মাফিয়া ক্রাশ বর পর্ব-২২

0
2408

#মাফিয়া_ক্রাশ_বর
#লেখিকা : মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্ব : ২২

রুহির বাবা অভিদের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে উঠে
” অভিদ !! তুমি আমার মেয়েকে খুঁজে বের করে আনো দয়া করে” অভিদ কিছু না বলে আগের মতোই বসে থাকে।
দুপুর গড়িয়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সবাই এখনও আগের মতোই বসে আছে। অভিদ দুপুরে আবার বেড়িয়ে গিয়েছিলো রুহিকে খুঁজতে। কিন্তু হতাশা ছাড়া আর কিছু পেলো না।

সন্ধ্যার পর অভিদ বাড়িতে ফিরে আসলো। ক্লান্ত ভারাক্রান্ত শরীর আর মন নিয়ে টলমল পায়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পিঠ লাগিয়ে মাটিতে বসে পরে। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। বন্ধ চোখ দিয়ে পানি পরতে থাকে। বাবা মারা যাওয়ার পর আর কোনদিন এভাবে ভেঙে পরেনি। সবসময় কোনো কাজ করার আগেই কনফিডেন্স ছিলো যে এটা করতে পারবে। কিন্তু আজকে নিজের ভেতর সেই বিশ্বাসটা থাকলেও মনে হচ্ছে রুহিকে সে হারিয়ে ফেলেছে। অভিদ সেভাবে বসেই চোখের পানি ফেলতে থাকে।
দরজার বাইরে রায়হান দাঁড়িয়ে আছে। অভিদকে কোনোদিন এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেনি। রুহিকে না পেয়ে অভিদ একদম ভেঙেই পরেছে।
রায়হান ধীর পায়ে ড্রইংরুমে এসে দাড়ালো।

সবাই কান্না মাখা চেহারায় বসে আছে। রুহির আম্মুর কথা বলতে গেলে একদম অসুস্থ হয়ে পরেছে। রুহির আব্বু নিজেকে ঠিক করে রেখেছে এখনও। অনি, মিশু, রাইমা, নিলা ওরা আগে অনেক কান্না করে এখন চুপচাপ করে আছে। তুষার মন মরা হয়ে বসে আছে। রায়হান সবাইকে দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। রুহির বড় মামা, ছোট মামা একটু আগে বাড়িতে গিয়েছে।

রায়হান ফোন বের পুলিশকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ফোন দেওয়ার আগেই বাড়িতে পুলিশ ঢোকে। রুহির আব্বু, রায়হান, তুষার ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রায়হান তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলে
” রুহিকে পেয়েছেন আপনারা !!! কোথায় রুহি??”
পুলিশ মাথা নিচু করে বলে
” সরি স্যার আমরা এখনও ওনাকে পাইনি। তবে আমরা আজকে একটা যা খবর পেয়েছি তা হলো এয়ারপোর্টের আগের রাস্তার সিসি টিভি ফুটেজে আমরা ম্যামকে দেখেছি। তবে সেটাতে দেখেছি ম্যাম গাড়িতে অজ্ঞান অবস্থায় ছিলো। পরে আর কোনো ক্লু পাইনি। ” অফিসারের শেষের কথাটা শুনে সবার মনে রুহিকে খুঁজে পাওয়ার যেই আসার আলো জেগে উঠেছিলো সেটাও আস্তে আস্তে নিভে যেতে লাগে।

রায়হান রেগে কিছু বলতে নিলেই তার আগে কোথা থেকে অভিদ ছুটে এসে অফিসারের কলার শক্ত করে চেপে ধরে চেচিয়ে বলতে থাকে
” আর কোনো ক্লু পাইনি, মানে কি ?? তোরা পুলিশ হয়েছেন কি করতে ?? কোনো কাজই তো তোরা করতে পারিস না। সব কিছু তো অন্য মানুষরাই করে তাহলে তোদের কাজে রাখা হয় কেনো ?? শুধু পুলিশের পোশাক পড়ে ঘুরে বেরালে আর ঘুষ খেলেই পুলিশ হয়ে যায় না। পুলিশেরও দায়িত্ব আছে। আমার রুহিকে খুজে বের করতে না পারলে তোর চাকরি যদি আমি বরবাদ না করেছি !! ” প্রথমে কেউ অভিদকে মা আটকালে ও যখন অফিসারের কাশি উঠে যায় তখন রুহির আব্বু আর তুষার অভিদকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।

রায়হান অফিসারের সামনে গিয়ে কলারটা ঠিক করে দিয়ে শান্ত সুরে বলে
” আর ক্লু পাইনি বলে হাত পা ছেড়ে বসে না থেকে এয়ারপোর্টের সব ডিটেইলস আর সিসি টিভি ফুটেজ দেখুন। আর রুহিকে যেভাবেই হোক খুজে বের করে আনবেন নাহলে অভিদকে আমিও আটকাতে পারবো না। now get lost from this house. ” অফিসার আর সাথে থাকা আরেকজন পুলিশ ঢোক গিলে কোনো রকম দৌড়ে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে।

রায়হান অভিদের কাছে গিয়ে ওর কাধে হাত রেখে বলে
” একদিনেই এমন ভাবে ভেঙে পরছিস কেনো ?? রুহিকে আজকে পাইনি কিন্তু এর মানে এটা না যে আর কোনোদিন পাবো না। রুহিকে খুঁজতে তোর শক্ত হতে হবে এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না।” অভিদ কিছু না বলে রাগ দেখিয়ে রুমে চলে যায়। রায়হান অভিদের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে রুহির আব্বু রায়হানের কাছে গিয়ে বলে
” বাবা আমরা এখন বাসাই যাচ্ছি রুহির কোনো খোজ পেলে আমাদের জানিও”
রায়হান অবাক হয়ে বলে
” আংকেল আপনারা চলে যাবেন কেনো ?? আপনারা এখানেই থাকবেন। আর আন্টিরও শরীর খারাপ না যাওয়াই ভালো। কালকে সকালের মাঝে ফুপি, ফুপাও এসে পরবে। আজকে জাবেন না প্লিজ !! ”
রুহির বাবা নিষিদ্ধ সুরে বলে
” না বাবা তা হয় না। আমরা কালকে আসব এখন চলে যাচ্ছি। সবার মনের অবস্থাই খারাপ। আর তোমার আন্টি কে বাড়িতে শান্ত করাতে হবে। ”
রায়হান রুহির আব্বুকে যেতে দিতে চাইছে না। অনেক জোড়া জুড়ির পর রুহির আব্বু বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে রাজি হয়। রায়হান সবাইকে রুম দেখিয়ে দেয় রেস্ট করার জন্য পরে সার্ভেন্টকে হালকা পাতলা কিছু ডিশ করতে বলে। রায়হান ডক্টরের সাথে কথা বলে রুহির মাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
রায়হান আর তুষার সবাইকে জোড় করে খেতে বসায়। সবাই একটু একটু করে খাবার মুখে দিয়ে উঠে যায়।

রায়হান অভিদের রুমে ঢুকে দেখে অভিদ রুমের লাইট অফ করে ফ্লোরে বসে আছে। রায়হান হতাশার নিশ্বাস ফেলে রুমের লাইট অন করে। অভিদের চেহারায় কোনো পরিবর্ত দেখা গেলো না। অভিদ রুহির একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান সার্ভেন্টকে ইশারা করতেই সে খাবার রেখে রুম ত্যাগ করে। রায়হান দরজা লাগিয়ে দিয়ে অভিদের পাশে বসে পরে। অভিদের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বলে
” তুই এতো ভেঙে পরছিস কেনো ?? রুহিকে আমরা ঠিক খুজে বের করবো। এভাবে ভেঙে পরা তোকে মানায় না। তুই একজন মাফিয়া কিং সেখানে একদিনেই এতো ভেঙে পরেছিস যে পরে রুহিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যেই ধৈর্য, মনের শক্তি প্রয়োজন সেটাও হারিয়ে ফেলবি। এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না তোকে অনেক শক্ত হতে হবে। ”

অভিদ ঘাড় ঘুরিয়ে রায়হানের দিকে তাকায়। অভিদের চোখে চোখে আস্তে আস্তে পানি জমতে থাকে। অভিদ ভাঙা গলায় বলে
” কিন্তু আমার রুহির সাথে কেউ যদি খারাপ কিছু করে থাকে ?? ”
রায়হান ধীর কন্ঠে বলে
” খারাপ কিছু ভাবলে সেটা হতে দুই মিনিটও লাগবে না। এসব ভাবনাকে মনের মাঝে জায়গা দিসনা। রুহিকে ফিরে পাওয়ায় জন্য মনকে শক্ত করতে হবে। নিজেকে ঠিক রাখতে হবে। এখন খাবারটা খেয়ে নে”
অভিদ মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে
” খিদে নেই আমার। তুই খেয়ে নে ”

রায়হান অভিযোগ সুরে বলে
” এইজন্যই মানুষ বলে কারো ভালো করতে নেই। ভালো করলে নিজেই পরে গুতো খেতে হয়। এতোক্ষণ তো একেবারে ভাঙা রেকর্ডের মতো আস্তে আস্তে কথা বলছিলি আর এখন আমি একটু মনে সাহস জুগিয়ে দিলাম আর তুই আমার সাথেই এভাবে কথা বলছিস !!! ” অভিদ রায়হানের ঠাট্টা বুঝতে পেরেও কিছু বললো না। রায়হান এবার সিরিয়াস হয়ে বলে
” প্লিজ ইয়ার খাবারটা খেয়ে নে। আমরা এয়ারপোর্টে যাবো। শুনেছিসই তো পুলিশ বলেছে এয়ারপোর্টের আগের রাস্তায় রুহিকে দেখা গিয়েছে। আমরা সেখানে গিয়ে কোনো না কোনো ক্লু তো পেয়েই যাবো। খাবারটা শেষ কর।” অভিদ রাগ নিয়ে তাড়াতাড়ি একটু খাবার খেয়ে নিলো। পরে আবার গম্ভীর ভাবে বলে
” তাড়াতাড়ি খেয়ে নে বের হবো ” রায়হান হুম বলে নিজেও কিছুটা খাবার খেয়ে অভিদের সাথে বেড়িয়ে পরে।

এয়ারপোর্টের সিসি টিভি, ফ্লাইট নেম লিস্ট সব দেখে নেয় কিন্তু কোথাও কিছু পেলো না। আর এটাও জানতে পেরেছে যে এখনও কোনো পুলিশ আসেনি এসব চেক করতে। অভিদ রেগে মেগে ফায়ার হয়ে গিয়েছে। অভিদ দাতে দাত চেপে বলে
” ওই পুলিশের তো আজকে চাকড়িটা খেয়েই ছাড়বো আমি নাহলে প্রাণটাই নিয়ে নেবো।” বলে হনহন করে গাড়িতে উঠতে নিলেই রায়হান অভিদকে আটকে দেয়। রায়হান বিরক্ত হয়ে বলে
” তুই ওই পুলিশের পেছনে কেনো পরেছিস। ওকে গার্ডরাও দেখে নিতে পারবে তোর যাওয়ার কি দরকার ?? তুই রুহিকে খোঁজার উপর কনসেন্ট্রেট কর। আর কিভাবে খুজে পেতে পারিস সেটা তো ভাবতে হবে নাকি ??” অভিদ রেগে গাড়ির দরজা জোড়ে লাগিয়ে দেয়।

অভিদ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে কয়েকটা গাড়ি আসছে। গাড়ি অভিদের সামনে থামতেই বুঝতে পারে আখিল এসেছে। আখিল গাড়ি থেকে নামতেই অভিদ গান বের করে আখিলের সামনে দাঁড়িয়ে আখিলের কপাল বরাবর ধরে। চোয়াল শক্ত করে বলে
” রুহিকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে শান্তি হয়নি তোর ?? আবার কেনো এসেছিস?? আমাকে মারতে ?? কিন্তু তার আগে আমি তোকে মেরে উপরে পাঠাবো আর আমার রুহিকে খুঁজে বের করবো। ”

আখিল হাত দুটো সামনে এনে অভিদকে থামিয়ে বলে
” প্লিজ রিলেক্স আমি একটা ডিটেইলস দিতে এসেছি এতে রুহিকে খুঁজে বের করতে সহজ হতে পারে।” অভিদ ভ্রু কুচকে গান নামিয়ে বলে
” কিসের ডিটেইলস দিবি তুই ?? ”
আখিল এগিয়ে এসে অপরাধীভাবে বলে
” প্রথমে বলবো আমাকে মাফ করে দিস!। আমার একটা ভুলের কারণে আজকে তোদের এই অবস্থা। রুহিকে আমার কারণেই হারিয়েছিস। তারজন্য ক্ষমা চাইছি। আর আমি বলতে এসেছি যে সেই ছেলেটাকে আমি কিছুটা দেখেছিলাম তাই যদি কোনো ছবি বা কিছু দেখি তাহলে হয়তো চিনতে পারি। আমিও এখানেই আসছিলাম তবে পরে জানতে পেরেছি তুই এসেছিস তাই তোর কাছেই এসলাম ”

আখিলের কথা শুনে অভিদ, রায়হান দুজনের চেহারায় আশার আলো দেখা গেলো। অভিদ আখিলের কাধে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে ফেলে। উৎসাহ কন্ঠে বলে
” তুই চিনতে পারবি তো ?? ” আখিল অনেকটা কনফিডেন্স নিয়ে বলে
” হ্যা ছবি দেখলে চিনতে পারবো।” অভিদ, রায়হান, আখিল, আশিক আর কয়েকজন গার্ড আবার ভেতরে গেলো। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রত্যেকটা ফ্লাইটের, প্রত্যেকটা পেসেঞ্জারের ছবি দেখাতে বলা হয়। একে একে সব ছবি দেখতে থাকে আখিল। সব দেখে মিলাতে না পেরে বলে
” অভিদ এখানের একটাও ছেলেনা। ”
অভিদ রেগে দেয়ালে পাঞ্চ মারে। আখিল মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে পরে।

দেখতে দেখতে দেড় মাস পার হয়ে গেলো। সেদিনের পর পুরো বাংলাদেশ খুঁজেও রুহিকে খুঁজে পায়নি অভিদ। আখিলও কম খুঁজেনি। নিজের একটা ভুলের জন্য কতো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে সেটা আখিল নিজের চোখে দেখেছে। নিজের অপরাধের কারণে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। রুহির বাবা যখন বুঝতে পারে আখিল নিজের কাজের ফল বুঝতে পেরে অপরাধবোধ করছে তখন তিনি ক্ষমা করে দিলেও অভিদরা কেউ ক্ষমা করেনি। তবুও আখিল অভিদের সাথে রুহিকে খুঁজতে থাকে। রুহির মা অনেক অসুস্থ তার অভিদের কথা মাথায় নেই সে শুধু তার মেয়েকে চায়। রাইমা, মিশু, নিলা, অনি সবাই মন মরা হয়ে থাকে। প্রতিটা মুহূর্তে রুহিকে মনে করে। রায়হান, তুষার অভিদের অফিস সামলাচ্ছে। রুহির বাবা অভিদকে বিশ্বাস করে অভিদের উপর রুহিকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছে। অভিদও দেড় মাসে নিজেকে ঘর বন্ধি করে নিয়েছে। অভিদের রাগও আগের থেকে দ্বিগুণ বেরেছে। দরকার ছাড়া কারো সাথেই কথা বলে না। দেড় মাসে ৭ দিন অফিসে গিয়েছিলো। অভিদের ফুপি, ফুপা এসেছিলো তবে ফুপা অনেকদিন থেকে চলে গিয়েছে আর ফুপি এখন সে এখানেই রয়েছে। অনি ভাইয়ের অবস্থা দেখে কাদে। অভিদ লন্ডন, নিউজিল্যান্ড, মুম্বাই, দুবাই সব জায়গায় পুলিশ কোর্স, গার্ড সব লাগিয়ে রেখেছে।

দের মাসে বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড, দুবাই সহ অনেক গুলো ড্রাগস পাচারের কারখানা পুরিয়েছে। তবে এখনও আসল মালিককে খুঁজে পায়নি। আখিলও সেই ছেলেটার কোনো ছবি পায়নি। এদিকে রায়হান অফিসের কাজ সাথে আরও কিছু কালো ব্যবসার কারখানা নষ্ট করার জন্য অভিদকে নিউজিল্যান্ড যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। অভিদ যেতে চাইছে না।

চলবে…wait for next part….