মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০৬

0
372

#মন_ভেজা_শ্রাবণে❤️
পর্ব – ৬
————–
গাল ফুলিয়ে বসে আছে অন্তি। পণ করে নিয়েছে আদ্র’র সঙ্গে আর একটা কথাও বলবে না। লোকটা বড়-ই নিষ্ঠুর।
আশ্চর্যজনক ব্যবহার তার। এই আগুন তো এই পানি। বাইকের মিররে অন্তির ফুলিয়ে থাকা গালে নজর বুলিয়ে মুচকি হাসে আদ্র। ইচ্ছে করে হঠাৎ বারকয়েক বাইক জোর টান মেরেছে যার ফলস্বরূপ অন্তি ছিটকে গিয়ে আদ্র’র গায়ের ওপর পড়েছে। অন্তি তাতে দ্বিগুণ রেগে গিয়ে নাকও ফুলিয়ে ফেলেছে। পারলে তো কেঁদেই ফেলে।

আদ্রদের দোতলা বাড়ি। অনেকটা বড়-ই। নিচতলা ভাড়া দেওয়া আর ওপর তলায় ওরা থাকে। আদ্র’র আরেকটি বোন আছে নাম আরিয়া৷ আরিয়া এ বছর ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। অন্তি আবার আরিয়ার প্রাণ। বলাবাহুল্য অন্তিকে তুমুল ভালবাসে আরিয়া। পারলে কলিজায় গেঁথে রাখে। আদ্র’র মা রুহানা বেগমও অন্তিকে ভীষণ ভালবাসেন। বোনের মেয়ে কম নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। আদ্র’র বাবা! আফরান সাহেব একজন গুরুগম্ভীর মানুষ। প্রয়োজনের অধিক কথা বলতে তাকে সচরাচর দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় ব্যবসার কাজে এ শহর ও শহর করে বেড়ায়। তবে তার আড্ডা জমে যেদিন অন্তির বাবা তাদের বাড়িতে আসেন সেদিন। দু’জনে তুমুল আড্ডা জুড়ে দেন। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই তারা সম্পর্কে ভায়রা। মনে হবে কিশোর কালের বন্ধু।

আদ্র অন্তিকে এখন তাদের বাড়িতেই নিয়ে এসেছে। অন্তির মা রুপালি বেগমকে কৌশলে আদ্র আগে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। যাতে করে অন্তির সঙ্গে একান্তে সময় কাটিয়ে তার মান ভাঙাতে পারে। অনিক আর অন্তির বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে তাদের কাজ শেষ হলে এ বাড়িতে চলে আসতে। তারাও আর দ্বিমত করে নি। দুই বাড়ির দুরত্ব মাত্র কয়েক কিলো.। বাইকে চেপে আসলে পা মিনিটে চলে আসা যায়। আজকে এই রাতের বেলায় দুই পরিবারের একত্র হওয়ার কারণ হলো “পিঠা”। এই পিঠা জিনিসটা দুই পরিবারের সকলেই পছন্দ করে। তাই প্রতিবারই যখনই পিঠা হয় রুপালি আর রুহানা বেগম একসঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে সকলের জন্য তৈরি করে। এমনিতেও এ বাড়িতে কিছু ভালো রান্না হলে ও বাড়ির মানুষকে না দিয়ে খায় না। এভাবেই তারা বেশ আছে।

♠♠
বাড়িতে ঢুকতেই অন্তি দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। পিঠার গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করছে। এতক্ষণে প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্তিকে দেখে রুহানা বেগম কন্ঠে পরম স্নেহ মিশিয়ে বললেন,

” এসে গেছিস। কেমন আছিস মা?”

“আলহামদুলিল্লাহ খালামনি অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আদ্র কোথায়?”

“ওনার ঘরে গেছেন।”

“ওহ আচ্ছা। তুই এদিকে বস। চেঁখে দেখ তো কেমন হলো?”

অন্তির দিকে দুটো পুলি পিঠা এগিয়ে দিয়ে বললেন রুহানা বেগম। অন্তি এক মুহূর্ত সময় নিল না। চটজলদি খেতে আরম্ভ করল। পিঠা মুখে পুড়েই বলল,

“উহুমম খালামনি ওয়াসাম। অনেক ভালো হয়েছে খেতে। তোমার হাতে জাদু আছে।”

রুহানা বেগম হাসলেন। কিন্তু খালা- বোনঝির এমন আহ্লাদ দেখে মুখ খুললেন রুপালি বেগম। খুনসুটির ছলে বললেন,

“হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো সব ক্রেডিট খালামনির আমি তো আর কিছুই করলাম না৷”

অন্তি ততক্ষণাৎ রুপালি বেগমকে পেছন থেকে জাপটে ধরে বলল,

“কে বলেছে তুমি কিছু করো নি। তোমার হাতে তো জাদুর বাক্স আছে আম্মু।নয়তো এমন চমৎকার হতো নাকি।”

অন্তির কথায় দুই বোনই শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে রুপালি বেগম এক বাটি ভর্তি করে পিঠা অন্তির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“আদ্র, আরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে খা। আমরা হাতের কাজগুলো শেষ করে আসি।”

অন্তি খুশি মনে পিঠা নিয়ে ওপরে চলে গেল। আরিয়ার ঘরে উঁকি দিতেই অন্তি বুঝতে পারল সে ঘরে নেই। বুঝল হয়তো আদ্র’র ঘরে। অন্তির চঞ্চলতা এবার কিঞ্চিৎ কমে এলো। সে ধীরুজ পায়ে আদ্র’র ঘরের সামনে গেলো। পর্দা সরাতেই দেখল দু ভাইবোন কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে আর ল্যাপটপ দেখছে। অন্তি দরজায় টোকা দিতেই ওরা ফিরে তাকালো। আদ্র কিছু বলার আগেই আরিয়া হাত বাড়িয়ে অন্তিকে কাছে ডাকল। অন্তি পিঠার বাটি টা ওদের সামনে দিয়ে একদম আরিয়ার কোল ঘেষে বসে ওকে জড়িয়ে ধরল। অতঃপর বলল,

“পিঠা খাও। গরম গরম খেয়ে নাও।”

আরিয়া অন্তির কপালে ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বলল,

“হুম খাচ্ছি। তুইও নে।”

আরিয়া নিজের জন্য একটা আর অন্তিকে একটা ধরিয়ে দিয়ে আদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভাইয়া তুমিও নাও।”

আদ্র’র সম্পূর্ণ মনোযোগ তখন ল্যাপটপে। সে সিরিয়াস মুড নিয়েই বলল,

“হুম নিচ্ছি। তোরা খেতে থাক।”

একটু পর আদ্র কাজ শেষ করে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে রেখে দেয়। তারপর আয়েশি ভঙ্গিতে বসে পিঠা মুখে তুলে নেয়। খেতে খেতেই অন্তির দিকে নজর বুলায়। অন্তি তখন আরিয়ার সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে চলছে নানা আলাপচারিতা। আদ্র পিঠায় কামড় বসাচ্ছে আর অন্তির গোলাপরঙা ঠোঁটের হেলিয়ে দুলিয়ে নেড়েচেড়ে কথা বলা দেখছে ৷ অকস্মাৎ বেখেয়ালিতে তার নিজের হাতে সে নিজেই কামড় বসিয়ে দেয়। পিঠা শেষ করে কামড় পড়ে হাতে। আদ্র ভ্রু কুঁচকে আহ শব্দে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। কামড় টা বেশ জোরেই পড়েছে। এমন একটি কামড় সে অন্তির মিষ্টি অধরে এঁকে দেওয়ার জন্য চিন্তায় মসগুল ছিল কিন্তু শেষমেশ হলো টা কী। নিজেই আহত হলো। আদ্র’র আর্তনাদে অন্তি,আরিয়া দুজনেই বকবকানি থামিয়ে ওর দিকে তাকালো। অন্তি কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর আরিয়া উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে ভাইয়া? আর ইউ ওকে?”

আদ্র ওদের এভাবে লক্ষ্য করাতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কোনোরকমে নিজেকে গুটিয়ে উত্তর দিলো,

“ওকে ওকে….. ”

বলতে বলতেই আদ্র ঘরের বাহিরে চলে যায়। অন্তি, আরিয়া হতভম্বের ন্যায় আদ্র’র চলে যাওয়া দেখে।

♣♣
রাতে অন্তির বাবা আর ভাই আসার পরপরই ড্রইংরুম জমে ওঠে। সকলে মিলে ডিনার করে জমিয়ে আড্ডা দিতে বসে। এই আড্ডা শেষ হতে হতে রাত তিনটেও বেজে যেতে পারে। অবশ্য এমনটাই এদের রেকর্ড আছে। আদ্র’র বাবা সন্ধ্যার পরপরই চলে এসেছিলেন। এসেই রেস্ট করে নিয়েছেন এখন তার মাইন্ড পুরোপুরি ফ্রেশ। আজ রাতে অন্তিরা সকলে এ বাড়িতেই থাকবে। এমনটা প্রায়শই হয়ে থাকে।

ঘড়ির কাটায় এক টা বাজতেই অনিক চলে গেল ঘুমতে। তার আবার সকাল সকাল ক্লাস আছে। আরিয়াও চলে গেল। যাওয়ার আগে অন্তিকেও তাড়া দিয়ে গেল। এ বাড়িতে আসলে এক্সট্রা রুম থাকা সত্ত্বেও অন্তি আরিয়ার সঙ্গে ঘুমায়৷ এই নিয়ম অবশ্য আরিয়াই ঠিক করেছে। আদ্র’র মাথাটা ধরেছে ভীষণ। সেও ধীরে ধীরে রুমে চলে যায়। এদিকে ছেলের ভাঙাচুরা চেহারা নজর এড়ায় না রুহানা বেগমের। সে ততক্ষণাৎ উঠে গিয়ে আদ্র’র জন্য এক মগ গরম গরম কফি করে নিয়ে ওর ঘরে দিতে যায়। ঠিক তখনই তার আদ্র’র বাবা বলেন,

“রুহানা আমাদেরকেও এক কাপ চা করে দিও তো।”

রুহানা বেগম থেমে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্তিকে ডাক দেয়। অন্তি তখন বাবা-খালুর থেকে এক রহস্যময় ঘটনা শুনছিল খুব মনোযোগ সহকারে। খালামনির ডাক পেয়ে সে দ্রুতই নেমে আসে তার কাছে। রুহাবা বেগম অন্তির হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে বলেন,

“যা তো মা এটা একটু আদ্রকে দিয়ে আয়। ছেলেটার মাথা ধরেছে। এটা খেলে ব্যথা কিছুটা কমবে। আমি যাই তোর বাবা, খালুকে চা দিয়ে আসি।”

আদ্র’র অসুস্থতার কথা শুনে অন্তির বুকটা ধক করে উঠল। সে একপ্রকার ছুট্টেই কফিটা নিয়ে গেল। আদ্র তখন ঘরের লাইক নিভিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে আছে। দরজা ভেজানোই ছিল। যারফলে অন্তি সামান্য ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাতের নিস্তব্ধতায় দরজার কর্কশ শব্দে কেঁপে ওঠে চারিদিক।

——————–

চলবে,
✍️সাদিয়া আফরিন নিশি