মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০৩

0
436

#মন_ভেজা_শ্রাবণে❤️
(পর্ব – ৩)
—————-

লক্ষী মেয়ের মতো আদ্রর হাতে খেয়ে নিলো অন্তি। যদিও প্রচন্ড আনইজি লাগছিল তবুও খেতে হলো। খাওয়া শেৃলত
ষে আদ্র একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল অন্তির হাতে ধরিয়ে দিল এবং নিজেও একটা নিলো। অন্তি ছোট ছোট করে কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিচ্ছে। আদ্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তা উপভোগ করছে। এই মুহুর্তে আদ্র’র মনে কিছু অবাধ্য ইচ্ছে জাগছে কিন্তু সেটা একদমই নিষিদ্ধ। আদ্র মনের অস্থিরতা কমাতে কোল্ড ড্রিংকসের বোতলটা একদমে শেষ করে ফেলল। তবুও কিছুতে কিছু হচ্ছে না। অস্থিরতা কমার বদলে ধীরে ধীরে বাড়ছে। আদ্র ধপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। অকস্মাৎ ঘটনায় অন্তি ঘাবড়ে গিয়ে আদ্রের দিকে তাকায়। আদ্র টেবিলে দু’হাতের ভর ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে আছে। অন্তিও ততক্ষণাৎ উঠে দাড়ায়। আদ্রকে এভাবে দেখে তার চিন্তা হচ্ছে। তার কিছু হলো না তো? সে ঠিক আছে তো? কিছু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস পাচ্ছে না অন্তি। তবুও মনের সমস্ত ভয়কে একপাশে রেখে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

“কী হয়েছে আপনার? ঠিক আছেন তো? খারাপ লাগছে কী?”

অন্তি উত্তরের অপেক্ষায় উৎসুক। অন্তির ভাঙা গলায় সুমিষ্ট ছোট্ট ছোট্ট বুলি কর্ণপাত হতেই আদ্র দৃষ্টি মেলে। চটজলদি দৃষ্টি মেলায় অন্তির অক্ষিপটে। মিলিত হয় চারচোখ। আদ্র’র নেশাক্ত চাহনি। যেন সে কত বছরের তৃষ্ণার্থ। মোটামুটি গড়নের অক্ষিযুগলে তীব্র রক্তিমা জলন্ত। অন্তি খানেক ভড়কালো। এই দৃষ্টির সঙ্গে সে পরিচিত নয়। তার আদ্র ভাই কী তবে কোল্ড ড্রিংকসের বদলে নেশাক্ত কিছু সেবন করেছে? কিন্তু কে তাকে বোঝাবে এই নেশা সেই নেশা নয়। এটা মনের ঘরে জন্ম নেওয়া তীব্র মাদক। যার প্রতিকার শুধু প্রেয়সীর শীতল স্পর্শ দ্বারাই মোচনীয়।

অন্তি নিস্তেজ। ভীষণ নিস্তেজ। আদ্র সেভাবেই তাকিয়ে।
কারো মুখে কোনো বুলি নেই। প্রকৃতি যেন থমকে, থমকে সময়। অনুভূতির কাছে পরাজিত যেন।

সহসা তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে হুঁশ ফিরে দুজনার। নাবিল এসেছে। খুব তাড়া যেন তার। এসেই হুড়মুড়িয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়েছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে কিছু একটা তড়িঘড়ি করে বের করতে করতে ব্যস্ত কন্ঠে বলছে,

“দোস্ত তাড়াতাড়ি দেখ। আমার আবার সময় বেশি নেই। অনেকগুলো কাজ ডিউ আছে। তার ওপর আবার দুটোর মধ্যে বাড়িতে ফিরতে হবে। নয়তো বাবা ক্ষেপে যাবে ভীষণ।”

নাবিলের উপস্থিতিতে পরিবেশ বদলায়। থমকে যাওয়া সময়ে যেন ব্যস্ততার রেশ নামে। এতক্ষণের থমকে যাওয়া সময় যেন ঝড়ের বেগে ছুটছে আগের রুপে ফেরার তাগিদে। অন্তি গুটিশুটি মে’রে চেয়ারে বসে পড়ে। দু-হাতের বন্ধনে খুব দৃঢ়তার সহিত চেপে ধরা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল। যেন শরীরের সমস্ত শক্তি দ্বারা ওটা আঁকড়ে ধরে আছে। এই মুহুর্তে ওই ছোট্ট বোতলটাই তার পুরো দেহের ভিৎ।

আদ্র গুটিয়ে যাওয়া অন্তির মুখশ্রী পুণর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেয় বারকয়েক। অতঃপর মাথাটা এক ঝাকি দিয়ে সোজা হয়ে চেয়ারে বসে। মনোযোগী হয় নাবিলের দিকে। নাবিল ততক্ষণে একটা নোট আদ্রের সম্মুখে ধরে আছে। আর বলছে,

“এই নে এটাই তোর সেই কাঙ্খিত জিনিস।”

আদ্র মৃদু হেসে নোট টা নাবিলের থেকে নিয়ে নেয়। নাবিল দেড়ি না করে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ায়। ব্যাগ কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে হাত নেড়ে আদ্র’র উদ্দেশ্যে বলে,

“আচ্ছা আমি তাহলে আসি দোস্ত। রাতে কথা হবে। কল দিবো নে।”

আদ্র নোট গুলো চেক করে নিতে নিতে বলে,

“এখনি উঠবি। কিছু তো নে।”

নাবিল হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,

“নাহ রে এখন থাক। সময় কম।”

আদ্র নোট থেকে চোখ তুলে নাবিলের দিকে দৃষ্টি দেয়।

“একটা কফি নয়তো শুধু….. ”

আদ্রকে কথা শেষ করতে দেয় না নাবিল। দৌড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার অবস্থায় বলে,

“নো নো নো… ”

বলতে বলতে সে গায়েব। আদ্র আনমনেই হাসে নাবিলের এমন পাগলামি দেখে। বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। নিহাত যতটাই না উগ্র নাবিল ঠিক ততটাই সভ্য। বাবার বাধ্য সন্তান সে। বাবার সব আদেশ মেনে চলাই তার একমাত্র লক্ষ্য। আদ্র নিজের ব্যাগে নোট টা ভরে ফেলে। দৃষ্টি ঘুরায় অন্তির দিকে। অন্তি তখনো একই অবস্থানে। ওপর থেকে নিজেকে যতই শক্ত প্রমাণ করতে চাক না কেন ভেতর থেকে সে খুবই কোমল, আদুরে হৃদয়ের অধিকারীণি। ভয়, লজ্জা জিনিস টা তার ভেতরে একটু বেশি মাত্রায় বিরাজমান। যেমন টা ঠিক তার বিপরীতে আদ্র। বেপরোয়া, লাজ-লজ্জাহীন, একরোখা, জেদি টাইপ ছেলে সে। বাবা-মায়ের বেশি অর্থসম্পদ আর আহ্লাদের ফল এসব। রাগ যেন তার নাকের ডগায় সর্বক্ষণ।

গাড়ির সিটে বসতে বসতে নাবিলের মস্তিষ্কে কিছু একটা নাড়া দিয়ে ওঠেললৌ। সেলফোন টা পকেট থেকে বের করে চটজলদি কল লাগায় আদ্রকে।

ফের নাবিলের ফোন দেখে আদ্র আশ্চর্য হয় না। কারণ এমনটা সে প্রায় করে। ব্যস্ততার জন্য অনেক কথাই বলতে ভুলে যায় আবার কল করে জানায়। আদ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে কল টা রিসিভ করে। কানে তুলতেই নাবিলের অপরাধী কন্ঠ ভেসে আসে।

“শুনলাম আজও নিহাত তোকে বিরক্ত করেছে। বোনটাকে নিয়ে আর পেরে উঠছি না। বাবা কেন যে ওকে এতো আহ্লাদ দেন? কই আমাকে তো এতো সোহাগ করেন না। আচ্ছা যাই হোক, আজ নাকি তোর সেই পিচ্চি এসেছিলো। তার সামনেই নাকি নিহাত তোকে……।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় পার হয়। ওপাশ থেকে শুধু দীর্ঘ শ্বাস শোনা যায়। অতঃপর কয়েক মুহূর্ত পর আবার নাবিল বলতে থাকে,

” দেখেছিস কত বড় গাঁধা। এতো বড় একটা সুযোগ মিস করে গেলাম। তোর সেই পিচ্চি তোর সঙ্গেই আছে তাই না। এতই ব্যস্ত ছিলাম আমি যে ওকে খেয়ালই করি নি। আরেহ তোর পিচ্চি টা হয়তো সত্যিই একটু বেশি পিচ্চি নয়তো আমার এই তীক্ষ্ণ চোখ তাকে মিস করে কীভাবে বলতো? আচ্ছা তুই কী পীপিলিকার মধ্যে ডুবে গেলি নাকি?দেখিস তোর মতো হাতির নিচে চাপা পড়ে আবার পীপিলিকার পতন না ঘটে।”

শেষোক্ত কথা গুলো নাবিল মসকারার ছলেই বলল। যা বলে নিজেই হাসতে লাগল। আদ্রও না হেসে পারল না। সেও রসিকতা করে বলল,

“শালা আর মানুষ হইলি না। সামনে পাই একবার দেখাবো মজা। বাই দি ওয়ে, পীপিলিকার ন্যায় তোর চোখ হয়ে দাড়িয়েছে। যার জন্য কোনো কিছুই তোর দৃষ্টিগোচর নয়।”

দু বন্ধু এমন রসিকতাময় কথা বার্তায় শেষ করল তাদের আলাপণ। অন্তি খুব করে লক্ষ করল আদ্র’র হাসিমাখা বদনখানি। হাসোজ্জল মুখে তাকে কতই না সুন্দর লাগে। গালের কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান টোল পরা দেখতে কতই না মোহনীয়। আর রেগে গেলে পুরোই যেন রাক্ষস।

আদ্র ফোন কেটে অন্তির দিকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখল। পরপর চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল,

“তাড়াতাড়ি চল তোকে বাড়িতে ফেলে দিয়ে আমার আবার একটা জরুরি কাজে বাবার অফিসে যেতে হবে।”

অন্তির ভ্রু কুঁচকে এলো। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,’বাড়িতে ফেলে আসবেন মানে? আমি কী কোনো বস্তু নাকি?” মনের কথা মনেই চাপা পড়ে রইল। বিনাবাক্যে সে অগ্রসর হলো আদ্র’র পেছন পেছন। আদ্র খাবারের বিল টা পে করে দ্রুত গতিতে অন্তির হাত টেনে ধরে হাঁটতে লাগল। এই মুহুর্তে নাবিল আর আদ্রের মধ্যে বিন্দু মাত্র তফাত অন্তির চোখে ধরা পড়ছে না। নাবিলের ব্যস্ততা পূর্ণ চেহারার প্রতিচ্ছবি এখন আদ্রের মধ্যে। অন্তি ছোট্ট নির্বোধ মস্তিষ্কে উল্টোপাল্টা প্রশ্নের আনাগোনা। কীসের এতো তাড়া ওনার? বাবার অফিসে কাজ আছে শুধু কী তাই নাকি অন্য কেউ অপেক্ষায় আছে?”

অন্তির এসব উটকো চিন্তাধারা যদি আদ্র’র কানে কোনো মতে ঢুকতে সক্ষম হতো না জানি অন্তির কপালে তবে কী ছিল।

——————

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি