মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০১

0
816

#মন_ভেজা_শ্রাবণে ❤️ ( রোম্যান্টিক লাভ)
সূচনা পর্ব
সাদিয়া আফরিন নিশি

মনের মানুষটিকে অন্য কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখলে কোনো মেয়েই তা মেনে নিতে পারে না। আর যদি হয় তা টিনএজ মেয়েদের ক্ষেত্রে তাহলে তো তা খুবই ভয়ংকর। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে আজ অন্তির জীবনে প্রথম দিন কলেজে এডমিশন নিতে এসে তার চোখ জোড়া যাকে দেখার জন্য হন্যে হয়ে ছিল তার সেই প্রাণপ্রিয় আদ্র ভাই একটি স্মার্ট, সুন্দরী মেয়ের সংস্পর্শে। গরমের উত্তাপে আদ্রের ললাটে জমে থাকা বিন্দু, বিন্দু ঘাম গুলো মেয়েটি খুব সন্তপর্ণে টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে। মুহূর্তেই একরাশ খারাপ লাগায় ছেঁয়ে গেল অন্তির ছোট হৃদয়। তখনই পাশ থেকে তার আম্মু রুপালি বেগম বলে উঠল,

“কী রে এভাবে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেনো? চল..”

অন্তি চোখের কোণে সদ্য জমে ওঠা পানিটুকু অগোচরে লুকিয়ে ফেলল। অতঃপর থমথমে মুখে বলল,

“হ্যাঁ চলো।”

একটু যেতেই রুপালি বেগম উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলেন,

“এই অন্তি দাড়া দাড়া। ওই তো আদ্র। মনে মনে আমি তো ওকেই খুঁজছিলাম। দাড়া ওকে ডেকে নিয়ে আসি। ছেলেটা থাকলে সুবিধা হবে। ওর চেনাজানা আছে তো সব তাড়াতাড়ি ভর্তি-টা করিয়ে দিতে পারবে। আমার আবার ডক্টরের এপয়েন্টমেন্টের টাইম হয়ে যাচ্ছে।”

অন্তির ছোট্ট হৃদয়ে অভিমানের পাহাড় জন্মেছে। সে মুখ ভার করে রুপালি বেগমকে বলল,

“থাক না আম্মু। শুধু শুধু আবার ওনাকে বিরক্ত করা কেন? দেখছ না উনি বিজি আছে।”

রুপালি বেগম মেয়ের কথায় বিরক্ত হলেন। অন্তির কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন,

“তুই থাম তো। ও কিসে ব্যস্ত শুনি৷ ওই তো দিব্বি আড্ডাবাজি করছে। আর আমাকে দেখলে বরং আরও খুশিই হবে।”

অন্তি ব্যর্থ কন্ঠে বলল, “তোমার যা ইচ্ছে করো।”

ততক্ষণাৎ রুপালি বেগম হাসোজ্জল মুখশ্রীতে এগিয়ে গেলেন আদ্রের নিকটে। অন্তি সেখানেই গাল ফুলিয়ে দাড়িয়ে রইল। ওখানে গিয়ে ইজ্জত খুয়ানোর কোনো মানে হয় না।

অদূরে দাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে থাকা অন্তিকে এক পল দেখে ততক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিলো আদ্র। পরপরই খালামনিকে দেখে হাসোজ্জল মুখে এগিয়ে এলো কয়েক কদম। রুপালি বেগম ততক্ষণে আদ্রের কাছাকাছি চলে এসেছে। আদ্র খালামনিকে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল,

“তোমরা এখানে?”

“অন্তিকে কলেজে ভর্তি করাতে এসেছি। তুই একটু সাথে চল না বাবা। একটু যদি তাড়াতাড়ি হয়। আমার আবার ডক্টরের কাছে যেতে হবে।”

“আচ্ছা চলো খালামনি।”

আদ্র ওর বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে রুপালি বেগমের সঙ্গে যখনই আসতে নেবে ঠিক তখনই সেই সুন্দরী মেয়েটি এক প্রকার দৌড়ে এসে তাদের সামনে দাড়ায়। আদ্র ভ্রু কুঁচকায়। রুপালি বেগম একবার আদ্রের দিকে তো একবার মেয়েটির দিকে তাকায়। অকস্মাৎ মেয়েটি রুপালি বেগমের পায়ে ধরে সালাম করে বসল। অতঃপর লজ্জা লজ্জা মুখশ্রীতে মাথা নুয়িয়ে বলল,

“আমি নিহাত। উনি নিশ্চয়ই বলেছে আমার কথা?”

শেষোক্ত কথাটি নিহাত আদ্রকে ইঙ্গিত করে বলেছে৷ রুপালি বেগম কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তবুও কোনো রকমে মাথা দুলিয়ে, “হ্যাঁ” বললেন। এদিকে আদ্রের চক্ষু চড়কগাছ। একে তো এসেই সালাম করল এখন আবার যা তা বলছে। আদ্র কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলল,

“এই তুমি এসব কী বলছো? যাও এখান থেকে আমাদের জরুরি কাজ আছে। সময় নষ্ট কোরো না।”

আদ্রের ধমকে নিহাত একটু মন খারাপ করল পরপরই আবার উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠল,

“আমিও যাবো আপনাদের সঙ্গে।”

আদ্র ততক্ষণাৎ বিষম খেলো। এমনিতেই অদূরে তার শ্রেয়সী রণচণ্ডী রুপে অবতার হয়ে এসেছে। তার ওপর ওকে সাথে নিলে নির্ঘাত বিয়ের আগেই তাকে বিধবা’র মেল ভার্সন যেটা আছে সেটা হতে হবে। আদ্র এবার কড়াকড়ি গলায় বলল,

“কথা কানে যাচ্ছে না যাও বলছি।”

নিহাত মুখ কালো করে দৌড়ে চলে গেল। আদ্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ক্লোজ ফ্রেন্ডের বোন বলে কিছু বলতে পারে না। নয়তো কবেই সাইজ করে ফেলত। এমনিতেই সকাল সকাল ন্যাকামি করতে এসে তার বিরাট বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। এখন তার পিচ্চি টার মান ভাঙাতে না জানি তাকে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। তার ওপর আবার খালামনির সামনে ইস্ ইজ্জতের অমলেট হয়ে গেল।

“এভাবে কেনো বলতে গেলি। ও আমাদের সঙ্গে গেলে তাতে কী এমন হতো?”

“কী হতো না হতো তা তুমি বুঝবে না খালামনি। তুমি বরং চলো।”

“হুম চল। তবে মেয়েটা কিন্তু ভারী মিষ্টি। তোর সঙ্গে দারুণ মানিয়েছে।”

“এসব তুমি কী উল্টাপাল্টা বকছো খালামনি। তুমি যা ভাবছো তেমন কিছু না।”

“হুম হুম বুঝি বুঝি এসব বয়স আমরা অনেক আগেই পাড় করে এসেছি। আর নাটক করতে হবে না। বললাম যে মেয়েটাকে আমার দারুণ লেগেছে। কী লাজুক, মিষ্টি দেখতে।”

“আহহ খালামনি থামবে তুমি। ওহ আমার বন্ধুর বোন তাই একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে কিছু বলতে পারি না বিধায়। আর বেশি মিষ্টিতে আমার ডায়াবেটিস আছে। এবার এই টপিক বাদ দিয়ে সামনে এগোও।”

আদ্রের চেহারায় বিরক্ত + রাগ দু’টোই স্পষ্ট। রুপালি বেগম তাই আর বেশি ঘাটলেন না। হতেও পারে তার বোঝার ভুল। আর আদ্রের মধ্যে কোনো পজিটিভ রিয়াকশন সে পায় নি তাই জোর দিয়ে কিছু বলারও নেই। অগত্যা তারা জোর কদমে হেঁটে অন্তির কাছে যায়।

মেয়ের থমথমে মুখশ্রী চোখ এড়ায় না রুপালি বেগমের। মেয়েটা তার বড্ড অভিমানী। নিজের মনের কষ্ট, চাওয়া, পাওয়া কিচ্ছু কারো সঙ্গে শেয়ার করে না।নিজের মধ্যে চেপে রাখে। তবে অল্পতেই কেঁদে ভাসায়। আবার সেই কান্নাটাও থাকে সকলের অগোচরে। কিন্তু মায়ের মন সব বোঝে। এই মেয়েটা তার কলিজার এক পাশ। মেয়ের কিছু হলে তিনি ভেতরে ভেতরে ব্যাকুল হয়ে পড়েন কিন্তু ওপরে তা বোঝা দায়।

“কী হয়েছে মুখ ভার করে আছিস কেনো?”

অন্তি মায়ের প্রশ্নে ঘাবড়ে যায়। মুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে বলে,

“কই আমি তো ঠিকই আছি। আসলে প্রথম দিন তো একটু নার্ভাস।”

কথা শেষ করে অন্তি মাথা নিচু করে ফেলে। মায়ের চোখে তাকিয়ে থাকলে নির্ঘাত কেঁদে ফেলবে।

রুপালি বেগমের পাশে দাড়িয়ে আরো এক জোড়া চোখ তার এই লুকোচুরি খেলা ধরে ফেলেছে অনেক আগেই। কিছু একটা দেখে শান্তি পেলেও শ্রেয়সীর অভিমান বড্ড বেশি পোড়াচ্ছে তার অন্তরীক্ষ। উহ ওই নিহাত আসার আর সময় পেল না। শুধু শুধুই কতো কাহিনি করে ফেলল। তার খালামনি টাও যদি একবার তাকে জানিয়ে আসত তবে আগে থেকেই সতর্ক থাকা যেতো। নিহাত নামক আপদ টার জন্য তার শ্রেয়সী তার ওপর অভিমান করতো না। অকস্মাৎ আদ্রের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল।সে অন্তির মন ভালো করার জন্য তার পেছনে লাগতে শুরু করল। ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলল,

“আরেহ খালামনি বুঝতে পারছো না। তোমার মেয়ে আই মিন আমার খালাতো বউ আই মিন ধান্ধাবাজ বাপের ধান্ধাবাজ মেয়ে সে তো এই কলেজে ভর্তি হতে অনিচ্ছুক। কারণ হলো এখানে আমি আছি। আর আমি থাকলে তার ধান্ধাবাজি কখনোই সফল হতে দিবো না। তাই সে চাইছে অন্য কলেজে গিয়ে ধান্ধাবাজি ব্যবসা টা খুব ভালো ভাবে স্টার্ট করতে।”

অন্তি রেগে গেল ভীষণ। এমনিতেই আদ্রের সঙ্গে কথা বলবে না বলে পণ করেছিল কিন্তু এর সঙ্গে কথা না বলে থাকা অসম্ভব। বজ্জাতের হাড্ডি একটা। অন্তি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

“এই আপনি আমায় আবার খালাতো বউ বললেন। বলেছি না এসব বাজে কথা একদম আমাকে বলতে আসবেন না। আর আমি বা আমার বাবা কেউই ধান্দাবাজ নই। ধান্দাবাজ আপনি আপনার চৌদ্দ গুষ্টি।”

“এই এই শুরু হয়ে গেল তো তোর ধান্দাবাজি। আরেহ খালাতো বউ কী আর আমি প্রথমে বলতাম নাকি? তোর মনে নেই ছোট বেলায় আমার পেছন পেছন ঘুরতি আর বর-পুতুল খেলার জন্য বলতি। আর আমি না খেললে সে কী কান্না তোর। আর তখনই তুই বলতি আমি তোর খালাতো বর তুই আমার খালাতো বউ। শেষমেশ পড়াশোনা সিকায় তুলে তোর সঙ্গে খালাতো বর-বউ খেলতে লেগে যেতাম। তুই কী সব ছাঁই পাস রান্না করে দিতি আমাকে তাই খেতে হতো। ইস জীবন ডা বড় বেদনার।”

অন্তি রেগেমেগে রুপালি বেগমকে বললেন,

“আম্মু তোমার বোনের ছেলেকে থামাও বলছি। আমি কখনোই এসব বাজে কাজ করি নি। সব তার কারসাজি।শুধু শুধু আমার নামে অপবাদ।”

রুপালি বেগম কিছু বলতে নেবেন কিন্তু দেখা যায় আদ্র তার কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে,

“এই দেখ আবার ধান্ধাবাজি করছিস তো। তুই আর তোর বাপ টা আসলেই ডিগ্রি প্রাপ্ত ধান্ধাবাজ।”

“আপনি আবার আমাদের ধান্ধাবাজ বলছেন। আপনাকে তো আমি……”

অবশেষে রুপালি বেগম মৃদু চিৎকার দিয়ে বললেন,

“আহহহ তোরা থামবি লেট হচ্ছে তো।”

“আম্মু তুুমি তোমার বোনের ছেলেকে কিছু বলছো না কেনো? সে যে সমানে আমার বাবাকে ধান্ধাবাজ বলছে। সিম কোম্পানিতে কাজ করলেই কেউ ধান্ধাবাজ হয়ে যায় নাকি? আমার বাবা তো সাধারণ একজন ইম্পোলয়ি মাত্র। ধান্ধাবাজি কেউ যদি করেও থাকে তবে তা কোম্পানির মালিক করেছে। আর সত্যিই যদি এমন কিছু হয়ে থাকতো তবে কোটি কোটি মানুষ কখনোই রবি সিম ইউজ করতো না। আচ্ছা সে নিজেই বলুক এতো যখন বোঝে তখন নিজে কেন এই সিম ইউজ করে শুনি?”

“আরেহ আমার মতো দয়াবান পাবলিক আছে বলেই তো তোরা বাপ-মেয়ে এখনো ধান্ধাবাজি করে বেঁচে আছিস। আমরা যদি এই সিম না ইউজ করি তাহলে তোদের এই অফার, সেই অফার বলে বলে ধান্ধাবাজিগুলো কাদের ওপর এপ্লাই করবি। তখন তো তোর বাপের বসের কোম্পানি লাটে উঠবে সেই সঙ্গে তোর বাপও। আর সেই সঙ্গে তোরাও। তবে এই দয়াটুকু আমি তোদের ওপর দেখাই শুধু মাত্র আমার খালামনি টার জন্য। তার কষ্ট হলে আমারও কষ্ট হবে। তাই আরকি।”

অন্তি এবার রেগেমেগে আদ্রের দিকে তেড়ে আসতে নিলে রুপালি বেগম ঝট করে তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যায়। তিনি বুঝে গেছেন এরা নিজে থেকে থামার নয়। আদ্র ওদের পেছন পেছন হাসোজ্জল মুখে হাঁটতে থাকে। অন্তি মায়ের শক্ত বাঁধনে আটকা পড়েও বারকয়েক পেছন ফিরে আদ্রকে চোখ গরম দেখিয়েছে। দেখা যায় আদ্র তাতে দ্বিগুণ মজা পেয়ে হু হা করে হেসে উঠেছে

——————-

চলবে,