মায়ার বাঁধন পর্ব-০৪

0
386

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৪.
বাপ-চাচাকে কাছে পেয়ে আনন্দের আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে নীরা। গতকাল বাড়ি ছাড়ার পর থেকে মনটা অস্থির হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো অচেনা রাজ্যে হারিয়ে গেছে সে। অবশেষে বাবা এবং ছোট চাচাকে কাছে পেয়ে বক্ষ শীতল হয় তার। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে ভাসায়। তুরান এগিয়ে দিয়ে শ্বশুর আর চাচা শ্বশুরের সঙ্গে আলাপ করে। তুরানের বিয়েতে অমতের বিষয়টা তারা কেউই জানেন না। একমাত্র নীরা জানে। নীরাকে জাহানারা চৌধুরী বিয়ের আগেই সবটা জানিয়েছিলেন সেই সঙ্গে অনুরোধ করেছিলেন তার ছেলেটির দ্বায়িত্ব নিতে। মাতৃসমা জাহানারার অনুরোধকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। নীরা অগত্যা রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। কিন্তু তার পরিবারকে এ বিষয়ে অবগত করতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। জাহানারা তাতেই রাজি হয়। তুরান যখন গতকাল বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই সেখান থেকে গায়েব হয়ে যায় জাহানারা তখন সকলকে ভুলভাল বুঝ দিয়ে সামলায়। বলে ছেলের জরুরি কাজ পড়ে গেছে শহরে যাওয়ার আগে তার অনুমতি নিয়ে গেছে। অগত্যা সকলেই বিশ্বাস করে নেয় তার কথাকে।

সদ্য বিয়ে হওয়া বাড়িতে মেহমানে ভরপুর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রিসিপশনে মেয়ে বাড়ির সকলের নিমন্ত্রণ থাকলেও মহিলা সদস্যরা আসতে পারলেন না। গ্রামের বাড়িতে মেহমান বোঝাই সবাইকে ফেলে কী করে আসবে? আবার সকলকে নিয়ে আসাও সম্ভব হলো না। কেউ বলে যাব তো কেউ বলে যাব না। অতঃপর সিদ্ধান্তঃ নেওয়া হয় বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে পুরুষ সদস্যরা আসবেন। মহিলারা থেকে যাবেন মেহমান আপ্যায়নে। সেই মোতাবেক বাড়ির পুরুষ সদস্য বলতে নীরার বাবা হাশিম শিকদার, চাচা রশিদ শিকদার এবং চাচাত ভাই নয়ন ও সুমন এসেছে। বাকিরা সকলে গ্রামে। সুমন ও নয়ন দু বছরের ছোট বড়। সুমন এবারে ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্র আর নয়ন ক্লাস নিউ টেন। দুই ভাই-ই নীরার কলিজা। তেমনই ওদের কাছেও নীরা প্রাণভোমরার ন্যায়৷ প্রিয় বোনের থেকে বিচ্যুত হয়ে এই একটা দিন অনেক কষ্টে কেটেছে ওদের। তাই তো সকাল সকাল বাবা-চাচাকে তারা দিয়ে নিয়ে এসেছে।

নীরা সুমন-নয়নকে বুকে চেপে কেঁদেই চলেছে। তুরান হাশিম শিকদার ও রশিদ শিকদারের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে আবার আড়চোখে নীরাকে পর্যবেক্ষণ করছে আর মনে মনে ফুঁসছে। মেয়েটা এমন ভাবে কাঁদছে মনে হচ্ছে এখানে সবাই মিলে ওর ওপর হা’ম’লা চালিয়েছে। বাড়ির লোকের থেকে সিমপ্যাথি পেতে চাইছে। মূহুর্তেই তুরানের চোয়াল শক্ত হয়। হাশিম শিকদার ও রশিদ শিকদারকে তার বাবার কব্জায় ঝুলিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে স্টেজ থেকে নেমে যায়। নীরা সেদিক পানে একপল দেখে পুনরায় ভাইদের নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ে। আপাততঃ ভাইদের সময় দেয়া তার দ্বায়িত্ব।

———🍂
খাবার খেয়ে হাত ধুতে যাওয়ার সময় অকস্মাৎ কারোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায় টিয়ার। বিরক্ত হয়ে ওপরে তাকায়। একটা ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে সে। ভাবতেই বিরক্তি রাগে পূর্ণতা পায়। তেড়ে গিয়ে বলে,

-“এই চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি মেয়ে দেখলেই ধাক্কা খেতে মন চায়?”

নয়ন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ধাক্কা দিয়ে আবার নিজেই কোমর বেঁধে ঝগড়া করছে। অদ্ভুত। নয়ন নম্র কন্ঠেই বলে,

-“ধাক্কা টা তো আপনি দিলেন মিস. এখানে আমার কী দোষ?”

টিয়ার ক্রোধ আকাশচুম্বী। সে পারে তো ছেলেটাকে চিবি’য়ে খা’য়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,

-“একদম মিথ্যে বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ধাক্কা মে’রেছেন।”

নয়নের রাগ হয় এবার। কুটুম বাড়িতে ঝামেলা করা তার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু এই মেয়ে তো নাছোড়বান্দা। না পেরে তেঁতে ওঠে নয়ন। সমান তালে তেড়ে গিয়ে বলে,

-“আর একবার উল্টো পাল্টা কথা বললে ভুলে যাব আপনি আমার কুটুম।”

-“কী করবেন হ্যাঁ কী করবেন আপনি?”

নয়ন এগোতে গেলেই পেছন থেকে সুমন তাকে বাঁধা দেয়। জিজ্ঞেস করে,

-“কী হচ্ছে এখানে?”

নয়ন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,

-“দেখ না ভাইয়া মেয়েটা ধাক্কা দিয়ে এখন আমাকেই দোষারোপ করছে।”

টিয়া বিরোধিতা করে। বলে,

-“মোটেই না। আমি ধাক্কা দেইনি উনিই ধাক্কা দিয়েছেন আমায়।”

ততক্ষণে হিয়াও সেখানে উপস্থিত হয়। টিয়াকে রাগান্বিত দেখে প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে।”

টিয়া সব বললে হিয়া একপল সুমন, নয়নের দিকে তাকায়। অগত্যা টিয়াকে পাশে টেনে নিয়ে যায়। ধমকের সুরে বলে,

-“কী করছিস এটা? কুটুম হন ওনারা আমাদের। ভদ্রতা রেখে কথা বল।”

-“কিন্তু…।

-“আর একটা কথাও নয়। এখনি চল গিয়ে সরি বলবি নয়তো আম্মুকে বলে দেব কিন্তু।”

টিয়া উপায়ন্তর না পেয়ে হিয়ার সঙ্গে যায়। হিয়া ওদেরকে নম্র কন্ঠে বলে,

-“আসলে আমরা ভীষণ ভাবে দুঃখিত। এখানে কারোরই দোষ নেই। ইট’স এ্যান এ’ক্সি’ডে’ন্ট। সো আমাদের উচিত এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা।”

টিয়া কিছু বলছে না দেখে হিয়া টিয়াকে টেনে সামনে এনে দাড় করাল। আদেশ করে বলল,”কী হলো সরি বল।”

টিয়া জোরজবরদস্তি সরি বলল। হিয়া স্বস্তি পেল। এদিকে সুমন নয়নকে বলল,

-“তোরও সরি বলা উচিত। সরি বল।”

নয়ন ভনিতা ছাড়াই সরি বলল। সকলে প্রসন্ন হলেও অপ্রসন্ন থেকে গেল টিয়া। মনে মনে শপথ নিল সুযোগ পেলে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে নয়নকে।

———🍂
সন্ধ্যার পরপরই নীরার বাড়ির লোকজন রওনা হয়ে গেছে গ্রামে। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে রাত নয়টা নাগাদ। দশ মিনিট হলো নীরা ছাড়া পেয়েছে এসব থেকে। বসে থাকতে থাকতে মাজা-পিঠ এক হয়ে গেছে তার। ব্যথায় টনটন করছে। ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে নিল সে। পরিধান করল কালো রঙের জামদানী শাড়ি।

ওয়াশরুম থেকে বেড়তেই মুখোমুখি হতে হলো তুরানের। সে বিরক্তি দৃষ্টিতে নীরার পানে চেয়ে। হাতে টাওয়াল সহ প্রয়োজনীয় পোশাক। নীরা বুঝল তার জন্য সাহেবের শাওয়ার নিতে দেড়ি হওয়ায় রেগে আছে। সে কিছু বলল না চুপচাপ তুরানের পাশ ঘেঁষে সরে গেল। তখনই পেছন থেকে তুরানের কটমট কন্ঠে ভেসে এলো,

-“তখন বাড়ির লোকদের সামনে এমন কাঁদছিলে যেন তোমাকে আমরা একরাতে মে’রে ধরে প্যাকেট করে রেখে দিয়েছিলাম ফ্রিজে। সিমপ্যাথি চাই তোমার তাই না?”

নীরা পেছন ঘুরে। বিষয়ান্বিত তার চাহনি। তুরান তার সম্পর্কে এটা ভাবছে? অথচ সে কী জানে একটা মেয়ের নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য পরিবারে মানিয়ে নিতে ঠিক কতটা কষ্ট হয়? আপনজনদের ছেড়ে থাকতে ঠিক কতটা কষ্ট হয়? জানবে কী করে তাকে তো আর কিছু হারাতে হয়নি যা হারানোর হারিয়েছে নীরা। তাই তো তুরান এত সহজে তার অনূভুতি গুলোকে সিমপ্যাথির কাতারে ফেলছে। নীরা এগিয়ে আসে। মুখোমুখি হয় তুরানের। শীতল তবু দৃঢ় কন্ঠে বলে,

-“ফার্স্ট অফ অল, আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করার আগে আমার পারমিশন নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আর আমি সিমপ্যাথি চাই বা না চাই আপনার সেদিকে না দেখলেও চলবে। পরিবার হারানোর মর্ম বোঝার সাধ্য আপনার কখনোই হবে না।”

নীরা গটগট পায়ে হেঁটে বেলকনিতে চলে যায়। উদ্দেশ্য ভেজা টাওয়াল শুকতে দেওয়া। তুরান সেদিক তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

-“পিচ্চি মেয়ে কী ভেবেছ তোমাকে সারাজীবন আপনি বলে সম্বোধন করব? কখনোই না। আর আসছে পারমিশনের কথা তবে বলব আমি আমার অধিকারের জোরেই বলছি এবং ভবিষ্যতেও বলব। খুব তো সকালে আমাকে অধিকার শেখালে। তা অধিকার বোধ কী তোমার একারই আছে আমার নেই?”

তুরান গায়ে টাওয়াল চেয়ে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। বেলকনি থেকে তুরানের বানী শুনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নীরা। এই ছেলেকে সোজা করতে তার একটু বেশিই কাঠখড় পোহাতে হবে।

চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি

(রিচেক করা হয়নি।)