মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০৪

0
389

#মন_ভেজা_শ্রাবণে❤️
পর্ব – ৪
————-
এবারে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বাইক চালায় আদ্র। অন্তিকে নামিয়ে দিয়ে ঝড়ের গতিতে বাইক টেনে উধাও হয়ে যায়।
আদ্র’র বাইকের চিহ্ন যতক্ষণ ছিলো অন্তি গেটের কাছে দাড়িয়ে একদৃষ্টে ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ছিল। আদ্র’র বাইক টি অদূরে মিলিয়ে যেতেই অন্তিও বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়।

রুপালি বেগম বাড়িতে ফিরতে ফিরতে তিনটে বেজে যায়৷ ক্লান্ত শরীরে ঘরে প্রবেশ করেন তিনি। অন্তি তখন বেঘোরে ঘুমচ্ছে। বাড়িতে এসে আদ্র’র কথা ভেবে মন খারাপ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তা সে নিজেও জানে না। ডুপ্লিকেট চাবি দ্বারা বাড়িতে ঢুকেছেন রুপালি বেগম। কারণ অন্তি কলিং বেল, ফোন কোনোটাই তুলছে না। অগত্যা কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়েই রুপালি বেগম মেয়ের ঘরে যায়৷ পরপরই অন্তির ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

———–
ঘুম ভেঙেও যেন ভাঙতে চাইছে না অন্তির। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের অধিক ভয়, অধিক টেনশন, অধিক নার্ভাসনেসে ঘুম পায় ভীষণ। আবার কারো কারো এমন সিচুয়েশনে ঘুম, খাওয়া সব উবে যায়। অন্তি হলো প্রথম সারির মানুষ। যার অধিক মাত্রায় সংক্রমণে তীব্র ঘুমে ধরে। আদ্রকে নিয়ে সে একটু বেশিই অস্থিরতায় ছিলো যার ফলে তার মনটাও ভীষণ খারাপ। কিছুতেই সকালে কলেজের ওই মেয়েটার কথা সে ভুলতে পারছে না।

ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে পড়ার টেবিলে বসে আছে অন্তি। উদ্দেশ্য আগামী দিনের জন্য কলেজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নেওয়া। ফার্স্ট টাইম তো তাই একটু বেশিই পরিপাটি হয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে সকালের সেই মেয়েটাকে টক্কর দেওয়ার জন্য হলেও মোটামুটি ভালোই প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু আদৌ কী তা সম্ভব হবে? দূর থেকে দেখলেও অন্তি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে মেয়েটি বেশ বিত্তশালী পরিবারের। তার সারা শরীরে আভিজাত্যের ছোঁয়া। এদিকে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে হয়ে অন্তির পক্ষে তাকে টেক্কা দেওয়া দূর্ভেদ্য বটে। অন্তির ছোট্ট হৃদয়টা এসব বিষয় ভেবে ক্ষীণ হয়ে পরল। ব্যাগ-পত্র টেবিলের এক প্রান্তে ঠেলে সে উঠে চলে যায় তার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায়।

নিকশ কালো আঁধার রাতের আকাশটা একটু বেশিই স্তব্ধ। মনে হচ্ছে আঁধারের চাপে সে গুমোট মে’রে আছে। এই আঁধারের কাছে ঝিকিমিকি জ্বলে ওঠা তারকার আলোয় যেন ঝিমিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে পঞ্জিকায় এখন কৃষ্ণপক্ষ তিথি বিরাজমান। গোটা শহর জুড়ে অমাবস্যার আঁধার।
ঠিক যেন অন্তির ছোট্ট হৃদয় টার মতো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের আধিপত্য দেখছে আর উসখুস মনে হাবিজাবি ভেবে চলেছে অন্তি। সহসা ফোনের মৃদু মৃদু আওয়াজ কর্ণগোচর হতে স্তম্ভিত ফিরে তার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘরে এসে ফোনটে হাতড়ে খুঁজে নেয়। হতে পারে কারো জরুরি দরকার। ফোনের স্কিনে তাকাতেই চমকে ওঠে অন্তি। গোটা গোটা অক্ষরে “আদ্র ভাই” নামটা ভেসে উঠেছে। অন্তি এক দৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে। ফোন রিসিভ করে না। করতে ইচ্ছে হয় না। অভিমান টা প্রগাঢ় হয়ে বক্ষস্থলে তীব্র আঘাত হানছে। ফোন রিসিভ করার ঈষৎ ইচ্ছে জাগ্রত হলেও তা খুব সন্তপর্ণে দমিয়ে ফেলল সে। বেশ কয়েকবার এভাবেই রিং বেজে বেজে কেটে গেল। অন্তির চোখে জল টলমল। একটু টোকা দিলেই যেন বাঁধ ভাঙে। টানা বাইশ বারে অন্তি ফোনটা রিসিভ করে। আর কতক্ষণ পারা যায়? ভালবাসার মানুষটির হাতছানি কখনোই কী অগ্রাহ্য করা যায়?

“এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে? ম’রে-টরে ছিলি নাকি?”

আদ্র’র গম্ভীর কন্ঠে কেঁপে ওঠে অন্তি। জানে এখন ঝড় উঠতে চলেছে। তবুও কিছু তো তাকে বলতেই হবে। চোখের সেই আটকে রাখা নোনাজল টুকু আদ্র’র কথায় এবার টুক করে গাল বেয়ে পড়ে। হাতের উল্টো-পিঠে সেটুকু মুছে ফেলে ভারাক্রান্ত কন্ঠে অন্তির উত্তর,

“ম’র’লে’ই তো আপনি খুশি।”

ওপাশ থেকে আর একটাও কথা শোনা গেল না। শুধু ভেসে এলো ফোন কেটে যাওয়ার টুট টুট শব্দ। অন্তির ছোট্ট হৃদয়ে চরম বেদনার আবির্ভাব ঘটল। প্রবল শক্তি প্রয়োগে ফোনটা অদূরে আছড়ে দিলো। ততক্ষণাৎ তা ভেঙে দু টুকরো। সেদিকে তার লক্ষ্য নেই। সে ব্যস্ত বিছানার চাদরে মুখ লুকতে। বালিশে মুখ গুজে চাদর খামচে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। সে কী চাপা আর্তনাদ। কেনো কাঁদছে সে? তার কান্নার আদৌ কোনো মানে আছে কী? আদ্রর জন্য? কিন্তু কেনো? আদ্রকে সে একটু একটু পছন্দ করে অনেক আগে থেকেই কিন্তু হয়তো শুধুই ভালো লাগা। যেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাবে। আর এমনিতেও আদ্র তো কখনো তাকে বলেনি যে সে অন্তিকে পছন্দ করে বা আদ্রর ব্যবহারেও এসব কখনো প্রকাশ পায় নি।আর না অন্তি কখনো তার অনুভূতি আদ্রকে জানিয়েছে। তবে কেনো অন্তি এতো কষ্ট পাচ্ছে?তাছাড়া আদ্র আর তার মধ্যে বিশাল তফাত। কাজিন হলেও তারা দু’জন দু’প্রান্তের। আদ্রদের স্ট্যাটাসের সঙ্গে সে কখনোই যায় না। শুধু শুধু আকাশকুসুম কল্পনায় বিভোর ছিল এতদিন। আদ্রের জায়গা থেকে সে একদম ঠিক।সে অন্য কাউকে ভালবাসতেই পারে। আর তা যদি হয় তার সমকক্ষ তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু এই সহজ কথা টা অন্তির মানতে এতো কেনো কষ্ট হচ্ছে? উত্তর পায় না অন্তি। কান্নার গতি ক্রমশ বেড়ে চলেছে তার। বালিশটা মাথার মধ্যে আরও একটু বেশি চেপে ধরে শব্দ থামানোর চেষ্টায় সে।

এরই মধ্যে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে হুঁশ ফিরে অন্তির। নিজের কর্মকান্ডে নিজেই অবাক সে। বালিশ থেকে মুখ তুলে তাড়াতাড়ি উঠে চোখমুখ ভালো ভাবে মুছে নেই। দৌড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ায়। চোখ মুখ ফুলে ঢোল। কী একটা অবস্থা। চোখ মুখে পানি না দিলেই নয়। কিন্তু ওদিকে দরজার শব্দ বেড়েই চলেছে। অন্তি ভাবল তার মা ডাকছে হয়তো। তাই সে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলল,

“তুমি যাও আমি আসছি আম্মু।”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। কিন্তু দরজার শব্দ বন্ধ হয়। অন্তি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে যায়। চোখে মুখে ভালো ভাবে পানি দিয়ে নেয়। এখন অনেকটা ঠিক আছে। তবুও চোখজোড়া হালকা লালচে, ওষ্ঠ মৃদু ফোলা, নাকের ডগা কিঞ্চিৎ লাল। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ কেঁদেছে। অন্তির হঠাৎ ভয় হলো। আম্মু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে সে? কেনো কেঁদেছে?

অনেক ভেবে চটজলদি একটা আইডিয়া বের করে ফেলল সে। হুম এটাই পারফেক্ট। বলবে মাথা যন্ত্রণায় এমন অবস্থা। এটা বললে তার আম্মু এক ঝটকায় বিশ্বাস করে নেবে। কারণ এমনটা তার প্রায়শই হয়। মাইগ্রেন আছে কি না।

রুম থেকে বেড়নোর আগে অন্তি আরেক দফা আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। যথা সম্ভব প্রস্তুত হয়ে নেয়। নিজের প্রতিচ্ছবি সঙ্গে নিজেই বিড়বিড় করে বলে,

“আর কখনো কাঁদবি না তুই অন্তি। আদ্র নামক পাষাণের জন্যে তো নয়ই। এখন থেকে আদ্র থেকে সবসময় আড়ালে থাকবি৷ মনে রাখিস এতে তোরই মঙ্গল। মরিচীকার পেছনে ছুটে অযথা নিজেকে কষ্ট দিস না। আদ্র তোর নয় অন্য কারো।”

ধীর গতিতে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল অন্তি। অন্তি সোফায় গিয়ে আরাম করে বসে টিভি ছেড়ে দিলো। রুপালি বেগমকে আশেপাশে না দেখে ভাবল হয়তো নিজের রুমে কোনো কাজে গেছে। তাই সেও আর ডাকলো না। আপাততঃ টিভি দেখার মুডে আছে সে। টিভি-টুভি দেখে মুডটা ফ্রেশ করতে চায় আরকি। অনিক আর তার বাবা এখনো বাসায় ফেরে নি। তাদের ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়।

আপন মনে টিভি দেখছে অন্তি। অকস্মাৎ তার চোখ যায় টিভি ক্যাবিনেটের ডান পাশে অবস্থানকৃত সিঙ্গেল সোফার দিকে। আচমকাই ধড়ফড়িয়ে উঠে সে। চোখ জোড়া বড় বড় করে চেয়ে আছে। বার কয়েক চোখে ঝাপটাও মেরেছে মনের ভুল ভেবে। সহসা গম্ভীর কন্ঠে বুঝতে পারে এটা সত্যিই কোনো কল্পনা নয়।

“ওভাবে কী দেখছিস? চোখ দিয়েই গিলে খাবি নাকি?

—————–

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি