মাই এক্স পর্ব-১৯

0
220

মাই এক্স (১৯তম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি

১৯

আইডিয়াটা শাহেদের। অনেকদিন থেকেই বলছিল, সবাইকে ডাকো। শাহেদের ফিরে আসা উপলক্ষ্যে একটা গ্রান্ড পার্টি করাতে আমারও ইচ্ছে করছিল। বাট ঐ… করছি, করব করে করা আর হচ্ছিল না। ইউনিভার্সিটি এখন অনেকটাই সময় নিয়ে নিচ্ছে আমার। একটা রিসার্চও শুরু করেছি।
এর মাঝে আরও মাস দুয়েক কেটে গেছে। জীবন এখন প্রায় পুরোটাই স্বাভাবিক। শাহেদ ওর আগের চাকরীটা ফিরে পেয়েছে। ডিরেক্টর নিজে ফোন করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওপর মহল থেকে চাপ ছিল, তাই উনার হাতে কোন অপশান ছিল না। শাহেদ রাজী হচ্ছিল না অফারটায়। অন্য চাকরি করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি বারণ করলাম। আগেরটাতে ফিরে যেতেই ওকে ইনসিস্ট করলাম। বললাম,
— ভয় কে পাইনি বল। সবাই তো সুমনের শর্তে রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। উনার আর তাহলে দোষ কি?
কি ভেবে আমার মতটা মেনে নিল। পুরনোটাতেই জয়েন করল। গতকাল সেখানেই ওর একটা প্রমোশান হয়েছে। মনে হয়, কমপেনশেশান হিসেবে। যেন পুরনো কথা ভুলে যায়। ওকে এখন এক্সেকিউটিভ ডিরেক্টর করা হয়েছে। এরপরে তো আর পার্টির ব্যাপারে গড়িমসি করার উপায় থাকে না। শাহেদকে জানালাম। ভেঙ্গে ভেঙ্গে করি। কলেজ আর ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ডদের জন্য একটা দিন রাখি। এবার উইথ স্পাউস করব। ওর আপত্তি নেই। আমাদের পুরো গ্যাংকে দিন তারিখ জানিয়ে দিলাম। সবাই এগ্রিড। শাহেদের ফিরে আসা অ্যান্ড প্রমোশান উপলক্ষে আজকে সেই গ্র্যান্ড পার্টিটা হবে।
গতকাল রাতে যখন শাহেদের সাথে ব্যাপারটা ফাইনাল করছিলাম, তখন শাহেদ নিজে থেকেই বলল
— তোমার সেই খোকন ভাইকেও বল।
বললাম
— মন্দ বলনি।
এরপরে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
— মানুষ কিভাবে বদলে যায়, না? যে মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম, সে কি করল। আর যাকে ঘৃণা করতাম…
— সেই হেল্প করল।
— ব্যাপারটাতে আমিও অবাক হয়েছিলাম, জানো? কো ইনসিডেন্স বোধহয় একেই বলে। আমি ভাবতেও পারিনি, এভাবে, এমন অপ্রত্যাশিতভাবে খোকন ভাই হেল্প করবে।
— এটাই লাইফ। যা ভাবি, তা হয় না, আর যা ভাবি না…। উনাকেও কিন্তু ফ্যামিলিসহ ইনভাইট কর।
ব্যাপারটা আমারও মনে ঘুরছিল। খোকন ভাইকে ফর্মালি একটা থ্যাঙ্কস দেয়া উচিত।
আজ হলিডে। সকাল থেকেই সবাইকে রিমাইন্ডার দিচ্ছিলাম। খোকন ভাই এখনও আনরিচেবল। কি যে করি? আর কিভাবে ট্রাই করি? ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের ভেতর পলিটিক্যালি অ্যাকটিভ ফ্রেন্ডগুলোর কারোর সাথেই তো এখন সম্পর্ক নেই। আর কার মাধ্যেমে খোঁজ নেব ভাবছিলাম এমন সময় শাহেদ ডাইনিং টেবিলে এসে হাজির। স্মিত হেসে বললাম
— মোটামুটি ফাইনাল।
পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরতে ধরতে বলল
— তোমার সেই খোকন ভাইকে বলেছো তো? ভদ্রলোককে আমি পার্সোনালি থ্যাঙ্কস দিতে চাই।
— উনাকেই তো পাচ্ছি না।
— কেন?
— আনরিচেবল।
— আর কোন নাম্বার নেই?
একমিনিট ভাবলাম। বললাম
— দেখি ট্রাই করে।
শেলির কাছে ফোন দিলাম। বললাম
— এই শোন, খোকন ভাইকে মনে আছে?
— ইউনিভার্সিটির?
— হ্যাঁ, যে… মানে আমাকে যে…
— হ্যাঁ। মনে আছে। তা ঐ ফাউল লোকটাকে কেন?
একবার মনে হল ওর ভুল ভাঙ্গাই, পরে চিন্তাটা বাদ দিলাম। পার্টিতে আসলে তখন নাহয় উনার সামনেই সব বলব। নিজেকে সামলে নিয়ে তাই জিজ্ঞেস করলাম
— উনার ফোন নাম্বার একটু যোগাড় করে দিতে পারবি? আই মিন তোর বরের মাধ্যমে… একই পার্টি যেহেতু করে…
— বাট উনাকে কেন?
— আছে কারণ। পরে শুনিস। এখন বল পারবি কি না।
— মনে হয় না। পার্টি রিলেটেড কিছু জিজ্ঞেস করলেই উনার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই জিজ্ঞেস করি না।
— ঠিক আছে। তারপরও… পারলে ট্রাই করিস।
— বাট উনাকে কেন?
— বলছি না, বলব। পরে শুনিস। মজার একটা সারপ্রাইজ।
এর বেশি আর কিছু বলা ঠিক হবে না। সারপ্রাইজটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে শেলির কথার সারাংশ হল, ও হেল্প করবে না, বা হেল্প করতে পারবে না। যেটাই হোক, আমাকে নেক্সটের কাছে যেতে হবে। ফোন লাগালাম তিথিকে। ওর বর বেশ করিৎকর্মা। কে কোথায় আছ, সব খবর উনি পান। ওকেও একই কথাই বললাম
— খোকন ভাইয়ের কোন খোঁজ জানিস?
— কোন খোকন ভাই?
— ঐ যে…
আর কিছু বলতে হল না। বুঝে গেল। কিন্তু যে উত্তরটা দিল তা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। বললাম
— হোয়াট?
— হ্যাঁ
— তুই সিওর?
— কেন সিওর হব না, আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সঙ্গে সঙ্গে সব ব্যাপার পরিস্কার হয়ে গেল। এতোদিন কি হচ্ছিল, কেন হচ্ছিল তা আর বুঝতে বাকী থাকল না। ও নো। আমি এতো গাধা? এই সোজা ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি? তিথিকে বললাম
— তুই এখন কোথায়?
ও জানাল নিজের বাসায়। আমি বললাম,
— তুই একদম কোথাও নড়বি না। আমি এক্ষুনি আসছি।
শাহেদ আমার পাশে বসে পত্রিকা পড়ছিল, আমার আচমকা এই পরিবর্তন দেখ সে ও অবাক হয়ে গেল। বলল
— কি হল? কোথায় যাচ্ছো?
আমি কোন রকমে কেবল বলতে পারলাম
— এসে বলছি।
বেরিয়ে গেলাম। ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তা প্রায় ফাঁকাই ছিল। ড্রাইভারকে জানালাম কোথায় যেতে হবে। রাস্তায় কেবল একটাই চিন্তা মাথায় আসছিল, কিভাবে এতো বড় ভুলটা করলাম আমি। কেন আমার একবারের জন্যেও সন্দেহ হল না। এখন যখন পুরনো ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবছি, তখন সবই কেমন ছকে বাঁধা মনে হচ্ছে। শাহেদের চাকরী যাওয়া, ওকে গুম করা কিংবা আমার চাকরী হওয়া। ইভেন, রিনি আপার অসুস্থতাও মনে হচ্ছে প্ল্যানড। বাট প্ল্যানড বাট ফর অ্যা ডিফ্রেন্ট রিজন।
ওর বাসায় পৌঁছে দরজায় দুমদাম আওয়াজ শুরু করে দিলাম। তিথি বোধহয় লিভিং রুমেই ছিল, দ্রুতই দরজা খুলল।
— কি রে দরজা ভাঙবি নাকি?
আমি ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই জানতে চাইলাম
— বর কোথায়?
— বাইরে। কেন?
ওকে হাত ধরে টান দিলাম। লিভিং রুমের সোফার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম
— আয়।
— কোথায়?
কথার উত্তর না দিয়ে ওকে ধরে টানতে টানতে সোফায় গিয়ে বসলাম। বললাম
— শেলির বিয়ের দিনে সুমনের সাথে তোর কি কথা হয়েছিল?
তিথি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল
— কেন?
— যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দে।
আমার কণ্ঠ রীতিমত সিরিয়াস। তিথিও বুঝে গেল, ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে। ভয়ে ভয়ে শুধু বলল
— বা রে, তোর এক্স বলে কি কথা বলা যাবে না?
আমার তখন এসব এক্সকিউজ শোনার সময়ে নেই। অস্থির হয়ে বললাম
— প্লিজ তিথি, এসব ফালতু কথা এখন রাখ। আই নিড টু নো, সুমন সেদিন কি কি বলেছিল।
আমার আচরণে এবার তিথি বেশ ভয় পেয়ে গেল।
— মানে?
মেজাজ অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে আনলাম। বুঝলাম আমি রেগে কথা বললে ও আরও ভয়ে পেয়ে যাবে। তাই যতটা সম্ভব মোলায়েম করে বললাম
— প্লিজ। তোর পায়ে ধরি। অন্য কোন কথা না, শুধু বল সেদিন সুমন কি বলেছিল?
তিথি আমার দিকে তাকিয়ে বুঝল, আমি রেগে নেই। তবে অন্য কোন কারণে এই ব্যাপারটায় বেশ সিরিয়াস। কি কারণ ভাবল জানি না, তবে মনে হল ‘কেন অতীত ঘাঁটছিস?’ টাইপ উপদেশ দেয়ার ইচ্ছে গজাচ্ছে। আমার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে সেটায় আপাততঃ সেটায় ক্ষান্ত দিল। বলল
— তেমন কিছু না। এমনি ক্যাজুয়াল আলাপ
আবার নিজের ওপর কন্ট্রোল হারালাম। ঝাঁঝিয়ে উঠলাম। বললাম
— কি সেটা। একেবার ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড বলবি।
এবার তিথি কেমন ভয় পেয়ে গেল। এরপরে কিছু একটা বলতে গিয়েও ইতস্ততঃ করছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম
— কোন কিচ্ছু লুকাবি না, আমাকে যদি গালাগালও করে থাকিস, সেটাও বল। প্লিজ।
আমার গলার আকুতি ও টের পেল। বলল
— সুমন ভাই প্রথমে এসে আমাকে বলল, কি খবর তোমাদের। আমি বললাম…
ওকে শেষ করতে না দিয়ে বললাম
— ওগুলো বাদ দে। আমার সম্পর্কে কি বলেছিল সেটা বল
খানিকটা ভাবল তিথি। এরপরে বলল
— তেমন কিছু না। এমনি ক্যাজুয়ালি জানতে চাইল, আমরা ফ্রেন্ডরা সবাই কি করছি।
— তারপর?
— সবার কথাই বললাম। কে কোথায় আছে। তোর কথাও বললাম
আমার হার্ট বিট বাড়ছে। অস্থির হয়ে জানতে চাইলাম
— দেন?
— তখন বললাম, তুই এখন বেশ বড়লোকের বউ। আর…
— আর?
এবার তিথি কিছুটা ইতস্ততঃ করতে করতে বলল
— প্লিজ তুই রাগ করিস না…
— আমি কিচ্ছু রাগ করব না, তুই প্লিজ বল। প্রতিটা কথা।
তিথি বুঝল, ডিটেইল শুনতে চাচ্ছি। এটাও বুঝল, আমি সেই কথার মাঝে অন্য কিছু খুঁজছি। তাই কিছুটা ফ্যাকাশে মুখে হলেও, বলতে লাগল
— তুই তো আমাদের সাথে তেমন সম্পর্ক রাখতি না, ফোন করলে খালি দেমাগ দেখানো কথা বলতি…
— বুঝলাম, এসব কথা বলেছিস, এইতো?
তিথি অপরাধীর মত মুখ করে বলল
— হ্যাঁ। আমি সত্যিই সরি রে।
— ধ্যাত। সরি ফরি পরে বলিস। এখন বল সুমন কি উত্তর দিল?
— কি বলবে, বলল, এতো পাল্টে গেছে তৃণা?
— উত্তরে তুই কি বললি?
— আমি বললাম, তা ও যদি নিজে কিছু করত। সুমন ভাই তখন বলল, দেমাগটা তাহলে মিসেস শাহেদ হওয়ার দেমাগ। এই তো? আমি বললাম, কি যে হয়ে গেছে না তৃণা, বিশ্বাস করতে পারবেন না। আমি ওর সবচেয়ে ক্লোজ ছিলাম, রুমমেট ছিলাম, এখন ফোন করলে ধরেই না। কয়েকবার করলে ধরে, আর প্রথমেই জানতে চায়, কি ব্যাপার। আমি যেন হেল্প চাইতেই ফোন করেছি।
আমার অস্থিরতা তখন তুঙ্গে। বললাম
— সুমন তখন কি বলল?
— বলল, আমারও ভাল লাগেনি। আমাকে দেখে যেভাবে রিয়াক্ট করল, মনে হল মহা ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে। ‘আমার ব্যাপারটা জানতে পারলে যদি বর ছেড়ে দেয়, তখন ওর কি হবে’ এই ভয়ে মরছে।
— ব্যাস? আর কিছু বলেনি?
— যেতে যেতে আমার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে শুধু বলল, মন খারাপ কর না। খুব শীঘ্রিই মিসেস শাহেদ তৃণা হয়ে উঠবে, ইটস মাই প্রমিজ।

চলবে