মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০৭

0
353

#মন_ভেজা_শ্রাবণে❤️
(পর্ব – ৭)
——–♦——-
নিস্তব্ধ কক্ষ জুড়ে শুধুই ভারি নিশ্বাসের শব্দ। আদ্র হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্তি খুব যত্নের সহিত আদ্র’র মাথাটা কোলের ওপর থেকে নামিয়ে রাখল। তারপর ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে নেমে জোর পায়ে হেঁটে ঘরের বাহিরে চলে আসল। দরজার সামনে এসে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। বাব্বাহ দমটা যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তার কাছাকাছি থাকলেই বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যায়। অনুভূতিরা নতুনত্ব পায় প্রতিমুহূর্তে। আর কিছু সময় এখানে থাকলে প্রাণটাই যেন চলে যেত।

ক্ষণকাল পূর্বে,
কফির মগ নিয়ে আদ্র’র ঘরে ঢুকতেই থমকে যায় অন্তি। ঘরটা পুরোই অন্ধকার। অন্তি ভেতরে ঢুকতে সাহস পেলো না। ওভাবেই দাড়িয়ে গলা ঝেড়ে ডাকল, “আদ্র ভাই।” ওদিক থেকে কোনো জবাব এলো না। দ্বিতীয় বার ডাকে আদ্র’র কাতর কন্ঠ ভেসে এলো, “ভেতরে আয়।” সেই কন্ঠ যেন অন্তির বুকে গিয়ে বিঁধল। লোকটা সত্যিই অসুস্থতায় ভুগছে। অথচ এতক্ষণ কতই না স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে সকলের সঙ্গে। কাউকে বিন্দু মাত্র বুঝতে দেয়নি। অন্তি এক এক কদমে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। আদ্র ল্যাম্পশেড টা জানিয়ে দেয়। অন্তি ধীরে সুস্থে কফির মগটা আদ্র’র সামনে ধরে। বলে,”এটা খেয়ে নিন,খালামনি পাঠিয়েছে ভালো লাগবে খেলে।” আদ্র সময় নিয়ে মগটা হাতে নেয়। আধশোয়া হয়ে বসতে নেয়। অন্তি ধরে তুলতে গিয়েও আবার থেমে যায়। কিছু একটা অদৃশ্য শক্তি তার কাজে সর্বদা বাঁধা হয়ে দাড়ায়। কফি খাওয়ার পুরোটা সময় অন্তি গুটিশুটি মে’রে ল্যাম্পশেডের পাশে দাড়িয়ে। উদ্দেশ্য কফির মগটা নিয়ে তবেই যাবে। কফি খাওয়া তো শেষ হলো কিন্তু আদ্র অন্তিকে যেতে দিলো কী! দিলো না!!
বিছানায় শুতে শুতে আদেশের সুরে বলল,”মাথাটা একটু টিপে দে তো বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে।” অন্তির অস্বস্তি হলো কিন্তু প্রকাশ করল না। আদ্র’র মাথার কাছে বসে তার কোমল, ছোট ছোট আঙুল গুলি চালিয়ে দিলো আদ্র’র চুলে। পরপরই নিজেই ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। অন্তি তখন আদ্র’র চুলে বিলি কাটতে ব্যস্ত ঠিক তখনই অকস্মাৎ আদ্র’র মাথা অন্তির ছোট্ট কোলটার মধ্যিখানে জায়গা করে নিলো। অন্তির তখন মরি মরি অবস্থা। নিজেকে সংযত করতে প্রায় দশ মিনিট লেগে গেলো। এতো কিছুর পরও আদ্র নিশ্চুপ। যন্ত্রণা টা তীব্র হচ্ছে তার। কথা বলার ইচ্ছে নেই৷ একটু ঘুমের বেশিই প্রয়োজন। সেই ঘুম এতো সহজে মিলবে না। প্রেয়সীর কোমল স্পর্শেই তা কেবল ধরা দিবে হয়তো।

——-♦——-
সকাল সকাল এ বাড়ি থেকেই কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয় অন্তি। রাতে অনিককে দিয়ে তার আম্মু অন্তির প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নিজ বাড়ি থেকে আনিয়ে রেখেছেন এ বাড়িতে। যাতে করে মেয়ের কোনো অসুবিধে না হয়। সাদা কামিজ,চুড়িদার, মাথায় সাদা হিজাব, হাতে সাদা ব্রেসলেট, এক হাতে সাদা পাথরের হ্যান্ডঘড়ি, ঠোঁটে হালকা করে গোলাপি লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কাজল। ব্যস একদম পারফেক্ট তৈরি অন্তি। কোমর অব্দি লম্বা চুল ক্যারি করা তার পক্ষে ভীষণ বিরক্তিকর এজন্যই মুলত হিজাব বেঁধেছে সে। হিজাবের নিচ দিয়ে কামিজের ওড়নাটা একপাশে পিন করে রেখেছে। হালকা সুতোর কাজে কারু-কার্যময় এই ড্রেসে অন্তিকে যেন দ্বিগুণ চমৎকার লাগছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো পবিত্র রাজ্যের শুদ্ধতম রমণী। আবার অনেকটা শরতের শুভ্র মেঘের মতো।

ডাইনিং টেবিলে সকলেই উপস্থিত। শুধু অন্তি ছাড়া। সকলেই খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে। সবার তাড়া আছে কি না। রুহানা বেগম আর রুপালি বেগম এখনো বসেন নি। তারা সকলকে বিদায় দিয়ে তারপর বসবেন। রুহানা বেগমের অনুরোধে আজকে বিকেল পর্যন্ত অন্তিরা এখানেই থাকবে। খেতে খেতে সকলের চোখ যায় হাতের ব্রেসলেট ঠিক করতে করতে আসা অন্তির দিকে। অন্তির চোখেমুখে বিরক্তি খেলা করছে। বোঝাই যাচ্ছে কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। এদিকে বাকি সকলের চোখে মুগ্ধতা। অন্তিকে দেখে সকলেই মুগ্ধ। মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই স্নিগ্ধ লাগছে কি না!!

ব্রেসলেট টা টানতে টানতে অন্তি এসে তার বাবার পাশে দাড়ালো। হাতটা এগিয়ে দিয়ে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,

“এটা একটু ছাড়িয়ে দাও তো বাবা। আমার এতো শখের ওড়না টার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল।”

জিয়া সাহেব লক্ষ্য করলেন অন্তির কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া ওড়নাটার কোণা বিশেষ হাতের ব্রেসলেটে আটকে আছে। অন্তি খুব যত্নের সহিত সেটা ছাড়িয়ে দিলেন। অন্তি একগাল হেসে বলল, “থ্যাংকিউ বাবা।” জিয়া সাহেব প্রতুত্তরে কিঞ্চিৎ হেসে মেয়েকে খেতে বসতে ইশারা করলেন।

আদ্র খাচ্ছে আর আড়চোখে একটু পরপরই অন্তিকে দেখছে। না চাইতেও তার চোখ চলে যাচ্ছে। বেহায়া মনটা আর মানে না। অন্তি অল্পস্বল্প খাচ্ছে আর আরিয়ার সঙ্গে কথা বলছে। এমন সময় অনিক বলে ওঠে,

“দ্রুত মুখ চালা নয়তো প্রথম দিনেই স্যারের থেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে হবে।”

“হ্যাঁ তুমি তো সব জানো।”

“জানি নয়তো কী আদ্রকে জিজ্ঞেস করে দেখ আমি কী কিছু ভুল বলছি? কী আদ্র তুই বল।”

আদ্র মুখ টিপে হেসে বলল, “উহুম!! একদম ঠিক বলছে অনিক। তোদের ক্লাস টিচার ওই যে পেট মোটা, টাকলা, ভুড়িওয়ালা আমিদ স্যার। উনি তো সবসময় ভীষণ সিরিয়াস। একটু এদিক সেদিক হলেই শেষ। দেখ তোর আজকে প্রথম দিন এখন যদি সে তোকে বেশি কথা শুনিয়ে বাহিরে কান ধরে দাড় করিয়ে দেয় তো, আবার তোর তো হিজাবে কান ঢেকে আছে দেখা গেল হিজাব খুলতে হলো সকলের সামনে, বা হাইবেঞ্চে কান ধরে উঠিয়ে দিলো, কিংবা পুরো কলেজ কান ধরে দৌড় করালো। কেমন হবে বিষয় টা একবার ভাব?”

অন্তির বিষম উঠলো ওদের কথা শুনে। সত্যিই তো এমন হলে ওই নিহাতের কাছে তাকে চরম অপমানিত হতে হবে। এদিকে অন্তির চিন্তিত মুখ দেখে অনিক আর আদ্র চোখ চাওয়া- চাইয়ি করে হাসছে। অনিক আবার বলে,”এই দেখ এখন আবার ভাবতে বসলি সময় কিন্তু আর মাত্র পনের মিনিট।”

অন্তি ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার গুলি মুখে পুড়ে উঠে পড়ল। এক প্রকার সকলের কাছ থেকে জোর বিদায় নিয়ে দৌড় লাগালো। পেছন থেকে আদ্র বলল,”আরে দাড়াবি তো একা একা যাবি নাকি আমরাও তো যাবো।”

রুহানা বেগম ছেলেদের কান্ডে কড়া ভাবে চোখ রাঙিয়ে বললেন, “এভাবে কেউ ভয় দেখায় বাচ্চা মেয়েটাকে। ঠিকভাবে খাওয়া টাও হলো না ওর।”

আদ্র,অনিক কিছু বলল না। মুচকি হেসে এগোলো। ওদের পেছনে আরিয়াও ব্যস্ত পায়ে ছুটলো।

আজ আর আদ্র বাইক নিলো না। চারজন তো আর বাইকে ধরবে না। তাই বাবার গাড়িটাতে করেই রওনা দিলো। ড্রাইভিং সিটে আদ্র। তারপাশে অনিক। পেছনের দুই সিটে আরিয়া, অন্তি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আরিয়া অন্তিকে কিছু ড্রেস কালেকশন দেখাচ্ছে যেগুলো সে অনলাইন থেকে অর্ডার করেছে। অন্তি মুগ্ধ নয়নে দেখছে। আসলেই ড্রেস গুলো অসম্ভব সুন্দর। আরিয়া অন্তির উৎফুল্ল নয়নের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সে এই সবগুলো ড্রেস নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্তির জন্যও অর্ডার করেছে। কিন্তু সেটা সে এখন অন্তিকে বলবে না। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দেবে।

আরিয়ার ফ্রেন্ড কল করায় সে ফোনে কথা বলছে। অকস্মাৎ অন্তির চোখ যায় গাড়ির মিররে যেখান থেকে একজোড়া চোখ তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টির গভীরতা মাপার সাধ্যি অন্তির নেই। সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। পরপরই শোনা গেল অনিকের কন্ঠ,

“ওই শালা দেখে শুনে ড্রাইভ কর। বাহিরে না দেখে মিররে কী দেখছ? এখনই মে’রে দিতিস।”

আদ্র সামনে তাকায়। অধরে এখনো মৃদু হাসি ঝুলছে। অনিকের এহেন বাক্যে তার উত্তর,

“অপ্সরী চিনছ তাই দেখি।”

অনিক আদ্র’র কপালে হাত রাখতে রাখতে বলল,”কী রে ভাই শরীর-টরীর খারাপ করলো নাকি তোর? এমন আবোলতাবোল বকছ কেন? শুনছি প্রেমে পড়লে মানুষ এমন আবোলতাবোল বকে, ভুলভাল দেখে। তোর কেস টা কী বলতো। ডুবে ডুবে জল-টল খাচ্ছিস নাকি?”

আদ্র স্টিয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে দৃষ্টি সামনে রেখেই বলল, “আচ্ছা তোরও বুঝি এমন হয়েছিল? ওই যে কী যেন নাম মেয়েটার?হ্যাঁ ‘পদ্ম’। পদ্মর সঙ্গে তোর…… ”

আদ্রকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অনিক ওর মুখ চেপে ধরে। ফিসফিসিয়ে বলে, “পেছনে বোনেরা আছে ভুলে যাস না। মান ইজ্জত খাবি নাকি!!”

অনিক সোজা হয়ে বসে। আদ্র বক্র হাসিতে নিমজ্জিত হয়।
পেছন থেকে ওদের কথোপকথন শুনে অন্তি লজ্জায় শেষ। তবে ভাই যে তার প্রেম করছে এটুকু সে বুঝে গেছে। উত্তেজনায় এখনই চেপে ধরতে উদ্ধত হচ্ছিল কিন্তু আদ্রর কথা মনে হতেই চুপসে যায়।

——-♦——-
গাড়ি এসে থেমেছে কলেজের সামনে। আরিয়া দ্রুত নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেছে। যাওয়ার আগে অন্তিকে বায় বলতে ভুলে নি। অনিক, আদ্র,অন্তি একত্রে হাঁটছে। সুবিশাল ক্যাম্পাস পেড়িয়ে তারা অন্তিকে নিয়ে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসের বসিয়ে দিয়ে আসে। অন্তির পাশে একজন মেয়ে। নিসন্দেহে এই ক্লাসের সবাই নতুন তাই আদ্র অন্তিকে নার্ভাস হতে নিষেধ করল। আরও কিছু আদেশ-নিষেধ বুঝিয়ে দিয়ে অনিক আর আদ্র বেড়িয়ে গেলো। এখনো স্যার ক্লাসে আসেনি। এখনো পাঁচ মিনিট হাতে আছে। তারমানে আদ্র তখন মশকরা করেছে। আনমনেই হাসল অন্তি। হাসোজ্জল মুখে সহসা বাহিরে দৃষ্টি যেতেই থমকে গেল তার মুখশ্রী। পূর্ণিমার আলোয় আচ্ছাদিত বদনখানিতে মুহুর্তেই নেমে এলো অমাবস্যার আঁধারী। বক্ষ দুরুদুরু। গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত-পা কম্পিত। হৃদয় শঙ্কিত। এ কেমন অনুভূতি?এমন টাই কী তবে হবার ছিলো।

——————

চলবে,
✍️সাদিয়া আফরিন নিশি