মায়ার বাঁধন পর্ব-০৫

0
337

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৫.
আজকের মতো রাতের খাবারটা নীরার জন্য তার শ্বাশুড়ি মা নিজ হাতে ঘরে পৌঁছে দেয়। কাল থেকে নিয়মিত সকলের সঙ্গে ডাইনিংয়ে বসে খেতে হবে। আজ যেহেতু সে ক্লান্ত তাই ঘরে বসেই খেয়ে নিক। এমনিতেই নতুন বউ সকলের সামনে খেতে লজ্জাবোধ করতে পারে। শ্বাশুড়ির যত্নে নীরার মনে আনন্দ খেলা করে। মা মা ব্যাপার আছে একটা।

তুরান নিচে গিয়ে সকলের সঙ্গে খায়। খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে দেখে নীরা আগে ভাগে বিছানার এক সাইড দখল করে শুয়ে আছে। উল্টো মুখী হওয়ায় তুরানের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে নীরা জেগে না ঘুমিয়ে। কিছুক্ষণ ভেবে সে মৃদু চিৎকারে বলে ওঠে,

-“এই মেয়ে তুমি আমার বিছানায় কী করছ?”

নীরা সবেই একটু ঝিমটি দিয়েছিল। তুরানের চিৎকারে তার কাঁচা ঘুমটা ছুটে যায়। রেগে গিয়ে ধপ করে উঠে বসে সে। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

-“আচ্ছা বজ্জাত লোক তো আপনি। সারাদিনে এত ধকল গেল এখন একটু রেস্ট নিব সে শান্তি টুকুও দিচ্ছেন না।”

-“রেস্ট নিবে তো নাও না। তবে আমার বিছানা ছেড়ে দাও।”

-“আপনি কী কানে কালা নাকি বোধে খাটো?কথা বুঝেন না? আর কতবার বলতে হবে এখন থেকে এ ঘরের প্রতিটি জিনিসের অর্ধেক ভাগ আমার। এমনকি আপনিও। আর একটা কথা বললে এখনই মায়ের কাছে বিচার দিব। চুপচাপ কথা না বলে ওপাশটায় এসে শুয়ে পরুন।”

নীরা আগের ন্যায় কম্বল টেনে উল্টোপিঠ ঘুরে শুয়ে পড়ে। তুরান স্তব্ধ বনে দাড়িয়ে থাকে ৷ নীরার কথা গুলো এমন বারুদের ন্যায় ছিল যে তার মগজে ঢুকাতে বেগ পেতে হচ্ছে। তুরান নিজের মস্তিষ্কে কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতেই সহসা চমকে ওঠে। চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে যায়। কী বলল মেয়েটা? এ ঘরের সবকিছুতে তার অর্ধেক ভাগ। এমনকি আমিও। আমাকেও নিয়ে নিচ্ছে? তারমানে স্ত্রীর অধিকার ঘাটাতে চাইছে? আবার মায়ের কাছে বিচার দেওয়ার হু’ম’কিও দিচ্ছে? আল্লাহ এ কোন দ’জ্জা’ল বউ কপালে জুটল আমার। কাঁদো কাঁদো হয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়ে তুরান। বিড়বিড় করতে করতে নীরার দিকে বারকয়েক তাকায়। অবশেষে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায়। তুরানের নিশ্বাস গাঢ় হতেই নীরা পেছন ফিরে। হাতে ভর দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকে তুরানের মুখপানে। অতঃপর মুচকি হেসে মিনমিন করে বলে,

-“ডিয়ার হাসবেন্ড, ইউ আর লুকিং সো হ্যান্ডসাম। আই লাইক ইট। উহুমম, সবই ঠিকঠাক তবে একটু ঘাড়ত্যাড়া। নো প্রবলেম, ব’ল’দের ত্যাড়া ঘাড় কী করে সোজা করতে হয় সে সম্পর্কে এই নীরা চৌধুরী ব্যাপক অবগত।”

——–🍂
ফজরের নামাজ পড়ে একটু বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি করে নিচে নেমে এলো নীরা। আজ আর বেখেয়ালি হলো না। সাতটা বাজার আগেই নেমে এলো। আজ আর এ বাড়িতে হিয়া,টিয়া নেই। তাদের বাড়ি এ বাড়ি থেকে বেশ কাছাকাছিই। পাঁচ মিনিটের রাস্তা। গতকাল রাতেই ওরা বাড়ি ফিরে গেছে। তবে যখন তখন মেয়ে দুটো এ বাড়িতে চলে আসে। চাচার বাড়ি কোনো বাধ্য বাচকতা তাদের জন্য নেই।

জাহানারা চৌধুরী রোজকার মতো রান্না করতে ব্যস্ত। এ বাড়ির ছেলেরা দশটার মধ্যে নাস্তা সেরে বেড়িয়ে যায়। তিনি রোজ সাড়ে ছয়টা নাগাদ রান্নার কাজে হাত লাগায়। নয়টার মধ্যে সবকিছু শেষ করেন। তার হাতে হাতে সাহায্য করার জন্য মেড সার্ভেন্ট হিসেবে হালিমা নামক একজন মধ্যবয়সী মহিলা নিয়োজিত আছেন। হালিমা রোজ ভোর ছয়টায় আসেন আর একেবারে রাত দশটায় বাড়িতে যান। রিনাকে সংসারের কোনো কাজেই খু্জে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ সময় বেলা বারোটা বাজে ঘুম থেকে ওঠে। জাহানারা চৌধুরী হাজার বকেও শুধরাতে পারেননি তাকে।

নীরাকে দেখে জাহানারা চৌধুরীর অধরে হাসি ফুটল। শাড়ির আঁচলে হাত মুছে এগিয়ে এলেন নীরার নিকট। নীরাও হাসল। বলল,

-“মা আপনার কী সাহায্য লাগবে আমাকে বলুন আমি করে দিচ্ছি।”

জাহানারা চৌধুরী নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-“এখনই এসব করতে হবে না। আরও কিছু দিন যাক তারপর না হয়….. ”

নীরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-“না না এখনই করব আমি। শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না আমার। তারচেয়ে বরং আপনার সঙ্গে কাজ করি আমারও ভালো লাগবে আপনারও সহযোগিতা হবে।”

নীরার বায়না সরূপ কথা শুনে জাহানারা চৌধুরীর প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তিনি উৎফুল্ল কন্ঠে বলেন,

-“আচ্ছা চল তবে।”

জাহানারা চৌধুরী যেতে গিয়েও থেমে যায়। জ্বিভে কামড় কেটে বলেন,

-“এই দেখো তোমাকে তুই করে বলে ফেললাম। কিছু মনে করো না কিন্তু।”

নীরা জাহানারা চৌধুরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। বিস্তর হাসি হেসে বলল,

-“এতে মনে করবার কী আছে? আমি তো তোমার মেয়ে তুমি আমাকে তুই করে বলতেই পারো। এই যেমন আমি তোমাকে তুমি করে বলছি।”

জাহানারা চৌধুরী নীরাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
কিয়ার বিয়ের পর থেকে তিনি প্রতিনিয়ত মেয়ে শূন্যতায় ভুগতেন। এবার বুঝি তার সেই শূন্যতা পূর্ণতা পেল। রিনাকে দিয়ে সে শখ তার কোনোদিনই পূরণ হবার ছিল না। একদিন মুখ ফস্কে তুই বলাতে রিনা যা কান্ড বাধিয়েছিল। তার নাকি ইগোতে লেগেছে।

অতঃপর দুই শ্বাশুড়ি-বউ মা হাতে হাতে রান্নার কাজ সেরে নিল। শ্বাশুড়ি বউয়ের এমন সুমধুর মিল বন্ধন দেখে আবেগ আপ্লুত হলেন হালিমা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে শুধু নীরাকেই দেখছিল। মেয়েটার মধ্যে নারী, নারী একটা ভাব স্পষ্ট। সবকিছু কেমন সহজে মানিয়ে চলছে।

——–🍂
সব কিছু গুছিয়ে গতকালের মতো আজও জাহানারা চৌধুরী নীরার হাতে গরম গরম কফির মগ ধরিয়ে দেয়। মূহুর্তের নীরার মুখ শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে যায়। জাহানারা চৌধুরীর চোখ এড়ায় না তা। সে নীরার কাঁধে হাত রাখে। ভরসার কন্ঠে বলেন,

-“ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নীরা মলিন হেসে মাথা নাড়ে। অতঃপর অগ্রসর হয় ঘরের দিকে। জাহানারা চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। মায়ের মন ছেলেমেয়েদের চোখ দেখলেই মন পড়তে পারে। নীরা, তুরানের মধ্যে যে কিছুই ঠিক হয়নি কেউ না বুঝলেও তিনি তা বুঝতে পারছেন।

আজ নীরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে রুম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পায়ের ব্যথাটা এখন নেই বললেই চলে। গতকাল জাহানারা চৌধুরী তাকে একটা পেইন কি’লা’র দিয়েছিল। নীরা খেয়ে নিয়েছে সেটা ৷ ব্যথা যেভাবেই পাক ঔষধটা তো ব্যথারই।

রুমে এসে পড়েছে আরেক বিপাকে। তুরান এখনো ঘুম থেকে জাগেনি। এখন উপায়? সে কী করে তুলবে তুরানকে? কী বলে ডাকবে? অনেক ভেবে তার চোখ যায় বিছানার পাশে থাকা টি-টেবিলে। যেখানে ঝকঝকে কাঁচের জার ও গ্লাস রাখা। নীরা সেখান থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে নিল। আর তারপর…….

চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি