মহাপ্রস্থান পর্ব-১৫

0
220

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
দোলা আজও বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখে হিমেল অপেক্ষা করছে। আজ আর সে ধমক দিল না। বরং নিজেও দু’কদম এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“হাতে সময় আছে?”

“আপনার জন্য অফুরন্ত সময় আছে।”

“বেশি রোমিও সাজার প্রয়োজন নেই। সত্যিটা বলো।”

হিমেল কোনো কিছুই না ভেবে বলল,

“আছে।”

“ঠিক আছে। চলো।”

হিমেল হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,

“কোথায়?”

“ভয় নেই। জেলে ঢোকাব না।”

“আমি জেলে যাওয়ার ভয় পাইও না।”

দোলা একটা রিকশা থামাল। দুজনে রিকশায় ওঠার পর দোলা বলল,

“এত সাহস?”

“সাহস না ভরসা। তারচেয়েও বড়ো কথা জেলে বসে বসে যদি আপনার মতো সুন্দরীকে দেখতে পারি তাহলে ভয় কেন পাব বলুন?”

“ফ্লার্ট তো ভালোই পারো।”

“আমার ভালোবাসাকে ফ্লার্ট বলে অবজ্ঞা করবেন না।”

দোলা তাচ্ছিল্য করে হাসল। দৃষ্টি এড়াল না হিমেলের। তবে এ বিষয়ে আর কোনো কথা না বলে অন্য প্রসঙ্গ টানল।

“আজ থানায় যাবেন না?”

“যাব। মন ভালো নেই তাই ভাবলাম একটু বের হই।”

“আমাকে সঙ্গে নিলেন যে?”

“সঙ্গ পাওয়ার জন্য। কোনো অসুবিধা থাকলে নেমে যেতে পারো।”

“কী যে বলেন আপনি! আমি তো সারাজীবন আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।”

দোলা এবারও হাসল। রিকশা এসে থেমেছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। হিমেল ভাড়া দিতে চাইলেও দোলা নিজেই জোর করে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে হিমেল কিছুটা মুখ ভার করে থাকে। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে দো’তলার কর্ণারের একটা টেবিলে বসে দুজন। দোলা খাবার অর্ডার দিয়ে বলল,

“এই রেস্টুরেন্টটা আমার অনেক পছন্দের জায়গা। আমি প্রায়ই আসি এখানে।”

“সাথে আর কে আসে?”

“কেউ না। আমি একাই।”

“কোনো বন্ধু-বান্ধব?”

“ওদের সাথে অন্য রেস্টুরেন্টে গিয়েছি। এখানে আমি কাউকে আনিনা।”

“তাহলে আজ আমায় আনলেন যে?”

“মন তোমার সঙ্গ চেয়েছে তাই।”

হিমেলকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে দোলা হেসে বলে,

“বেশি উড়ো না। এর মানে এই না যে, আমি তোমায় ভালোবাসি।”

সঙ্গে সঙ্গে হিমেলের মুখটা চুপসে যায়। মনে মনে আওড়ায় সে,’নিষ্ঠুর নারী!’

দোলা অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে থেকে বলল,

“আমার একটা অতীত আছে জানো?”

হিমেল দোলার শুষ্ক মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,

“অতীত তো সবার জীবনেই থাকে। তবে আপনার অতীত কী সেটা জানি না।”

“সবারই অতীত থাকে?”

“হ্যাঁ। এইযে একটু আগে আপনি বাসায় ছিলেন আর আমি রাস্তায় ছিলাম। সেই সময়টা পার হয়ে গেছে। মানে হচ্ছে ওটাও অতীত। তবে আমরা যদি কাউকে ঘটা করে কোনো অতীতের গল্প শোনাই তবে সেটা শুধুই অতীত থাকে না। সেটা হয়ে যায় ব্যক্তিগত অতীত। আর এই অতীতের গল্পটা সবাইকে বলা যায় না।”

“তোমার কোনো ব্যক্তিগত অতীত নেই?”

“আছে তো! ঐযে সেদিন বললাম। মা-বাবাহীন এতিম আমি।”

“কোনো প্রিয়তমা ছিল না?”

“না। তবে এখন আছে। আপনি।”

দোলা দুর্বোধ্য হাসল। বলল,

“আমার ছিল। আমার একান্ত ভালোবাসার মানুষ ছিল রাফসান।”

হিমেলের বুকটা ধ্বক করে উঠল। মুখে কিছু না বলে চুপ করল রইল কিছুক্ষণ। দোলা বলল,

“তুমি রাফসান চৌধুরীকে চেনো তো?”

“অভিনেতা রাফসান চৌধুরী?”

“হ্যাঁ। ও-ই ছিল আমার একান্ত ভালোবাসার মানুষ। যাকে নিজের সবটা দিয়েই ভালোবেসে ছিলাম।”

হিমেল বিস্ময় নিয়ে বলে,

“আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন?”

“বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। ওরকম বিখ্যাত একজন অভিনেতার সাথে আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিল কখনো এটা যে কেউই বিশ্বাস করতে চাইবে না।”

“কিন্তু আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আর আপনি সাধারণ মেয়ে কেন হতে যাবেন? আপনি একজন পুলিশ অফিসার।”

“সম্পর্ক যখন ছিল তখন আমি পুলিশ ছিলাম না আর রাফসানও অভিনেতা ছিল না।”

“সম্পর্ক হয়েছিল কীভাবে?”

“আমরা ব্যাচমেট ছিলাম। ভালোলাগা, ভালোবাসা আমার থেকেই শুরু হয়। আমার হাভভাবে রাফসান সব বুঝে যায়। নিজে থেকেই প্রপোজ করে। সেদিন মনে হয়েছিল আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সম্পর্ক আর পাঁচটা সম্পর্কের মতোই সুন্দর চলছিল। সমস্যা বাঁধল তখন, যখন রাফসান অভিনয় জগতে প্রবেশ করল। ওর ফ্যান-ফলোয়ার হলো, নানান জ্ঞানীগুণী লোকের সঙ্গে, বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পীদের সঙ্গে ওঠা বসা। সত্যি সত্যিই রাফসান তখন আকাশের চাঁদ হয়ে গেল। চলে গেল আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। একদিন ফোনে জানাল, আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে পারবে না। কারণ জানতে চাইলে আমায় কী বলেছিল জানো?”

হিমেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দোলা বলল,

“আমি নাকি ওর যোগ্য নই। এই কথার পর আমার আর বলার মতো কিছুই ছিল না। আটকাইনি। সাধ্যও ছিল না। যে চলে যেতে চায় তাকে কি কখনো জোর করে আটকে রাখা যায়?”

“এরপর আর কখনো কথা হয়নি?”

“না। তবে ওর সব মুভি, সাক্ষাতকার আমি দেখতাম।”

“সরাসরি আর দেখা হয়নি?”

“আগে হতো না। কিন্তু এখন রোজই হয়।”

হিমেল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বলল,

“কীভাবে?”

“কারণ রাফসান এখন আমার থানায়।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হিমেল। মনের অজান্তেই একটা প্রশ্ন করে বসল,

“আপনি কি এখনো তাকে ভালোবাসেন?”

দোলা সময় না নিয়েই বলল,

“সফলতা পাওয়ার পর যে প্রতারণা করে, সে কখনো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।”

মুখে কিছু না বললেও এ কথা শোনার পর মনে মনে খুশি হয় হিমেল।
_______

সম্পূর্ণ শরীরে ব্যথা পৃথুলার। সারা রাত ব্যথা, যন্ত্রণায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। সকালে ঘুম ভাঙতেই আবারও সেই ব্যথা টের পায় সে। উঠে বিছানায় বসতেও পারছে না। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই তার শরীর শিউরে ওঠে। সে কোনো রকমে উঠে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে। তার ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ করা। জ্ঞান ফেরার পর সে আবছা আবছা দেখেছিল, একজন ডক্টর ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। সে বড়ো শ্বাস নিয়ে রুমে চোখ বুলাল। এই রুমটা তার ভীষণ পরিচিত। তার মানে এখন সে বাংলোবাড়িতে আছে। আরশান! আরশান কোথায়?

পায়েও ব্যথা থাকায় উঠতে পারল না। শরীর দুর্বল। মিনিট পাঁচেক পর রুমে শিমুল আসে। তার হাতে নাস্তার ট্রে। পৃথুলাকে বসে থাকতে সে বিস্মিত হয়ে বলে,

“একি! কখন উঠলেন? এখন কেমন শরীর?”

পৃথুলা ছোটো করে উত্তর দিল,

“একটু ভালো।”

“আমি স্যারকে ডেকে নিয়ে আসছি।”

শিমুলের সাথেই রুমে এলো আরশান। তার দৃষ্টিতে একই সাথে রাগ, জেদ এবং মায়া। সে গম্ভীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে এখনো?”

পৃথুলা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল।

“নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে নিন। ঠিক হয়ে যাবে।”

“আমি একা একা ওয়াশরুমে যেতে পারব না। ফ্রেশও হতে পারব না।”

আরশান যেন রাগ ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। সে ধমক দিয়ে বলল,

“কেন পারবেন না? পাকনামি তো ভালোই করতে পারেন। অবাধ্যও হতে পারেন। এখন কেন একা ফ্রেশ হতে পারবেন না?”

এমন মুমূর্ষু অবস্থায় আরশানের ধমক হজম হলো না পৃথুলার। কান্নারা সব গলায় এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে সে। চোখে চোখ রাখলেই কেঁদে ফেলবে।শিমুল আরশানের হাত চেপে ধরে বলল,

“স্যার! মাথা ঠান্ডা করুন।”

“মাথা ঠান্ডা রাখার মতো কাজ করেছে ও? ননসেন্স একটা! এত করে বললাম, বের না হতে। শুনেছে আমার কথা? ঠিকই ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করতে করতে বেরিয়ে গেছে। এখন ভালো হয়েছে না? থাকুক অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে। ওর চাকর নাকি আমি? সবসময় পিছে পিছে ঘুরে ওকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমার?”

আরশান রাগের মাথায় যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছে। এত কথা শুনে পৃথুলাও আর কান্না আটকে রাখতে পারে না। আরশান আরও রেগে যায়। সে শিমুলকে বলে,

“ও একা একা ফ্রেশ হয়ে খেতে পারলে খাবে, না পারলে নেই। যা ইচ্ছে করুক এই রুমে। দু’দিন পর একটু সুস্থ হলে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। এখন চলো এখান থেকে।”

শিমুল কিছু বলতে চাচ্ছিল। তবে আরশান সেই সুযোগ দিল না। শিমুলকে টেনে বাইরে নিয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল। পৃথুলার এখন ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। শরীরের যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে মনের যন্ত্রণাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

ড্রয়িংরুমে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আরশান। তার পাশে অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে শিমুল। কিছু বলার সাহসও পাচ্ছে না। সে কোনো কথা না বলে এক গ্লাস পানি এনে রাখল সামনে। আরশান পানিটুকু পান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পায়চারি করে রাগ কমিয়ে পৃথুলার রুমে গেল সে। পৃথুলা তখনও কাঁদছিল।

আরশান এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“নেমে আসুন।”

প্রচণ্ড অভিমানে পৃথুলা হাত বাড়াল না। কয়েক সেকেন্ড হাত বাড়িয়ে রেখেও যখন দেখল পৃথুলা হাত বাড়াচ্ছে না, তখন আরশান নিজেই পৃথুলার বাহু ধরে ধীরে ধীরে খাট থেকে নিচে নামায়। ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্রেশ হওয়া হলে আবার খাটে এনে বসায়। নাস্তা সামনে দিয়ে বলে,

“কোনো রকম ঘাড়ত্যাড়ামি না করে চুপচাপ খেয়ে নেবেন।”

পৃথুলা ভয়ে ভয়ে অল্পকিছু খাবার খেল। আরশান ওষুধগুলো এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে খাওয়ার জন্য। খাওয়া শেষে পৃথুলা থমথমে মুখে বলে,

“আমি সুস্থ হব কবে?”

“ক্ষ’ত তো কম না। সময় লাগবে। কী হয়েছিল রাতে?”

পৃথুলা একটু সময় নিয়ে বলল,

“আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন লোক এসে পথ আটকায় আমার।”

“কেউ ছিল না সেখানে?”

“কয়েকজন ছিল। তবে দূরে।”

“চিৎকার করে সাহায্য কেন চাননি?”

“সেই সুযোগটাই তো পাইনি। ওদের মধ্যে একজন রুমাল মুখে চেপে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর আর কিছুই মনে নেই আমার।”

“তার মানে আপনি অজ্ঞান থাকা অবস্থাতেই আ’ঘা’ত করেছে। ক’জন ছিল বলতে পারবেন?”

“না।”

“আনুমানিক তাও ক’জন হবে?”

“সাত, আটজন হতে পারে।”

আরশানকে র’ক্তচক্ষুতে তাকা দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় পৃথুলা। আবারও রাগ হচ্ছে তার। সে পৃথুলার এরকম অবস্থা কিছুতেই মানতে পারছে না। সে কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“ঠিক আছে রেস্ট নিন।”

পৃথুলা হাত ধরল আরশানের। বলল,

“আপনি কি আমার ওপর খুব রেগে আছেন?”

আরশান উত্তর দিল না। তার চোখে-মুখে যেন আ’গু’নের স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছিল। আচমকা একটা কাজ করে বসে পৃথুলা। সে জড়িয়ে ধরে আরশানকে। কাঁধে মাথা রেখে বলে,

“আমি সরি। ভুল হয়ে গেছে আমার। তখন আপনার কথা শোনা উচিত ছিল আমার। আর কখনো এমন হবে না। এবারের মতো আমায় ক্ষমা করে দিন প্লিজ! তবুও এভাবে রাগ করে থাকবেন না।”

আরশানের গলার স্বর নরম হয়। সে কোমল কণ্ঠে বলে,

“কেন শুনলেন না আমার কথা পৃথু? কেন তখন একটাবার আমার কথা শুনলেন না? তাহলে তো আপনাকে এখন এতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না।”

“এই যন্ত্রণার জন্যই তো আপনাকে কাছে পেলাম। নয়তো কি আর আসতেন এত কাছে? সব খারাপ কিন্তু খারাপ না। কিছু খারাপ ভালোর জন্যও হয়।”

“সবসময় সবকিছু নিয়ে ফাজলামো করবেন না। যদি কিছু হয়ে যেত আপনার?”

“হলে হতো। এমনিতেও আমার কাছের কেউ নেই। আমার জন্য কষ্ট পাওয়ারও কেউ নেই।”

আরশান কিছু বলল না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পৃথুলার থেকে। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই পৃথুলা ফের হাত টেনে ধরে বলল,

“চলে যাচ্ছেন যে? একবার পৃথু বলে ডাকবেন না?”

আরশানের কী হলো কে জানে, সেও আচমকা পৃথুলাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আপনি অসভ্য চঞ্চল, বোকা মায়াবতী পৃথু!”

চলবে…