মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০২

0
496

#মন_ভেজা_শ্রাবণে❤️
পর্ব – ২

——————————-
ভর্তি শেষে রুপালি বেগম আদ্রকে বলেন,

“আব্বা আমার আমি এখন ডক্টরের চেম্বারে যাবো। আসতে লেট হতে পারে। তোর কী সময় হবে অন্তিকে তবে বাড়িতে রেখে আসতি।”

“ওকে খালামনি তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি ওকে দিয়ে আসছি।”

তাদের কথার মধ্যে বাঁধ সাধল অন্তি। বিরোধিতা করে বলল,

“নাহ আম্মু আমি বরং তোমার সঙ্গেই যাই। লেট হলেও আমার কোনো প্রবলেম নেই।”

“আহ তুই সবসময় বেশি কথা বলিস। আদ্রের সঙ্গে বাড়িতে যা। আর হ্যাঁ রান্না করা আছে খেয়ে নিস। সকালেও তেমন কিছু খাস নি।”

বাধ্য হয়ে অন্তিকে থেকে যেতে হলো। রুপালি বেগম খুশি মনে চলে গেলেন। অন্তি আদ্র’র দিকে তাকালো। অকস্মাৎ তখনকার দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুহুর্তেই কেমন অস্থির হয়ে উঠল সে। আদ্র এতক্ষণ কাউকে কিছু টেক্সট করছিলো। কাজ শেষ করে অন্তির দিকে তাকাতেই দেখল অন্তি কেমন জানি অস্থির হয়ে আছে। আদ্র অন্তির কাছে গিয়ে নম্র কন্ঠে বলল,

“কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?”

অন্তির রাগ হলো ভীষণ। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করায় চেষ্টায় বলল,

“নাহহ ঠিক আছি।”

আদ্র আরেকটু নিকটে এসে অন্তির ছোট্ট নমনীয় ডান হাতটি নিজের বা হাতের বন্ধনে আঁকড়ে নিলো। অন্তি ততক্ষণাৎ সেই হাত মোচড়াতে শুরু করল। উদ্দেশ্য আদ্রে’র কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া। কিন্তু তার সকল মোচড়ামুচড়ি বন্ধ হলো আদ্র’র এক ধমকে। আদ্র রক্তিম দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

” এমন ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছিস কেনো? লাফালাফি বন্ধ করে সোজা হয়ে দাড়া।”

অন্তি লাফালাফি বন্ধ করল ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি দমে গেল না। গলার স্বর নামিয়ে বলল,

“হাত টা ছেড়ে দিন।”

আদ্র অন্তির কিঞ্চিৎ সংস্পর্শে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ছাড়ার জন্য ধরেছি কী?”

অন্তির হৃদয় ধক করে উঠল। সে আর টু শব্দটি করল না। আদ্র মুচকি হেসে অন্তিকে সঙ্গে করে হাঁটতে লাগল। আদ্র অন্তিকে নিয়ে ওর ফ্রেন্ডদের কাছে গেল। ছোট্ট করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“ও অন্তি।

আদ্র’র ফ্রেন্ড মিহু, তিহা, রওনক, সাহেল, ইসতি ওখানে উপস্থিত ছিল। শুধু ছিল না নাবিল আর নিহাত। নিহাত নাবিলের ছোট বোন। এই কলেজেই পড়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। নিহাতের মধ্যে একটু সমস্যা আছে। সে মানসিক ভাবে বিক্ষিপ্ত। একটু পাগলাটে টাইপ। সুইসাইড করার ইন্টেনশন বেশি৷ ছোট খাটো বিষয় গুলোতেও অনেক বড় কাহিনী করে ফেলে। সে আবার আরও কয়েক বছর আগে থেকেই আদ্র’র জন্য পাগল। বন্ধুর বোন তার ওপর ওর মানসিক দিক বিবেচনা করে নিহাতকে আদ্র জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। তবে অতোটাও প্রশ্রয় দেয় না। আদ্র বেখেয়াল থাকতেই হুটহাট নিহাত তার সুযোগ নিয়ে এটা ওটা করে বসে। যেমন আজ সকালেও এমনটাই হয়েছিল। আদ্র বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিল ঠিক তখনই নিহাত কোত্থেকে উড়ে এসে আদ্র’র মুখ মুছে দিতে শুরু করে দিল। আদ্র বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে নিবে ঠিক তখনই তার চোখে পড়ে অদূরে দাড়িয়ে থাকা অন্তিকে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তিকে দেখে আদ্র ঘাবড়ে গিয়ে নিহাতকে কিছু বলতেও পারে নি। নয়তো এই কাজের জন্য নিহাতকে অনেক বকা খেতে হতো। আদ্র তখন কিছু বলতে পারে নি দেখেই নিহাত সাহস করে রুপালি বেগমের সম্মুখে গিয়ে অমন একটা কান্ড করে বসে। ভেবেছিল আদ্র হয়তো ভালো মুডে আছে তাই কিছু বলছে না। পরপরই আদ্র’র ধমকে সেখান থেকে মন খারাপ করে চলে যায়। আদ্রই একমাত্র ব্যক্তি যার ধমকে নিহাত রেগে যায় না বরং উপভোগ করে। নয়তো অন্য কেউ তাকে কিছু বললে তুলকালাম কান্ড করে ছাড়ে। সবই অবশ্য তার ওই মানসিক সমস্যার জন্য। আদ্রর কাছে নাবিল পারসোনাল রিকুয়েষ্ট করেছে যাতে করে তার বোনটাকে একটু ম্যানেজ করে নেয়৷ এটা নিয়ে যদিও সে প্রায় প্রতিদিনই আদ্রর কাছে ক্ষমা চায়।

আদ্র অন্তির পরিচয় দিলে দেখা যায় তার সঙ্গে সবাই হেসে হেসে কথা বলছে শুধু একজন ছাড়া। আদ্র তার বন্ধুদের পরিচয় দিলে অন্তি তখন জানতে পারে ওই মেয়েটির নাম মিহু। মিহুকে দেখে মনে হচ্ছে সে অন্তিকে দেখে খুশি নয় কিন্তু কেনো?

——————-
বাইক চলছে ধীর গতিতে। অন্তির ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এতো স্লো কেউ গাড়ি চালায়? আদ্র যে ইচ্ছে করেই এমন টা করছে এটা অন্তির অজানা নয়। এক পর্যায়ে ধৈর্য হারিয়ে অন্তি ক্ষেপে ওঠে। উগ্র কন্ঠে বলে,

“এটা কী শুরু করেছেন হ্যাঁ? মনে তো হচ্ছে বাইক না ঠেলাগাড়ি চলছে।”

“আমার এতো সুন্দর,স্টাইলিশ, দামী বাইক টাকে তোর ঠেলাগাড়ি মনে হচ্ছে। ওয়েট বেইবি এবার তোমাকে দেখাবো এই আদ্র’র ম্যাজিক।”

অন্তি মুখে ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকাল। অকস্মাৎ জোর ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে সে গিয়ে পড়ল আদ্র’র ওপর। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আদ্র’র শার্ট খামচে ধরল। বাইক চলছে ঝড়ের গতিতে। মনে হচ্ছে কোনো টর্নেডো চলছে। ভয়ে অন্তির আত্মা শুকিয়ে। চোখ সেই যে বন্ধ করেছে খোলার সাহস মেলে নি আর।

“এভাবেই চেপে ধরে মে’রে ফেলবি নাকি আমায়?”

আদ্র’র কন্ঠে ঘোর কাটে অন্তির। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। বাইক থেমেছে। অন্তি আদ্রকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। তারা একটি রেস্টুরেন্টের সম্মুখে। অন্তি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। পরপরই আদ্রের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব ধরে। গভীর কন্ঠে বলে, “নেমে দাড়া।”

অন্তি কেমন জানি ভড়কায়। এখানে কেনো এলো? বাড়িতে যাওয়ার কথা তো।

আদ্র বাইক পার্ক করে অন্তিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢোকে। রেস্টুরেন্ট টা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। বোঝাই যাচ্ছে এখানে অর্থবিত্ত লোকেদের আনাগোনা। আশেপাশে কতশত মানুষ৷ তাদের সকলের পোশাকে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। অন্তি তাদের দিকে একবার আর নিজের দিকে একবার দেখে নিল। তাকে এখানে কেমন জানি বেমানান লাগছে। আদ্র লক্ষ্য করল অন্তির নার্ভাসনেস। সে এক হাতের সাহায্যে অন্তিকে নিজের বাহুবন্ধনে আঁকড়ে নিলো। অন্তি হতভম্ব হয়ে আদ্রের দিকে তাকাল। ভীত, লজ্জিত দৃষ্টিতে বলল,

“ছাড়ুন। আশেপাশে কত মানুষ। সবাই দেখছে। কী ভাববে?”

আদ্র’র সাবলীল উত্তর, “এখানে আমাদের দেখার জন্য কেউ বসে নেই। সবারই নিজস্ব কাজ আছে।”

অন্তি এবার ভালো ভাবে আশপাশ টা দেখে নিলো। সত্যিই কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে নেই। সকলেই নিজেদের মতো ব্যস্ত। সে আর কোনোরুপ দিরুক্তি ছাড়া আদ্র’র সঙ্গে একটা টেবিলে গিয়ে বসল। টেবিল টায় তিনটে চেয়ার সেট করা। অন্তিকে আদ্রর ডান সাইডের সিটে। বাম পাশটা ফাঁকা। অন্তি ভাবছে এখানে আবার কে বসবে। ইচ্ছে থাকলেও প্রশ্নটি করার মতো সাহস হলো না তার। ততক্ষণে আদ্র খাবার অর্ডার করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাহারি আইটেমের খাবারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল টেবিলটি। আদ্র একটা ফ্রাইড রাইসের প্লেট এগিয়ে দিল অন্তির সামনে। সঙ্গে একটা চিলি চিকেন। নিজের জন্যও নিয়ে নিলো। কন্ঠে গাম্ভীর্য টেনে বলল,

“নে শুরু কর।”

অন্তি ইতস্তত বোধ করছে। এমন জায়গায় সে কখনো আসে নি। আসবে কী করে, আদ্রদের মতো তারা তো আর বিত্তশালী নয়। তার বাবা সামান্য সিম কোম্পানির এমপ্লয়িয়ার। বলতে গেলে একটা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি তারা। এমন বিলাসিতা তাদের জন্য নয়। অন্তিকে চুপ থাকতে দেখে আদ্র দুষ্টু কন্ঠে বলল,

“খাইয়ে দিতে হবে নাকি? আমার কিন্তু কোনো অসুবিধা নেই। সুন্দরীদের জন্য এই আদ্র সর্বদা তৎপর।”

অন্তি থতমত খেলো। চোখ গরম করে তাকালো আদ্রের দিকে। মিনমিনিয়ে বলল,”অসভ্য।”

♠♠
আদ্র নিজের মতো করে খেয়ে চলেছে। কখনো সস নিচ্ছে তো কখনো চিকেন। যখন যেটা প্রয়োজন। কিন্তু ঠিকঠাক খেতে পারছে না অন্তি। এখানো তিন ভাগের এক ভাগ খাবারে সে আটকে। আদ্র নিজে খাবার তাকে বেশ কয়েকবার ধমকেছে কিন্তু দেখা গেছে তাতে বিন্দু মাত্র লাভ হয়নি। অন্তি সেভাবেই মুরগির বাচ্চার মতো টুকে টুকে খাচ্ছে।

অকস্মাৎ মুখের সামনে খাবারের লোকমা দেখে চমকে উঠে অন্তি। সামনে তাকিয়ে আর বুঝতে বাকি নেই এবার সে শেষ। আদ্র চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে খাবার বাড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ রেগে গেছে। অন্তি বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলল। অতঃপর যেই না কিছু বলতে নেবে দেখা যায় আদ্র তাকে থামিয়ে দেয় নিজের গম্ভীর কন্ঠ দ্বারা।

“একটাও কথা নয় চুপচাপ হা কর। নয়তো কাল সকালের ব্রেকিং নিউজ হবে,পাঁচতলা বিশিষ্ট রেস্টুরেন্টের ছাদ থেকে ঝাপ মে’রে ১৭ বছরের কিশোরীর মৃ’ত্যু।”

অন্তি চোখ রসগোল্লার মতো করে ফেলে। চটজলদি আদ্র’র হাত থেকে খাবার টা খেয়ে নেয়। বলা তো যায় না কখন কী হয়ে যায়। এই লোককে দিয়ে বিশ্বাস নেই। একেবারে ভয়ংকর পুরুষ মানুষ। যখন তখন যা কিছু করে ফেলতে পারে।

——————-

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি