মাফিয়া ক্রাশ বর পর্ব-৫১

0
1882

#মাফিয়া_ক্রাশ_বর
#লেখিকা :মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্ব : ৫১

রুহি আবার কান্না করতে নিলেই অভিদ ছোট ছোট চোখ করে রুহির দিকে তাকায়। রুহি নাক টেনে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে থাকে। রুহি ফ্রেশ হয়ে এসে রেস্ট করতে থাকে। অভিদ
রুহির পাশে বসে বলে
” পাখি তুমি শুয়ে থাকো আমি খাবার নিয়ে আসছি ঠিকাছে ??” রুহি মাথা নেড়ে হ্যা বলে।
অভিদ নিচে চলে যায় রুহির জন্য খাবার আনতে। মিশু আর অনি টেবিলে বসে খাচ্ছিলো। অভিদকে আসতে দেখে দুজন উঠে দাঁড়ায়। অভিদ সার্ভেন্টের সাথে কথা বলে ল্যাপটপ নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে। মিশু আর অনি গিয়ে অভিদের পাশে দাঁড়ায়। অভিদ ওদের খেয়াল করেনি সে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। মিশু, অনি দুজিন কিছুক্ষণ গুঁতোগুতি করে কে আগে কথা বলবে সেটা নিয়ে। উপায় না পেয়ে অনিই আগে কথা শুরু করে। অনি অভিদের কাছে গিয়ে বলে
” ভাইয়া আমরা দুজনেই সরি !! আমাদের জন্যই আজকে ভাবি বিপদে পরেছিলো।” অভিদ অনির কথা শুনে ঘার ঘুড়িয়ে দুজনের দিকে তাকায়।
মিহি গলায়
” হুম ” বলে আবার ল্যাপটপের দিকে তাকায়। মিশু এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে বলে
” ভাইয়া আপনি আমাদের ক্ষমা করেদিন। we really really very sorry. Please vaiya forgive us.” অভিদ পুনরায় দুজনের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বলে
” ক্ষমা করে দিয়েছি তবে এরপরে আর এমন কিছু হলে আর ক্ষমা করতে পারবো না। আর রুহিকে বলবে না যে ওকে সিহাব কিডন্যাপ করেছিলো। ” অনি অবাক হয়ে বলে
” কেনো ভাইয়া ??” অভিদ গম্ভীর গলায় বলে
” রুহির কাছে এই কথা অজানাই থাক। সেটা শুধু আমরা জানি আর কাউকে জানাবে না। রুহি কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে ওকে আমি ওই লোকটার থেকে নিয়ে এসেছি। আর কিছুই হয়নি। ওকে !!” মিশু আর অনি মাথা নেড়ে আবার খেতে বসে পরে। সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে আসলে অভিদ খাবার নিয়ে উপরে চলে আসলো।

রুহিকে ঘুমাতে দেখে খাবার রেখে রুহির পাশে বসে ধীর গলায় বলে
” রুহি ঘুমিয়ে গিয়েছো ??” অভিদের গলা পেয়ে রুহি ধপ করে চোখ খুলে ফেললো। মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো ঘুমে। অভিদের গলা শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। রুহির চোখ গুলো লাল লাল দেখে অভিদ বুঝতে পারলো রুহি ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। অভিদ রুহিকে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে বলে
” আগে খেয়ে নাও তারপর ঘুমাবে।” অভিদ রুহিকে খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়ার মাঝে রুহি বলে
” আপনি খেয়েছেন ??” অভিদ কিঞ্চিত হাসলো। রুহি বুঝতে পারলো অভিদ এখনও খায়নি। অভিদ আবার খাবার দিলেই রুহি হাত দিয়ে সরিয়ে বলে
” আপনার খাবারও নিয়ে আসুন।” অভিদ আবার খাবার সামনে নিয়ে বলে
” তুমি খাওয়া শেষ করো আমি নিচে গিয়ে খাবো।” রুহি জেদি স্বরে বলে
” নাহ আপনি এখনি খাবেন। খাবার নিয়ে আসুন”
অভিদ ফুস করে নিশ্বাস ফেলে একজন সার্ভেন্টকে ডাকতে থাকে। মুহূর্তেই একজন সার্ভেন্ট দৌড়ে আসে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলে
” জী স্যার !!” অভিদ উঠে বলে
” আমার খাবারটা রুমে দিয়ে যাও।” মেয়েটা মাথা নেড়ে চলে গেলো। অভিদ এখন না খেয়েই সিহাবের কাছে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো। ভেবেছিলো পরে এসে খেয়ে নেবে তবে রুহির জন্য আর হলো না। সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে যায়। রুহি অভিদ দুজন খাবার খেয়ে নেয়। অভিদ হাত ধুয়ে এসে রুহির মেডিসিন খাইয়ে শুয়ে দিয়ে বলে
” তুমি ঘুমাও। আমার কাজ আছে আমি বাইরে যাবো।” রুহি অভিদের হাত ধরে বলে
” জরুরি কাজ না হলে একটু পরে জান !!” অভিদ চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে হ্যা বলে। রুহির পাশে এসে বসে রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। রুহি চোখ বন্ধ করে নেয়। আস্তে আস্তে রুহি ঘুমে তলিয়ে গেলো। ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। রুহি পুরোপুরিভাবে ঘুমিয়ে পরার পর অভিদ রুহির পাশ থেকে নেমে বাইরে চলে গেলো। নিচে এসে কাউকে দেখতে পেলো না। অভিদ সোফায় বসে মোবাইক বের করে রায়হানের নাম ধরে ডাক তুললো। মিনিট কয়েকের মাঝে রায়হান এসে উপস্থিত হলো। রায়হান অভিদকে বসে থাকতে দেখে বলে
” কিরে বসে আছিস কেনো ??” অভিদ মোবাইলে মনোনিবেশ করে বলে
” অনি আর মিশু কোথায় ??” রায়হান মুখ ভেঙিয়ে বলে
” আর কোথায় থাকবে ?? দুজন আঠার মতো লেগে বসে আছে। সারাদিন তো তিনজন এক সাথে আঠার মতো বসে থাকে। রুহি আজকে নেই দেখে।” অভিদ হেসে দিলো রায়হানের কথায়। কথা উড়িয়ে বলে
” ওদের ডাক তো।” রায়হান দৌড়ে রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরে দুজনকে টেনে ধরে আনলো। রায়হানের কাজ দেখে অভিদ শব্দ করে হেসে উঠলো। উঠে মোবাইল পকেটে রেখে ওদের কাছে গিয়ে বলে
” রুহি ঘুমিয়ে আছে। উঠলে ওর কাছে গিয়ে গল্প করো বা ওকে নিচে নিয়ে এসো। একটু পরে তুষারও এসে পরবে। আমরা একট্য বেরচ্ছি।” দুজন এক সাথে মাথা নেড়ে রুহির রুমে দৌড় লাগালো। অভিদ রায়হানকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

অভিদ, রায়হান যাবেদ খান আর সিহাবকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে এসেছে। দুজনকে যেই রুমে রাখা হয়েছে সেখানে গেলো। যাবেদ খানের অবস্থা আর দেখার মতো নেই। প্রায় মরে গিয়েছে। সিহাবের জ্ঞান ফিরেছে। সিহাব দুই হাটুতে হাত রেখে তার বাবার দিকে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের পাপের কারণে নিজের বাবাকে আজকে এইভাবে দেখতে হবে ভাবেনি। ছোট থেকেই মায়ের ভালোবাসার অভাব ছিলো যার কারণে বাবার কাছে যা চেয়েছে বাবা তাই দিয়েছে। তবে কিভাবে অন্ধকার পথে নেমে গেলো দুজন টাকার কারণে সে সব বুঝতেই পারলো না। নিজেদের কর্মের কারণে আজ এই দশা। ভবিষ্যতে কি হবে সেটাও ধরে নিলো। বাবার মতো এভাবেই তিলে তিলে মরবে হয়তো।
অভিদ নিশ্চুপ নয়নে দুজনকে দেখে থাকলো। রায়হান গম্ভীর গলায় সিহাবকে ডেকে উঠে। সিহাব সেই ভাবেই রায়হান আর অভিদের দিকে তাকালো। থমথমে ভাঙা গলায় বলে
” আমার বাবাকে ছেড়ে দে প্লিজ।”
অভিদ কোনো কথা না বলে হকিস্টিক নিয়ে সিহাবকে মারা শুরু করলো। সিহাব ব্যাথায় চিৎকার করা ছাড়া আর কিছু বললো না। এটাও বললো না যে অভিদ আমাকে ছেড়ে দে ‘ চোখের পানি ফেললো আর মার খেলো। দীর্ঘ এক ঘন্টা থেমে থেমে মারার পর একে বারে থেমে গেলো। হকিস্টিক টা পাশে ছুড়ে ফেলে দিলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফ্লোরে সিহাবের সামনে বসে পরলো। রায়হানও হাটু গেরে বসে অভিদের কাধে হাত রাখলো। অভিদ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলা শুরু করে
” আমিও না আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতাম তবে ওই মহিলার কারণে আমি আমার বাবাকেও কাছে পেলাম না আর না তার ভালোবাসা পেলাম। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি সব খারাপ কাজকে ঘৃণা করি। শপথ করেছিলাম কোনোদিন খারাপ কাজকে প্রশ্রয় দেবো না। তাই মাফিয়া রাস্তায় নেমে পরলাম। কাউকে ঠকাতে দেবো না, যারা খারাপ কাজ করে তাদের শাস্তি দেবো। এতোবছর ধরে এসব করেও আজকে এখানে এসে থেমে গেলাম। আজকে তোর বাবাকে আর মারতে পারছি না তাই তো লোক দিয়ে ওনাকে শাস্তি দিচ্ছি। আজকে থেকে উনার মুক্তি।আর তোর শাস্তি শুরু। তুইও একদিন ছাড়া পাবি তবে এতো সহজে না। তোরা এতো অন্যায় কেনো করেছিলি ?? তাও আমার রুহির সাথে যার কারণে তোদের আমি কোনো দিন ছেড়ে দিতে পারবো না। তবে তোদের মারতেও পারবো না। তোর বাবার কারণে আজকে এই প্রথম কেউ এতো অন্যায় করার পরও তাকে মারতে পারছি না। তোর বাবাকেই কি অন্যায় করতে হলো !! তুই একা করতে পারলি না?? তোরা এতো অপরাধ করার পরও আজকে তোদের মারতে পারছি না এটা আমার ব্যর্থতা আর আফসোস। বাবা শব্দটায় কি আছে বুঝতে পারছি না তবে এই শব্দটাই আজকে আমাকে আটকে দিয়েছে। হয়তো আমিও একদিন বুঝতে পারবো বাবা শব্দের অর্থ।”
অভিদের কথা শুনে রায়হান, সিহাব দুজনের চোখ দিয়ে পানি পরছে। অভিদ উঠে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো। রায়হান দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে চারজন হসপিটালের স্টাফের পোশাক পরা লোক এসে সিহাবের বাবাকে নিয়ে গেলো। দৃশ্যটা দেখে সিহাবের মনে প্রশান্তিতে ভরে গেলো। অভিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। এতো অন্যায়ের পরও তার বাবাকে ছাড়া দিয়েছে এটাই যেন ওর সবচেয়ে বড় পাওনা। শরীরের ব্যাথা গুলোকে পাত্তা না দিয়ে ফ্লোরে বিছানো তোশকে গা এলিয়ে দিলো ঘুমানোর জন্য। আজকে শান্তিতে ঘুমাবে। এতোদিন বাবার চিন্তায় আর অভিদকে কি করে বরবাদ করবে সেই চিন্তায় ভালো করে ঘুমাতে পারেনি। আজকে সিহাবের সব খারাপ কাজের সমাপ্তি ঘটলো আর সব কাজের শাস্তি শুরু হলো।
বাবার চিন্তা থেকেও মুক্তি হলো। অভিদ যে আর তার বাবার সাথে কিছু করবে না সেটা ভালো করেই বুঝতে পারলো।

অভিদের চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। রায়হান পাশে বসে অভিদকে পর্যবেক্ষণ করছে। অভিদ যে আজকে কাঁদবে সেটাতে নিশ্চিত হয়ে গেলো। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই দুজন বেড়িয়ে গেলো। অভিদ আগে পিছে না তাকিয়ে দুর্বল পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ড্রইংরুমে রুহিরা চারজন বসে ছিলো। অভিদকে এভাবে দেখে চারজন অবাক হয়ে গেলো। রায়হান রুহির কাছে এসে শীতল গলায় বলে
” রুহি অভিদের কাছে যাও।” রুহি কি হয়েছে কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলো। পা বাড়িয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। রুমে এসে দেখে রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে। বারান্দার থাই গ্লাস আধখোলা দেখে রুহি সেদিকে পা বাড়ায়। অভিদ কে দেখে অবাক হয়ে গেলো। বারান্দার ডিভানে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে বাইরের কাপড়টাও নেই একটা কালো গেঞ্জি আর টাওজার পরা। এতো তাড়াতাড়ি পাল্টে ফেলেছে !! রুহি শব্দ হীন ভাবে অভিদের পাশে বসে পরলো। মিহু স্বরে অভিদের কাধে হাত রেখে বলে
” কি হয়েছে আপনার ?? মন খারাপ কেনো ??” অভিদ ঘার ঘুরিয়ে রুহির দিকে তাকালো না। তার চোখের পানিটা রুহিকে দেখাতে চাইলো না। সেদিকে তাকিয়েই রুহির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো। ভাঙা গলায় বলে
” বাবার কথা খুব মনে পরছে।” অভিদের ভাঙা গলা শুনে রুহির বুঝতে বাকি রইলো না অভিদ কাঁদছে। রুহি অভিদকে জোড় করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। অভিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুহি অভিদের চোখের পানি মুছে দেয়। আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই হঠাৎ অভিদ বলে উঠে
” আচ্ছা !! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহারদের মধ্যে একটা তো হলো মা – বাবা। সেই শ্রেষ্ঠ উপহারটা আমার কাছে কেনো থাকলো না ?? বাবাকে তো খুব ভালোবাসতাম সে চলে গেলো আর সেই দুশ্চরিত্রা মহিলা সব শেষ করে দিলো। বাবার ভালোবাসা, মায়ের ভালোবাসা সব কেড়ে নিলো আমার আর অনির থেকে।” রুহির চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো অভিদের গালে। অভিদ গালের পানি গুকো মুছে উঠে রুহির দিকে তাকালো। রুহিকে বুকে জড়িয়ে বলে
” শোনো আমরা না খুব ভালো মা-বাবা হবো ঠিকাছে ?? ওদের কোনো কষ্ট দেবো না।” রুহি অভিদের আবেগময় কথা শুনে কান্না থামাতে পারলো না। অভিদকে জড়িয়ে ঢুকড়ে কান্না করে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে
” খুব ভালো মা – বাব হবো।” অভিদ রুহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপে চোখের পানি ফেলতে থাকে।

তিন বসন্ত কেটে গেলো। সবার জীবনের ক্যালেন্ডার থেকে তিন তিনটে বছর কেটে গিয়েছে। অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে আবার কিছুই বদলায়নি। অভিদ, রুহির সেই ভালোবাসা বিদলায়নি। সবার ভালোবাসা গুলো আগের মতো রয়েছে। বলতে গেলে আরো মজবুত হয়েছে। আজকে বাড়ির দুই ছেলে, মেয়ে অনি আর তুষারের গায়ের হলুদের তোড়জোড় চলছে। কেউ কোনো কমতি রাখছে না। কেউ এদিক ছুটছে তো কেউ ওদিক ছুটছে। সবাই ব্যাস্ত।

চলবে…wait for next part….