মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-০৯

0
361

#মন_ভেজা_শ্রাবণে
(পর্ব-৯)
————–
“তুই কেনো এমন করিস? কেনো এতো কষ্ট দিস আমায়? কেনো একটু বুঝতে চাস না? জানিস তোকে না পেয়ে এতটা টেনশনে ছিলাম আমি। পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কেনো এমন করলি? আমার সঙ্গে আসার কথা ছিল না তোর তাহলে একা একা কেনো এলি। তাও আবার আমাকে না জানিয়ে? কী হলো বল!”

কঠোরতার পরে এমন কোমল রুপ সত্যিই অদ্ভুত। আদ্র’র এমন কোমল কন্ঠে অন্তি ফুপিয়ে উঠল। এতক্ষণের সব ভয় যেন নিমেষেই গায়ের। আবেশে আদ্রর পৃষ্ঠদেশ বরাবর খামচে ধরল সে। দুজনেই গভীর মনোযোগে উপলব্ধি করছে মুহুর্তটা। সহসা আরিয়ার কন্ঠে চমকে ওঠে দু’জনেই। ছিটকে দুূদিকে চলে যায়।

“অন্তি, অন্তি কোথায় তুই দেখ কী এনেছি তোর জন্যে।”

অন্তি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে,”কই কী এনেছ আপু?”

আরিয়া অন্তির হাতে ফুচকার থালাটা তুলে দেয়। অন্তি মুহুর্তেই ভীষণ খুশি হয়ে যায় কিন্তু পরপরই মন খারাপ করে বলে, “এই দুপুর বেলা। এখন তো লাঞ্চ টাইম!!”

আরিয়া অন্তির কানে ফিসফিসিয়ে বলে,”খালামনি দেখে নি কিন্তু লুকিয়ে এনেছি।”

অন্তি খুশি হয়ে আরিয়াকে জড়িয়ে ধরে।পাশে দাড়িয়ে আদ্র ওদের হাবভাব দেখছে। এই অসময়ে ফুচকা খাওয়ার চরম বিরোধিতা করতে গিয়েও অন্তির হাসোজ্জল বদনখানি দেখে থমকে যায় সে। একদিন না হয় অনিয়ম হলো তাতে এমন কী আর হবে!! আদ্র মৌন মুখে বেড়িয়ে যায়। আরিয়া সেদিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলে,

“আচ্ছা অন্তি ভাইয়ার কী হলো বলতো? আমি তো ভেবেছিলাম কপালে দুঃখ আছে ভীষণ কিন্তু কিছুই হলো না।”

“কী জানি।”

অন্তি চটপট ফুচকা খেতে লেগে যায়। বেশি ভেবে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই তার এখন। খাওয়ার ফাঁকে আরিয়াকেও ইশারায় নিতে বলে কিন্তু আরিয়া নেয় না। সে বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছে বলে জানায়।

—————-
বিকেলে আদ্র অফার করল অনিক, আরিয়া, অন্তিকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে। মুলত তার এই উদ্যোগের কারণ হলো অন্তির মন খুশি করে ওর মুখ থেকে কথা বের করা৷ লাঞ্চ টেবিলেও অন্তি কেমন চুপচাপ ছিলো। আদ্র পুরোটা সময়ই ওকে লক্ষ্য করেছে। অন্তি প্রথমে ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরিই নাকচ করে দিয়েছিলো কিন্তু আরিয়ার রিকুয়েষ্টে রাজি হতে বাধ্য হয়। অন্তির বাবা, মা আরও আগেই নিজেদের বাড়িতে চলে গেছেন।

ব্রিজের অপর প্রান্ত জুড়ে গ্রামাঞ্চল চোখে পড়ে। সেদিক টাই এখন ওরা যাচ্ছে। এই ব্রিজটা শহর থেকে খুব কাছে। ব্রিজের এপারে শহর ওপারে গ্রাম এমনটাই। ব্রিজের ওপর দিয়ে ওরা হেঁটে হেঁটে ওপারে যাচ্ছে। শুধু ওরাই নয় আরও শতাংশ মানুষ এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা সবাই নিজেদের মতো আড্ডা দিতে ব্যস্ত। কেউ কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে সময় কাটাতে। কেউ বা প্রেমিকা নিয়ে। আবার কেউ কেউ ফ্রেন্ড সার্কেল। এমন অনেক আছে। আদ্র অন্তির হাত ধরে নিজের সঙ্গে আগলে নিয়ে হাঁটছে। যাতে করে কারো গায়ে টাচ না লাগে। এভাবেও অনেক বাজে ছেলেরাও আছে এখানে। ওদের কাজই মেয়েদের উত্তপ্ত করা। মূলত এদের থেকেই প্রটেক্ট করছে আদ্র অন্তিকে। অপরদিকে আরিয়া নিজেই নিজেকে সামলাতে পারে। সে তো অন্তির মতো ছোট নয়। অনিক ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। খুব সাবধানতার সহিত কথা বলছে অন্য কারো শোনার উপায় নেই। অন্তি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে আদ্র’র দৃঢ় বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কিন্তু আদ্র’র কড়া দৃষ্টিতে বারংবার সে চুপসে গিয়েছে।

—————
ব্রিজটা তুলনামূলক একটু বেশিই উঁচু। যার ফলস্বরূপ নামতে গেলে গায়ের মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ তৈরি হয়। অন্তি সেই মুহূর্ত সামলাতে না পেরে আদ্র’র হাত দ্বিগুণ শক্ত করে চেপে ধরল। আদ্র সেদিকে লক্ষ্য করে মুচকি হেসে অনত্র চাহিল।

বেশি একটা বাড়িঘর নেই এই পাশটায়। বেশিরভাগই ধানের ক্ষেত। অন্তি দুহাত মেলে দিয়ে উপভোগ করছে আশেপাশের মনোরম পরিবেশ। আরিয়া সতর্কতা জারি করে বলল,

“অন্তি সামলে। পড়ে গেলে ব্যথা পাবি সোনা।”

অন্তি মাথা নেড়েচেড়ে উত্তর দিল। যার অর্থ সে পড়বে না।
আদ্র মুগ্ধ নয়নে অন্তির চঞ্চলতা উপভোগ করছে। মেয়েটার মনটা হয়তো কিঞ্চিৎ ভালো হয়েছে কিন্তু কী সেই কারণ যার জন্য ওর মন খারাপ। নাহ আদ্রকে এটা জানতেই হবে।

—————
অকস্মাৎ আরিয়ার একদল ফ্রেন্ড সার্কেল সেখানে উপস্থিত হয়। আরিয়া ওদের পেয়ে ভীষণ খুশি। ওদের দলে মোট চারজন ছিলো। আরিয়া আদ্রকে বলে ওদের সঙ্গে চলে যায়। আদ্র বলে দেয় বেশি দূরে না যেতে আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে। এদিকে অনিক সেও চুপিচুপি তার প্রেমিকা পদ্মকে এখানে ডেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। এখন শুধু অন্তি আর আদ্র। আশেপাশে ওরা দুজন ছাড়াও আরো বেশকিছু কাপল রয়েছে। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। অন্তি মনে মনে ভয়ে আছে। আদ্র কেমন নিশ্চুপ। আদ্র’র এই নিশ্চুপতা অন্তিকে একটু বেশিই ভাবাচ্ছে। এভাবে চুপ করে থাকার লোক তো আদ্র নয়। তবে কী হয়েছে তার।

আশেপাশে লোকজনের সমাগম একদমই পছন্দ হচ্ছে না আদ্র’র। তাই তো একটা জনমানবশূন্য স্থান খুঁজছে। অবশেষে পেয়েও গেছে। অন্তির হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরে সে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। জায়গা হলো নদীর পাড়। ওরা যে ব্রিজ অতিক্রম করে এসেছে এটা সেই নদীর পাড়। কিন্তু ব্রিজ থেকে একটু দূরে হওয়ায় এখানে সচরাচর কেউ আসে না। তার ওপর এখন সন্ধ্যা নেমে গেছে তাই একদমই শুনশান জায়গাটা।

অন্তির ছোট্ট, কোমল হাতটিতে শক্ত হাতের চাপে লালবর্ণ ধারণ করেছে। অপরাহ্নের মৃদু আলো-আঁধারিতে বেশ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আদ্র অন্তির হাতের দিকে এক পল তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নদীর বালুকাময় পাড়ে বসতে বসতে ভরাট কন্ঠে বলে,

“বসে পড় ”

অন্তি টলতে টলতে বসে আদ্রর থেকে কিছুটা দুরত্বে। আদ্র সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অল্পতেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। এক হাতে অন্তির কোমর চেপে ধরে একদম নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। ভয়ে নেতিয়ে পড়া অন্তি এবার শঙ্কিত চাহনি নিক্ষেপ করে আদ্র’র পানে। কম্পিত কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলে,

“ক- ক -কী ক-র-করছেন?

আদ্র যেন দ্বিগুণ জ্বলে ওঠে। আরও দৃঢ় বন্ধনে আটকে নেয় অন্তিকে। অন্তি ক্রমাগত কাঁপছে। প্রকৃতির মৃদু পবনে অন্তির বেবি হেয়ার গুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে। আদ্র অন্য হাতে খুব যত্নের সহিত সেগুলো কানের পেছনে গুজে দেয়। অন্তি ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠে আদ্র’র বাহু খামচে ধরে। চোখজোড়া আপনা হতেই বন্ধ হয়ে যায়। ততক্ষণাৎ তার কর্ণে ভেসে আসে সেই চিরচেনা নেশাক্ত কন্ঠস্বর।

” তুমি রেগে থাকলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় মায়াবতী। তুমি আমার সঙ্গে কথা না বললে আমি ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হই। তুমি আমাকে ইগনোর করলে আমি শেষ হয়ে যাই। তোমাকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব কঠিন। তুমি আমার অদ্ভুত সুখানুভূতি। তুমি আমার রঙিন স্বপ্ন। তুমি আমার অধর কোণে ফুটে ওঠা তীব্র খুশির কারণ। সেই তোমার এতো অবহেলা আমি কী করে সইবো মায়াবতী? মরেই যাবো?”

অকস্মাৎ অন্তির বন্ধ চোখ খুলে যায়। দৃষ্টি পড়ে সোজা আদ্র’র দৃষ্টিতে। আদ্র’র বাহু খামচে ধরা হাতটি আপনাআপনি চলে যায় আদ্র’র ওষ্ঠে। উদ্বীগ্ন, ভীত কন্ঠে সে বলে,

“এসব কথা মুখেও আনবেন না। আমি থাকতে আপনার কিচ্ছু হবে না। কিছু হতেই পারে না। আপনাকে এতো নরম মানায় না। আপনি পাষাণ, নিষ্ঠুর, কঠিনই ঠিক আছেন। সেভাবেই আপনাকে আমি গ্রহণ করেছি। এতো কোমল রুপ সত্যিই আমার হজম করতে কষ্ট হয়। ভয় হয়।”

আদ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“তারমানে এতোদিন তুই আমাকে পাষাণ, নিষ্ঠুর, কঠিন এসব ভেবে এসেছিস?”

অন্তি থতমত খেয়ে যায়। হুঁশ ফিরতেই আদ্র’র থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে বলে,”ক কই না মানে আসলে।”

“আর মানে মানে করতে হবে না। এখন বল কেনো রেগে আছিস? কলেজ থেকে ওভাবে একা একা কেন চলে এলি? সারাক্ষণ আমায় ইগনোর কেন করছিস?”

অন্তি কিছু বলে না। মুখশ্রী নিমেষেই থমথমে ভাব নেয়। ছিটকে আরেকদিক ঘুরে বসে। কিয়ৎক্ষণ পরে কাঁধে গরম নিশ্বাস উপলব্ধি করে। কোমরে শক্ত হাতের চাপ। কেঁপে ওঠে আরেকদফা। কর্ণে নেশাক্ত বুলি প্রবেশ করতেই অদ্ভুত শিহরণে ঝাকিয়ে তোলে সর্বাঙ্গ।

“বল না জান। না বললে বুঝবো কী করে।”

—————–
চলবে,
✍️সাদিয়া আফরিন নিশি