনা টাকায় চিকিৎসা করে দিতে হবে। রাতে কিন্তু আমাদের সাথে খেয়ে যাবে। উঁহু, কোন কথা শুনব না।”

বড় মামীর এত জোড়াজুড়ির পর জায়িন না করতে পারল না। ছোট মামী বাইরে ওদের কথা শুনে বাবু কোলে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। জায়িনকে দেখে তিনিও খুশি হয়ে বলে উঠল,

“আরে এটা জায়িন না! হায় হায়, দেখো কাণ্ড। আমি তো চিনতেই পারিনি। কবে এসেছ?”

আবির মামীর কোল থেকে ছোট বোনকে কোলে নিয়ে জায়িনের পাশে বসে বলল,

“আমার ফিউচার বউ। দুনিয়ায় আসতে একটু দেরি করে ফেলেছে। দেখ তো ভাবী পছন্দ হয়েছে কি-না।”

জায়িন হেসে ফেলল। এত সুন্দর বাবু সে সত্যিই কখনও দেখেনি। বড়ো বড়ো চোখ। ঠোঁট দু’টো লাল টুকটুকে। ছোট ছোট হাত নেড়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আবির বলল,

“ভাবীকে কোলে নিবি? নে শালা নে। কোলেপিঠে নিয়েই বড় কর। বউ তোমার দেবরের কোলে গিয়ে একটু হিসু করে দাও তো। বুইড়া দেবর তোমার।”

জায়িন বাবুকে ঠিকমতো কোলে নিতে পারল না। বাবুর শরীর অনেক নরম। ধরা যাচ্ছে না। যেন পড়ে যাবে। আবির জায়িনের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে বলল,

“বুইড়া দামড়া হয়ে এটুকু একটা বাচ্চা কোলে নিতে পারছিস না? আমাদের মীরা তো সারাক্ষণই ওকে কোলে নিয়ে ছোটাছুটি করে। ওর নাম কে রেখেছ বল তো। মীরা নিজের নামের সাথে মিলিয়ে মাহা রেখেছে। সুন্দর না? এখন তো রাগ করে আছে। আমি বাবু কোলে নিয়েছি দেখলে দেখতিস কী করে। আমার কাছ থেকে কেড়ে বাবুকে নিয়ে যেত। প্রচন্ড রাগী মেয়ে।”

চলবে_